Showing posts with label প্রেম. Show all posts
Showing posts with label প্রেম. Show all posts

Sunday, June 1, 2025

প্রেম-ফেল

ফার্স্ট ইয়ারের শেষ দিকে গজিয়ে ওঠা ভালোবাসা থার্ড ইয়ারের শুরুর দিকে ফেল পড়া মাত্র সুমন্ত নরম প্রেমের গান শোনা বন্ধ করেছে। বিকেলে পার্কের বেঞ্চে বসে আহা-উঁহু করার মত মনোরম হাওয়া গায়ে লাগলেই দাঁত খিঁচিয়ে গ্লোবালওয়ার্মিংয়ের কথা বলছে। গল্পের বই বাদ দিয়ে ধারালো সব সেল্ফডেভেলপমেন্ট মার্কা বই খুঁজছে। এমন কী শুরুর দিকে সিগারেট ধরার একটা মৃদু চেষ্টাও করেছিল, তবে অনেক কেশেও ধোঁয়া ব্যাপারটার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা যায়নি। তার বদলে সর্বক্ষণ চুয়িংগাম চিবিয়ে গোটা দুনিয়াকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে চলেছে সে। তবে এত কিছু করেও সুমন্ত নিজের অপ্রেমিক বিপ্লবী ব্যক্তিত্বের ঝাঁজ নিয়ে সন্তুষ্ট হচ্ছিল না। আরও রাগতে হবে, গর্জে উঠতে হবে, কথায় কথায় খেইমেই করে উঠতে হবে, তেমনটাই তার ইচ্ছে।

শেষে এক বর্ষার বিকেলে সব এলেমেলো হয়ে গেলো, যেমনটা হয় আর কী। যুগে যুগে তো ঠিক এ'ভাবেই বিপ্লব ভেসে গেছে, ফিকে হয়ে এসেছে প্রতিবাদের রঙ। বিকেলের দিকে রেলের মাঠের পাশে ফার্স্টইয়ারি ভালোবাসাকে ফুচকার ঝালে নাকানিচোবানি খেতে দেখে ইনকিলাব হলো টলোমলো। পড়ন্ত আলোয় ফেলে-আসা-"ও"কে ফুচকা সাঁটাতে দেখে সব কেমন যে্ন এলোমেলো হয়ে গেলো। সুমন্তর মনে পড়লো "আহা, ও যে আমার চেয়ে মাস চারেকের ছোটো। যেই ওর সঙ্গে থাকুক, ফুচকাওলাকে ঝালের ব্যাপারে সঠিক ইন্সট্রাকশন যেন দিতে পারে। ও যে ঝাল সইতে পারে না"।

এরপর "বম্ ভোলে" হুঙ্কার দিয়ে নচিকেতার প্রেমের গান গুনগুন করতে করতে বাড়ির দিকে এগোলো সুমন্ত, আজ নারায়ণ দেবনাথে ঝাঁপ না দিলেই নয়।

Sunday, March 16, 2025

ফুচকা ও প্রেম



আন্তর্জাতিক ফুচকা ফেডারেশন সম্প্রতি একটা রিপোর্টে জানিয়েছে ফুচকার পরিসরে সেরা প্রেমের লাইন কোনগুলো। সে রিপোর্ট আমার হাতে কী'ভাবে এলো তা জেনে আপনাদের কোনো কাজ নেই। লাইনগুলো কী কী সে'টা বরং জানিয়ে দিই।

"আর একটা খাও না, এই তো। আমার ফাউটা...নাও না। নাও বলছি তো"।

"দাদা! ও ঝাল কম খায়, ওর আলুমাখাতে যতটা ঝাল কম দেবেন ততটা আমারটায় বাড়িয়ে দেবেন। ব্যালান্স রাখতে হবে তো নাকি"।

"আহা, দু'টো বাটি নেওয়ার কী দরকার"।

"হ্যালো? হ্যাঁ। শুনছি। হ্যাঁ হ্যাঁ, আলুকাবলিটা প্যাক করাবো বলেই তো দাঁড়ালাম। কী? ফুচকা খাচ্ছি কিনা? ধুস। তোমায় ছাড়া ফুচকার মুচমুচ নেতিয়ে যায় যে"।

"গন্ধরাজ লেবুটা একটা জব্বর ডাইমেনশন যোগ করে না? ঠিক যেন আমাদের রিলশনশিপে তোমার ঘ্যানঘ্যানানি "।

"আমার উনি আবার ফুচকায় টকজল খান না, স্রেফ শুকনো ফুচকা। বলতে পারেন, উনি ফুচকা-ভিগান"।

মিস্টার চ্যাটার্জির শেষ ক'টা দিন



- মিস্টার চ্যাটার্জি।
- হুঁ?
- জানলাটা খুলে দিই?
- নার্স, হাতে আর কয়েকটাদিন মাত্র। ভিটামিন ডি দিয়ে করবটা কী। তার চেয়ে বরং টিভিটা অন করুন। ভালো সিনেমাটিনেমা কিছু দেখা যাক..।
- বাইরেটা দেখতে ইচ্ছে করছে না?
- জানালার বাইরে দু'টো নিম গাছ, একট কদমগাছের অর্ধেক দেখা যায়। বাকি সবই হাইরাইজ। মরে যাচ্ছি বলে জোর করে রোম্যান্টিক মেজাজ তৈরি করার কোনো মানে হয় না।
- সরি। আমি টিভি চালিয়ে দিচ্ছি।
- ডাক্তার বর্মন আমার রিকুয়েস্টটার ব্যাপারে কিছু বলেছেন?
- মাংসভাত পারমিট করবেন বলে তো মনে হয় না।
- ফুল।
- ও'ভাবে বলবেন না। বর্মন স্যারের মত ডাক্তার..।
- সরি, ওকে আমার ফুল বলা উচিৎ হয়নি।
- ইট ইজ ওকে।
- ব্লাডিফুল।
- কোন চ্যানেল দেখবেন?
- নার্স, আপনার খারাপ লাগলো? ডাক্তার বর্মনকে দু'টো কড়া কথা বলেছি বলে?
- না না..।
- করেক্ট। মনে রাখবেন আমি মারা যাচ্ছি। কয়েকদিনের মধ্যে। সিম্প্যাথি অলিম্পিকে টীম হুইলচেয়ার বা টীম ব্রেইলের আগে টীম শ্মশানকে এগিয়ে রাখাটা আপনাদের কর্তব্য।
- এ'ভাবে যে সবার সঙ্গে গা জ্বালানো সু্রে কথা বলছেন, তা'তে মনে মনে শান্তি পাচ্ছেন?
- বানিয়ে মিথ্যে বলার চার রইল না। অনেকটা নিশ্চিন্দি বোধ করছি।
- কোন চ্যানেল চালিয়ে দি বলুন তো? ক্রিকেট?
- টিট্যুয়েন্টি হলে ফাইন। লম্বা ফর্ম্যাট দেখার সময় নেই। সামান্য তাড়া আছে।
- সিনেমাই হোক।
- হিন্দি। মারপিটের। প্রিটেনশাস উঁহুআহা দেখে গাল চুলকাতে পারবো না।
- এই সিনেমাটা চলবে? নতুন রিলীজ..। প্রচুর অ্যাকশন।
- গুড। এ'বারে আসুন। ঘণ্টা তিনেক আমায় ডিস্টার্ব করবেন না।
- আমি নার্স। আপনার যা সিচুয়েশন আমি আপনার পাশে না থাকলে..।
- প্রচুর ইন্টিমেট সিন আছে এই সিনেমায়। আপনি পাশে থাকলে আমার ইনটেনশন যে কোনদিকে যাবে..।
- আপনাকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা আমার আছে।
- নিজেকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি দেখতে তেমন মন্দ নন। শেষ পাতে নিজের চরিত্রের এই দিকটা ফলাও করার মানে হয় না। এমার্জেন্সি বেল আছে তো, আপনি আসুন।
- আর ইউ শিওর মিস্টার চ্যাটার্জি?
- নার্স, আপনার প্রফেশনে এই ন্যাকামো ব্যাপারটা খাপ খায়?
- আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
- আপনার কোয়ার্টার তো হসপিটাল কম্পলেক্সেই। খামোখা এ'খানে বসে থাকা কেন। কোয়ার্টারে যান। বিপদআপদ হলে ছুটে আসতে বড়জোর মিনিট পাঁচ।
- আপনি এত খবর জোগাড় করলেন কী ভাবে? আমি তো কখনও..।
- আমার লিভারটা গেছে। মগজ, চোখ-কান বেশ টনটনে।
- আর জিভের ধারটাও।
- প্লীজ, ফ্লার্ট করবেন না। আমি আপনার পিসেমশাইয়ের বয়সী। যদি আপনার তেমন সুন্দরী পিসি থেকে থাকে আর কী।
- ভারি বিটকেল আপনি।
- মনে রাখবেন। আমি মারা যাচ্ছি। আনন্দ সিনেমাটা মনে করে হামেশা চোখটা ছলছলে করে রাখাটা সবার কর্তব্য।
- আর আপনার কাজ সবাইকে বিব্রত করে কথা বলা?
- আপনি ব্লাডিফুল নন। তবে বড্ড বেশি কথা বলেন। এ'বার আসুন। শারুক্কখান এসে পড়েছেন।
- আমি বাইরের বেঞ্চিতেই বসছি..।
- গো ব্যাক টু ইওর কোয়ার্টার..। আপনার জন্য আমার প্রেশার বাড়ছে..।
- আশ্চর্য! বেশ, আমি আসছি। লছমনকে বলে যাচ্ছি..।
- পিন্টুকে আমার হয়ে বার্থডে উইশ করে দেবেন।
- আপনি কী করে আমার ছেলের কথা...আর আজ যে ওর জন্মদিন সে'টাও বা..।
- আমি আপনার মোবাইল কল..ইয়ে..ওভারহিয়ার করি।
- আমি আপনার রুমে কখনও পার্সোনাল ফোন কল নিইনি।
- ইয়ে, চ্যাটফ্যাট পড়ে ফেলেছি হয়তো।
- মিস্টার চ্যাটার্জি!
- ভুলবেন না। সিম্প্যাথি অলিম্পিক। আমি আনন্দ সেহগল।
- আসুন। পিন্টু স্কুল থেকে ফিরে অনেকক্ষণ একা বসে।
- আমি ঘণ্টাখানেকেই ফিরে আসবো।
- আমার হাতে হপ্তাদুই আছে। খামোখা অত তাড়াহুড়ো কেন।
- কেক আনবো?
- ব্লাডিফুল পারমিশন দেবে?
- আমি রিকুয়েস্ট করবো ডাক্তার বর্মনকে..।
- আপনার রিকুয়েস্ট থাকলে বর্মন আমায় শুধু কেক কেন, লুচি বেগুনভাজা নিজের হাতে খাইয়ে দেবে।
- আপনার ইঙ্গিতটা শোভন নয় মিস্টার চ্যাটার্জি..।
- আপনি সিঙ্গল, ব্লাডিফুল সিঙ্গল এবং সৎ।
- আপনি ভীষণ ই্নট্রুসিভ! আর এ'টা রীতিমতো অন্যায়..!
- আসুন এ'বার। সুইমস্যুটে নায়িকা স্ক্রিনে এসে পড়েছেন। খামোখা আপনার সঙ্গে খেজুর করার মানে হয় না। সন্ধের ভিজিটিং আওয়ার্সের পর আমি বর্মনকে আর্ম ট্যুইস্ট করে আপনার কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেব।
- শাটাপ মিস্টার চ্যাটার্জি!
- নার্সদেবী, পিন্টুকে সে ব্লাডিফুল ভালোবাসে। স্নেহ করে। পিন্টুও তাকে পছন্দই করে।
- হাউ ডু ইউ নো?
- আমি শুধু আপনার মোবাইল চুরি করে পড়ি ভেবেছেন? ব্লাডিফুলের জার্নাল রয়েছে তার মোবাইলে, সে মোবাইলের পাসওয়ার্ড আবার আপনার জন্মদিন আর সে ক্যাবলা ডাক্তারের পকেট থেকে দিনেরবেলা মোবাইল সরালে সে রাত্তিরে গিয়ে টের পায়।
- কেক আনবো, কেমন?
- ব্ল্যাক ফরেস্ট প্লীজ। এইবারে, গেট আউট!
(ছবি: AI)

হিসেবনিকেশ

- এই যে তুই সকাল থেকে এত নিশ্চিন্ত হয়ে বই পড়ছিস..।
- আর এই যে তুই ক্রমাগত বাগড়া দিচ্ছিস তুলি..।
- এত ম্যানেজ করতে আমার আর ভালো লাগে না।
- মাইক্রোম্যানেজ করা বন্ধ কর। দেখবি সব ভালো লাগবে।
- বিনু, গোটা রোব্বার বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলে তো প্রব্লেমগুলো নিজে থেকে সলভ হবে না।
- সে কী। আমার তো ধারণা এই বই পড়াটাই সলিউশন।
- আজ মাসের দু'তারিখ। তোর আর আমার অ্যাকাউন্ট মিলে পড়ে আছে সতেরোশো টাকা। আর সে'সব নিয়ে আলোচনা না করে গল্পের বই পড়াটা সলিউশন?
- মাংসের দোকানে লাইন দেওয়ার নেই। সিনেমার টিকিট কাটার নেই। ঘুরতে যাওয়ার নেই। অখণ্ড অবসর; অতএব বই পড়াটা এস্কেপ রুট নয়, সলিউশন।
- আমি ও'রকম চোখ বুজে ভবাপাগলা হয়ে থাকতে পারি না।
- পারলে আরো দু'টো টিউশনি নে।
- আর তুই? তুই কি করবি? সংসারটা আমার একার?
- আমি বই কেনা ছেড়ে দেব। তা'তে আমার নেট কন্ট্রিবিউশান তোর দু'টো টিউশনির চেয়ে বেশি হবে।
- ছুটির দিনে পড়বি কি?
- পুরোনো বই। রিপীট টেলিকাস্ট।
- বিনু। সিরিয়াস কবে হবি।
- আরে তুই বড্ড প্যানপেনে। আগামী হপ্তায় দু'টো কমিশন ব্যাঙ্কে ঢুকবে। মিনিমাম আট হাজার।
- মাসকাবারি বাকি।
- তোর ওই লেকটাউনের টিউশনির টাকাটা পাওয়া বাকি আছে না?
- দিয়ে দেবে। আজকালের মধ্যে। ও'দিকে স্কুটারের ইএমআইটাও কাটবে পরের হপ্তাহে। ওরে বাবা রে...কত খরচ রে আমাদের..। এখনও গোটা মাস পড়ে..।
- অন দ্য ব্রাইটার সাইড তুলি..এ মাসে আঠাশ দিন। দু'দিন আগেই পরের স্যালারি ঢুকবে। ভেবেই মনে হচ্ছে সন্ধেবেলা ফিশফ্রাই খাই।
- ফোন আর ওয়াইফাইয়ের রিচার্জ বাকি।
- তুলি।
- ভাল্লাগেনাছাই। আরো কত খরচ বাকি..। আর এ'টা শুধু এ'মাসে নয়। এক টানা, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এক মাসের ধাক্কা কোনোরকমের সামলে পরের মাসের টেনশনে ঢোকা...ভাল্লাগেনা বিনু..।
- তুলি..।
- কখনও জিরোতে পারি না যেন। ধুর।
- তুলি!
- কী?
- এ'দিকে আয়।
- হ্যাট। ন্যাকা।
- ইধর আও।
- কী ব্যাপার?
- আয় না।
- বল্।
- মাসের পয়লায় আমরা বাড়িভাড়া দিই। বছরের শুরুতেই মেডিকেল ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়াম ভরি। গরমকালে এসি চালাই। গত তিন বছরে একবার পাহাড় একবার সমুদ্র হয়েছে। আমরা খুব বড়লোক রে তুলি।
- তা আমি জানি। সে জানায় টেনশন কমে না।
- এটা একটা ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট প্রব্লেম। একটু দ্যাখনাই গলা শুকোনো।
- ভাল্লাগেনা বিনু। একটু গা ছেড়ে খরচ করতে ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে। খুব বড়লোকি না, ওই একটু দুশ্চিন্তা না করে রেস্টুরেন্টে ঢোকা একদু'বার। ও'তেই হবে।
- নির্মলদার দোকানের রুটি তরকা যে কেন তোর এলিট রেস্টুরেন্ট মেনুতে পড়ে না কে জানে।
- থাম তুই। অসহ্য ডেঁপো।
- ডেঁপো হ্যাস এক্সেপশনাল চুলেবিলি স্কিলস।
- তা হ্যাস।
- তুলি, একটা মাইনর আপডেট।
- কী?
- নীলুর দোকান থেকে ফোন এসেছিল। আমাদের ফ্রিজটা আর রিপেয়ার হবে না।
- সে কী! আমায় এখন বলছিস? এই বাজারে নতুন ফ্রিজ পাবো কই!
- সেই এমার্জেন্সি ফান্ড!
- না। মরে গেলেও না!
- ও'টা এখন সত্তর হাজার আছে। ও'খান থেকে বড়জোর কুড়ি বেরোবে।
- না! খবরদার!
- উপায় কী? ফ্রিজ ছাড়া থাকলে ডেলি খরচ বাড়বে।
- বিনু তুই একটা আস্ত বজ্জাত।
- আমার ওপর চটে কী হবে।
- বিনু, ও'টাকে তুই এমার্জেন্সি ফান্ড বলিস কেন? ও'টা আমাদের বিয়ের ফান্ড! ও'টায় দু'লাখ জমলে আমাদের জমজমাট বিয়ে করার কথা।
- একদম! ও'টায় দু'লাখ হলেই ছাদনাতলা! স্ট্রেট!
- পাঁচবছর সংসার হয়ে গেল বিনু অথচ এখনও বিয়ের ফান্ড একলাখও পেরোলো না। সবার চোখে লিভটুগেদার কাপল হয়েই রয়ে গেলাম।
- পাতি সইসাবুদে বিয়ে তোর মনে ধরে না। বিয়ে নিয়ে লাটসাহেবি করলে এই হবে!
- বিয়ে পাতি হবে কেন রে রাস্কেল?
- নবাব নবাবী করে তুলি তুলিগিরি, মিছিমিছি গাল খায় বিনুভিখিরি।

Thursday, November 21, 2024

মধু মিত্র



মধু মিত্র সিগারেট খান না ক্যানসারের ভয়ে।
পান খান না দাঁত নষ্ট হওয়ার ভয়ে।
আর লজেন্স খান না ব্লাড-শুগারের ভয়ে।

অতএব কী অছিলায় পান-দোকানে গিয়ে গল্প জুড়বেন সে'টা ঠাহর করতে পারছিলেন না। এ'খানে স্বাভাবিক ভাবেই আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন পান-বিড়ি এড়িয়ে চলা মানুষের দরকারটা কী পান দোকানে যাওয়ার। সে'টা আগে বুঝিয়ে বলি। মধু মিত্রকে ঠিক যুবক বলা চলে না, নয় নয় করে বয়স ছত্রিশ পেরিয়েছে। কিন্তু চেহারা দেখে যদি আপনি বেয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ বলে ভুল করেন তা'হলেও আপনাকে দোষ দেওয়া সম্ভব নয়। একটা প্রাইভেট ফার্মে ছোটখাটো চাকরী করেন। অনেক চেষ্টা করেও বিয়েটা করে উঠতে পারেননি, কাজেই একাই থাকেন। হাতে অঢেল পয়সা না থাক, মায়ের রেখা যাওয়া পেল্লায় এক বাক্স গয়না আছে; সে'টা বেচে নিশ্চিন্তে একটা ব্যাচেলর জীবন ফুর্তিতে কাটিয়ে দেওয়া যায়। অবসর সময়ে বই কেনেন আর মোবাইলে রিল দেখেন। সম্প্রতি একটা নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে এ পাড়ায় এসে উঠেছেন। দিব্যি ছিমছাম ফ্ল্যাট, মারাত্মক সুন্দর একটা ব্যালকনি আর ইয়াব্বড় একটা ড্রয়িং রুম। আর আছে একটা পেত্নী, শর্মিলা নামে। শর্মিলা সদালাপী, প্রাণোচ্ছল। প্রথম আলাপের পর মনে মনে শর্মিলা সম্বন্ধে প্রাণোচ্ছল বিশেষণটা ব্যবহার করেই অবশ্য জিভ কেটেছিলেন মধু মিত্র। ভালো শোনায় না, আহা রে, শর্মিলা নিষ্প্রাণ না হতে পারে; তাই বলে জ্যান্তও তো নয়। শর্মিলা অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে দাদা বানিয়ে ফেললে, এমন সরল-সিধে মেয়ে। আগামীকাল ভাইফোঁটা, তাই রান্নাঘরের ময়লার ডিবের থেকে মাছের আঁশগুলো পরিষ্কার করেনি মধু। এমনিতে তার শুচিবাই সাংঘাতিক, অপরিচ্ছন্নতা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ওই আঁশের গন্ধটা শর্মিলার ভারি পছন্দ। মেয়েটার জন্য একদিন এ জিনিস বরদাস্ত করাই যায়, রান্নাঘর ব্যবহার না করলেই হলো।

শর্মিলার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধও আছে মধু মিত্রের। ও ছিল বলেই এত সুন্দর ফ্ল্যাটটা প্রায় জলের দরে ভাড়া পেয়ে গেল সে। তা'ছাড়া শনিবার দুপুরে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শর্মিলার গালগল্প শুনতে বেশ লাগে। সে আত্মহত্যা করেছিল আজ থেকে বছর কুড়ি আগে, তখন তার বয়স ছিল একুশ। সে অর্থে সে মধু মিত্রর চেয়ে বয়সে বড়। অথচ মারা যাওয়ার পর থেকে শর্মিলার বয়স বাড়ছে না; সে'দিক থেকে তাকে কচি খুকিও বলা চলে। শর্মিলা ছোট বোনের মতই আবদারের সুরে কথা বলে, দিব্যি লাগে মধু মিত্রের। বিশেষত ছুটির দুপুর মানেই শর্মিলা আড্ডার আসর জমাবেই। মধু মিত্র নিজে বিশেষ গল্প বলতে পারে না, তবে তাঁর মত ভালো শ্রোতা খুব কমই আছে। সে জন্যই হয়তো শর্মিলার তাঁর এই নতুন দাদাটিকে এত পছন্দ হয়েছে। সেই স্নেহের জোরেই আজ দুপুরে শর্মিলা মধু মিত্রকে নিজের এক টুকরো দুঃখ জানালে। নির্মলের প্রেমে পড়েছিল সে ক্লাস নাইন থেকে। কিন্তু নির্মল পড়াশোনায় তেমন সুবিধের ছিল না, ডানপিটে হিসেবে পাড়ায় তার সবিশেষ বদনামও ছিল। অথচ শর্মিলা ছিন শান্ত মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। পড়াশোনাতেও ব্রিলিয়ান্ট। মাধ্যমিকে থার্ড হলে, উচ্চমাধ্যমিকে ফিফথ। ফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ করার খুব ইচ্ছে ছিল, সেই মত পড়াশোনাও শুরু করেছিল। ও'দিকে নির্মল তদ্দিনে পড়াশোনা শিকেয় তুলে বাবার দেওয়া পানের দোকানে গ্যাঁট হয়ে বসেছে। কিন্তু প্রেম ব্যাপারটা শর্মিলাকে বেশ কাবু করে এনেছিল। তার খুব ইচ্ছে ছিল নাকি নির্মলের দুর্দশা ঘোচানোর, এমন একটা কিছু করার যাতে নির্মল পান দোকান ছেড়ে একটা বড়সড় ব্যবসা ফেঁদে বসতে পারে। সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো নির্মলকে। কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় গোলমেলে অবস্থা হয়, বাবা শর্মিলার গায়ে হাত তোলেন। সে দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারেনি শর্মিলা। সে গল্প শুনতে শুনতে মধু মিত্রের চোখে জল এসে গেছিল।

"এই যে তুই আমার সঙ্গে এত মিষ্টি ভাবে আলাপ জমালি শর্মিলা, তুই নির্মলের সঙ্গে রোজ কথা বলিস না কেন"?

"তুমি খানিকটা খ্যাপাটে, আমারই মত। তাই ভূত-পেত্নীতে ঘাবড়ে যাও না। সবাই কি ছাই তাই"?

"কিন্তু নির্মল তোকে ভালোবাসতো তো, সে তো তোর সঙ্গে গল্প করতে পারলে খুব খুশিই হবে"।

"ভালোবাসার মানুষ চলে গেলে তার ফটোর দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়। তার ভূত দেখলে প্রেম-মহব্বত হাওয়া হয়ে যায়। হা হা হা হা হা হা"।

শর্মিলার খ্যানখ্যানে হাসি আর যুক্তি কোনোটাকেই পাত্তা দেননি মধু মিত্র। তিনি নিশ্চিত যে নির্মল যদি জানতে পারে শর্মিলা এখনও তার আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, সে নিশ্চয়ই গল্প করতে চাইবে। স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইবে। ভাইফোঁটায় শর্মিলাকে ঠিক কী উপহার দেওয়া উচিৎ সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না মধু মিত্রের। তাই খানিকক্ষণ পর, যখন দেখলেন নির্মলের পানের দোকানে অন্য কোনো খদ্দের নেই, তিনি "জয় মা" বলে এগিয়ে গেলেন।

***

চাটুজ্জেদের ফেলে যাওয়া ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটে ভদ্রলোক যে ছিটগ্রস্ত সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না নির্মলের। কিন্তু ভদ্রলোক এইমাত্র যা যা বলে গেল তা'তে তো মনে হয় সে বদ্ধ পাগল। কিন্তু নির্মলের তবু মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল, কেমন একটা অস্বস্তি চেপে ধরলো তাকে। শর্মিলা আর তার ছোটবেলার কথাগুলো এমন নিখুঁত ভাবে এই মধু মিত্র ভদ্রলোক জানলেন কী করে? এমন কী গঙ্গার ঘাটের বিকেলটার খবরও তাঁর অজানা নয়। নাহ, মনের অস্বস্তিটা কাটাতে ভদ্রলোকের বাড়িতে একবার ঢুঁ মারা দরকার। এত করে ভদ্রলোক বললেন যখন, আজ রাত্রেই যাওয়া যাক। যদি ফেরেববাজ কেউ হয়, তা'হলে তাঁকে একটু ধমক দিয়ে আসতে হবে। এই ভেবে দোকানটা সাত-তাড়াতাড়ি বন্ধ করে সামনের আধ-ভূতুড়ে অ্যাপার্টমেন্টের চার তলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন নির্মল।

খটকা লাগলো, মধু মিত্রর ফ্ল্যাটের দরজাটা অর্ধেক খোলা। পাশের দু'টো ফ্ল্যাট নির্ঘাত ফাঁকা। এ'দিক ও'দিক তাকিয়ে দু'একবার হাঁক পড়লেন নির্মল; "মধুবাবু আছেন নাকি"? কোনো সাড়া নেই। কেন জানি না নির্মলের পেটের ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠলো। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন নির্মল। একটা টিউব জ্বলছে, আর ফ্যানে গলায় দড়ি দিয়ে যিনি ঝুলছেন তিনি আধঘণ্টা আগে নির্মলের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে গল্প করে গেছেন। সামনের টি-টেবিলের ওপর একটা ঢাউস বার্মা কাঠের বাক্স। তার ওপর দু'টো ভাঁজ করা কাগজ। ওপরের কাগজটা হাতে নিয়ে টিউব-লাইটের আলোয় মেলে ধরলেন নির্মল;

"নির্মলদা,

এ'টা মধু মিত্রবাবুর হাতের লেখায় লেখা। আর কোনো উপায় না পেয়ে ভদ্রলোককে দিয়েই লিখিয়ে নিতে হলো। আশা করি তুমি বুঝবে।

তুমি ভালো আছো?
ভালো আছো না ছাই! আমি নেই, তুমিও ভালো নেই। সে আমি খুব জানি।

শোনো, অনেক হয়েছে, এ'বার ওই পান-দোকান তোমায় ছাড়তে হবে। এই কাঠের বাক্সে প্রচুর গয়না আছে। এ'গুলো বেচে তুমি একটা বড় কোনো ব্যবসা শুরু করো। আমার কত স্বপ্ন তোমায় নিয়ে নির্মলদা, কত বড় গলায় বাবাকে বলে গেছিলাম জানো, "তুমি দেখো বাবা, নির্মল চিরকাল ওই পান-দোকানে আটকে থাকবে না"। আমার কথা ফেলতে পারবে না তুমি, বলে রাখলাম। এই চিঠিটা তুমি ছিঁড়ে ফেলো, পারলে গিলে ফেলো। পাশাপাশি আর একটা চিঠি রেখে গেলাম; মধুবাবুকে দিয়েই লেখানো। ও'টাকে রেখে যেও। পুলিশ পড়বে মধু মিত্রর সুইসাইড নোট।

তোমায় ভালোবাসি নির্মলদা, কেমন? ভালো না বেসে আমার যে কোথাও যাওয়ার নেই।

আমার কত স্বপ্ন তোমায় নিয়ে, সে'গুলো পূরণ না হলে আমি কোথায় যাই বলতে পারো!

ইতি তোমার শর্মি"।

(ছবি: জেমিনাই)

Tuesday, July 16, 2024

মহাবিপদ



মরে গিয়ে মহাবিপদে পড়েছি বুঝলেন। এর চেয়ে বেঁচেই ভালো ছিলাম। বড়জোর অফিসে বড়সাহেবের আর বাড়িতে বৌয়ের মুখচোপা শুনতে হত দিনে দু-তিনবার। এ'ছাড়া ছিল নানারকমের ভয়; ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম ফেল করা, সেলস টার্গেট ঝুলে যাওয়া, কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া; আরো কত কী। কিন্তু মরার পর থেকে দেখছি দুশ্চিন্তা হাজারগুণ বেড়ে গেছে। রক্ত নেই, রক্তচাপ বাড়ছে। হৃৎপিণ্ড নেই অথচ বুকের মধ্যে ধড়ফড়। মহামুশকিলে পড়েছি। এ'বার একটু খোলসা করে বলি।

গতকাল রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ দু'পেগ হুইস্কিতে ভেসে আমাদের সাত তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে একটু দরদ দিয়ে গান ধরেছিলাম, "আমি যে জলসাঘরে"। দরদের ফোর্সটা একটু এ'দিক ও'দিক হয়ে গেল; কী'ভাবে যেন আমি ব্যালকনির রেলিং টপকে এক্কেবারে সোজা গিয়ে পড়লাম অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সুইমিং-পুলসাইডে। পুল-ভিউ ফ্ল্যাট কেনার এ'টা একটা বাড়তি সুবিধে, এই ধরণের দুর্ঘটনায় বেশ একটা সিনেম্যাটিক মাত্রা যোগ হয়।

ব্যাপারটা যা দাঁড়ালো; জলসাঘরের মেজাজ আর হুইস্কি মিলে কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি। যা হোক, এমন রক্তারক্তি একটা ব্যাপার ঘটে গেল; থানা-পুলিশ তো হবেই। ইন্সপেক্টর গুপ্তর মনের মধ্যে একটা অদম্য গোয়েন্দা বাস করে। বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি ওর মগজের মধ্যে ঢুকে দেখে এসেছি; সে'খানে আগাথা ক্রিস্টি আর আর্থার কনান ডয়েলের মাদুর পেতে পাশাপাশি বসে গল্পগাছায় ব্যস্ত। অতএব পেশায় ইন্সপেক্টর আর শখে গোয়েন্দা গুপ্তবাবু যে একটা সাদামাটা ব্যাপারকে সহজেই গুলিয়ে দেবেন, সে'টাই স্বাভাবিক।

মিনিট দশেক পায়চারী করে ইন্সপেক্টর গুপ্ত ঘোষণা করলে, "এ'টা যে দুর্ঘটনা সে'টা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না৷ আত্মহত্যা হতে পারে। এমন কী, খুনও হতে পারে"। আমার শ্যালক অমিয় সে'দিন সন্ধ্যে থেকে আমাদের সঙ্গেই ছিল, আমার গ্যাঁটের টাকায় কেনা হুইস্কি যতটা পেরেছে গিলেছে। বলাই বাহুল্য অমিয় ছোকরাটি হাড়বজ্জাত। কথায় কথায় বড় বড় বাতেলা এ'দিকে কাজের বেলায় লবডঙ্কা। ফিউশন রেস্টুরেন্ট চালানোর নাম করে বাপ-ঠাকুর্দার জমানো টাকাগুলো জলে দেওয়াটাই ওর প্যাশন। ইন্সপেক্টর গুপ্ত যেই বলেছে, "খুন", অমনি সে দুলে-দুলে সায় দিলে, "মার্ডার। মাই গড! জামাইবাবুর এলেম আছি মাইরি দিদি, মার্ডার হয়ে গেল? বিগ ব্রাদার দীনবন্ধু আইচ, তোমার এলেম আছে। আমাদের ফ্যামিলির জামাইদের মধ্যে ডাক্তার আছে, রঞ্জি খেলা ক্রিকেটার আছে, কিন্তু মার্ডার হওয়া কেউ এদ্দিন ছিল না৷ হোয়াট আ ডে। উই শুড অল বি প্রাউড"!

ও'দিকে আমার বৌ নীলা আপ্রাণ চেষ্টা করছিল একটু কান্নাকাটি করার। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছিল না। একটু সিনেমা-সিরিয়াল না দেখলে ওর চোখের জল ঠিক ফ্লো করতে চায় না। কিন্তু খুনের সন্দেহ যে একট অস্বস্তিকর ব্যাপার সে'টা বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি৷ খুন শুনেই মোবাইল থেকে মুখ তুলে হাউহাউ শব্দে ইন্সপেক্টর গুপ্তর দিকে তেড়ে গেলো, "কী বলছেন ইন্সপেক্টরবাবু। আমার স্বামী অমন দেবতুল্য মানুষ। তার কি কোনো শত্রু থাকতে পারে? তাছাড়া ঘরে এ সময় ছিলটা কে। আমি, আর অমিয়। আর আমাদের মেয়ে বুল্টি গেছে ওর মেজপিসির বাড়ি। এর মধ্যে কে খুন করবে ওকে"? বরাবরই দেখেছি, নীলার কথার মধ্যে একটা ধারালো ব্যাপার আছে। ইন্সপেক্টর গুপ্ত একটু থতমত খেলেন৷

" ইয়ে মানে", দু'পা পিছিয়ে গিয়ে বলতে শুরু করলেন গুপ্তবাবু, "রেলিঙটা তো যথেষ্ট উঁচু, ও'টা আলোগোছে মনের ভুলে ডিঙিয়ে যাওয়াটা ঠিক.."। শুনে মনে হলো ইন্সপেক্টর গুপ্ত হুইস্কি রস থেকে বঞ্চিত৷ নয়ত মাতালের উটকো ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলার ক্ষমতা সম্বন্ধে অকারণ সন্দেহ প্রকাশ করতেন না৷ ফের আমতাআমতা করে বলা শুরু করলেন, "তবে আপনারা বলছেন যখন..নিশ্চয়ই তাই হবে৷ দুর্ঘটনা.."। গুপ্তদারোগার মনের ভিতর পাতা মাদুরের ওপর তখন আগাথাদিদি আর আর্থারদাদা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছেন৷

নীলা আর একরাউন্ড অশ্রুহীন হাউহাউ দিয়ে ইন্সপেক্টরের পিলে চমকে দিয়ে বললে, "এমন সোনার সংসার। আমার দীনু অকারণ সুইসাইড করতে যাবে কেন"?

ইন্সপেক্টর গুপ্ত পত্রপাঠ বিষম খেয়ে জানিয়ে দিলেন "আপনার দীনুবাবুর পোস্টমর্টেম একটা হবে..তবে বোঝাই যাচ্ছে স্পষ্ট দুর্ঘটনা"। দুর্ঘটনার আশ্বাস নিয়ে নীলা মোবাইলে স্ক্রিনে নিশ্চিন্তে ফেরত গেল৷ অমিয় টলতে টলতে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে, ভাজাভুজি কিছু পড়ে আছে কিনা দেখতে।

এ'দিকে আমার শুরু হলো দুশ্চিন্তা৷ এত খাটুনি সব জলে না যায়৷ আমার দু'পেগ আর অমিয়র চার পেগের মাথায় মাতলমির অজুহাতে শালার গায়ে গিয়ে ঢলে পড়েছিলাম, সে আমায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়৷ অমিয়র নখগুলো জঙলি৷ আমি নিশ্চিত আমার ঘাড়ে অমন অদ্ভুতভাবে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর টাটকা নখের দাগ পাওয়া যাওয়ার ব্যাপারটা পুলিশকে ভাবাবে৷ আড়ালে অমিয়র ফোন হাতড়ে কিছু গর্হিত ইন্টারনেট সার্চও করে রেখেছি, "ক্যান আ পার্সন সার্ভাইভ আফটার ফলিং ফ্রম দ্য ইলেভেন্থ ফ্লোর"৷ ইন্সপেক্টর গুপ্ত কি অমিয়র ফোন বাজেয়াপ্ত করবে না? পুলিশ কি আমার ঘাড়ে অমিয়র ধাক্কা দেওয়া আঙুলের ছাপ বা নখের দাগ খুঁজে পাবে না?
মারাত্মক টেনশন হচ্ছে৷ মারাত্মক৷ অমিয় হয়ত পুরোপুরি ফাঁসবে না, কিন্তু একবারের জন্যও সামান্যতম সন্দেহ ওর ওপর এসে পড়লেই আমার শ্বশুরমশাই ওর পিছনে ক্যাঁক করে একটা কমল মিত্র অন স্টেরয়েড সুলভ লাথি কষাবেন৷ অন্তত বাপ-ঠাকুর্দার রেস্টুরেন্টের ব্যবসাটা নিশ্চিতভাবেই অমিয়র হাতছাড়া হবে গবেটত্বর জন্য৷ আর সে ব্যবসা নিশ্চয়ই নীলা পাবে৷ ওর পাওয়া উচিৎ। নীলা সত্যিই পারবে ও ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে৷ ও অমিয়র মত অকালকুষ্মাণ্ড নয়।

বিয়ের পর এতগুলো বছরে নীলার মেজাজটা ভারি তিতকুটে হয়ে গেছে৷ বাইরে থেকে সবাই দেখে ভাববে কী'রকম জাঁদরেল স্নেহহীন নিরেট মানুষ৷ আমি জানি নীলা এমনটা ছিল না চিরকাল, আমিই ওকে যথেষ্ট ভালো রাখতে পারিনি। মিইয়ে যেতে যেতে কেঠো হয়ে গেছে একসময়৷ ওর পরিবারের পুরুষরা ওকে তেমন পাত্তা দেয়নি কোনওদিন, বিয়ের পর আমিই বা কদর করলাম কই৷ ডাক্তার সান্যাল যে'দিন রিপোর্ট দেখে আমায় জানালেন যে আমার হাতে আর বড়জোর মাসচারেক, তখনই ঠিক করেছিলাম নীলার জন্য কিছু করার শেষ চেষ্টা একটা করতে হবে৷ আশা করি ডাক্তার সান্যাল রিপোর্টটা গোপন রাখার কথাটা ভুলবেন না।

এই মুহূর্তে ইন্সপেক্টর গুপ্ত নিজের কাজে ব্যস্ত৷
বেয়াদপ অমিয় রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পা ছড়িয়ে বেগুনি চিবুচ্ছে।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে নীলা একমনে মোবাইলের স্ক্রিন দেখে যাচ্ছে৷ ওর মনের মধ্যে একটু ঢুঁ মেরে দেখলাম; সে'খানে একটা নিরিবিলি বারান্দার গ্রিলে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে নীলা; কলেজে পড়া নীলা৷ সে বারান্দায় ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ ইচ্ছা হল ওকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু আমি তো ইচ্ছে-অনিচ্ছে পেরিয়ে বহুদূর চলে এসেছি৷ আচমকা সেই তরুণী নীলা ঘুরে তাকালো৷ ও নির্ঘাৎ আমায় দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু আমি দেখলাম ওর দু'চোখ ঝাপসা৷

একটা শেষ চেষ্টা করে দেখলাম নীলার হয়ে৷ ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াচ্ছে সে'টা না জানা পর্যন্ত আমার দুশ্চিন্তা কাটবে না।