"তখনও আলোর ও সময়ের জন্ম হয়নি। সময়ের যেহেতু জন্ম হয়নি সেহেতু 'তখনও' কথাটা বলা ঠিক হলো কিনা জানি না। মুম্ফাসাইরসের মানুষরাও এ সম্বন্ধে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারবে না, যদিও এ রূপকথা তাদেরই। তখন ছিলো বলতে শুধু হেকেথা; আদিম নিষ্প্রাণ পৃথিবী। হেকেথার বুকের মধ্যিখানে রয়েছে সিতেগস নামের নিস্তরঙ্গ সমুদ্র। মুম্ফাসাইরসি ভাষায় সিতেগস মানে অশ্রু। বিষণ্ণতার ভার বইতে না পেরে সিতেগসের বুক চিরে অবশেষে জন্ম নেয় স্রিয় আর তিরা; আলো আর সময়। হেকেথার চিরবিষন্ন অবিচলতা ছিন্ন হলো, নেমে এলো অস্থিরতা বা স্নেম।
স্রিয় আর তিরার সন্তান ওয়েব্বেজা, আকাশ; মুম্ফাসাইরসিদের প্রথম ঈশ্বর। ওয়েব্বেজা সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আর সেই গোলমাল বাঁচিয় হইহল্লা এড়িয়ে সিতেগসকে বুকের আড়ালে রেখে দিলে হেকেথা। আদিম আদরের এই অনুভূতি-সমুদ্রকে তো আর ময়লা হতে দেওয়া যায় না। সিতেগসকে মনে রাখলে শুধু হেকেথা, স্রিয়, তিরা ও ওয়েব্বেজা।
প্রতি দশ হাজার বছরে একবার স্রিয় ও তিরা সিতেগসের সৈকতে এসে বসে। এ সাগর আজও নিস্তরঙ্গ, বিষন্নতায় অবিচল। ওয়েব্বেজা তাদের সকলকে জড়িয়ে রাখে। স্রিয়-তিরার এই দশহাজারি 'ডেট'য়ের জন্য সারা বছর সুরাসংগ্রহে ব্যস্ত থাকে ওয়েব্বেজা। সে সুরার নাম ভিসিতেগসো; মানুষের কান্না। স্রেফ সেই ভিসিতেগসো সংগ্রহের জন্য যত আয়োজন, যত উৎসব। হ্রুই অর্থাত মেঘ, রিউতিসিউ অর্থাৎ বৃষ্টি, ঘ্রঙসং অর্থাৎ বজ্রপাত। আর অতি অবশ্যই রয়েছে ত্যিউ, অর্থাৎ মানুষ"।
এদ্দূর একটানা বলে ডাক্তার ঢকঢক করে অর্ধেক গেলাস জল সাবাড় করলেন। মনুবাবু ড্যাবাড্যাবা চোখে গল্প শুনছিলেন, ডাক্তার এমন হাত পা নেড়ে গালগল্প ফাঁদেন যে চোখের ভিজে ভাব উবে যেতে বাধ্য। জলের গেলাস নামিয়ে রেখে পকেট থেকে ধবধবে সাদা ইস্তিরি করা রুমাল বের করে ঠোঁট এবং গোঁফ মুছলেন ডাক্তার।
"কাজেই যা বলছিলাম মনু, বৃষ্টিতে একা থাকলেই যে কান্না-কান্না বাইটা তুমি অনুভব করো, সে'টা এলেবেলে নয়"।
"আমার চোখের জল ঈশ্বরের ওয়াইন"?
"মাইন্ড ইউ, ধান্দাবাজি চোখের জল হলে চলবে না। অন্তর থেকে উঠে আসা বেদনা চাই। পিওর কোয়ালিটি গ্রীফ ছাড়া ও জিনিস তৈরি হয় না। আরে বাবা আলো ও সময়ের ওয়াইন, তা'তে কি আর ভেজাল চলে"!
"ডাক্তার, তোমার গপ্প শুনে বড্ড স্নেম অনুভব করছি"।
"কী অনুভব করছো"?
"ওই যে। স্নেম। মুম্ফাসাইরসি ভাষায় যে'টা হলো গিয়ে অস্থিরতা"।
"রাইট রাইট। তোমার মত হাইকোয়ালিটি শ্রোতা আছে তাই এ'সব অমূল্য গপ্প মাঝেমধ্যে ঝুলি থেকে বের করি"।
"এ দু:খ ফেলনা নয়, তাই না ডাক্তার"?
"সিতেগস থেকে আমরা সবাই বেরিয়েছি যে মনু। নিখাদ দু:খ যে'টুকু যা আছে বুকের মধ্যে, সে'টুকুই আসল। বাকি সমস্তই ওয়েব্বেজার ছেলেমানুষি খেলনাবাটি আর কী"।
প্রাণখোলা একট হাসি ভেসে উঠলো মনুবাবুর মুখে। কিন্তু চোখ ফের ভিজে। বাইরে বৃষ্টি ফের শুরু হয়েছে। মনু্বাবু অস্ফুটে বলে উঠলেন, "রিউতিসিউ"।
"তোমার চা পাতার কৌটোটা খালি নেই আশা করি" বলে ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলেন হেঁসেলের দিকে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন মনুবাবু।
জানালার বাইরে সন্ধের গুমড়ে ওঠা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনু বিড়বিড় করে বললেন, "ডাক্তার শালা বড় ফেরেব্বাজ, বড় আপন"।
No comments:
Post a Comment