Showing posts with label কবীর সুমন. Show all posts
Showing posts with label কবীর সুমন. Show all posts

Tuesday, August 23, 2022

অর্ক আর সুমন



স্কুল থেকে ফিরেই দুদ্দাড় করে স্নান, হুশহাশ করে ঝোল-ভাত সাফ করা। এর পর অর্ক গিয়ে বসে ছাতের ঘরে। এ'টাই তার দুপুর-সাম্রাজ্য। আর তার সাম্রাজ্যে সবচেয়ে দামী জিনিস হল একটা ফিলিপ্সের পুরনো টেপরেকর্ডার।  মেজদা এক জন্মদিনে উপহার পেয়েছিল, কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়ার আগে অর্ককে উইল করে দিয়ে গেছে। 

তা'তে প্রচুর হিন্দি গান শোনে অর্ক। প্রচুর। কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, অলকা ইয়াগ্নিক আর সাধনা সরগম; তার খুব পছন্দ। ফুলকাকার ধারণা অত লারেলাপ্পা হিন্দি গান শুনে অর্ক বখে যাবে। বাবার ধারণা ফুলকাকা বড্ড বেশ চালবাজ, সে'টাই বাঁচোয়া। 

বাবা বলে "যে গান পছন্দ সে গানই শুনবি। গানও যদি অন্যের মতে শুনতে হয়, তা'হলে আর বেঁচে থেকে হবেটা কী"।



**



- এক্সকিউজ মী। এই যে আপনি..আপনাকে কি আমি চিনি?



- আরে, মিস্টার চ্যাটার্জী৷ হোয়াট আ প্লেজ্যান্ট সারপ্রাইজ। আমি আপনারই অপেক্ষায় বসেছিলাম তো৷ 

আমিই দুলাল।

- এই অঞ্চলে আমি এর আগে আসিনি৷ একটা জরুরী কাজে আচমকাই এ'দিকে..। এই চায়ের দোকানও আগে দেখিনি৷ আচমকাই চলে এলাম। আমি জানতাম না এই বেঞ্চিতে আপনি বসে থাকবেন৷ নেহাত আপনার মুখটা একটু চেনা ঠেকল..

তাই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আর আপনি বলছেন আপনি আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন?দুলাল নামে কাউকে কখনই আমি...।

- বহু বছর ধরে মাই লর্ড। বহু বছর ধরে আমি আপনার অপেক্ষায় বসে।

- কী'সব আজেবাজে কথা!

- বাজে কথাই যদি হবে, তা'হলে আপনার আমায় চেনা-চেনা ঠেকল কেন মিস্টার চ্যাটার্জী?যাক গে, খামোখা সময় নষ্ট কেন। যে কারণে এসেছেন, সে ব্যবস্থা করা যাক।

- এক মিনিট। আমি কী কারণে এসেছি? এ'সব হেঁয়ালির কী মানে দুলালবাবু?

- আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারছেন না?

মিস্টার চ্যাটার্জী একটা পেল্লায় ঢোক গিললেন। বুকের ঢিপঢিপটা বেশ অস্বস্তিকর পর্যায় পৌঁছে গেছে। 



**



বাবার কাছ থেকে মাসে দু'টো ক্যাসেট কেনার টাকা পাওয়া যায়৷ তা দিয়ে বিভিন্ন হিন্দি সিনেমার ক্যাসেট খুঁজেপেতে নিয়ে আসে অর্ক৷ কিন্তু এই অদ্ভুত লোকটার অদ্ভুতুড়ে বাংলা গানগুলো কী'ভাবে যেন ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। এক ক্লাসমেটের বাড়িতে গিয়ে ওঁর গান প্রথম শুনেছিল, তারপর থেকে খানিকটা নেশার মত হয়ে গেছে। কাজেই গত মাসের 'ক্যাসেট-বখশিশ' দিয়ে ওই দাড়িওলারই দু'দুটো ক্যাসেট কিনেছে সে। "তোমাকে চাই" আর "ইচ্ছে হল"। আপাতত অবশ্য "ইচ্ছে হল" অ্যালবামটাই অর্কর বেশি প্রিয়। 

আর এই ক্যাসেটে একটা গান অর্ক বার বার রিওয়াইন্ড করে শোনে; "বয়স আমার মুখের রেখায়..."।
গানটা যতবার শোনে, অর্কর মনের মধ্যে আশেপাশের বয়স্ক মানুষগুলো সম্বন্ধে একটা আলাদা রকমের মনকেমন তৈরি হয়। একটা কেমন ব্যথা মেশানো স্নেহ; সে ঠিক বোঝাতে পারে না। ওই ব্যথা, স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা মিলে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা। গানটার সুর যেমন, কথাগুলোও তেমনি সুন্দর। বাবার দূরসম্পর্কের মামা, কথায় কথায় ছড়া কাটা বিনোদদাদুর কথা মনে পড়ে, আসানসোলের দাদু-দিদার কথা মনে পড়ে, জামশেদপুরের অঙ্ক-পাগল বিমলজ্যেঠু,  এমন কি বাড়ির পাশের  মুদিখানায় বসে থাকা খিটখিটে জয়ন্ত জ্যেঠুর কথা ভেবেও মনটা সামান্য খারাপ হয়ে আসে। ওই বয়সে গিয়ে সবাই কি অল্প-বিস্তর একা হয়ে পড়ে? কে জানে। গত সাতদিন ধরে দুপুরবেলা নিয়মিত এই গানটা অন্তত বার তিনেক করে শুনছে অর্ক। 

**


চায়ের দোকানে বেঞ্চির ওপরই একটা ক্যানভাসের ব্যাগ রাখা ছিল। সেই ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেশ একটা মাতব্বরে হাসি ছুঁড়ে দিলেন দুলালবাবু। মিস্টার চ্যাটার্জীর অস্বস্তি বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই সরে পড়তে ইচ্ছে করছিল না। আর কী আশ্চর্য, দোকানের অন্যান্য মানুষজন তাঁদের পাত্তাও দিচ্ছে না।

অন্তত আড়াই মিনিট সে ব্যাগ হাতড়ে দুলালবাবু ঘোষণা করলেন, "পেয়েছি মিস্টার চ্যাটার্জী, পেয়েছি"। 

**

সুমনের এই গানটা শুনতে শুনতে প্রতিবার বুকের মধ্যে একটা মোচড় টের পায় অর্ক। আজকেও পাচ্ছিল। আচমকা সামনের দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাটার দিকে বুক ছ্যাঁত করে উঠল। 

**

ব্যাগ হাতড়ে একটা সস্তা দাড়ি কামানোর আয়না টেনে বের করলেন দুলালবাবু। 

- কই মিস্টার চ্যাটার্জী, এ'টার জন্যই তো এসেছিলেন। নাকি!

- এ'সব কী পাগলামো হচ্ছে দুলালবাবু?

- পাগলামো দেখেও তো পালিয়ে যাচ্ছেন না মিস্টার চ্যাটার্জী। দেখুন না, এ'টার জন্যই তো আপনি ছুটে এসেছেন। তাই না?

- এই আয়না? 

- দেখুন না।

- দেখার কী আছে! বিচ্ছিরি একটা আয়না। আর তা'তে আমি আর আপনি।

- সত্যিই তো। দেখার কী আছে। শুনুন। শুনুন। আয়নায় শুনুন।

- শুনব? আয়নায় শুনব?

- শুনুন না। মন দিয়ে।

মিস্টার চ্যাটার্জীর বুকের ভিতরে যেন কেউ ইটপাটকেল ছোঁড়াছুড়ি করছে।  গলা শুকিয়ে আসছে। স্পষ্ট হয়ে আসছে সব কিছু। খানিকটা কান্নাও পাচ্ছে তার। আর নিজেকে বড় ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। বৃদ্ধ চ্যাটার্জী দিব্যি টের পাচ্ছিলেন যে আয়না থেকে ভেসে আসছে গান, "বয়স আমার, মুখের রেখায়..."। 

**
অর্ক হতবাক হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে। সে নিজেকে দেখতে পারছে না। আয়না থেকে তার ঘরটাও হাওয়া। আয়নায় তখন দু'জন মানুষ দাঁড়িয়ে। দু'টোই অচেনা মুখ। একজনের উসকোখুসকো চেহারা, গালভরা হাসি। সে যেন অর্কর দিকে তাকিয়েই হাত নাড়ছে। আর তার পাশে একজন বয়স্ক মানুষ, নির্ঘাত বছর ষাটেক বয়স। এর মুখটা আবার অচেনা হয়েও চেনা। ভীষণ চেনা। সেই বুড়োটে আধ-চেনা মানুষটার চোখ ছলছল, যেন এই মাত্র কেঁদে ভাসাবেন। 

ও'দিকে ফিলিপ্স টেপ রেকর্ডারে সুমন অক্লান্ত ভাবে গেয়ে চলেছেন;
"গলার কাছে পাল তুলেছে আজগুবি এক স্মৃতির খেয়া
বয়স হওয়া মানেই বোধহয়; স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়া,
কে বলে হে আড্ডা নাকি কম বয়সের কথকতা
বয়স হলেই বরং জমে আড্ডা এবং নীরবতা"!

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আয়না থেকে সেই দু'জন বিটকেল মানুষ হারিয়ে গেল। কাঁপা হাতে অর্ক টেপ রেকর্ডারের 'স্টপ' বোতামটা টিপল।

**

কয়েক মুহূর্তেই আয়না থেকে সুমনের সেই গান হারিয়ে গেল। ততক্ষণে সমস্তই জলের মত সহজ। ডুকরে কেঁদে উঠে দুলালবাবুকে জড়িয়ে ধরলেন অর্ক চ্যাটার্জী।

দুলালবাবু আয়না সরিয়ে রেখে শুধলেন, "এই বয়সে গিয়ে সবাই কি অল্প-বিস্তর একা হয়ে পড়ে মিস্টার চ্যাটার্জী"?

Sunday, June 19, 2022

চালশে আর ফার্স্টইয়ারি



সুমনবাবুর চালশে গানটা প্রথম শুনেছি কৈশোরে৷ আমার অন্যতম প্রিয় 'সুমনের গান'। আজও এ গানটা আমার কৈশোরের গান। কলেজের গান৷ হাইস্কুলে থাকতে বাড়ির ফিলিপ্স টেপরেকর্ডারে এ গান বাজত। পরে কলকাতার মেসে বসে সস্তায় কেনা এফএম রেডিওতে সে গান মাঝেমধ্যেই শোনা যেত৷ সে বয়সে, গানটা গুনগুন শুরু করলেই আশেপাশের চালশেদের প্রতি অস্ফুট "আহা, উঁহু"-ভাব টের পেতাম৷ একটা প্রবল সিমপ্যাথি। 

মনে হত, "আহা রে, কত গুঁতোগাঁতা খেয়ে এ বয়সে এসে পৌঁছেছেন৷ মাঝবয়সী খিটমিটগুলোয় না জানি তাদের কতশত স্ট্রাগল আড়াল হয়ে যাচ্ছে"।  ফার্স্টইয়ারি মেজাজের সিংহাসনে বসে ভাবতাম, "আফটার অল, এই বাবা-জ্যাঠা-কাকা-মামাদের তো ইয়ুথটাই গন৷ লোহা চিবিয়ে হজম করার দম আর নেই৷ বেনিয়মে বন্ধুদের হুল্লোড় নেই। সোমবার বিকেলের কলেজ স্কোয়্যারের ঘটিগরম নেই৷ প্রেমের চিঠি নিয়ে ফলাও করে মেস-বৈঠক বসানোর সুযোগ নেই৷ বাজে গল্পে রাতকাবার করার ধক নেই৷ পুজোয় লম্বা ছুটি নেই৷ এদের আর আছেটা কী। আহা রে, এ'দের জীবনটাই তো ফিনিশ হয়ে গেছে৷ পড়ে আছে শুধু গাদাগুচ্ছের রেস্পন্সিবিলিটি"। ব্যাস, এইসব ভাবনাকে আরও একটু উস্কে দিত সুমনের এই গান৷

এ'বারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, আজও এই গানটা আমি সেই ফার্সইয়ারি ছেলেবেলার কান ছাড়া শুনতে পারিনা৷ এমন অনেক গানই রয়েছে অবশ্য, যে'গুলো শিল্পী, সুর, কথার ওপরে গিয়ে স্মৃতি-ফসিল হয়ে রয়ে গেছে৷ কে সুমন, কীসের দামী লিরিক্স, কীসেরই বা মনকেমনের সুর- চালশের গানে সেই ক্লাস টুয়েলভ বা কলেজের বিকেল-রাত্রির গন্ধ লেগে৷ সেই গন্ধই সে গানের আইডেন্টিটি। এ'সব গান একটু মন দিয়ে শুনলে এখনও ক্যালকুলাসের ভয়টা বুকের মধ্যে ছ্যাঁতছ্যাঁতিয়ে উঠবে বোধ হয়৷ যাক গে, এই চালশের গান শুনলে এখনও ওই ফার্স্টইয়ারি একটা কণ্ঠস্বর ভারী মিহি স্বরে আহা উঁহু করে বলে, "আহা রে, যাদের বয়স চল্লিশ পেরোল তাদের কী দুঃখ গো৷ প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়ে চিন্তা করেই দিন গুজরান করতে হয়, কলেজ ফেস্টের খোঁজখবর আর তাদের নিরেট জীবনে দাগ কাটে না৷ জোড়া রোল খাওয়ার বদলে তারা একটা ভেজিটেবল চপ ইন্সটলমেন্টে খায়৷ ইশ৷ আর এরা বেপরোয়া বিরিয়ানিতে রইল না, সুবোধ স্যান্ডুইচে এসে ঠেকেছে৷ দলবেঁধে দীঘা যাবে কী, গ্রুপ ইন্সুরেন্স ছাড়া আর কোনও ভাবনায় এদের স্বস্তি নেই৷  এদের জন্য কী মনকেমন গো"। 

সমস্যা হল, সে সিমপ্যাথির বেলুনে সুট করে চুপসে দেয় অন্য একটা গাম্বাট কণ্ঠস্বর, " ওরে আমার কচি খোকা এলেন হে৷ এ'সব ভাবনা হাউই নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? অম্বলের ওষুধ কি তোমার গ্র‍্যান্ডফাদার খাবে"? অমনি, বুকের মধ্যে বরফঝড়।   এই গান যে আর 'ওদের' জন্য লেখা নয়। এ গান এখন ডাইরেক্ট আমার এবং আমাদের৷ আমি আর এ গানের অডিয়েন্স নই, সাবজেক্ট৷ আমি আর "আজকে যে.."র দলে নেই৷ সুট করে "কালকে সে.." টীমে এসে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছি৷ চল্লিশ আসছে, ছোটবেলার সুমন দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই৷

Tuesday, November 2, 2021

অ্যাপোক্যালিপ্স

- এই যে স্যার৷ জ্ঞান ফিরেছে তা'হলে৷ চারদিকে তাকিয়ে দেখুন৷ এই বজরাই হচ্ছে এখন আপনার আস্তানা৷
- বাহ্৷ আপনার এই বজরাটা দিব্যি তো৷
- স্টেট অফ দ্য আর্ট মশাই৷ স্টেট অফ দি আর্ট৷
- বেশ৷ একটু জিরিয়ে নিই৷
- হ্যাঁ। বেশ তো৷ এ'খানে তো আপনার অখণ্ড অবসর৷ সামান্য ব্র্যান্ডি দিই? নাকি চা করে আনব? শুধু ব্ল্যাক টী পাবেন কিন্তু৷
- আপনি কিডন্যাপার৷ আপনি যখন বলছেন, তখন অখণ্ড অবসরই সই৷ যা দেবেন খেতে, তাই রুচবে৷
- অমন খিটখিটে মেজাজে কথা বলবেন না প্লীজ৷ বড় আশা করে আপনাকে নিয়ে এসেছি৷
- তুলে এনেছেন বলুন।
- এহ হে, কিডন্যাপিংয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি বেশ ইরিটেটেড বোধ করছেন৷ তাই নয় কি স্যর?
- ইরিটেটেড হওয়া উচিৎ নয়, তাই না? না হয় একটু ক্লোরোফর্ম শুঁকিয়ে চ্যাংদোলা করে তুলে এনেছেন৷ এ আর এমন কী৷
- শুনুন স্যার৷ অমন চ্যাটাংচ্যাটাং কথা বেশি বলবেন না৷ আমি আপনাকে প্রাণে বাঁচিয়েছি৷
- কিডন্যাপ করে?এই বিচ্ছিরি একটা স্টীমারে এনে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন?
- এক্সকিউজ মি! এ'টা স্টীমার? চারদিকে চেয়ে দেখুন মশাই৷ এ'টা বজরা৷
- তা আমার প্রাণরক্ষা কী'ভাবে করেছেন?


- যে'ভাবে করার কথা ছিল৷ প্রলয় শুরু হয়ে গেছে৷ অর্ধেক পৃথিবী অলরেডি জলের তলে৷ কলকাতা ভেসে গেছে আজ ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ। এক্কেবারে যাকে বলে ডিলিউজড৷ বাকি দুনিয়াটা ডুবে যাবে আগামীকাল দুপুরের মধ্যে৷ সে জলও অবিশ্যি বিষিয়ে যাবে৷ টোটাল ডেস্ট্রাকশন। ধুয়েমুছে সাফ।
- অ্যাপোক্যালিপ্স?
- ইয়েস স্যার৷
- কিডন্যাপার৷ গুল শিরোমণি৷ আপনার বায়োডেটাটা বেশ ইম্প্রেসিভ কিন্তু৷
- উড়িয়ে দিতে পারেন৷ তবে অল্প সময়ের মধ্যেই মালুম হবে, আমি ভুল বলছি না৷
- আপনি নোয়া?
- নোয়া নয়৷ নোয়া ট্যু পয়েন্ট ও৷
- এ'টা আপনার আর্ক ট্যু পয়েন্ট ও?
- আরে মশাই এ তো আর বিফোর ক্রাইস্ট নয়৷ এ'টাও আর্ক নয়, শৌখিন বজরা৷ বললাম তো৷
- গা জ্বলে যাচ্ছে৷
- অবিশ্বাস কেটে গেলে স্বস্তি পাবেন। পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে স্যার৷ আমরাই শুধু রইনু বাকি৷
- তা, ইয়ে৷ আমার এনেছেন কী মতলবে? আপনিও পুরুষ৷ আমিও তাই। যদি পৃথিবীকে রিপপুলেট করতেই হয়, তা'হলে তো আমরা সাফিশিয়েন্ট নই৷ তাছাড়া জন্তুজানোয়ার আর গাছপালার স্যাম্পেলগুলো কই?
- আরে ধুর ধুর৷ আমার বয়ে গেছে এ'সব জঞ্জাল আবার রিক্রিয়েট করতে৷ সব বিষিয়ে গেছে স্যার। সব। এবার সব কিছু ধুয়েমুছে সাফসুতরো হয়ে গেলেই মঙ্গল৷
- তা ভাই, আমিও তো সেই বিষাক্ত পৃথিবীরই একজন। আমিও ভেসে গেলেই ভালো হত না?
- না স্যার৷ না৷ শেষ আলোটুকু আপনার সুরেই ছিল৷ তাই আপনাকে নিয়ে আসা৷ এ বজরায় কয়েক মাসের খাবার মজুদ করা আছে৷ আপনার গিটার, মাউথঅর্গান আর কীবোর্ডটাও আনিয়ে রেখেছি৷ আর রিপপুলেট করার গবেটামো নয়৷ এ'বারে শুধু আপনার গানে গানে ভেসে গিয়ে ফুরিয়ে যাওয়া৷ ব্যাস৷ হিসেব খতম৷ দুনিয়াদারীর হাড়বজ্জাতি আর সহ্য হয় না৷
- আমরা সত্যিই কোথায় আছি বলবেন?
- আমি মিথ্যে বলছি না সুমনবাবু৷ অনন্ত সাগরে আর নিরেট অন্ধকারে; আমরাই শেষ দুই প্রাণবিন্দু৷ আপনার গানই শেষ আলো৷ সে আলো নেভার পর সমস্ত শেষ৷
- ভাই নোয়া..।
- আর গাঁইগুঁই নয় সুমনবাবু৷ ওই যে আপনার গীটার৷ এই নিন, ধরুন। এ'বার একটা গান হোক দেখি৷ আমার আর আপনার কিন্তু সত্যিই আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই।

Tuesday, March 16, 2021

সুমন আর দাদু

আমি আর দাদু একসঙ্গে সুমন আবিষ্কার করেছিলাম৷ বন্ধুর থেকে ধার করা ক্যাসেটে - "ইচ্ছে হল"। তখন সবে ক্লাস টেনের বোর্ড পরীক্ষা শুরু হয়েছে৷ দুপুরের দিকে পরীক্ষা, তাই সকাল থেকেই বুক ধড়ফড়, গা-কাঁপুনি৷ গোটা বছর মন দিয়ে পড়াশোনা না করার বিশ্রী গ্লানি। সে অস্বস্তি কাটাতে ভরসা ছিল ফিলিপ্সের টেপ-রেকর্ডার আর দাদুর 'আরে এগজামই তো, হাতিঘোড়া-বজরাপানসি তো নয়' মার্কা হাসি৷ 

সেই সকালগুলোর স্মৃতি ফিকে হওয়ার নয়৷
সুমনের সুরে দাদু মাথা দুলিয়ে চলেছে, হাঁটুতে তাল ঠুকছে, আর 'বাহ্ বাহ্' বলে বিড়বিড় করে চলেছে৷ একদিকে অধরা সিলেবাস মনের কলার টেনে ধরছে আর অন্যদিকে সুমনের বাঁশুরিয়াদাদা বুকের মধ্যে ঢুকে ঝাড়পোছ শুরু করে দিয়েছে৷ মা হাঁকডাক শুরু করেছে স্নানে যাওয়ার জন্য, পরীক্ষার জন্য সময়মত না বেরোলেই নয়৷ কিন্তু ক্যাসেটের সেই দাপুটে সুমন থামছেন না। খাটের এককোণে সুমনাপ্লুত দাদু, ডায়াগোনালি অন্যকোণে আমি৷ মাঝে অদরকারী কিছু বইখাতা৷ 

দাদু মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে বলছে, "সবজিওয়ালা বন্ধু তো বটেই৷ এই সুন্দর সেন্টিমেন্টটা নিয়ে আমরা আগে গান বাঁধিনি বা শুনিনি কেন বলো দেখি ভাই"? অরুণ মিত্রের উঠে দাঁড়ানোর অ্যাডভেঞ্চার শুনে দাদুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে - সেই ঔজ্জ্বল্যে ভর দিয়েই আমার সুমন-ভালোবাসার দিকে এগিয়ে যাওয়া৷ 

দাদুর চলে যাওয়া বছর সাতেক আগে, মার্চের এই ১৬ তারিখেই।
সুমনের গান কখনও কোত্থাও যাবে না, সে'টাই বাঁচোয়া৷ 

শুভ জন্মদিন, সুমন৷

Tuesday, April 28, 2020

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৯


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৯

কত পুরনো অভ্যেস এ'বারে সত্যিই আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। 
ফেলতেই হবে।
জিলিপি, সন্দেশ নিয়ে আপাতত ভাবনাচিন্তা না করতে হলেও, লারেলাপ্পা বোলচালগুলো এ'বার ছাড়তেই হবে।

"মনডে ব্লুজ" বিষয়ক শৌখিন সস্তা ঠাট্টাগুলোও এ'বার বাদ না পড়লেই নয়।

হাল না ছাড়ার গানটা ভাগ্যিস থেকে যাবে। ভাগ্যিস।

Tuesday, December 25, 2018

ডানপিটে লোকটাকে

- আপনি? আপনিই?

- আজ্ঞে।

- বিশ্বাস হয় না...আপনি আদতে...এত ম্যাড়ম্যাড়ে?

- ওই। দূর থেকে যে চকমক দেখা যায়, তা কি কাছে এলে থাকে।

- তার চেয়েও বড় কথা, আপনার সঙ্গে যে সত্যিই দেখা হবে..তা ভাবাই যায় না। আপনি তিনিই তো?

-  আজ্ঞে, বাঁ হাতে চটের ব্যাগটা তো দেখতেই পাচ্ছে। ভারি আর বেঢপ চেহারা। আর এই আমার ডান-পা খানা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ফুটবোর্ডে।

- বিলক্ষণ! বিলক্ষণ।  ডেসক্রিপশন একদম মিলে যাচ্ছে। বাস যত জোরে ছুটছিল..।

- আমিও তত জোরে..।  ডান হাত দিয়ে আছি পিছনের হাতলটা ধরে।

- কিন্তু সব থেমে আছে কেন? বাস, লোকজন। সব স্ট্যান্ড স্টিল কেন?

- আপনি ভাবছেন, হাত বাড়াবেন কিনা। সেই মুহূর্তের ভগ্নাংশে আমরা আটকে আছি।

- সর্বনাশ, এক পা ফুটবোর্ডে রেখে ভাবছেন কেউ হাত ধরবে কিনা? আপনি তো খতরনাক লোক মশাই।

- উপায় নেই স্যার। মরার সময় কি আছে যে অত সুবিধে অসুবিধে নিয়ে ভাবব? আপনি হাত বাড়ালে ভালো, নয়ত অন্য কারুর হাত। মোট কথা আমার থলিটা দূরে দূরে পৌঁছতে হবেই। যা করবেন তাড়াতাড়ি করুন, বাসের গতি এ'বারে বাড়বে।

- ডানপিটেই বটে আপনি। এই যে বাড়িয়ে দিলাম, কষে ধরুন দেখি হাতখানা।

***

তন্দ্রা যখন ভাঙলো তখন ডানপিটে ভদ্রলোক আর তার ঢাউস থলে হাওয়া, বাস কন্ডাক্টর মুখ ঝামটা দিচ্ছেন দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিমোনোর জন্য। হাতের মুঠোয় চিরকুটটা পেয়ে দিবাকর মিত্র অবাক;

"দিবাকরবাবু, হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ'বার পিছু হঠলে চলবে না। অম্লান দাস নামে একজনের ঠিকানা দিলাম। অম্লানবাবুর তেমন কেউ নেই, চায়ের দোকানে বাসন মেজে চলে যায়। তিন নম্বর মতিলাল ঘোষ লেন ঘেঁষা সে দোকান। সে'খানেই তাঁর বাস। দাসবাবুর বড় পেস্ট্রি খাওয়ার শখ৷ এক বাক্স ভালো পেস্ট্রি তাঁকে পৌঁছে দেবেন? প্লীজ? চুপিচুপি? আমার বোধ হয় থলি হাতে ও পাড়ায় যাওয়া হবে না এ'বার। প্লীজ, এ কাজটা করে দেবেন? অম্লানবাবু খুব খুশি হবেন, বছর দশেকের খোকারা যেমন খুশি আর কী; বেনামি কেক-প্যাস্ট্রির বাক্স পেলে। প্লীজ, কেমন?

ইতি ডানপিটে"।

ফ্লুরিস থেকে একবাক্স প্যাস্ট্রি কিনে যখন মিত্রবাবু বেরিয়ে এলেন, ততক্ষণে পার্ক স্ট্রিটে সন্ধ্যে নেমেছে। চারদিকে আলো; টুনি বাল্বের স্যান্টা ক্লজ ঝলমল করছে। আলোর স্যান্টার দিকে তাকিয়ে মিচকি হাসলেন মিত্রবাবু;
"স্যান্টাদা, আপনাকে সাক্ষাতে দেখতে পেলে টুনি দিয়ে আপনার এমন এলেবেলে ছবি কেউ আঁকত না"।

Sunday, October 22, 2017

মাঝরাত্রের স্কুলবাড়ি আর দাসগুপ্তবাবু



- আসুন মিস্টার দাসগুপ্তা। ওয়েলকাম। ওয়েলকাম টু দ্য ফার্স্ট ডে অফ স্কুল।

- ধন্যবাদ। কিন্তু মানে...আমি ঠিক...।

- বুঝতে পারছেন না? ন্যাচরালি, ন্যাচরালি। ক্লাসরুমে নিয়ে যাওয়ার আগে তাই দেখা করতে এলাম..। আমি এ'খানকার হেডমাস্টার। ইয়ে, শিক্ষক বলতেও আমিই..।

- কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না...এত রাত্রে আমি এই সাতপুরনো ভাঙাচোরা স্কুলবাড়িতে কী করছি? এলামই বা কী করে? 

- ভূতের স্কুল তো পোড়ো স্কুলবাড়িতেই হবে।

- কী? আমি মৃত? 

- অফ কোর্স। আপনি মৃত! আমি বা এ'খানের সমস্ত ছাত্ররা, সবাই...।

- আমি মারা গেছি?

- নিঃসন্দেহে। শুধু মড়ারা এই স্কুলবাড়িটা দেখতে পায়।

- আমি মারা গেছি! ব্যারাকপুরের অরিন্দম দাসগুপ্ত মারা গেছে! 

- আপনি মারা গেছেন! অরিন্দম দাসগুপ্ত মারা যাবেন কেন? তিনি এই মাত্র ইয়ারবাড খুঁজে না পেয়ে "ধ্যারশ্লা" বলে ফের শুতে গেলেন।

- আমিই তো অরিন্দম দাসগুপ্ত।

- মিস্টার দাসগুপ্তা। রিল্যাক্স। ইউ আর নট হিম। ইউ আর জাস্ট আ ডেড ড্রীম অফ মিস্টার দাসগুপ্তা। আপনি দাসগুপ্তবাবুর সদ্য মৃত স্বপ্ন। এ'টা মড়া স্বপ্নদের স্কুল মিস্টার দাসগুপ্ত। 

- ওহ...আমি তাহলে...।

- আচমকা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়ে মাকে চমকে দেবেন ভেবেছিলেন। আজ সন্ধেবেলা পৌঁঁছনোর কথা ছিল। ভেবেছিলেন মাকে জড়িয়ে ধরবেন। পাড়ায় হাঁটতে বেরোবেন। দত্তবাজার থেকে ট্যাংরা কিনে এনে মাকে বলবেন ঝাল করতে। রাতে মায়ের পাশ ঘেঁষে শুয়ে কত গল্প। পুরনো পাশবালিশের কাচা ওয়াড়ের সুবাস। শোওয়ার ঘরের জানালার পাশে গন্ধরাজ গাছ। যেই গাছের আশেপাশে দত্তবাড়ির মিতুল ঘোরাঘুরি করত। সে'সব ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে আপনার ঘুমিয়ে পড়ার কথা ছিল। আপনি সেই স্বপ্নের মিস্টার দাসগুপ্ত,  আপনি মারা গেছেন। মারা গেছেন।

- তা'হলে...।

- যা হয়। মিস্টার দাসগুপ্তার মিসেস ভ্যাকেশন প্ল্যান করে ফেলেছিলেন। প্লাস ফিরে এসেই অফিসের রিভিউ।  দেশের বাড়িমুখো স্বপ্নের মিস্টার দাসগুপ্তা হ্যাড টু ডাই। দেশের বাড়ির স্বপ্নের মিস্টার দাসগুপ্তা বা আপনি না মরলে আদত দাসগুপ্ত ছিন্নভিন্ন হতেন। এই কিছুক্ষণ আগেই আদত দাসগুপ্ত দেশের বাড়ি ফেরার টিকিট ক্যান্সেল করেছেন।

- অর্থাৎ সে টিকিট ক্যান্সেল করে আদত দাসগুপ্ত আমায় খুন করেছেন। আর আমি ওর মৃত স্বপ্নের ভূত।

- প্রিসাইসলি। তবে মনখারাপ করবেন না। আপনার ক্লাসে অসংখ্য মৃত স্বপ্নের ভূত, ইন ফ্যাক্ট ব্যারাকপুরের অরিন্দম দাসগুপ্তর প্রচুর মড়া স্বপ্ন আপনার ক্লাসমেট হতে চলেছে। ওদের সঙ্গে আলাপ হলে আপনার ভালো লাগবে।

- ইয়ে, আপনার পরিচয়টা হেডমাস্টার স্যার? ক্লাসও তো আপনিই নেবেন?

- ক্লাস আমিই নেব। আমার ডাকনাম সুগা।

- সুগা?

- পুরো নাম সুমনবাবুর গান! 

- ওহ! যাক। ক্লাসরুমটা কোনদিকে সুগাবাবু?

- আসুন আমার সঙ্গে। আর হ্যাঁ, মিতুলদেবীর একটা মড়াস্বপ্ন আপনারই ক্লাসে রয়েছেন, "অরিন্দম একদিন অন্তত জোর গলায় বলবে 'তুই অন্য কাউকে বিয়ে করবি না' " গোছের একটা স্বপ্ন। মরে কাঠ হয়ে ছিল। আমি এই ক্লাসে ভর্তি করিয়ে নিয়েছি। আপনার ইন্টারেস্টিং লাগতে পারে, তাই বললাম। এ'বার চটপট আসুন দেখি, ক্লাস শুরু হতে দেরী হচ্ছে।

Saturday, August 12, 2017

চেনা চেনা হাসিমুখ

সেই ছোটবেলার শহর।

সেই কবেকার। কত স্মৃতি। কত পুরনো মানুষের স্নেহসুবাস জড়িয়ে রয়েছে এ শহরে।  অনিন্দ্যর যে কী ভালো লাগছিল।

বাবা যখন বদলি হয়ে এখানে এসেছিল, অনিন্দ্য তখন ক্লাস ফোরে। এ'খান থেকে যখন বাবা ফের ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসে তখন অনিন্দ্য সবে ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছে। ওই পাঁচ বছরের স্মৃতি আজও অনিন্দ্যর মনে জ্বলজ্বল করে। বাগানে ঘেরা চমৎকার একটা দোতলা কোয়ার্টারে ওরা থাকত। স্কুলবাড়িটা ওদের সেই বাড়ি থেকে হেঁটে
বড় জোর মিনিট দশেকের রাস্তা। স্কুলের সামনের মাঠে রোজ ফুটবল বা ক্রিকেট। বাপ্পা, মন্টু, নেপাল আর আসিফের সঙ্গে সেই সন্ধে পর্যন্ত আড্ডা। এদ্দিন পর কাজের সূত্রে এ'খানে এসে কী ভালোই যে লাগছিল। অনিন্দ্যর খুব ইচ্ছে ছিল বাবা মাকে নিয়ে আসার, কিন্তু এই ছোট্ট শহরে হোটেলের সুব্যবস্থা কেমন থাকবে সে বিষয়ে সে ততটা নিশ্চিত ছিল না। পুরনো যোগাযোগও কিছু নেই। তাছাড়া মাত্র একটা দিনের ব্যাপার।

কাজ মিটে গেছিল সন্ধ্যে ছ'টার মধ্যেই, অনিন্দ্যর ট্রেন রাত্তির পৌনে ন'টায়। অনিন্দ্য ঠিক করেছিল স্টেশনবাজারে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, কোনও পরিষ্কার ভাতের হোটেল দেখে রাতের খাওয়াটা সেরে নেবে। সঙ্গে শুধু একটা কাগজপত্র রাখার হালকা সাইডব্যাগ, কাজেই ঘোরাফেরায় কোনও অসুবিধে নেই। এই স্টেশন বাজার অনিন্দ্যদের পুরনো কোয়ার্টার থেকে হাঁটাপথ। বেশ জমজমাট বাজার। অটোস্ট্যান্ড,  রিক্সাস্ট্যান্ড, মাছ সবজির বাজার,  শাড়ি জামাকাপড়ের দোকান; সব মিলে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ একটা ব্যাপার। বিশেষত সন্ধের দিকটায়।

অনিন্দ্য ছোটবেলায় এ'দিকে প্রায়ই আসত, কখনও বাবার সঙ্গে মাছসবজির বাজারে, কখনও বইখাতা কিনতে, কখনও বন্ধুদের সঙ্গে নিউ মাদ্রাজ ক্যাফের সম্বর-দোসা বা ডিলাইট বেকারির চিকেন প্যাটি খেতে, কখনও স্টেশন লাগোয়া মনোরমা বুক স্টোর থেকে আনন্দমেলা বা শুকতারা কিনতে অথবা অন্য কোনও কাজে। সে'সব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘণ্টা দুয়েক দিব্যি কেটে যাবে। পুরনো জায়গাগুলো এই সুযোগে আরও একবার ঢুঁ মারা যাবে।  পরেশকাকুর একটা দশকর্মার দোকান ছিল যে'খান থেকে ঠাকুমার ফরমায়েশ মত পুজোর সামগ্রী আসত, ভদ্রলোক দুর্দান্ত ভূতের গল্প বলতেন। দিনদুপুরে এমন সমস্ত অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে গল্প বলতেন যে অনিন্দ্যর গায়ে কাঁটা দিত, পরেশকাকুর সঙ্গে দেখা হলে বেশ হয়। অথবা বীণাপাণি ক্যাসেট সেন্টারের মনাদা যার কিশোরকুমারের সমস্ত গান মুখস্ত থাকত। এরা এখন কেমন আছে? মনাদা নিশ্চই এখন সিডি ডিভিডি বিক্রি করে।

অনিন্দ্য যখন ক্লাস সেভেনে তখন তাদের বাড়িতে প্রথম টেপ রেকর্ডার আসে। ফিলিপ্সের স্টিরিও। প্রথম ক্যাসেট কেনার টাকা দিয়েছিলেন ঠাকুমা, পঞ্চাশ টাকায় সে সময় অন্তত দু'টো ক্যাসেট হয়ে যেত। সে দিনটা অনিন্দ্যর স্পষ্ট মনে আছে। মনাদা খৈনি মুখে পুরতে পুরতে বলেছিল "মিউজিকের হিমালয় একজনই, কিশোরদা। বাকি সব স্পীডব্রেকার। কাজেই তোর প্রথম দু'টো ক্যাসেট হওয়া উচিৎ গোল্ডেন হিটস অফ কিশোর কুমার ভল্যুম ওয়ান আর ভল্যুম ট্যু"।

অনিন্দ্য ভল্যুম ওয়ানটাই নিয়েছিল। বাকি টাকায় একটা নতুন গানের ক্যাসেট খুঁজছিল সে। নতুন টেপরেকর্ডারে একদম নতুন সুর, নতুন কথা আর নতুন কণ্ঠ মিলিয়ে নতুন গান। মনাদার সমস্ত জ্ঞান কিশোরকুমার ঘেঁষা। কাজেই ওর ভরসায় না থেকে অনিন্দ্য নিজেই হন্যে হয়ে খুঁজছিল বীণাপাণি ক্যাসেট সেন্টারের প্রতিটা শেল্ফে। মলাট দেখে বই বিচারের চেয়ে সতেরোগুণ বেশি কঠিন হচ্ছে ক্যাসেটের মলাট দেখে গান বিচার। অনিন্দ্য যখন প্রায় হন্যে হয় কিশোরকুমারের গোল্ডেন হিটস ভল্যুম ট্যুয়ের বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া মুখে তখন পাশে দাঁড়ানো এক অপরিচিত কাকু তার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন "সুমন চাটুজ্জের গান শুনেছ খোকা? না শুনে থাকলে এই বেলা ওর সদ্য রীলিজ হওয়া 'তোমাকে চাই' ক্যাসেটটা কিনে ফেল। জীবন পাল্টে যাবে সেই সুর আর কথায়"।

সেই নীল চেক শার্টের ভদ্রলোকটির কথা আজও মনে পড়ে অনিন্দ্যর। জীবনের একটা ভালোবাসা সে'দিন খুঁজে পেয়েছিল সে; সুমনবাবুর গান।

**

স্টেশন বাজার আমূল পালটে গেছে, অনিন্দ্যর প্রায় সব কিছুই নতুন ঠেকছিল। রিক্সাস্ট্যান্ড উঠে গিয়ে এখন টোটো স্ট্যান্ড হয়েছে।  পরেশকাকুর দশকর্মার দোকান ভেঙে একটা ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়েছে; মালিক পরেশকাকুরই ছেলে। ডিলাইট বেকারির চেহারা বরং আগের চেয়ে  অনেক বেশি জীর্ণ, আগে সন্ধেবেলা টিউশন ফেরত ছাত্রেদের একটা ভিড় লেগে থাকত একটানা, সে'টা নজরে পড়ল না।

মাদ্রাজ ক্যাফে আগে বাতানুকূল ছিল না, সামনে ইয়াব্বড় গ্লোসাইন ছিল না। ভাতের হোটেল না খুঁজে ডিনারটা সে'খানেই সেরে নিল অনিন্দ্য। মশলা দোসার স্বাদ এখন আমূল পাল্টেছে। কাউন্টারে বসা রাজু ভাইয়ার বেশ মুটিয়ে গেছে, চুলেও পাক ধরেছে। দোসা আর ফিল্টার কফি খেয়ে বেরিয়ে অনিন্দ্য দেখল হাতে তখনও আধ ঘণ্টা সময় রয়েছে। 

স্টেশন বাজারের যে সরু গলিতে মনাদার বীণাপাণি ক্যাসেট সেন্টার ছিল সে'টা মাদ্রাজ ক্যাফের পাশেই। মনাদাকে দেখার সামান্য ইচ্ছে আর সময় দু'টোই হাতে ছিল। মাদ্রাজ ক্যাফের ক্যাশ কাউন্টারে রাখা স্টিলের বাটি থেকে তুলে নেওয়া ভাজা মৌরি চিবুতে চিবুতে অনিন্দ্য ঢুকল সেই গলিতে।

অদ্ভুত ব্যাপার, গোটা শহর ভোজবাজির মত বদলে গেলেও এই গলিটা আদৌ পালটায়নি। সেই সাতপুরনো পোস্টবাক্স, সেই দেওয়ালে হলুদ আর লাল পেন্টে আঁকা বাপি গেঞ্জির বিজ্ঞাপন, সেই ল্যাম্পপোস্টগুলোর গায়ে সাঁটা "এই চিহ্নে ভোট দিন" পোস্টারগুলো । গলির শেষ প্রান্ত থেকে ভেসে আসা ভেজিটেবল চপের গন্ধটাও ঠিক তেমন ভাবেই নাকে এলো; যেমনটা পাওয়া যেত অত বছর আগে।

অনিন্দ্য রীতিমত চমকে গেল বীণাপাণি ক্যাসেট সেন্টারের সামনে এসে। সেই পালিশ ওঠা সব শোকেস। সেই সবজে পেডেস্টাল ফ্যানের ঘরঘর। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, এ'খানে এখনও ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে। আজকালও লোকে ক্যাসেট কেনে? এখনও কারুর কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার পাওয়া রয়েছে? মনাদার চেহারায় এতদিনেও তেমন কোনও পরিবর্তন নেই, সেই খৈনি চিবুনো হাসি। মনাদা অবশ্যই অনিন্দ্যকে চিনতে পারেনি, সে তখন বছর বারো তেরো বয়সের ছেলেকে কিশোরকুমারের ক্যাসেট গোছাতে ব্যস্ত।

হলদেটে জামা গায়ে ছেলেটার হাতে গোল্ডেন হিটস অফ কিশোরকুমার ভল্যুম ওয়ান। মনাদা ওকে দু'নম্বর ভল্যুমটাও গছাতে চাইছে। নিজের নীল চেক শার্টের দিকে তাকিয়ে অনিন্দ্যর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ঘামতে শুরু করেছিল অনিন্দ্য। ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে, এখুনি ছুটতে হবে প্ল্যাটফর্মের দিকে।

ভাবনাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার আগে নিজেকে চটপট গুছিয়ে নিয়ে ছেলেটির কাঁধে হাত রাখল অনিন্দ্য;
"সুমন চাটুজ্জের গান শুনেছ খোকা? না শুনে থাকলে এই বেলা ওর সদ্য রীলিজ হওয়া 'তোমাকে চাই' ক্যাসেটটা কিনে ফেল"।

Sunday, January 24, 2016

অনেকদিন পর

- ওই তারাটা কী?
- নীলচে ওইটে?
- হুঁ।
- ওটা তারা নয়। গ্রহ।
- ওহ। ওটাকে তারা ভেবে গান লিখে ফেললাম গো দাদা।
- পছন্দ?
- কী?
- গ্রহটা পছন্দ? যাবি?
- যাওয়া যায়?
- প্রাণ আছে তো সেখানে।
- তাই নাকি?
- তুই বড় ভুলো বোধি। কতবার তুই ঘুরে এসেছিস ওখান থেকে।
- ওহ। তাই বুঝি এই টানটা অনুভব হচ্ছে?
- একদম। যাবি আবার ওখানে?
- কাল গোটা রাত ও'দিকে তাকিয়েই কেটে গেল। ইচ্ছে হচ্ছে। পাঠিয়ে দাও।
- যদি বিরক্তি আসে?
- আসুক। ক'দিন তবু বেঁচে আসি।
- বেশ। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তা হ্যাঁ রে বোধি, গানটা কী লিখলি বললি না...?
- গেয়ে শোনাই?
- হোক।
- সারারাত জ্বলেছে নিবিড়....।

-জয়েনিং ডে'তে রেসিগনেশন? আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড ইয়ংম্যান?

-ফোন ধরে যে বেলা নয়; বেলার মা দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ, সেটা ঠাহর করতে পারিনি।

- মানে?

- মানে বুঝে কাজ নেই স্যার। এক কপি রিসিভ করে দিয়ে দিন। আজ রাতের ট্রেনে দেওঘর যাচ্ছি। পার্মানেন্টলি।

Thursday, September 24, 2015

প্রফেট

১। গান 


- ঈশ্বর!!


- অবাক হচ্ছ? 


- ভাবতে পারছি না।


- আমার জন্যেই তো এত তোড়জোড় তোমার, তাই না?


- আমি তো নিমিত্ত।


- যুদ্ধে চললে?


- সংগ্রাম। ধর্মের হয়ে। আপনার হয়ে। এ শুধু যুদ্ধ নয়। আপনার পুজোও বটে। আশীর্বাদ করুন। 


- বন্দুক কেন সাথে?


- পুষ্পাঞ্জলির সময় আসবে ইশ্বর, এ সংগ্রামের অন্যদিকে। সমস্ত পাপের শেষে। ততদিন যে বন্দুকই যে আপনার চরণকমলে নিবেদিত। আশীর্বাদ করুন হে শ্রেষ্ঠ। 


- বেশ। আশীর্বাদ করি তোমার বন্দুককে স্পর্শ করে। এসো কাছে, ও বন্দুক এগিয়ে দাও।


- আমি ধন্য।

বন্দুক ছুঁয়ে ইশ্বর গাইলেন - 

" ...তুমি হও আমার মেয়ের ঘুমিয়ে পড়া মুখ
তাকিয়ে থাকি,এটাও আমার বেঁচে থাকার সুখ"।


পুচকে কবরের বুকে লুটিয়ে পড়লেন ভক্ত। বৃষ্টি নেমে ধুইয়ে দিল কবরের উপরের ধুলো, ভিজিয়ে দিলে পিঠের আলগা হওয়া বন্দুক।

ভক্তের বুকে রয়ে গেল হাপুস কান্নার সুর - 


"তুমি হও বেঁচে থাকার রসদ সবার কাছে", তার গালে স্মৃতির ধুলো, কাঁধে ট্রিগারের ভার, পিঠে ঈশ্বরের হাত।


২। উত্তর 

- তুমি শেষ পর্যন্ত ওই দিবাকর জানার ছেলেকে বিয়ে করবে? শেষে ওই গোয়ালার ছেলেকে পছন্দ করলে তুমি? ছিঃ।

- তোমার চিন্তাগুলো এত ছোট বাবা? দিবাকরকাকু গোয়ালা তো কী হয়েছে? অনেস্ট বিজনেস্‌ করে এসেছেন গোটা জীবন। ওর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। 

- থাম! বড় বড় কথা শিখেছ। তুমি ওই গোয়ালা দিবাকর জানার ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। 

- আমি তোমার কথা শুনতে পারব না। 

- আমার কথা শুনবে না?

- না।

- বটে? খুব লায়েক হয়েছ না? প্রেম করে বিয়ে করবে? ওই ছেলেকেই বিয়ে করবে? ও তোমার স্টেটাস মেইন্টেইন করতে পারবে? ডাক্তার সান্যালের ছেলের সম্বন্ধ এসেছে। তাকে ছেড়ে তুমি ওই জানা গোয়ালাকে কনসিডার করতে পারলে কী করে? তুমি আমার ডিসিশন কিছুতেই শুনবে না? চুপ থেক না, উত্তর দাও। 

- প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরতো জানা।



৩। চেনা 





- আপনি বুদ্ধ?

- ইয়াপ্‌।

- গৌতম বুদ্ধ?

- ইয়াপ্‌।

- রিবার্থ?

- ইয়াপ্‌।

- হোয়াট দ্য হেল? 

- হেল? ওই ব্যাপারে কিন্তু আমি সাইলেন্ট।

- ধুর।

- রিয়েলি। বাই দি বাই, আপনি?

- আপনি যখন বুদ্ধ, তাহলে আমি চে গুয়েভেরা। 

- ওকে চে।

- বেশ, আপনি যখন বুদ্ধ; তখন ফিলোসফি কিছু ঝাড়ুন।

- ফিলসফি? ফিলোসফি একটাই। ওই গিটারটা দিন। শুনিয়ে দিচ্ছি।

- গিটার চাই? কেন?

- সে জন্মে নির্বাণ এ জন্মের গিটার। দিন না দিন। ফিলোসফি গেয়ে শোনাই। 

- এই নিন। শুরু করুন।

- চে না দুঃখ,চে না সুখ...