Wednesday, January 31, 2018

বইমেলা ২০১৭: হাইলাইটস


১. আমরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে বড় স্ক্রিনে বাংলা সিরিয়াল দেখছি। 

২. আমাদের গায়ের ডিও, ঘাম আর ব্যাগের সদ্য কেনা বইয়ের গন্ধ ছাপিয়ে বইমেলার হাওয়া ভারি হয়ে আছে আরামবাগের মুর্গি ভাজা, আলিবাবার বিরিয়ানির গন্ধে।

৩. বইমেলার শেষ বেলায় এসে মনে হয়েছে যে মোটামুটি  ভাবে বইমেলার ম্যাপটা বোধগম্য হয়েছে।

৪. চায়ের কাপ, জলের প্যাকেট ইতিউতি মাঠময় ছড়িয়ে ডেওয়াটা একটা আর্ট। ডাস্টবিন হচ্ছে আর্টকিলার।

৫. অসতর্কতাবশত আগুন লাগলে প্রশাসনের কলার হেঁচড়ে ধরা ইজ মাচ ইজিয়ার দ্যান মেলার ভিড়ে সিগারেট না খাওয়া।

৬. আমরা আচারবিচারে শ্রেষ্ঠ। বিশাল আচারের দোকান বইমেলার মধ্যিখানে। আচারের দোকানে মনকাড়া ভিড়। ঝাল আমের আচার বেস্টসেলার।

৭. যদ্দিন সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে, তদ্দিন বইমেলায় কার্তিকচন্দ্র পাল থাকবেন। (পেয়েছি, তার অটোগ্রাফসহ বইয়ের এক কপি আজ পেয়েছি)।

৮. বইমেলার শেষদিনে সিদ্ধি খাওয়ার চল নেই।

(স্বাভাবিক; পুরনো লেখা)

জিলিপিস্তান


- দেখেছেন? দেখেছেন জিলিপিটার সাহস? আমায় ভ্যাঙাচ্ছে ব্যাটচ্ছেলে! বদমাইসের গাছ।

- কোনটা?

- ওই যে। ওইটে।

- জিলিপি জিভ বের করে ভ্যাঙাচ্ছে?

- জিলিপির জিভ হয়? সে ব্যাটা গামলা থেকে মুণ্ডু বের করে নাচিয়ে আমায় অপমান করছে।

- কই দেখি।

- মন দিয়ে দেখুন। ওই যে। বাঁদিকে যেখানে ফোকাসটা এসে পড়ছে। ওই ব্যাটা হারামি জিলিপ। আমায় হ্যাটা করছে।

- ঠিক। ঠিক। স্পষ্ট দেখছি। আপনার প্রতি একটা ডিস্টিঙ্ক্ট অবজ্ঞা ওর চোখে মুখে ফুটে উঠছে। আপনি ইনসাল্টেড ফিল করছেন না?

- করছি না আবার! গা রি রি করছে।

- আমারও! রক্ত টগবগ করে ফুটছে। আপনার অপমান মানে আমার অপমান।

- নেহাত আমার সুগারটা বেড়েছে তাই।

- তা বলে অপমান টলারেট করবেন? ও ব্যাটা জিলিপির বাচ্চা কন্সট্যান্ট হাবেভাবে আপনাকে বলছে 'ধক থাকে তো খেয়ে দেখা"।

- ধক নিয়ে কথা বলছে। আমারও তাই মনে হচ্ছে। যদিও আমার সুগারটা বেড়েছে।

- রাজপুতেরা সম্মানের জন্য কচাকচ নিজেদের গলা কাটত জানেন?

- রাজপুতেরা নিজেদের গলা কাটত। আর আমি সামান্য সুগারের ভয়ে অপমান হজম করব?

- কভি নহি। আপনি সহ্য করলে আপনি আমার চোখে নেমে যাবেন।

- ঠিক হ্যায়। অ্যাই ব্যাটা, জিলিপি দে দেখি এক পিস। এইটা নয়। ওই ফোকাসে নিচে যেটে দাঁত কিড়মিড় করে পড়ে আছে, উসকো লাও।

- শ্যামবাবু।

- ইয়েস অমিয়বাবু।

- আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। জিলিপি ব্যাটাকে যোগ্য ঠ্যাঙানি দিয়েছেন।

- থ্যাঙ্ক ইউ।

- একটা কথা বলি?

- বলুন।

- গতকাল লালুর তেলেভাজার দোকানে একটা আলুর চপ আমায় দেখে বিশ্রী খ্যাঙোর খ্যাঙোর শব্দ করে হাসছিলে। রাস্কেল কোথাকার। নেহাত কোলেস্টেরল লেভেলটা বিট্রে করছে। নেহাত।

- অপমান। অপমান। বিটনুন অন ইঞ্জুরি। এ আপনি সহ্য করবেন?

- সহ্য করব না?

- সহ্য করলে আপনি দেশের কলঙ্ক। দশের কলঙ্ক।

- মানুষ আমি, নহি তো মেষ। বদলা নেব।

- আলবাত নেবেন।

- কোলেস্টেরলের ক্যাঁথায় আগুন, ল্যাজে ভেসলিন। চলুন, নেক্সট বদলা; কালু দাসের স্পেশ্যাল আলুর চপ।

- জয় হিন্দ।

এক জোড়া বিরাশি বছর জিলিপিস্তান জয় করে চপনগরের দিকে রওনা হলেন।

একটা করে


"ওদিকের জানালাটা আমার বেশ প্রিয় জানো অপর্ণা!  জানালাটার ওপারে একটা পুরোনো বাড়ি যা এক কচি খোকা দিনরাত হাসিকান্নায় মাথায় করে রেখেছে। সে বাড়ির পাশ দিয়ে সরু ইট বাঁধানো রাস্তা গিয়ে মিশেছে আকাশে। আকাশটা অমন মরচে মাখানো সাদা কেন, তাই ভাবছ? আর সাদার গায়ে ছোপ ছোপ কেন?

ক'দিন থাকো এখানে। তারপর বুঝতে পারবে। ওই যে'টাকে ফ্যাকাশে সাদা আকাশ ভাবছ, সে'টা আসলে পুরোন বইয়ের পাতা। কালো ছোপ ছোপগুলো হচ্ছে ছাপার অক্ষর। ছাপা ছেতরে গেছে কেন তাই ভাবছ? আসলে মেয়েটা ঘুরে ফিরে এ পাতাটায় ফেরত আসে, উদ্ভ্রান্তের মত পড়ে আর ফিরে যায়। বড় মায়া আছে মেয়েটার চোখে। ভেজা। বালিশে আর বইয়ের পাতায় সে ভেজা ভাব মিশে যায় বারবার। 

অবিশ্যি মায়া মেয়েটার মধ্যে না তার চোখের জলে ভেজা বালিশে তা বলতে পারিনা। তবে সে বালিশে যখন এ পাতায় খোলা বইটা উপুড় করে রাখে মেয়েটা, তখন ওই ডান দিকের লাগোয়া ছাতে বৃষ্টি নামে; আমি বেরিয়ে ভিজে আসি বেবাক। বেশ লাগে। 

এখন কিনা বইটা বন্ধ করে রাখা, তাই আকাশ অমন ফ্যাকাসে। তাই হয়তো তোমার অমন গুমোট লাগছে।  মেয়েটা মন খারাপে পড়লেই এ বই বিছানায় নিয়ে এসে সপাট চলে আসে এ পাতায়। সেদিন আকাশ জুড়ে শুধু মেঘ, সে মেয়ের চোখের মেঘকালো আনচান। মন খারাপের রঙ আর মন ভালোর গন্ধ মেশানো।"

*
বারবার এ পাতায় ফিরে আসা। বারবার। তবু এদ্দিন অপুকে ডিঙিয়ে অপর্ণাকে ছুঁতে পারেনি সুমি। কিন্তু আজ কেমন করে যেন ঝরঝর করে অপর্ণা বয়ে চলে  এলো। পুরোনো ভালো লাগা বইকে নতুন করে চেনা যে কী আনন্দের। বিষন্নতা মন্দ নয়, সুমির তাই ভেবে হাসি পেলো। মন ভালো করা হাসি। ভেজা হাসি।

*
অপর্ণা বুঝলে বৃষ্টির ভিজে যাওয়ার বড় আদরের। আর বৃষ্টির আদর বড় লজ্জার। সংসারে ভেজা মাটি আর বইয়ের গন্ধ খুঁজে পায় সে। অপুর ঠোঁট আবডাল দেখে তার বৃষ্টি ভেজা গালের কাছে নেমে এলে সে ফিসফিসিয়ে ওঠে "প্রতি বৃষ্টিতে একটা করে, কথা দিয়েছ কিন্তু"।

টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেকশন


- হীরা চমকায় কেন জানিস?
- টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেকশন। অফ কোর্স।
- ডেমো দেখাতে পারবি?
- হীরে নিয়ে ঘুরছ নাকি মামা?
- নয়তো ডেমো দেখাতে বলছি কী করে!
- রিয়েলি? 
- এই দ্যাখ। 
- ধুস। শিঙাড়া। এটা কি তোমার সেই স্পেল অফ কবি ভাব? পুরী বিচ ফিট?
- পাকামি করিস না। কোশ্চেনটায় ডেপথ রেখেছি।
- বেশ তুমিই ডেমোটা দেখাও।
- এ শিঙাড়া যে সে শিঙাড়া নয় বাবু। ডেসিমাল সাইজের ব্রিলিয়ান্স। তা বলে প্যাকেট করা হলদিরামি ভাঁওতা নয়। ভিতরে জেনুইন হলুদ মাখো মাখো আলুর পুর। জেম।
- কথায় কাজ কী? ডেমোয় এসো। টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেকশন। ডায়মন্ড। থ্রু শিঙাড়া।
- ওকে। এই দ্যাখ। পুরীর বে বেঙ্গলের ছাদের নরম আলোর ফোকাসে শিঙাড়াটাকে প্লেস করলাম। ওকে?
- ওকে।
- সে আলো অপ্টিক্যালি ডেন্স মিডিয়াম থেকে রেয়ারার মিডিয়ামে চলা ফেরা করে চকমকি জেনারেট করছে সে'টা তো স্পষ্ট দেখতেই পাচ্ছিস।
- ধ্যার। 
- চকমক দেখতে পাচ্ছিস না?
- ধ্যার ধ্যার।
- ওরে, এ কি যে সে হীরে? দুম করে চমকালেই হল? ফাটা কেষ্ট কি দড়াম করে কেলিয়ে দিয়েই খালাস হয়? সে মারে এখানে আর লাশ ফেলে শ্মশানে। তেমনই, এ হীরে চমকায় এখানে কিন্তু ঝলক পড়ে গিয়ে বুকের ভিতরে। ইনসাইড ইওর সোল।
- শিঙাড়াটা কি খাবে না মামা?

ভয়ডর

- মৃত্যু ভয়?
- জন্মিলে মরিতে হবে..এট সেটেরা।
- স্বজন হারানোর চিন্তা?
- ডেডবডি স্বজন নয়।
- কলঙ্কের কালি মাখতে হলে?
- একটু স্ক্যান্ডাল, অল্প ভুঁড়ি। ক্যারেক্টারে পালিশ আনে।
- তাহলে আপনি নির্ভয়?
- হান্ড্রেড পার্সেন্ট নই। একটা টেরর্ রয়েইছে।
- কী?
- মাঝরাত্তিরের পিপাসা।
- বিছানার পাশে বোতল নিয়ে শুলেই হল। এই যেমন আমি নিয়ে শুয়েছি। এই দেখুন।
- সেই পার্ফেকশন হিট করা..ঠিক ততটাই জলপান যাতে পিপাসার সাপও মরবে আবার ছোট বাথরুমের প্রেশারও ক্রিয়েট হবে না। ডিফিকাল্ট। বিশেষত শীতের রাতে। আজ পর্যন্ত কেউ অপ্টিমাইজ করতে পারেনি।
- কী কুক্ষণে যে আপনাকে ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। কী কুক্ষণেই যে আপনার সঙ্গ রুম শেয়ার করতে রাজী হলাম মশাই। এখান পিপাসা পাচ্ছে।
- বেশ। আপনি পিপাসা আর বাথরুমকে বাইসেক্ট করার চেষ্টা করুন। আমার ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।

হাফ সোয়েটার আর বেড়ালটুপি


বাবার একটা আকাশী রঙের হাফসোয়েটার ছিল।
খোকার ছিল বেড়ালটুপি।

বাবার গল্পে দু'টো হলুদ হাঁস অনবরত ঝগড়া করে যেত।
খোকার ড্যাবা চোখে চিকচিক।

বাবার গায়ে বিকেলমাখানো গন্ধ ছিল। সাইকেলের বেলের টুং আর বিকেলস্নানের ভিজেভাব, সে গন্ধে সমস্তটুকু মিলে থাকত।
খোকার দরজার দিকে আঙুল তোলা ঘ্যানঘ্যান।

বাবার খবরের কাগজের এ পাতা থেকে ও পাতা যাওয়ার খসখস।
খোকার বালিশের ওয়াড় চেবানো নিশ্চুপ। 

বাবার রোব্বারে ঘর সাফাইয়ের ধুম । বাথরুমের মেঝে ঘষা জগঝম্প। ঝুলঝাড়ু হাতে ঘরময় কুচকাওয়াজ।
খোকার পেন্সিলের মাথা চেবানো, বারান্দা ক্রিকেটের অপেক্ষা।

**
বাবার বয়সের বছরগুলো খোকার বুকের ভিতর বরফের মত ঝুরঝুরিয়ে জমা হয়। চারদিক সাদা, কনকনে। 

খোকা ক্রমশ খেইহারানোগুলো গিলতে শেখে।
ও'দিকে খোকাlet কুতকুতে চোখে খোকার খোকাness চ্যালেঞ্জ করে বসে। শত চেষ্টাতেও নিজের গা থেকে বিকেলমাখানো সুবাস খুঁজে পায় না খোকা। 

কলমের মাথা চিবিয়ে টেনশন ঠেকিয়ে রাখে খোকা, খোকাlet এক জোড়া হলুদ হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁকে গল্পে লুটোপুটি যাবে তো? নইলে সব মাটি

ভীতুর দাবী

ভীতু মানুষ চাই।

যাদের বন্দুকের ভয় দেশাত্মবোধের চেয়ে বেশি।
যাদের খিদের জ্বালা ধর্মের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে প্রখর।
যাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে চুমুর লোভ বেশি।
যারা একবার বড়বাথরুমে আয়েশ করে বসলে শত বিপ্লবের ডাকেও সাড়া দেবে না।
যারা যুদ্ধ শুনলে শীতের দুপুরে কাঁথার তলায় সেঁধোবে, এন্তার রুমাল চিবিয়ে ভয় কাটাবে।
যাদের রক্ত দেখলে বমি আসবে, নতুন দিনের আলোর আশায় যে বমিভাব প্রশমিত হয় না।
যাদের দাউ দাউ আগুন দেখলে মায়ের কথা মনে পড়বে।
যারা আদর্শের জন্য বলিপ্রদত্ত নয়, যাদের গোটা বছর কাটবে শুধু মিস্টার বীন দেখে।
যারা টপ করে নিজের প্রাণ পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ভাবলেই জ্বর আসে, যারা জ্বরের ঘোরে পান্নালাল শুনে রাত কাবার করেন।

ভীতুর দেশ।
যে'খানে দড়াম দুড়ুম করে আদর্শবাজরা অসহায়দের লাশ ফেলে দেয় না।
যে'খানে খোকাখুকুদের টপাটপ নিকেশ হওয়ার কোনও হুড়োহুড়ি নেই।

তড়কা


পঁচিশ টাকায় ধোঁয়া ওঠা ডিম তড়কা।
দশ টাকায় চারটে নরম গরম রুটি।
সঙ্গে ফাউ সদ্য কাটা ঝুরি পেঁয়াজ, একটা কাঁচা লঙ্কা আর হাফ চামচ বিটনুন।

কামড়ে কামড়ে তুলতুল। তড়কার ফরমায়েশি বাড়তি ঝালে জিভে ডগায় আলতো হুহু। মার্চ শেষের দুপুরের  চিটচিট দিব্যি ভুলিয়ে দেওয়া স্বাদ। বাঁশির সুরের মত ভাসতে ভাসতে একটা রুটি খতম করে অন্য রুটিতে পৌঁছে যাওয়া।

"দাদা,আর একটু পেঁয়াজ দেবেন প্লীজ। আর অল্প নুন"।

এ'ভাবেই সম্পর্ক তৈরি হয়।

এ'ভাবেই একদিন আশ্বাস আসে, "পাঁচ মিনিট বসুন দা'ভাই। আপনাকে গরম রুটি না দিতে পারলে ভালো লাগে না। অফিসের খাটাখাটনির মাঝে খাওয়াটা তৃপ্তির না হলে ফাইল সাফ করবেন কী করে? আর রুটি গরম হলে তা' নুন মাখিয়ে খেয়েও আরাম। পাঁচ মিনিট বসুন। ভিড়টা একটু ম্যানেজ দিয়েই আপনার প্লেট রেডি করে দেব"।

খাওয়াদাওয়া নিয়ে যে স্নেহটুকু,  তার জন্য দাদা আরআর দা'ভাইয়ের নাম পদবী জানার দরকার পড়ে না।

"আর একটা রুটি খান তো দা'ভাই, এরপর টিফিন করবেন তো সেই সন্ধ্যেবেলা" এ'টুকুর বাইরে সমস্তটুকুই তো ব্যালেন্স শীট।

ফারুক


এক তাল মাখনে একটা ছুরির ফলা অত সহজে ঢুকতে পারবে না যতটা সহজে ফারুক শেখ মিচকি হেসে গল্প ফেঁদে বিকেল কাটিয়ে দিতে পারবেন। সঞ্জীবি মিঠে মেজাজ আর তারাপদরায় গোছের গল্পেকথায় কেটে যাওয়ার কথা সেই বিকেল।

ফারুক শেখের মত একটা বিকেল। যেমন বিকেল পেলে  জিন্দেগীর ধূপে ঘন ছায়া নেমে আসার কথা। যেমন বিকেল পেলে বাদাম চিবুতে চিবুতে চাকরীর ইন্টারভ্যিউয়ের রিজেকশন লেটারকে বাতাসে ভাসিয়ে দায়মুক্ত হওয়া যায়।

ফারুক শেখের মত একটা বিকেল। যে'খানে পাড়ার মাঠে থেবড়ে বসে অপেক্ষা করা যায়। যদি একটা টিউশন-ফেরতা বেগুনী রঙের লেডিবার্ড সাইকেল উত্তরের গোলপোস্টের ও'পাশ দিয়ে হুশ্ করে বেরিয়ে যায়।

যদি যায়।
সেই হুশ্ করে বয়ে যাওয়া কয়েক সেকেন্ড। আর ফারুক শেখের মত একটা বিকেল।

কাপ্তান


একটা মেয়েকে কারা যেন গুলি করেছিল সে স্কুলে যেতে চেয়েছিল বলে। কিছু মানুষের ধর্মরক্ষা হয়েছিল মেয়েদের স্কুল ভেঙে দিয়ে। কেউ বিপ্লব খুঁজে পেয়েছিল স্কুলপড়ুয়াদের খুন করে।
হাজার ফতোয়া আর সহস্র বছরের দুমড়ে দেওয়া অন্ধকার, এগুলোকে আঁকড়ে কত মানুষের জীবন গুজরান।

আমাদের এই সমস্ত গোঁয়ার্তুমি ফুঁড়ে কয়েকজন বেরিয়ে আসার দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলেন। আলোর নেশা বড় খতরনাক, সে নেশায় 'নিয়ম'কে কাঁচকলা দেখিয়ে ফেলেন কয়েকজন।

কাপ্তান মির সেই কয়েকজনের একজন। বা সেই কয়েকজনের একটু বেশি।
সমস্ত 'নিয়ম'য়ের তোয়াক্কা না করে,
স্কুলভাঙিয়েদের কান মুলে
একদল মেয়েকে নিয়ে ক্রিকেট খেলতে নামেন তিনি।

চওড়া কাঁধে একটা দলকে বয়ে নিয়ে যান কাপ্তান। তাঁদের সাফল্যে ভেসে যান তাঁদের হয়ে দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কসুর করেন না। আর সানা মির ভালোবাসেন, খেলাটকে আর তাঁর দলের প্রত্যেকটা মেয়েকে। তাঁদের প্রত্যেকটা চোট আঘাতে ককিয়ে ওঠেন, তাঁদের প্রতিটা মাইলস্টোন নিজের বুকে চেপে ধরেন।

কাপ্তান সানা মির। দল যখন অন্য কারুর অধিনায়কত্বেও মাঠে নামে, তখনও মেরুদণ্ড হয়ে স্পষ্ট হয়ে থাকেন একজনই। সানা মির।

এক মুঠো অন্ধকারে ক্রিকেটের ঝিরঝির আলো ছড়িয়ে দেন সানা মির। দাপুটে জ্বলজ্বলে টেনে নেন আরও কয়েকজনকে। অমন এক কাপ্তান পাশে থাকলে সবকিছু সহজ হয়ে যায়। গান তৈরি হয়, যুদ্ধ থামে। সানা মির কাঁধে হাত রাখলে মুঠো শক্ত হয়। এ দেশে সমস্তটুকুই বারুদ গন্ধে বুঁদ নয়, এখনও সবুজ আছে। এখনও আকাশে আলো। গুলাম ফাতিমা, বিসমা মারুফদের প্রতিটা সাফল্যে সানা মিরের ক্রমাগত উত্তরণ ঘটে চলে।

কাপ্তান সানা মির। যুদ্ধের নয়, ভালোবাসার। আশার। সানা মির শুধু পাকিস্তানের নন। বীরভূমের যে মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরেই বাসন মাজতে বসেছে, সানা মির তারও।

#দিলদিলসানামির #দিলদিলকাপ্তান

( বছর খানেক আগে প্রথম পাকিস্তানি মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে একশো উইকেট আর হাজার রানের 'ডাবল' করেছিলেন  সানা। সেই সময়ের লেখা এ'টা। 
তবে আদত কাপ্তানদের হিসেব স্রেফ নম্বরে হয় কী?)

Tuesday, January 30, 2018

রাধাবিনোদের ইচ্ছে


রাধাবিনোদবাবু একা মানুষ। অনেক চেয়েও কারুর সাতপাঁচে থাকা হয় না। কদ্দিন যে একা আছেন তার ইয়ত্তা নেই। কদ্দিন। কতদিন। এই বাড়িতে তিনি চিরকালের একা। বাড়ি বলতে দু’কামরার একরত্তি আস্তানা, তার সামনে ছোট্ট উঠোন। উঠোন কিছু গাঁদাফুল আর শাকসবজির গাছপালা। একটা কাঠবেরালির গুষ্টি সে বাগানেই আছে বটে, তবে তারা বংশানুক্রমে রাধাবিনোদকে পাত্তা দেয় না। এ’টাই ওদের ট্র্যাডিশন।

যেমন রাধাবিনোদবাবুর ট্র্যাডিশন হল একা থাকা।

অনেক ছোটবেলায় এক পিসিমা ছিলেন সঙ্গে। তবে সে পিসিমার মুখ বড় একটা মনে পড়ে না। পিসিমার স্মৃতি বলতে পিসিমার বিড়বিড়ানি। বুড়ি একটানা বিড়বিড় করে যেতেন, তাঁর থেকেই মন্ত্রটা প্রথম শিখেছিলেন রাধাবিনোদবাবু;
“ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”।

রাধাবিনোদবাবুর শোওয়ার ঘরের দক্ষিণের দিকের দেওয়ালে ঝোলানো ছবি; তা’তে লেখা “ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”। রাধাবিনোদবাবুর খাটের পাশে রাখা ছোট্ট বেতের টেবিল; সেই টেবিলের ওপর রাখা একটা কাচের গেলাস আর একটা বই।
খয়েরী চামড়ায় বাঁধানো বই; যার নাম হল “ফাঁসি ভালো না ইলেকট্রিক চেয়ার”? বইটা ইয়াম্মোটা। হাজার দেড়েক পাতার বই। তবে গোটা বই জুড়ে একটাই লাইন বার বার লেখা; “ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”। ঘুমোতে যাওয়ার আগে এই বইয়ের খান তিরিশেক পাতা না পড়লে রাধাবিনোদবাবুর কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না; ছোটবেলার অভ্যাস যে।

বাইরের ঘরের সোফার পাশের দেওয়ালে ঝোলানো আড়াইশো বছরের ক্যালেন্ডার। সে ক্যালেন্ডারে গাঁদা ফুলের ছবি; তার নিচে লেখা; “ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”। দিনের শেষে সেই তারিখে দাগিয়ে দেওয়াটা রাধাবিনোদবাবুর আরও একটি অভ্যাস।

রাধাবিনোদবাবুর আরও একটি অভ্যাস আছে; খবরের কাগজ পড়ার। ভোর বেলা মুখ ধুয়ে কাগজ না নিয়ে বসলে তার হয় না। “দৈনিক ইলেকট্রিকচেয়ার সংবাদ”। কাগজ জুড়ে রোজই থাকে ইলেকট্রিক চেয়ারের দুনিয়ার রংবেরঙে খবরাখবর। অবশ্য ফাঁসি বিরোধী খবরাখবরও যে দু’একটা থাকে না তা নয়। এ কাগজ পড়া না হলে রাধাবিনোদবাবুর মুখে জলখাবার রোচে না।

তবে খবরের কাগজ আর একটা বই উলটে পালটে কতক্ষণ আর সময় কাটে। মাঝেমধ্যে তিনি নেমে পড়েন বাগানের পরিচর্যায়। তখন তাঁর কোমরে কষে বাঁধা থাকে গামছা, হাতে খুপরি আর মুখে লোকগীতি;
“ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ও ভাই,
ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”।
সে গানের যেমন সুর, তেমনি মন কেমন করা গানের কথা। বুকে আরাম লাগে।  

তা, একরকম একাএকাই দিন কেটে যাচ্ছিল রাধাবিনোদবাবুর। মাঝেমধ্যে একঘেয়ে লাগে বটে, তবে কী আর করা যাবে।
এইসব কিছুর মধ্যেই একটু বেহিসাব ঘটে গেল এই সেইদিন।
হঠাৎ একদল পেয়াদা এসে হাজির। রাধাবিনোদ সেলাম ঠুকে জানতে চাইলে ব্যাপারটা কী।

পেয়াদাদের সর্দার গলায় জানালে যে রাজাবাহাদুরের শমন নিয়ে এসেছে সে।
রাজাবাহাদুরের ইচ্ছে হয়েছে রাধাবিনোদের বাড়িটা ভেঙে সেখানে একটা বিড়ির দোকান বসাবেন। রাজার আদেশ, রাধাবিনোদকে নিকেশ করে তাঁর জমি বাড়ি কব্জা করতে হবে; তারপর সে’খানে বসবে এলাহি এক বিড়ির দোকান।

তবে রাজাবাহাদুর অবুঝ পাষাণ নন। তিনি নিজে জানতে চেয়েছেন যে রাধাবিনোদবাবুর ফাঁসিতে ঝুলতে বেশি ভালো লাগবে না ইলেকট্রিক চেয়ারে বসতে। আনন্দে চোখে জল এসেছিল রাধাবিনোদের। একটু খটকা ছিল অবশ্য মনে, তাই তিনি একবার মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন;
“পেয়াদা ভাই, তুমি বলছ বটে আমার কান্নাটা আনন্দের। তবু বুকের ভিতর থেকে দুঃখ দুঃখ মার্কা পোড়া গন্ধ আসছে কেন”?
“পোড়া গন্ধ? পাগল হলে নাকি রাধাবিনোদ। খোশবু বলো। রাজা তোমার পছন্দ অপছন্দ জানতে চেয়েছেন। এমন নসীব ক’জনের হয় বলতে পারো? তাই তোমার বুকে আনন্দের ঢেউ। এই খোশবু আনন্দের। আর তোমার চোখের জলও, আনন্দের চোটে বইছে”।
অমনি সমস্ত ধন্দ কেটে গেছিল রাধাবিনোদের মন থেক। সে গুনগুন করে গেয়ে উঠেছিল;
 “ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ও ভাই,
ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”।
সুরে মোহিত হয়ে পেয়াদা সর্দার বলেছিলেন; “আহা, তোমার গলায় কী অপূর্ব সুর ভায়া রাধাবিনোদ। আরও গাও দেখি খানিকক্ষণ”।

পরের দিন “দৈনিক ইলেকট্রিক চেয়ার সংবাদ”য়ের প্রথম পাতার অর্ধেকটা জুড়ে ছিল রাধাবিনোদের হাসি হাসি ছবি। শিরোনাম; “রাজ্যের স্বার্থে স্বেচ্ছায় ইলেকট্রিক চেয়ার বরণ করলেন মানবশ্রেষ্ঠ রাধাবিনোদ”।   






  

Friday, January 26, 2018

বইমেলাফিকেশন

(পুরনো লেখা)


- দাদা রে, কাল যাবি?


- কোথায়?


- যেখানে যাওয়া উচিৎ। অবিলম্বে। চটপট। তুরন্ত।


- রান্নাঘর? পায়েসের ট্রায়াল মা অ্যালাউ করা শুরু করেছে? 


- উফ। না রে। 


- তা'হলে? অমন মনোহারিণী সুবাসে ঘর ভরে গেছে। তোর ব্রেন পায়েস ছাড়া অন্য কোনও ইনফর্মেশন প্রসেস করতে পারছে রে? 


- দাদা। খাইখাই একটু বাদ দে।  


- তুই ডেঁপোমিটা বন্ধ কর।


- আমার সঙ্গে যাবি কিনা বল।


- কোথায়? শুনি।


- বইমেলা। কাল। প্লীজ।


- কাল টিট্যুয়েন্টি আছে।


- বইমেলা বলে কথা। চ'না, তুই না গেলে আমার যাওয়া হবে না।


- বই? বাড়ির তাকে, বাবার আলমারিতে, তোর স্কুলের আর আমার কলেজের লাইব্রেরীতে, বন্ধুদের শেল্ফে, ফ্লীপকার্টে; চারিদিকে একগাদা বই পড়ে আছে তো। অবশ্য ধুলোবালি আর ভিড়ের ঠ্যালাঠেলি যদি তোর সাইডডিশ হিসেবে দরকারি মনে হয়, তাহলে সেটা আলাদা কথা।


- তুই যাবি না?


- বললাম তো। টিটুয়েন্টি।


- মামা আমায় দু'হাজার টাকা দিয়েছে।


- মামা? তোকে দু'হাজার? আর আমি এক প্যাকেট হজমিগুলি চাওয়ায় গাঁট্টা মারলে?


- তুই তো আর মাধ্যমিকে আমার মত রেজাল্ট করিসনি।


- তুই বড্ড এলিটিস্ট হয়ে যাচ্ছিস। কথায় কথায় অমন বাতেলা ভালো নয়। যাক গে, দুহাজার নিয়ে কী বলছিলিস?


- বলছিলাম তোমায় বইমেলা থেকে ফেরার পথে রোল না হয় আমি খাওয়াবো।


- অত ইজি না চাঁদু। এক আমার এক তোর।


- মামা আমায় ভালোবেসে টাকাটা দিয়েছেন।


- কংসকেই বল তাহলে,তোকে বইমেলা ঘুরিয়ে আনবে।


- বেশ, এক হাজার তোর। কিনিস বই।


- সরি। বইমেলায় আমি বই কিনি না। আমার ফ্লিপকার্ট আর কিন্ডল বেঁচে থাক।


- তবে?


- সোল অফ বইমেলা কী? জানিস তো?


- বই অফ কোর্স।


- কচুপোড়া।


- নয়তো কী?


- বইমেলার প্রাণ ভোমরা রয়েছে বেগুনী আর বেনফিশে। বেশক্। বেফিকর। 


- বেশ। তুই কাল আমার সঙ্গে গেলে আমার ফান্ডের পঞ্চাশ পার্সেন্ট বেগুনিতে আর বেনফিশে। এবার কাটাতে পারবি টিট্যুয়েন্টির মায়া?


- টিট্যুয়েন্টি আবার ক্রিকেট নাকি? টেস্ট ম্যাচ হলে বইমেলা ক্যানসেল করার কথা ভাবতাম। কাল তাহলে দুপুর দুপুর বেরিয়ে পড়ব, কেমন?


দেশের দশের

দেশের জন্য দশের জন্য মাঝেমধ্যে ভাবতে ভালো লাগে।

মন কেমন হয়ে যায়।

বুকের মধ্যে 'বলো বলো বলো সবে'র সুবাস বয়ে যায়। একটা কিছু পাল্টে ফেলার তাগিদ টের পাই। মনে পড়ে যায় স্বামীজীর কথাগুলো। ভার্বাটিম মনে পড়ছে না তাই কোট করছি না।
বা সুভাষবাবুর সেই ইস্পাত বাণী। ভার্বাটিম মনে পড়ছে না তাই কোট করছি না।
অজান্তেই মুঠো শক্ত হয়ে আসে, সোফার হেলান কেটে যায়।

জানালার বাইরের আকাশের দিকে চেয়ে মনভার খানিকটা লাঘব হয়। আহা এমন উজ্জ্বল আসমানি রঙ কী অবলীলায় একই সঙ্গে মনভালো আর মনখারাপ মিশিয়ে দেয়।

হোক এ দেশ মিডিওক্রিটিতে ভরা।
নাচুক এ দেশ রিগ্রেসিভ হনুমানেদের লেজের তালে।
কোরাপশনের ডকে উঠুক।
তবু। আমার দেশ তো।
অরবিন্দই তো বলেই গেছিলেন সে কথা..ভার্বাটিম মনে পড়ছে না তাই পুরো কোট করছি না।

দেশ। মা। চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপতে থাকে। মা। দেশ।

সুর আপনা থেকেই গলা বেয়ে জিভের ওপর দিয়ে গড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তাতে মিশে থাকে সামান্য অদৃশ্য মা মা ডাকের মিহিকান্না;
"তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি...."।

সমস্ত কালিমাটালিমা যে আমাদেরই মুছতে হবে। আমাকেই মুছতে হবে। গানের ধাপে ধাপে হাতের মুঠো শক্ত হয়, সোফা-কুশন খামচে ধরি।

"মা গো, ভাবনা কেন"।

ঠিক তখুনি বিশ্রী চিৎকার ভেসে আসে;

"দিনের বেলাতেও লাটসাহেবের বাথরুমের আলো জ্বালা চাই।  অথচ বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় বাতি বন্ধ করার প্রয়োজন নেই, তাই না? আর কল ভালো করে বন্ধ করলে কি ঠাকুর পাপ দেয় না পাঁজিতে বারণ"?

মায়ের গজরগজর।

মুঠো আলগা হয়ে আসে।
মাথার ভিতরের প্যাট্রিওটিক টিউনগুলো তালগোল পাকিয়ে যায়।
জননী জন্মভূমিশ্চ (পুরো মনে পড়ছে না তাই কোট করছি না) না ছাই। দেশের কথা দশের কথা ভাবার সময় যত বাথরুমের আলো নেভানো আর কলবন্ধের ফরমায়েশ।

ডিসগাস্টিং।

Wednesday, January 24, 2018

রুথলেস

সে'খানে বেশ শীত।

রাতের ট্রেনের জানালা খোলা রাখা দায়।
সোয়েটারের ওপর একটা চাদর জড়াতে পারলে ভালো হয় যেন। কালচে সবুজ রঙের মাফলারটুকু আছে তাই বাঁচোয়া। চা, ঝালমুড়ি, কাগজ, প্যাকেটখোলা বাদাম, ট্রেনের ধুলো আর মানুষ; সব মিলে একটা গন্ধ তৈরি হয়। সে গন্ধের ভালো মন্দ নেই, শুধু থাকা আছে; নাক বুক জুড়ে।

মাঝে মধ্যে জানালার কাচ তুলে একটু বাতাস নাকে নেয় বিনু। কনকনে হাওয়া, তবু। আরাম লাগে। মুখে ট্রেনে ফুঁড়ে আসা হাওয়ার ঝাপটা লাগলেই বিনুর বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে।

হস্টেল ফেরতা। বাড়ির স্টেশন আসার মিনিট দশেক আগে থেকেই কাঁসার থালায় বেড়ে দেওয়া গরম ভাতের ওম টের পেত বিনু।
বাড়ি ঢোকার মুখে অঙ্ক স্যার আনন্দবাবুর বাড়ি, সে বাড়ির সামনে চোখ জুড়োনো বাগান। আনন্দবাবু দুঃখ করে বলতেন "টপ ক্লাস মালি হতে চেয়েছিলাম রে, অ্যাকাডেমিক ব্রিলিয়ান্স এসেই সব গোলমাল করে দিল"। শীতের রাতে আনন্দবাবুর বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটলেই ঠাণ্ডা বাতাস আর আনন্দবাবুর বাগানের মিঠে গন্ধে বুকের ভিতর চনমন করে উঠত।

ট্রেনের জানালা বেয়ে আসা হাওয়ার ঝাপটা যে কী ভালো। আর কী "রুথলেস"।

রুথলেস শব্দটা দাদা খুব বলত।
আর বিনু বরাবর দাদার মত হতেই চাইত।
দাদার মত টপাটপ কবিতা কোট করতে চাইত।
দাদার মত অফস্পিন প্র‍্যাক্টিস করত।
দাদার মত দুপুরবেলা বালিশ বুকে গল্পের বই পড়ত।
দাদার মত ভালো ইংরেজি বলতে চাইত, ওর মত নিঁখুত বাংলা লিখতে চাইত।

আনন্দবাবুর মেয়েকে বাবা মেনে নেননি ওরা ব্রাহ্মণ নন বলে।
বাবাকে দাদা রুথলেস বলত।
দাদাও বাবাকে মেনে নেয়নি।
বিনুর বড় ইচ্ছে হয় দাদাকে রুথলেস বলতে।

বিনু এখনও মাঝেমধ্যেই বাড়িতে যায়। সেই কাঁসার থালায় গরম ভাত বেড়ে দেয় একজন হাড়হিম করা ভূত যে একটা প্রাণের নির্মম বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। ভূতকে মা বলে ডাকতে বিনুর বড় কষ্ট হয়।

বাড়িটা এখনও আছে।
বিনুর আর বাড়ি ফেরা নেই।

রাতের মত ভালো

বালিশের ওয়াড় হবে আবছা গোলাপি, তা'তে লাল সুতোর ডিজাইন।
ধবধবে সাদা বিছানার চাদর।
গায়ে দেওয়ার সাদা কালো চেক ভাগলপুরী চাদর।
বাটিক প্রিন্টের ওয়াড় দেওয়া পুষ্ট পাশবালিশ।
খাটের মাথার কাছে টেবিল। সেই টেবিলে কাঁচের গেলাস ভরা জল, কাঠের কোস্টারে ঢাকা। পাশে পুরনো কাচের স্কোয়্যাশ বোতলে জল।
জলের বোতলের পাশে এক শিশি মিষ্টি আমলকি।
আর বালিশের পাশে পকেট রেডিওতে নজরুল। 

আর বুকের ওপর সঞ্জীব।
মাথার ভিতর সদ্য পড়া 'রাবণবধ'।
হাতের নাগালে বেডস্যুইচ।

ডার্ক

- দশটা সাবজেক্টের মধ্যে সাতটায় ফেল করেছি। বাবা পিঠের চামড়া গুটিয়ে মাদুরে মলাট দেবে রে ভাই।

- সর্বনাশ। আর তোর বাবার যা মেজাজ!

- গতকাল মেজদা র'য়ে ড়'য়ে গুলিয়েছিল বলে বাবা বারো খানা গাঁট্টা কষালে। এই রেজাল্ট দেখলে আমার নামে মামলা না ঠুকে দেয়। কী যে বলব বাবাকে...।

- একটা যুক্তি দিতে পারিস, আজকাল পাবলিকে সে'টা খাচ্ছে বেশ।

- বলছিস?

- আলবাত।

- কী যুক্তি?

- রেজাল্ট দেখিয়ে গম্ভীর মুখে বল 'ডার্ক হিউমর'। কাকু তোকে আনন্দের চোটে কাফকাটাফকার বই কিনেটিনে দিতে পারেন।

আপ বঙ্গালী হ্যায়?

- আপ বঙ্গালী হ্যায়?

- কেয়সে পতা চলা? ওয়েট, লেট মি গেস...।

- হাঁ কিজিয়ে গেস।

- বিকজ আই ওয়াজ টকিং আবাউট মিস্টার ঘটকস মুভি মেকিং স্টাইল?

- ঘাটাক সাহাব তো ইন্টারন্যাশনাল ফিগার হ্যায়।

- ও। বিকজ আই আস্কড ফর ফিশ?

- না না, ফিশ ভি আজকল কাফি কসমোপলিটান হ্যায়।

- ফির? ক্যাইসে পতা চলা যে ম্যায় বাঙালি?

- ইহা পে সব লোগ শেয়ার মার্কেট ক্র‍্যাশ লেকে পরেশান হ্যায়। লেকিন উধর আপকে অপোজিট সাইডকে ওয়াল পে যো অগলা সাল কা ক্যালেন্ডার হ্যায়, আপ উয়ো ক্যালেন্ডারকে বারা মহিনে মে সিরফ অক্টোবর কা ডেটস ঘুর রহে থে। অউর হস রহে থে।

- ওহ, না মানে আসলে....ওই কী বলে যেন; শেয়ারফেয়ার তো হাতের ময়লা হ্যায়। কৃষ্ণ আগর বেঙ্গলি হোতা তো উয়ো কেয়া বোলতা পতা হ্যায়? কর্মটর্ম তো হোতা রহেগা, আগে পুজোর প্ল্যানফ্ল্যান লেকে  ডিসেম্বর সে চিন্তাভাবনা শুর কর দেনে কা।

Monday, January 22, 2018

সিলভার লাইনিং


- এই যে মিস্টার প্ল্যাটিরিঙ্কোস! ডেটা তৈরি? 
- ইয়েস ম্যাডাম। স্প্রেডশিট আর সামারি তৈরি।
- শুনি। হাইলাইটস।
- আপনার পায়ের কাছে এ বছর যা যা বই ডিপোজিট হয়েছে সে'টা অ্যানালিসিস করে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। ট্রেন্ড এ বছরেও পাল্টায়নি। বাহান্ন শতাংশ বই অঙ্কের।
- ধুস। অঙ্ক ভুল ভাবে শিখিয়ে শিখিয়ে আমরা একের পর এক ভিতু জেনারেশন তৈরি করছি। এ আর পাল্টানোর নয়। 
- স্পেশ্যাল ট্রিভিয়া ম্যাডাম। জমা পড়া অঙ্কের বইয়ের মধ্যে বত্রিশ শতাংশ বই হচ্ছে গাইড বই আর সাজেশনের খাতা। যা কিনা গত বছরের তুলনায় সাড়ে ছয় শতাংশ বেশি। 
- এর মানে খবরের কাগজে জ্যোতিষ আর তুকতাকের বিজ্ঞাপন বেড়েছে, তাই না মিস্টার প্ল্যাটিরিঙ্কোস? 
- ইনক্রেডিবল। জ্যোতিষ চর্চার বিজ্ঞাপন ঠিক সাড়ে ছয় শতাংশ বেড়েছে। ইয়ার অন ইয়ার।
- কনেকশনটা স্পষ্ট ভাই প্ল্যাটিরিঙ্কোস। এত হিন্ট দেওয়ার চেষ্টা করি। সব জলে। সবাই কুল খাওয়ার ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস নিয়ে পড়ে আছে। নাহ্, এ'সব ডেটা নিয়ে পড়ে থেকে লাভ নেই। ও স্প্রেডশিট আমার ডেস্কটপে এক কপি সেভ করে দিও। খামোখা প্রিন্টট্রিন্ট নিয়ে ফাইল মোটা করতে যেও না। সিলিভার লাইনিং কিস্যু নেই কোথাও।
- ইয়ে।
- কী ইয়ে?
- একটা মাইনর অ্যানোমালি আছে ম্যাডাম। 
- মাইনর? কী?
- না মানে, এ'টা সিলভার লাইনিং কিনা জানিনা। আপনার পায়ের কাছে জমা পড়া সমস্ত কেতাব দস্তাবেজের মধ্যে খান তিরিশেক ইয়ে...পাওয়া গেছে।
- আবার ইয়ে?
- কয়েকটা মেনুকার্ড। তিনটে আরাসালান, পাঁচটা সিরাজ, দু'টো আমিনিয়া এট সেটেরা...। আর কয়েকটা ট্র‍্যাভেল ব্রশার...কুণ্ডু ট্র‍্যাভেলস টাইপের। ব্যাপারটা কী ভাবে যে ইন্টারপ্রেট করব ম্যাডাম...!
- ফাদার অফ সিলভার লাইনিং মিস্টার প্ল্যাটিরিঙ্কোস! আশা আছে, ডেফিনিটলি আছে।


ভেবেটেবে

অনেক ভেবেটেবে দেখলাম।

ভালোলাগা গানের শেষের ফুড়ুৎ করে বেরোনো 'আহা',
হুড়মুড়ের মধ্যিখানে ফোনের ও'পাশে মায়ের 'খেয়েছিস?',
পুজো আসছের মন ফুরফুরে 'এইব্বারে জমবে',
জমাটি শীতের রাতে মনপসন্দ বইয়ের শেষে পাতায় পৌঁছনো 'আইব্বাস',
পুরী যাওয়ার ওয়েটলিস্ট টিকিট কনফার্ম হওয়ার 'ইউরেকা',
হাজারবার প্ল্যান করেও জমানো চিঠি ছিঁড়ে কুচিকুচি না করতে পারার 'ধ্যাত্তেরি',
ছোটবেলার ইয়ারদোস্তের গায়ে পড়া 'আরে বল না বে কী হয়েছে',

এ'গুলো কিছুতেই যাওয়ার নয়।

অতএব,
'সিটিসি'র পায়ে দড়ি পরিয়ে 'ছোটিসি আশা'র বাঁশের খুঁটিতে বাঁধতে পারলেই নিশ্চিন্দি।

(ইয়ে, 'বাঁশ'য়ের খুঁটির রেফারেন্স দিলাম কেন কে জানে)।

Sunday, January 21, 2018

সুবিমলবাবু

- সুবিমলকে একটু ডেকে দেবেন?
- কে?
- আমি মনোময় দত্ত। ও আমার সঙ্গে অক্রুর দত্ত লেনের মেসবাড়িতে টানা অনেকদিন ছিল।
- না না, আপনি কাকে খুঁজছেন বললেন?
- সুবিমল। সুবিমল মৈত্র। ডেকে দিতে পারবেন কি?
- এ'খানে ওই নামে কেউ থাকেন না।
- ওহ। ডাকতে পারবেন না তা'হলে।
- থাকেনই না কেউ ওই নামে।
- আমিও তো তাই বললাম। সুবিমল তা'হলে এখন নেই।
- আরে! বলছি সুবিমল নামে কেউ এ বাড়িতে থাকেই না।
- আমি কি আপত্তি করেছি?
- তাহলে বলছেন কেন যে সুবিমলকে আমি ডেকে দিতে পারব না।
- পারবেন কি? ডেকে দিতে? এখন?
- ইয়ার্কি হচ্ছে! ওই নামে কেউ কস্মিনকালেও এ'খানে থাকেনি।
- অত ঘুরিয়ে বলছেন কেন? জানতে চাইলাম সুবিমলকে ডেকে দিতে পারবেন কিনা। পারবেন না, ল্যাঠা চুকে গেল!
- পারার প্রশ্নটা আসছে কোথা থেকে? যে এ'খানে নেই তাকে ডাকবই বা কী করে?
- মহামুশকিল। সে যদি এখানেই থাকবে, তা'হলে তাকে খামোখা ডাকতে বলবই বা কেন? এখানে নেই, তাই বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম যে সুবিমলকে ডেকে দিতে পারবেন কিনা।
- না মানে, কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
- স্বাভাবিক। আমি এক প্রশ্ন করছি অথচ আপনি কী সব আগডুমবাগডুম উত্তর দিয়ে চলেছেন। পারবেন কি সুবমিলকে ডেকে দিতে?
- সুবিমল? আপনার মেসের বন্ধু?
- এই তো। দিব্যি চেনেন। পারবেন ডেকে দিতে?
- আমি তো সুবিমল বলে কাউকে চিনি না। মাইরি। আমার নাম হরিহর দত্ত। আমার বাপ দিবাকর গত হয়েছেন বছর দশেক। আমি এক ছেলে, বিয়েথা করিনি। একাই থাকি।
- ফের অদ্ভুত যুক্তি। আপনার বাপের নাম দিবাকর বলে আপনি সুবিমলকে ডাকবেন না? উইলে লিখে গেছিলেন নাকি আপনার বাবা?
- আমার কেমন গোলমাল ঠেকছে মনোময়বাবু।
- ঠেকছে না? আপনার কথাবার্তায় আমারও তেমনই মনে হচ্ছে হরিহরবাবু।
- আচ্ছা, ডেকে দেখব? সুবিমলকে?
- ক্ষতি তো নেই। থ্যাঙ্ক ইউ।
- কিছুই বলা যায় না, বলুন?
- পয়েন্ট।
- তা'হলে ডাকি? সুবিমলবাবুকে?

**

"সুবমিলবাবু" বলে বার চারেক হাঁক পাড়তেই পুঁটিরাম সুট করে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে মনোময় দত্তর কোলে উঠে বসল। মনোময় শুকনো থ্যাঙ্ক ইউ বলে বেরিয়ে গেলেন।

মাস ছয়েকের পরিচয়েই পুঁটিরামকে বড় আপন করে নিয়েছিলেন হরিহরবাবু। কিন্তু আজ স্পষ্ট বোঝা গেল যে পুঁটিরাম হরিহরবাবুকে আদৌ নিজের ভাবতে পারেনি। যাকগে, একা থাকার কপাল হরিহরবাবুর,  তাঁর ভাগ্যে অমন আদুরে বেড়ালের সঙ্গ-সুখ সইবে কেন?

Saturday, January 20, 2018

আয়

"তোর বোধ হয় দেরী হচ্ছে, তাই না"?

"হুঁ"?

"তোর জরুরী কাজ আছে, তাই না? এখুনি যেতে হবে"?

"হ্যাঁ! মানে, একটা জরুরী মিটিং। কোয়ার্টার এন্ড প্রেশার! বুঝতেই পারছিস"।

"আয়, আমি কিছুক্ষণ এ'দিকটায় হাঁটাহাঁটি করে ফিরে যাব'খন"।

"আসি"।

"আয়"।

"সাবধানে ফিরিস"।

"আয়"।

"আসি"?

"আয়"।

চ্যাটার্জিবাবুর মিটিংয়ে ফেরার তাড়া বিশেষ ছিল না। গলা বুক জ্বালাটা বোধ হয় অসময়ে চা-ফুচকার। অথবা না বলা দলা পাকানো "ধ্যাত, যাব না"র।

ইস্তিরি

গুপ্তিপাড়ার পুটুপিসির আনা সম্বন্ধটা বেশ মনে ধরেছিল মন্টুবাবুর। ফটোতেও কমলার হাসিটা কী উজ্জ্বল, মন ভালো করা। পিসি একপ্রকার ধাঁতানি দিয়েই বলেছিলেন "মেঘে মেঘে বেলা তো কম হল না। কলকাতায় একা একা বাউণ্ডুলে হয়ে আর কদ্দিন পড়ে থাকবি? চাকরীবাকরী করছিস, এ'বার বিয়ে করতেই হবে"।

মন্টুবাবু গাঁইগুঁই যে'টুকু করেছিলেন সে'টুকু স্রেফ লজ্জায়। আদতে ভদ্রলোকের বড় শখ ছিল একটা বিয়ের। আয়নায় সাঁটানো টিপ, কাচে তুলে নেওয়া টিপের ফেলে আসা আঠার ছাপ। আলনায় রংচঙ। আলমারির ছোট লকারে দু'টো হার, কয়েক গাছা চুরি, চার জোড়া দুল। বাথরুম থেকে ভেজা পায়ে বেরোলে মুখ ঝামটা, যার ঝাঁজ ডাইলুট হয়ে যাবে চুরির খনরখনে। ড্রেসিংটেবিলে চোদ্দ রকমের ক্রীম আর লোশন, ঘরময় ফুরফুরে পন্ডসিও সুবাতাস। শীতে চেসমী গ্লিসারিন সাবান, বাকি সময় মোতি স্যান্ডালউড। হপ্তায় একবারের বেশি দু'বার 'মাংস খাবো' গোছের হাভাতে স্লোগান তুললেই ভুঁড়ির খোঁটা খাওয়া। চটপট একটা এলআইসি আর খান কয়েক মিউচুয়াল ফান্ডের কথা ভাবতে হত। মেডিক্লেমটা আর একটু পোক্ত করতে হত। বছরে একবার রাজস্থান বা দার্জিলিং।

আর ছুটির দিনগুলোয় বৌয়ের একবার পরা শাড়িগুলো নিয়ে বসতে হত ইস্তিরি করতে। মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে গুছিয়ে বসে। অপার মনোযোগ দিয়ে ছাপার থেকে তাঁতে, এ রঙ থেকে ও রঙের ওপর ইস্তিরি বোলানো। রান্নাঘর থেকে ডালে ফোঁড়ন দেওয়ার মনমোহিনী গন্ধ ভেসে আসবে। শাড়িগুলোকে পরিপাটি করে বাধ্য গরুদের মত গুনে গুনে আলমারির গোয়ালে চালান করা, আহা। মাংস কষানোটা আবার পুরুষের হাতেই ভালো হয়, মন্টুবাবু সে দায়িত্ব নিজের কাঁধেই রাখতে চান।

কিন্তু স্বপ্ন থাকলেই তো সবসময় স্বপ্নপূরণের পথে পা বাড়ানো সম্ভব হয় না। শত ইচ্ছে থাকলেও মন্টুবাবুকে শেষ পর্যন্ত গুপ্তিপাড়ার ঠিকানায় কমলার ছবিটা ফেরত পাঠাতে হল। মেয়েটার চোখ দেখে বোঝা যায় ওর মনটা কতটা ভালো, কী ভীষণ নিষ্পাপ। অফিসের মানুষজন, পাড়ার কিছু মানুষ আর ছ'মাসে ন'মাসে দেখা হওয়া পুটুপিসিকে ঠকানো যায়। কিন্তু কমলাকে বিয়ে করে অমন দাগা মন্টুবাবু কিছুতেই দিতে পারবেন না।
পাড়া অফিসের লোক আর পিসি আঁচ করতে না পারলেও, ঘরের বৌ কি টের পাবে না? যে বছর দুয়েকে আগের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষদের যে লিস্টিখবর কাগজে বেরিয়েছিল তাতে মন্টুবাবুরও নাম ছিল? বৌ কি টের পাবে না যে মন্টুবাবু হপ্তায় একবার মর্গের সেই ঘরটায় ফেরত যান যে'খানে দু'বছর আগে নিজের বডিটা ফেলে আসতে হয়েছিল?