Sunday, May 29, 2022

পুজোবার্ষিকী আর আইপিএল



বছর কুড়ি আগে আচমকা পুজোসংখ্যায় আগ্রহ কমে গেছিল। বছরভর অপেক্ষা করে থাকা, তারপর খান পাঁচেক বিভিন্ন পুজোসংখ্যা সংগ্রহ করে ধীরসুস্থে পড়ে ফেলা। মাস দুয়েক ধরে রসিয়ে প্রতিটা গল্প উপন্যাস কমিক্স উপভোগ করা। বেশ মনোগ্রাহী একটা প্রসেস ছিল সেই ছেলেবেলায়৷ প্রায় একটা বাৎসরিক উৎসব। কিন্তু হুট করে আগ্রহ কমে গেল৷ ভ্যাকিউম তৈরি হল।

এরপর এলো আইপিএল। এক্কেবারে জমজমাট প্যাকেজ, বছর বছর দিস্তেদিস্তে পুজোর লেখা পড়ার মতই একগাদা ক্রিকেট ম্যাচ, পরপর-প্রতিদিন, মাস দুয়েকের কার্নিভাল।  খেলার মাঠ থেকে ফিরে আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোরভারতীর ওপর উপুড় হয়ে পড়ার মতই রোজ অফিস ফেরতা ক্রিকেট দেখতে বসা। 

এই সাত-আট হপ্তায় খানিকটা ঘোর মিশে থাকে। কোন দল কেমন খেলছে; কারা চমকে দিচ্ছে, কারা ধ্যাড়াচ্ছে। ফ্যান্টাসি টীমে কাকে রেখে কাকে ভুলতে হবে। টুক করে অফিসের আড্ডায় তর্ক, বাসে-ট্রামে স্কোর আদানপ্রদান। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ মিস করা যাবে না, কাজেই দু'একটা সন্ধ্যের কাজ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মজবুত কাল্পনিক কৈফিয়ৎ তৈরি করে রাখা৷ আর দু'একটা হোয়্যাটস্যাপ গ্রুপে ঠিক এই মাসখানেক ধরে দেখা যায় 'হাইভোল্টেজ স্পার্ক''। আইপিএলের একটা মস্ত সুবিধে হল আমার মত গাম্বাট ক্রিকেট-মগজ মানুষেরও জোর গলায় মতামত দেওয়ার সাহস থাকে। ঠিক যেমন পুজোসংখ্যা পড়ে বলতে কচিবয়সেও ঘ্যাম নিয়ে বলে দিতাম, "খারাপ না। তবে এ'বার কিন্তু কাকাবাবু অতটা জমাতে পারেনি। জোজো জাস্ট বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে"। কাজেই সে'সব হোয়্যাটস্যাপ আইপিএল আড্ডা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে বইকি।

যা হোক। পুজোর মাসখানেক আগে থেকে পড়া শুরু হত। ওই লক্ষ্মীপুজো নাগাদ শেষ হত পুজোবার্ষিকী ম্যারাথন।  আর ছেলেবেলায় প্রায় প্রতিবারই আমি শীর্ষেন্দুর উপন্যাসটা রেখে দিতাম এক্কেবারে শেষবেলায় পড়ব বলে। সেই শেষ উপন্যাস শুরু করেই একটু মনকেমন হত। ছুটি শেষ, ছুটির দুপুর-সন্ধের গল্প-কমিক্স পড়া শেষ। সেই মন-ভালো-করা রুটিনে ফিরতে আবার বছরখানেকের অপেক্ষা। আইপিএলের ফাইনাল দেখতে বসেও প্রতিবার মনের মধ্যে ওই খুচরো একটা মাইনর-বিজয়া-লেভেল মনখারাপ তৈরি হয় বটে। দু'মাস ধরে তৈরি হওয়া একটা সিস্টেম উপড়ে ফেলতে হবে তো, সে এক যন্ত্রণা। আর একবছরের অপেক্ষা ছাড়া কোনও গতি নেই। 

আইপিএল এই ধেড়ে বয়সের পুজোসংখ্যাই বটে।

Thursday, May 26, 2022

গুলচন্দ্র গোলন্দাজ বনাম গুলশাহেনশাহ গুলগুলি



'অন্দাজ অপনা অপনা'র সেই অনাবিল দৃশ্য। 
অমর আর প্রেম দু'জনেই এন্তার গুল দিচ্ছে, প্রাণপণে যাতা বলে চলেছে৷ গুলের গণ্ডার মরে কাঠ আর বাতলের ভাণ্ডার সাফসুতরো৷ সবচেয়ে বড় কথা দু'জনেই বুঝতে পারছে যে দু'জনেই গুলবাজ; "আমি যেমন গুলচন্দ্র গোলন্দাজ, অন্যজনটিও গুলশাহেনশাহ গুলগুলি"৷ সেই সিনেমারই ভাষায় বলতে গেলে, দু'জনের মনের মধ্যেই ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে এক কাব্যিক উপলব্ধিঃ; "শালা! ম্যায় ভি ফেকু অউর ইয়ে ভি ফেকু"।

কিন্তু কেউই পিছু হটছে না৷ ক্লান্ত হচ্ছে না৷ লজ্জায় পিছিয়ে আসছে না৷ বরং গুলের তেজ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে৷ ও'দিকে গল্পের গরু ইউক্যালিপটাস গাছ পেরিয়ে মনুমেন্টের ডগায় পৌঁছে জর্দা পান চিবোয়৷ এ'রকম পরিস্থিতি শুধু বলিউডি কমেডিতেই থাকে ভেবেছেন? আদৌ নয়৷ 

অফিস মিটিংয়ে ভোম্বলদার বস তার টীমমেম্বারদের মোটিভেট করতে চেয়ে ফস করে একটা খটমট জার্গন বলে ফেললেন। বলে ফেলেই মনে মনে জিভ কাটলেন এই ভেবে যে একটা ফালতু কথা বেরিয়ে গেল যার না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু৷ কিন্তু রণেভঙ্গ দেওয়া অ্যাটিচিউড নিয়ে টীমলীডার হওয়া যায়না৷ অতএব জান লড়িয়ে দিলেন বস, নিজের গুল-জারগনকে নব-জাগরণের সূত্র হিসেবস প্রমাণ করতে চেয়ে। ভোম্বলদাও মহাসেয়ানা। বসের স্লিপ অফ টাং দিব্যি ধরতে পেরেও চেপে গেল৷ প্রমোশনের মায়া বড় মায়া আর প্রমোশন দেনেওলাদের খোঁটা দেওয়া মানে নিজের মুখে দু'চামচ পেট্রোল ঢালার পর সিগারেট ধরানো। কাজেই বসের মুখ ফসকে বলা কর্পোরেট-গুলকে অমৃতবাণীর লেভেলে টেনে তুলতে জান কবুল করলেন ভোম্বলদা। 

ভোম্বলদার বস জানেন তিনি গুল দিয়ে ফেলেছেন৷ তিনি এও জানেন যে ভোম্বলদা সে গুল ধরে ফেলেছে৷ ভোম্বলদাও টের পাচ্ছে যে বস জানেন যে ভোম্বল দত্ত খচ্চরশ্রেষ্ঠ। কিন্তু দু'জনে আধঘণ্টা আলোচনা চালাবেন এমন ভাবে যেন বস হলেন রামকৃষ্ণ আর ভোম্বলদা আজ বিকেলেই শেয়ালদা থেকে শিকাগোর ট্রেন ধরবে৷ সে আলোচনায় যেমন ধার, তেমনি ঘ্যাম৷ 

বস বলছেন, "কেমন দিলাম হে ভোম্বল"? 
ভোম্বলদা বলছেন, " কী ভাবে পারেন এমন পার্লস অফ উইসডম এত কেয়ারলেসলি ছড়িয়ে দিতে"?
বস বলছেন, "ভাবতে পারো কী সাংঘাতিক ডেপথে গিয়ে বলেছি"?
ভোম্বলদা মাথা নাড়ছে, "গতকাল ইউটিউবে বিল গেটসের টেডটক শুনছিলাম৷  এ'রকমই বলতে চাইছিল৷ তবে আপনার মত ক্ল্যারিটি ছিল না"।

দিনের শেষে, যখন গুলগুলিস্তানের উৎসাহ স্তিমিত, তখন বসের মনে সামান্য সন্দেহ দানা বাঁধবে, " সত্যিই কি ভুল বলেছিলাম? না বোধ হয়৷ দামী কিছুই বলে ফেলেছি হয়ত। নয়ত ভোম্বল অত শার্প ছেলে, সে কিনা বলদের মত মাথা নেড়ে গেল"। আর লোকাল ট্রেনে ঝালমুড়িওলার ধাক্কা খেতে খেতে ভোম্বলদা হয়ত টের পাবে, "নাহ্, বস মানুষটার অতশত ডিগ্রী৷ কত হাজার বছরের এক্সপিরিয়েন্স৷ যা বলেছেন ভালোই বলেছেন নির্ঘাৎ।  আমারই বুঝে উঠতে সময় লাগছে"। 

ভাবছেন এ সিচুয়েশন শুধু অফিস আর সিনেমাতেই থাকবে? কভি নহি।

পকেট গড়ের মাঠ৷ এ'দিকে দ্যাবা বলছে সামনের মাসে পাহাড়, দেবী বলছে সমুদ্র৷ ধুন্ধুমার তর্ক৷ প্রায় রক্তারক্তি ব্যাপার৷ কেউই পিছু হঠবে না৷ দার্জিলিং বনাম পুরী; সে এক বিশ্রী আগুন৷ অথচ দু'জনেই জানে যে বসিরহাটে পিসির মেয়ের বিয়েতে যাওয়ার খরচটুকুও জোগাড় করা যাবে না৷ তবু তর্কের ঝাঁজ কমবে না৷ সেই ঝাঁজটুকুতেই বলভরসা। আবার ধরুন দু'জন ব্যর্থ ভালোবাসাবাসির মানুষ। তাদের আর পাশাপাশি এসে বসা হলো না৷ হাত টেনে ধরা হলো না৷ বিপদেআপদে 'আমি আছি তো' বলে জাপটে ধরা হলো না; কোনওদিন সে সুযোগ হবেও না৷ তবু, তাদের গল্পের আকাশকুসুম কমার নয়। আর সেই আকাশকুসুমটুকু থেকে যাবে বলেই হয়ত এই পৃথিবীটা নির্দ্বিধায় ঘুরে চলেছে। 

Thursday, May 19, 2022

বংপেনের পনেরো বছর



পনেরো বছর আগে, ঠিক আজকের দিনে (১৯শে মে, ২০০৭) বংপেনের প্রথম 'পোস্ট' 'পাবলিশ' হয়েছিল৷ লেখালিখির মানুষ নই আদৌ, আগ্রহ ছিল ব্লগ ব্যাপারটাকে বোঝার৷ অমন টপ করে নিজের ওয়েবসাইট খুলে বসা যায়৷ যা খুশি লেখা যায়, ছবি আপলোড করা যায়৷ ব্যাপারটা রীতিমতো থ্রিলিং মনে হয়েছিল৷ তখন আমি সামার ইনটার্নশিপ করতে কলকাতায়৷ মাস দুয়েকের জন্য সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের পুরনো মেসবাড়িতে ফিরে গেছি৷ সেই সময়ই এই আগ্রহটা দানা বাঁধে আর সূর্য সেন স্ট্রিটের একটা সাইবার ক্যাফেতে বসে ব্লগারে রেজিস্টার করি৷ প্রথমে ভেবেছিলাম ইংরেজিতে লিখব৷ পরীক্ষার খাতার বাইরে একদমই বাংলায় লেখার অভ্যাস ছিল না৷ ওই যে বললাম, উদ্দেশ্য ছিল ব্লগ ব্যাপারটাকে বোঝার৷ ব্লগের বিষয় কী হবে, সে'খানে কী থাকবে; সে'সব ভাবনা নেহাতই অপ্রয়োজনীয় ছিল৷ 

বাংলা ব্লগের সংখ্যা তখন নেহাতই হাতে গোনা৷ কিন্তু তদ্দিনে অনেকেই ইংরেজিতে ব্লগ লিখতে শুরু করেছেন৷ আর সে'সব লেখা খুঁজেপেতে পড়তে বেশ লাগছিল৷ মিডিয়ামটা যে ছাপার থেকে একটু স্বতন্ত্র, পাঠক হিসেবে সে'টা বুঝতে অসুবিধে হয়নি৷  তখনও আমরা ফেসবুক ট্যুইটার দেখিনি, ছিল সবেধন নীলমণি অর্কুট। অর্কুটের স্ক্র‍্যাপ ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত ছিল; ওয়ান-টু-ওয়ান প্রসেস৷ ব্লগ তা নয়৷ সে'খানে বহু মানুষ নিজের চিন্তা,ভাবনা, লেখালিখি সাজিয়ে নিজের মনের মত জার্নাল তৈরি করছেন৷ সে ব্যাপারটা যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই খোলামেলা৷ যাদের প্রাক-ফেসবুক-ইন্টারনেট-যুগের স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে (বা ছোটরা যারা সে সময়টা দেখেইনি), তারা সেই প্রথম ব্লগ দেখার 'উরিব্বাস' অনুভূতিটা ঠিক ধরতে পারবেন না৷

আমার চিরকালই ধারণা ছিল অলিখিয়ে মানুষদের নিজের লেখা ফলাও করে লোক হাসানো উচিৎ নয়৷ কিন্তু ইন্টারনেট একটা অদ্ভুত স্পেস দিল নির্লজ্জ হওয়ার৷ খারাপ লিখি, বেশ করি; কারুর কপালে বন্দুক রেখে তো পড়তে বলছি না৷ লিখেই দেখিনা৷ 

আমি সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম নিজের ব্লগকে নিজের মত সাজাতে পারার ব্যাপারটায়৷ বরাবরই আমার হাতের লেখা ভয়াবহ৷ গভীর প্রেমে পড়েও নিজের হাতে চিঠি লেখার দুঃসাহস কোনওদিন হয়নি৷ কিন্তু ব্লগে সে দুশ্চিন্তা নেই। লেখার বিষয় কাগের ঠ্যাং হোক, লেখার কোয়ালিটি বগের ঠ্যাং হোক; আমি মনের মত ফন্ট বেছে নিতে পারি৷ ইচ্ছে মত মাস্টহেড ঠিক করা যায় (বহুদিন একটা কাকের ছবি আমার ব্লগের মাথায় ছিল, কেন সে ছবি বেছে নিয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই)৷ ব্লগের রংচঙও ইচ্ছে মত বদলে নেওয়াই যায়৷ গোটা প্রসেসটা যে কী ভালো লেগেছিল৷ তাই ভাবলাম ব্লগ একটা খুলেই ফেলি৷ নিজে লিখব, নিজেই পড়ব, আর নিজেই নিজের ব্লগকে ক্রমাগত কাস্টোমাইজ করে যাব। ক্লাস ইলেভেনে উঠে প্রথমবার রোডর‍্যাশ কম্পিউটার গেমটা খেলে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, ব্লগ আবিষ্কারেও সম্ভবত আমি সে আনন্দই পেয়েছি। 

তা, ব্লগ শুরু হলো গুগলের ব্লগারে। অন্য কোনও প্ল্যাটফর্ম চিনতামও না৷ কী মনে করে ঠিক করলাম ইংরেজিতে নয়, বাংলাতেই লিখব৷ তবে রোমান হরফে৷ তখনও অভ্র সম্বন্ধে সচেতন হইনি৷ আর বাংলা ওয়ার্ডে লেখার চেয়ে ডালভাতের সঙ্গে স্টোনচিপস ভাজা চেবানোও সহজ মনে হত৷ কাজেই একটা গোলমেলে বাংরেজি মার্কা শুরু৷ সেই পাঁচমেশালি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় বংপেন নামটা বেছে নেওয়া৷ বছরখানেক পর শুরু করি অভ্রতে বাংলা লেখা।

আর পাঁচটা মানুষের মত আমারও মনের মধ্যে অনেক হুজুগ আসে, আবার ফাঁকতালে কেটেও পড়ে৷ আর সত্যি বলতে কী; হাল ছাড়ার ব্যাপারে আমার জুড়ি মেলা ভার৷ তা'ছাড়া কত মধ্যবিত্ত ভয় আর লজ্জা মনের মধ্যে আছে৷ কোনও কিছু করতে নেমেই মনে হয়ে, "এহ হে, লোকে হাসবে"। বা "কী দরকার, এ দিয়ে আখেরে কিছু হবে কী", এমন কতশত ভয়৷ এমনি'ভাবেই কত শখ ভেসে যায়৷ এহেন মানুষ হয়ে, একটা কথা ভাবতে কিন্তু বেশ ভালো লাগে; যে এদ্দিনেও ব্লগটা ছেড়ে দিইনি৷ বংপেন ডট নেট৷ ও'টা সত্যিই আমার "এলাকা"৷ লোক হাসানোর ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া সে'খানে নেই৷ সবচেয়ে বড় কথা, ওই একটা ব্যাপারে আমি আজও 'রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট' ভেবে নার্ভাস হইনা৷ বাথরুমের গান আর ব্লগের লেখা, এ'দুটো ব্যাপারে পিছপা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই স্পেস শুধুই আমার৷ নিজের ব্লগে (ফেসবুক পেজ নয়, আদত ব্লগটা) আমি নিয়মিত (রোজ) ঢুঁ মারি৷ পড়ি, পুরনো ভুল শুধরে নিই, ছবি পাল্টাই, ফন্ট এ'দিক ও'দিক করি, ট্যাগগুলো ঝালিয়ে নিই৷ এই গোটা প্রসেসটা আমার মনের ঝুলবারান্দা, আত্মার বিরিয়ানি৷ আর একবার বলি, বড় ভালো লাগে এই ভেবে যে এমন একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছি যে'খানে ইচ্ছেমত কেরদানি ফলানো যায়৷ জায়গাটা ডিজিটাল কিন্তু ছোঁয়াও যায়৷ 

একটা ব্যাপার না জুড়লেই নয়৷ লিখতে লিখতে হাজার রকমের দোষ বেরিয়ে এসেছে, সে'গুলো অত্যন্ত সহৃদয়ভাবে ধরিয়ে দিয়েছেন এবং শুধরে দিয়েছেন মানুষজন৷ বংপেনের পাঠকরাই মোটামুটি ঠুকেঠাকে চালিয়ে দিয়েছেন এই ব্লগটাকে৷ বানান শুধরে দেওয়া, টাইপো দাগিয়ে দেওয়া, লেখার ভুল ধরিয়ে দেওয়া; সবচেয়ে বড় কথা, পিঠ চাপড়ে দেওয়া৷ তাঁদের যোগানো দুঃসাহসের ভরসাতেই মনে হয়েছে, আর একটু লেখাই যায়৷ বংপেনের সূত্রে, এই পনেরো বছরে কত কিছু শিখেছি৷ কত ভালো বই, সিনেমা, খাবারদাবারের সাজেশনে সমৃদ্ধ হয়েছি৷ সবচেয়ে বড় কথা, ঢিমেতালে হলেও আমার মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসাটা ক্রমশ বেড়েছে৷ এই যে নিয়মিত বাংলা লিখছি, সে অভ্যাসটাও তৈরি হয়েছে স্রেফ এই বংপেন ছিল বলে। কৃতজ্ঞতা প্রসঙ্গে একটা জরুরী কথা না বললেই নয়৷ বংপেন ব্লগটা না থাকলে কিছু জরুরী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগই হত না৷ 

বংপেন আদৌ কোনও জার্নাল নয়৷ তবে ব্লগের প্রতিটা লেখার সঙ্গেই কোনও না কোনও স্মৃতি জুড়ে আছে৷ হয়ত কোনও পরিচিত মানুষের কথা বলার স্টাইল, কোনও সুপরিচিত জায়গার গন্ধ, কোনও প্রিয় সিনেমার সিচুয়েশন, কোনও হঠাৎ মনে পড়া ঠাট্টা বা মনখারাপ৷ কাজেই কতশত খাজা লেখাও স্রেফ সেই নিজের রকমারি স্মৃতির সঙ্গে আবছা যোগাযোগের জন্য আমার কাছে জরুরী হয়ে রয়ে গেছে৷ আজকাল একটা ইচ্ছে জোরালো হচ্ছে; আমার ছেলে বড় হয়ে বাপের আগডুম-বাগডুম লেখাগুলো পড়বে আর সে'সব লেখায় সেঁধিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো ডিকোড করে আনন্দ পাবে৷ হয়ত মাঝেমধ্যে মুচকি হাসবেও। 


Tuesday, May 17, 2022

সোনপাপড়ি পিউরিটানের ব্যথা

ওর ওপর ভীষণ বিরক্ত বোধ করছিলাম৷ একটা পেল্লায় বাক্স সোনপাপড়ি এনেছে, ভালো কথা৷ সোনপাপড়ি খুবই ভালো জিনিস৷ অনায়াসে আইপিএলের চার-ছয়-উইকেটের তালে তালে উড়িয়ে দেওয়া যায়৷ কাজেই সে জিনিস এনে ভুল করেনি৷ ভুল করেছে একটা বিশ্রী ফ্লেভার নিয়ে এসে৷ এলাচ ফ্লেভারের সোনপাপড়ি! এর কোনও মানে হয়? 

প্রথম কামড় দিয়েই টের পেলাম গোলমালটা৷ ফুরফুরে সোনপাপড়ির সেই পিওরিটিটাই নেই৷ আরে সবকিছুতে রিমিক্স রিমেক ঝঙ্কার বিটস বা আনপ্লাগড ব্যাপারস্যাপার আনলেই হল নাকি? এক কামড়েই জিভটা কেমন যেন হয়ে গেল৷ ধুস৷ গোটা চার পিস খাওয়ার পর টের পেলাম যে মেজাজটাই গেছে ছাই খিঁচড়ে৷ অগত্যা ঢকঢক করে খানিকটা জল খেতে হল জিভের নিউট্রালিটি ফেরত আনতে৷ খানিকটা গাভাস্কারের আইপিএল কমেন্ট্রিও শুনতে হল, মন থেকে এলাচ-সোনপাপড়ির ইনফ্লুয়েন্স দূর করতে৷ 

এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল৷ অল্প গোলমাল হয়ে গেল যখন টের পেলাম জল-গাভাসকারের কম্বিনেশনেও জিভের একদিকটা চ্যাটচ্যাটে হয়েই আছে৷ সে'টা একটা অস্বস্তি৷ এলাচ সোনপাপড়ির বাক্সটা তখনও বন্ধ করা হয়নি। ভাবলাম চ্যাটচ্যাটে ব্যাপারটা জিভে ইউনিফর্মলি ডিস্ট্রিবিউট করে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ অতএব আরও কয়েক পিস সোনপাপড়ি খরচ হয়ে গেল। আবারও টের পেলাম, কী অদরকারী জিনিস এই এলাচ দেওয়া সোনপাপড়ি৷

সে কথাটাই ওকে বুঝিয়ে বলছিলাম৷ সোনপাপড়ির বাক্স দেখলে আর উঠিয়ে নিলে, অমন ইনডিসিপ্লিন মিষ্টির ব্যাপারে থাকলে চলবে কেন? সিস্টেম চাই, চেকলিস্ট চাই৷ আনারস ফ্লেভারের মাটন প্যাটিস নিশ্চয়ই তুলে নেওয়া চলে না? কাজেই প্যাকেটটা মন দিয়ে পড়তে হবে৷ নতুন ফ্লেভার দেখলে নিজের মনটা ঘেঁটেঘুঁটে দেখতে হবে সে স্বাদ মনের মধ্যে একটা পজিটিভ হাওয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে কিনা৷ তারপর আসবে পারচেজ ডিসিশন৷

এ'দিকে আমার আবার সিরিয়াস আলাপ-আলোচনার সময় মুখ চালানোর দরকার পড়ে৷ হাতে কাছে রাখা এলাচ সোনপাপড়ির বাক্সটা তাই বন্ধ করা হয়নি৷ কাজেই যা হওয়ার হল৷ ফাঁকা বাক্সটা চাটতে চাটতেই নিদান হাঁকতে হল; 
"অমন কেয়ারলেসলি সোনপাপড়ি কেনার কোনও মানেই হয় না"।

Sunday, May 15, 2022

চাংবুমজার মোড়ল



- তা'হলে এই তোমাদের ধর্ম, মোড়ল?

- আমরা তো তোমাদের থেকে ধর্ম-অধর্ম বুঝব না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব৷ বারবার তোমাদের বলা হয়েছে, এ গাঁ পর্যন্ত পুল বানাতে পারবে না তোমরা৷ নিয়মিত তোমাদের নেতা-আমলা সক্কলকে বারণ করা হয়৷ তা সত্ত্বেও এই বজ্জাতির কী মানে?

- চাংবুমজা গাঁয়ের মানুষের পক্ষে যে'টা মঙ্গল, তা'তে তোমাদের এত আপত্তি কীসের? পাহাড়ের আর পাঁচটা গাঁয়ে ব্রিজ পৌঁছোয়নি? সে'খানে পিচের রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি? হাসপাতাল বসেনি? তা'তে মানুষের উপকার হয়েছে৷ তারা সুযোগসুবিধা পেয়েছে, আগের চেয়ে ভালো আছে৷ 

- ব্রিজ৷ রাস্তা৷ স্কুল৷ হাসপাতাল৷ বটেই তো৷ সে'সব গাঁয়ে না আনলে মানুষের মধ্যে শয়তানি, রোগ, আর হাজার রকমের পাপ বয়ে আনবে কী করে! শোনো ইঞ্জিনয়ার, দেওতার আশীর্বাদে আমাদের গাঁয়ের আশি বছরের বুড়োরাও দিনরাত মেহেনত করে, আমাদের কাচ্চাবাচ্চারা সৎপথে আনন্দে বড় হয়৷ 

- তোমার নাতিই গতবছর দু'দিনের জ্বরে মারা গেল না? একটা হাসপাতাল থাকলে, নিদেনপক্ষে ব্রিজটা থাকলে, শিশুটাকে বাঁচানো যেত৷ স্রেফ নিজের জেদের বশে গোটা গাঁয়ের মানুষের ক্ষতি করছ তুমি মোড়ল। 

- আমার জেদ নয় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব৷ দেওতার নিদান৷ ও পুল যেই তৈরি করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে, তারই সর্বনাশ হবে৷ দেওতার রোষ থেকে মুক্তি নেই৷

- দেওতার ওপর তোমার ভরসা নেহাতই কম দেখছি মোড়ল৷ আমার সর্বনাশটা তাঁকেই করতে দিতে পারতে৷ এ'ভাবে তুলে আনাটা নিশ্চয়ই দেবতার নিদান নয়৷ এ'বার আমায় গুমখুন করবে আর মানুষ জানবে দেওতার রোষে আমি নিখোঁজ৷ তাই তো?

- তোমার বয়স অল্প ইঞ্জিনিয়ার সাহব৷ রক্ত গরম৷ ওই গরম রক্তের অপচয় করে লাভ নেই৷ তবে তোমার নিজের দুনিয়ায় ফেরত গিয়েও আর কাজ নেই৷ 

- এর মানেটা কী? আমায় বন্দী করে রাখবে?

- এ গাঁয়ে মোড়লের অনেক কাজ, ইঞ্জিনিয়ার৷ আর ইঞ্জিনিয়াররা বেশ কাজের মানুষ৷

- এ'সব আজেবাজে কথার কী মানে?

- গত দু'আড়াইশো বছর ধরে বহু ইঞ্জিনিয়ার চাংবুমজায় পুল বানানোর কাজ শুরু করতে চেষ্টা করেছে৷ আর, তাদের সবাই গায়েব হয়ে গেছে৷ জানোই তো। দেওতার রোষ।

- সে তো দেখতেই পারছি৷ কী'ভাবে কী ঘটে৷ আর দেওতার রোষের ভাঁওতাটা এ'বার থাক না মোড়ল৷ 

- বেশ৷ তা, যা বলছিলাম৷ একের পর এক ইঞ্জিনিয়ার গায়েব হয়ে যায়৷ তাই বহুদিন এ'সব পুল বানানোর পরিকল্পনা বন্ধ ছিল৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এ'তে আমরাও পড়লাম মহাফাঁপড়ে৷ বিশেষ করে আমি।

- তোমার মাথা ঠিক আছে মোড়ল?

- আমাদের গাঁয়ের মানুষ আমায় কেন এত ইজ্জত দেয় জানো? তুকতাক করে সবার পিলে চমকে দিই বলে নয়৷ সে কাজের জন্য পুরুত আছে৷ আমি বানাই যন্ত্রপাতি৷ আমার দলবল আছে, তবে আমিই উপায় বাতলে দি৷ চাংবুমজায় সে'টাই সবচেয়ে বড় যাদু৷ চাষবাষ, ঘরবাঁধা, জল তোলা, আরও কত কী। সে সমস্তর দায়ই আমার৷ কাজেই বুঝতেই পারছ, চাংবুমজার মোড়লপনা চাট্টিখানি কথা নয়৷ ইঞ্জিনিয়ার না হলে উপায় নেই৷

- আমি কিন্তু কিছুই..।

- আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে আমিও এসেছিলাম এ'খানে ব্রিজ বানানোর জন্য ইন্সপেকশন করতে৷ তারপর ওই৷ ফেরা হল কই।

- এ'সব কী ব্যাপার মোড়ল?

- চাংবুমজার মোড়লগিরি গত কয়েক শতাব্দী ধরে আউটসোর্সড। ইঞ্জিনিয়াররা তো হাজার বছর ধরে আছে৷ কয়েকশো বছর ধরে তারা এ'খানে ছুটে আসছে; এ গাঁয়ে রাস্তা বা ব্রিজ বানাবে বলে৷ এককালে তারা আসত রাজার হুকুমে, এখন আসে সরকার বাহাদুরের ইচ্ছেয়৷ আমরা কী করি? দরকার মত ধারালো সব ইঞ্জিনিয়ার নেতাদের তুলে আনি চাংবুমজায়৷ তাদের সামনে দু'টো পথ খোলা থাকে৷ হয় খুন৷ নয়ত চাংবুমজার একজন হয়ে থেকে যাওয়া৷ নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান দিয়ে গাঁয়ের ভালোমন্দ দেখা৷ আর, সময় মত মোড়ল হয়ে ওঠা৷ এই আমার মত। আর বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইলেই মৃত্যু৷ এ গাঁয়ের মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব।  অবশ্য তাঁদের ভালোবাসার বাঁধন বড় গভীর৷ এ'খানে কিছুদিন কাটানোর পর শহুরে ভাঁওতায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে উবে যায় হে ইঞ্জিনিয়ার৷ তুমি দেখো। এ'খানে থাকলে ঠকবে না৷ 

- তুমি ইঞ্জিনিয়ার? মোড়ল?

- সে'সব ইতিহাস এ'খন অদরকারী। গত বাহান্ন বছর ধরে আমার পরিচয় আমি চাংবুমজার মানুষ৷ এ'দের  ভাষা, ভাবভালোবাসা, রীতিনীতি সব আমার ধমনীতে ঢুকে গেছে৷ আমার ঘরসংসার সন্তানসন্ততিও এ'খানেই৷ আর গত তিরিশ বছর ধরে আমি এ'খানকার মোড়ল৷ আমার আগে যে মোড়ল ছিলেন সে ভদ্রলোক এককালে বেলজিয়ান ছিলেন৷ মারা গেছেন অবশ্য চাংবুমজার একজন হয়েই। যেমন আমাকেও যেতে হবে৷  বয়স তো কম হল না। যাক গে৷ এ গেল পুরনো কাসুন্দি৷ আমি খবর নিয়েছি। তুমি ভালো ইঞ্জিনিয়ার৷ সংসার পাতোনি এখনও৷ এ'বার ভেবে বলো৷ এসে গুছিয়ে বসবে আমাদের গাঁয়ে? আমি আর ক'দিন, চাংবুমজার মোড়ল তুমিই হবে তারপর৷ তোমার আমাদের বড় দরকার ইঞ্জিনিয়ার৷ যাবে তো? নাকি, আমায় আজ একটা খুন করতেই হবে?

এজেন্ট বর্ধমান



- আপনি তো ক্যালকেশিয়ান দেখছি৷

- বর্ধমান৷

- ওই হল৷ হিমাচলে বসে পুরো বেঙ্গলটাই তো ক্যালক্যাটা৷

- আপনি প্লুটোতে বসে থাকলেও সে ধারণাটা ভুল৷

- প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড৷ আপনি কি এ'খানে উইথ ফ্যামিলি?

- না৷ একাই৷ একটা জরুরী কাজে৷

- ও মা। হিলস্টেশনে আবার জরুরী কাজ কীসের মশাই৷ তবে আমিও একাই এসেছি৷ গত বাইশ বছর ধরে সোলো ট্র‍্যাভেল করছি বুঝলেন৷ গ্র‍্যাজুয়েশনের পর নিজের জমানো যৎসামান্য পকেটমানি নিয়ে গোপালপুর গেছিলাম৷ অবভিয়াসলি একাই৷ সেই শুরু৷ বিয়েথাও হল না৷ আমার সংসার বলতে এই ট্র‍্যাভেলিং৷ 

- বাহ্৷ ভালো কথা। 

- তা, আপনার কেসটা কী? তিনদিন ধরে দেখছি এই ম্যালে এসে বসছেন৷ বই পড়ছেন৷ অফিসের ব্যস্ততা নিশ্চয়ই নেই৷ ইয়ে, প্লীজ ফরগিভ মাই কিউরিওসিটি৷ 

- আসলে কী জানেন,  আমার কাজের নেচারটা একটু গোলমেলে৷ অসীম ধৈর্য ছাড়া আমার গতি নেই৷ তবে হ্যাঁ, আমি ছুটি কাটাতে আসিনি৷ এই বেঞ্চিতে বসে দিনের পর দিন কাটাচ্ছি বটে। ওয়েল অবজার্ভড৷ তবে মোটেও ঝাড়াহাতপা নই। 

- আপনি স্পেশ্যাল এজেন্টটেজেন্ট নাকি? ডিটেকটিভ?

- খানিকটা দু'টোই। আমার কাজে ডিটেকশনের একটা আলগা ভূমিকা আছেই৷ ভিড়ের মধ্যে থেকে সঠিক মানুষ চিনে বের করা৷ তার গতিবিধি মেপে নেওয়া৷ সেই অনুযায়ী অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা৷ আর ভেবে দেখুন, কিডন্যাপার তো এক ধরণের স্পেশ্যাল এজেন্টই। তাই নয় কি?

- এ ধরণের ঠাট্টা খুবই বিশ্রী৷ ঘাট হয়েছে যেচে আলাপ করতে এসেছি৷ নেহাত বাংলা বই পড়ছেন দেখে..।

- ডিডিউস করলেন আমি কলকাতার৷ কিন্তু মনে রাখবেন, কিডন্যাপারদের চোখ কিন্তু অত কাঁচা নয়৷ আর বর্ধমানের কিডন্যাপাররা তো মহাবজ্জাত৷

- গুড বাই।

- আসুন৷ আর বর্ধমানের দিকে এলে চোখকান খোলা রাখবেন৷ হয়ত দেখা হয়ে যেতে পারে৷

ইজ্জৎ

- কাকা, দু'জন দেখা করতে এসেছে৷

- কী চায়, টাকাপয়সা? খুচরো দু'চারটাকা দিয়ে বিদেয় কর৷ উঠোনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দিসনি৷

- না না, টাকা নয়..।

- এই সেরেছে৷ উপকার করতে বলবে না তো? দেখিস বাবা৷ মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে বল পরশু দুপুরে আসতে, উপকার রেডি রাখব৷

- ও মা! কাল থেকে তো তুমি একমাস নেই কাকা৷ তীর্থফীর্থ কোথায় যাবে না?

- আহ্! সে জন্যই তো পরশু আসতে বলছি৷ 

- অ৷ কিন্তু তারা উপকার চাইতে আসেনি তো।

- সর্বনাশ৷ আলাপ জমাতে এসেছে? কেমন-আছেন-আমি-ভালো-আছি মার্কা হাড়জ্বালানের দল? শোন, ও'দের দু'চারদানা নকুলদানা আর আধগেলাস জল দিয়ে কাটিয়ে দে। যত আপদ।

- আরে না গো কাকা! সে'সব নয়৷

- তবে? ওদের মতলবটা কী?

- ওরা সম্মান চাইতে এসেছে।

- কী চাইতে এসেছে?

- সম্মান৷ ইজ্জৎ।  রেস্পেক্ট।

- বাঁশপেটা কর ওদের৷ এখুনি৷ ওরে কে কোথায় আছিস! আন, কাটারি আন৷ বঁটি আন৷ জুতো, লাঠি, মুগুর, সেফটিপিন, গীতবিতান; হাতের কাছে যা পাবি নিয়ে আয়৷ রাস্কেলদের সাহস দেখো, সম্মান চাইতে এসেছে৷ এদের চামড়া গুটিয়ে দে, সম্মান আদায়ের শখ যেন পুরোপুরি মিটে যায়৷ বুঝেছিস?

Monday, May 9, 2022

সানডে অপটিমিস্ট



- ভাইটি।

- ফ্লেক?

- আজ নয়৷ 

- কেন কাকা? সিগারেট কমাচ্ছেন?

- তা নয়৷ তবে এ'সন্ধেয় ফ্লেকবাজি চলবে না হে। 

- এ সন্ধেটা কী'রকম?

- আজ সন্ধেবেলায়, বুঝলে হে; একটা পিকিউলিয়ার মনকেমন অনুভব করছি৷

- কী'রকম মনখারাপ কাকা? হজমে গোলমাল? 

- আরে না না৷ ডাইজেস্টিভ ট্র‍্যাকের বাইরেও জীবন আছে৷ এই মনকেমনের নেচারটা স্পিরিচুয়াল৷

- বুঝিয়েই বলুন না।

- আজ সন্ধে থেকেই, বুঝলে.."আগামীকাল বৃষ্টি হবে" টাইপের মনকেমন৷ 

- যাচ্চলে৷ কাল নামবে নাকি?

- গুগল বলছে কাঁচকলা৷ কিন্তু মন বলছে সোমবারটা জাস্ট ধুইয়ে দেবে৷ তবে ঝেঁপে নামবে দুপুরের দিকে৷ ফাইলের ঢিপির ও'পারের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখব ঝাপসা কাচ৷ অফিস থেকে বেরোনোর আগেই অবশ্য ধরে যাবে। ফেরার সময় বাতাসে শুধুই মিঠে আমেজ৷ অটোর সাইডে বসলে মনে হবে ফ্লাইং কার্পেট৷ রোলের দোকানের সামনে দাঁড়ালে মনে হবে চিৎকার করে বলি; তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার জোড়া রোলই চাই। 

- তা কাকা, সোমবারের বৃষ্টিতে রোব্বারে মনখারাপ কেন?

- আরে ধের ছাই কাঁচকলা৷ মনখারাপ আর মনকেমন এক নয়৷ মনখারাপ চিমটি, মনকেমন সুড়সুড়ি৷ মনখারাপ খবরের কাগজ, মনকেমন আবোলতাবোল৷ মনখারাপ "ভোট দিন ভোট দিন", মনকেমন হল, "আর একটু ভাত দিই"। কী বুঝলে?

- আপনার মনখারাপ নয়৷ মনকেমন।

- করেক্ট ভাইটি৷ করেক্ট৷ ভ্যাপসা গরম ক্যান্সেল করে একটা বৃষ্টিতে-ঠাণ্ডা লেবুজল-মার্কা সোমবার আসছে৷ সে ঠাণ্ডা হাওয়ার চোটে অফিসের বড়সাহেবের মুখ বাঙলার পাঁচ থেকে তৃপ্ত অনিল চ্যাটুজ্জ্যেতে কনভার্ট হবে৷ অফিস ক্যান্টিনের মেনু সবাইকে চমকে দিয়ে ক্ষীরকদম অফার করবে৷ এমন কত কী দুর্দান্ত সব ব্যাপার ঘটে যাবে; স্রেফ ওই হঠাৎ বৃষ্টির গুণে। 

- কিন্তু কাকা, ওয়েদার ফোরকাস্ট তো বলছে রুখাশুখা দিন। টেম্পারেচার বাড়বে৷ 

- সে হিসেবের ফোরকাস্টটুকুই কি সব রে? এই যে এমনভাবে মন ডাকছে, তার কোনও ভ্যাল্যুই নেই?

- তা আছে কাকা৷ দেখবেন, কাল নিশ্চিত বৃষ্টি হবে৷

- আলবাত হবে৷ হতেই হবে৷ আমি এত কনফিডেন্ট কেন জানিস?

- কেন?

- কারণ আমি সানডে অপটিমিস্ট৷

- অ৷ তা, জর্দাপান দেব কাকা?

- নো স্যার৷ আজ নো জর্দা৷ একটু নরম দাগের কিছু চাই৷ একটু মোলায়েম৷ একটু মখমলে।

- একটা মিঠা বানাই? 

- বানাও৷ তবে নো সুপুরি৷ সাফিশিয়েন্ট গুলকন্দ৷ রকমারি মিঠে মশলা। মনকাড়া খুশবু৷ এক্কেবারে ভীমনাগের পান। কী ইয়ংম্যান,  পারবে না?

- নিশ্চয়ই কাকা..।

- ইরশাদ..।

- কী স্বাদ কাকা?

- পানটা বানাও ভাইটি৷ ধীরেসুস্থে, কেমন?