Friday, October 30, 2020

লক্ষ্মী

- কে? বিমল?

- হ্যাঁ ভজাদা।

- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। ভেতরে আয়।

- না, মানে..ঠিক বলেকয়ে আসার সুযোগ পাইনি তো।  তুমি মক্কেলদের নিয়ে ব্যস্ত আছ কিনা এই ভেবে একটু হেসিটেট করছিলাম আর কী।

- কাতলা আর ওয়াসাবি দিয়েএকটা এক্সপেরিমেন্টাল রেসিপি ফ্রেম করছিলাম।  সে'দিক থেকে বলতে গেলে ব্যস্ত তো বটেই। আয়, বস। এ, কী। ভিজে কাক অবস্থা যে।

- অসময়ের বৃষ্টি। আর এমন ঝমঝমিয়ে নামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে গিয়ে গলির ভিতর দৌড়ে আসতে গিয়েই..।

- উকিলের চেম্বারে ব্যাকআপ শার্ট  এক্সপেক্ট করিস না, গামছাও নেই। তুই বরং শার্টটা খুলে টেবিল ফ্যানের সামনের ওই চেয়ারটায় মেলে দিয়ে বস। আর আমি কফি বানাই গিয়ে। ফ্লাস্কের নয়, টাটকা। সে'সরঞ্জাম আজকাল অফিসেই রাখছি। তবে ব্ল্যাককফি।

- না না। অত ব্যস্ত হয়ো না। আমি এখুনি বেরোব। গলির মুখে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে এসেছি।

- সে কী৷ এমন শশব্যস্ত হয়ে এ'খানে এলি? আমি ভাবলাম ওই ইউসুয়াল তাস আর আড্ডার টানে এসেছিস। তা, কোনও আইনি ফাঁপরে পড়লি নাকি?

- না ভজাদা। 

- তবে?

- ব্যাপারটা খুবই পাতি..।

- বলেই ফেল না বিমল। ভেজা গায়ে অত ভূমিকা ফাঁদার কোনও দরকার নেই।

- আজ সন্ধ্যেবেলা একবার আমার ফ্ল্যাটে ঢুঁ মেরে যেও৷ যদি খুব ব্যাস্ত না থাকো।

- সে কী৷ উইকেন্ড গুলজার? স্কচটচ এনে রেখেছিস নাকি? তা ফোনে বলে দিলেই তো হত..।

- তা হত। তবু, এ'দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই..। তবে ইয়ে, আসরটা ঠিক স্কচ ফিশফ্রাইয়ের নয় কিন্তু।

- ব্যাপারটা কী বল তো?

- আজ লক্ষ্মীপুজো। জানো তো?

- আমি তো জানি। কিন্তু সে'খবরে তোর কী কাজ কে জানে। 

- সকালের দিকে একটা একটা মূর্তি এনেছি জানো। সঙ্গে ধুপ, ধুনো, ফুল আর সামান্য ফল। এই এখন ফিরে গিয়ে খিচুড়ি আর লাবড়া রাঁধব। সময় পেলে লুচি আর পায়েসও।

- প্রবল নাস্তিক শ্রীমান বিমল হালদারের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো? অথচ আমি কতদিন বলেছি চ' একবার আমার বেনারসের গুরুজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ফ্যাসিনেটিং ক্যারেক্টার আর ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন। সে'বেলা যত বইপড়া বাতেলা।  

- ব্যাপারটা ঠিক তা নয়৷ পুরুতঠাকুর কেউ আসছে না৷ সে অর্থে পুজোও হবে না।  তবে আমি পাঁচালি পড়ব। তুমি আসবে ভজাদা? আর কাউকে ডাকতে ঠিক সাহস পাচ্ছিনা।

- তোর শরীর ঠিক আছে? তুই পাঁচালি পড়বি? আমার গুরুজির চেয়েও হাইক্লাস কারুর পাল্লায় পড়লি নাকি?আর তাছাড়া হঠাৎ এই পুজো..।

- খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল ভজাদা। খুব। 

- আই সী।

- এই পুজোর দিনটায় মা উপোস করত। নির্জলা। গোটাদিন কেটে যেত ভোগ রান্না আর পুজোর জোগাড়যন্ত্রে৷ সন্ধ্যেবেলা পুরুতমশাই এলে শুরু হত লক্ষ্মীপুজো। তারপর মায়ের পাঁচালী পড়া। দুলে, দুলে। সে কী অপূর্ব রিদম ভজাদা। ভোগের ভুনো খিচুড়ি, বেগুনভাজা, সুজির হালুয়া, লুচি, পায়েসের পাশাপাশি ধুপ, ধুনো, ফুলফুলের গন্ধ মিশে যে কী মনভালো করা একটা ব্যাপার হত। তবে সমস্ত সুগন্ধ ছাপিয়ে যে'টা মনে লেগে থাকত সে'টা হল মায়ের সুবাস। মায়ের সুবাস অবশ্য রিক্রিয়েট করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু বাকি গন্ধগুলোর জন্য হঠাৎ কেমন করে উঠল। ঈশ্বর বিশ্বাস নয়..। 

- তোরও বুঝি নির্জলা উপোস আজ? তাই কফি রিফিউজ করলি? বেশ, আমি বরং একটু আগেই যাব। পায়েসটা আমিই চাপাব'খন৷ আমার তাসের পার্টনার রতন মল্লিক গেলে কোনও অসুবিধে নেইতো? পুরুত সে নয়। তবে বড় ভালো বাউল গায়। আজ রাতে তোকে একা রাখব না ভাবছি। তোর পাঁচালী পাঠের অডিয়েন্সও একজন বাড়বে আর রাতের আড্ডায় তোর মনখারাপ বাড়লে বাউলেরও বন্দোবস্ত থাকবে।

- শেষের কয়েকবছর লক্ষ্মীপুজোয় বাড়ি ফিরতে পারিনি জানো। কাজের চাপে। মা অবিশ্যি কোনওদিনও অভিযোগ করত না।

- অভিযোগ করলে ভালো হত, তাই না রে বিমল?

- হেহ্। হয়তো। এই লক্ষ্মীপুজোর দিনটায় এমন দড়াম করব মায়ের কথা মনে পড়ে গেল..। এমন একটা অদ্ভুত আনচান। যাকগে, এখন আসি। দশকর্মার দোকান থেকে কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে। 

- ঈশ্বরবিশ্বাসে তোর কাজ নেই। তবে এই আনচানটুকুও আস্তিকতা। বুঝলে বিমলচন্দ্র? নাহ্, আজ আর মক্কেলের অপেক্ষায় চেম্বারে বসে থেকে লাভ নেই। চ', আমিও বরং তোর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ি।

সেতু কার

- কে? বিমল?

- হ্যাঁ ভজাদা।

- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। ভেতরে আয়।

- না, মানে..ঠিক বলেকয়ে আসার সুযোগ পাইনি তো।  তুমি মক্কেলদের নিয়ে ব্যস্ত আছ কিনা এই ভেবে একটু হেসিটেট করছিলাম আর কী।

- কাতলা আর ওয়াসাবি দিয়েএকটা এক্সপেরিমেন্টাল রেসিপি ফ্রেম করছিলাম।  সে'দিক থেকে বলতে গেলে ব্যস্ত তো বটেই। আয়, বস। এ, কী। ভিজে কাক অবস্থা যে।

- অসময়ের বৃষ্টি। আর এমন ঝমঝমিয়ে নামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে গিয়ে গলির ভিতর দৌড়ে আসতে গিয়েই..।

- উকিলের চেম্বারে ব্যাকআপ শার্ট  এক্সপেক্ট করিস না, গামছাও নেই। তুই বরং শার্টটা খুলে টেবিল ফ্যানের সামনের ওই চেয়ারটায় মেলে দিয়ে বস। আর আমি কফি বানাই গিয়ে। ফ্লাস্কের নয়, টাটকা। সে'সরঞ্জাম আজকাল অফিসেই রাখছি। তবে ব্ল্যাককফি।

- না না। অত ব্যস্ত হয়ো না। আমি এখুনি বেরোব। গলির মুখে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে এসেছি।

- সে কী৷ এমন শশব্যস্ত হয়ে এ'খানে এলি? আমি ভাবলাম ওই ইউসুয়াল তাস আর আড্ডার টানে এসেছিস। তা, কোনও আইনি ফাঁপরে পড়লি নাকি?

- না ভজাদা। 

- তবে?

- ব্যাপারটা খুবই পাতি..।

- বলেই ফেল না বিমল। ভেজা গায়ে অত ভূমিকা ফাঁদার কোনও দরকার নেই।

- আজ সন্ধ্যেবেলা একবার আমার ফ্ল্যাটে ঢুঁ মেরে যেও৷ যদি খুব ব্যাস্ত না থাকো।

- সে কী৷ উইকেন্ড গুলজার? স্কচটচ এনে রেখেছিস নাকি? তা ফোনে বলে দিলেই তো হত..।

- তা হত। তবু, এ'দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই..। তবে ইয়ে, আসরটা ঠিক স্কচ ফিশফ্রাইয়ের নয় কিন্তু।

- ব্যাপারটা কী বল তো?

- আজ লক্ষ্মীপুজো। জানো তো?

- আমি তো জানি। কিন্তু সে'খবরে তোর কী কাজ কে জানে। 

- সকালের দিকে একটা একটা মূর্তি এনেছি জানো। সঙ্গে ধুপ, ধুনো, ফুল আর সামান্য ফল। এই এখন ফিরে গিয়ে খিচুড়ি আর লাবড়া রাঁধব। সময় পেলে লুচি আর পায়েসও।

- প্রবল নাস্তিক শ্রীমান বিমল হালদারের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো? অথচ আমি কতদিন বলেছি চ' একবার আমার বেনারসের গুরুজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ফ্যাসিনেটিং ক্যারেক্টার আর ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন। সে'বেলা যত বইপড়া বাতেলা।  

- ব্যাপারটা ঠিক তা নয়৷ পুরুতঠাকুর কেউ আসছে না৷ সে অর্থে পুজোও হবে না।  তবে আমি পাঁচালি পড়ব। তুমি আসবে ভজাদা? আর কাউকে ডাকতে ঠিক সাহস পাচ্ছিনা।

- তোর শরীর ঠিক আছে? তুই পাঁচালি পড়বি? আমার গুরুজির চেয়েও হাইক্লাস কারুর পাল্লায় পড়লি নাকি?আর তাছাড়া হঠাৎ এই পুজো..।

- খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল ভজাদা। খুব। 

- আই সী।

- এই পুজোর দিনটায় মা উপোস করত। নির্জলা। গোটাদিন কেটে যেত ভোগ রান্না আর পুজোর জোগাড়যন্ত্রে৷ সন্ধ্যেবেলা পুরুতমশাই এলে শুরু হত লক্ষ্মীপুজো। তারপর মায়ের পাঁচালী পড়া। দুলে, দুলে। সে কী অপূর্ব রিদম ভজাদা। ভোগের ভুনো খিচুড়ি, বেগুনভাজা, সুজির হালুয়া, লুচি, পায়েসের পাশাপাশি ধুপ, ধুনো, ফুলফুলের গন্ধ মিশে যে কী মনভালো করা একটা ব্যাপার হত। তবে সমস্ত সুগন্ধ ছাপিয়ে যে'টা মনে লেগে থাকত সে'টা হল মায়ের সুবাস। মায়ের সুবাস অবশ্য রিক্রিয়েট করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু বাকি গন্ধগুলোর জন্য হঠাৎ কেমন করে উঠল। ঈশ্বর বিশ্বাস নয়..। 

- তোরও বুঝি নির্জলা উপোস আজ? তাই কফি রিফিউজ করলি? বেশ, আমি বরং একটু আগেই যাব। পায়েসটা আমিই চাপাব'খন৷ আমার তাসের পার্টনার রতন মল্লিক গেলে কোনও অসুবিধে নেইতো? পুরুত সে নয়। তবে বড় ভালো বাউল গায়। আজ রাতে তোকে একা রাখব না ভাবছি। তোর পাঁচালী পাঠের অডিয়েন্সও একজন বাড়বে আর রাতের আড্ডায় তোর মনখারাপ বাড়লে বাউলেরও বন্দোবস্ত থাকবে।

- শেষের কয়েকবছর লক্ষ্মীপুজোয় বাড়ি ফিরতে পারিনি জানো। কাজের চাপে। মা অবিশ্যি কোনওদিনও অভিযোগ করত না।

- অভিযোগ করলে ভালো হত, তাই না রে বিমল?

- হেহ্। হয়তো। এই লক্ষ্মীপুজোর দিনটায় এমন দড়াম করব মায়ের কথা মনে পড়ে গেল..। এমন একটা অদ্ভুত আনচান। যাকগে, এখন আসি। দশকর্মার দোকান থেকে কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে। 

- ঈশ্বরবিশ্বাসে তোর কাজ নেই। তবে এই আনচানটুকুও আস্তিকতা। বুঝলে বিমলচন্দ্র? নাহ্, আজ আর মক্কেলের অপেক্ষায় চেম্বারে বসে থেকে লাভ নেই। চ', আমিও বরং তোর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ি।

অরুর গান

- একবার গান গাইতে বসলে অরুর আর সময় জ্ঞান থাকেনা।

- তাই নাকি?

- একদম৷ এই দেখ। বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে। সেই তিনটে নাগাদ গলা সাধতে বসেছে। 

- বটে।

- জানিস মন্টু, অরুর সুরে বড় মায়া আছে৷ অনেকটা ব্যথাও মিশে আছে অবিশ্যি। এমনিতে হাসিখুশি ছটফটে হলে কী হবে, ছেলেবয়সে মাকে হারানোর যন্ত্রণাটা কি সহজে ভোলা যায়? মিনুর না থাকার ব্যথাটা ও সর্বক্ষণ বয়ে বেড়ায়। হ্যাঁ রে মন্টু, তুই এলেই মিনু কতরকমের পদ রান্না করতে বসত..মনে আছে?

- বৌদির হাতের রান্না ভোলা অসম্ভব। 

- না হয় সে চলেই গেছে। মানছি, আমার হেঁসেল বিদ্যেয়  ডাল ডিমের অমলেটের বেশি রেঁধে খাওয়ানো সম্ভব নয়৷ তাই বলে দাদা ভাইপোর খবর নিতে মাঝেমধ্যে আসবি না? বছর দুয়েক পর তুই এ বাড়িতে এলি মন্টু।

- ফোন তো নিয়মিত করি রে দাদা।

- তা করিস। নাহ্, খোঁজখবর তুই রাখিস বটে। আমিও অরুকে তাই তো বলি, রক্তের টান ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আর তাছাড়া..। ওহ্। আহা৷ এই যে।

- কী হল রে দাদা?

- অরু এ'বার একটা নজরুলগীতি ধরেছে৷ শুকনো পাতার নুপুর পায়ে৷ আহা। মিনু খুব গাইত। 

- দাদা, অরু গান করছে না।

- তুই শুনতে পারছিস না হয়ত। কিন্তু অরু গান গাইছে মন্টু৷ ওই যা না পাশের ঘরে, দেখ কেমন দরদ দিয়ে গাইছে।

- কিছু মনে করিসনা দাদা। তোর মাথাটা গেছে৷ আর আমার চিন্তা হচ্ছে যে তোর এই পাগলামো অরুকে আরও এফেক্ট করবে।

- কিন্তু অরু গান গাইতে বসে রে মন্টু৷ বিশ্বাস কর..।

- কারণ ওর মাথাটাও ঠিক ব্যালেন্সড নেই। আর সেই গোলমালকে তুই আরও প্রশ্রয় দিচ্ছিস।

- কী বলছিস তুই মন্টু!

- ঠিকই বলছি। অরু কথা বলতে পারেনা৷ বৌদির মারা যাওয়ার শকে হি লস্ট হিস স্পীচ। এই রিয়ালিটি থেকে পালিয়ে বেড়ালে ওর মঙ্গল হবে ভেবেছিস? বৌদির হারমোনিয়াম আঁকড়ে মাঝেমধ্যে সে পাগলামো শুরু করে আর তুই সেই পাগলামোকে তোল্লাই দিচ্ছিস এই সব করে৷ 

- না রে মন্টু। শুনতে পাই তো। বিশ্বাস কর। অনুভব করতে পারি ওর সুরের স্পর্শ। আমার চামড়ায় এসে ঠেকে সে সুর। অরু ওর মায়ের হারমোনিয়াম আঁকড়ে গান করার ভান করেনা, সে গান গায়। গতকাল সন্ধ্যেয় সে অতুলপ্রসাদ ধরেছিল। চোখে জলে এসে গেছিল মন্টু। বিশ্বাস কর।

- দ্যাখ দাদা, অরু এখন বোবা।

- মন্টু। তুই এ'বার আয়।

- দাদা! 

- আয়। আর নয়। 

**

অরুর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন বিমলেন্দু। সাদা নীল চাদরে ঢাকা বিছানার ওপর বসে অরু চোখ বুজে গাইছে, হারমোনিয়ামটা ছুঁয়ে আছে শুধু। 
শব্দ নেই, আছে শুধু সুরের শিহরণ।  

"আহা রে, খোকার মা নেই"। মিনুর ওপর মাঝেমধ্যেই বড় রাগ হয়। বদ্ধ কালাদের দুনিয়ায় অরুকে ফেলে চলে গেল সে। 

ততক্ষণে অরু রবীন্দ্রনাথে এসেছে। 

"আমার সুরের রসিক নেয়ে-
তারে ভোলাব গান গেয়ে..."।

Wednesday, October 28, 2020

সুবিনয়বাবু আর মনু


- আরে। মনু না?

- মনু? 

- তুই মনুই তো? প্রেসিডেন্সি? বারুইপুর বুলেটসের সেন্টার ফরওয়ার্ড? ফুচকা চ্যাম্পিয়ন? 

- জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ছেলেবেলা থেকে ক্রনিক হাঁপানি, তাই ফুটবল জীবনে খেলিনি।  বারুইপুরের ছোটপিসি থাকে বটে তবে ও'দিকে  বড় একটা যাওয়া হয়না। আর ক্লাস সেভেন থেকে গ্যাস্ট্রিক আলসারে জেরবার, একবারে ম্যাক্সিমাম তিনটে ফুচকা খেতে পারি, আলু আর টক জল ছাড়া।

- তা'হলে তো মনুর সঙ্গে মিলছে না। কিন্তু চেহারায় কোথায় যেন একটা স্ট্রাইকিং ইয়ে আছে। 

- স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার হল,আপনকে দেখেও আমার ঠিক তেমনই একটা ইয়ে বোধ হয়েছিল। চেহারায় ঠিক কোথায় যেন..।

- আপনি শিওর আপনি মনু নন?

- সেন্ট পার্সেন্ট৷ মানিব্যাগে আধার কার্ড আছে৷ চাইলে দেখতে পারেন।  আমি সুবিনয় দত্ত৷। কিন্তু ব্যাপারটা খুব ইন্ট্রিগিং, এই আপনার চেহারা দেখেও আমার এমন এই ইয়ে হওয়াটা৷ চেনা চেনা যেন। যাক গে, ভেরি সরি ভায়া৷ আমি মনু নই। খুব আশা করেছিলেন নিশ্চয়ই..পুরনো চেনামুখের সঙ্গে দেখা হল ভেবে। 

- কী আর করা যাবে বলুন।

- তা আপনার নামটা তো জানা হল না।

- আমার নাম? মনু। 

- এক্সকিউজ মি?

- মনু।

- আপনিই মনু? 

- প্রেসিডেন্সি। বারুইপুর বুলেটস। ফুচকা চ্যাম্পিয়ন৷ 

- কিন্তু তবে যে এই..।

***

গড়িয়াহাটের মোড়ে হঠাৎ দেখা৷ আর সামান্য গোলমেলে কথাবার্তার পর ভদ্রলোক যেন স্রেফ উবে গেলেন৷ এই মিস্টরিয়াস মনুকে নিয়ে সুবিনয়বাবুর মনে এক বিশ্রী অস্বস্তি তৈরি হল। সে অস্বস্তি কাটাতে সুবিনয়বাবু গিয়ে দাঁড়ালেন  দাস কেবিনের সামনে। গায়ে পড়ে এমন ফাজিল আলাপ করার কোনও মানে হয়?

দোকানের ভিতর থেকে স্পেশ্যাল মোগলাইয়ে সুবাস নাকে আসতেই সুবিনয়বাবুর ব্রেনে লাগল হাইভোল্টেজ স্পার্ক। তাই তো! মনু তো অচেনা নয়৷ বছর কুড়ি আগে, কলেজে পড়ার সময় নিজের ডায়েরীতে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন। দেড়শো পাতা পর্যন্ত তরতর করে সে'উপন্যাস এগিয়েওছিল। কিন্তু আর পাঁচটা ছেলেমানুষি ঝোঁকের মত সে লেখাটাও অসম্পূর্ণই রয়ে গেছিল। সেই অসম্পূর্ণ উপন্যাসের নায়ক মানবেন্দ্র ওরফে মনু চেহারায় ও স্বভাবে সুবিনয়েরই মত। কিন্তু সুবিনয়ের দুর্বলতাগুলো মনুর মধ্যে আদৌ নেই৷ মনু যেমন স্মার্ট, তেমনি সাহসী, তেমনি রোম্যান্টিক আর তেমনি চাবুক তার স্বাস্থ্য। 

 নিশ্চয়ই কোনও ব্যাটা সে ডায়েরী হাতিয়ে সে লেখা পড়েছে। আর তারপর আজ এসে গায়ে পড়ে সুবিনয়বাবুর ওপর এমন একটা বিচ্ছিরি প্র‍্যাক্টিকাল জোক চাপিয়ে সরে পড়ল। একটা তেতো স্বাদ সুবিনয়বাবুর গোটা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। দাস কেবিনের মোগলাই সুবাসও তার মনের চনমন ফেরাতে পারল না। কিন্তু ট্রাঙ্কে রাখা পুরনো ডায়েরী খুলে পড়ল কে? সর্ষের মধ্যে এমন ঘোড়েল ভূত এলো কী করে? প্রথমেই সন্দেহটা গিয়ে পড়ল নিজের ফিচেল শ্যালকটির প্রতি৷ 

যা হোক, মিনিবাসের বদলে ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি ছুটলেন সুবিনয়বাবু। 

**

ট্রাঙ্কের তালা ভাঙতে হল। সেই সাতপুরনো বহুবছরের জং পড়া তালার চাবি অনেক আগেই হারিয়েছে। কাজেই ডায়েরীটা বেহাত হওয়ার কথা নয়। ডায়েরী খুলতেই সুবিনয়ের চক্ষু চড়কগাছ।  উপন্যাসের জন্য লেখা দেড়শো পাতা লেখা গায়েব৷ পাতা গায়েব নয়, শুধু লেখা গায়েব। অথচ প্রথম পাতায় নিজের নাম দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়না এ ডায়েরী সে ডায়েরীই।

তার বদলে পড়ে রয়েছে বিটকেল দু'লাইন। নিজের জঘন্য হাতের লেখা নিয়ে সুবিনয়বাবুর লজ্জার সীমা নেই৷ কিন্তু এই দু'লাইন লেখা রয়েছে মুক্তোর মত হাতের লেখায়৷ 

"সরকারী চাকরী, সংসার, হাঁপানি আর গ্যাস্ট্রিকে সুবিনয় বন্দী থাকতে পারে। কিন্তু ট্রাঙ্কের তালায় বা ডায়েরীর পাতায় এ শর্মাকে আটকে রাখা যাবে না।

- ইতি মনু"।

Thursday, October 22, 2020

দ্য গ্র‍্যান্ড তুকতাক

- কী চাই?

- হুঁ?

- কী চাই? চাকরীতে টপাটপ প্রমোশন বাগানোর মাদুলি? শুগার কন্ট্রোলে রাখার তাবিজ? হাড়বজ্জাত মানুষজনের বদনজর এড়িয়ে চলার জন্য কবচ?

- কই, না তো।

- তা'হলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসা কেন?

- দ্যাখ বুড়ো..।

- আমার সঙ্গে যারাই দেখা করতে আসে তারা আমায় চমৎকারিবাবা বলে ডাকে। আপনি-আজ্ঞে করে নুয়ে পড়ে। 

- তাঁরা তো আর তোর বাপ নয় বুড়ো।

- উফ। আদত তন্ত্রসাধকের বাপ-ঠাকুরদা থাকতে নেই।

- প্রায় এক বছর হতে চলল বাড়ি ছেড়ে এইসব ফোরটুয়েন্টিগিরি শুরু করেছিস।  আর কতদিন!

- ফোরট্যুয়েন্টিগিরি?  আমি রেগে গেলে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটে যাবে কিন্তু। 

- মানছি আমি একসময় তোর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি৷ পারিবারিক ব্যবসায় ফাঁকি দিচ্ছিস দেখে মেজাজ খিঁচড়ে গেছিল, না হয় ভালোমন্দ চারটে কথা বলেই দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে তুই তারাপীঠে এসে পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙার ব্যবসা শুরু করলি রে বুড়ো? 

- আর একটাও আজেবাজে কথা শুনলে এমন বাণ মারব..।

- বাড়ি ফিরে চল বুড়ো। আমি না হয় মায়াদয়াহীন স্ক্র‍্যাপের দালাল। মায়ের কথা ভেবে অন্তত বাড়ি ফের।

- তন্ত্রসাধকের আবার বাড়ি। তন্ত্রসাধকের আবার মা।

- তুই না হয় বাড়িতে গিয়েই একটা এই হোকাসপোকাসের চেম্বার খুলে বসিস বুড়ো। আমি নিজের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব। নীচের তলার একটা ঘরে সর্ষের তেলের গোডাউন করব ভাবছিলাম। সে'খানে বসেই না হয় তুই  মাদুলি বেচিস।

- সাধনাটাকে ধান্দাবাজি বলে হ্যাটা করাটা রীতিমত অন্যায়৷  শ্মশানের মড়াপোড়া হাওয়া গায়ে না ঠেকলে তন্ত্রসাধনা চলে না। আর তাছাড়া গেরস্থালির গুমোট পরিবেশে আর আমায় বাঁধা সম্ভব নয়৷ 

- সম্ভব নয়?

- কভি নহি।

- কোনও ভাবেই আর তোকে বাড়ি ফেরানো যাবে না?

- শ্মশানকালী প্রাইভেটলি স্বপ্নে এসে রিকুয়েস্ট করলেও নড়ছি না। 

- হ্যাঁ রে বুড়ো, কাল থেকে পুজো। পুজোয় বাড়ি ফিরবি না?

- হুঁ?

- পুজোয় বাড়ি ফিরবি না?

- পুজো? বাড়ি। পুজো। বাড়ি।

- কী হল বুড়ো?

- না মানে...যদিও তন্ত্রসাধনায় পুজো পুজো আদেখলামো থাকতে নেই..।

- কাল থেকে পুজো। বাড়ি ফিরবি না তুই?

- বাবা।  পুজো সত্যিই এসে গেল। তাই না?

- তাই তো। এসেই গেলো।

- আমি বাড়ি যাব বাবা। বাড়ি যাব।

- আলবাত যাবি। পুজোয় বাড়ি না গেলে চলে?

বুড়োকে বাড়ি ফেরানোর তুকতাকটি চমৎকারিবাবার বাপ দিব্যি জানতেন। বাড়ি ফেরার নিশির ডাক - "পুজো"।

Tuesday, October 13, 2020

মামা ও বিরিয়ানি রহস্য


- কী হল মামা! বিরিয়ানিতে কবজি না ডুবিয়ে অমন গুম মেরে বসে রইলে যে?

- ক্যালামিটি!

- সে কী।

- ক্যাটাক্লিজম।

- আরে হয়েছেটা কী?

- রাহাজানি। 

- উফ! বিরিয়ানির খুশবুতে গড়বড়? 

- না। পার্ফেক্ট সৌরভ নাকে বুকে কভারড্রাইভ চালাচ্ছে৷ সমস্যা অন্য জায়গায়৷ 

- কোথায়?

- আমি নিজে দু'প্লেট বিরিয়ানি প্যাক করিয়ে এনেছি ভাগ্নে। নিজের হাতে করে বয়ে এনেছি সেই দু'প্যাকেট।

- তবে?

- তোর প্লেটে পরিমাণ ঠিক আছে৷ কিন্তু আমার প্লেটে..।

- কম? 

- কম।

- কিন্তু আমার চোখে তো..।

- শুধু চোখ দিয়ে বিরিয়ানির তল পাবি নাকি রে রাস্কেল?

- স্পষ্ট দেখছি তো, সেম কোয়ান্টিটি। 

- কাঁচকলা। আমার প্লেটে কম।

- কতটা কম?

- এককণা চাল কম। 

- তুমি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ মামা?

- ডেড সিরিয়াস। বিরিয়ানি নিয়ে ফচকেমো আমি বরদাস্ত করতে পারিনা।  

- তোমার সামনেই তো প্যাকেট থেকে প্লেটে ঢাললাম। এই দেখো বাক্স। এক কণাও চাল এখানে পড়ে আছে কি? নেই। শেষ কণাটুকু  প্যাকেট থেকে থালায় ট্রান্সফার করেছি। আর টেবিলেও ভালো করে দেখো। এক কণাও কোথাও পড়ে নেই। উফ, আমি এই আজগুবি অভিযোগের উত্তরই বা কেন দিচ্ছি কে জানে।

- একসময় পৃথিবীর রোটেশন আর রিভোলউশন ব্যাপারটাও মানুষ আজগুবি বলে মনে করত। যাকগে। নাহ্, বিরিয়ানি ঢালতে গিয়ে তুই কোনও রকম অযত্ন করিসনি। কিন্তু তবু, একদানা অমৃত চাল যে কোথায় গায়েব হল রে ভাগ্নে...।

- যত্তসব পাগলামো। এক কণা চাল নাকি পাতে কম পড়েছে। তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে মাম,  মামী ঠিকই বলে। তুমি বিরিয়ানির প্লেট থেকে হারিয়ে যাওয়া এককণা হারানো চাল নিয়ে শোকসভা বসাওগে যাও৷ আমি বরং  খাওয়া শুরু করছি।

- হাই-ক্লাস বিরিয়ানির থালা থেকে হাপিস হওয়া এক কণা চালের দাম বোঝার বয়স তোর হয়নি ভাগ্নে। হয়নি। 


*****

- এই যে কেষ্টা! পাঞ্চালী কতক্ষণ ধরে টেলিপ্যাথেটিকালি তোমায় ডেকে ডেকে হন্য হচ্ছে৷ আর এতক্ষণে তোমার আসার সময় হল?

- যুধিদা। তোমার সবেতেই টেনশন। কেসটা কী?

- আরে ফরেস্ট ক্যাম্পের লাঞ্চমেনুতে আজ খিচুরি মামলেট ছিল। খেয়েদেয়ে আয়েস করে সবে লম্বা হওয়ার তাল করছি- এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত। দুর্বাসা স্যার হাজির। এক্কেবারে সদলবলে।

- এই সেরেছে। খিটখিট বুড়ো আবার এই ভরদুপুরে জঙ্গলে কেন? দু'দিন আগেই তো তাঁকে দুর্যোধনের বাড়িতে ফুর্তি করতে দেখলাম। 

- ওই রাস্কেল দুর্যোরই কারসাজি এ'টা। খেপচুরিয়াস দুর্বাসাকে অসময়ে এ'খানে লাঞ্চে করতে পাঠিয়েছে যাতে আমরা খাওয়াতে না পেরে অপদস্থ হই। আর তারপর একটা অভিশাপ-টভিশাপ দিলেই চিত্তির। 

- তা দুর্বাসা আর তাঁর দলবল এখন কই?

- নদীতে নাইতে গেছে। তবে ফিরে এলো বলে। এ'দিকে হেঁসেল খালি। পাঞ্চালী গোঁ ধরে বসে আছে - কিছুতেই সে এই অসময়ে গেস্টদেরর জন্য নতুন করে রান্না চাপাতে পারবে না। 

- কেসটা সিরিয়াস। তবে চাপ নিওনা যুধিদা। ম্যায় হুঁ না। খিচুড়ির হাঁড়িটা আমার কাছে  নিয়ে এসো দেখি।

- তা'তে কী হবে? সে হাঁড়ি খালি পড়ে আছে।

- ও একদানা চাল পড়ে থাকলেও হবে।

- ভীম ওই হাঁড়ি থেকে ডাইরেক্টলি খায় কেষ্টা। এককণাও পড়ে থাকার চান্স নেই। হাঁড়িখানা পড়ে আছে তাই বাপের ভাগ্যি।

- আরে আনো না হাঁড়িটা। আমি না হয় মন্ত্রবলে এক কণা চাল সে'খানে নিয়ে আসব'খন। যে সে চালের কণা নয়- এক্কেবারে সুপার ইস্পেশ্যাল ভাতের কণা। সেই এক দানা চাল আমি নিজের মুখে চালান করলেই জগৎসংসারের খিদে গায়েব হবে। দুর্বাসা আর তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারাও ঢেঁকুর তুলতে তুলতে কেটে পড়বে, পাতপেড়ে খাওয়ার সাহস আর তাঁদের থাকবে না।

- বাহ্। তুকতাক ভালোই শিখেছ কিন্তু কেষ্টা। তা, এই ইস্পেশাল ভাতের কণাটা আসবে কোথা থেকে?

- বিরিয়ানি নামের একটি পদ থেকে তুলে আনতে হবে যুধিদা। স্ট্রেট ফ্রম দ্য ভবিষ্যৎ। যাও, এ'বার ফাঁকা হাড়িটা নিয়ে এসো দেখি।

Monday, October 5, 2020

অমলকান্তির অফিসে


সকাল সকাল বসের তলব। 

অমলকান্তি তড়িঘড়ি ছুট দিলেন বসের ঘরের দিকে। পৌঁছে দরজায় একটা মোলায়েম টোকা। তারপর গুলকন্দ মেশানো গলায় শুধোলেন
"স্যার, আসব"?

উত্তর এলো টিনের ওপর ইটপাটকেল পড়া বাজখাঁই সুরে।

"আপনাকে নিশ্চয়ই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নজরুলগীতি গাওয়ার জন্য ডাকিনি। ভিতরে এসে উদ্ধার করুন"।

অমলকান্তি বুঝলেন হাওয়া সুবিধের নয়। নিজের গোবেচারা না-ঘরকা-না-ঘাটকা হাসিখানা মুখে সেঁটে ঘরের মধ্যে পা রাখলেন।

"আচ্ছা অমলকান্তিবাবু, আপনি কি আমায় বোকা ভাবেন? ডু ইউ থিঙ্ক আই অ্যাম আ ড্যাম ফুল"?

ভেবড়ে গেলেন অমলকান্তি। এই ধরণের প্রশ্নের সামনে অধোমুখ নেকুসম্রাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকেনা৷ কিন্তু সকাল সকাল এই রাফায়েল-বোফর্স মেশানো আক্রমণের কারণটা ধরতে পারলেন না৷ 
শর্মা অ্যান্ড শর্মার ফাইলটা জমা হয়ে গেছে৷ 
গতকাল সন্ধ্যেয় ঘণ্টা দুই বাড়তি বসে গতমাসের স্টেটমেন্টখানাও রিকনসাইল করা হয়ে গেছে। 

তবে? 

সেই 'তবে'র তল আর পেলেন অমলকান্তি। কী একটা অতি-খুচরো প্রসঙ্গ তুলে উত্তমমধ্যম শুরু করলেন বস। মিউমিউ করে দু'চারটে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু সেই মিউমিউ বসের মেজাজের আগুনে কেরোসিন হয়ে  ঝরে পড়ল। ঝাড়া মিনিট দশেক কথায় কথায় খড়মপেটা করে তবে অমলকান্তিকে মুক্তি দিলেন বস। 

ইস্তিরি করা পরিপাটি শার্ট প্যান্টের আড়ালে ভাঙচুর হয়ে যাওয়া মনটাকে লুকিয়ে কোনওক্রমে নিজের চেয়ারে এসে গা এলিয়ে দিলেন অমলকান্তি। কড়া করে এক কাপ ব্ল্যাক কফি না পেলেই নয়। সোজা হাঁক পাড়লেন;

- অ্যাই শিবু!

- এই যে অমলদা।

- কথা কি কানে যায় না? অফিসে আসিস কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে? মাইনেটা কি কোম্পানি মাগনা দেয়?

- সে কী অমলদা। সাড়া দিলাম তো।

- চোদ্দবার ডাকার পর।

- কই...আমি তো প্রথম ডাক শুনেই..।

- আমি কি মিথ্যে বলছি? অ্যাঁ? ইয়ার্কি হচ্ছে?

- ছি ছি। আপনি মিথ্যে বলবেন কেন।

- তুই কি আমায় বোকা ভাবিস? ডু ইউ থিঙ্ক আই অ্যাম আ ড্যাম ফুল?

- না না..সে কী!

- দ্যাখ শিবু, বাজে কথায় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। সামান্য এক কাপ কফির জন্য যদি এত কথা বলতে হয়, তা'হলে কাজ হয়েছে আর কী।

- আমি এখুনি কড়া করে এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে আসছি অমলদা।

- কে চেয়েছে কড়া করে কফি? কে চায় ব্ল্যাক?

- ইয়ে..আপনি তো ওই কড়া ব্ল্যাক কফিই পছন্দ করেন..।

-  যত আজেবাজে কথা! ব্ল্যাককফি নাকি আমার পছন্দ। ইডিয়ট। বেশি দুধ বাড়তি চিনি দিয়ে এক কাপ নিয়ে আয় এখুনি। চট করে। ক্যুইক। আমার অত সময় নেই। বড়সাহেব একটা জরুরী কাজ দিয়েছেন।

শিবু কফি আনতে যেতেই খানিকটা শান্ত বোধ করলেন অমলকান্তি। 

ও'দিকে ওভেনে কফির সসপ্যানটা চাপাতেই শিবুর পকেটের ফোনটা বেজে উঠল। 
বাবা।

- হ্যালো।

- শিবু, শোন একটা জরুরী কথা ছিল..।

- কতবার বলেছি, অফিসে আমায় ফোন করবে না! হাজার রকমের দায়িত্ব আমার কাঁধে। অমলদা একটা জরুরী কাজ দিয়েছে। এখন ফোনে খেজুর করার সময় আমার নেই।

বলে ফোনটা খটাস্ করে কেটে দিলো শিবু।

চাউমিনার


রাস্তা ঘেঁষা চাউমিনের স্টলগুলোর সবচেয়ে বড় 'প্লাস পয়েন্ট' হলো চাউমিন রান্নাটা আগাগোড়া দেখা যায় এবং উপভোগ করা যায়। বড় রেস্তোরাঁর (বা জোম্যাটোর মাধ্যমে আনানো) চাউমিন প্রথমেই দেখা যায় প্লেটে। চাউমিনের গায়ে কী'ভাবে রং ধরল, সে'টুকু 'অবজার্ভ' করতে না পারলে তৃপ্তি হয়না৷ 

সামান্য পেঁয়াজকুচি আর অনেকটা কুচনো বাঁধাকপি (কিছু ক্ষেত্রে সামান্য রুখাশুখা গাজর কুচিও থাকে) ফায়্যার হবে চাটুর গরম তেলে। মনে রাখা দরকার- 'রাস্তার' চাউমিনে বিনস, বেলপেপার গোছের বাড়তি শখ-শৌখিনতা অদরকারি,সে'খানে চাই মারকাটারি অ্যাকশন । 

চাউমিনের চাটুর ওপর খনখনাখন্ খুন্তি নাড়ার শব্দ, আহা; এর তুলনা শুধু অমলেট বানানোর আগে স্টিলের গেলাসে চামচ দিয়ে ডিম ফেটানোর খটখটর মিঠে শব্দের তুলনা চলতে পারে৷ যা হোক৷ কথা হচ্ছিল চাউমিন নিয়ে। ভাজা পেঁয়াজ আর বাঁধাকপির মধ্যে পড়বে চাউমিন, বাড়বে চাউমিন-ভাজিয়ের ব্যস্ততা৷ পড়বে নুন, মশলা আর (যতই খুঁতখুঁত করুন না কেন) আজিনামোটোর গুঁড়ো। বাতাসে ভেসে বেড়াবে সুবাস। আর সে সুবাসে চড়চড়ে বিদ্যুৎ যোগ হবে ভিনিগার ছড়িয়ে দেওয়া মাত্র। জিভের মধ্যে সুড়ুৎ খেলে যাবে জল। এরপর যেই চাউমিন-ভাজিয়ে সোয়্যাসসের বোতলে হাত দেবেন, আমি হাঁ হাঁ করে উঠব "অল্প, একদম অল্প, কয়েক ফোঁটা মাত্র। কেমন"?

চাউমিন তখন প্রায় তৈরি। চাটুর একপাশে সে চাউমিন সরিয়ে রেখে চাটুর খালি জায়গায় ফের খানিকটা তেল ছড়িয়ে তার ওপর ফেলে দেওয়া হবে ফেটানো জোড়া-ডিম। খুন্তি দিয়ে নির্দয়ভাবে কচুকাটা করা হবে সে ডিমভাজা। বাবলর‍্যাপ ফাটানোর মতই এই চাটুর ওপর ভাজা ডিম ক্ষতবিক্ষত করাটাও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক কাজ। যা হোক, তারপর সেই চাউমিন আর ভাজাডিম মিলে মিশে একাকার।

চাটু থেকে সে চাউমিন নামানোর আগে চাউমিন-ভাজিয়ের প্রতি নম্র আব্দার ভাসিয়ে দেওয়াটাও রুটিন; "চাউমিনের ওপর দিয়ে লঙ্কাকুচি আর সামান্য কাঁচা পেঁয়াজ ছড়িয়ে দেবেন প্লীজ৷ আর হ্যাঁ, স্যস-ট্যস দেবেন না, কেমন"?

 বুকের মধ্যে তখন কয়েক হাজার জয় গোস্বামী একসঙ্গে মন্ত্রপাঠ করে চলেছেন  
"পাগলী, তোমার সঙ্গে এগচাউমিন কাটাব জীবন"।

টপ ১০ মহালয়া এলিমেন্টস ফ্রম দ্য নাইনটিজ



১। ঢাউস একখানা অ্যালার্ম ঘড়ি। যে ঘড়ির দিকে তাকালেই ঘুমটুম উড়ে যায়। যে ঘড়ি মাথার কাছে রেখে চোখ বুজলেই বুকে ঢিপঢিপ; এই বুঝি বোমা ফাটল। যে ঘড়ির অ্যালার্ম শ্যামবাজারে বাজলে গোলপার্কের ঝিমোনো মানুষজন চমকে ওঠে। 

২। ব্যাকআপ অ্যালার্ম; "দিদা, বাই চান্স অ্যালার্মটা ফেলে করলে একটু ডেকে দিও"। কম্যুনিস্ট দাদারাও এ'দিনটায় মার্ক্স ত্যাগ করে কালচারের তাড়নায় দিদিমাদের দিকে ঘেঁষতেন।

৩। রেডিও। বোনাসঃ আগের দিন সন্ধ্যেয় কাটলেট সহযোগে ফ্রিকুয়েন্সি টেস্টিং।
 
৪। ব্যাকআপ ট্রানজিস্টার। ব্যারাকপুরের মেসো বারবার বলতেন, পলিটিশিয়ান আর যন্ত্রপাতিদের চোখ বুজে ভরসা করতে নেই।

৫। চানাচুর। ভোরবেলা ঝাল চানাচুর হল চাউমিনে পোস্তর সমান। দরকার হল টকমিষ্টি চানাচুর। বাটি অপ্রোয়জন,  বয়াম থেকে ডাইরেক্ট মুঠো করে তুলে নেওয়াটাই ট্র‍্যাডিশন।  তারপর দুলে দুলে বীরেন্দেবাবুর সুরে তাল দিয়ে চেবানো। 

৬। চা। কাপে হবে না। সাপ্লাইলাইন দাঁত খিঁচোবে৷ ফ্লাস্কে ভরে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসাটাই যুক্তিযুক্ত। 

৭। প্রথম দু'মিনিট শোনার পর। গলায় উত্তেজনা! "ভদ্রবাবুর ভয়েসে যে কী ম্যাজিক! দ্যাখ দ্যাখ। এই দ্যাখ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে"।

৮। দশ মিনিট শোনার পর। মোলায়েম আবেগ এসে চেপে ধরবে, "মা আসছেন"।

৯। পনেরো মিনিট শোনার পর। "এ কী রে মেজদা। ঘুমোলি নাকি? আদত ইয়েটা তো সবে ইন্টেন্সিফাই হচ্ছে"।

১০। কুড়ি মিনিট পর - "চোখটা না..লেগে আসছে৷ তাছাড়া এইচএমভির ক্যাসেটজোড়া তো আছেই। বেলার দিকে লুচি বেগুনভাজা খেতেখেতেই না হয়.."।

পুরানি দিল্লী


২০০৭। দিল্লী।

একটা প্রেম দাঁড় করানোর কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রোজকার ক্লাস শেষ হতেই ছুট; সোজা গিয়ে ছ'শো একুশ নম্বর বাস ধরে কনট প্লেস। দেখাসাক্ষাতের ব্যাপারটা বেশিরভাগ দিন ও'খানেই সারা হত। তারপর ইনার সার্কেল আর আউটার সার্কেল জুড়ে মাইলের পর মাইল হাঁটা। 

একটানা অকারণ হাঁটা, অর্ধেক দুপুর আর পুরোটা বিকেল জুড়ে। অকারণ; কারণ ওই বয়সের প্রেম-প্রেম হাহুতাশকে লজিকের ফ্রেমে ধরতে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি। 

কনট প্লেসের বেশিরভাগ দোকানপাট আর রেস্তোরাঁই কলেজপড়ুয়াদের পকেটের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর৷ সে বয়সে কেএফসির মত রেস্তোরাঁতে ঢুঁ মারার কনফিডেন্সও ছিলনা৷ ওয়েঙ্গার্সের স্যান্ডউইচ বা কেভেন্টার্সের শেকও বড্ড দামী মনে হত। আমাদের ভরসা ছিল মূলত ফুটপাতের খাবার বিক্রেতারা৷  শিঙাড়া, বাদামভাজা, আলুচাট, চিপস, 'স্লাশ', বরফগোলা; এই'সব।  বুকে 'অষ্টমীতে প্রথম দেখা' মার্কা হুহু থাকলে আলুচাটের থেকেও চিকেনরোলের সুবাস পাওয়া যায়। দিব্যি উতরে যেত সেই দুপুর আর বিকেলগুলো।

শুধু কোনও কোনও দিন হাঁটাহাঁটির মধ্যে পেত প্রবল খিদে। প্রবল। সুতীব্র। সে বয়সে খিদেপেটে মনে হত; পারলে মরিচ ছড়িয়ে, মাখন মাখিয়ে চেয়ার টেবিল বা এনসাইক্লোপিডিয়াও চিবিয়ে খেতে পারি বোধ হয়। সেই হাইক্লাস খিদে যে আলুচাট বা বাদামভাজায় বধ হবে না, সে'টাই স্বাভাবিক।  

আমরা গোটা এলাকা চষে ফেলে এমন একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম যে'খানে দশ-পনেরো দিনে একবার লাঞ্চ করলে পথে বসতে হবেনা। আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট। সে'খানকার বোলচাল বেশি নয় আর রান্নাবান্না বেশ মশলাদার। আমাদের অবশ্য বেশি এক্সপেরিমেন্ট করবার ক্ষমতা ছিল না। একটা প্রবল ভাবে অ-চৈনিক চিলি চিকেন বানাতো তারা৷ তার সঙ্গে রুমালি রুটি দিব্যি জমে যেত। যে'দিন তেমন মেগা-খিদের খপ্পরে পড়তাম, সে'দিন আমরা গিয়ে বসতাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টে। এক প্লেট চিলি চিকেনের দাম ওই একশোটাকা মত ছিল, দশ পিস পাওয়া যেত। ছ'পিস আমার প্লেটে, চার পিস তার। রুমালি রুটিও বেশ সস্তাই ছিল।  ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট না থাকলে আমাদের মাঝেমধ্যে অমন আয়েস করে বসে গল্প করা হত না, হেঁটেই হদ্দ হতে হত। 

এক প্লেট চিলি চিকেন আর খান ছয়েক রুটি অর্ডার দিয়ে রহিসি মেজাজে গল্প শুরু হত। দশ মিনিটের মাথায় খাবার সার্ভ হয়ে যেত টেবিলে; সঙ্গে বোনাস - পুদীনার চাটনি আর কুচোনো পেঁয়াজ। ছ'টা রুটির চারটে আমার থালায়। 

খাবার আসা মাত্রই পেটের খিদে চারগুণ, চোখের সামনের জলজ্যান্ত প্রেমিকাটি আবছা হয়ে আসত। জীবনে পড়ে রইত শুধু ওই ছ'পিস চিলি চিকেন আর ছ'টা রুমালি রুটি। স্রেফ চিলি চিকেনের ঝোল ছুঁইয়ে চারটে রুমালি উড়ে যেত, তখনও চিকেনের টুকরোগুলো অক্ষত।  আরও দু'টো রুমালি চেয়ে নেওয়া হত। সাত নম্বর রুমালি শেষ হলে চোখের সামনে প্রেমিকার অবয়ব ফের স্পষ্ট হয়ে উঠত। সে তখনও দু'নম্বর রুমালি রুটি নিয়ে টুকুরটুকুর চালিয়ে যাচ্ছে। আট নম্বর রুমালিতে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে ভাসিয়ে দিতাম সেই 'একবার বলো উত্তমকুমার' লেভেলের আর্তি;
"তোমার থেকে হাফ-পিস চিলিচিকেন পাওয়া যাবে"?

ও'দিক থেকে হাফ-পিসের বদলে একটা গোটা পিসই উঠে আসত আমার পাতে। সে কী সহাস্য আস্কারা।  

মুখে বলতাম " আহা, এতটা আবার কেন"? অথচ মনের মধ্যে তখন চিত্রহার, রঙ্গোলী আর সুপারহিট মুকাবলা  একসঙ্গে ফায়্যার হচ্ছে।

**

বহুদিন পর গতকাল আবার গেছিলাম কনট প্লেসের ও'দিকে৷ এক জোড়া রুমালিতে ঘায়েল হওয়া সেই মানুষটাই ডেকে দেখাল; ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের রংটা এখনও পাল্টায়নি।

আই লাভ ইউ


- তুমি আমায় আই লাভ ইউ টাভ ইউ বিশেষ বলো না কিন্তু।

- ন্যাকাপনা। 

- শেষ যখন বলেছিলে তখন কেন্দ্রে কংগ্রেস,  রাজ্যে সিপিএম। 

- গা জ্বলে যায়।

- ডাইভার্ট করে দিও না সুমি। ডাইভার্ট করে দিও না। 

- হঠাৎ এ'সবের শখ হলো কেন?

- শখ? রাইট বলো। অধিকার অফ আ স্পাউস।

- গাম্বাটদের অধিকার থাকতে নেই।

- আমি গাম্বাট?

- আলবাত।

- আই লাভ ইউ দাবী করেছি বলে আমি গাম্বাট? 

- আই লাভ ইউতে আই লাভ ইউ খুঁজে হদ্দ হচ্ছ বলে।

- এই এক ঝামেলা। যে কোনও তর্কে দিব্যি কেমন ঘুরপাক খাইয়ে গুলিয়ে পেঁচিয়ে দাও।

- সাধে কি বলি? গাম্বাট। উইথ আ ক্যাপিটাল জি।

- আই লাভ ইউতে আই লাভ ইউ খুঁজে হদ্দ হওয়ার কেসটা কী সুমি?

- আই লাভ ইউ বলতে গেলে "আই লাভ ইউ"ই বলতে হবে, এ'সব গোদা আইডিয়াগুলো এ'বার ত্যাগ করো। মনে রেখো, গদা দিয়ে ইয়ারবাডের কাজ চালানো যায়না।

- তুমি আমায় বলো কখনও? আই লাভ ইউ? 

- বলি। তবে হাইক্লাস ট্রান্সলেশনে।

- কী'রকম?

- এই যেমন গতকাল দুপুরে যে বললাম। "তোমার বানানো বিরিয়ানি আরসালানকে টক্কর দেবে"। 

- ও'টা আই লাভ ইউ?

- টপমোস্ট ক্যাটগরির। রীতিমত ব্লাইন্ড।

- আই সী। তা'ছাড়া?

- গত হপ্তায় আদতে বললাম আই লাভ ইউ। কিন্তু শব্দগুলো যখন তোমার কানে পৌঁছল, তুমি শুনলে "আজ কলেজ স্ট্রিট গেছিলাম তোমার জন্য খানকয়েক পুরনো পুজোসংখ্যা জোগাড় করতে"।

- তা বটে। ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া সমস্ত পুজোসংখ্যা,  প্রাইসলেস।

- তারপর ওই যে সে'দিন। তুমি বললে মনখারাপ৷ আমি বললাম "এসো, নবরত্ন তেল দিয়ে মাথা মালিশ করে দিই"। এর চেয়ে হাইকোয়ালিটির আই লাভ ইউ হয়?

- তাই তো। আই উইথড্র মাই অ্যালিগেশন৷ আর ইয়ে, আই কিন্তু লাভ ইউ। মাইরি।

- চলো, দু'জনে মিলে মুড়ি মাখি বরং।

দ্য পুজো পুজো রোব্বারস


দিব্যি কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে খটরখটর কী-বোর্ড চালিয়ে যাচ্ছিল অনিন্দ্য৷ দিব্যি।

সাতটা এক্সেল শিট আর আর তিনটে ওয়ার্ড ফাইল চোখের সামনে খোলা। কনসেন্ট্রেশন তুঙ্গে, কাপের কফি আধঘণ্টা আগেই ফুরিয়েছে অথচ মাঝেমধ্যে সেই খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছিল সে। 

এমন সময় হল কী...কম্পিউটারটা আপনা থেকেই রিস্টার্ট হল৷ সমস্ত খোলা ফাইলকে না পাত্তা না দিয়ে সে ব্যাটার স্ক্রিন দুম করে বন্ধ হয়ে আবার জ্বলে উঠলো৷ অনিন্দ্যর মেজাজটাও গেল বিগড়ে। আচমকা সে টের পেল কফির কাপটা ফাঁকা। তারপর খেয়াল হল আশেপাশের কিউবিকেলগুলোও ফাঁকা। কেউ কোত্থাও নেই। অনিন্দ্যর মনে পড়ল আজ রোব্বার। অন্য কারুর অফিসে আসার কথা নয়৷ কিন্তু তাকে প্রায়ই ছুটির দিনে আসতে হয়৷ প্রায়ই তাকে রোব্বারি-তলব পাঠান বড়সাহেব৷ বড়সাহেবের রোব্বারি ডাক সবাই এগিয়ে গেলেও অনিন্দ্য পাশ কাটাতে পারেনা। সে জন্য অবিশ্যি বড়সাহেব তাকে বিশেষ পছন্দ করেন। 

যা হোক। কম্পিউটার রিস্টার্ট হওয়ার সময় কনসেন্ট্রেশনটা গেল গুলিয়ে। আর সে'টাই হল কাল। মুহূর্তের অসাবধানতায় অনিন্দ্যর চোখ গিয়ে পড়ল জানালার ও'পাশে, আকাশের দিকে। এক্সেল, ওয়ার্ড ডক, আউটলুক ইনবক্স সব কেমন ঝাপসা হয়ে পড়ল। কেমন একটা অস্বস্তিকর ঝকঝকে নীল৷ বারো ঘণ্টা অফিস, বাড়ি ফিরে একার সংসারে সামান্য রান্নাবান্না আর রাতের দিকে টিভির পাশাপাশি ল্যাপটপে অফিসের দু'একটা খুচরো কাজ দেখতে দেখতে গা এলিয়ে দেওয়া৷ 

এ'সব কিছুর মধ্যিখানে আকাশের দিকে চোখ যাওয়ার কথা নয়, দৈবক্রমে আজ গেল। রিস্টার্ট হওয়া কম্পিউটারের স্ক্রিনে কিছুতেই আর চোখ আটকে রাখা যাচ্ছেনা৷ অথচ ওই হতচ্ছাড়া আকাশের দিকে তাকানোরও সাহস হচ্ছে না৷ মিনিট সতেরো ছটফট করার পর বড়সাহেবকে একটা ফোনই করে বসল অনিন্দ্য।

- হ্যালো। বলো অনিন্দ্য। 

- হ্যালো স্যার।

- গুপ্তার ফাইলটা কম্পলিট হল? খুব আর্জেন্ট কিন্তু। রাত হলেও ক্ষতি নেই কিন্তু ফাইলটা কম্পলিট করা চাই। অবশ্য, তোমার কাছে তো এ'সব জলভাত।

- হ্যাঁ। স্যার, ওই ফাইলটার ব্যাপারেই একটা কথা বলার ছিল।

- বলো না।

- ফাইলটা আর আজ প্রসেস হবে না।

- সে কী। এনিথিং রং?

- নীল।

- হোয়াট?

- আকাশের রঙটা৷ কেমন একটু অস্বস্তিকর নীল৷ আপনি দেখেছেন?

- আর ইউ ওকে অনিন্দ্য?

- ফাইলটা আজ আর হবে না৷ 

- বাট ইট ইস ভেরি আর্জেন্ট।

- কাঁচকলা। 

- হোয়াট কাইন্ড অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ইস দিস?

- গুপ্তাদের ফাইলটা তিনদিন পরে করলেও ক্ষতি নেই। আমি শিডউল চেক করেছি।

- বাট উই মাস্ট স্টে আহেড অফ দ্য শিডিউল।

- ইউ মাস্ট। আমার মাস্ট তো স্রেফ আপনার মাস্টে তালে মিলিয়ে চলা। 

- ব্যাপারটা কী বলো তো? 

- ফাইলটা আজ আর হবে না। আগামীকাল আর পরশু আমি ছুটি নিচ্ছি৷ ক্যাসুয়াল লীভগুলো খামোখা প্রতি বছর নষ্ট হয়। বুধবারের মধ্যে বরং আপনি ফাইলটা পেলেও পেতে পারেন।

- ক্যাসুয়াল লীভগুলো নষ্ট হয় বলেই ইউ আর আ ফাস্ট রাইজার। সে'টা ভুলে যেওনা।

- কেরিয়ারে ফাস্ট রাইজ করব বলে ক্যাসুয়াল লীভ নিই না, আপনা এই ধারণা ভুল৷ ছুটি চাইতে বুক কাঁপে, ঘাড়ে চাপানো আজেবাজে কাজ কেন করব সে লজিকাল প্রশ্ন করতে ভয় পাই। এক্সেলেন্সে মন নেই, কম্পলায়ান্স কম্পল্যায়ান্স করেই ফতুর হচ্ছি৷ প্রমোশনের লোভ আমার নেই স্যার। কিন্তু চাকরীতে এ'দিক ও'দিক কিছু হলে লিলুয়ার মেজপিসি চিমটি কেটে কী বলবে তা ভেবে কেঁপে উঠি। রিয়েলি। "ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার" যে আউড়ে চলি তা কিন্তু স্রেফ ভয়ে। অ্যাম্বিশনে নয়। 

- বটে? এ'সব ফিলোসফিকাল বাতেলা আমায় শোনাতে এসো না। মনে রেখো, সামনেই রিভিউ..।

- আর সামনেই পুজো। জানেন, কিছুক্ষণ আগেই খেয়াল পড়ল। বছর কুড়ি আগে কেনা কয়েকটা পুজোসংখ্যা আমার  পুরনো বইয়ের ট্রাঙ্কে এখনও রাখা আছে। পড়া হয়নি৷ তখন পরীক্ষার নম্বর কমলে মধ্যবিত্ত বাপ-মায়ের মধ্যবিত্ত স্বপ্নভঙ্গ হবে, সে ভয় ছিল। এখন বাপ-মা আর নেই বটে। তবে ভয় বয়ে বেড়ানোর অভ্যাসটা রয়ে গেছে স্যার। কিছু একটা না করলেই নেই।

- য়বাজে বকার সময় আমার নেই। কম্পলিটেড ফাইলটা আমার রাতের মধ্যে চাই।

- আজ রাতের মধ্যে কুড়ি বছর পুরনো শারদীয়া শুকতারার রিভিউ পেতে পারেন। আগামীকাল রাতের মধ্যে সাতপুরনো পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলার রিভিউ।  পরশু রাত্রের মধ্যে পাবেন পুরনো কিশোরভারতী পুজোসংখ্যার রিভিউ। তারপরের দিন বোধ হয় এই ফাইলটা পেলেও পেতে পারেন।

- ইউ ইডিয়ট!

- আই এগ্রী স্যার। এমন পুজো পুজো রোব্বারের দুপুরে কোথায় কড়াইতে মটন কষাবো! তা নয়। আমি অফিসে বসে ভিলুকআপ চালিয়ে হদ্দ হচ্ছি। আলবাত আমি ইডিয়ট৷ যাকগে, এখন আসি বরং।

সেল্ফ হেল্প

যে সেলফ হেল্প বইগুলো আমি পড়তে চাই -  

১। দ্য সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি এফেক্টিভ ল্যাদিস্টস।

২। হাউ টু উইন এক্ট্রা ফাউস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স ফুচকাদাদাস।

৩। দ্য পাওয়ার অফ "ভাল্লাগছেনা"।

৪। দ্য সাটল আর্ট অফ "সোফা ছেড়ে উঠব না"। 

৫। দ্য ম্যাজিক অফ থিঙ্কিং বিরিয়ানি।

নেশা ও সলিউশন


- এই যে অনির্বাণ। ও'দিকে কোথায় ছুটে যাচ্ছ। এ'দিকে এসো। 

- বড়সাহেবের চেম্বারে দিকে যাচ্ছিলাম। জরুরী তলব।

- ব্রাদার। হিউম্যান রিসোর্সে থেকে অমন তাড়াহুড়ো করতে নেই। 

- বস তাড়া দিলেও নয়?

- তা'হলে তো একেবারেই নয়। সিনিয়রদের লাই দিয়ে মাথায় না তোলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

- সান্যালদা, কী যে বলেন আপনি মাঝেমধ্যে। 

- বাইশ বছর এই কোম্পানিতে আছি হে। আজ পর্যন্ত একটা প্রমোশনও মিস করিনি। কাজেই আমি যখন যাই বলি, জানবে সে'গুলো আদতে বাণী। 

- একটু বুঝিয়ে বললে সুবিধে হয় সান্যালদা।

- বড়সাহেব কেন ডেকেছেন। সে'টা জানা আছে?

- কোম্পানির অবস্থা তো সবই জানেন। গতমাস থেকে ফ্যাক্টরির সমস্ত লেবারদের সবার মাইনেকড়ি আটকে আছে। সামনের হপ্তায় কিছু টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ফিনান্স থেকে আজ জানালে আগামী মাসখানেক তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। এ'দিকে আজ বিকেলে খেপচুরিয়াস ইউনিয়নের নেতারা আসছেন বড়সাহেবের সঙ্গে মিটিং করতে। তাঁদের কী ভাবে শান্ত করা যায়..সে'সব নিয়ে আলোচনা করতেই আমায় ডেকেছিলেন বড়সাহেব।

- আই সী। তা, কী ভাবে তাঁদের শান্ত করবে? মিটিংয়ে শিঙাড়া জিলিপি আর সল্টেড কাজুবাদাম খাইয়ে? 

- সান্যালদা। সিচুয়েশনটা বেশ যাকে বলে..অগ্নিগর্ভ। 

- তা, কী সলিউশন অফার করবে বড়সাহেবকে? উনি নিশ্চয়ই তোমায় কফি বিস্কুট খাওবেন বলে ডাকেননি।

-  সলিউশন তো একটাই৷  বকেয়া মাইনে মেটানো৷ 

- কোম্পানির ফিনানশিয়াল স্টেটমেন্টগুলো দেখেছ?

- জানি, পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। মনে হয় না আগামী তিনমাসের মধ্যে লেবারদের কোনওরকম কিছু দেওয়া যাবে।

- বটে। তিনিমাস মাইনে না হলে, তোমার বড়সাহেবকে টিকতে দেবে কারখানার শ্রমিকরা? আর বড়সাহেব না থাকলে আমাদের টিকিজোড়াই বা আমরা কোথায় বাঁধব?

- লেবারদের কি কোনও ভাবেই ঠাণ্ডা রাখা যায়না?

- এতগুলো মানুষের পেটের খিদেকে কী'ভাবে ঠাণ্ডা করবে বাবু হিউম্যানরিসোর্স? সেল্ফি কন্টেস্ট ঘোষণা করে না স্লোগান রাইটিং কম্পিটিশন অর্গানাইজ করে?

- জাস্ট ছিঁড়ে খাবে কিন্তু আমাদের। আফটার অল, আমাদের মিসম্যানেজমেন্টের জন্যই তো ওদের আজ এই অবস্থা। ফ্যাক্টরির প্রডাকশনে তো কোনও অসুবিধে হয়নি।দে হ্যাভ বিন কোয়াইট এফিশিয়েন্ট।

- সলিউশন ছাড়াই বড়সাহেবের ঘরে ঢুকবে অনির্বাণ? 

- কিন্তু এই সিচুয়েশনে আর তো কোনও উপায়ও নেই সান্যালদা। শ্রমিকদের খাওয়া জুটছে না৷ তারা আমাদের কথা শুনবে কেন?

- শ্রমিকরা তোমার কথা শুনবে না। কিন্তু ইউনিয়ন শুনবে।

- ইউনিয়নই বা আমাদের হয়ে কথা বলবে কেন?

- যুক্তির ভরসায় থাকলে চলবে না। উহাদেরকে ওপিয়াম জোগান দিতে হইবে।

- ওপিয়াম? ঘুষটুষ দিতে বলছেন নাকি?

- ঘুষ খুব পাতি ব্যাপার অনির্বাণ।  ও'দিয়ে এক'দুজন ধান্দাবাজকে কেনা যায়। জনতার আগুন মেজাজকে বশে আনা যায়না।

- তা'হলে ওপিয়ামটা কি?

- বসন্ত ভৌমিক। ওই যে, এই ইউনিয়নের উঠতি নেতা। গত  মাসে ফ্যাক্টরিতে নাইটশিফট করে ফেরার পথে কিছু লুম্পেনদের খপ্পরে পড়ে৷ মারধোর খায়। মোটোরবাইক, রিস্টওয়াচ আর মানিব্যাগ খোয়ায়। 

- তার সঙ্গে আমাদের সমস্যার কী সম্পর্ক?

- পেশেন্স অনির্বাণ।  পেশেন্স। 

- বেশ। বলুন। 

-মাসখানেক পরেও পুলিশ সেই লুম্পেনদের  পাকড়াও করতে পারেনি। লোকাল থানার ওসি সুবিমলবাবু ভারী মাইডিয়ার। আমার সঙ্গে পুরনো যোগাযোগ।  বড়সাহেবের তরফ থেকে সামান্য নজরানা প্রায়ই যায় তার কাছে। তিনি আমাদের সাহায্য করবেন। আমি তার সঙ্গে একপ্রকার সমস্ত কথাবার্তা বলে রেখেছি।

- কী কথা সান্যালদা?

- পুলিশ আজ দুপুরে রাইভাল ইউনিয়নের অমল সমাদ্দারকে অ্যারেস্ট করবে।

- অমল সমাদ্দারকে অ্যারেস্ট করবে? কেন? সে বসন্ত ভৌমিকের রাইভাল নেতা হতে পারে৷ সমাদ্দার লোকটা যে বিশেষ সুবিধের তাও নয়। কিন্তু তাই বলে সে বসন্তবাবুকে মারধোর করার বান্দা নয়৷ আর চোর তো নয়ই।

- আমি নিশ্চিত অমল সমাদ্দার এ কাজ করেনি৷ তবে তা বিচার করার দায় তোমার আমার নয়৷ পুলিশ দুপুরে তাকে তুলে নিয়ে যাবে। দুই ইউনিয়নের মধ্যে খামচাখামচি শুরু হবে। একে অপরকে সন্দেহ করবে। গসিপ করবে। গুজব ছড়াবে। লোকাল নেতারা সে হল্লায় সামিল হবে। আজ বিকেলে যখন আমাদের ইউনিয়নের নেতারা আসবে, তখন মাইনের চেয়েও বেশি আলোচনা হবে অমল সমাদ্দারের শয়তানি নিয়ে। বড়সাহেব বলবেন যে তিনি আমাদের শ্রমিকদের ইউনিয়নের নেতা বসন্ত ভৌমিকের এমন হেনস্থা কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না। উই উইল অফার এভ্রি কাইন্ড অফ হেল্প টু আওয়ার ফ্রেন্ডস ফ্রম দি ইউনিয়ন। আমরা উকিল দেব, পুলিশ লাগাব।

- মাইনে নিয়ে আলোচনাটা তা'হলে এ যাত্রা বোধ হয় থামানো যাবে। তাই না সান্যালদা?

- আমাদের তিনমাস দরকার অনির্বাণ। তিনমাস পর খালিপেট থেকে আধপেট হলেই তারা বর্তে যাবে। তারপর কে আসল লুম্পেন সে'টা জানা যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে ভেবে আমাদের কাজ নেই।

- আপনি জিনিয়াস সান্যালদা।

- যুক্তির চেয়ে নেশায় কাজ দেয় বেশি। এই বেদবাক্যটা চিরকাল মনে রেখ হে। এ'বার পা চালোও, বড়সাহেব অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন।

প্রজাপতি

কলকাতা সরগরম।
ফুটপাত জমজমাট।
সন্ধ্যের হইহট্টগোল, ট্রামের ঘরঘর, 
বাসের হর্ন আর অটোর হুড়মুড়। 
ভীড়। ঠেলাঠিল। 
"আরে দাদা, একটু দেখে পা ফেলবেন তো" গোছের খোঁটা।

ব্যস্ততার স্রোত বয়ে যায়, সন্ধ্যের এই সময়টা শ্বাস ফেলার ফুরসৎটুকু পায় না কলকাতা। আহা, মানুষের দল বাড়ি ফিরছে। শহরের গায়ে যে কী অবিশ্বাস্য গতি লেগে থাকে এই সময়।

সেও ছুটছিল। 
অবিশ্বাস্য গতিতে। 
তবে কলকাতার উল্টো দিকে। 

কলকাতা ডাইনে ছুটলে, সে এগোচ্ছে বাঁয়ে। 
কলকাতা ছড়া কাটলে, সে ধরছে খোলতাই টপ্পা।
কলকাতা ধুরন্ধর চালে কিস্তিমাত করতে চাইলে, সে চালছে দু'ছক্কা পাঁচ।
কলকাতার কভার ড্রাইভের জবাবে তার বাইসাইকেল কিক।
কলকাতা উত্তম হাসি হাসলে, সে ভাসিয়ে দিচ্ছে তুলসী চক্কোত্তি মার্কা 'বাপ রে বাপ রে বাপ'।

মোদ্দা কথা হল কলকাতার বয়ে চলা অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ উল্টো খাতে বইছিল সে। গোটা শহরটাকে এক অন্য ডাইমেনশনে ফেলে রেখে অন্য জগতে এসে পড়েছিল সে।

সে ছুটছিল। 
একহাতে কাগজের ঠোঙায় ডিমপাউরুটি৷ পাউরুটি, ডিম আর সর্ষের তেলে ভেজা কাগজের গন্ধ মিলেমিশে তার নাকেবুকে নহবত বসিয়েছিল যেন। অন্য হাতে একজোড়া প্রজাপতি বিস্কুট। 

ডিমরুটির নরম আর প্রজাপতি বিস্কুটের মিঠে মুচমুচ ব্যালেন্স করে সিকি মাইল ছুটে গিয়েছিল সে। শার্টে ঘাম, বুকে ধুকুরপুকুর, আর আলো আলো মুখ। সে ছুটে যাওয়াটা কলকাতার দৃষ্টিগোচর হয়নি। 

তার ছুটে আসা যে দেখেছিল একজোড়া ঝাপসা চোখ। 

- এই যে।

- এ'গুলো কী?

- দু'দিনের জন্য শহরে ঘুরতে আসো। পিটারক্যাটফিটারক্যাট মার্কা লারেলাপ্পাতে কাটিয়ে ওয়াপিস চলে যাও । তাই এই ডিমপাউরুটি। আর চায়ের দোকানের বয়াম থেকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া বিস্কুট। দ্যাট ট্যু প্রজাপতি। কলকাতা মেড-ইজি ফর ইউ।

- তুমি ছুটে আনতে গেলে?

- ডিমপাউরুটির উষ্ণতাটা রিটেন করার জন্য। তাছাড়া, তোমার সময় কম। ছুটলে দু'মিনিট বাঁচে। 

ঝাপসা-চোখজোড়ার শাড়ির আঁচল টেনে ধুকুরপুকুর-বুক নিজের কপালের ঘাম মুছতে চেয়েছিল।
সাহসে কুলোয়নি।

সে সাহসের অভাবটুকুও কলকাতার দৃষ্টিগোচর হয়নি।