Thursday, December 4, 2025

হোটেল


কোন শব্দ কেমন ভাবে মনের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকবে সে'টা বলা ভারি মুশকিল। একই শব্দ বানান বা উচ্চারণের তফাতে মনের আলমারির আলাদা আলাদা খোপে গিয়ে বিড়ালছানার মত বসে থাকে।

এই যেমন 'রেস্টুরেন্ট'। রেস্টুরেন্ট শুনলেই মনে হয় চমৎকার একটা সন্ধেয়, দিব্যি একটা সাত-পুরনো কাঠের চেয়ারে বসে; দেওয়ালে ঝোলানো মেনুবোর্ডের দিকে প্রেমে টইটম্বুর হয়ে দেখছি আর ঠাহর করার চেষ্টা করছি পেটের চুঁইচুঁই খিদেটা মোগলাইমুখী না কাটলেটমুখী। রেস্টুরেন্টের ওয়েটাররা বাহারে গল্পের ধার ধারেন না, সাত নম্বর টেবিলের চাউমিন আর চার নম্বরের ফিশফ্রাই; এ'সব নির্মম কেঠো ইকুয়েশন ব্যালেন্স করে চলাটাই তাদের ধর্ম। রেস্টুরেন্টের দেওয়ালে ক্যালেন্ডার, টেবিলের সানমাইকায় ঝোলের ছোপ, চারপাশে সুতৃপ্ত কলরব আর হঠাৎ কানে আসা সুতীব্র টেবিল চাপড়ানি।

রেস্তোরাঁ শুনলেই আবার চারপাশের আলো আপনা থেকেই নিস্তেজ হয়ে আসে। গায়ে মুখে এসির হাওয়া এসে লাগে। চীনামাটির প্লেটে স্বল্প পরিমাণের বাহারে খাবার, মিষ্টি সুরে ওয়েটার-বাবুদের সঙ্গে সুমিষ্ট বাক্যালাপ। রেস্তোরাঁর মেনুকার্ডের পাতা ওলটাতে হয় আঙুলের নরম ছোঁয়ায়, খাবারের অর্ধেক স্বাদ জোটে পাতের বাইরের 'অ্যাম্বিয়েন্স' থেকে। সে'খানকার নরম গদিওলা চেয়ারে বসেই জবাব দিতে হয় তেষ্টার জল 'রেগুলার' হবে না 'মিনারেল'। সে আবহে হইহইয়ের স্থান নেই, সে'খানে প্রয়োজন পালিশ দেওয়া ফিসফিসের। রেস্তোরাঁয় হুড়মুড় করে খেতে শুরু করলে সমস্তটাই মাটি, সে'খানে খেল জমাতে পারেন শুধু কন্যোসাররা।

আর একটা রোম্যান্টিক শব্দ আছে। "হোটেল"। অভিধান যাই বলুক, আশি-নব্বুই দশকের অঙ্ক মেনে বলি; 'হোটেল' কথাটা শুনলেই নাকে এসে ঠেকবে শালপাতা বা সস্তা স্টিলের থালার ওপর বেড়ে দেওয়া গরম ভাতের সুবাস। জোলো মুসুরির ডাল, নরম আলুভাজা, পাঁচমেশালি সবজির পাশাপাশি রুই মাছ বা দু'পিস মুর্গির মাংস-সহ একটা বাটি ঝোল। হোটেলের দুনিয়ায় আবার বাস-স্ট্যান্ড বা রেলস্টেশন সংলগ্ন হোটেলগুলোর কদর সবিশেষভাবে বেশি। বাঙালিরাও হোটেলে গিয়ে থালা নয়, থালির খোঁজ করে থাকেন; ভেজ, মুর্গির, মাছের, মাংসের, ইত্যাদি। সে'খানে খাবারদাবারের স্বাদে কেজো মানুষের ব্যস্ততা মিলেমিশে যে সিম্ফনি তৈরি হয় তা অতুলনীয়। রাত্রিবাসের হোটেল তো সম্পূর্ণ এক অন্য প্রাণী।

এই সমস্তকিছুই অবশ্য মেন্টাল কন্সট্রাক্ট। আমার মনের হোটেল আর আপনার মনের হোটেলে হয়ত বিস্তর ফারাক। আমার রেস্টুরেন্ট আর আপনার রেস্তোরাঁ হয়ত একই সুরে বাঁধা। মোদ্দা কথা হলো, দেলখোশা রেস্টুরেন্ট কেন রেস্টুরেন্ট, মোকাম্বো রেস্টুরেন্ট কেন রেস্তোরাঁ আর জয় মা তারা রেস্টুরেন্ট কেন হোটেল; সে জটিল অঙ্ক মনই জানেন।

No comments: