Tuesday, June 29, 2021

বই কেনা ও পড়া




*নতুন বইয়ের খবর পাওয়া গেল*

দু'সেকেন্ডের মাথায়ঃ
গুডরীডস ঘেঁটে দেখা বইটা সম্বন্ধে কে কী বলছে।

আড়াই মিনিটের মাথায়ঃ
গুগলে অন্যান্য রিভিউয়ের খোঁজ৷

সতেরো মিনিটের মাথায়ঃ
বন্ধুকে ফোনঃ ওই বইটা পড়েছিস ভাই? কেমন বল দেখি? অমুক বইটার তুলনায় কেমন? তমুক বইটার তুলনায়? তুই নিশ্চিত ভালো? মা কালীর দিব্যি? দ্যাখ! কিনে ফেলছি কিন্তু।

বাইশ মিনিটের মাথায়ঃ
অন্য বন্ধুকে ফোনঃ হ্যাঁ রে ভাই, ভটকাই বলছে বইটা বেশ ভালো৷ ওর কথা বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে কি? অন্যের বোলিংয়ে ব্যাটা একদম মন দিয়ে ফিল্ডিং করত না কিনা..তুই বলছিস বইটা ভালো? সিরিয়াসলি? 

তেত্রিশ মিনিটের মাথায়ঃ
আমাজনে (বা অন্য কোথাও) অর্ডার। 

দু'দিনের মাথায়ঃ
আমাজনের প্যাকেটটা রাক্ষুসে ভাবে ছিঁড়ে ফেলে বইটা বের করে হুড়মুড় করে চার পাতা পড়ে, 
তাকে সাজিয়ে রেখে;
স্নান করতে যাওয়া/হাতের জরুরী কাজগা সেরে ফেলা/খেতে বসা। 

আড়াই বছর পরঃ
তাকে রাখা সে বইটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস; সামনের মাসের মধ্যে বইটা পড়ে না ফেললেই নয়৷

Monday, June 21, 2021

যোগসাধনা




বছর তিনেক আগে৷ 
অফিস থেকে বেরোনোর মুখে ব্রজদার ফোন৷ ভদ্রলোক আমার বাপের বয়সী৷ তবে কফিহাউস আলাপের ক্ষেত্রে বয়স নিয়ে শুচিবাই চলেনা৷ ব্রজদা ব্যাচেলর দিলদরিয়া মানুষ৷ আড্ডায় সরেস, খাওয়াতে ভালোবাসেন৷ প্রচুর ঘুরে বেড়ান, তাই গল্পের স্টক অফুরন্ত৷ বদগুণ একটাই; বড্ড বেশি কবিতা লেখেন আর সে'সব মাঝেমধ্যে হাসি মুখে শুনতে হয়৷ 

কবিতা ব্যাপারটা ভালো লেখেন না খারাপ সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই নেই৷ কবিতা ব্যাপারটাই গোলমেলে এবং সম্ভবত লোকঠকানো৷ কাজেই এ বিদঘুটে ব্যাপার আমি চিরকালই এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু ব্রজদার কবিতাগুলো অবশ্য হাসিমুখেই হজম করে থাকি, কারণ চপ-কাটলেট না খাইয়ে উনি কবিতার ডায়েরি নামান না৷ 

- ব্রাদার, একটি বারে জন্য যে আমার বাড়িতে আসতে হবে। এখুনি।

- কী ব্যাপার ব্রজদা?

- না এলেই নয়৷ চট করে চলে এসো দেখি৷ তারপর ডিটেলে বলছি৷

- শনিবার কফিহাউস থেকে বেরিয়ে না হয় আপনার ফ্ল্যাটে ঢুঁ মারব..আজ একটু..।

- বড় দেরী হয়ে যাবে ভায়া৷ ইট ইজ অ্যান এমার্জেন্সি৷ স্পেশ্যাল মোগলাই পরোটা আর মাটন কষা অর্ডার করেছি৷  ক্যুইকলি চলে এসো৷ 

এরপর আর না বলা সম্ভব নয়৷

**

নেহাৎ বিভূতি রেস্টুরেন্টের হাইক্লাস মোগলাই আর জিভ কাঁপানো কষা মাংস আগেভাগেই পেটে পড়েছিল। নয়ত নার্ভাস হয়ে হাঁটু ক্র‍্যাশ করে যেত৷ ব্রজদাই বলেছিল "আগে ডিনারটা সেরে নেওয়া যাক"৷ কিন্তু তারপর ব্রজদা যে খেল দেখালে, আমি তো থ৷ 

ডিনারের পর, "এক মিনিটে আসছি" বলে ব্রজদা ভিতরের ঘরে মিনিট কুড়ির জন্য গায়েব হলেন৷ সে ফাঁকে ব্রজদার রেফ্রিজারেটর জরীপ করে এক বাক্স চমচম পাওয়া গেল। সে বাক্স অনেকটা হালকা করে এনেছিলাম৷ এমন সময় ব্রজদা ফিরল।  আর ব্রজদাকে দেখে একটা বিশ্রী বিষম খেতে হল যার ফলে মুখ থেকে এক টুকরো চমচম উড়ে গিয়ে থিতু হয় বসল দেওয়ালে টাঙানো গ্রিনপ্লাইয়ের ক্যালেন্ডারে৷ 

স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি ছেড়ে ব্রজদা গেরুয়া জোব্বা পরে বেরিয়ে এসেছে৷ গলায় কয়েক'ছড়া রুদ্রাক্ষের মালা৷ কাঁধে একটা হলদে ঝোলা আর ডান হাতে একটা সুটকেস৷ আর মুখের হাসি অত্যাধিক চওড়া আর অস্বস্তিকর ভাবে দেখনাই৷ 

হাসিটাকে আরও একটু চওড়া করে, সুটকেসটা নামিয়ে রেখে আমার সামনে ক্যাটওয়াকের ভঙ্গীমায় তিরিশ সেকেন্ড মত হাঁটলেন৷ তারপর আচমকা হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে উৎসুকভাবে তাকালেন। 

- কেমন বুঝছ ভায়া?
- কী ব্যাপার ব্রজদা? হঠাৎ এই পোশাকে..থিয়েটার টিয়েটারে চান্স পেয়েছেন নাকি?
- ঘাবড়ে গেছ দেখছি।
- হ্যাঁ মানে আচমকা এ'ভাবে..।
- একটা সিগারেট দাও..বলাই বাহুল্য..মাই লাস্ট সিগারেট।
- সিগারেট ছেড়ে দেবেন? 
- মোগলাই আর মাটন ছেড়ে দিলাম হে৷ এ তো স্রেফ ধোঁয়া৷
- ওহ আজ তাহলে..।
- লাস্ট সাপার ছিল৷ ঠিকই ধরেছ।
- কিন্তু আপনি হঠাৎ..। 
- চললাম। হে বন্ধু, বিদায়। এই ক্যালক্যাটা, অফিস; সব নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম৷ 
- ডিটক্স?
- পার্মানেন্ট৷ সন্ন্যাস। গত হপ্তাতেই এক বাবাজী জোগাড় করতে পেরেছি৷ গোট দেশে তাঁর খানসাতেক আশ্রম৷ ব্রশার পাঠিয়েছিল। আমি হিমাচলের একটা স্পট সিলেক্ট করেছি৷ আজ রাতের ফ্লাইটে দিল্লী চললাম৷ সে'খানে বাবাজীর হেডঅফিস৷ একটা কন্ডিশনিং কোর্স করতে হবে সে'খানে। দিন সাতেক পর সোজা কোর্স কম্পলিশন সার্টিফিকেট হাতে সোজা আশ্রম৷ পাহাড়ের কোলে, সাররিয়াল, পীসফুল৷ ভাবতেই ভালো লাগছে।
- বাবাজীর আশ্রমের ব্রশার? কন্ডিশনিং কোর্স?
- ব্রশারের সফটকপিও আছে৷ তোমায় হোয়্যাটস্যাপ করে দেব'খন। 
- ওহ্। 
- তা, মহাপ্রস্থানের জন্য আজকের দিনটা প্রেফার করলাম কেন আশা করি বুঝতে পারছ৷ ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ ইয়োগা আজ। অফিসের কচকচি, লিটল ম্যাগাজিনের ইন্টেলেকচুয়াল ভাঁওতা, কফি হাউসের কলার টানাটানি আর এই চপ-কাটলেটের লোভের অন্ধকার থেকে নিজেকে লেভিটেট করিয়ে তুলে নিচ্ছি৷ এরপর আমার গোটা জীবনটাই হয়ে উঠবে যোগসাধনা৷ প্রতিটি মুহূর্তই প্রাণায়াম।  
- আপনি কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছেন ব্রজদা?
- ফর এভার৷ ট্যু ক্রাউডেড৷ চারদিকে ধান্দাবাজি৷ বছরে সাড়ে এগারো মাস প্যাঁচপ্যাঁচে গরম৷ ভাজাভুজিতে ভেজাল তেল। অফিসে ল্যাং মারামারি৷ বাসে ঝুলোঝুলি, ফুটপাতে ধাক্কাধাক্কি৷ ফেড আপ৷ আশ্রমে একটা বড় খোলামেলা ঘর পেয়েছি, রিভার ফেসিং - বুঝলে! বাবাজির ট্রাস্টে একটা বড় আমাউন্ট দিতে হয়েছে অবিশ্যি সে'সবের জন্য৷ এখন সেই পীস হ্যাভেনে শুধু আমি আর আমার যোগসাধনা৷ 

**

- এই যে ভায়া!
- আরে ব্রজদা না?
- এটা নতুন নম্বর, সেভ করে নাও৷
- হোয়াট আ সারপ্রাইজ৷ আছেন কেমন?
- জাস্ট তোফা৷
- কদ্দিন পর কথা হচ্ছে বলুন তো?
- পাক্কা তিন বছর পর।
- রাইট৷ তাই তো৷ তা আছেন কেমন? মোক্ষলাভ হল কি? এখনও সেই রিভার ফেসিং রুমেই আছেন নাকি হিমালয়ের কোনও গুহায় কৌপীন পরে গাঁজা টানিছেন? 
- আপাতত বিভূতি রেস্টুরেন্ট ফেসিং ব্যালকনিতে বসে তোমায় ফোন করছি।
- সে কী? কলকাতায় ফিরেছেন? কদিনের জন্য? ভক্ত সমাগম কেমন? দর্শন দেবেন কি?
- এক ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ ইয়োগাতে প্রস্থান৷ অন্য এক ইন্টারন্যাশনাল ইয়োগাতে রিটার্ন।
- বলেন কী! আশ্রম ছেড়ে দিয়েছেন?
- সমস্তটাই যোগসাধনার স্বার্থে৷ তোমায় তো বলেইছিলাম, ইয়োগা ইস মাই লাইফ৷
- কেন? আশ্রমে সাধনায় ব্যাঘাত ঘটছিল বুঝি ব্রজদা?
- মনের মত আসনটা ঠিক হয়ে উঠছিল না৷ 
- মনের মত আসন?
- তিনটি বছর লাগল সত্য অনুধাবন করতে৷ একমাত্র একটাই যোগে আমার মুক্তি৷ প্রাণখুলে নিজের লেখা কবিতা শোনানো; অনলি ফর্ম অফ ইয়োগা আই নীড ভায়া৷ এ তিন বছরে কম আশ্রম আখড়া ঘুরলাম না। কিন্তু আমার সমস্ত ধরেবেঁধে কবিতা শোনানোর বন্ধুদের যে কলকাতাতেই ফেলে গেছিলাম ভায়া৷ কবিতা না শোনাত পেরে মনের ভিতর ময়লা জমতে শুরু করেছিল, পেট ফেঁপে ওঠার উপক্রম৷ কাজেই, যোগদিবসে তাই ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন৷ শোনো, চলে এসো৷ এখুনি! তিন বছরে দিস্তে দিস্তে পোয়েট্রি লিখেছি। সে'সবের শ্রোতা না পেলে আমার যোগসাধনা বৃথা।
- ইয়ে,  মানে...সামনের উইকেন্ডে আসব না হয়? গোটাদিন বেশ আড্ডা জমানো যাবে৷ আজ একটু কাজ জমেছিল..।
- আশ্রমে থেকে আমার আমিষে আগ্রহ সত্যিই গেছে৷ নিজের জন্য কয়েকটা লুচি ভাজব বলে ময়দা মেখে রেখেছি৷ আর বেগুনভাজা৷ তোমার জন্য অবশ্য রুমালি রুটি, মাটন চাপ, ব্রেনকারি, মেটে চচ্চড়ি আর মুর্গ পোলাও আনিয়ে রেখেছি৷ চলে এসো৷ আমি বাহাত্তরটা কবিতা শর্টলিস্ট করে রেখেছি পড়ব বলে। ক্যুইকলি চলে এসো ভাই।

এরপর আর না বলা সম্ভব নয়৷

Friday, June 18, 2021

নিউনর্মাল বিরিয়ানি



- লাঞ্চে বাসি বিরিয়ানির জবাব নেই ভায়া৷

- ট্রু৷ তবে ইয়ে, থার্ড ওয়েভ ঠেকিয়ে রাখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না৷

- মাংস হয়ত পাতে সামান্য কম রয়েছে, কিন্তু ওভারনাইট রেফ্রিজারেশনের ফলে ফ্লেভারে একটা অন্য ঘ্যাম চলে আসে, তাই নয় কী?

- একদম৷ ইয়ে, এইমাত্র একটা গা-কাঁপানো আর্টিকল পড়লাম। বম্বেতে ইতিমধ্যেই নাকি তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে৷ অবশ্য ঠেকানোটা ওয়াজ নেভার অ্যান অপশন, শুধু ইম্প্যাক্টটাকে যদি একটু মিনিমাইজ করা যেত৷ আসল অস্ত্র হল পাইকারি ভ্যাক্সিনেশন৷ খোলামকুচির মত ছুঁচ গেঁথে যেতে হবে৷ 

- ডিম সেদ্ধটা অবভিয়াসলি টাটকা৷ বাসি বিরিয়ানির আলু আর তাজা ডিমসেদ্ধর কম্বিনেশনটা কিন্তু আউটস্ট্যান্ডিং। 

- একদম তাই৷ আচ্ছা, মাস দেড়েক আগের সেকেন্ড ওয়েভের সেই ডিসাস্টার যেন গত জন্মের কাহিনী মনে হচ্ছে৷ তাই না? অথচ  দু'দণ্ড মন দিয়ে সে'সব কথা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। মেজপিসেমশাই চলে গেলেন৷ পাড়ার মন্টু মাত্র তিনদিন ভুগে...। অফিসেই তো অন্তত জনা চারেক..। অথচ আজ দেখো, সে'সব যেন অন্য জগতের ঘটনা মনে হচ্ছে৷ 

- আমার একটা পার্সোনাল থিওরি আছে জানো৷ টাটকা বিরিয়ানির স্কেলে সিরাজ সামান্য এগিয়ে৷ কিন্তু বাসিতে আরসালাম ফটোফিনিশে বেরিয়ে যাবে৷ 

- হুম৷ পরের ফেজে শুনছি ছোট ছেলেমেয়েদেরও বিস্তর ভুগতে হতে পারে। খোকার সেফটির কথা ভেবেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে৷ নট টু মেনশন; বাপ-মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই৷

- আসলে কী জানো, বিরিয়ানি বাসি হলে তার গায়ে মায়া লাগে।

- নাহ্, লাইফটাকে কচুকাটা না করে এ প্যান্ডেমিক সরবে না।

- দু'দিন বইতো নয় ভায়া৷ রাত্রে গুরুপাক না রেখে সামান্য চাপ আর রুমালি রুটি জোম্যাটো করা যাক৷ কী বলো?

- তাই হোক৷ আর ইয়ে, অক্সিমিটারটা ট্রাবল দিচ্ছে৷ ব্যাটারি চেঞ্জ করেও লাভ হল না৷ আর একটা কিনতেই হবে৷ অর্ডার দিয়েই ফেলি৷ এ'সব ব্যাপারে দেরী করে লাভ নেই৷

**

খেতে বসে নিজের সঙ্গে গল্প না জুড়ে উপায় থাকছে না৷ খেলোয়াড়দের দেখেছি হাইভোল্টেজ মুহূর্তে নিজেদের সঙ্গে কথা বলতে৷ শেষ বলে জিততে হলে চার রান দরকার, বোলার রানআপের গোডায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছেন "কাম অন, কাম অন। বোল ইট ওয়াইড আউটসাইড দ্য অফ স্টাম্প । স্কেলে মাপা বল; কাম অন! ইউ ক্যান ডু ইট"। পাড়াতুতো এক জ্যেঠুকে দেখেছি শেষ বয়সে এসে অনবরত নিজের সঙ্গে গল্প জুড়ছেন; নিজেই গোলমেলে প্রশ্ন করছেন, নিজেই লাগসই উত্তর দিয়ে কেল্লা ফতে করছেন৷ আমার এক বন্ধুকে দেখতাম জটিল অঙ্ক কষার সময় মশগুল হয়ে চাপা সুরে অঙ্কের স্টেপগুলো আউড়ে যেত; কোনও জব্বর কঠিন কোনও প্রব্লেমকে জব্দ করতে পারলে নিজেই নিজেকে সাবাশ বলে উঠত। 

নিজের সঙ্গে নিজের বিড়বিড়গুলো বোধ হয় এক ধরণের মেডিটেশন৷ ধরা যাক ধুন্ধুমার যুদ্ধ চলছে, সাতাশ ঘণ্টা অনবরত শত্রুপক্ষের বুলেট এড়িয়ে হয়ত কোনও সৈনিক নিজের বাঙ্কারে এসে পৌঁছেছে৷ ঘামরক্তভেজা জামাকাপড় ছেড়ে কফির মগ হাতে দু'দণ্ড গা এলিয়ে দিয়ে প্রিয় গানের সুর গুনগুন করতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই গানের সুরে আর কফির গন্ধে ভেসে গেলে তো তার চলবে না৷ মনের মধ্যে একটা বেসুর বেজেই চলবে "ঘণ্টাখানেক পরেই যুদ্ধ ব্রাদার! যুদ্ধ। গুলি। বুঝেছ? ব্লাডি ওয়ার! মুহূর্তের অসাবধানতায় স্নাইপারে সাফ হয়ে যাওয়া বা ল্যান্ডমাইন ফেটে উড়ে যাওয়া"। কফি শেষ হয়, গান থামে; কিন্তু স্নায়ু গা এলাবার তাল করলেই চিমটি৷ 

এই নিউ নর্মালে নিজেদের নির্ভেজাল ভালোলাগাগুলোকেও আর নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না৷ পছন্দের খাবার, ভালো লাগা বই, মনভালো করা আড্ডা; এ'সমস্ত কিছুর মধ্যেই নিজের সঙ্গে জরুরী আলোচনাগুলো চালিয়ে যেতে হচ্ছে৷ এ যুদ্ধ সহজে শেষ হওয়ার নয়৷ সমস্ত ভালোলাগাগুলোকে মুলতুবি রাখার উপায় নেই, আবার সহজে ভেসে যাওয়ারও উপায় নেই। 

নিজের মধ্যে বাস করা বিরিয়ানি ভালোবাসা আলাভোলা মানুষটার আস্তিন মাঝেমধ্যেই টেনে ধরছে যে ভদ্রলোক, সেও ভুরু কুঁচকে আমার মধ্যেই গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে৷

Thursday, June 17, 2021

ডিভাইডেড আইল্যান্ড



কিছুদিন আগে ফ্যামিলি ম্যান -২ দেখলাম৷ টানটান, ঝকঝকে; ওই যাকে আমরা বলি "অ্যাকশন প্যাকড"৷ আর পাঁচজনের মত আমারও ভালো লাগল৷ সে'খানেই দাড়ি টেনে দিলে হত৷ কিন্তু সেই সিরিজের অন্যতম প্রধান চরিত্র রাজিকে ছুঁয়ে আগ্রহের নিশানা গিয়ে ঠেকল শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে৷ সে বিষয় নিয়ে একটা আলগা ধারণা যে ছিল না তা নয়৷ ওই তামিল ইলম, এলটিটিই, প্রভাকরণ ইত্যাদি৷ এলটিটিইকে দুরমুশ করে যুদ্ধে ইতি টানা হয়েছে, নিউজচ্যানেল এবং ইন্টারনেটের বদান্যতায় তাও খানিকটা জানা ছিল৷ অবশ্য শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের বাইরে সে'খানকার ইতিহাস সম্বন্ধে তেমন আগ্রহ এর আগে টের পাইনি৷ শেষে একটা ওটিটি থ্রিলার সে আগ্রহটা সামান্য উস্কে দিল৷ আমি যে কোম্পানিতে কাজ করি, তাদের অফিসপাট রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। কাজেই শ্রীলঙ্কায় কিছুদিন চাকরী করে আসা কিছু মানুষজনকে চিনি৷ কলোম্বোর জীবন সম্বন্ধে খানিক গল্পগুজবও জুড়েছি তাদের সঙ্গে কয়েকবার৷ তবে অফিস পরিসরে যা ঘটে, গল্প-আলোচনা গভীরে পৌঁছয় না৷ 

এই বইটার খোঁজ দিল আমার শ্রীলঙ্কা-বিশেষজ্ঞ বন্ধু সুহেল৷  বই জোগাড় হল। পড়াও হল৷  গোড়াতেই সহজ কথাটা বলে দেওয়া যেতে পারে। এ বই না পড়লেই নয়৷ শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে আগ্রহী না হলেও, মানুষের মানুষামি এবং অমানুষামি সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার জন্য এ বই প্রায় মেড-ইজি-গাইডের মত৷ ক্ষুরধার সাংবাদিকতার সঙ্গে গভীর সংবেদনশীলতা না মিশলে এমন লেখা বোধ হয় সম্ভব নয়৷ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের নির্মম ইতিহাস পরিপাটি ভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন সামন্থ। গোটা বইটাই উঠে এসে সাধারণ মানুষের কথায় ভর দিয়ে। সে দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে, বহু মানুষকে বড় কাছ থেকে চিনে, তাঁদের জ্বালা-যন্ত্রণাকে পাশে থেকে অনুভব করে এই বই লিখেছেন সামন্থ৷ আর ভদ্রলোকের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ হলো 'ব্যালেন্স'৷ টাইগার আর সিংহ; দু'দলেরই গোলমেলে দিক নিয়ে নির্দ্বিধায় আলোচনা করা হয়েছে এ বইয়ে৷ এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এতটা ব্যালেন্সড লেখা বেশ একটা অসাধ্যসাধন করা ব্যাপার৷ 

কিছু গা-কাঁপানো ব্যাপার সামন্থের ঈর্ষনীয় ডিটেলিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসেঃ

- যুদ্ধের পাগলামি কাউকেই রেয়াত করেনা।

- দুর্বলের প্রতি চড়াও হওয়ার পাশবিক বাসনা মানুষের মজ্জাগত, এর অন্যথা কোনওদিন ঘটেনি, ঘটবেও না৷ আমাদের যাবতীয় ইন্টেলেক্ট আর সভ্যভব্য বাতেলার আড়ালে একটা পাশবিক মব-মেন্টালিটি লালন করে চলা ধান্দাবাজ বসে আছে৷ ধান্দাবাজিটুকুই সিভিলাইজেশন বোধ হয়; মমনমোহন মিত্তির অন্তত ঠারেঠারে তেমন কিছুই বলতে চেয়েছিলেন৷ 

- আমরা সবাই স্রেফ সুযোগের অভাবে অন্যের বুকে ছুরি বসিয়ে মুনাফা লুটছি না৷ আওয়ার ভালোমানুষি ইজ প্রবাবলি দ্য অভাব অফ সুযোগ৷

- ভেঙেচুরে যাওয়া হেরো মানুষদের ঝাড়পোছ করে সাফ করে দিতে পারাটাই ইতিহাস। (সামন্থ পেরেছেন অ-ইতিহাসটুকু নিয়ে কথা বলতে, সে'খানেই এই বই সার্থক)।

যাকগে৷ লাইক আ ট্র‍্যু ঢেঁকি ধান-ভাঙিং ইন স্বর্গ; শ্রীলঙ্কা আর বাংলার যোগাযোগ নিয়ে দু'টো ট্রিভিয়া দিই (অবশ্যই এ বই থেকে ধার করে)ঃ

প্রথমত, 
রাজপুত্র বিজয় সিংহের কথা৷ এ'টা হয়ত অনেকরই জানা৷ সাতশোজন অনুচর নিয়ে বিজয় সিংহ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছন৷ সেই বিজয় সিংহ থেকেই সিংহলদের যাত্রা শুরু৷ এ' ভদ্রলোকের বাপের রাজত্ব নাকি ছিল বাংলায়। ক'দিন আগে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন নিয়ে খানিকটা পড়েছিলাম, তিনিও এই বিজয় সিংহের লঙ্কাকাণ্ড নিয়ে ফলাও করে একটা মহাকাব্য লেখার ছক কষেছিলেন (শেষমেশ  সে লেখা অবশ্য এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি)। 

দ্বিতীয়ত,
সত্যজিতের গল্প৷ এ যোগাযোগটা একটু প্যাঁচালো তবে ব্যাপারটা বড় সুন্দর৷ বিজয় সিংহের লঙ্কা আগমনের পর হাজার দুই বছর কেটে গেছে৷ একদিন, সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট প্রগিথ একনালিগোডা (বানানটা বাংলায় ঠিক লিখলাম না হয়ত, ইংরেজিতে Prageeth) মন দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের একটা স্কেচ আঁকছিলেন৷ ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সময়ই একটা বিশেষ প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন এক এনজিওর কর্মী সন্ধ্যা। সেই প্রথম তাঁদের আলাপ৷ আলাপ থেকে বন্ধুত্ব, প্রেম, সাদামাটা বিয়ে আর প্রবল ভালোবাসার সংসার৷ প্রগিথ আর সন্ধ্যা তাঁদের প্রথম ছেলের নাম রাখা রেখেছিলেন সত্যজিৎ; নিজেদের প্রথম আলাপের কথা মনে রেখে৷ ঘটনাচক্রে,  সেই সত্যজিতের জন্মও হয়েছিল ২-মে৷

এই প্রথম ও দ্বিতীয় ঘটনাটির মাঝখানে শ্রীলঙ্কার বড় হয়ে ওঠা, বুড়িয়ে যাওয়া, এবং আর পাঁচটা দেশের মতই; বিষিয়ে যাওয়া। সরকারের না-পসন্দ কথাবার্তা নিজের আঁকা ও লেখার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রগিথ৷ বিভিন্ন হুমকি অগ্রাহ্য করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে লেখালিখি শুরু করেছিল সে৷ একের পর এক হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করার মাশুল তাকে অবশেষে দিতে হয়৷ আচমকা একদিন কাজের শেষে আর বাড়ি ফেরা হয়না প্রগিথের৷ বাতাসে মিলিয়ে যায় সে; সরকার বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদের যেমন দশা হওয়া উচিৎ আর কী৷ শ্রীলঙ্কার সেই সত্যজিতের বাবা আর ফেরেননি৷

লোক পোক



স্বপ্নের সিকুয়েন্স।

মেসবাড়ি। যেমন হয় আর কী। সাতপুরনো, জীর্ণ। তবে জমজমাট। 

দেওয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ মনের সুখে দাড়িতে কলপ লাগাচ্ছেন। আর গুনগুন করছেন; "রিমঝিম গিরে সাওয়ান"।

পাশের চৌকিতে আধোশোয়া শিব্রাম সেই সুরের তালে ঠ্যাং নাচাচ্ছেন আর চোখ বুজে মনের মধ্যে ফাউল কাটলেটের ছবি আঁকছেন।

ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে ঘনশ্যাম দাস একটা ভারিক্কি  ডায়েরি উল্টেপাল্টে দেখে বলছেন, "এ'সব ছাইপাঁশ পাবলিশ করার তাল করছেন নাকি রবিদা"?

শিব্রামের উল্টোদিকের চৌকিতে ম্যাদা মেরে বসে আছেন এক গোবেচারা ভদ্রলোক। মুখে একরাশ বিরক্তি। 

ঘনশ্যাম দাসের প্রশ্নের উত্তর এলো না।
রবীন্দ্রনাথের গুনগুন থামল না।
শিব্রামে ততক্ষণে কাটলেট ছেড়ে রাবড়িতে গিয়ে ঠেকেছেন, ঠ্যাং নাচানো অবশ্য থামেনি।
এর পাশাপাশি  মান্ধাতা আমলের সিলিং ফ্যানের ক্যাঁচক্যাঁচর। 

সে গোবেচারা মানুষটি এ'বার হুঠ করে উঠে দাঁড়ালেন। আচমকা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন;
"তোমাদের মত ইরেস্পন্সিবল ইয়ারদোস্ত আমি আর দেখিনি। আমি এত বড় একটা কনসার্ন শেয়ার করলাম অথচ কারুর কোনও হেলদোল নেই। এর চেয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকলে বরং বেশি লোকের দরদ পাওয়া যেত"।

ঘনশ্যাম দাসের ডায়েরি থেকে মুখ তুলে চাইলেন।
রবীন্দ্রনাথের গুনগুন থামল।
শিব্রামে ততক্ষণে রাবড়ি ছেড়ে  রুই কালিয়ায় পৌঁছেছেন, ঠ্যাং নাচানোও থামেনি। 

"বলি আমার প্রব্লেমটা নিয়ে কেউ কি কিছুই বলবে না"?, গোবেচারা ভদ্রলোকের মধ্যে আচমকা একটা খেপচুরিয়াস ভাব।

ঘনশ্যামবাবু এ'বার ভুরু কুঁচকে বললেন, "এমন ডিলেমায় পড়েছিলাম সে'বার ভ্ল্যাডিভস্টকে"।

"এই আবার শুরু হল", চুপসে যাওয়া বেলুনের মত ধপাস করে চৌকিতে বসে পড়লেন গোবেচারাটি, "আমার কী করা উচিৎ সে ব্যাপারে কেউ কি কিছুই বলবে না"?

ঘন কালো দাড়ির আড়াল থেকে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, "তুমি ফিরে যাও মুকুল"। 

"বলছেন ফিরব"? গোবেচারা মানুষটি যেন বুকে বল পেলেন, " লোকে আবার ট্রোল-ঠ্রোল করবে না তো"?

"লোক না পোক", শিব্রামের ঠ্যাং নাচানো ততক্ষণে থেমেছে, " আখের শুনেছি আখের রসের মতই সুমিষ্ট৷ তুমি ফেরো মুকুল। আমি অভয় দিচ্ছি। ফেরো, আর ফেরার পথে দু'ঠোঙা চপ নিয়ে ফিরো"।



বোধদয়



স্যাঁতসেঁতে একটা ঘর৷  একটা দেওয়ালে পাশাপাশি দু'টো ক্যালেন্ডার, একটা বাংলা আর একটা ইংরেজি৷ মা তারা হার্ডওয়্যার স্টোর্সের বাংলা ক্যালেন্ডারটা চার বছর পুরনো, গ্রীনপ্লাইয়ের ইংরেজিটা বছর দুই আগের৷ টিউবের আলোতেও ঘরের ঘোলাটে ভাব কাটছে না। হলুদ দেওয়ালগুলো বেশ বিবর্ণ৷ যে দেওয়ালে ক্যালেন্ডার-জোড়া ঝুলছে, তার উলটো দিকের দেওয়ালে একটা অজন্তার দেওয়াল ঘড়ি৷ ঘড়িটা বন্ধ৷ তবে সময়টা সন্ধ্যের পরেই হবে। 

সে ঘড়ির নীচেই ঘরের একমাত্র জানালা, সে'টা বন্ধ৷ জানালা ঘেঁষে রাখা একখানা টেবিল যার বয়স অন্তত আশি হওয়ার কথা৷ সে টেবিলের ওপর বইয়ের স্তুপ। আর একটা কলমদানি। আর একটা টেলিফোন। ঘরের আসবাব বলতে একটা চৌকি, আর দু'টো আলমারি৷ একটা আলমারি স্টিলের, অন্যটা কাঠের৷ কাঠের আলমারিটাও বইয়ে বোঝাই৷ 

 সেই স্টাডি টেবিলের সামনে একটা চেয়ার৷ সে চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক৷ মাথায় যে ক'গাছা চুল পড়ে রয়েছে তার অর্ধেকের বেশিই পাকা কিন্তু মুখ দেখলে মালুম হয় যে বয়স নিশ্চয়ই বাহান্নর বেশি নয়৷ পরণে হাফ শার্ট আর পাজামা৷ 

আচমকা৷ 
ঘরের দরজাটা ঘটাং শব্দে খুলে গেল আর ভদ্রলোকের ঝিমুনি গেল চটকে। ঘরে ঢুকল এক ছোকরা গোছের ছেলে, বয়স বাইশ চব্বিশের বেশি হবে না৷ হালকা গোঁফ, বাহারি টেরি আর তার কালো টিশার্টে একটা হলুদ বেড়ালের ছবি৷ ছোকরার হাতে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। 

চেয়ারে বসা ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন।

- ঘরে ঢোকার আগে নক করতে হয় রে রাস্কেল!

- আরে মামা! তুমি এখন সে'সব ছেঁদো এটিকেটের থেকে অনেক দূরে চলে গেছ। রিল্যাক্স।

- ফের শুরু হল যত অলুক্ষুণে কথাবার্তা৷

- ট্রুথ ইস নট অলুক্ষুণে মামা৷

- যত আগডুমবাগডুম৷ কতবার বলেছি আমায় জ্বালাতে আসিস না।

- না এসে উপায় কী? তুমি এ ঘর ছেড়ে না বেরোলে আমাদের লাইটইয়ার্স ক্লাবের ঘর হিসেবে এ'টাকে ব্যবহার করব কী করে বলো। 

মামা এ'বার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ 

- এ ঘরে আমি আঠাশ বছর ধরে আছি৷ এ ঘর  আমি ছাড়তে যাব কোন দুঃখে রে হারামজাদা?

- ল্যাঙ্গুয়েজ মামা। প্লীজ। ল্যাঙ্গুয়েজ।

- দ্যাখ পটা, তোর এই বদমায়েশি আমি অনেকদিন ধরে সহ্য করছি৷ প্র‍্যাক্টিকাল জোক খানিকক্ষণ ভালো লাগে তবে এ'টা জাস্ট সমস্ত লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷

- আচ্ছা ঝামেলা তো। নিজে মরে ভূত হয়ে এ ঘর আটকে বসে আছ!অথচ সে'টা বললেই দোষ?

- দিব্যি বই পড়ছি, পোয়েট্রি লিখছি৷ আর তুই ব্যাটা এ ওবেলা এসে এ'সব রিউমর ছড়িয়ে যাচ্ছিস৷ আমি তোকে পুলিশে দেব।

- ছ'মাস আগেই পটল প্লাক করে ফেলেছ মামা৷ এমন ঢ্যাঁটামোর কোনও মানে হয়? 

- মহাঝ্যামেলা। দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি৷ এই দ্যাখ, পিঠে ঘামাচিও বেরোচ্ছে।

- ও'সব তোমার মনের ভুল৷ হাবুল তান্ত্রিক এসে বারবার তোমায় রিয়ালিটিটা জানিয়ে যাচ্ছে অথচ তোমার সুবুদ্ধি উদয় হচ্ছে না৷ 

- হাবুলটা একটা ফোর টুয়েন্টি৷ ফ্রড৷ তুই জানিস এককালে সে লোক ঠকিয়ে এক জালি কোম্পানির ইন্স্যুরেন্স গছাতো মানুষকে?

- এখন হাবুলদা রিফর্মড মানুষ মামা৷ কেবল-টিভিতে বসে প্রতি অমাবস্যার রাত্রে লোককে কনসাল্ট করে৷ মেজমাসী বলে ধন্বন্তরি।  

- বুল্টিটা একটা গবেট৷ 

- মামা, আবারও বলছি। ছ'মাস হল৷ সেরিব্রাল। ম্যাসিভ৷ এ'বার এ ঘরটাকে হন্টেড করে না রেখে মানে মানে সরে পরো দেখি৷ লাইটইয়ার্স ক্লাবের ফিউচার নষ্ট করছ তুমি৷ এই ঘরটা বাগাতে পারলে আমি ক্লাবের সেক্রেটারি হব, সেটিং করা আছে।

- আরে মহামুশকিল। নিজের আখেরের জন্য জ্যান্ত মানুষকে মড়া বলবি?

- ইউ আর অনলি অ্যান আত্মা।

- দ্যাখ, ফের যদি তুই হাবুলকে এনেছিস..।

- না মামা। আমি হাবুলের চেয়েও এফেক্টিভ প্রমাণ এনেছি৷ 

- প্রমাণ? আমি মারা গেছি তার প্রমাণ? 

- অকাট্য।

লায়েক ছোকরাটি প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে একটা সাদা কাগজের বাক্স বের করে সে'টা মামার সামনে টেবিলের ওপর রাখে৷

- এ'টা কী রে?

- এ'টাই প্রমাণ। যে তুমি মৃত।

- ইয়ার্কি হচ্ছে?

- আগে বলো, সর্দি হয়েছে তোমার?

- না৷ ন্যাসাল প্যাসেজ ক্লীন৷ 

- মনের মধ্যে আচমকা ফুর্তি টের পাচ্ছ?

- নট অ্যাট অল। এ'সব কী রকমের হেঁয়ালি?

ভাগ্নে চোখ গোলগোল করে এগিয়ে এলো মামার দিকে। 

- কোনও সুবাস পাচ্ছ না মামা?

- নাথিং৷ তা'তে কী?

পি সি সরকারের মত বরফ গলানো হাসি ভাসিয়ে পটা ফের জিজ্ঞেস করলে;

- কোনও গন্ধই কি পাচ্ছ না? মনে কি কোনও আনচানই নেই?

- নেই! আরে খুলে বল না কাঁচকলা!

উত্তর না দিয়ে পটা এগিয়ে এসে সে কাগজের বাক্সের ঢাকনাটা খুলে দিল। 

বাক্সের ভিতরে তাকিয়ে থমকে গেলেন মামা। গলার স্বর বুজে এলো৷ চোখ ছলছলিয়ে উঠল৷ কাঁপতে কাঁপতে সে বাক্সের ওপর ঝুঁকে পড়লেন তিনি৷ কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়েও ম্যাজিকের মত গায়েব হয়ে গেল। উদ্ভ্রান্তের মত মাথা নাড়তে লাগলেন তিনি। 

আর পটা বিকট ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করলে, যেন সে ঠাকুর বিসর্জনে চলেছে আর মাইকে লারেলাপ্পা গান বাজছে৷ 

খানিক পর মামাই অস্ফুটে বলে উঠলেন;

- আ...আমি..আমি বিরিয়ানির সুবাস পেলাম না?

- দ্যাট ট্যু মামা, আরসালানের বিরিয়ানি। প্যাক করিয়ে ডাইরেক্টলি নিয়ে আসছি।

- আমি বিরিয়ানির সুবাস পেলাম না!

- বিলকুল পেলে না।

- বিরিয়ানির সুবাস পেলাম না৷ মনটা আনচান করে উঠল না। বুকের মধ্যেও নো-মোচড়!

- পেলে না৷ উঠল না। মোচড়ালো না।

- আমি সত্যিই মরে গেলাম রে পটা৷ এমন এলেবেলে ভাবে? জাস্ট মরে গেলাম?

- জাস্ট মরে গেলে মামা।

- ক্লাবঘর করবি কর। বইগুলোর অযত্ন করিস না। কেমন? 

- যো হুকুম মামা৷ এ'বার এসো দেখি৷ দুগ্গা দুগ্গা!

মামার চেহারাটা আবছা হয়ে আসছিল৷ আর ও'দিকে পটা ততক্ষণে 'বলো হরি হরি বোল' ডিস্কো সুরে গাইতে গাইতে বিকট নাচ শুরু করেছে।

Sunday, June 6, 2021

মেটিয়াবুরুজের নবাব




বিরিয়ানির উল্লেখ ছাড়া ওয়াজিদ আলি শাহ, লখনৌ আর মেটিয়াবুরুজ একটা জবরদস্ত বই লিখেছেন শ্রীপান্থ। বিরিয়ানি ভক্ত হয়েও বলতে পারি সে'টা একটা প্লাস পয়েন্ট। কারণ একবার বিরিয়ানির আলোচনায় ঢুকে পড়লে বাঙালি পাঠকের ফোকাস ডকে ওঠার সম্ভাবনা।

সে'সময়ের লখনৌয়ের আড়ম্বর, তেহজিব আর বাদশাহী রসবোধ সম্বন্ধেও ধারণাটা বেশ খানিকটা স্পষ্ট হল (বলা ভালো, মাথা ঘুরে গেল)। একের পর এক ট্রিভিয়া সাজিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে শ্রীপান্থর জুড়ি মেলা ভার, এ বই সে'দিক থেকে টানটান।

তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ওয়াজিদের চরিত্র যে কতটা ইন্ট্রিগিং, তা মালুম হল। তাঁর চরিত্রের বেশ কিছুদিক নিয়ে এর আগে তেমন মাথা ঘামাইনি কখনও; যেমন শাসক ওয়াজিদ আলি কেমন ছিলেন? সত্যিই কি অপদার্থ ছিলেন নাকি কোম্পানির বদমায়েশিটাই আদত ব্যাপার? এ বই পড়ে সে'সব বিষয়ে খানিকটা জ্ঞান অর্জন করা গেল বটে। আর তৈরি হল আগ্রহ; ওয়াজিদ আলির শাহয়ের ব্যাপারে আরও বিশদে খানিকটা না পড়লেই নয়।

এ বই থেকে একটা ছোট্ট অংশ কোট করতে পারার লোভ সামলাতে পারলাম না। রইলঃ

** কোট **

১৮৫৫ সালে কিছু মোল্লার নেতৃত্বে অযোধ্যায় হনুমান মন্দিরের কাছে একটি মসজিদ গড়ার জন্য আন্দোলন শুরু হয়৷ আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ছিল, সেখানে মাটির তলায় একটি মসজিদ চাপা পড়ে আছে৷ দাঙ্গা হাঙ্গামার উপক্রম।
...
...
(শান্তি রক্ষার জন্য) ওয়াজিদ আলির সমস্ত উদ্যোগ ব্যর্থ হল৷ ৭ নভেম্বর,  ১৮৫৫ সন। মুসলিম ধর্মযোদ্ধারা এগিয়ে চললেন  হনুমানগড়ের দিকে৷ তাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো অযোধ্যার বাদশা ওয়াজিদ আলির ফৌজ। যে করে হোক হিন্দু মন্দিরের ওপর আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে, মুসলমান শাসক এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। 

**

(রক্তক্ষয় ভালোই হয়েছিল, দু'পক্ষেই৷ তবে ওয়াজিদের ফৌজ রুখে দিয়েছিল সেই ধর্মযোদ্ধাদের)

Saturday, June 5, 2021

স্ক্রিউ


- কী ব্যাপার দত্ত, অমন ব্যাজার মুখে বসে যে।

- ও কিছু না৷

- আরে ভায়া! বলো না৷

- বললাম তো মন্টুদা,  অল ইজ ওয়েল।

- অল যদি ওয়েলই হবে তবে সামনে রাখা ডিমটোস্টটা ঠাণ্ডা করে কলমের মাথা চেবাচ্ছ কেন? দস্তুরের ফাইল খুলে রেখে ফ্যাফ্যা করে জানালার দিকে চেয়ে আছ কেন? বলে ফেলো ভায়া৷ কল্যিগ হিসেবে আমার একটা রেস্পন্সিবিলিটি আছে তো। বলেই ফেলো৷ 

- বেশ৷ বলেই ফেলি৷ 

- ডিমটোস্টটা ওয়েস্ট করা ঠিক হবে?

- আপনিই খেয়ে নিন বরং৷ টাচ করিনি৷ মুখ বিস্বাদ হয়ে আছে৷ 

- বেশ৷ তা, বলো৷ হয়েছেটা কী।

- বাপের ওপর বড় রাগ হচ্ছে মন্টুদা।

-  সে কী! হঠাৎ? উনি তো বোধ হয় গত বছরই..।

- গত হয়েছেন। রাইট৷ এবং বিদেয় নেওয়ার আগে আমার জন্য টাকার গদি বিছিয়ে যাননি৷ কলকাতার বুকে দু'টো বাড়ি তিনটে ফ্ল্যাট রেখে যাননি। 

- ডিমটোস্টের কসম ভায়া৷ তোমার রাগের ডিরেকশনটা ঠিক ধরতে পারছি না..।

- বাবা যদি টাকার গদিতে বসিয়ে যেতেন তা'হলে বড়সাহেবের জোরজুলুম এমন নিশ্চুপ ভাবে হজম করতে হত না৷ মুখের ওপর একটা কড়া রেসিগনেশন ছুঁড়ে ভ্যাকেশনে বেরিয়ে পড়তাম মন শান্ত করতে। কোনও হিমালয়ান রিট্রীটে বসে পাইপের ডাঁটি চিবুতে চিবুতে পিয়ানো শুনতাম আর বলতাম, "আই ডোন্ট গিভ আ ড্যাম"।

- ওহ, রাগ তা'হলে বাপের ওপর নয়৷

- একশোবার বাপের উপর৷ টাকার গদিটা রেখে না যাওয়া ছাড়াও বহুবিধ কুকর্ম তিনি করে গেছেন।

- যেমন?

- টনটনে আত্মসম্মান বোধ আর তার পাশাপাশি সব হারানোর ভয় রক্তে ট্রান্সফার করে দিয়ে গেছেন৷ মনের মধ্যে প্রিন্সিপাল আর মর‍্যালিটির বাতিক ইঞ্জেক্ট করে করে এক্কেবারে নাম্বার ওয়ান নেকুমাল বানিয়ে ফেলে রেখে গেছেন৷ কাজেই রাগটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট তাঁর ওপরই৷

- বড়সাহেব খেপচুরিয়াস হলেন কেন বলো দেখি? অবশ্য প্রশ্নটা ভুল হল৷ খেপচুরিয়াস ব্যাপারটাই ওর নর্মাল স্টেট৷ তা আজ হয়েছেটা কী?

- হবে আবার কী। বড়সাহেব ফোন করেছেন৷ ও'দিকে আমি দস্তুরের ফাইল রিকনসাইল করার জন্য ম্যাক্সিমাম কনসেন্ট্রেশনে কাজ করব বলে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছি৷ তিনবার রিং বেজে গেছে, আমি দস্তুরে দস্তুরমত ডুবে৷ ব্যাস, বস সে'টাকে অ্যানার্কি বলে ধরে নিয়েছেন৷ অতঃপর রেগে আগুন হয়ে তিনি আমার টেবিলের সামনে এসে বলে গেছেন, "আই উইল থ্রো ইউ আউট অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অ্যান্ড পুট ইউ ইন আ হেল হোল৷ অ্যান্ড দেন আই উইল স্ক্রিউ ইউর কেরিয়ার"।

- বটে। স্ক্রিউ করবে বলেছে? ডিক্লেয়ার করেছে?

- তিরিশ সেকেন্ডের জন্য মনে হল যাই - হাইক্লাস ইংরিজি ঝেড়ে একটা গা কাঁপানো রেসিগনেশনের চিঠি লিখি আনি৷ কিন্তু ওই৷ ছেলের ফিউচার, নতুন ফ্ল্যাটের ইএমআই, বাপের গছানো নার্ভাসনেস; সব মিলে বুঝলাম যে জুতোর হাজার ঘা হজম করতে হলেও, স্যালারির গোদানটা রিফিউজ করার ধক আমার নেই৷ 

- মনখারাপ ভায়া?

- নিজেকে মিনিমাম বাহাত্তরটা চড় মারার ইচ্ছেটাকে মনখারাপ বলা চলে কিনা জানিনা।

- হায়্যারার্কিতে না হই, তোমার চেয়ে আমি বয়সে বড় তো বটেই৷ তাই সাহস করে একটা বাজে জ্ঞান দিয়ে যাই৷ কেমন?

- ইরশাদ।

- কেরিয়ার স্ক্রিউ করাটা বড়সাহেবের হাতে৷ হক কথা৷ কিন্তু দত্ত, এই মুখের সামনে রাখা ডিমটোস্ট বিস্বাদ করে দেওয়ার ক্ষমতাটা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছ কি মরেছ৷ 

- আপনিও লেগপুল করবেন মন্টুদা?

- বাপের জন্য মনকেমন করা খোকার লেগপুল করার আগে যেন আমি নরকের কড়াইতে বসে নিমপাতার পোলাও খাই হে দত্ত৷ শোনো, লোকজনকে দুরমুশ করে কেরিয়ার বাগানোটা কর্পোরেটে জগতে নতুন নয়। আর তেমন গুঁতোগুঁতি করে ভাবে বসের চেয়ারবাগানো মানুষের ইগো পোল্ট্রির ডিমের খোসার চেয়েও পাতলা। তারা পাওয়ার বলতে বোঝে 'কেরিয়ার স্ক্রু করে দেওয়া'৷ লেট মি টেল ইউ দত্ত, দে ডোন্ট উইন বাই স্ক্রুইং ইওর কেরিয়ার৷ বাট দে ডু উইন বাই রুইনিং ইওর ডিমপাউরুটিস; ইয়ে, ডিমপাউরুটিটা একটা মেটাফর। অবভিয়াসলি৷ প্রমোশন যায় যাক, ওই ডিমরুটি আর ঠাণ্ডা হতে দিও না ভায়া৷ আর যাই হোক, ওই গাম্বাট-বুদ্ধি বসদের অত সহজে জিততে দেওয়ার কোনও মানেই হয় না। 

- আর একটা ডিমটোস্ট অর্ডার করব তা'হলে বলছেন?

- বেড়ে বানিয়েছিল কিন্তু৷ আরও দু'প্লেট বলে দাও বরং৷