Sunday, November 6, 2022

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে



- মিস্টার চ্যাটার্জী...।

- কে?

- আমার নাম বিনোদ।

- আমি তো আপনাকে ঠিক...।

- আমায় বস পাঠিয়েছেন।

- ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...।

- বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব।

- আসুন, ভিতরে আসুন।

- আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে।

- যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না?

- এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে।

- প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই।

- কী দরকার বলুন জামা পালটে।

- দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন।

- ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

- ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...।

- মিতুল আপনার...।

- ওয়াইফ। গতবছর একটা আচমকা অ্যাটাকে...। যাক গে। আসুন না।

***

- বাহ্‌, জামাটায় কিন্তু জেল্লা আছে মিস্টার চ্যাটার্জী।

- থ্যাঙ্কিউ। মিতুল বলেছিল পরলে নাকি আমার বয়স বছর পাঁচেক কমে যেতে বাধ্য। আমায় ইয়ং রাখার জন্য যে ও কতকিছু করত।

- মিসেসরা তো তাই চায়, হাসব্যান্ডরা যাতে চট করে ঢ্যাপস বুড়ো না হয়ে যায়।

- আপনার মিসেসও বুঝি...।

- হে হে...নয়ত কি আর এই লাল নীল চেক টিশার্ট আমি নিজে শখ করে কিনেছি নাকি মশাই।

- ভেরি নাইস ভেরি নাইস। আপনাকে খুব মানিয়েছে এই জামাটায়।

- থ্যাঙ্ক ইউ। ইয়ে, একটু পা চালিয়ে। রেলের মাঠের দক্ষিণের দিকটা ফাঁকা, নিরিবিলি। ও'খানেই কাজ সেরে নেব।

- ও হ্যাঁ। জায়গাটা সত্যিই বড় নিরিবিলি। রাতবিরেতে ধারেকাছে কেউ ঘেঁষে না। ইয়ে বিনোদবাবু, এই ব্যাপারটাকে কি না করলেই নয়?

- দেখুন, বসের হুকুম নড়চড় হওয়ার উপায় নেই।

- মানে, না হয় একটা সামান্য ভুল করে ফেলেছি। তার জন্য এত বড় একটা শাস্তি...।

- সামান্য? বসের তিনটে ট্রাক পুলিশে ধরেছে আপনার একটা ছোট্ট ভুলে। মিনিমাম চার কোটির লস। বসের রাইট হ্যান্ড ম্যান গুপ্ত পুলিশের হেফাজতে। ছোট্ট ভুল?

- ছোটো নয়, তাই না?

- সরি মিস্টার চ্যাটার্জী। রিয়েলি সরি। আপনি মানুষ খারাপ না। কিন্তু আমাদের কাজকর্মগুলো ঠিক ভালোমানুষি দিয়ে হয়না। এ'সব লাইনে আপনি এসেই ভুল করেছেন।

- আসলে, ক্রিয়েটিভ অ্যাকাউন্টিংয়ে আমার এলেম আছে। তাই ভাবলাম প্রতিভাটা ইউটিলাইজ করি। আমি কিন্তু টাকার জন্য এ লাইনে আসিনি জানেন। স্রেফ একটা অদম্য আগ্রহ...।

- আগ্রহের বসে মানুষ এভারেস্ট চড়তে চায়। বুড়ো বয়সে গান শেখার ক্লাসে ভর্তি হয়। আপনি ভিড়লেন স্মাগলারদের খাতা লেখার কাজে। মিস্টেক, মিস্টেক।

- আসলে মিতুল চলে যাওয়ার পর মাথাটা ঠিক...। বিনোদবাবু, কোনও উপায়ই কি নেই?

- কোনও উপায় নেই।

- তা, আপনার প্রসেসটা কী হবে?

- রিভলভার, পকেট ঢিপি হয়ে আছে দেখছেন না? সে'জন্যই তো এমন জায়গা দরকার যে'খানে নিশ্চিন্তে গুড়ুম করা যাবে। আড়াই সেকেন্ডের যন্ত্রণা। তারপর নিশ্চিন্দি।

- বুলেট? ইয়ে, সায়ানাইড টাইপ কিছু নেই? বুলেট ব্যাপারটা একটু ব্রুটাল।

- কিন্তু এফেক্টিভ। ঝামেলা কম। পয়জনটা ঠিক আমার এরিয়া নয়। ওতে বিস্তর পড়াশোনা করতে হয়।

- আই সি। যাক গে। আড়াই সেকেন্ডের হ্যাপা, তাই তো?

- আড়াই। দুইও হতে পারে। কিন্তু তিন হবে না। এ ব্যাপারে এক্সপিরিয়েন্স তো কম হল না।

- বিনোদবাবু, আমরা রেলের মাঠের দিকে যাচ্ছি তো?

- হ্যাঁ।

- আধ কিলোমিটার ঘুরে গেলে আশা করি কিছু মাইন্ড করবেন না? একবার রথতলার বাজার হয়ে গেলে ভালো হত।

- চালাকি করছেন না তো?

- মাইরি না। রথতলার বাজারে মিঠুনের ফুচকা খেতাম দু'রাউন্ড।

- ফুচকা?

- প্লীজ, না করবেন না। মিতুলের জন্যই ইচ্ছেটা। আসলে হপ্তায় মিনিমাম দু'দিন আমি আর মিতুল মিঠুনের কাছে ফুচকা খেতাম। আমি ম্যাক্সিমাম ঝাল, মিনিমাম টক। মিতুল মিনিমাম ঝাল, ম্যাক্সিমাম টক।

- ওহ, আমারও আবার বৌদির মত কেস। মিনিমাম ঝাল, ম্যাক্সিমাম টক।

- তা'হলে চলুন না বিনোদবাবু। মিঠুন বেশ রাত পর্যন্ত থাকে। চলুন না। লাস্ট উইশ।

- বাটিকের শার্ট আপনার শেষ ইচ্ছে ছিল।

- এ'টা সত্যিই ফাইনাল। প্লীজ।

- ফাইনাল কিন্তু! দু'রাউন্ড ফুচকা।

- মাইরি। প্লীজ। আর ইয়ে, আপনাকেও না খাইয়ে ছাড়ছি না কিন্তু।

***

- মিঠুনদা!

- খাবেন? আসুন তাড়াতাড়ি। এ'বার ঝাঁপি বন্ধ করব...।

- এইতো খেয়ে গেলাম আধঘণ্টা আগে।

- হুঁ?

- বাহ্‌, ওই যে, ওই বাটিক শার্ট পরা ভদ্রলোককে নিয়ে এলাম। দু'জনে তিরিশ তিরিশ ষাটটাকার ফুচকা খেলাম। আমি টক বেশি ঝাল কম, বাটিক ভদ্রলোক ঝাল বেশি টক কম।

- অ। তা কিছু ফেলে গেছেন?

- খানিকটা সে'রকমই।

- কী জিনিস?

- সামান্য অন্যমনস্ক থাকায় আমি আর সেই বাটিক-জামা-দাদা আমাদের ফাউ ফুচকা চাইতে ভুলে গেছিলাম। সে'টার জন্যই ফিরে এসেছি। তা বাটিকদাদাটি বিশেষ অসুবিধের কারণে আসতে পারলেন না। ওই দু'জনের ফাউটাই আপনি আমায় দিয়ে দিন প্লিজ।

- কী?

- দু'জনের ভাগের ফাউ ফুচকা, আমায় দিন। চটপট। হাত চালিয়ে। আমার আবার পৌনে এগারোটার লোকালটা ধরতে হবে।

বাটপার

- স্যার, সরি। ভেরি সরি। আর করব না এমনটা! মাইরি বলছি। ভদ্রকালীর দিব্যি...।
- মন্টু, শোনো...শোনো...।
- গড প্রমিস করছি স্যার। এ'বার ছেড়ে দিন। দিব্যি দিয়ে বলছি আমি আর জীবনে পকেট মারব না। আমি এ'পাড়াতেই আর আসব না। এক্কেবারে খোদার কসম স্যার। এইবারটি ছেড়ে দিন মাইরি। আমি বুঝতে পারিনি জাস্ট...। শুধু এ পাড়া কেন, এই ডিসট্রিক্টে যদি ফের আমায় দেখেন তা'হলে সোজা চাক্কু চালিয়ে দেবেন। কিচ্ছুটি বলব না...।
- আহ মন্টু...।
- প্লীজ ছেড়ে দিন স্যার...।
- আমার পা ছাড়ো আগে...।
- কিছুতেই না, মরে গেলেও আপনার পা ছাড়ব না। আমি ভগবান স্যার, আমি ছুঁচো। খামোখা একজন পকেটমারকে সাইড করে নিজের হাত গন্ধ করবেন কেন বলুন। প্লীজ দাদা...থুড়ি...স্যার...। ছেড়ে দিন না...আমি ছাই কী করে বুঝব বলুন, যে সাত জেলা কাঁপানো গুণ্ডা-শ্রেষ্ঠ বিধু হালদার অমনভাবে লোকাল ট্রেনে বসে সল্টেড বাদাম চিবুবে। আর সব দোষ আমার আঙুলের, আপনার ফতুয়ার আলগা পকেট পেয়ে সুট করে আঙুল এগিয়ে গেল মাইরি। তা তখনই আমায় দু'টো থাপ্পড় মেরে দিতে পারতেন তো।
- তোমার ভুল হচ্ছে মন্টু...।
- আচ্ছা বেশ, না হয় একটা ঠ্যাং ভেঙ্গে ছেড়ে দিতেন। আড়াই মাস লেংচে চলতাম। বেশ হত। আমার মত গবেটের লেংচেই চলা উচিৎ। একটা কান কেটে নিলেও আপত্তি করতাম না। কিন্তু স্যার, এই অধমকে তাই বলে এমনভাবে তুলে আনবেন? নিজের ডেরায় এনে লাশ ফেলবেন? জানি ব্যাপারটা আপনার কাছে জলভাত...তবু...বাড়িতে সে আমার এক বিধবা পিসি, দু'টো আধ-পোষা বেড়াল, তিনটে জবা গাছ; সব জলে যাবে।
- আরে ধুরছাই। তোমায় আমি খুন করব বলে তুলে আনিনি। পকেটমারিতে তোমার সত্যিই এলেম আছে। আমি তোমায় তুলে এনেছি একটা বিশেষ কাজে। তা আমার লোকজন তোমায় মারধোর করেনি তো?
- একদমই না। শুধু হাত-পা-মুখ বেঁধে, চ্যাংদোলা করে একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ির ডিকিতে দিন দেড়েক বন্ধ করে রাখলে, তারপর এই আপনার চোরকুঠুরিতে এনে তিন দিন বন্ধ করে রাখলে। সামান্য মানিব্যাগ সরিয়েছিলাম স্যার। ও'তে সাতশো বাহান্নটাকা ছিল। ছেড়ে দিননা স্যার, আমি পিসির গয়না বিক্রি করে সাতহাজার টাকা আপনার অফিসে জমা করে যাব। রসিদও চাইব না; পিসির দিব্যি। বিধবা বুড়ির ও'সবে গয়নাটয়নায় কাজ কী বলুন।
- উফ, তুমি বড় বাড়তি কথা বলো মন্টু।
- বিধুস্যার...। মেরে ফেলবেন না। শুনেছি মরে যাওয়ায় বড় কষ্ট। ব্যথাট্যাথা লাগে, দুঃখটুঃখ হয়। তার চেয়ে না হয় আরও দু'দিন না খাইয়ে রাখুন।
- চোপ!
- সরি। আমি চুপ।
- এ'বার যা বলছি, সে'টা মন দিয়ে শোন। তোমায় আমার একটা কাজ করতে হবে।
- রেশন তুলে দেব? সর্ষের তেল দিয়ে কষে গা মালিশ করে দেব? ভাতে-ভাত রান্না করে দেব?
- ফের বাজে কথা বলে। আগে শোনো...।
- বলুন স্যার।
- তোমায় আমার হয়ে পকেট মারতে হবে।
- আপনার হয়ে?
- আমার হয়ে।
- আপনি এ লাইনেও তবে...। মানে, আমি তো জানতাম বিধু মাস্তান মানেই উঁচু দরের কাজ। তোলা আদায়। ভাঙচুর। ইয়ে, কিডন্যাপিং।
- লাইন আমি চেঞ্জ করিনি। তবে একটা সূক্ষ্ম কাজ আছে। সে'জন্য আমার তোমায় প্রয়োজন।
- হুকুম করুন না। কার পকেট মারতে হবে বলুন। দারোগার? প্রাইম মিনিস্টারের?
- মনোজ সামন্ত। সে তো তোমার পাড়ারই লোক, তাই না?


- মনোজ মাস্টার? হাইস্কুলে এককালে অঙ্ক পড়াতেন? ও মা, ও বুড়োর পকেট কেটে পাবেনটা কী। তার নিজেরই খাওয়াপরার ঠিক নেই।
- আমি যা বলব, তাই করবে। তার বাইরে কিস্যুটি নয়।
- আচ্ছা বেশ, এ'বার ছেড়ে দিন। আজ বিকেলের মধ্যেই মনোজ মাস্টারের পকেট ফাঁক।
- ফাঁক করলে হবে না মন্টু।
- এই সেরেছে। পকেট মারতে বললেন তো।
- মনোজ মাস্টারের পকেট থেকে ওর মানিব্যাগ সরাবে। সে মানিব্যাগে একটা দু'হাজার টাকার নোট রাখবে। তারপর সে মানিব্যাগ মাস্টারমশাইয়ের পকেটে রেখে সরে পড়তে হবে।
- এই আপনার মতলবটা কী বলুন তো...।
- এ কাজের জন্য তুমিও পাঁচশো টাকা পাবে। প্রতি হপ্তায় এ কাজ একবার করে করতে হবে। প্রতি হপ্তায় তোমার পকেটে পাঁচশো।
- ঠাট্টা করছেন স্যার?
- এই যে, কড়কড় আড়াই হাজার টাকা। রাখো।
- মাস্টারকে সোজা গিয়ে টাকা দিলেই তো হয়।
- মাস্টারমশাই তো আমার থেকে টাকা নেবেন না।
- আপনার অত পিতলে পীরিতের দরকারটাই বা কি?
- ভদ্রলোক আমায় বিনে পয়সার পড়িয়েছেন বহুবছর। অনেক চেষ্টা করেছিলেন একসময় আমায় মানুষ করতে। তবে আমার বখে যাওয়াটা রুখতে পারেননি। ইদানীং শুনলাম বড় অভাবে পড়েছেন। ওর ছেলেটা মারা গেছে। স্ত্রী অসুস্থ। এ বয়সে বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে তেমন ম্যানেজ দিতে পারছেন না। তাই ভাবছিলাম আমার ঋণ খানিকটা শোধ করব।
- কিন্তু স্যার...।
- কোনও কিন্তু নয়...।
**
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো মন্টুর। এ কী! তাঁর নিজের পকেট থেকে মানিব্যাগ হাওয়া? সর্বনাশ! কিন্তু মন্টু বিশেষ কিছু ঠাহর করার আগেই টের পেল পকেটে আবার ওজন ফেরত এসেছে; ও মা! এইত্তো ফিরে এসেছে মানিব্যাগ! ভোজবাজি নাকি মনের ভুল? ভরদুপুরবেলা হাটেবাজারে এমনটা হল? আচমকা পিঠে একটা নরম টোকা পেয়ে স্যাট করে ঘুরে তাকাল সে।
- কে? এ কী! মনোজ মাস্টার যে!
- নিজেকে খুব লায়েক ভাবিস তুই, তাই না মন্টু?
- না মানে...মাস্টারমশাই...শুনুন...এই কান ছাড়ুন না...এ কী।
- আমি গোড়াতেই বুঝেছিলাম যে প্রতি রোববার বাজার থেকে ফেরার পথে আমার মানিব্যাগে একটা দু'হাজার টাকার নোট উড়ে এসে জুড়ে বসে কী করে। শোন ব্যাটা! অঙ্কমাস্টার আমি, ঘাসে মুখ রেখে চলিনা। ওই লেভেলে পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে ফেরত রাখার এফিশিয়েন্সি যে শুধু তোর আছে সে'টাও আমি আঁচ করেছিলাম গোড়াতেই।
- ও মাস্টারমশাই, মাস্টারমশাই গো! পুলিশে দেবেন না প্লীজ...আমি কিন্তু ঠিক চুরি করিনি...বরং উলটোটা...।
- শাটাপ। আমায় চ্যারিটি করতে এসেছিস? তাও ওই গুণ্ডামাস্তানের টাকায়? তক্কে তক্কে ছিলাম শায়েস্তা করার। দিনের পর দিন প্র্যাক্টিস করেছি, যাতে খেল আমিও দেখাতে পারি।
- প্র্যাক্টিস?
- গত দেড় মাসে আমায় বারো হাজার টাকা দিয়েছিস, মানে ওই বিধুমাস্তানের দান আর কী। তোর পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে, তা'তে ছ'টা দু'হাজার টাকার নোট ফেরত রেখে ফের তোর পকেটে চালান করেছি। কী, কাজটা স্মুদলি করেছি তো? মন্টু পকেটমারের স্কিল ম্যাচ করতে পেরেছি তো?
- আজ্ঞে মাস্টারমশাই, লজ্জা দেবেন না...।
- শোন মন্টে, প্র্যাক্টিসে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। ঠিক সময়ে অঙ্কটা সাফিশিয়েন্টলি প্র্যাক্টিস করলে আজ বিধুর এ'অবস্থা হত না। ছি ছি, মাস্তানির টাকায় নিজের মাস্টারের উপকার করবে? কী দুঃসাহস।
- আমার কোনও দোষ নেই, আমায় ছেড়ে দিন প্লীজ।
- তোকে ছেড়ে না দিলে তুই বিধুর মুখে ওই বারো হাজার টাকা ছুঁড়ে মারবি কী করে! আর শোন, বিধুকে বলে দিস যে বুড়ো শিক্ষকের প্রতি অত দরদ থাকলে যেন একদিন বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে আসে। ও গুণ্ডা হলেও আমার ছাত্র। সে রাইট ওর আছে।
- বলে দেব। বলে দেব মাস্টারমশাই।
- আর এও বলে দিস, যে সে নিজে না এলে আমি তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে কান মুলবো। প্র্যাক্টিসে যে কী সম্ভব তা তো নিজের চোখেই দেখলি। এক মাসের প্র্যাক্টিসে তোর মত পকেটমারের পকেট যদি মারতে পারি, তা'হলে চেষ্টাচরিত্র করে কিডন্যাপিংয়েও বিধুর ওপর বাটপারি করাটা ইম্পসিবল নয়।
- আপনি যা যা বললেন,মুখস্থ করে নিয়েছি। বিধু স্যারের কাছে গিয়ে এক্কেরে উগরে দেব। এ'বার আসি?
- যাবি? দাঁড়া। এই ভরদুপুরে তোকে ধরে-বেঁধে এত জ্ঞান দিলাম। যাওয়ার আগে অন্তত দুটো রসগোল্লা খাওয়াই। চ'সমরের মিষ্টির দোকানে গিয়ে বসি খানিকক্ষণ। বিধু কেমন আছে সে খোঁজখবর একটু নেওয়া দরকার।

কলেজস্ট্রিট ও চলে যাওয়া



"দাদা, একটা ডিমরুটি৷ ডবল ডিম৷ একটু বাড়তি পেঁয়াজকুচি দেবেন প্লীজ?রুটির মাথাটা একটু বেশি বাদ দেবেন৷ হ্যাঁ, অতটাই৷ আর খুব কড়া ভাজবেন না, কেমন"?

দু'পাশ দিয়ে তরতরিয়ে বয়ে চলছে শশব্যস্ত কলেজ স্ট্রীট৷ হাতে সদ্য কেনা সাতপুরনো বই খানতিনেক, সেই হলদ ঝুরঝুরে কাগজের গন্ধ আর দরদামের ক্লান্তি মিলেমিশে বিকেলটা বড় মায়ার৷ স্টিলের ছোট গেলাসে চামচ দিয়ে ডিম ফেটানোর শব্দ হুট করে বুকে এসে ঠেকে৷
যাহ্, এইবার চলে যাওয়া৷

অবশ্য খানিকটা গড়িমসি করাই যায়৷ ইউনিভার্সিটির দিক থেকে হাঁটা শুরু করে কফিহাউসের সামনে পৌঁছোলে একটা পছন্দসই লেবু সরবতওলা পাওয়া যাবে৷ সে সরবতের গেলাস হাতে আরও মিনিট দশেক আদায় করে নেওয়াই যায়।

পুরনো পাড়ার গন্ধ, চেনা হইহট্টগোল, আর সে'সব ছাপিয়ে মনের মধ্যে "আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই" মার্কা বিহ্বলতা; মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে৷ লেবুর সরবতের গেলাসটা অত শক্ত করে না ধরলেও চলত বটে; কিন্তু ওই৷ ও'ভাবেই যদি অন্তত শেষের দশটি মিনিটকে টেনেহিঁচড়ে নিলডাউন করিয়ে রাখা যায়৷

দুই খোকা



মফস্বলি ওই কোণাটা নেহাতই জলাজঙ্গল। সাপখোপ, পোকামাকড়, ঝোপঝাড়, কাদাজল; কোনও কিছুরই অভাব নেই৷ তবে নরম রোদ্দুরের দুপুরে ও'দিকটায় গেলে আরামদায়ক ছায়া আর নদী ছুঁয়ে আসা তুরীয় ঠাণ্ডা হাওয়া জুটতে পারে। সে লোভেই ও'দিকটায় গেছিলাম। বসেছিলাম একটা গজিয়ে ওঠা ছোট্ট শিবমন্দিরের চাতাল ঘেঁষে।

আচমকা, চার্চের পাঁচিল টপকে দুই স্কুল-টেক্কা দেওয়া ছোকরা এ'পাশে নেমে এলো৷ আমাকে খানিকক্ষণ সন্দিগ্ধ চোখে জরীপ করার পর বুঝল আমি স্পাই নই, বরং আমার চোখে বোধ হয় সামান্য প্রশ্রয়ই ছিল। এরপর ঝাড়া আধঘণ্টা সে দু'জন স্রেফ রকমারী বাঁদরামি করে কাটিয়ে দিলে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখে গেলাম৷

ব্যাটারা গাছ বেয়ে ওঠা নামা করলে৷
টারজানের মত হাঁক পাড়লে অকারণ৷
চেল্লামেল্লি করলে, হেসে গড়াগড়ি খেলে৷
শ্যাডো বোলিং করলে।
একে অপরকে গাঁট্টাও কষালে বোধ হয়।
আবার ঠিক আধঘণ্টার মাথায় আবার পাঁচিল টপকে সরেও পড়লে।

ও'টুকু সময়ের মধ্যেই মনপ্রাণ আলো করে দিয়ে গেল নাম-না-জানা দু'টো ছেলে। বেঁচেবর্তে থাক বাপেরা, আনন্দে থাক। আরও বহুবছর যেন ওরা ও'ভাবেই অপ্রয়োজনে পাঁচিল টপকে এই নিরিবিলিতে এসে হুলস্থুল পাকাতে পারে৷ দু'দিন বইতো নয়৷

পুনশ্চঃ ওদের স্কুল ইউনিফর্ম সত্যিই সার্থক।

বাইজুবাওরা

বাইজুর দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা জানিয়েছেন তাঁরা মর্মাহত এতগুলো মানুষকে ছাঁটাই করতে হল বলে। আড়াই-হাজার মানুষকে বাদ দিতে হল নিতান্ত নিরুপায় হয়েই, "প্রফিটেবিলিটি টার্গেট" বাগে আনতে। ব্যাপারটা এই যুগে দাঁড়িয়ে খুব একটা অদ্ভুত নয়, এমনটা তো আকছারই হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু বাইজুপ্রধান যে মনভার করা "ওপেন লেটার"টি বাজারে ছেড়েছেন, সে'টিকে আলাদা করে স্যালুট না করে উপায় নেই। মুনাফা ম্যাক্সিমাইজ করতেই যুগেযুগে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে, ব্যাপারটার এথিকাল দিকে যাওয়ার কোনও মানে হয়না। কিন্তু এমন বুক বাজিয়ে আহা-উঁহু দুঃখ প্রকাশ করে পি-আর পয়েন্ট আদায় করতে বুকের পাটা লাগে। বাইজুপ্রধান সত্যিই এর জন্যে প্রশংসার দাবী রাখেন।

আড়াই হাজার মানুষের চাকরী গেল। আড়াই হাজার। ইংরেজিতে বলি, কানে তা'তে 'সুইটলি' বাজবে হয়ত; ট্যু অ্যান্ড আ হাফ থাউজ্যান্ড চাকরীজ; জাস্ট ফুড়ুৎ। সেই ঘ্যাচাং খবরটা মোলায়েমভাবে পেশ করে বাইজুপ্রধান চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছেন, "কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। আই অ্যাম সরি। কিন্তু কী করব বলুন, আমাদের এমন স্যাটাস্যাট গ্রোথ হবে সে'টা আগে থেকে ঠিক আঁচ করতে পারিনি। (যেহেতু আমারা আশাতীত ভাবে উন্নতি করেছি) কাজেই অতিরিক্ত 'ইনএফিশিয়েন্সি' আর 'রিডানডেন্সি' (লিঙ্কডইনকে আদরবাসা) আর নেওয়া যাচ্ছে না"।

এ'সব নিয়ে আলোচনার মানে হয়না। কিন্তু যেহেতু একটা মন-কেমনকরা "আহা, আমরা চাইনি, তবুও নিরুপায় হয়ে...সরি"-মার্কা চিঠি বাজারে (কাগজে-কাগজে) ছেড়েছেন, কাজেই দু'টো প্রশ্ন করাই যায়।

প্রথমত। ইনএফিশিয়েন্সি সম্বন্ধে। আড়াই হাজার ইনএফিশিয়েন্ট মানুষকে রিক্রুট করেছিলেন বাইজুবাবু? ট্যু অ্যান্ড আ হাফ থাউজ্যান্ড রিক্রুটমেন্ট ফেলিওরস? ভাবা যায়? এই যে তবে টেড-টকে শুনি, ভুল করা খারাপ। কিন্তু বারবার ভুল করাটা সাংঘাতিক লেভেলের পাপ। আড়াইহাজার ভুলভাল রিক্রুটমেন্ট? দলনেতার নাকের নীচ দিয়ে সে'টা এদ্দিন ঘটেছে? সে'টা কি এক ধরণের...ইয়ে...ইনএফিশিয়েন্সি? সে' ইনেফিশিয়েন্সির কোনও প্রতিকার আছে কি? কে জানে।

দ্বিতীয়ত। রিডানডেন্সি সম্বন্ধে। নিজের ব্যবসা কোনদিকে যাবে সে'টা ঠাহর করতে পারেননি? তাই এখন টুক করে সামান্য অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া "প্রফিটেবিলিটি টার্গেট" মিট করতে? অথচ দেখুন, লীঙ্কডইন বলছে লীডারদের দূরদর্শী হতে হবে। কাজেই এই যে ব্যবসার ভবিষ্যৎ সঠিক ভাবে আঁচ করতে না পারা; সে'টা কি...ওই...রিডানডেন্সি?

যাক গে, এই খোলা চিঠিটার ডাকনাম দেওয়া হোক "শেষের কবিতা"।

মামার রিভেঞ্জ ফর্মুলা



- মামা, লোকে বলছে সাকসেস ইজ দ্য বেস্ট রিভেঞ্জ। এমন সাকসেসফুল হতে হবে যাতে হাড়বজ্জাত লোকজন হিংসেয় জাস্ট জ্বলে-পুড়ে খতম হয়ে যায়।

- বাহ্‌, তা'হলে আর চিন্তা কীসের। বদলার চিন্তা না করে, সাকসেসফুল হওয়ায় মন দে।

- খাটাখাটনি করছি বটে, তবে সাকসেস-টাকসেস ঠিক গ্রিপে আসছে না।

- তবে আর মরাল থিওরি কপচে হবেটা কী। যা গিয়ে দু'টো গাঁট্টা মেরে আয়। পারলে আড়াল থেকে ঢিল ছোঁড়।

- মারধোর করলে বড় লাগে। গাঁট্টার বদলে চিমটির সিচুয়েশন এলেই আমি ক্র্যাশ করে যাবো। নার্ভ ধরে রাখতে পারব না।

- গুণ্ডা লাগা।

- গুণ্ডা? তুমি শকুনি না কংস?

- সাকসেসফুল হয়ে লোকজনকে জেলাস করতে পারবি না। লাথি-ঘুষি চালাতে পারবি না। গসিপ ছড়াতে পারবি?

- গসিপ? আড়ালে-আবডালে নিন্দে করতে হবে?

- শুধু নিন্দে নয়। সে নিন্দে ডাহা মিথ্যে হতে হবে। স্ক্যান্ডাল তৈরি করতে হবে। ওটাই হচ্ছে কোল্ডেস্ট রিভেঞ্জ।

- মামা, আইডিয়াটা ভালো। কিন্তু...

- আবার কিন্তু?

- মিথ্যে বলতে খারাপ লাগে না। কিন্তু আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারিনা। ছড়িয়ে ফেলি। খেই রাখতে পারিনা। গুলগুলো ইনকসিস্টেন্ট হয়ে যায়।

- নাহ, ওই নার্ভ নিয়ে গসিপ ছড়াতে যাসনা।

- মামা, আমার আর রিভেঞ্জ নেওয়া হবে না? এত অন্যায় অপবাদ স্রেফ ডাইজেস্ট করে নেব?

- সব অপমান যদি চিরকাল হজম করে যাস, তা'হলে এই দুনিয়া তোকে সার্ভাইভ করতে দেবেনা। গুরুদেব বলে গেছেন; জন্মিলে রিভেঞ্জিতে হবে, সন্ন্যাসী কে কোথা কবে।

- তবে উপায়?

- যখনই কেউ ইনসাল্ট করবে, সোজা নিজের প্রিয় কাটলেট আনিয়ে হেমন্ত শুনতে শুনতে খেতে আরম্ভ কর।

- তা'তে কী হবে?

- ম্যাজিক!

- ম্যাজিক?

- ম্যাজিক। যেই দেখবি কেউ বিট্রে করছে, অমনি কাটলেট-হেমন্ত ফায়্যার করবি। যত বিট্রেয়াল; তত কাটলেট, তত হেমন্ত। ক'দিন পর দেখবি তোর বডি বিট্রেয়ালের রেস্পন্সে নিজে থেকেই বাড়তি ডোপামিন জেনারেট করছে। শরীরের রেস্পন্স অ্যালগরিদমটাই পালটে দে। ল্যাঠা চুকে যাবে।

- থ্যাঙ্কিউ মামা। তা'হলে আপাতত জোড়া কাটলেট অর্ডার দেওয়া যাক..।

বেলিয়াতোড়ের লালুর মালাই-চা


আজ বিকেলের দিকে যখন বেলিয়াতোড় মোড় ক্রস করছিলাম; তখন পেটে খিদে তেমন ছিলনা, তার আগে বিষ্ণুপুরের মোনালিসা হোটেলের লাঞ্চটা ভালোই হয়েছিল৷ কিন্তু অমন সারিসারি মিষ্টির দোকানে থরে থরে সাজানো ম্যাচার গ্র্যাভিটেশনাল পুল ঠেকিয়ে রাখা গেল না৷ ম্যাচার প্রতি আমার তেমন টান নেই, কিন্তু জেনুইন হুজুগ ব্যাপারটাকে সমীহ না করে থাকা যায়না৷

"লালু মেচা" দোকানটার সামনে দাঁড়ালাম কারণ সে'খানে দেখলাম জনসমাগম অন্যান্য দোকানের তুলনায় বেশি৷ ম্যাচা খেলাম; ওই যে বললাম - আমার জিভে মন্দ ঠেকেনা, তবে তা নিয়ে পদ্য লেখাটা বাড়াবাড়ি৷ কিন্তু লালু মেচার দোকান জাস্ট জ্বালিয়ে দিল দু'টো আইটেমে;
প্রথমত, চপ৷
দ্বিতীয়ত, মালাই চা৷

ইয়াব্বড় চপ, ভেজিটেবল তবে ট্র্যাডিশনাল টেক্সচারের নয়৷ সে' চপের বেসনের পরতটা হাইক্লাস আলুর চপের মত৷ আর ভিতরের সবজির পুরটা বিটের লালে লাল নয়; পাঁচমেশালির হলুদ৷ স্বাদে সত্যিই অনন্য৷ দেদার বিটনুন ছড়িয়ে, শালপাতায় মুড়ে দোকানিদাদা এগিয়ে দিলে সেই ধোঁয়া ওঠা চপ। আমরা পত্রপাঠ উড়িয়ে দিয়ে দু'নম্বর চপখানা চেয়ে নিলাম৷

কিন্তু ওই চপের চেয়েও উচ্চমার্গের ব্যাপার হল গিয়ে ওই মালাই চা৷ আমি চা-প্রেমি আদৌ নই, কিন্তু ওই মাটির ভাঁড়ে সার্ভ করা ওই মালাই মেশানো অমৃতর জন্য মাইল তিনেক পথ দিব্যি হেঁটে যেতে পারি। চপের মতই, ওই চাও দু'বার চেয়ে খেতেই হল।

জয় বেলিয়াতোড়, জয় লালু।

রামলীলা আর মেলা


নয়ডা স্টেডিয়াম লাগোয়া ময়দানে রামলীলার জবরদস্ত মেলা দেখে এলাম আজ৷ সে'খানে পৌঁছনো মাত্রই বেগুসরাইয়ে মেলা ঘোরার সুখস্মৃতি দিব্যি মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে গেল। হাইক্লাস মেলার সমস্ত রসদই ছিল। বিভিন্ন সাইজের নাগরদোলা, রকমারী খাবারদাবারের ঝলমলে সব স্টল, কচিকাঁচাদের হইহল্লা, আধবুড়োদের মাতব্বরি, খতরনাক মউত কা কুয়া, ছোটখাটো একটা সার্কাস, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর আয়োজন, জিলিপির দোকান; সাজসরঞ্জামের অভাব ছিলনা৷

যা বুঝলাম, নাগরদোলার টিকিটের দাম হুহু করে বেড়েছে৷ অবশ্য কোনও কিছুর দামই তো পড়তির দিকে নয়, নাগোরদোলাওলাদের আর কী দোষ। তবে খরচ বাড়লেও, তাতে মেলামুখো মানুষের আগ্রহ মিইয়ে যায়নি৷ আর যাই হোক, করোনায় দু'বছর দমবন্ধ করে বসে থাকার পর চলাফেরা জমায়েত হৈ-হুল্লোড় সবে শুরু হয়েছে যে।

গোড়াতেই বলেছি। এ মেলা খানিকটা বিহারের স্মৃতি উস্কে দিয়েছে৷ সেই উস্কানি পূর্ণতা পেল লিট্টির দোকানে এসে৷ লিট্টিদাদা ব্যস্ততাও চোখে পড়ার মত৷ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজনের মেলায় লিট্টির এই সমাদর দেখে খানিকটা গর্বও হল বটে৷ বিহারের প্রতি আন্তরিক টানটা রয়ে গেছে দেখছি।

আমাদের ও'দিকে মফস্বলের মেলায় রোলের দোকানের যেমন দাপট, এ'দিকে সে দাপট বোধ হয় টিক্কিচাট গোছের স্টলগুলোর৷ দিল্লী, নয়ডার দিকে মানুষের চাটভক্তি চোখে পড়ার মত৷ আর শত-ব্যস্ততার মধ্যেও এই তরুণ চাট-আর্টিস্ট পোজ দিতে বা খেজুরে গল্প জুড়তে পিছপা হচ্ছেন না৷ সে উষ্ণতায় মনে হয়; কোভিডকে বোধ হয় আমরা সত্যিই খানিকটা দমিয়ে দিতে পেরেছি৷ খানিকটা অন্তত।
মিষ্টিমুখের আয়োজনও ছিল, গরম গুলাবজামুনের দেখলাম বেশ কদর৷ মিঠেপানের দোকানও জুটে গেল৷ বেশিরভাগ দোকানই সামাল দিচ্ছে অল্পবয়সী ছেলেপিলের দল; মেলার ভ্যাগাবন্ড দোকান বলে তাদের 'ফোকাস অন সার্ভিস এক্সেলেন্স' ফিকে হয়ে যায়নি৷ আর আজকাল একটা মস্তসুবিধে; ছোটখাটো দোকানেও ইউপিআই বা ডিজিটাল ওয়ালেট থেকে টাকা দেওয়া যাচ্ছে। কাজেই পকেটে তেমন টাকাপয়সা না থাকলেও দিব্যি টপাটপ গোলাপজাম সাফ করে দেওয়াই যায়।

খাওয়াদাওয়া-নাগরদোলা; এ'সব তো হল৷ এ'খানে এসে রামলীলার যাত্রাপালা (অবশ্য যাত্রা কথাটা এ'দিকে অচল) দেখবনা তা কী'করে হয়৷ ইয়াব্বড় মাঠ, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কালো মাথার গিজগিজ৷ আর পালার সে কী এনার্জি৷ ইমোশনের সে কী মার্ভেলাস টানাপোড়েন। আধমাইল দূরে দাঁড়িয়েও সে থ্রিল অনুভব করা যায়৷ আর জানা-প্লটে অভিনয় করেও যে এমন উত্তেজনা মাঠভর্তি দর্শকদের মধ্যিখানে ছড়িয়ে দেওয়া যায়; সে'টা ভেবে দু'একবার ব্রাভো বলতেই হয়। দূর থেকে দেখার একটা অসুবিধে হল খোকার হাইটের প্রবলেম। অগত্যা খোকাকে কাঁধে নিয়ে মিনিট পনেরো রামের বিয়ে দেখলাম৷ সীতার 'বিদাই'য়ের সময় জনকরাজার সে কী হৃদয়বিদারক বুক-চাপড়ানো কান্না; তা শুনে পাথুরে মানুষকেও নড়েচড়ে বসতেই হবে৷
শেষপাতে অত্যন্ত খারাপ (এবং পোড়া) তেলে ভাজা সুস্বাদু পাপড় চিবুতে চিবুতে বাড়ি ফিরলাম। অল ইজ ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল৷