Showing posts with label রাজনীতি. Show all posts
Showing posts with label রাজনীতি. Show all posts

Thursday, November 21, 2024

লজ্জাঘেন্না

লজ্জাঘেন্না ত্যাগ না করলে সম্ভবত রাজনৈতিক ক্ষমতা আদায় করে নেওয়া যায় না৷ কাজেই তাঁদের আগডুমবাগডুম কথাবার্তায় আকাশ থেকে পড়ার কিছু হয়নি৷ কিন্তু এই "প্রতিবাদ করছেন তবুও মাইনে-বোনাস নেবেন?" গোছের প্রশ্ন যে যতবার করবেন, ততবার জোরালো গলায় "মিথ্যে বলছেন, মানুষকে টুপি পরাচ্ছেন" বলে সরব না হয়ে উপায় নেই৷

ন্যায্য প্রতিবাদকে ঠেকাতে গিয়ে এই সস্তা-মিথ্যে-বাজে যুক্তিটুকু অনেকেই চালিয়ে থাকেন৷ অনেকে আবার এ'টা বলে ভাবেন "বেশ দারুণ স্মার্ট একটা কথা বলে ফেললাম আর কী"। কিন্তু ক্ষমতাসীন মানুষ, বিশেষত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন মারাত্মক রকমের আত্মবিশ্বাস নিয়ে এ'সব গুল (আইনের দিক থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে, কমনসেন্সের দিক থেকে) ফায়্যার করেন, তখন মনে হয়ে সত্যিই সব রসাতলে গেছে বটে।

এ'ক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিবাদীরা নিজেদের প্রতিবাদের পাশাপাশি নিরলস ভাবে মানুষের জন্য কাজও করে চলেছেন৷ তবে ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তরে অদ্দূর যাওয়ার দরকারটাই বা কী৷ ন্যায্য প্রতিবাদ রুখতে বেতন কাটা আর লেঠেল লেলিয়ে ঘরদোর ভেঙে শায়েস্তা করার মধ্যে খুব বেশি তফাত নেই। এই সহজ-সরল কথাটা না জেনেও জননেতা হওয়া যায়-সে লজ্জা তাঁর নয়, সে লজ্জা আমাদের৷

Tuesday, July 16, 2024

দত্তবাবুর মুক্তি



- গুড মর্নিং।

- আরে আপনি, আসুন। আসুন।

- তৈরি হয়ে নিন মিস্টার দত্ত৷

- মানে?

- মানে আপনার মুক্তি আসন্ন। আপনার সরকারের সঙ্গে আমাদের হাইকমান্ডের সমঝোতা হয়ে গেছে।

- ওহ্‌।

- এ'বার অন্তত আর অমন গোমড়া মুখে থাকবেন না।

- নাহ্‌৷ মানে ঠিক, বিশ্বাস হচ্ছে না...। গত সাতটা মাস এমন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কাটলো..। তবে এজেন্ট রস। আপনাকে ধন্যবাদ না জানালে চলবে না৷ এই অন্ধকারের মধ্যেও আপনি দিব্যি বন্ধুর মত পাশে ছিলেন।

- তৌবা তৌবা মিস্টার দত্ত৷ আপনাকে যে টেররিস্টের দল কিডন্যাপ করেছে, আমি তাদের কম্যান্ডার। আমায় বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিজেকে ছোটো করবেন না৷

- এজেন্ট রস। আমি কিন্তু আপনার মধ্যে একজন ভালোমানুষকে দেখেছি৷ এই ক'মাসে চাইলে আপনি আমার ওপর অকথ্য অত্যাচার করতে পারতেন। এ'সব না করে আপনি আমার সঙ্গে দু'বেলা গল্পগুজব করেছেন৷ দাবা খেলেছেন৷ আমার বউ-মেয়ের খবর পৌঁছে দিয়েছেন নিয়মিত। আর সবচেয়ে বড় কথা অন্য কেউ আমার ওপর তম্বি করতে এলে তাকে ঠেকিয়ে রেখেছেন।

- মিস্টার দত্ত। আপনাদের খাতার আমায় টেররিস্ট বলে দাগিয়ে দিয়েছেন বটে। হয়তো সে'টা নেহাৎ ভুলও নয়। তবে কী জানেন, যাই হই, পেটি মার্সিনারি তো নই। অসহায় বন্দীকে খুঁচিয়ে আনন্দ আমি কোনোদিনই পাইনি৷ আর আপনি তো গুণী মানুষ।

- আই মাস্ট সে, আপনার হাতের রান্নাও কিন্তু এ-ক্লাস৷ নয়ত আপনাদের ক্যাম্পের লপসি খেয়ে সাত মাস টানতে পারতাম না৷

- তৈরি হয়ে নিন৷ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ মিনিট দশেকের মধ্যে রওনা হবো।

- এজেন্ট রস৷ এইবারে অন্তত আপনার আদত নামটা যদি..।

- ব্যাপারটা গোপন রাখায় আমার তেমন স্বার্থ নেই দত্তবাবু৷ তবে আমাদের সম্পর্ক এই সাত মাসেরই ছিল৷ এজেন্ট রস আর মিস্টার দত্তের বাইরে নিজেদের টেনেহিঁচড়ে এনে কী লাভ৷ নিন, ক্যুইক৷ এ'সব ব্যাপারে দেরী করলে চলবে না৷ আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি৷ রেডি হয়ে হাঁক পাড়লেই চলে আসবো।

- এজেন্ট রস। থ্যাঙ্কিউ৷

- হুঁ। আমি আসি..।

- আপনার গ্রামের নামটা ইউসজ্বেক, তাই না?

- নামটা বেশ গোলমেলে। আপনি মনে রেখেছেন, ভালো লাগলো।

- সে'দিন আপনি ঠিকই বলেছিলেন রস। এ যুগে দাঁড়িয়ে ও গাঁয়ের মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, এই অন্যায় বরদাস্ত করা যায় না৷ একটা কথা দিয়ে যাচ্ছি; এর বিহিত এ'বার আমরা করবই৷ ফিরে যাই একবার৷ কোনো ট্যাঁফোঁ শুনছি না৷ সরকারের থেকে এ জিনিস আমি আদায় করবই৷

- থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার দত্ত৷ আপনি মানুষটা বড় ভালো। মেয়েদের স্কুল একটা হলে, গাঁয়ের মানুষের সত্যিই মঙ্গল হবে৷

- আপনার সঙ্গে হয়ত আর কখনও দেখা হবে না৷ কিন্তু আগামী একবছরের মধ্যে আপনার ছোট্ট দুই মেয়ে স্কুলে যাবে৷ কথা দিলাম৷

- রেডি হয়ে নিন৷

- আপনার থেকে একটু এক্সাইটমেন্ট আশা করেছিলাম কিন্তু৷ প্রগ্রেসের দাবীতেই তো আপনারা লড়াইয়ে নেমেছেন, তাই না?

- মিস্টার দত্ত। আপনাদের কিছু বোমারু বিমান গতকাল আমাদের ও'দিকের অন্তত দশখানা গ্রামকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে গেছে। হাইকম্যান্ড তারপরেই রণেভঙ্গ দেবে ঠিক করেছে৷ কেউ যদি বেঁচেই না থাকে, তবে প্রগ্রেস কাকে ছোঁবে।আর এই অসম লড়াই কহাতক টানা যায়৷ জানেন, আমাদের গাঁ-খানাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ আমার বউ আর মেয়ে দু'টোও এ যাত্রা আর বাঁচল না।

- এজেন্ট রস!

- তবে কিছু বাচ্চা মেয়ে এখনও পুড়ে ছাই হয়ে যায়নি৷ পারলে সরকারবাহাদুরকে ধরেবেঁধে স্কুলটা বানাবেন৷ কেমন?

- আমি..আই অ্যাম সরি।

- এ'বারে মুক্তি মিস্টার দত্ত৷ কঙ্গ্রাচুলেশনস টু ইউ অ্যান্ড ইওর গভর্নমেন্ট৷

আপদবাজি ভূতের গল্প



আপদবাজি ভূতের নাম শুনেছ তোমরা? নির্ঘাত শোনোনি। কিন্তু মনে রেখো, তোমরা শোনোনি বলেই যে সে জিনিস সত্যি নয়, এমন হামবড়াই মনের মধ্যে পুষে না রাখাই ভালো। যখনই তেমন অহংকার মনের মধ্যে উঁকি দেবে, একটা মন্ত্র বত্রিশবার জপ করবে, তা'তেই সেই হামবড়া ভাব কেটে যাবে: "পৃথিবীটা বিপুলা, আমি জানি কাঁচকলা"। তুমি ফের বলবে "এ'টা কোনও মন্ত্র হলো? তা'ছাড়া ছন্দেও ভুল রয়েছে"। আমি বলব "পৃথিবীটা বিপুলা, তুমি জানো কাঁচকলা"।

যা হোক। আপদবাজি ভূতের কথা হচ্ছিল। আপদবাজি ভূতদের বাস গুড়বালি ডোবার ধারের বোঁদেপচা জঙ্গলে। গুড়বালি ডোবা আর বোঁদেপচা জঙ্গলের নাম শোনোনি? কী আর বলবো বলো। ইশকুলের বই আর কাঠ-কাঠ অ্যাটলাসের মধ্যে আটকে থেকে এই দশা হয়েছে আর কী। তা, বোঁদেপচা মানুষের কাছে জঙ্গল হতে পারে, ভূতের চোখ দিয়ে সে জঙ্গল যদি দেখতে পারতে তবে বুঝতে সে জঙ্গল আদতে সাজানো-গোছানো ছিমছাম একটা টাউনশিপ। বসতবাড়ি, ক্লাবঘর, বাজারঘাট, স্কুল; সবই রয়েছে। ওই যে বললাম, ভূতের চোখ থাকলে বুঝতে বোঁদেপচার কী রোয়াব।

তা এই আপদবাজিরা বড় মামুলি ভূত নয়; ভূতের জগতে তাদের স্থান প্রায় গন্ধর্ব-কিন্নরদের মত। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ মরে আপদবাজি ভূত তৈরি হয় না। কী, কেমন দিলাম! চমকে গেলে তো? যাও, গিয়ে এক গেলাস জল খেয়ে এসো। তোমাদের তো সেই বস্তাপচা সব ধারণা; ভূত তৈরি হবে মানুষ মরে। আর ধুর ধুর, মানুষ-ভরা ভূতেরা অতি নিকৃষ্ট, মানুষের মতই। বড় ছিঁচকে তাদের চিন্তাভাবনা, নিতান্তই পাতি তাদের কাজকারবার।

আপদবাজিদের ব্যাপারই আলাদা। মানুষ নয়, মানুষের বিপদ মরে গিয়ে আপদবাজি ভূতের তৈরি। যে সে মোটাদাগের বিপদ হলে চলবে না, একদম হাইক্লাস বিপদের মেঘ যখন কেটে যায়, তখন বোঁদেপচা আলো করে নতুন কোনও সদস্য ঢুকে পড়ে। এই যেমন ধরুন, ঘুপচি নামের আপদবাজি মেয়েটা জন্মেছিল অমল সাহার ঘুম ভাঙার পর। তোমাদের নিয়ে এই এক সমস্যা, সোজা কথা সোজাসাপটাভাবে শুনলেও হাজারটা প্রশ্ন তোমার মনে ঘুরপাক খায়। ঘুম আবার কী ধরণের বিপদ আর ঘুম-ভাঙাটাই বা বিপদের কেটে যাওয়া কী করে। আরে বাবা, অমলবাবু যে মেল ট্রেনের ড্রাইভার। টিকিয়াপাড়ার পর দিব্যি ট্রেনের ড্রাইভারের কেবিনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, ঘুম ভাঙল বর্ধমান ঢোকার দু'টো স্টেশন আগে। আর দু'মিনিট এ'দিক ও'দিক হলেই একটা বিশ্রী কিছু হয়ে যেত। কিন্তু হলো না। তার বদলে আমরা পেলাম ঘুপচিকে। আর পাঁচটা আপদবাজির মতই ঘুপচির দিন কাটে কবিতা আউড়ে। ওহ হো। তোমাদের বলা হয়নি, আপদবাজিদের ওই এক গুণ, কথায় কথায় ছড়া কাটা। সমস্যা হলো, মানুষের কান দিয়ে শুনলে ছড়াগুলো শুনলে তোমার গা গুলিয়ে উঠতে পারে। কী আর করবে বলো, চাইলেই তো আর মানুষের কান ফেলে দিয়ে ভূতের কান লাগিয়ে নেওয়া যায় না। এই যেমন আজ মনের সুখে ছড়া আউড়াতে আউড়াতে ঘুপচি এ'গাছ থেকে ও'গাছ নেচে বেড়াচ্ছিল।

"যত ব্যাটা আছিস যে'খানে সব মর্‌,
হোক নিউমোনিয়া, হোক ডিসেন্ট্রি, হোক জ্বর
যত ব্যাটা আছিস যে'খানে সব মর্‌,
হোক অম্বল, হোক মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড়
যত ব্যাটা আছিস যে'খানে সব মর্‌"।

তোমরা শুনেই ভাবলে কী বিশ্রী ছড়া এ'টা। ঠ্যাং নেই, মাথা নেই, ছাঁদ নেই, ছিরি নেই, ছন্দে লবডঙ্কা। ঘুপচির তা'তে বয়ে গেছে। হোঁচটবাবুর খুব ভালো লাগে ঘুপচির ছড়া কাটা। নিজের ঝোপের এক কোণে হেলান দিয়ে বসে তিনি মুগ্ধ হয়ে শোনেন ছোট্ট ঘুপচির ছড়া। মাঝেমধ্যেই বলে ওঠেন,

"আহা আমার ঘুপচি মামনির মনটা বড্ড নরম,
বোঁদেপচায় চির-পৌষ আর মানুষ-পাড়ায় বোশেখ গরম।
আহা আমার ঘুপচি মামনির মনটা বড্ড নরম"।

হোঁচটবাবুর বয়সের গাছ পাথর নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কোনও জমিদার গিন্নীর ওপর গোঁসা করে মিছরির সরবতসহ গেলাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, জানতেও পারেননি সেই গেলাসে দুষ্ট নায়েব বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন। সে গেলাস ছুঁড়ে ফেলা মাত্র হোঁচটবাবু এই বোঁদেপচায় উদয় হন। বড়ই সাদামাটা ভূত হোঁচটবাবু। অবশ্য আপদবাজি মাত্রই সাদামাটা। এখানে গোলমেলে ভূত বলতে একজনই; বাবু বুকভার। বাবু বুকভারের আস্তানা হোঁচটবাবুর ঝোপের পাশেই। দুপুর-নাগাদ, যখন গোটা বোঁদেপচা ঝিমিয়ে পড়ে, বাবু বুকভার এসে হোঁচটবাবুর পাশে বসে। সবিশেষ গপ্প হয়না। বাবু বুকভার মোটেও গপ্পের মানুষই নয়। তবে বদ নন, তাই হোঁচটবাবু অপছন্দ করেন না তাঁকে। তবে গোলমেলে একটাই কারণে, ঠিক কী'রকম বিপদ কেটে যাওয়ার তিনি এ পাড়ায় এসেছেন, তা কেউ জানে না। একসময় হোঁচটবাবু খবর বের করার অনেক চেষ্টা করেছেন, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। গোটা বোঁদেপচায় বাবু বুকভারের সঙ্গে সখ্যতা শুধু ওই হোঁচটবাবুরই ।

দুপুরবেলাটা বিড়বিড় করে কতরকমের গল্প করে যান হোঁচটবাবু, বাবু বুকভার শুধু তার হিলহিলে স্প্রিংয়ের মত লম্বাটে গলার মাথায় বেঢপ সাইজের ডিমের মত মাথাটা নেড়ে সঙ্গত দিয়েই খালাস। বুকভারকে সবাই বোবা আপদবাজি বলেই ধরে নিত। যদি না সে মাঝেমধ্যে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠত;
"ভোট দিন ভোট দিন,
ভোট দিন ভোট দিন"।

এই হাবিজাবি কথাগুলোর মানে ঠাহর করতে পারতেন না হোঁচটবাবু।
**
গল্পের পেটে গল্প লুকিয়ে থাকে, সে'টা শুনেছ তো? নাকি সে'টাও আমাকেই বলে দিতে হবে। আচ্ছা জ্বালা তো। যা হোক। শোনো।

খানিকক্ষণের জন্য বোঁদেপচা থেকে বেরিয়ে এসো। পিছিয়ে যাও কিছু বছর। চলে যাও মানুষের মধ্যে। কান পাতো, সাবধানে।
শুনতে পাবে একটা বুক ঠাণ্ডা করে দেওয়া কণ্ঠস্বর।
"একটা ভোটও যদি ও'পাশে যায়, জানবি, তোদের গাঁয়ের একটা বাড়িও আস্ত থাকবে না"।

ভোটের বেহাত হওয়া তবুও আটকানো যায়নি। কোনো এক ছোট্ট অদরকারী গ্রাম জ্বলে ছাই হয়ে গেছিল কোনো এক রাত্রে। চারদিকে লাশ, হাহাকার, আগুন, রক্ত, চিৎকার। সমস্ত বিপদ কি নির্বিবাদে কাটে? কিছু বিপদ কাটাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়, পুড়ে যেতে হয়। একটা গ্রামভর্তি মানুষ এককাট্টা হয়ে আশপাশের কুড়ি-বাইশটা গ্রামকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন দস্যুদের কবল থেকে, ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের বিপদ; স্রেফ ভোট দিয়ে।

বাবু বুকভার যে'দিন বোঁদেপচায় উদয় হয়েছিলেন, তার কানে তখন বিশ্রী চিৎকার; "ভোট দিন ভোট দিন, ভোট দিন ভোট দিন"।

Wednesday, July 12, 2023

স্পাইন



- আর একটু ভাত দিই রন্টু?

- আর না বাবা।

- কাল থেকে এই বাড়ির ডালভাতই রাজভোগ মনে হবে৷ 

- হেহ্৷ আচ্ছা দাও আর দু'টো ভাত।

- তোর মা থাকলে আমার ওপর কী রাগটাই না করত৷ আজকের দিনটা অন্তত ঝোলভাত খাওয়াতে পারতাম। আসলে সময় এত কম..।

- হ্যাঁ। তুমি মাছ এনে ঝোল রেঁধে খাওয়ানোর তাল করলে ডুবতে হত৷ শেষে পাউরুটি চিবিয়ে বেরোতে হত।

- ওরা এলো বলে, তাই না রন্টু?

- খবর তো সে'রকমই।

- রন্টু। জেলে বোধ হয় লপসি দেয়, তাই তো?

- কাতলার ঝোল, গন্ধরাজ লেবুর টুকরো দিয়ে যে ভাত সার্ভ করবে না সে'টা নিশ্চিত। 

- তুই ঘাবড়ে যাস না রন্টু। সমরকাকু বলেছে বেইল পেতে অসুবিধে হবে না..আরে দেশে আইনকানুন তো এখনও উঠে যায়নি।

- সমরকাকুর সাধের লিগ্যাল প্র‍্যাক্টিস এ'বারে ডুবলো বোধ হয়।

- ওরা চাপ দেবে বুঝি? থ্রেট? চোটপাট? মাস্তানি?

- তোমার কী মনে হয়?

- সমরের স্পাইন আছে৷ ও নুইয়ে পড়বে না৷

- সমরকাকুর একটা সংসারও আছে। সব হারানোর ভয়ও আছে৷ একটা সিডিসাস ছেলের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে যদি ফ্যামিলি সেফটি বিঘ্নিত হয়..।

- হ্যাঁ রে রন্টু৷ তোর মা নেই৷ তাই আমার থাকাটাও ম্যাটার করে না, তাই না? তাই তোর  সংসার নেই? শুধুই স্পাইন আছে?

- স্পাইনটা তোমার থেকেই পাওয়া৷ অফিসে ঘুষ নেওয়ায় মদত দাওনি বলে মারধোর খাওনি তুমি? 

- অফিসের ওপরওলাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আর গোটা পলিটিকাল মেশিনারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা কি এক হল রে? তোকে দেখে আমি যে কী ইন্সপায়্যারড হই রন্টে..।

- এই সেরেছে। মনে রেখো, মেরুদণ্ডের গল্প প্রবন্ধে লেখা এক জিনিস৷ কিন্তু বয়স হলে বোন ডেন্সিটি কমে যায়৷ এ বয়সে তোমার পুলিশের লাঠি সইবে না৷

- আমায় আন্ডারএস্টিমেট করিস না৷ তুই জানিস এককালে আমি মুগুর ভেজেছি?

- সে'তো ভালো কথা৷ তা'বলে বেগুনটা আজ এক্সট্রা ভেজে কালো করে ফেলবে?

- এহ্৷ মনে হচ্ছিল বটে যে ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে৷ তেতো লাগছে নাকি রে?

- না না। অতটাও খারাপ নয়৷

- রন্টু, এই শোন৷ জেলে ওরা তোকে..। মানে..তোকে যদি ফস করে..মানে।

- কী?

- না মানে..সমস্ত মেশিনারি ওদের হাতে৷ চাদ্দিকে কত কিছু শুনি। কিন্তু যদি..।

- যদি?

- না না৷ নেগেটিভ কিছু ভাবব না৷ অপটিমিজম ছাড়া রিভোলিউশন হয় না৷

- বাবা৷ আমার কপালে লপসি ফেস্টিভাল নাচছে৷ তুমি নার্ভাস হয়ো না।

- নার্ভাস? আমি? হেহ্৷ হাসালে ব্রাদার৷ এক কোপে পাঁচ কিলোর কাতলা দু'ফালি করে দিই এখনও৷ নার্ভস অফ স্টিল।

- ব্রাভো।

- ফিরে আসিস বাবু৷ কেমন?

- তোমায় বেশিদিন একা ছাড়লে মা দুশ্চিন্তার চোটে ওপর থেকে নেমে এসে চোটপাট শুরু করবে। সে রিস্ক নেওয়া যাবে না।

- কী গর্ব হচ্ছে আমার তোকে নিয়ে বাবু৷ কী গর্ব। তুই জয়েন্টে যেদিন ফস্কে গেলি, আমি তো রেগে ফায়্যার। তোর মা বারবার আমায় বলেছিল, রন্টুকে জয়েন্ট-মেডিকালের স্কোরে বাঁধা যাবে না৷ 

- উফ্! বাবা! এই নড়বড়ে মন নিয়েই বেগুনভাজা পুড়িয়ে ফেললে মাইরি।

- হেহ্। আর একটু ভাত নে না রন্টু। নে। আর একটু৷ এই একটু। এক চামচ মাত্র৷ এ'টুকুই তো৷

- দাও।

- যাকগে। লপসি মুখে দিয়ে বাপের রান্নার সুবাস মনের মধ্যে টেনে আনিস৷ দেখবি স্পাইন টনটনে থাকবে।

- বাবার রান্নার হাত; অমর রহে।

- জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ!

Saturday, July 1, 2023

দেশ ও দশ

জর্জ কার্লিনকে বলতে শুনেছিলাম, "মানুষের কনফিডেন্সের বলিহারি- একে অপরকে ভারিক্কি চালে বলে চলেছে যে এইবেলা প্লাস্টিক থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে। আরে ইস্টুপিডের দল, পারলে নিজেদের প্লাস্টিকের থেকে বাঁচা। তোরা মরে হেজে যেতে পারিস, তা'তে পৃথিবীর কিছু এসে যাবে না। পেল্লায় একটা গ্রহ, টুক করে নিজেকে রিসেট করে নেবে। মানুষের মত কত এলেবেলে চিজ এলো গেলো, তা'তে পৃথিবীর হেলদোল থাকবেই বা কেন? পৃথিবী হাজার হাজার বছর আগেও ছিল, হাজার হাজার বছর পরেও থাকবে"। অবশ্যই কার্লিন অবিকল এই ভাষায় বলেননি, তাঁর ভাষার ধার ও মেধার গভীরতা আমার অনুবাদ-ক্ষমতায় আঁটবে না।
কথায় কথায় যারা "দেশের সম্মানের কী হবে" যুক্তি ভাসিয়ে দিয়ে জরুরী তর্ক পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন - তাঁদেরকেও বোধ হয় কার্লিনের টেমপ্লেটে প্রশ্ন করতে উচিৎ। ভারতবর্ষ কি কাটোয়ার ন'পিসি? তাঁর প্রেস্টিজ কি অতই ঠুনকো যে ভাইপো ঝ্যাম্পারাপার মার্কা বলিউডি সুর গুনগুন করলে ইজ্জত জলে যাবে?
মানুষের প্রতিবাদকে এড়িয়ে না যাওয়াটাই দশের মঙ্গল। দেশের লেগপুল করা অত মামুলি ব্যাপার নয়। কথায় কথায় বেফালতু যুক্তি দিয়ে ইস্যু গুলিয়ে বেশিদিন চলবে কী করে? ইতিহাসের মত মারত্মক একজন হেডমাস্টার সবার ওপর নজর রাখছে আর ইজিচেয়ারে বসে মিটিমিটি হাসতে থাকা দেশের দিকে তাকিয়ে বলছে, "দ্যাখো কাণ্ড, তোমার ইনসাল্ট হল কি হল না তা নিয়ে এরা মারামারি করছে। আচ্ছা গাম্বাটের দল তো"!

Sunday, July 24, 2022

জনসেবা



প্রিয় সুমি,

হাসপাতাল থেকে লিখছি। মন ভার৷ জিভ বিস্বাদ৷ গা-হাত-পা ব্যথা৷ যা হোক, নিজের দুঃখকে কোনওদিনই তেমন বড় করে দেখিনি, আজও দেখব না৷ মানুষের ভালো করতে চেয়ে এ বন্ধুর পথ আমি নিজেই বেছে নিয়েছি, সামান্য দু'একটা চোরকাঁটা বা সেফটিপিনের খোঁচায় দমে গেলে চলবে কেন?

যাক গে। যা বলতে কলম ধরলাম।আজকাল আর অসহায় মানুষদের কথা কেউ মন দিয়ে ভাবে না৷ কত সহায়সম্বলহীন মানুষ যে সহমর্মিতার অভাবে দুর্ভাগ্যের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই৷

এই আমার কথাই ধরো৷ সাধারণ মানুষের জন্য তো কম করলাম না এ'কবছরে৷ এ'পাড়ায় টিউবওয়েল চাই, ও'পাড়ায় ডিসপেনসারিতে ভালো ডাক্তার চাই, অমুক অঞ্চলে রাস্তার মেরামতি দরকার, তমুক অঞ্চলে তেলেভাজার দোকান বসানো দরকার৷ নেতা মানুষের কাজ কি কম সুমি? অথচ দেখ, এত কিছু করিয়ে দেওয়াটা কেউ দেখল না৷

এরা দেখে শুধু কে আমায় জোর করে সামান্য কমিশন গছিয়েছে, কে ভালোবেসে ক্ষীরকদমের বাক্সে পুরে তোমার জন্য চোদ্দ ভরির হার দিয়েছে৷ চারদিকে নেগেটিভ মাইন্ডসেট৷ ওরে বাবা টিউবওয়েল সাপ্লায়ার আমার বাড়ির চারতলার ঘরের মেঝে মোজায়েক করে দিয়েছে কি দেয়নি; তা জেনে পাবলিকের কী লাভ? আরে টিউবওয়েল তো জায়গা মত বসেছে, নাকি! ঠিক আছে, সাত মাসের মধ্যে বার পাঁচেক সে টিউবওয়েল খারাপ হয়েছে বটে, কিন্তু তার ফলে টিউবওয়েল রিপেয়ার করনেওলা কন্ট্র‍্যাক্টর যে বাড়তি ব্যবসা পেল, তা'তে তো আখেরে ইকনমিরই উপকার; তাই নয় কি? লোকে সে'সব অ্যাপ্রিশয়েট করবে না, গণ্ডমূর্খের দল যত৷ শুধু খুঁত ধরবে। টিউবওয়েল সাপ্লাইয়ের কন্ট্র‍্যাক্টর আর টিউবওয়েল রিপেয়ার করার কন্ট্র‍্যাক্টর, তারা ভালোবেসে আমায় ছোটখাটো সামান্য কী'সব বাড়ি, গাড়ি দিয়েছে; তা'তে লোকের গাত্রদাহের শেষ নেই৷ কী জেলাসি ভাবতে পারো? এ জন্যেই বাঙালির আজ এই দুর্দশা। 

একটু মনপ্রাণ দিয়ে জনতা-জনার্দনের সেবা করব, সে'উপায় আর রইল না৷ অকারণ অদরকারী ব্যাপারস্যাপার নিয়ে টানাটানা করে, আমার পিছনে খামোখা টিকটিকি লাগিয়ে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার করল৷ আরে ঠিক আছে, জেরা করবি কর। সে ব্যাপারটায় একটা আলগা রোম্যান্স আছে বইকি। তা'বলে  স্যাট গ্রেপ্তার করার কী আছে? বাধ্য হয়ে বুকের ব্যথার রেফারেন্সটা দিতে হল৷

যাকগে, পার্টি ব্যাপারটা সামলে দেবে। আমায় নিয়ে তুমি ভেবোনা, ডাক্তার বলে গেছে আমার বুক চিনচিনটা সারাতে একমাত্র পথ্য হলো মাটনকষা আর বাসন্তী পোলাও৷ হাসপাতালে ক'দিন সে'সবই চলবে। সঙ্গে নেটফ্লিক্স।  জামিনের ব্যবস্থাটা হয়ে গেলেই  আবার ওই স্ট্যু আর ম্যানিফেস্টোতে ফিরে যাব'খন৷ আফটার অল ওয়েলথ ইজ হেলথ। 

তুমি সাবধানে থেকো। জনতার স্বার্থে, দেশের স্বার্থে; আমি শিগগিরই ফিরে আসছি৷ 

জয় হে। জয় হে। জয় হে।

ইতি,

সুমির আমি।

পার্লামেন্টারি



- দোলগোবিন্দবাবু!

- *ফুড়ুৎফুড় নাক ডাকার শব্দ*

- ও দোলগোবিন্দবাবু! এই যে! মিস্টার দোলগোবিন্দ গোলদার! 

- এই! কে! ডাকাত নাকি? এই পুলিশ ডাক! এই কেউ আমার ফলস দাতটা নিয়ে আয়। এই কেউ আমার বন্দুকটা নিয়ে আয়। আর ট্যাপা, সবার সমানে ফ্যাট করে বলে দিসনা এ'টা তোর খেলনা  রাইফেল!

- আপনার লজ্জা করেনা দোলগোবিন্দবাবু?

- অ্যা! ও, ওহ। সরি সরি! সরি ইওর অনার! আমি ভাবলাম ড...ডাকাত পড়েছে। তবে খামোখাই ভয় পেয়ে গেছিলাম মশাই। আমি তো আর চোরছ্যাঁচোর নই যে আমার মেজানাইন ফ্লোরে রাখা ডিভানের গদির পেটে কোটিকোটি কালোটাকা পোরা রয়েছে। আমার আবার ভয় কীসের।

- ইওর অনার আবার কী! আপনি মাঝেমধ্যেই নিজেকে কাঠগড়ায় দেখতে অভ্যস্ত তাই না? 

- ওহ, তাই তো। এ'টা তো পার্লামেন্ট। সরি। সরি। একটু চোখ লেগে এসেছিল তো। তাই গুলিয়ে গেছিল। যাকগে, বলুন স্পীকারবাবু।

- বলবেন আপনি। সে'জন্যই আপনাকে ডাকাডাকি।

- ওহ হো। আগের ভদ্দরলোকের ওই ভ্যান্তেরা শেষ হয়েছে এতক্ষণে? উফ, বাপ রে বাপ। কী বাজে কথা রে বাবা...।

- এ'খানে একটা ডেকোরাম আছে। এ'টা পরনিন্দাপরচর্চার জায়গা নয়। জরুরী ডিসকাশন চলছে। বিরোধী হিসেবে আপনার কী বক্তব্য আছে সে'টাই বলুন। প্লীজ স্টিক টু দ্য টপিক। 

- জো হুকুম ধর্মাবতার...।

- এই সেরেছে...।

- সরি। সরি। ধন্যবাদ স্পীকার মহাশয়। এ'বারে যা বলছিলাম...এই যে বিল নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে এত...। 

- দোলগোবিন্দবাবু...পার্লামেন্টে বসে ঘোঁতঘোঁত করে ঘুমোলে এই হবে। কিছুই তো জানেন না! জলঘোলা শব্দটা এ'খানে ব্যবহার করা নিষেধ।

- আজ্ঞে?

- নিষেধ।

- অ। তা ঠিক। তাই এ বিল নিয়ে এত কচকচি চলছে মশাই...।

- কচকচি? হাউ রিডিকুলাস। নাকচ।

- যাচ্চলে। যাকগে। এই বিল নিয়ে এই যে এত কেলোর কীর্তি...।

- আপনাকে আজ লাল কার্ড দেখতে হবে মশাই...।

- ধুত্তোর। যাক গে। আব্বুলিস। নতুন করে শুরু করছি। সরকারপক্ষ এই যে একটা বিটকেল বিল এনেছেন...। 

- এ'সব কী ভাষা? বিটকেল?

- আচ্ছা বেশ। রক্ষে করুন স্পীকারদাদা। এই যে  চমৎকার বিল পার্লামেন্টে আনা হয়েছে, তা'তে যে দশের এবং দেশের আখেরে ক্ষতি, সে'টা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? আমি একটা রিপোর্ট কোট করছি...।

- এই দাঁড়ান দাঁড়ান দাঁড়ান। ক্ষতি? ক্ষতি তো নেগেটিভ শব্দ। আনপার্লামেন্টারি। ও'সব চলবে না। 

- লে হালুয়া।

- ও'টাও চলবে না। লে হালুয়াও বাদ। আপনি কি পার্লামেন্টারি এটিকেটের বইটা বেচে দিয়েছেন দোলগোবিন্দবাবু?

- বেচে দেওয়া ব্যাপারটা বোধ হয় পার্লামেন্টারি, তাই না?

- সারকাজম ? ফের নাকচ।

- ধেরছাই ছাতার মাথা।

- ছাতা শব্দটা ঠিক ছিল। ছাতার মাথাটা অফেন্সিভ। ছাতার বাট দিয়ে আক্রমণ করা আয়। আপনার মতলব ভালো বুঝছি না দোলগোবিন্দবাবু।

- এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। 

- ঝামেলা। ফের আনপার্লামেন্টারি।

- বেশ। বুঝলাম। আমি একটা কথাই বলতে চাই। বিলটা দারুণ হয়েছে। এক্কেবারে অপূর্ব! এ'বার যথেষ্ট পার্লামেন্টারি হয়েছে কি?

- এইবারে একশোয় একশো পেয়েছেন।

Thursday, June 16, 2022

বুলেট দস্তিদারের গ্রেপ্তারি



ভীষণ নার্ভাস লাগছে। ভীষণ। এমন একটা বিপদে যে পড়তে হবে সে'টা ভাবিনি। এখন বেলা সোয়া বারোটা। সকাল দশটা থেকে অন্তত বারো গেলাস জল খেয়েছি তবু তেষ্টা কমার নাম নেই। এ'দিকে পেট ফুলে ঢোল, গা গুলিয়ে উঠছে, অন্তত বার সাতেক বাথরুম ছুটতে হয়েছে। হাবিলদার গোলক বটব্যাল মাঝেমধ্যেই ক্রিকেট স্কোর ঘোষণা করে হাড় জ্বালাচ্ছে। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, ও পড়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ফলোঅন নিয়ে, ধুরছাই। 

তান্ত্রিক অনুপ দত্ত থানায় ঢুকলে বেলা পৌনে একটা নাগাদ। দাঁত বের করে বললে, "সরি দারোগাবাবু, ঘণ্টাখানেক দেরী হয়ে গেল। আসলে এর আগের অ্যাপয়েন্টমেন্টের আত্মাটা মহা ঢিট। খেলিয়ে কাজ ম্যানেজ করতে গিয়ে বেলা হয়ে গেল"।  

মেজাজ চড়ে ছিল, দিলাম ধমক; "অনুপ, থানা থেকে আর্জেন্ট কাজে আপনাকে ডাকা হয়েছে। আপনি আমায় অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখাচ্ছেন? আপনি জানেন ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস"?

অনুপ দত্তের হাসি মিইয়ে গেল না। চেয়ার টেনে বসে বললে, "তেনারা কি আর পুলিশ-দারোগাকে ডরায় বলুন। নিজেদের মর্জির মালিক। তাঁদের তো আর পদে পদে ওপরঅলাকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। যাক গে, এত বেলা পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি। দু'টো চা নিমকির ব্যবস্থা করুন দেখি"। 

অনন্তকে ডেকে চা-ভাজাভুজি দিতে বললাম। সে'সব টেবিলে না আসা পর্যন্ত অনুপ দত্তকে কাজের কথায় টানা গেল না। চারটে পেঁয়াজি আর দু'টো আলুর চপ সাবাড় করে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনুপ অবশেষে উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকালে। 

আমি সোজাসুজিই বললাম, "ভারী ফ্যাসাদে পড়েছি অনুপ"। 

"নয়ত আর অনুপ দত্তকে ডাকবেন কেন বলুন। আমি তো আর কাশ্মীরি শালওলা নই যে শীতের দুপুরে ডেকে নিয়ে শখের দরদাম করবেন। নিন, কেসটা খুলে বলুন দেখি"। 

"বুলেট দস্তিদারকে চিনতে"?

"নতুনপাড়া সুপারস্টার্স ক্লাবের এক্স-সেক্রেটারি? সে'তো এ পাড়ার শারুক্কান ছিল মশাই। কী কেত ছিল। পাড়ার ফক্কর ছেলেছোকরারা বুলেটদা বলতে অজ্ঞান। চাঁদা তুলতে, বেপাড়ায় গিয়ে রঙবাজি করতে, মড়া পোড়াতে, হাসপাতালে রাত জাগতে; বুলেটের জুড়ি মেলা ভার ছিল। মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টটা সত্যিই আনফরচুনেট দারোগাবাবু। ও ছেলে বেঁচেবর্তে থাকলে পাড়ার নাম উজ্জ্বল করত। তা, ইয়ে, ওঁর আত্মাকে নামাতে হবে নাকি"?  

"হবে। আর্জেন্ট"। 

"সে কী! কেন"? 

"এমএলএ গগন সান্যালের জন্য"।

"এই সেরেছে। গগন সান্যালের হঠাৎ বুলেটের ভূতের দরকার পড়ল কেন"?

"তুমি কি কিছুই শোনোনি"? 

"আমি সাধক মানুষ। লোকের গালগল্পে তেমন মন দিইনা। বলুন না দারগোবাবু, কী ব্যাপার"? 

"আর বলো কেন অনুপ। হপ্তা-দুই আগে, এক শনিবার  সন্ধের পর। গগন সান্যাল নিজের বাড়িতে কী একটা পুজোফুজো দিয়ে গোটা পাড়াজুড়ে গুজিয়া বিলি করে বেড়াচ্ছিল। তা মিথ্যে বলব না, গগন সান্যালের সে এমন হামবড়া ভাব যেন সবার হাতে আড়াই কিলো সাইজের ইলিশ তুলে দিচ্ছে। দিচ্ছিস তো পাতিয়া গুজিয়া, তার জন্য একটা বড় তাসাপার্টি, নাচের দল আরও কত কী। নেহাত এমএলএ মানুষ, লোকে ভয়ভক্তি করে, তাই বড় একটা কিছু বলছিল না। গোল বাঁধল গুজিয়া প্যারেড নতুনপাড়া সুপারস্টার্স ক্লাবঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়। পাড়ার লোক অবাক হয়ে দেখল গগন সান্যালের চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে, হাত পা বেসামাল ভাবে নড়াচড়া শুরু করেছে। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গগন সান্যাল দু'কান চেপে চেল্লামেল্লি শুরু করেছে "শুয়ার বুলেটটাকে কেউ থামতে বল। থামতে বল"। 

"এত কিছু ঘটে গেল? আমি মাইরি বেশির ভাগ সময়ই সাধনায় মগ্ন থাকি কিনা। তাই জানতেই পারলাম না। তা, গগন সান্যালকে কি বুলেট দস্তিদার পাকড়াও করেছিল"? 

"ঠিক পাকড়াও নয়। সে মুহূর্ত থেকে নাকি একটানা গগন সান্যাল নিজের কানে বুলেটের কণ্ঠস্বরে বিচ্ছিরি সব খোঁটা শুনে চলেছে। আর সে সমস্ত খোঁটার সঙ্গে থাকছে একটা মর্মান্তিক নাম; গুজিয়া গগনা। আর এ'খবরটা কী'ভাবে যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। এখন পাড়ার সবাই গগন সান্যালকে গুজিয়া গগনা বলে ডাকছে।  প্রথমদিকে শুধু অপোনেন্টরাই আড়ালে-আবডালে বলে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। সে'দিন একটা মিছিলেও নাকি পার্টিরই একজন ওয়ার্কার বলে ফেলেছে, আমাদের নেতা গুজিয়া গগনাকে ভোট দিন, ভোট দিন। উত্তেজনার বশে বিরিয়ানির প্যাকেট ঘুষ খাওয়া পাবলিক চিল্লিয়ে ফেলছে গুজিয়া গগনার জন্য আমরা বুকের রক্ত দিতে পারি। গতকাল পাড়ার শিল্ড ফাইনালে কমেন্ট্রি করতে গিয়ে প্রফেসর ভোম্বল চাটুজ্জে অ্যানাউন্স করলে, "এ'বারে, বিজয়ী দলের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার জন্য আমি মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি, মাননীয় এমএলএ মহাশয় গুজিয়া গগনাকে! এমন কী ভদ্রলোকের তিন বছরের নাতিও নাকি আধো আধো সুরে বলছে "আম্মার দাদ্দু গুজ্জিয়া গগন্না"। আর এ'সব শুনে গুজিয়া গগনা, থুড়ি, গগন সান্যাল এক্কেবারে ফায়্যার"।

"কেসটা মর্মান্তিকই বটে। কিন্তু দারোগাবাবু, আমায় কী করতে হবে"?

"গুজিয়া গগনার দাবী...আরে ছি ছি...ছি ছি...আই মীন, গগনবাবু কড়া হুকুম...বুলেট দস্তিদারের ভূতকে নামিয়ে অ্যারেস্ট করতে হবে"। 

"ওই বুলেট দস্তিদার মহা বিটকেল ছেলে। ওকে ঘাঁটানো কি ঠিক হবে দারোগাবাবু"?

"শোনো অনুপ, ও'সব বাহানা আমি শুনছি না। এ বয়সে এসে সাসপেন্ড হতে পারব না। যে করে হোক তুমি বুলেট দস্তিদারের ভূতকে রাজি করাও হাজতবাস করতে। ওঁর যা যা ফেসিলিটি চাই, সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। কিন্তু ওকে একবার জেলে পুরতেই হবে ভাই অনুপ। আমি না শুনছি না। নয়ত এই গুজিয়া গগনা...আরে ধের ছাই...নিজের জিভ কেটে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে...শালা ট্রেটার টাং...আই মীন...নয়ত গগন সান্যাল আমার জীবনটা দেবে চটকে"। 

*** 

আমি দারোগা মানুষ। আমার বাড়িতে সময়ে অসময়ে ফোন আসবেই। ও'তে আমি ভেবড়ে যাইনা। কিন্তু এই ভোরবেলা ফোন তুলে গুজিয়া গগনা...থুড়ি...গগন সান্যালের ফোন শুনে সামান্য চমকাতে হল। ওঁর সেক্রেটারিকে দিয়ে ফোন করাননি, নিজে ডায়াল করেছেন। মনে হল থ্যাঙ্কিউ জানাতে ফোন করেছেন। 

বিগলিত সুরে বললাম, "গুডমর্নিং স্যার। গুড নিউজটা কাল রাতেই আপনার সেক্রেটারিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আশা করি পেয়েছেন"। 

"পেয়েছি। বুলেটের আত্মাকে কে নামালে"?

"আজ্ঞে, অনুপ। ভারী ট্যালেন্টেড তান্ত্রিক। ইয়ং কিন্তু এফিশিয়েন্ট। একদিন আপনার অফিসে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দেব। ভারী মাই ডিয়ার ছেলে"।

"বুলেটের আত্মাকে তোমরা জেলে পুরেছ"? 

"একদম। হিউম্যান হিস্ট্রিতে এই প্রথম একজন ভূতকে অ্যারেস্ট করা হল। আপনি ইতিহাসের পাতায় একজন মহানায়ক হয়ে থেকে গেলেন স্যার"। 

"মহানায়ক"?

"আজ্ঞে। কংগ্রাচুলেশনস স্যার"। 

"দারোগা, তোমার আর ওই অনুপ তান্ত্রিককে আমি জ্যান্ত কবর দেব"। 

"আ...আজ্ঞে"?

"তোমাদের চামড়া গুটিয়ে নেব"। 

"কী...কিন্তু...শুনুন..."!

"আজকের কাগজের হেডলাইন দেখেছ"? 

"ক...কোন কাগজ"? 

"যে কোনও কাগজের প্রথম পাতা খুলে দেখ। আমি বরং তোমার সাসপেন্সনের ব্যবস্থা করি গিয়ে"। 

ফোন রেখেই ছুটে গেলাম বসার ঘরে। কাগজ খুলে প্রথম পাতাটা টেবিলে ছড়িয়ে দিলাম। হতবাক হয়ে দেখলাম সেই কাগজ আলো করা হেডলাইনঃ

"ভূতকে হাজতে পুরে গিনেস বুকে নাম তুললেন বাংলার গর্ব গুজিয়া গগনা"!

Wednesday, April 20, 2022

বুলডোজার রাখাল আর মায়ের হারমোনিয়াম



১। 

- মিনিস্টার! একটা খবর ছিল..।

- দিস ইজ আনপার্ডনেবল চীফ।

- দেখুন মিনিস্টার, আমি যে কী বলব..।

- আপনাদের লজ্জা করে না? এত বড় একটা স্ক্যান্ডাল, এত বড় একটা সিকিউরিটি থ্রেট তৈরি হয়েছে স্রেফ আপনাদের ক্যাবলাকান্ত সিস্টেমের জন্য৷ আর এখন আপনি ভেবে পাচ্ছেন না যে কী বলবেন?

- আসলে গোটা ব্যাপারটাই এত মিস্টিরিয়াস..।

- তবে আর কী! দেশ গোল্লায় যাক। আর আপনারা, সেনাবাহিনীর কর্তারা; ব্যাপারটাকে মিস্টিরিয়াস বলে ঝাড়া-হাত-পা হয়ে ফুর্তি করুন। 

- দেখুন স্যার..। ব্যাপারটা সত্যিই ব্ল্যাক ম্যাজিকের মত..। 

- মাই ডিয়ার আর্মি চীফ গোবর্ধন গলুই৷ আমাদের ন্যাশনাল আর্মির গর্ব, আপনাদের দ্য গ্রেট বুলডোজার রেজিমেন্টের সমস্ত বুলডোজার কোনও রকম হিউম্যান ইন্টারভেনশন ছাড়া, নিজেরাই ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়েছে৷ শহর জুড়ে হাহাকার..অথচ আপনারা ক্লুলেস?

- দেখুন মিনিস্টার, এই বুলডোজারগুলো অত্যাধুনিক৷ আপনি তো জানেন, গতবছরই এ'রকম বারোশো ইউনিট কেনা হল৷ সেল্ফ ড্রিভেন, রিমোট কন্ট্রোলড৷ কিন্তু তাই বলে তাদের তো আর নিজস্ব মগজ নেই৷ আমাদের কন্ট্রোলরুম থেকে হিউম্যান ইন্সট্রাকশন না গেলে তাদের এক ইঞ্চিও নড়ার কথা নয়।

- বেশ৷ তাই যদি হবে তা'হলে কন্ট্রোল রুমের হুকুম ছাড়া সে বুলডোজারের দল ব্যারাক ছেড়ে বেরোল কী করে?

- সে'টাই তো..ইয়ে..মিস্ট্রি৷ 

- নিনকম্পুপ্স! অত সাধের সব ইম্পোর্টেড বুলডোজার, যা না-পসন্দ তা নিমেষে সাফ; সে'গুলো শেষে হাতছাড়া হল? আরে ও'গুলোর তো এখনও ওয়ারেন্টিই খতম হয়নি৷ আপনাদের কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিৎ! যাকগে, সে'সব সময়মত হবে'খন৷ আগে বলুন সেই গোলমেলে বুলডোজারগুলো এখন কোথায়? ওদের মুভমেন্ট ট্র‍্যাক করছেন আশা করি! সে ব্যাটারা কি নিজে নিজেই বস্তিটস্তি ভাঙা শুরু করল নাকি? অবশ্য ক্ষতি নেই তা'তে, কিন্তু মিডিয়াকে ডাকা হলো না যে৷ কভারেজ কম হবে। কেসটা কী?

- সে'টা রিপোর্ট করতেই এ'খানে এসেছি মিনিস্টার৷ 

- চটপট৷ নাটুকে সাইলেন্স আর সহ্য হচ্ছে না।

- সমস্ত বুলডোজার সারিবদ্ধ ভাবে, বেশ ডিসিপ্লিন নিয়ে এগোচ্ছে৷ কোনও বস্তি-টস্তির ধারেকাছে যায়নি।

- সে'কী! কোন দিকে এগোচ্ছে?

- ইয়ে..!

- চীফ গলুই, বুলডোজারগুলো কোনদিকে যাচ্ছে?

- যাচ্ছে না৷ মানে, ইয়ে৷ আসছে৷ 

- আসছে?

- এই এ'দিকে৷ জিপিএস তাই বলছে। 

- আ..আমাদের পার্টি আপিসের দিকে এগিয়ে আসছে?

- ই..ইয়ে..আসছে। 

- থামাও!

- কী বলি মিনিস্টার, থামছে কই! ইয়ে, একটা এমার্জেন্সি কল এসেছে মোবাইলে। 

- ফোনটা রিসিভ করে আমায় উদ্ধার করুন৷ দেখুন আর কী দুঃসংবাদ এলো৷

(মিনিট সাতেক পরে)

- মিনিস্টার! একটা ভাইটাল খবর। 

- কী?

- ব্যাপারটা খুব ইয়ে..ঠিক বিশ্বাসযোগ্য কিনা জানিনা৷ তবে আপনাদের এই পার্টি অফিসের বাইরে এক আধপাগলা লোক দাঁড়িয়ে হল্লা পাকাচ্ছিল। সে ক্লেম করেছে যে..।

- কী ক্লেম করছে?

- যে..যে সেই নাকি বুলডোজারদের ডেকে আনছে।

- হ্যামলিনের বুলডোজারওলা? ইয়ার্কি হচ্ছে?

- গোটা ব্যাপারটা এমনই ডার্ক আর গোলমেলে। কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আমার কম্যান্ডাররা ওকে  থার্ড ডিগ্রী দিচ্ছে, কিন্তু সে ব্যাটার হাসি থামানো যাচ্ছে না। 

- ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন৷ 

- কিন্তু মিনিস্টার..।

- ক্যুইক৷

***

২।

- পেন্নাম অনারেবল মিনিস্টার হলধর হসন্ত! হোয়াট অ্যান অনার!

- আপনাকে ওরা খুব মারধোর করেছে বুঝি? আই অ্যাম সরি৷ আমি কিন্তু জানতে পেরেই..।

- ও নিয়ে আপনি ভাববেন না স্যার৷ আমি এ দেশের গরীবমানুষ, জীবনটাই থার্ডডিগ্রী৷ ও'সব চিমটি কাটায় আমাদের কিছু এসে যায়না।

- আপনার নাম?

- গোবিন্দ গাইয়ে। 

- বাহ্, সুন্দর নাম৷ তা, গোবিন্দবাবু, চা খাবেন? বা লেবুর সরবত? কোল্ডড্রিঙ্কস? লস্যি?

- ইয়ে, ভাত হবে? 

- ভাত?

- ভাত৷ 

- নিশ্চয়ই৷ এখুনি আনতে বলে দিচ্ছি৷ আমাদের ক্যান্টিনের থালি খুবই ফেমাস৷ সতেরো রকম আইটেম থাকে৷ ম্যাসিভ একজোড়া রাজভোগসহ। 

- এক্সেলেন্ট৷ আটশো বিরানব্বুই প্লেট অর্ডার করে দিন প্লীজ৷

- আটশো বিরানব্বুইটা প্লেট?

- আজ্ঞে। একটা এ'খানে দিয়ে যাবে৷ আর আটশো একানব্বইটা ডেলিভার করবে বোসপাড়ার পিছনের বস্তিতে৷ গতকাল আপনাদের বুলডোজারগুলো সে'খানকার লোকজনদের বাড়িঘরদোর ভেঙেটেঙে দিল। কাজেই তাদের আজ রান্নাবান্নার পাট নেই৷ আপনার লোক যদি খাবার ডেলিভার করে দেয়, তা'হলে রাতটা নিশ্চিন্ত৷ 

- গোবিন্দবাবু, কাজের কথায় আসি..। বুলডোজার।

- ভাতটা বোধ হয় তেমন কাজের কথা নয়, তাই না?

-  শুনুন৷ আপনি আর্মির লোককে বলেছেন যে ওই বুলডোজারগুলোকে আপনি ডেকে এনেছেন?

- সর্বৈব সত্য৷ হসন্তবাবু, বুলডোজার তো যন্ত্র৷ মানুষের ডাক না পেলে তারা নড়বে কী করে?

- অতগুলো বুলডোজার আপনার ডাকে সাড়া দিলে? এ'টা গুল নয়?

- গুল হলে, আপনি কি আমার ডেকে ভাত খাওয়াতেন?

- বুলডোজারগুলো আপনার ডাকে সাড়া দিচ্ছে? কেন?

- গতকাল আপনাদের বুলডোজার রেজিমেন্ট আমাদের পাড়ায় এলো বুঝলেন। হুলোর বাড়ি ভাঙলো সবার আগে। আমি পাত্তা না দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে পল্লীগীতি গাইছিলাম। তারপর মিনুর বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেল। আমি ধরলাম নজরুল। একে একে মধু, সেলিম, গুপে আর আরও কত মানুষের ঘর ভাঙল। বিশ্বাস করুন, আমি সে'সব ছোটখাটো ব্যাপারে পাত্তা না দিয়ে আমার হারমোনিয়াম নিয়ে দিব্যি ছিলাম। এমন কী আমার ঘরও যখন ভাঙতে এলো, আমি দিব্যি 'এক্সকিউজ মি' বলে পাশ কাটিয়ে, হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে; বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে আমি গজল ধরেছি৷ আহা, সে কী প্রেম প্রেম ভাব৷ 

- তারপর?

- আমার গান আপনার বুলডোজার রেজিমেন্টের কম্যান্ডারদের সহ্য হল না৷ কোনও মানে হয় বলুন? তাঁরা স্রেফ হাহাকার শুনতে চায়, তাঁদের কানে গান সইল না। আমার হারমোনিয়াম ছিনিয়ে নিয়ে চলন্ত বুলডোজারের সামনে ফেলে দিলে৷ ব্যাস, সাফ৷ আমার বারণ শুনলে না। তারপর তাঁরা আমায় বেধড়ক পেটালে, বুঝলেন৷ এক্কেবারে তলপেটে ভারী বুটের লাথি৷ দে দমাদম৷ অজ্ঞান হয়ে গেলাম৷ জ্ঞান ফিরল এক্কেবারে ভোরের দিকে৷ সামনে আমার মায়ের রেখে যাওয়া হারমোনিয়াম গুঁড়ো হয়ে পড়ে৷ কিন্তু কী অদ্ভুত, গায়ে বিন্দুমাত্র ব্যথা নেই৷ আর..আর আমি দিব্যি টের পেলাম আমার মায়ের হারমোনিয়াম ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার আগে আমার মধ্যে ম্যাজিক ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

- ম্যাজিক?

- আমি অনুভব করতে পারলাম হলধরবাবু৷ টেস্ট করার জন্য মনে মনে একটা বুলডোজারকে ডাকলাম৷ ও মা, পাক্কা দশ মিনিটের মধ্যে একটা বুলডোজার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, সে'টার মধ্যে থেকে একটা মিঠে যান্ত্রিক গোঙরগো শব্দ বেরোচ্ছে৷ ঠিক যেন একটা পোষা ভেড়া৷ ব্যাস, বাকি বুলডোজারদের ডেকে নিলাম। আর এখন তাদের চরিয়ে বেড়াচ্ছি৷ মিউজিশিয়ান থেকে রাখাল হয়ে গেলাম স্যার। 

- গোবিন্দবাবু! বুলডোজারদের আটকাতেই হবে!

- তারা রক্তের স্বাদ পেয়েছে মিনিস্টার হসন্ত৷ আর হারমোনিয়াম হত্যার পাপ তাদের হিংস্র করে তুলেছে৷ এ'বার নিস্তার নেই৷ 

- প্লীজ, শুনুন আপনি..।

- ওই যে, মন্টুসোনার গোঙরগো আওয়াজ পাচ্ছি। আপনি শুনতে পাচ্ছেন মিনিস্টার?

- মন্টুসোনা? মন্টুসোনা কে?

- ওই প্রথম যে বুলডোজার আমার কাছে এসে নত হয়েছিল৷ বড় আদর করে নাম রেখেছি৷ তা, সে এসে পৌঁছেছে আপনার অফিসে৷ যাকগে, একটা গজল শুনবেন হলধর হসন্ত?

Friday, April 15, 2022

১৫২৯



- শুভ নববর্ষ ভায়া৷ 

- উফ, এই তুমি পিলে চমকে দেওয়া বন্ধ কর মাইরি৷ আরে বাবা আত্মা বলে কি নক করতে নেই? মিনিমাম ভদ্রতা না জানলে চলবে কেন? দুম করে শোওয়ার ঘরের ইজিচেয়ারে এসে বসাটা জাস্ট অসভ্যতা নয়?

- তুমি ভাই জ্ঞান দেওয়া বন্ধ করো৷ মড়াটি হয়েও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছ, নলিহাড় চিবিয়ে ছাতু করছ, হপ্তায় তিনদিন রেস্টুরেন্ট ঘুরে ঘুরে প্রেম করছ; আর আমায় দ্যাখো৷ পয়লা বোশেখের দিনে ফ্যাফ্যা করে এ'দিক সে'দিক উড়ে বেড়াচ্ছি৷

- শরীর বয়ে বেড়ানোর ঝামেলা তো পোয়াতে হচ্ছেনা তোমায়৷ সংসার রোজগারের টেনশনও নেই৷ ফুড়ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াও, গান গাও আর আমার কানের কাছে এসে টিপ্পনী ঝাড়ো। তোমারই তো সুখ ভাই৷

- আর কদ্দিন আমায় বাইরে ফেলে রাখবে বলো৷ তুমি তো আর অক্কা পাওনি৷ খামোখা আমায় সাইড করে এমন জম্বি হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে কী লাভ৷ 

- এই শুরু হলো৷ বলি জ্ঞান দেওয়া শেষ হলে মানে মানে কেটে পড়ো৷ আমি লুচি তরকারি খাবো৷ শেষপাতে ক্ষীরকদম৷ 

- আমায় ফিরিয়ে নাও ভাই৷ আত্মা-লেস হয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো৷ খাওয়াদাওয়া, মাইনে, দশ রকমের বারফাট্টাই; এ'সব করে আর কদ্দিন? ফ্রি উইল তো নেই৷ তুমি তো বাঁধা পড়ে আছো৷ কন্ট্রোলড বট! আমায় ফিরিয়ে নাও৷ বছরটা সত্যিই শুভ হোক।

- গেট আউট।

- তোমার চোখে আমি লোভ দেখতে পারছি ভাই৷ আত্মাকে আত্মস্থ করার লোভ৷ আমায় ফিরিয়ে নেওয়ার লোভ৷ প্রাণ খুলে গান গাওয়ার লোভ৷ গলা হেঁচড়ে প্রতিবাদ করার লোভ৷ ফিরিয়ে নাও না ভাই!

- নিকলো ইহা সে৷ ব্যাটাচ্ছেলে রাস্কেল! বেরোও!

**

- কী ব্যাপার হৃদয়হরণ? এমন হন্তদন্ত হয়ে..কিছু হয়েছে?

- আজ্ঞে, সবার আগে বলি নেতাবাবু ; শুভ নববর্ষ।  

- গোটা বছরটাই শুভ হে৷ দেশজুড়ে অপার শান্তি৷ দেশের প্রতিটা মানুষ আমাদের সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ সবাই সর্বক্ষণ গদগদ হয়ে আমার কথা ভেবে আমায় এবং সরকারের অন্য নেতানেত্রীদের কথা ভেবে মনে স্যালুট ঠুকে চলেছে৷ এমন সোনার সংসার, এমন হাইক্লাস ফাংশনাল ডেমোক্রেসি; শুভ না হয়ে উপায় কী বলো৷ 

- আজ্ঞে, সে তো বটেই৷ শুধু এই সোনার সংসারে একটা সামান্য খোঁচা৷ 

- সে কী! কার এত দুঃসাহস? 

- আজ্ঞে, কলকাতার সাত নম্বর মদন মল্লিক স্ট্রিটের ভবেশ দত্ত৷ 

- পাতি লোকের খবরে আমার কী কাজ ভাই হৃদয়হরণ?

- লোকটা পাতি৷ তবে তাঁর আত্মাটা মহাছ্যাঁচড়া৷ মাঝেমধ্যেই ভবেশ দত্তর আত্মা ওর বডিটকে এসে উস্কে যাচ্ছে৷ আজ  পয়লা দেখে সকাল সকাল এসে হানা দিয়েছিলে৷ আত্মা বডিতে ঢুকতে চাইছে৷  ভবেশ দত্তর বডিও রেস্পন্ড করতে শুরু করেছে৷ 

- আত্মা বডিতে ঢুকতে চাইছে? বডি নরম হয়ে আসছে? কী সর্বনাশ! তা'হলে সরকারকে দিনে বাহাত্তরবার স্যালুট ঠুকবে কে? আজ এক ভবেশ দত্তর আত্মা বিট্রে করছে৷ কাল গোটা কলকাতা৷ পরশু গোটা দেশ৷ সমস্ত বডি তারপর আত্মা ফিরে পেয়ে নাচুক আর কী! তারপর ফের রাস্তায় প্রতিবাদ, সোশ্যাল মিডিয়ায় হইহই৷ সরকার ডকে তুলতে চাও হৃদয়হরণ? 

- আজ্ঞে, সে'টা রিপোর্ট করতেই আসা। তা'হল কী..।

- ভবেশ দত্তর আত্মা যাতে ফেরার জন্য বডি না পায় সে ব্যবস্থাই করো হে৷ পলিটিকাল প্রটেস্টের মামদোবাজি আর সহ্য হবে না৷

- যো হুকুম ভাগ্যবিধাতা। যো হুকুম৷ ভবেশ দত্তের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলছি৷ তবে ইয়ে..।

- আবার কী..।

- নববর্ষের দিনে৷ যদি অভয় দেন, একটা আর্জি ছিল..।

- আর্জি? 

- আজ্ঞে, আত্মা হিসেবে আমি তো আর ভবেশ দত্তর আত্মার মত বেআক্কেলে নই। তবে একটা বিশ্রী শখ..।

- শুনি৷

- কদ্দিন শরীরের মধ্যে সেঁধিয়ে পৃথিবীটাকে দেখিনা৷ আমিও তো, আপনারই মধ্যে ছিলাম। অন্তত যদ্দিন না আপনি সরকারের মাথায় এসে বসেছেন৷ তদ্দিন তো..। আত্মা হিসেবেও আমি ক্ষয়ে গেছি৷ আমার দ্বারা প্রতিবাদটাদ আর হবে না৷ তাই, আজকের দিনটা কি আপনার মধ্যে ঢুকে যাব? একটু কবিতাটবিতাই পড়ব না হয়। ছোট ছেলেমেয়েদের দেখলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেব। সন্ধ্যেবেলা ছাতে বসে চা-মুড়ি খাব। শুধু এই নববর্ষের দিনটা! সুযোগ দেবেন? আমি তো আর অন্য কেউ নই৷

- তোমার ওপর আমার মায়া একটু আছে হৃদয়হরণ! একটু আছে৷ 

- চান্স দেবেন তা'হলে?

- তুমি এ'খানে একটু দাঁড়াও৷ আমি ভিতরের ঘর থেকে একটা জরুরী কাজ সেরে আসি৷ তারপর তোমার একটা হিল্লে করা যাবে। কেমন?

- যেয়াজ্ঞে৷ 

**

বহুক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন নেতা ঘরের বাইরে বেরোলেন না, আত্মা হৃদয়হরণ উশখুশ করে উঠলেন৷ বেলা বয়ে যাচ্ছে, অনেক কাজ পড়ে৷ দু'একবার হাঁক দিয়েও কোনও সাড়া পেলেন না৷ তবে আত্মাদের বেজায় সুবিধে, দরজা-টরজার মত ঠুনকো বাধায় আটকে যেতে হয়না৷ একরাশ হাওয়া হয়ে হুশ করে নেতার ঘরে ঢুকে পড়লেন হৃদয়হরণ।  দেখলেন, নিজের সুপরিচিত দেহটা সিলিংফ্যান থেকে ঝুলছে৷