Saturday, May 27, 2017

মাধ্যমিক

- আরে এই যে, দত্তবাবু যে! আসুন আসুন আসুন। খুব ভালো সময়ে এসেছেন। আজকেই আমরা লঞ্চ করলাম আম রাবড়ি।
- রাবড়ি ফর আমজনতা না ম্যাঙ্গো ফ্লেভার?
- আজ্ঞে,  ফ্লেভার। ফ্লেভার।
- অ।
- দেই? কিলো তিনেক?
- তিন কিলো?
- আড়াই? নাকি রসোগোল্লাতেই স্টিক করবেন? একশো পিস!
- আমি পাইকারি মেঠাই কিনব কেন?
- আজকের দিনটা আমি খেয়াল রেখেছি। মিষ্টির বাড়তি স্টক মজুত রাখতে সবকটা কর্মচারীকে কাল গোটা রাতের ওভারটাইম দিয়েছি।
- দেখুন, আমি এসেছি চারটে গুজিয়ে নিতে। প্রত্যেক শনিবার যেমন নিই, রিক্সাস্ট্যান্ডের শনিমন্দিরের জন্য। প্লাস দশটাকা দক্ষিণা। কিন্তু ব্যপারটা কী বলুন তো?
- আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে, সকাল থেকে টার্নওভার ডাবল হয়ে গেছে। আপনার মেজছেলে মন্টুও এ'বারে এগজ্যাম দিয়েছে। তাই না?
- মাইরি?
- মানে?
- মাইরি? আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে?
- ইয়ার্কি করছেন স্যার?
- শেষ ইয়ার্কি করেছিলাম নাইন্টি ফাইভে। অফিসের বড়হুজুর মাইনে কাটার হুমকি দিয়েছিলেন বুঝতে না পেরে। সে যাক। আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে মানে নিশ্চিন্দি। তবে ইয়ে, মন্টেটা এ'বার মাধ্যমিক দিয়ে দিল? সেই কবে পড়েছিলাম, টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েটস ফর নান...।
- এই যে আপনার গুজিয়া। আসুন।

- হ্যাঁ গো! মন্টের আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে?
- বেরোলে বেরিয়েছে, তা'তে তোমার কী?
- এহ হে হে, দেখেছ কাণ্ড! এক্কেবারে গুলিয়ে গেছিল। ডাকো রাস্কেলটাকে। চাবকে দিই।
- ও'মা! চাবকাতে যাবে কেন?
- ওহ্! ভালো নম্বর পেয়েছে? ফার্স্ট ডিভিশন? স্টার? প্রচুর লেটার? বেশ, ঘোষের দোকানে আজই লঞ্চ হয়েছে ফুলকপির রাবড়ি। এইমাত্র জেনে আসলাম। যাই গিয়ে এক কুইন্টাল নিয়ে আসি।
- আমার হাড় না জ্বালালে শান্তি পাও না, তাই না?

- বাবা! তোমায় প্রণাম করা হয়নি।
- আয় আয়। আশীর্বাদ করি তুইও যেন তোর দাদার মত ডাক্তারিতে চান্স পাস।
- বাবা, ইয়ে। মানে। দিদির মত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তাই তো?
- ওই হল। আরে আমি তো ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম। সেই ভোর ভোর ডিউটিতে বেরিয়ে যাওয়া, মাথায় খালি ছ'টা ছাপ্পান্নর লোকালের হুইসল ঘুরপাক খায়। আজ নেহাত ফেরার পথে গুজিয়া নেওয়ার সময়...।
- বাবা! ইঞ্জিনিয়ারিং আমার দ্বারা হবে না বোধ হয়। ইলেভেনে সায়েন্স আমি নিচ্ছি না। আর্টস নেব।
- তবে রে? ফ্যামিলির নাম ডুবোতে চাস? ফক্করবাজি? আর্টস নিবি? আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
- অঙ্ক ফিজিক্স আমি ঠিক ম্যানেজ করতে পারব না।
- অঙ্কে কি এমন হাতি ঘোড়া আছে বল? এ প্লাস বি হোল স্কোয়্যার ইজ ইকুয়াল টু এ স্কোয়্যার প্লাস ট্যু এ বি প্লাস বি স্কোয়্যার। জলবৎ। আর ফিজিক্স? ম্যাগনেটিক ফিল্ড। একবার ঢুকে পড়তে পারলেই...।
- বাবা, তোমারও ইয়ে...আর্টস ছিল।
- আমার?
- আর্টস। ব্যাচেলর অফ আর্টস!
- মাইরি?
- আলমারির ফোলিও ব্যাগে তোমার মার্কশিট রাখা আছে। আমি দেখেছি।
- বলিস কী! তাহলে তো সন্তুটাই দেখছি ফ্যামিলির ব্ল্যাকশিপ। কোন সাহসে ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে?
- সন্তু ক্লাস এইটে। দিদি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।
- মিতুলটা এমন বিট্রে করল রে! ডাক ওকে।
- ও খড়গপুরে থাকে। হস্টেলে।
- তাই তো রে। মাকে কদ্দিন দেখিনা। কাল তো রোববার, যাবি? দিদির সঙ্গে দেখা করতে?
- দিদি কাল আসছে। ফোন করেছিল।
- মার দিয়া কেল্লা। কাল তিন কিলো পেঁপের রাবড়ি আনব।
- পেঁপের? রাবড়ি? হয় নাকি? ধুস!
- বিপুলা এ ব্যারাকপুরের কতটুকু জানিস তুই? ঘোষবাবুর মেঠাইরের দোকানটা একটা অত্যাধুনিক ল্যাবোরেটরি। অসাধ্য সাধন হতে পারে সে'খানে।
- ও।
- মন্টে।
- কিছু বলবে? বাবা?
- সরি।
- এ মা! কেন?
- এই। ভুলে যাই। তুই জানিস তো। আমি বরাবরই...।
- জানি! আচ্ছা বাবা, তুমি শনিবারের গুজিয়া কেনার কথা কোনওদিন ভোলো না, তাই না?
- কারণ ভুতোকে মেঠাই খাওয়ানোর আর কেউ নেই।
- ভুতো?
- বিশুর ছেলে। যে রিক্সা চালায়, সেই বিশু। এত্তটুকুন বয়স ভুতোর। মা নেই। বাপও তো সেই উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ। ছেলেটা শনি মন্দিরের চাতালেই পড়ে থাকে গোটাদিন। সে ব্যাটা ওই সামান্য গুজিয়ার ছোট বাক্স দেখলে যা লাফালাফি শুরু করে। আর দিই দশটাকা, ঘুগনি পাউরুটি কেনে ব্যাটা। কোনওদিন আবার পুরিসবজি। বা দিলুর দোকান থেকে মামলেট।
- হেহ হে। তুমি লাজওয়াব বাবা।
- বলছিস?
- একশো বার।
- যাক,  ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে নিশ্চিন্ত করলি। আজকাল যা মেডিক্যাল খরচ বেড়েছে রে বাপ।
- বাবা, আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি।
- ওহ হো! সরি। মাধ্যমিক। রাইট। যাক, সোজা সায়েন্স নিয়ে বসে যাবি।
- আর্টস!
- আমার ছেলে হয়ে তুই আর্টা নিবি রে ব্যাটা?
- বেশ। আজ শুতে যাই?
- অফ কোর্স। গুড নাইট।
- আমার একটা ক্রিকেট ব্যাট ভাবছি তোমার ভুতোকে দিয়ে দেব।
- তুই লাজওয়াব মন্টে। লাজওয়াব।

Friday, May 26, 2017

হিমসাগর

মামাবাড়ির পিছনের দিকে আধ-জংলি বাগান। জামরুল, গন্ধরাজ, টগর, জবা, সুপুরি, কাঁঠাল গাছে ঢাকা। নয়নতারার ঝোপ আর আগাছাও। গরমের দুপুরেও ছায়াছায়া ভালো লাগা। আর সেসে সমস্ত ছাপিয়ে হিমসাগরের গাছ। দু'মরসুমে একবার ফল ধরত গাছে, তখন নুয়ে পড়ত। সে অঞ্চলে হাওয়ার সুবাস পালটে যেত।

তখন বেশ ছোট, আমের প্রতি হাভাতেপনায় রাশটানার দরকার ছিল না। আমে কামড় দিয়ে লাফিয়ে উঠেছি "খুউউউব মিষ্টি"! দাদু শিখিয়েছিল "কন্যোসারের ভাষায় বলো। খুব মিষ্টির বদলে বলো সুমিষ্ট"।

মাঝেমধ্যেই হনুমানের উপদ্রবে গাছের আম নষ্ট হত, বিশেষত দুপুরের দিকে। ধুপধাপ শব্দ শুনলেই দিদা ছুটে যেত ছড়ি হাতে, পিছুপিছু আমি। ছড়ি ঘুরিয়ে খানিকক্ষণ তম্বি করলেই তারা লেজ গুটিয়ে বা না গুটিয়ে পালাতো। একদিন হয়েছে কী, দিদার ছড়ি আর হুঙ্কারে ডাল ছেড়ে তারা যখন শেষ স্টেশনে লোকাল খালি করার মেজাজে দৌড় লাগালে, তখন এক পুঁচকে এত্তটুকুন খোকাহনু ডাল ফসকে ধপাস। চোট তেমন পায়নি, কারণ পরক্ষণেই মায়ের হাত ধরে দুদ্দাড় ভেগে পড়ায় কোনও ঢিলেমি ছিল না। কিন্তু খোকাহনুর হাতের টসটসে হিমসাগরটা ছিটকে মাটিতে গড়িয়ে গেছিল, দিদা নাকি দেখতে পেরেছিল যে খোকা মায়ের হাত ধরে পালানোর সময় সকরুণ চোখে সেই মনমোহিনী আমের দিকে তাকিয়েছিল।

আচমকা দিদার সে কি হাহাকার! "ওইটুকুন বাছা আমার একটু আম খেতে চেয়েছিল"। সে আম হাতে দিদা "আয় আয়" বলে বেদম ডাকাডাকি করেছিল কিন্তু কুকুর ডাকা চুকচুক আহ্বানে হনুমানের গোঁসা কাটে না। শেষে আম গাছ ঘেঁষা পাঁচিলে খান কয়েক আম সাজিয়ে রেখে এসেছিল দিদা, যদি খোকার বাপ অন্তত সাহস করে ফেরত এসে খোকার জন্য খান দুয়েক আম নিয়ে যেতে পারে।

সে হিমসাগর গাছ সাফ হয়ে এখন গ্যারেজ। বাকি গাছপালার জঞ্জাল সরে গিয়ে বাঁধানো চাতাল। দিদা দাদু এখন সুমিষ্টঘ্রাণ স্মৃতি। আমি ব্যর্থ কন্যোসার।

Monday, May 22, 2017

ক্যালক্যাটা বিভ্রাট

- দাদা, আমায় বাঁচান।
- ম্যাডাম! কলার না ছাড়লে বাঁচাবো কী করে?
- সরি। সরি। খুব লেগেছে?
- টুঁটি টনটন করছে। তবে ইট ইজ ওকে।
- আমায় বাঁচান প্লীজ।
- আমি ইয়ে...আমি তো পুলিশ! ডাক্তার তো নই।
- ডাক্তার পারবে না পুলিশদাদা, ডাক্তারের ক্ষমতায় কুলোবে না। ওই হারামজাদার জন্যে আজ আমার এই দশা!
- ওই...ওই লোকটা? দাড়িওলা? ওই বাজে মেকআপ করা লোকটা? আমি ভাবলাম আপনারা দু'জনেই থিয়েটার আর্টিস্ট। আপনি হিরোইন। ও ব্যাটা সাইডরোল।
- এ'সব থিয়েটার থিয়েটার কী করছেন? বাঁচান আমায়!
- ওই রাস্কেলটা আপনাকে টীজ করেছে? দেব লকআপে ঢুকিয়ে দু'ঘা মালটাকে?
- ধুস। ও'সব কিছু না।
- তাহলে? যাক গে, আমি রিপোর্ট লিখে নিচ্ছি। আগে নাম বলুন আপনার।
- সীতা।
- সীতা কী?
- সীতা।
- আই সী। সারনেম ইউজ করেন না। হাজব্যান্ডের নাম?
- আজ্ঞে?
- স্বামীর নাম?
- রামচন্দ্র।
- বাহ্। রাজযোটক মাইরি। এ'বারে বলুন। কেসটা কী?
- ব্যাপারটা তেমন কিছুই না। এই লোকটা আমায় এই বিশ্রী জায়গায় নিয়ে চলে এসেছে।
- আপনার বাড়ি কোথায়?
- অযোধ্যা।
- ইয়ার্কি হচ্ছে?
- জনকরাজার মেয়ে আমি দাদা। গলা কাটলেও মিথ্যে বেরোবে না।
- যাহ শালা। অদ্ভুত চাপ। আপনি সীতা? অযোধ্যার রামের সীতা? তাহলে এ'খানে কী করছেন?
- দিব্যি লঙ্কায় রামচন্দ্র  এসে পৌঁছলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ও মা! মিনসের আবার মতিভ্রম। বলে কিনা অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। বাধ্য হয়ে অগ্নিদেবকে, মানে ওই ব্যাটাচ্ছেলেকে ডাকলাম। অল্প কমিশনে আগুনে প্রবেশ করিয়ে দেবার কথা। বদ ব্যাটাছেলে কলির মে মাসের কলকাতায় এনে বলে এই হল অগ্নিপ্রবেশ। দাদা গো, আমায় বাঁচান। রামচন্দ্র অগ্নিপরীক্ষা বলেছিলেন, উনি এতটা পাষাণ নন যে এই গা ভাঁপানো গরম কড়াইতে আমায় পাঠাবেন। আমায় বাঁচান স্যার, আমায় এই কলকাতা থেকে বের করুন।

Sunday, May 21, 2017

চ্যাটার্জিবাবুর চিন্তা


- স্যার! মিস্টার চ্যাটার্জি!
- আরে! স্টোরবাবু!
- চিনতে পেরেছেন তাহলে?
- ঝারখণ্ডের ওই অজগাঁয়ে দিনের পর দিন বৌদির আশীর্বাদী মাছের ঝোল খেয়ে বেঁচে থেকেছি, সে ঋণ যে দশ জন্মেও ভোলার নয় স্টোরবাবু।
- অমন ভাবে বলবেন না স্যার। একে আপিসের বড়বাবু, তায় আমাদের পেয়িং গেস্ট। আপনার জন্য ও'টুকু করব না?
- বৌদিকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন যে সম্পর্কটা শুধু অফিসের বা পেয়িংগেস্টের ছিল না।বেনিয়মে বৌদি আমায় ধমকটমক দিতেও কসুর করতেন না।
- সে'সব বিলক্ষণ জানি।
- আমার ঘরের অবস্থা তো দেখছেন। আপনাকে যে কোথায় বসতে বলি...।
- মাদুরটা পাতাই রয়েছে তো। আমি বরং..।
- বেশ।
- আপনি চলে আসার পর গিন্নীর মনটা বড় খারাপ হয়ে গেসল। আর আপনিও এমন দুম করে গায়েব হলেন...।
- আসলে ব্যাপারটা এমনই...।
- কী এমন ব্যাপার মশাই? যার জন্যে বছর চারেক এক্কেবারে ডুব মেরে রইলেন? আর ওইভাবে কেউ গায়েব হয়? আপনার জিনিসপত্র সব এখনও আমাদের ও'খানেই পড়ে রয়েছে। গিন্নীর উপরোধে আপনার বাড়ির ফোন নাম্বারেও কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু সে'খান থেকেও সঠিক কোনও খবর পাইনি।
- আসলে কাউকেই ঠিক...। আচ্ছা, আমি যে ভাগলপুরে স্কুলমাস্টারি করছি, সে খবর আপনাকে কে দিলে?
- নরেশ মারাণ্ডির সঙ্গে গতমাসে আপনার দেখা হয়েছিল?
- হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাগলপুর এসেছিল কোনও কাজে। স্টেশনেই দেখা। সেই জানালে বুঝি?
- স্যার, রাগ করেননি তো? এমন ঝুপ করে চলে এলাম বলে?
- হা হা হা, কী যে বলেন! আপনি স্নান সেরে নিন, আমি বরং মুর্গি নিয়ে আসি। কষিয়ে নেওয়া যাবে। ও'বেলা আপনাকে শহর ঘুরিয়ে আনব'খন।
- মুর্গির প্ল্যান তো দিব্যি। কিন্তু আমায় বিকেলের ট্রেনে ফিরতে হবে।
- যা হোক। আপনি জিরিয়ে নিন। আমি বাজার ঘুরে আসি।
- চ্যাটার্জিবাবু। আমি আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ,  শুভাকাঙ্ক্ষী। অমন বড় চাকরী ছেড়েছুড়ে এ'খানে...এমন অবস্থায়...কেন?
- একলা মানুষ। যখন যেমন।
- পিড়াপিড়ি করতে আসিনি। আপনি যে সুস্থ আছেন, সে'টা জানলে গিন্নী সোয়াস্তি পাবে। আমার আসার মূল উদ্দেশ্যটা আগে জানাই। আপনি চলে আসার কিছুদিন পর আপনার এক পরিচিতা আপনার খোঁজে আসেন। আপনাকে না পেয়ে অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়েন। এই চিঠিটা উনি আপনার জন্য রেখে যান, এ'টা নাকি অত্যন্ত জরুরী।
- আচ্ছা।
- চিঠিটা টেবিলের ওপর রইল?
- বেশ। গামছা রইলো স্টোরবাবু। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি চট করে বাজার থেকে ঘুরে আসছি।

**

মাঝরাতে ট্রেনের হুইসল স্পষ্ট শোনা যায়। স্টোভে সসপ্যান চাপালে একটা অদ্ভুত স্বস্তি নেমে আসে, সে'টা ভালো লাগে চ্যাটার্জিবাবুর। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ভেসে আসা বাতাসে কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ। মোড়ের মাথায় বেজে চলা ঢোলের শব্দ আর দেহাতি সুরে আপন মনেই মাথা নেড়ে চলেন তিনি। বড্ড গরম পড়েছে,  একটু বৃষ্টি না নামলে ভ্যাপসা ভাবটা যাবে না।

গঙ্গার ঘাটের কথা মনে পড়ে চ্যাটার্জিবাবুর। ছোটবেলার পাড়া। ধুনো,ঘাস, ছোলাচানাচুরওলার ঠেলার লম্ফের গন্ধ মেশানো সন্ধ্যেগুলো। ক্রমাগত ক্রসব্যাট চালানোর জন্য সাহেবদার কানমলা। ক্লাবঘর থেকে ভেসে আসা একটানা ক্যারমের খটাখট। টিউশনির ব্যাগ পিঠে সাইকেল প্যাডেলের মচরমচর।

আর গঙ্গার ঘাট ঘেঁষা সেই নিমগাছটা। ছায়া আর শেষবিকেল মিলে যে'খানে এক খাবলা বুকছ্যাঁত পড়ে রইত প্রত্যেক সন্ধ্যেয়।

- আমরা বিয়ে করব, তাই না?
- ইডিয়ট।
- জাস্ট। রিকনফার্ম করছিলাম।
- ডাম্ব ট্যূ।
- কবে...মানে..ঠিক...মানে কী'ভাবে?
- তোর দ্বারা হবে না বাবু। আমিই বলব। কখন। কী'ভাবে।
- আমার দ্বারা কেন হবে না? দিব্যি হবে।
- আগে অনার্সটা না ধেড়িয়ে ম্যানেজ কর। ও'সব ডেঁপোমি পরে হবে।
- যদি...।
- যদি কী?
- যদি না হয়?
- সাধে বলি? ইডিয়ট? ডাম্ব?
- ছোটমামা বলে তুই আজহারউদ্দীনের কব্জির মোচড় হলে আমি উকুন বাছার আঙুল।
- শোন, যে'দিন সময় হবে সে'দিন দেখবি তোর ঘাড়ে চেপে বসে চিৎকার করে বলছি "এসে গেছি বাবু"! সে'দিন তোর কত কাজ। নতুন বাসনপত্র,  নতুন পর্দা, ছোট পোর্টেবল টিভি,কত কী কেনার।
- কী'সব যে বলিস।
- ঘাবড়াস না। ঘাড়ে চাপার কথাটা ফিগারেটিভ। চিঠি দিয়ে জানাবো। তখন আবার ধানাইপানাই করিস না।

**

স্টোরবাবু চিঠিখানা পড়ার টেবিলে রেখে গেছেন আজ মাস চারেক হলো। এনভেলপ খোলার সাহস এখনও হয়নি। রাতের চা খাওয়াটা বেড়েছে।
চিঠিতে ও কী লিখেছে? "সরি বাবু, খবরটা ঠিকই শুনেছিস" নাকি "এসে গেছি বাবু"?
ট্রেনের হুইসেলে বারবার বাড়াবাড়ি ভাবে চমকে ওঠাটা চ্যাটার্জীবাবুর এক বিশ্রী বদঅভ্যাস।

Saturday, May 20, 2017

কবরখানায় ইন্টারভ্যিউ

- মড়া হিসেবে এই কবরখানায় থাকার একটা মস্ত সুবিধে আছে জানেন দত্তবাবু!
- সে'টা কী?
- আপনার মত গোটা গায়ে ওডোমস মেখে হদ্দ হতে হচ্ছে না।
- ফানি! যাক গে। ইন্টারভ্যিউ শুরু করতে পারি ডাক্তার? আমাদের হাতে সময় বেশ কম। অলরেডি আপনি আবছা হতে শুরু করেছেন।
- ওহ হ্যাঁ। আজ বড্ড হাওয়া। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
- এ'বার বলুন।
- কী?
- কবে ঘটনাটা ঘটল?
- কোন ঘটনা?
- মরে যাওয়াটা।
- ওহ। এই, বছর তিনেক।
- নর্মাল?
- সুইসাইড। তাই আমায় এত সহজে ট্র‍্যাক করতে পেরেছেন। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব দত্তবাবু?
- ক্যুইক।
- গোরস্থান ঘুরে বেড়িয়ে এমন ইন্টারভ্যিউ নিয়ে বেড়ানোর মানে কি?
- বই লিখছি। একশো ভূতের সাক্ষাতকার। গত বারো বছর ধরে এই টেকনিক ধরে দেশের অন্তত দেড়শো কবরখানা হানা দিয়েছি। এখনও পর্যন্ত বাহান্নটা ইন্টারভ্যিউ নিতে পেরেছি। আপনি ফিফটি থার্ড।
- আই সী!
- সুইসাইড করলেন কেন?
- বহুদিনের অপরাধ বোধ।
- আফসোস হয়?
- নাহ্।
- অপরাধ বোধটা কীসের, জানা যায়?
- আই কিল্ড আ চাইল্ড।
- কিল্ড? মার্ডার?
- চিকিৎসায় গাফিলতি।  সোজাসুজি দায়টা আমারই ছিল। তবে খুব সুচারু ভাবে ব্যাপারটা চেপে দেওয়া হয়েছিল। আমার হোল্ড কম ছিল না। ইন ফ্যাক্ট, ঘটনাগা এমন ভাবেই ঢেকে দেওয়া হয়েছিল যে বাচ্চাটার বাপ মাও সন্দেহ করেনি, ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল।
- ও। কিন্তু আপনি অপরাধবোধটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আই সী।
- কত বছর রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। সামান্য চোখ লাগলেই মনে হত সেই খোকার মুখ চোখের সামনে  ভেসে উঠছে। বারবার। বড় হাসিখুশি ছিল। কতই বা বয়স, পাঁচ কি ছয়। মিস্টার দত্ত, আই কিলড হিম। স্রেফ গাফিলতি দিয়ে। তার চেয়ে ছেলেটাকে বিষ দিলে বোধ হয় আমার অপরাধ কম হত।
- ডাক্তার। ছেলেটার মুখ মনে পড়ে?
- স্পষ্ট, জানেন? স্পষ্ট। কটা চোখ। হাসলে দু'গালে টোল পড়ত। আর ডান গালে একটা কাটা দাগ।
- ঠিক এ'রকম ডাক্তার?
- মাই গড! অবিকল। আর আপনার চোখও তো...। ওহ।
- হেহ্। ডক্টর জোসেফ!
- টোল, দু'গালে...।
- আমার বাবা রিপোর্টার ছিলেন, সে'টা মনে আছে ডাক্তার? ওই ছোটবেলাতেও আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে আমায় রিপোর্টার হতে হবে। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল আমায় নিয়ে অনেক, ওঁরা চাইত আমি খুব বড় হব। কিন্তু আপনি সমস্ত হিসেব গুলিয়ে দিলেন। তবে মরে দেখলাম আমার বড় হওয়াটা থামল না, এমনি রিপোর্টার হওয়াটাও বিশেষ ঝামেলার কিছু নয়। শুধু জ্যান্ত কারুর ইন্টারভ্যিউ নিতে পারি না। এ'টাই যা।
- কিন্তু..কিন্তু...ওই মশা মারার ক্রীম গায়ে রগড়াচ্ছিলেন যে বড়?
- নাহ্, ও জিনিষ মশা তাড়ানোর জন্য নয় ডাক্তার! ও'টা ব্রেনোলিয়া আর ছায়া প্রকাশনী মেশানো জাদুক্রীম, যা গায়ে রগড়ে ভূতও জীবনে বড় হয়ে উঠতে পারে, সাফল্য অর্জন করতে পারে।

Thursday, May 18, 2017

মার্কেট

- সারকাস্ম কেন মন্দ হতে যাবে মামা? বঙ্কিম সারকাস্ম চালিয়ে বাংলাদেশ তোলপাড় করে ফেললেন। আর আমি সারকাস্টিকালি কিছু বললেই তুমি এত ইয়ে কর কেন?

- বঙ্কিম ফেদার টাচে প্রাণে মারতে পারতেন। আর তুই কোদাল দিয়ে ঘামাচি খুঁটিস। মনে রাখিস; সারকাস্ম সঠিক লোকের হাতে চন্দ্রহার, ভুল পাবলিকের হাতে লুঙ্গির গিঁট।

- ধ্যের। আধুনিক হিউমর সম্বন্ধে তোমার কোনও আইডয়াই নেই। আমার লেখায় টপাটপ কত লাইক পড়ে জানো?

- লাইক? তুই বংপেনে লাইক গুনিস রে?

- তা'তে কী?

- তুই পার্টটাইম গুড়ের ব্যবসা কর। আজকাল এক্সপোর্ট হচ্ছে শুনেছি। ভালো মার্জিন।

- মার্কেট ফীডব্যাককে উড়িয়ে দিচ্ছ মামা? আঁতলামি?

- মহামুশকিল রে। এই যে তোর মার্কেট। এই নিয়ে বড় মুশকিল।

- মার্কেট কী দোষ করল?

- মার্কেট অর্ধেক লোকজনকে বলছে লিটল ম্যাগে কবিতা লিখে নিজের লেখা নিজে পড়তে, অর্ধেক লোককে বলছে ফেসবুকে লাইক গুনতে, আর অপেক্ষায় রয়েছে যে বাকিরা তার পিছনে আসবে। তোর মার্কেট বড় একা রে বাবু। গুড়ের মার্কেটে আয়। আমার কন্ট্যাক্ট আছে। একটু কাজের কাজ অন্তত হবে।

Monday, May 15, 2017

ক্ষুদ্র

মোহন সিংহ চেষ্টা করছিলেন ছোট হওয়ার। বেশ ছোট।

ক্ষুদ্র।

অ্যালবামের হলদে গ্রুপ ফটোটার এক কোণে বসে থাকা খোকার মত একরত্তি। বড্ড রোগা, জংলি ঘাসের ওপরে একটা স্মাইলি বসিয়ে দিলে যেমনটা হওয়া উচিৎ আর কী। ডেসিমালের মত কুচি।

ক্ষুদ্র।

'মোহনকুমার সিংহ" বানানে হোঁচট খাওয়া খোকাটির সর্বস্ব ওই ফিক হাসি। তার সিঁথি,  যত্নে পাট করে আঁচড়ানো। এক খাবলা নারকোল তেল মাথায় রগড়ে, কুয়োর ঠাণ্ডা জলে ঝপাংঝপ স্নান করিয়ে, ঘসঘসিয়ে গামাথা মুছে; তারপর; তারপর যত্ন করে আঁচড়ে দেওয়া। যত্নে, ছায়াছায়া গন্ধে।

মোহন সিংহ মনে মনে পতপত করে উড়তে থাকেন, চারদিকে হুহু। আহা, যদি হওয়া যেত; ক্ষুদ্র।

**

"ধেড়ে গোবিন্দ হয়েই গোল পাকালি রে মোহন,  তুই ওইটুকুনি হলে দিব্যি তোর চুল পাট করে করে আঁচড়ে দিতাম"।

"মায়ের মত, বল"?

Sunday, May 14, 2017

র‍্যান্ডম


মা মানে গান। ছাপার শাড়ি। সন্ধ্যেবেলার পার্পল প্যাচ; খেলে ফেরা আর পড়তে বসার মাঝের মিনিট চল্লিশটুকু। মা মানে সবার আগে ওইটুকু।

স্টিলের গ্লাসে গরম ধোঁয়া ওঠা কম্পল্যান হাতে আমি। ঠাকুমার ঘর থেকে ভেসে আসা ধুনোর গন্ধ। আর হারমোনিয়ামের পাশে মা।


বাটিচচ্চড়িতে মা পিয়ারলেস। আর বেগুন দিয়ে ইলিশের ঝোলে। আর আধ ফালি করা হাঁসের ডিমের ঝোলে। আর সজনের চচ্চড়িতে।

দিদার হাতের রান্না আরও ভালো ছিল। তবে দিদার বয়ে আনা ঢাকার গন্ধ কিছুটা হলেও এখনও মায়ের হাতে রয়ে গেছে।

ওহ্। মায়ের হাতের আলু সেদ্ধ মাখা। ঘি সর্ষের তেল আর শুকনো লঙ্কা ভাজা দিয়ে। স্বপ্নের মত।


মা ঝগড়াকে ভয় পায়। যুদ্ধকে ঘেন্না করে। চিৎকারকে এড়িয়ে চলে। মায়ের মধ্যে নরম গামছা গোছের একটা ব্যাপার আছে।


মা অভাব দেখেছে। চিনেছে। আত্মস্থ করেছে। সে'সব দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে আজও মা নুয়ে পড়ে, প্রণাম করে, সমীহ করে। অনটন মাকে তেতো করতে পারেনি, না পাওয়াগুলো ন্যুব্জ করে দেয়নি।
না পাওয়াগুলোকে ঘিরে কত অজস্র সুখস্মৃতি যে সাজিয়ে চলে মা, ভাবলে অবাক হতে হয়।

বিস্কুটের টিন

- মা।
- চুপ।
- মা!
- চুপ। চুপ।
- খিদে।
- চুপ।
- ওই উল্টোদিকের দেওয়ালে..।
- কী?
- তাকে বিস্কুটের টিন। ওই যে, হলুদ টিনটা।
- টিনে বিস্কুট না থাকলে? কার না কার বাড়ি। আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র লুকিয়ে থাকতে হবে খোকা।
- ফাঁকা টিন কেউ সাজিয়ে রাখে?
- ভালো করে দেখ। ওই তাকের দিকে যেতে হলে ওই কাচের জানালা পেরিয়ে যেতে হবে। যদি সৈন্যরা দেখে ফেলে?
- দেখে ফেললেই গুম গুম গুড়ুম?
- ঠিক।
- কিন্তু খুব খিদে পাচ্ছে মা। কাল রাত্তির থেকে কিছু খাইনি।
- আর কিছুক্ষণ খোকা। সন্ধ্যে নামলেই সৈন্যরা এ অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যাবে। তখন এ'খান থেকে দিব্যি পালানো যাবে। বিস্কুটের টিনটাও নিয়ে নেব, কেমন?
- আর কতদিন পালিয়ে থাকতে হবে?
- যদ্দিন যুদ্ধ চলবে।
- কদ্দিন যুদ্ধ চলবে?
- বিদেশ থেকে সৈন্য আসবে, মিত্রপক্ষের। আমাদের বাঁচাতে। আর মাত্র ক'দিন।
- ওরা আজকেই এসে পড়ছে না কেন? এখুনি এসে পড়ছে না কেন মা? আমার বড্ড খিদে। বড্ড।
- খোকা। আর একটু। ওই তাকের দিকে গেলেই জানলা পেরোতে হবে। আশেপাশেই সৈন্য।
- পারছি না মা।
- ঘুমো।
- খিদে মা। বিস্কুট। ওই যে। একটা।
- আর একটু খোকা। আর একটু।

খোকার 'খিদে খিদে' গোঙানি ক্রমশ ঝিমিয়ে এসেছিল ক্লান্তির ঘুমে। কতক্ষণ জানা নেই, তবে ঘুম ভেঙেছিল কান ফাটানো শব্দে।

খোকা অবাক হয়েছিল তার মাথার কাছে হলুদ বিস্কুটের টিনটা গড়াগড়ি যেতে দেখে। দূর থেকে ছুঁড়ে ফেলায় টিনের ঢাকনা খুলে কয়েকটা বিস্কুট ছড়িয়ে পড়েছিল মেঝেতে। খোকার প্রিয় বাদাম বিস্কুট।

খানিক দূরে জানালার সামনে ভাঙা কাচ ছড়িয়ে রয়েছে। সে'খানেই মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে মা, মায়ের সাদা জামার পিঠে লাল ছোপ।

Friday, May 12, 2017

জাস্ট ইন

উইকিপিডিয়া বলছে জাস্টিন বীবারের বয়স তেইশ। তেইশ বছরের একজনকে নিয়ে আমরা বেশ খিল্লিটিল্লি করলাম। কারণ ওর গান গান নয়।

যদিও ওর শোয়ের টিকিট না কেটেও থাকা যায়। যদিও নিজের প্লেলিস্টে ওর গান রেখে বরদাস্ত করতেই হবে তেমন দিব্যি কেউ দেয়নি। তবু। খিল্লি বড় টেম্পটিং। আমার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জটা আরও বড় ছিল। ওর একটাও গান না শুনে আমায় খিল্লি করতে হয়েছে। পিয়ার প্রেশার। বীবারের প্রতি খিল্লি, বীবার ভক্তদের প্রতিও।

খিল্লির থীম? ওই; ওর গান গান নয়।

এই তেত্রিশ বছর বয়সেও বাপে দু'টো কড়া কথা বললে মনখারাপ হয়ে ল্যাটোরপ্যাটোর অবস্থা হয়। আর এই তেইশ বছরের ছেলেটাকে কী লেভেলের খিল্লি যে ম্যানেজ দিতে হয় কে জানে।

অবশ্য শোবিজনেসে খিল্লি থাকবেই। সে'টাই স্বাভাবিক।

তবে ইয়ে, ওই বয়সটা। তেইশ। ও এ'রকম লাইমলাইটে রয়েছে বছর পনেরো বয়স থেকে।

তেইশের আমি? মাকে কিছুদিন দেখতে না পেলেই নুনের জ্যাকেট গায়ে জোঁকের মত ছটফট করছি।

আর তেইশের বীবারকে একটা বহু মানুষ প্রাণপণে ভালোবাসছে। অনেকে আবার খিল্লিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে ব্যাটাকে।

কারণ ওর গান গান নয়।

এর আগে কার কার গানকে গান নয় বলে নস্যাৎ করা হয়েছে যেন?

Tuesday, May 9, 2017

থার্ড ডিগ্রী

কৌতুহল অতি বিষম বস্তু। হজম শক্তি কমে আসে। বাঁ কানের পিছনে চুলকানি শুরু হয়। মাথার ভিতরে একটা অসোয়াস্তিকর ঝুনঝুনুন বেজে চলে একটানা।

বিনয় মল্লিকের কৌতুহলটা বরাবরই বাড়াবাড়ির দিকে, আর মরার পরেও ব্যাপারটা কমেনি আদৌ। নরকে চেক্ ইন করেছেন ঘণ্টা খানেক হল। দিব্যি সিস্টেমে চলে সবকিছু এ'খানে। আসার সঙ্গে সঙ্গেই তার পাপের ক্যাটেগরি-ওয়াইজ লিস্ট হাতে পেয়ে গেছেন। তিনটে পাপের ক্যাটেগরি;
ফার্স্ট ডিগ্রী অর্থাৎ হিংসে, লোভ, পরনিন্দা,  অন্যের পিছনে কাঠি ইত্যাদি। শাস্তি হিসেবে দিনে দেড়শো থেকে দেড় হাজার বার বিছুটি লাগানো মুগুর-পিটুনি, টানা দেড় হাজার বছর । বিনয়বাবুর কপালে জুটেছিল দিনে সাড়ে তিনশো ঘা।

সেকেন্ড ডিগ্রিতে খুন রাহাজানির শাস্তি। দিনে মিনিমাম দু'ঘণ্টা করে উনুনে পিঠ রেখে শুয়ে খবরের কাগজ পড়া। সে শাস্তি অবশ্য বিনয়বাবুকে ভোগ করতে হবে না।

সবার ওপরে থার্ড ডিগ্রী, এর থেকে নিস্তার জোটেনি বিনয়বাবুর। এক স্যুইমিং পুল ফুটন্ত তেলে বাটারফ্লাই স্ট্রোকে ঘুরে বেড়ানো, দিনে দশ ঘণ্টা; আগামী আড়াই হাজার বছর ধরে। শিউরে উঠতে হয় ভাবলেই। কিন্তু এ'খানে ডিসিশন রিভ্যিউ সিস্টেম নেই। সবচেয়ে মুশকিল হল লিস্টে থার্ড ডিগ্রী শাস্তি কোন অপরাধের জন্য সে'টা লেখা নেই।

এনকোয়্যারি অফিস খুঁজেপেতে বের করে বিনয়বাবু জানতে চাইলেন তাঁর থার্ড ডিগ্রী অপরাধ কী। কিন্তু কাউন্টারের পেত্নী ঝেড়ে কাশলেন না। এ'টুকুই জানা গেল যে থার্ড ডিগ্রী অপরাধ একটাই। কিন্তু তা এতটাই গুরুতর যে সেটার কথা মুখে আনাও পাপ, লিস্টে লেখা তো দূরের কথা। তবে ফুটন্ত তেলের স্যুইমিং পুলে নামার আগে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

কৌতুহল এতটাই বিষম যে প্রথম দিন সবার আর থার্ড ডিগ্রিই বেছে নিলেন বিনয়বাবু। সেই আগুন স্যুইমিং পুলে নামার মুখে তার কানে কেউ ফিসফিস করে বলে দিল; "থার্ড ডিগ্রীর পাপ; লহ প্রি-ফিক্স না লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম জানানো"।

অশোকবাবুর ডেডবডি


অশোকবাবুর আঙুলের ডগার  তিরতিরে কাঁপুনিটা অনুভব করতে পারছিলেন। পিঠের নিচে কাঠের খরখরে ভাবটাও দিব্যি টের পাচ্ছিলেন। কিন্তু চোখ খোলার সাহস হচ্ছিল না। চারিদকে হাউমাউ চলছে উত্তাল সুরে। এ সময় দুম করে চোখ মেললে ঢিঢি পড়ে যেতে পারে।

ইলেক্ট্রিক চুল্লিতে ঢোকার আগে এমন বদখত ভাবে বাঁশের ওপর শোয়ায় কেন? অসোয়াস্তি। অবিশ্যি মড়ার তো অসোয়াস্তি বোধ থাকতে নেই। মুশকিল হল অশোকবাবু দিব্যি টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর জ্ঞান ফিরছে। অর্থাৎ তিনি মারা যাননি।

তবুও। স্যাট করে চোখ মেলতে সাহস হচ্ছিল না।


- বাবা!
- উঁউঁউঁ!
- ও বাবা!
- ধ্যাত্তেরি। সকাল থেকে একটানা বাবা বাবা বাবা। দেখছিস না আমি কাঁদছি? বাপ মারা যাওয়ায় দু'দণ্ড প্রাণ খুলে কাঁদব তারও উপায় নেই। তখন থেকে ব্যাবা ব্যাবা ব্যাবা। কী ব্যাপার?
- দা...দাদুর আঙুল নড়ল এই মাত্র। বাঁ হাতের!
- কী?
- দাদুর আঙুল নড়ে উঠল।
- চুপ কর স্টুপিড। যত্তসব বাজে কথা।
- ওই দ্যাখো, আবার নড়লো।
- কই!
- ওই যে। আবার!
- ও সামান্য হয়, মড়া মাঝেমাঝে নড়াচড়া করে। বাজে কথা না বলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদ দেখি। কাজের বেলার লবডঙ্কা,  এ'দিকে যত আজেবাজে কথা।
- বাবা! দাদুর চোখের পাতা নড়ছে। হুই দ্যাখো।
- চোপ হারামজাদা ছেলে! উইল জাল করার হ্যাপা জানিস?
- উইল?
- ফের বাজে প্রশ্ন? এক চড়ে চোয়াল উড়িয়ে দেব। কাঁদ, দাদু মরেছে তোর! কাঁদ!


- এই যে! এ'দিকে শুনুন।
- বলুন।
- আমাদের মড়া চুল্লিতে কখন ঢুকবে?
- একটা পোড়ানো প্রায় শেষ হয়ে এলো বলে। আপনার বাবার বডির আগে আরও দু'টো মড়া আছে। আপনার বাবারটা তারপরে।
- ভাইটি। এরপরেই আমার বাবার বডিটা চুল্লিতে দিতে হবে যে।
- লাইনে আসতে হবে স্যার। নিয়ম!
- পাঁচশো দেব।
- শ্মশানে ঘুষফুষ চলেনা।
- ঘুষ না। উপঢৌকন।  পাঁচ হাজার।
- টাকা?
- ডলার দিলে ভাঙাবে কোথায়?
- বডি রেডি করুন।


- বাবা! দেখেছ?
- আবার কী!
- দাদুর ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
- হাসি?
- হাসি! চুল্লির মুখে। তোমায় অপদার্থ বলার সময় যে হাসি দাদু হাসত, অবিকল সে'রকম।
- আজ তোকেই কোতল করব রাস্কেল!