Tuesday, April 26, 2022

আশিসবাবুর খাওয়াদাওয়া



অনেকের মতই আমিও প্রচুর খাওয়াদাওয়ার ভিডিও দেখি৷ এবং বাকিদের মতই বহু ধরণের খাওয়াদাওয়ার ভিডিও দেখে থাকি৷ কেউ জাম্বিয়ার রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ভালো মাংসের পদের খোঁজ করছেন, কেউ থাইল্যান্ডের কোনও গ্রামে বসে বিদঘুটে নামের কিছু চেখে দেখছেন, কেউ পাকিস্তানের গলিঘুপচি চষে দুর্দান্ত সব কাবাবে মনোনিবেশ করছেন। আবার কেউ হরিদ্বারের পুরি তরকারি সাজিয়ে গুডমর্নিং বলছেন বা বাঁকুড়ার আশেপাশের কোনও ছোট্ট ভাতের হোটেলের রুই মাছের ঝোল আর মোটা চালের ভাত খেয়ে মুগ্ধ হচ্ছেন৷ অনেক ব্লগার নিজগুণে সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছেন, অনেকে তেমন 'পপুলার' না হয়েও মনের সুখে ভিডিও রেকর্ড করছেন আর আমাদের তৃপ্ত করছেন। এ'ছাড়া আছেন এমন অনেক সেলিব্রেটি যারা পথে নেমেছেন ভ্লগারের ভূমিকায়৷ 

আশিস বিদ্যার্থী ওই তৃতীয় ক্যাটেগরিতে পড়েন৷ এবং ইদানিং আমার বড় প্রিয় হয়ে উঠেছেন৷ ভদ্রলোকের সারল্যের তুলনা নেই৷ চেটেপুটে খাচ্ছেন, সাপটে প্লেট থালা সাফ করছেন, আর যে'খানে সে'খানে থেবড়ে বসে পড়ছেন৷ এ সমস্ত ভিডিও শ্যুট করার আগে নির্ঘাৎ খানিকটা আগাম পরিকল্পনা থাকেই। তবে ভদ্রলোক গোটা প্রসেসটা যে'ভাবে উপভোগ করেন, তা'তে ভালো না লাগার কোনও প্রশ্নই নেই৷ ওঁর মধ্যে খাওয়ার অ্যানালাইজ করার ঝোঁক নেই, স্রেফ মুখ চালানোয় মশগুল। যেন একরাশ ভালো লাগা নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন ভদ্রলোক, সে'টাই তাঁর সুপারপাওয়ার; তাকে হতাশ করা সহজ নয়৷ এবং ওঁর হাতে যেন অঢেল সময়, যেন বত্রিশ ঘণ্টার দিন আর বাহাত্তর মিনিটের ঘণ্টা হাতে নিয়ে চলার লোক তিনি৷ সবচেয়ে বড় কথা; এমন "দিব্যি আছি ভাইটি" গোছের লোক টাইমলাইনে একবার এসে পড়লে চারপাশটা আলোয় আলো হয়ে যেতে বাধ্য৷ 

সাধারণত ছোটখাটো খাওয়ার জায়গাগুলো বেছে বেছেই ঢুঁ মারছেন৷ এবং বেশিরভাগ ভিডিওতে খাবার ছাপিয়ে যে'টা আছে সে'টা হল ভদ্রলোকের নিখাদ মুগ্ধতা। ওই যে বললাম, খাবারের বিশ্লেষণ দেখার জন্য ওর চ্যানেলে যাওয়ার মানে হয়না৷ একজন মাঝবয়সী মানুষ, আলাভোলা মেজাজে ঘুরছেন, মৌজ করে খাচ্ছেন আর পাড়ার মাইডিয়ার দাদা-কাকাদের মত তোফা গপ্প জুড়ছেন৷ 

সবই খাবার ভিডিও নয়। মাঝেমধ্যে পাড়ার সেলুনে মাথা মাসাজ করছেন, কিংবা কোনও ছবির মত সুন্দর স্টেশনের স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে গল্প জমাচ্ছেন; আর সর্বক্ষণ মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘুরছেন। সে হাসি যেন ক্যামেরার জন্য নয়, স্রেফ তাঁর নিজের জন্যই৷ অমুক সারকাজম,  তমুক প্রতিবাদ, এই দুঃসংবাদ, ওই ঝগড়া; এ'সব টপকে টাইমলাইনে একটু অক্সিজেন ইঞ্জেক্ট করে যায় ভদ্রলোকের ভিডিওগুলো।

ইয়ে, বলে রাখিঃ
ঘটনাচক্রে আমার টাইমলাইনে ঘুরেফিরে ওঁর খাওয়াদাওয়ার ভিডিওগুলোই আসে। তার বাইরেও ভদ্রলোককে বোধ হয় সাত-সতেরো রকমের ভিডিওতে দেখা যায়৷ আমার মন্তব্যগুলো শুধুই ওর খাওয়াদাওয়া আর আলগা ঘুরে বেড়ানোর ছোট ছোট ভিডিও ও রিলগুলো সম্বন্ধে (বিশেষত ইন্সটাগ্রামে)৷

Wednesday, April 20, 2022

বুলডোজার রাখাল আর মায়ের হারমোনিয়াম



১। 

- মিনিস্টার! একটা খবর ছিল..।

- দিস ইজ আনপার্ডনেবল চীফ।

- দেখুন মিনিস্টার, আমি যে কী বলব..।

- আপনাদের লজ্জা করে না? এত বড় একটা স্ক্যান্ডাল, এত বড় একটা সিকিউরিটি থ্রেট তৈরি হয়েছে স্রেফ আপনাদের ক্যাবলাকান্ত সিস্টেমের জন্য৷ আর এখন আপনি ভেবে পাচ্ছেন না যে কী বলবেন?

- আসলে গোটা ব্যাপারটাই এত মিস্টিরিয়াস..।

- তবে আর কী! দেশ গোল্লায় যাক। আর আপনারা, সেনাবাহিনীর কর্তারা; ব্যাপারটাকে মিস্টিরিয়াস বলে ঝাড়া-হাত-পা হয়ে ফুর্তি করুন। 

- দেখুন স্যার..। ব্যাপারটা সত্যিই ব্ল্যাক ম্যাজিকের মত..। 

- মাই ডিয়ার আর্মি চীফ গোবর্ধন গলুই৷ আমাদের ন্যাশনাল আর্মির গর্ব, আপনাদের দ্য গ্রেট বুলডোজার রেজিমেন্টের সমস্ত বুলডোজার কোনও রকম হিউম্যান ইন্টারভেনশন ছাড়া, নিজেরাই ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়েছে৷ শহর জুড়ে হাহাকার..অথচ আপনারা ক্লুলেস?

- দেখুন মিনিস্টার, এই বুলডোজারগুলো অত্যাধুনিক৷ আপনি তো জানেন, গতবছরই এ'রকম বারোশো ইউনিট কেনা হল৷ সেল্ফ ড্রিভেন, রিমোট কন্ট্রোলড৷ কিন্তু তাই বলে তাদের তো আর নিজস্ব মগজ নেই৷ আমাদের কন্ট্রোলরুম থেকে হিউম্যান ইন্সট্রাকশন না গেলে তাদের এক ইঞ্চিও নড়ার কথা নয়।

- বেশ৷ তাই যদি হবে তা'হলে কন্ট্রোল রুমের হুকুম ছাড়া সে বুলডোজারের দল ব্যারাক ছেড়ে বেরোল কী করে?

- সে'টাই তো..ইয়ে..মিস্ট্রি৷ 

- নিনকম্পুপ্স! অত সাধের সব ইম্পোর্টেড বুলডোজার, যা না-পসন্দ তা নিমেষে সাফ; সে'গুলো শেষে হাতছাড়া হল? আরে ও'গুলোর তো এখনও ওয়ারেন্টিই খতম হয়নি৷ আপনাদের কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিৎ! যাকগে, সে'সব সময়মত হবে'খন৷ আগে বলুন সেই গোলমেলে বুলডোজারগুলো এখন কোথায়? ওদের মুভমেন্ট ট্র‍্যাক করছেন আশা করি! সে ব্যাটারা কি নিজে নিজেই বস্তিটস্তি ভাঙা শুরু করল নাকি? অবশ্য ক্ষতি নেই তা'তে, কিন্তু মিডিয়াকে ডাকা হলো না যে৷ কভারেজ কম হবে। কেসটা কী?

- সে'টা রিপোর্ট করতেই এ'খানে এসেছি মিনিস্টার৷ 

- চটপট৷ নাটুকে সাইলেন্স আর সহ্য হচ্ছে না।

- সমস্ত বুলডোজার সারিবদ্ধ ভাবে, বেশ ডিসিপ্লিন নিয়ে এগোচ্ছে৷ কোনও বস্তি-টস্তির ধারেকাছে যায়নি।

- সে'কী! কোন দিকে এগোচ্ছে?

- ইয়ে..!

- চীফ গলুই, বুলডোজারগুলো কোনদিকে যাচ্ছে?

- যাচ্ছে না৷ মানে, ইয়ে৷ আসছে৷ 

- আসছে?

- এই এ'দিকে৷ জিপিএস তাই বলছে। 

- আ..আমাদের পার্টি আপিসের দিকে এগিয়ে আসছে?

- ই..ইয়ে..আসছে। 

- থামাও!

- কী বলি মিনিস্টার, থামছে কই! ইয়ে, একটা এমার্জেন্সি কল এসেছে মোবাইলে। 

- ফোনটা রিসিভ করে আমায় উদ্ধার করুন৷ দেখুন আর কী দুঃসংবাদ এলো৷

(মিনিট সাতেক পরে)

- মিনিস্টার! একটা ভাইটাল খবর। 

- কী?

- ব্যাপারটা খুব ইয়ে..ঠিক বিশ্বাসযোগ্য কিনা জানিনা৷ তবে আপনাদের এই পার্টি অফিসের বাইরে এক আধপাগলা লোক দাঁড়িয়ে হল্লা পাকাচ্ছিল। সে ক্লেম করেছে যে..।

- কী ক্লেম করছে?

- যে..যে সেই নাকি বুলডোজারদের ডেকে আনছে।

- হ্যামলিনের বুলডোজারওলা? ইয়ার্কি হচ্ছে?

- গোটা ব্যাপারটা এমনই ডার্ক আর গোলমেলে। কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আমার কম্যান্ডাররা ওকে  থার্ড ডিগ্রী দিচ্ছে, কিন্তু সে ব্যাটার হাসি থামানো যাচ্ছে না। 

- ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন৷ 

- কিন্তু মিনিস্টার..।

- ক্যুইক৷

***

২।

- পেন্নাম অনারেবল মিনিস্টার হলধর হসন্ত! হোয়াট অ্যান অনার!

- আপনাকে ওরা খুব মারধোর করেছে বুঝি? আই অ্যাম সরি৷ আমি কিন্তু জানতে পেরেই..।

- ও নিয়ে আপনি ভাববেন না স্যার৷ আমি এ দেশের গরীবমানুষ, জীবনটাই থার্ডডিগ্রী৷ ও'সব চিমটি কাটায় আমাদের কিছু এসে যায়না।

- আপনার নাম?

- গোবিন্দ গাইয়ে। 

- বাহ্, সুন্দর নাম৷ তা, গোবিন্দবাবু, চা খাবেন? বা লেবুর সরবত? কোল্ডড্রিঙ্কস? লস্যি?

- ইয়ে, ভাত হবে? 

- ভাত?

- ভাত৷ 

- নিশ্চয়ই৷ এখুনি আনতে বলে দিচ্ছি৷ আমাদের ক্যান্টিনের থালি খুবই ফেমাস৷ সতেরো রকম আইটেম থাকে৷ ম্যাসিভ একজোড়া রাজভোগসহ। 

- এক্সেলেন্ট৷ আটশো বিরানব্বুই প্লেট অর্ডার করে দিন প্লীজ৷

- আটশো বিরানব্বুইটা প্লেট?

- আজ্ঞে। একটা এ'খানে দিয়ে যাবে৷ আর আটশো একানব্বইটা ডেলিভার করবে বোসপাড়ার পিছনের বস্তিতে৷ গতকাল আপনাদের বুলডোজারগুলো সে'খানকার লোকজনদের বাড়িঘরদোর ভেঙেটেঙে দিল। কাজেই তাদের আজ রান্নাবান্নার পাট নেই৷ আপনার লোক যদি খাবার ডেলিভার করে দেয়, তা'হলে রাতটা নিশ্চিন্ত৷ 

- গোবিন্দবাবু, কাজের কথায় আসি..। বুলডোজার।

- ভাতটা বোধ হয় তেমন কাজের কথা নয়, তাই না?

-  শুনুন৷ আপনি আর্মির লোককে বলেছেন যে ওই বুলডোজারগুলোকে আপনি ডেকে এনেছেন?

- সর্বৈব সত্য৷ হসন্তবাবু, বুলডোজার তো যন্ত্র৷ মানুষের ডাক না পেলে তারা নড়বে কী করে?

- অতগুলো বুলডোজার আপনার ডাকে সাড়া দিলে? এ'টা গুল নয়?

- গুল হলে, আপনি কি আমার ডেকে ভাত খাওয়াতেন?

- বুলডোজারগুলো আপনার ডাকে সাড়া দিচ্ছে? কেন?

- গতকাল আপনাদের বুলডোজার রেজিমেন্ট আমাদের পাড়ায় এলো বুঝলেন। হুলোর বাড়ি ভাঙলো সবার আগে। আমি পাত্তা না দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে পল্লীগীতি গাইছিলাম। তারপর মিনুর বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেল। আমি ধরলাম নজরুল। একে একে মধু, সেলিম, গুপে আর আরও কত মানুষের ঘর ভাঙল। বিশ্বাস করুন, আমি সে'সব ছোটখাটো ব্যাপারে পাত্তা না দিয়ে আমার হারমোনিয়াম নিয়ে দিব্যি ছিলাম। এমন কী আমার ঘরও যখন ভাঙতে এলো, আমি দিব্যি 'এক্সকিউজ মি' বলে পাশ কাটিয়ে, হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে; বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে আমি গজল ধরেছি৷ আহা, সে কী প্রেম প্রেম ভাব৷ 

- তারপর?

- আমার গান আপনার বুলডোজার রেজিমেন্টের কম্যান্ডারদের সহ্য হল না৷ কোনও মানে হয় বলুন? তাঁরা স্রেফ হাহাকার শুনতে চায়, তাঁদের কানে গান সইল না। আমার হারমোনিয়াম ছিনিয়ে নিয়ে চলন্ত বুলডোজারের সামনে ফেলে দিলে৷ ব্যাস, সাফ৷ আমার বারণ শুনলে না। তারপর তাঁরা আমায় বেধড়ক পেটালে, বুঝলেন৷ এক্কেবারে তলপেটে ভারী বুটের লাথি৷ দে দমাদম৷ অজ্ঞান হয়ে গেলাম৷ জ্ঞান ফিরল এক্কেবারে ভোরের দিকে৷ সামনে আমার মায়ের রেখে যাওয়া হারমোনিয়াম গুঁড়ো হয়ে পড়ে৷ কিন্তু কী অদ্ভুত, গায়ে বিন্দুমাত্র ব্যথা নেই৷ আর..আর আমি দিব্যি টের পেলাম আমার মায়ের হারমোনিয়াম ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার আগে আমার মধ্যে ম্যাজিক ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

- ম্যাজিক?

- আমি অনুভব করতে পারলাম হলধরবাবু৷ টেস্ট করার জন্য মনে মনে একটা বুলডোজারকে ডাকলাম৷ ও মা, পাক্কা দশ মিনিটের মধ্যে একটা বুলডোজার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, সে'টার মধ্যে থেকে একটা মিঠে যান্ত্রিক গোঙরগো শব্দ বেরোচ্ছে৷ ঠিক যেন একটা পোষা ভেড়া৷ ব্যাস, বাকি বুলডোজারদের ডেকে নিলাম। আর এখন তাদের চরিয়ে বেড়াচ্ছি৷ মিউজিশিয়ান থেকে রাখাল হয়ে গেলাম স্যার। 

- গোবিন্দবাবু! বুলডোজারদের আটকাতেই হবে!

- তারা রক্তের স্বাদ পেয়েছে মিনিস্টার হসন্ত৷ আর হারমোনিয়াম হত্যার পাপ তাদের হিংস্র করে তুলেছে৷ এ'বার নিস্তার নেই৷ 

- প্লীজ, শুনুন আপনি..।

- ওই যে, মন্টুসোনার গোঙরগো আওয়াজ পাচ্ছি। আপনি শুনতে পাচ্ছেন মিনিস্টার?

- মন্টুসোনা? মন্টুসোনা কে?

- ওই প্রথম যে বুলডোজার আমার কাছে এসে নত হয়েছিল৷ বড় আদর করে নাম রেখেছি৷ তা, সে এসে পৌঁছেছে আপনার অফিসে৷ যাকগে, একটা গজল শুনবেন হলধর হসন্ত?

Tuesday, April 19, 2022

রবি ঘোষের বই



আত্মজীবনী লেখায় বাঙালিদের যে কেন এত অনীহা কে জানে৷ রবি ঘোষের মত মানুষ যদি নিজের ভাষায় নিজের কাজকর্মের গল্প বিশদে লিখে যেতেন, বাঙালি বর্তে যেত৷ ওঁর মত গুণী মানুষদের ক্ষেত্রে যে'টা সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ওঁদের কাজের ডিসিপ্লিন আর প্যাশন সম্বন্ধে পড়ে মুগ্ধ হওয়ার জন্য সিনেমার ছাত্র হওয়ার দরকার পড়েনা৷ বরং খানিকটা পড়েই মনে হয়; ইস, রবি ঘোষ যে'ভাবে অভিনয়ের গ্ল্যামারহীন দিকগুলোকেও অনুগত ছাত্রের চোখ দিয়ে দেখছেন, তেমন ভাবে আমিও যদি অফিসের পেন্ডিং ফাইলগুলো ঘাঁটতে পারতাম; তা'হলে রোজকার কাজটা কতটা উপভোগ্য হয়ে উঠত। তুলনাটা হয়ত বাড়াবাড়ি হল৷ তবে বক্তব্য হচ্ছে রবি ঘোষ স্তরের শিল্পীদের নির্বাণলাভের জন্য  গ্যালারি থেকে ভেসে আসা উচ্ছ্বাস আর হাততালিটাই শেষ কথা নয়৷ কাজের ডিসিপ্লিনে ডুবে থাকাটাই সম্ভবত তাঁদের মূল ইনসেন্টিভ৷ আমার মত মানুষ, যার শিল্প জগতের সঙ্গে এতটুকু সুতোর যোগই  নেই, যদি শিল্পীদের প্যাশন সম্বন্ধে একটা আইডিয়া পেতে চাই; তা'হলে রবি ঘোষের মত স্টলওয়ার্টদের লেখাই কুড়িয়ে-কাছিয়ে পড়তে হবে৷ কুড়িয়ে-কাছিয়ে ভদ্রলোকের খুচরো লেখাগুলো জড়ো করার দুরূহ কাজটা করা হয়েছে  "আপনমনে" বইটাতে৷ সম্পাদক অভীক চট্টপাধ্যায় এবং সপ্তর্ষি প্রকাশনকে ধন্যবাদ৷ ভদ্রলোক জীবনী লেখার বা লেখানোর কোনও চেষ্টা যখন করেননি, তখন আমাদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ 

বইটা স্রেফ একটা প্রবন্ধ সংকলন, রবিবাবু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে'সব লেখা দিয়েছেন; সে'গুলোই জড়ো করে ছেপে দেওয়া হয়েছে৷ লেখাগুলো বেশিরভাগই টপিকাল, কাজেই কিছু ঘটনা, অনুভূতি ও অভিব্যক্তি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে৷ তা সত্ত্বেও বইটা আমার খুব ভালো লেগেছে। কেন?

প্রথম কারণটা বলেইছি৷ কর্মযোগ যে কী ফ্যান্টাস্টিক ব্যাপার, সে'টা এ বই পড়লেই মালুম হবে৷ একটা মানুষ নিজের কাজের মধ্যে ডুবে আছেন, কাজের ভালোবাসায় নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন৷ আর নিজেকে ঠুকেপিটে রোজ একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেলেন 'নেক্সট-লেভেল-এক্সেলেন্সের' দিকে৷ সে'টা যে কী দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার।  দ্বিতীয়ত, সেই সময়, সে'সময়ের কলকাতা, সে'দিনের বাংলা অভিনয় আর সে'যুগের মানুষজনদের ব্যাপারে একটা ছিমছাম প্রাইমার রয়েছে এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে৷ আর একটা জব্বর ব্যাপার হল উৎপল দত্ত আর সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে রবি ঘোষের অবজার্ভেশনগুলো; সে'গুলো আমি খোলসা করতে গেলে খেলো হয়ে যাবে৷ রবি ঘোষের ভাষাতে পড়াই ভালো৷ 

বইটার আর একটা দুর্ধর্ষ ব্যাপার হল বাংলা সিনেমায় কমেডি এবং কমিক অভিনয় সম্বন্ধে ওঁর মতামত, খেদ আর অভিমান। সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে সিনেমার হাসির যোগাযোগ নিয়ে চমৎকার কিছু মনোলগ লিখে গেছেন ভদ্রলোক; সে'গুলো যতটা ধারালো, ততটাই হতাশা মেশানো৷ আর ভদ্রলোকের ভাষার উইট মিশে লেখাগুলো বেশ রসালোও হয়েছে। সত্যজিতের স্ক্রিপ্ট থেকে উঠে আসা নটবর মিত্তিরের মতই তার কথাগুলো স্মার্ট, সাবলীল, মজারু, এবং সরলসিধে৷ আর একটা ব্যাপার, ভদ্রলোক যাই লিখেছেন সে'টা পড়লে মনে হবে টেবিলের ওপারে চায়ের কাপ নিয়ে বসে বলছেন। কাজেই তার বাংলায় চলে এসেছে প্রচুর ইংরেজি শব্দ যা আমরা সাধারণ কথাবার্তায় দিব্যি বলে থাকি৷ আমার অবশ্য সে'টা ভালোই লেগেছে। এই বই নিয়ে লিখতে বসে তাই দিব্যি ইংরেজি শব্দগুলো ফিল্টার না করে চালিয়ে গেলাম৷ 

আর একটা ব্যাপার প্রশংসার দাবী রাখে। প্রত্যেক প্রবন্ধের শেষে যত্ন করে টীকার লিস্ট সাজিয়েছেন সম্পাদক৷ আর ফুটনোটের মত কিপটেমি করে লেখা নয়, গুছিয়ে লেখা এক একটা প্যারাগ্রাফ৷  আমার মত কম-জানা মানুষজনের জন্য যা বেশ কাজের জিনিস৷ এই যেমন সেই টীকা পড়েই জেনেছু অভিনেতা সত্য বন্দোপাধ্যায় জার্মান ভাষা জানতেন আর রবি ঘোষই শর্মিলা ঠাকুরকে কমলকুমার মজুমদারের কাছে নিয়ে গেছিলেন অভিনয় শেখাতে৷ 

কাজেই, যদি না পড়ে থাকেন, তা'হলে বইটা চট্ করে সংগ্রহ করে নিতেই পারেন। 

Sunday, April 17, 2022

বন্দুকবাজ বাঘ উত্তমকুমার



লালমোহন গাঙ্গুলির বোম্বাইয়ের বোম্বেটে উপন্যাস অবলম্বনে যে বলিউডি সিনেমা তৈরি হয়েছিল সে'টার নাম দাঁড়িয়েছিল 'জেট বাহাদুর'। নামের মধ্যে স্পীড, দুঃসাহস আর অ্যাডভেঞ্চার সবই ছিল৷ যাকে বলে থ্রিসিক্সটিডিগ্রি অ্যাপিল৷ পরিচালক পুলকবাবু নিশ্চিত ছিলেন যে দর্শক স্রেফ নামের জোরেই অর্ধেক ঘায়েল হবে৷ 

তা এদ্দিনে সেই জেট বাহাদুরকে টেক্কা দেওয়ার মত নাম চলে এসেছে বাজারে৷ অবশ্য সিনেমায় নয়, বইয়ে। তবে নামটা যে কী সাংঘাতিক সিনেম্যাটিক। সেই নামের মধ্যে কী নেই?
সুপারহিরোর ঘ্যাম? আছে৷
রোম্যান্টিক আবেদন? আছে।
ঢিশুম ঢিশকাঁও মার্কা অ্যাকশন? ইয়েস স্যার। 
রূপকথা? তাও আছে৷

মানে যা যা আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারে; সে সমস্ত উপাদান বইয়ের নামের মধ্যেই আছে।

"উত্তমকুমারঃ এক বন্দুকবাজ বাঘের গল্প"।

 এ'রকম রক্তারক্তি নাম দেওয়ার পর সেই থ্রিল গোটা গল্পে ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু রোহণ কুদ্দুসের সাদামাটা ভালোমানুষ চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে মগনলালের প্রাইভেট সার্কাস মাত করে দেওয়া এক খতরো কা খিলাড়ি। সেই খিলাড়িপনা দিয়েই এই গল্প জেটবাহাদুরত্ব অর্জন করেছে।

স্পয়লার দেওয়া অত্যন্ত খারাপ অভ্যাস৷ তবে যে স্পয়লারে মানুষকে বইয়ের দিকে টেনে আনা যায়, সে'সব চেপে রাখতে নেই৷ বিশ্বাস করুন, এ গল্পে সত্যিই এক বন্দুকবাজ বাঘ রয়েছে। আর রয়েছে একরাশ 'মিথ-বাস্টিং'৷ বাঘ-মানুষের সম্পর্কের আদা-কাঁচকলা ব্যাপারটা যে আগাগোড়াই গুল; সে'টা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে গেলে এ বই পড়তেই হবে। এরপর, এই ধরুন আপনার জানা উচিৎ যে বাঘ-ম্যানেজমেন্টে বুলেটের চেয়ে বেশি কাজ দেয় আচার। কেন? আমায় জিজ্ঞেস না করে বইটাই পড়ে ফেলুন৷ তা'ছাড়া বাঘেদের গ্যাসের ব্যামো হয়, তাদেরও রোদ্দুর রায় পায়; সে'সব জরুরী ইনফো সাজিয়ে হাতে-গরম জার্নাল তৈরি করেছে রোহণ৷ 

তবে হ্যাঁ, এ বই শুধু রোহণের নয়৷ কারণ এ বই পড়ার আনন্দ শুধু রোহণের লেখায় নয়। তন্ময়ের আঁকা ছবি এ বইয়ের প্রাণ। রোহণ খুব চেয়েছিল তন্ময় মুখুজ্জে এ বইয়ের জন্য ছবি আঁকুক৷ কিন্তু ব্যাটাচ্ছেলে মুখুজ্জে আঁকাতেও বানান ভুল করে। সে'জন্য রোহণকে অন্য তন্ময় খুঁজতে হয়েছে। আর বিশ্বাস করুন, তন্ময় বিশ্বাস জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছে৷ এই বই আমি আর খোকা একসঙ্গে পড়েছি; ইয়ে, আমি পড়েছি (লেখা এবং ছবি দু'টোই) আর খোকা ছবিগুলো গিলেছে৷ দু'জনেই একই ওয়েভলেন্থে থেকে গোটা গল্পটা উপভোগ করেছি। তাই বলে আবার ভাববেন না গল্পটা শুধুই ছোটদের৷ বুড়োবুড়িদের বালিশের তলা আলো করে তুলতে পারে এই বই৷ 

প্রকাশকের কাছে একটাই দাবী, এই বইয়ের স্পেশ্যাল এডিশন বের করা হোক। ইয়াব্বড়, কফিটেবিল বই সাইজের৷ প্লীজ, জরুরী।

লুচি ও লঙ্কা



ভালোবাসাবাসি নিয়ে শুধু সাহিত্যিকরাই উঁচু গলায় কথা বলবেন ও জলদগম্ভীর ভাষায় লিখবেন; তেমন মনোপলি বরদাস্ত করা যায়না৷ 

কেউ ভালোবাসবেন মোটা দাগে, অমিত-লাবণ্যের ডিসিপ্লিনে তাঁদের বাঁধা চলবে না৷
কেউ গদগদে হয়ে পড়বেন বিটকেল হ্যা-হ্যা হাসিতে, স্মিত ক্লাসিকাল হিসেবকিতেবে তাদের মন গলবে না৷ 
কারুর প্রেমে থাকবে শুধুই বিসর্জনের বেহিসেবি কোমর নাচানো ব্রেকড্যান্সে, হাইক্লাস ছন্দমিলে তারা কলুষিত হবেন না, কাব্যের নিয়মে তাদের ঘ্যাম বিঘ্নিত হবে না৷ 

তাদের হয়ে ভালোবাসার দু'টো জরুরী থাম্বরুল আপনার টাইমলাইনে গছিয়ে গেলাম৷ প্রেমে বিশ্বাস থাকলে এ নিয়মি দু'টোকে অবহেলা করবেন না৷ প্লীজ৷ 

প্রথমত, লুচি গুনতে নেই৷ পাত পেড়ে বসে লুচির হিসেব রাখতে নেই৷ লুচিকে অঙ্কে বেঁধে ফেললেই সর্বনাশ।

দ্বিতীয়ত, ভাজাভুজি বা তরকারিতে ফালা করে দেওয়া লঙ্কাদের না চিবিয়ে সাইড করতে নেই৷ নেই৷ বিশ্বাস করুন৷ মাইরি।

Friday, April 15, 2022

১৫২৯



- শুভ নববর্ষ ভায়া৷ 

- উফ, এই তুমি পিলে চমকে দেওয়া বন্ধ কর মাইরি৷ আরে বাবা আত্মা বলে কি নক করতে নেই? মিনিমাম ভদ্রতা না জানলে চলবে কেন? দুম করে শোওয়ার ঘরের ইজিচেয়ারে এসে বসাটা জাস্ট অসভ্যতা নয়?

- তুমি ভাই জ্ঞান দেওয়া বন্ধ করো৷ মড়াটি হয়েও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছ, নলিহাড় চিবিয়ে ছাতু করছ, হপ্তায় তিনদিন রেস্টুরেন্ট ঘুরে ঘুরে প্রেম করছ; আর আমায় দ্যাখো৷ পয়লা বোশেখের দিনে ফ্যাফ্যা করে এ'দিক সে'দিক উড়ে বেড়াচ্ছি৷

- শরীর বয়ে বেড়ানোর ঝামেলা তো পোয়াতে হচ্ছেনা তোমায়৷ সংসার রোজগারের টেনশনও নেই৷ ফুড়ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াও, গান গাও আর আমার কানের কাছে এসে টিপ্পনী ঝাড়ো। তোমারই তো সুখ ভাই৷

- আর কদ্দিন আমায় বাইরে ফেলে রাখবে বলো৷ তুমি তো আর অক্কা পাওনি৷ খামোখা আমায় সাইড করে এমন জম্বি হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে কী লাভ৷ 

- এই শুরু হলো৷ বলি জ্ঞান দেওয়া শেষ হলে মানে মানে কেটে পড়ো৷ আমি লুচি তরকারি খাবো৷ শেষপাতে ক্ষীরকদম৷ 

- আমায় ফিরিয়ে নাও ভাই৷ আত্মা-লেস হয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো৷ খাওয়াদাওয়া, মাইনে, দশ রকমের বারফাট্টাই; এ'সব করে আর কদ্দিন? ফ্রি উইল তো নেই৷ তুমি তো বাঁধা পড়ে আছো৷ কন্ট্রোলড বট! আমায় ফিরিয়ে নাও৷ বছরটা সত্যিই শুভ হোক।

- গেট আউট।

- তোমার চোখে আমি লোভ দেখতে পারছি ভাই৷ আত্মাকে আত্মস্থ করার লোভ৷ আমায় ফিরিয়ে নেওয়ার লোভ৷ প্রাণ খুলে গান গাওয়ার লোভ৷ গলা হেঁচড়ে প্রতিবাদ করার লোভ৷ ফিরিয়ে নাও না ভাই!

- নিকলো ইহা সে৷ ব্যাটাচ্ছেলে রাস্কেল! বেরোও!

**

- কী ব্যাপার হৃদয়হরণ? এমন হন্তদন্ত হয়ে..কিছু হয়েছে?

- আজ্ঞে, সবার আগে বলি নেতাবাবু ; শুভ নববর্ষ।  

- গোটা বছরটাই শুভ হে৷ দেশজুড়ে অপার শান্তি৷ দেশের প্রতিটা মানুষ আমাদের সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ সবাই সর্বক্ষণ গদগদ হয়ে আমার কথা ভেবে আমায় এবং সরকারের অন্য নেতানেত্রীদের কথা ভেবে মনে স্যালুট ঠুকে চলেছে৷ এমন সোনার সংসার, এমন হাইক্লাস ফাংশনাল ডেমোক্রেসি; শুভ না হয়ে উপায় কী বলো৷ 

- আজ্ঞে, সে তো বটেই৷ শুধু এই সোনার সংসারে একটা সামান্য খোঁচা৷ 

- সে কী! কার এত দুঃসাহস? 

- আজ্ঞে, কলকাতার সাত নম্বর মদন মল্লিক স্ট্রিটের ভবেশ দত্ত৷ 

- পাতি লোকের খবরে আমার কী কাজ ভাই হৃদয়হরণ?

- লোকটা পাতি৷ তবে তাঁর আত্মাটা মহাছ্যাঁচড়া৷ মাঝেমধ্যেই ভবেশ দত্তর আত্মা ওর বডিটকে এসে উস্কে যাচ্ছে৷ আজ  পয়লা দেখে সকাল সকাল এসে হানা দিয়েছিলে৷ আত্মা বডিতে ঢুকতে চাইছে৷  ভবেশ দত্তর বডিও রেস্পন্ড করতে শুরু করেছে৷ 

- আত্মা বডিতে ঢুকতে চাইছে? বডি নরম হয়ে আসছে? কী সর্বনাশ! তা'হলে সরকারকে দিনে বাহাত্তরবার স্যালুট ঠুকবে কে? আজ এক ভবেশ দত্তর আত্মা বিট্রে করছে৷ কাল গোটা কলকাতা৷ পরশু গোটা দেশ৷ সমস্ত বডি তারপর আত্মা ফিরে পেয়ে নাচুক আর কী! তারপর ফের রাস্তায় প্রতিবাদ, সোশ্যাল মিডিয়ায় হইহই৷ সরকার ডকে তুলতে চাও হৃদয়হরণ? 

- আজ্ঞে, সে'টা রিপোর্ট করতেই আসা। তা'হল কী..।

- ভবেশ দত্তর আত্মা যাতে ফেরার জন্য বডি না পায় সে ব্যবস্থাই করো হে৷ পলিটিকাল প্রটেস্টের মামদোবাজি আর সহ্য হবে না৷

- যো হুকুম ভাগ্যবিধাতা। যো হুকুম৷ ভবেশ দত্তের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলছি৷ তবে ইয়ে..।

- আবার কী..।

- নববর্ষের দিনে৷ যদি অভয় দেন, একটা আর্জি ছিল..।

- আর্জি? 

- আজ্ঞে, আত্মা হিসেবে আমি তো আর ভবেশ দত্তর আত্মার মত বেআক্কেলে নই। তবে একটা বিশ্রী শখ..।

- শুনি৷

- কদ্দিন শরীরের মধ্যে সেঁধিয়ে পৃথিবীটাকে দেখিনা৷ আমিও তো, আপনারই মধ্যে ছিলাম। অন্তত যদ্দিন না আপনি সরকারের মাথায় এসে বসেছেন৷ তদ্দিন তো..। আত্মা হিসেবেও আমি ক্ষয়ে গেছি৷ আমার দ্বারা প্রতিবাদটাদ আর হবে না৷ তাই, আজকের দিনটা কি আপনার মধ্যে ঢুকে যাব? একটু কবিতাটবিতাই পড়ব না হয়। ছোট ছেলেমেয়েদের দেখলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেব। সন্ধ্যেবেলা ছাতে বসে চা-মুড়ি খাব। শুধু এই নববর্ষের দিনটা! সুযোগ দেবেন? আমি তো আর অন্য কেউ নই৷

- তোমার ওপর আমার মায়া একটু আছে হৃদয়হরণ! একটু আছে৷ 

- চান্স দেবেন তা'হলে?

- তুমি এ'খানে একটু দাঁড়াও৷ আমি ভিতরের ঘর থেকে একটা জরুরী কাজ সেরে আসি৷ তারপর তোমার একটা হিল্লে করা যাবে। কেমন?

- যেয়াজ্ঞে৷ 

**

বহুক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন নেতা ঘরের বাইরে বেরোলেন না, আত্মা হৃদয়হরণ উশখুশ করে উঠলেন৷ বেলা বয়ে যাচ্ছে, অনেক কাজ পড়ে৷ দু'একবার হাঁক দিয়েও কোনও সাড়া পেলেন না৷ তবে আত্মাদের বেজায় সুবিধে, দরজা-টরজার মত ঠুনকো বাধায় আটকে যেতে হয়না৷ একরাশ হাওয়া হয়ে হুশ করে নেতার ঘরে ঢুকে পড়লেন হৃদয়হরণ।  দেখলেন, নিজের সুপরিচিত দেহটা সিলিংফ্যান থেকে ঝুলছে৷

Sunday, April 10, 2022

শক্তিগড় অপটিমাইজেশন থিওরি



দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে হুশহাশ বেরিয়ে গেলেই হল নাকি৷ শক্তিগড় এলে আপনাকে দাঁড়াতেই হবে৷ সঙ্গে জ্ঞানগর্ভ জ্যেঠু বা পিউরিটান পিসেমশাই থাকলে সেই পিটস্টপটা আরও মজাদার হয়ে উঠবে৷ তাঁরা হাইক্লাস ল্যাংচা সম্বন্ধে একটা ছোটখাটো লেকচার দিয়ে জানান দেবেন যে হাইওয়ের পাশের এইসব 'পেটি' দোকানের ল্যাংচাকে আদৌ পাত্তা দেওয়া উচিৎ নয়৷ তারপর আপনার অর্ডার দেওয়া  ল্যাংচাকে ক্রিটিসিজিমে ফালাফালা করতে করতে নির্দ্বিধায় উড়িয়ে দেবেন৷। এরা মিহিদানা সম্বন্ধেও তেমনই একটা চমকদার অ্যানালিসিস তুলে ধরবেন এবং বলাই বাহুল্য যে স্যাট করে মিহিদানার প্লেটটা সাফ করে আলাদা এক ডিবে প্যাকও করিয়ে নেবেন৷ আর তাঁরা এও জানাবেন যে সীতাভোগ ক্লাসিকাল মিষ্টির ব্র‍্যাকেটে পড়েইনা৷ আবারও আপনি অবাক হবেন দেখে যে সেই অখাদ্য সীতাভোগকে তাঁরা কী'ভাবে আলগোছে কাছে টেনে নিয়েছেন গল্পগুজবের আড়ালে৷ 

যাকগে৷ জ্যেঠু-পিসেমশাইদের বাদ দিয়ে বলি। শক্তিগড়ে হাইওয়ের পাশে না দাঁড়ানোটা অন্যায়৷ দেশে ডিসিপ্লিন বলে এখনও তো কিছু আছে, না কী! দেখবেন, গাড়ির ইঞ্জিন কেমন আপনা থেকেই ঢিমে হয়ে আসে শক্তিগড় পৌঁছনোর কয়েক মাইল আগে থেকে৷ আর বাসটাস হলে তো থামতেই হবে, পঞ্জিকায় বোধ হয় তেমনটাই প্রেসক্রাইব করা আছে। 

আর শক্তিগড় নেমে কচুরী তরকারি (বা ডাল) না খাওয়ার মানেই হয় না৷  আর হ্যাঁ, সে কচুরীর-তরকারি জমে ভালো মিহিদানা মিশিয়ে খেলে৷ একটা টুকরো কচুরী, তার মধ্যে তিনভাগ তরকারি আর একভাগ মিহিদানা৷ পরের কচুরী-গ্রাস মুখে পোরার আগে আগে আর এক ভরাট চামচ মিহিদানা৷ এইভাবেই সে মিহিদানার কদর করতে হবে। 

তবে হ্যাঁ৷ সীতাভোগকে কিন্তু মিহিদানার ফর্মুলায় ফেলা যায় না৷ সে জিনিস বেশ স্বতন্ত্র, লুচি-কচুরীর সঙ্গে খাপ খায় না। ইয়ে, সীতাভোগের 'এফেক্টিভনেস এনহান্স' করার একটা আলাদা ফর্মুলা রয়েছে বটে৷ শক্তিগড়ে হাইওয়ের পাশের প্রায় সমস্ত মিষ্টির দোকানের সামনেই রয়েছে ডিম-পাউরুটির ঠেলা৷ কাগজের প্লেটে সার্ভ করা ডিম-পাউরুটি সাপটে শেষ করুন৷ তারপর সেই প্লেটেই ঢেলে নিন সীতাভোগ। সে প্লেট কাছিয়ে সীতাভোগ খাওয়ার আনন্দই আলাদা৷

সবশেষে ঘিয়ে ভাজা ল্যাংচা এক বাক্স প্যাক করিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসুন৷ তারপর জ্যেঠু-পিসের মুখে "মিষ্টান্ন খাইবার আদর্শ উপায়" বিষয়ক পাঁচালী শুনতে শুনতে ফরওয়ার্ড মার্চ৷ শক্তিগড়কে ষোলোআনা উশুল করতে হবে তো, নাকী!

(ছবিটা বছর পাঁচেক পুরনো)

প্রিয় রেস্টুরেন্ট




আমার অন্যতম প্রিয় 'রেস্তোরাঁ'; এই বহু ঘষটানো গাড়িখানা৷ 

দোকান থেকে খাবারদাবার নিয়ে এসে ধীরেসুস্থে সাজিয়ে বসা৷ ব্যাকগ্রাউন্ডে গাড়ির স্টিরিওতে নিজের প্রিয় প্লেলিস্টের গান (মোবাইলে ক্রিকেট চললে তো কথাই নেই)৷ আর হ্যাঁ, ভ্যাপসা গরম বা ধুলোর উপদ্রব না থাকলে আর একটা সুবিধে আছে; চাইলেই জানালার কাচ নামিয়ে 'ওপেন এয়ার অ্যাম্বিয়েন্স' ৷ এর ওপর ধরুন ঘ্যাম রেস্টুরেন্টের মতই নরম হলদেটে আলো৷ আর এমন আরামদায়ক সুপরিচিত চেয়ার অন্য কোথাও পাওয়া সহজ নয়, সীটে ঠ্যাং তুলে বসলেও কেউ হা-হা করে উঠবে না৷ সুড়ুৎ-সড়াৎ করে আঙুল চাটলেও কেউ বাঁকা চোখে তাকাবেনা, এটিকেটের খোঁটা দেবে না৷ মেজাজটাই আসল রাজা, মেজাজ খোলতাই হওয়াটাই তো ফাইন ডাইনিংয়ের মূলে৷ 

সবচেয়ে বড় কথা; এই রেস্টুরেন্টের একমাত্র ওয়েটার হিসেবে আমি নিজেকে দারুণ খাতিরযত্ন করে থাকি৷ সর্বক্ষণ মুখে হাসি, সর্বক্ষণ তৎপর। সময়মত নিজেকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দেওয়া, চেবানো হাড় ফেলবার ঠোঙা এগিয়ে দেওয়া; সব ব্যাপারেই আমি অত্যন্ত চটপটে৷ আর হ্যাঁ, গাড়িতে মৌরিমিছরি গোছের মুখশুদ্ধিরও একটা স্টক মেন্টেন করা থাকে। 

একসময় যখন সেলসের কাজে বিহারের গ্রামেগঞ্জে ঘোরাঘুরি করতাম, তখন গাড়িতে ছাতুর ডিবে আর নুনের প্যাকেটও রেখেছি৷ আর থাকত স্টিলের গেলাস, চামচ আর অবশ্যই জল। আচমকা খিদেপেটে ধাবাটাবার খোঁজ না পেলে দিব্যি ছাতুর সরবতের গেলাস হাতে, সীট রিক্লাইন করে, সিঙ্গল মল্ট-লেভেল ঘ্যাম নিয়ে গা এলিয়ে বসেছি৷ গাড়ি তখন অলিপাব। স্টিরিওতে পঙ্কজ উদাস তালে তাল দিয়ে বলতেন; "গাড়ির ঘুপচি নয় হে এ'টা এখন৷ এ'টা পানশালা। তুমিই সাকী, তুমিই নেশায় আলুথালু পথিক। থোড়ি থোড়ি পিয়া করো। ইত্যাদি৷ ইত্যাদি"।

Saturday, April 9, 2022

মাধববাবু আর শনিবারের চা



দুপুরের মেনুতে মাংসভাত থাকার ফলে যা হওয়ার তাই হলো৷ ভাতঘুম হিসেবের বাইরে চলে গেল। সন্ধে সোয়া সাতটা নাগাদ চোখ কচলাতে কচলাতে রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল বসালেন মাধব চ্যাটার্জী৷ 

সসপ্যানে জল ফুটছে। মাধববাবু দু'কলি কিশোরকুমার গুনগুন করতে শুরু করেছেন৷ দুনিয়াটা ভীষণ রঙিন৷ 

চায়ের কাপ তৈরি৷ আদা-চায়ের প্রাণকাড়া সুবাসে ঘর গুলজার। কিশোর ততক্ষণে মাধববাবুর গলা ছেড়ে বসার ঘরে রাখা ব্লুটুথ স্পীকারে গিয়ে সেঁধিয়েছে৷ এমন সময় কলিংবেলের ট্যাঙট্যাঙানিতে রোম্যান্সের সুতো গেলো কেটে৷ বিকেলের চায়ের সঙ্গে অযাচিত আলাপটালাপ ভদ্রলোকের নিতান্তই না-পসন্দ৷ 

দরজা খুলে একটা ছোটখাটো আর একটা বড়সড় বিষম খেলেন মাধববাবু৷ দু'জন সরকারি অফিসার কটমটিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে। তাদের বিটকেল নীল-সবুজ চেক জামা আর কালো চশমাতেই মালুম হয়৷ একজনের হাইট অন্তত সাড়ে ছ'ফিট৷ অন্যজন নির্ঘাত পাঁচের নীচে৷ ছোটখাটো লোকটাই নেতা গোছের, কথাবার্তা তার সঙ্গেই হল৷

- আমি এজেন্ট ভবেশ দাস৷

- আজ্ঞে, আমি মাধব চ্যাটার্জী। 

- আমরা জানি৷ আপনার বয়স বাহান্ন৷ বিপত্নীক৷ নিঃসন্তান। পাইকারি বাজারে হালুয়ার ব্যবসা আছে আপনার৷ ট্যাক্সে ফাঁকি নেই৷ পুলিশের খাতায় কেস নেই৷

- আজ্ঞে৷ কিন্তু আপনারা..।

- আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে৷

- যেতে হবে?

- এখুনি৷ 

- আসলে চা'টা এখনও খাওয়া হয়নি৷

- পরশু থেকে যুদ্ধ৷ সেনাবাহিনীর লোক দরকার৷ আপনি চা নিয়ে চিন্তিত?

- স্যার, শনিবার বিকেলের চা। হেলাফেলা করলে দেশের অমঙ্গল যে।

- সময় নেই৷ বাজে কথা বন্ধ৷ ক্যুইক৷ কোনও জিনিসপত্র নেওয়ার দরকার নেই৷ ক্যুইক মার্চ জওয়ান।

- ভুঁড়ির ডেপথ দেখেছেন? হুটহাট দৌঁড়নোর কি উপায় আছে?

- বুস্কিয়ানাল্যান্ড আমাদের আক্রমণ করতে চলেছে।  অমন ঢিলেঢালা মেজাজ হলে চলবে না৷  আপনাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হবে। এজেন্ট হারু, ওঠাও মাধব চ্যাটুজ্জেকে।

**

এন্তার গোলাগুলি৷ রাস্তার এ'দিকে একজন বন্দুক হাতে তম্বি করছেন, অন্যদিক থেকে শত্রুপক্ষের এক সৈনিক ঠারেঠোরে জবাব দিচ্ছেন৷ এমন সময়, একদিকের বন্দুক থেমে গেল৷ একটা ভাঙা দেওয়ালের আড়াল থেকে ভেসে এলো চিৎকার। 

- রোক্কে রোক্কে রোক্কে।

- কী ব্যাপার হারামজাদা? রোক্কে রোক্কে করছিস কেন? হেস্তনেস্ত কর আগে৷ তারপর রোক্কে৷ এই চালালাম গুলি৷ 

- দেখুন স্যার৷ আমার একটা মাইডিয়ার নাম আছে। মাধব চ্যাটার্জী।  খামোখা হারামজাদা বলছেন কেন?

- তুই শত্তুর৷ তোর মুখে ছাই দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। আর তোদের সবার নাম হারামজাদা। 

- তা ঠিক৷ কিন্তু এ যে শনিবার সন্ধ্যে৷ 

- তা'তে কী রে রাস্কেল? ছুঁড়ব গ্রেনেড? 

- আরে ধেত্তেরিকা৷ বুস্কিয়ানাল্যান্ডের মানুষরা কি শনিবার বিকেলেও ব্যাজার মুখে খিটমিট করে চলে?

- খবরদার!  খবরদার যদি বুস্কিয়ানাল্যান্ডের বদনাম শুনেছি তোর মুখে৷ আর দেখে যাস উইকেন্ড ইভনিং কাকে বলে আমাদের দেশে৷ রিল্যাক্সিং টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। কেউ মগ্ন হয়ে বই পড়ছে৷ কেউ আলাভোলা গান গাইছে৷ কেউ সোফায় শুয়ে ভুলভাল কবিতা লিখছে৷ এক্কেবারে টোটাল শখের প্রাণ গড়ের মাঠ সিচুয়েশন৷

- তা আপনি এমন খ্যাটখ্যাট মাস্টার কেন? খালি গুলি গ্রেনেড বাতিক আর বাতেলা৷ আরে শনিবার সন্ধে হলো তো নাকি।

- আপনার মতলবটা কী বলুন দেখি মাধববাবু?

- আজ্ঞে৷ ফ্লাস্কে চা এনেছি৷ দুধ চা৷ আর ইয়ে, এই যুদ্ধের বাজারেও আদা জোগাড় করে চার্জ করেছি৷ তাছাড়া একটা ছোট ব্লুটুথ স্পীকার আছে, তা'তে কিশোরকুমার বাজিয়ে গান শোনা যাবে৷ 

- আদা চা? কিশোরকুমার?

- আজ্ঞে৷ 

- মাধববাবু৷ হারামজাদাটা উইথড্র করছি৷ তবে সে'টা শুধু চা শেষ হওয়া পর্যন্ত।

- হ্যাঁ৷ তারপরেই খুনোখুনি৷ বুস্কিয়ানাল্যান্ডকে ছেড়ে দেব ভেবেছেন? 

- ইয়ে মাধববাবু৷ আমার পকেটে দু'টুকরো ক্যারট কেক রয়েছে৷ আশা করি আপনার চায়ের সঙ্গে বেমানান হবে না৷

- আরে করছেন কী মশাই! মার্ভেলাস৷ 

- তা'হলে স্যাটার্ডে টী-ব্রেকের জন্য সীজ-ফায়্যারে বেরোচ্ছি কেমন?

- ওয়েলকাম স্যার৷ ওয়েলকাম।

- ইয়ে, আপনার প্লেলিস্টে 'পল পল দিল কে পাস' গানটা রয়েছে কি?

মিডিয়াম



হাইক্লাস মামলেট৷

তার বাইরেটা লালচে, অথচ ভিতরটা নরম। যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কায় পরিপুষ্ট৷

মিডিয়াম? অবশ্যই সর্ষের তেল৷

আবারও বলছি৷ মনে রাখবেন, ইংরেজি বাংলা- এ'সমস্তই মায়া। সেরা মিডিয়াম একটাই; খাঁটি সর্ষের তেল৷

ভোগ ও ভোগান্তি



- দেখেছিস?

- দেখছি।

- ঢালবে৷

- নির্ঘাত।

- ভোগান্তি।

- হবেই।

- জ্যাম।

- কাদা।

- প্যাচপ্যাচ।

- ম্যাজম্যাজ।

- তবে..।

- তবে?

- ভাল্লাগবে।

- জলকাদা?

- হাঁটব।

- বৃষ্টিতে?

- আলবাত।

- জ্বরকাশি?

- নেকু।

- হাত?

- ধরিস।

- ইয়ে।

- বাধা?

- না।

- তবে..।

- ঠোঙা।

- ঠোঙা?

- হাতে।

- কীসের?

- চপের।

সর্বঘটে চিলি চিকেন



বরাবরই বলে আসছি চিলি চিকেনের মত ফ্লেক্সিবল ব্যাপার আর হয়না৷ এমন মজবুত আইটেমকে স্রেফ চাউমিনের সঙ্গতে ফেলে রাখাটা অনুচিত। 

একসময় দুর্গাপুরে পরেশের ধাবার বিস্ফোরক ঝাল চিলি চিকেনের সঙ্গে অজস্র রুটি উড়িয়েছি৷ দিলখুসাতেও হাফ প্লেট চিলি চিকেনের সঙ্গে মিনিমাম ছ'খানা হাতরুটি অনায়াসে উড়ে যেত৷ শেয়ালদার কাছে অন্নপূর্ণা রেস্টুরেন্টে আবার চিলি চিকেন গ্রেভিতে ডুবিয়ে খেতাম রুমালি রুটি৷ বেগুসরাইতে একবার নেহাতই বিপদে পড়ে বাসি চিলিচিকেন আর তাজা পাউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেছি; অতি উপাদেয়। বলাই বাহুল্য যে সেদ্ধচালের ভাত চিলিচিকেনের ঝোল দিয়ে কষে মাখাটা অত্যন্ত সহজসরল আর স্বাভাবিক ব্যাপার; সে ঝোলভাতের পাশাপাশি সামান্য বিউলির ডালের বড়ার মুচমুচ অন্য ডাইমেনশন যোগ করে৷ 

তা দিল্লীর ইউনাইটেড কফিহাউস জবরদস্ত চিলিচিকেন বানায়, কলকাতার সঙ্গে দিব্যি টক্কর দেওয়ার মত। সে'খানে গতকাল খেলাম চিলিচিকেন পিজ্জা৷ দিব্যি জমজমাট।  সম্ভবত তাদের সিগনেচার ড্রাই চিলি চিকেনের টুকরোগুলো পিজ্জা ব্রেডের ওপর সাজিয়ে বেক করে দেওয়া৷ চমৎকার। বেজিং আর রোম যেন হাওড়া-ব্যান্ডেল মেনলাইনে পাশাপাশি দু'টো স্টেশন৷ 

এ'বার ভাবছি একদিন হাইক্লাস চিলিচিকেনের ঝোল দিয়ে মুড়ি মেখে দেখব৷ সঙ্গে মাংসের চপ। বলা যায়না, খাপে খাপ পড়তেও পারে৷

বিরিয়ানির টেক-আনবক্সিং

টেক রিভিউয়াদের চ্যানেলে,
তাঁদের মনোগ্রাহী একপেশে স্টাইলে;

বিরিয়ানির আনবক্সিং ও রিভিউ দেখতে চাই৷ 

প্রথমে দেখানো হবে কনফিগারেশনঃ
৮ জিবি মাটন,
অক্টাকোর আলু,
কোয়াড এইচডি চাল,
তেলতেলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর,
ইত্যাদি। 

তারপরে পার্ফমেন্স টেস্টিং৷

দেখনাইয়ের রেজোলিউশন,
ফাস্টচার্জিং সুবাস৷
বোকে মোডে নলিহাড়ের মায়া,
হাইডেফিনিশন মশলার মাপা ম্যাজিক,

সবশেষে ফাইনাল রেটিং;

জিভে ক'লিটার জল বইবে।
ট্যাঁক কতটা ধসবে। 
আর, মনের গোরিলা গ্লাসে সে বিরিয়ানি কতটা দাগ ফেলবে৷

তবেই না রিভিউ৷ 

কবে পাবো আমরা বিরিয়ানির MKBHD বা "'মোস্ট-কাব্যিক-বিরিয়ানি-হাভাতে-ডিউড"কে?

Sunday, April 3, 2022

নাগরদোলা



হুড়মুড়, হইহল্লা, আলো ঝলমল; মেলার সন্ধ্যে যেমনটা হয় আর কী৷ অঙ্ক টিউশনের গুমোট কাটিয়ে একদল ছেলেমেয়ে সেই মফস্বলি মেলা চষে বেড়াচ্ছে৷ ঢাউস খানতিনেক চপের দোকান, সে'খানে সবচেয়ে সস্তা এবং হাই-সেলিং আইটেম হল আলুর চপ৷ ছাত্রসমাজে আলুর চপের ভূমিকা নিয়ে রীতিমত এস্যে লিখতে পারে অনি৷ কিন্তু ক্লাস টুয়েলভের ছাত্রেদের সে'সব জরুরী বিষয়ে ভাবতে শেখায়না সিলেবাস৷
হাওয়াই মিঠাইয়ের চিনিগোলা ব্যাপারটা অনির তেমন পছন্দ নয়, কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে হাওয়াই মিঠাই হাতে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি না করলে মেলা আলুনি হয়ে পড়ে৷ সে ব্যাপারটা প্রায় ডিসিপ্লিনের পর্যায় পড়ে৷ এ'ছাড়া রয়েছে বন্দুকবাজি, বেলুন ওড়ানোর হুল্লোড়৷ সস্তা মনকাড়া জিনিসপাতির দোকানও অজস্র, সে'গুলো ঘুরে দেখাটাও গুরুদায়িত্ব৷ তবে আলুর চপ আর বন্দুকে উজাড় হয়ে যাওয়ার পর আর টিউশনফেরত ছেলেমেয়েদের তেমন কিছু কেনাকাটির দম থাকে না৷ বড়জোর দু'একটা পোস্টার, সস্তা ম্যাজিকের রসদ৷ আর সামান্য কিছুটাকা বাঁচিয়ে না রাখলেই নয়; মেলার স্লগওভারঃ নাগরদোলা৷
টিউশনির ব্যাচের সকলেই নাগরদোলায় চড়বে৷ ঢাউস একখানা চাকায় খানকয়েক টিনের আলখাল্লা বাক্স ঝোলানো। দোলা ঘুরবে, বাক্সগুলো মচমচ করে দুলবে৷ চলন্ত বাসের জানালায় কনুই রেখে বাপ-মায়ের ধমক খাওয়া ছেলেমেয়েরা এই খতরনাক চাকায় ঘুরপাক খেয়ে ফুর্তি করে৷ তবে অনির ব্যাপারটা আলাদা। ট্রেনের আপার বার্থে উঠতে গেলে তার বুক কাঁপে, রেলিং ছাড়া সিঁড়ি দেখলে গলা শুকিয়ে আসে৷ কাজেই নাগরদোলা অনির ধাতে সয়না৷
কিন্তু সে'দিনকার ব্যাপারটা আলাদা। সস্তা রেক্সিনের মানিব্যাগে রাখা শেষ দশটাকার নোটখানা বের করে টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেছিল অনি। কারণ তেমনটাই কথা ছিল।
- অনি! তুই এমন কাঠ হয়ে বসে আছিস কেন?
- কাঠ? ক..কই না তো দিব্যি তো। রি..রিল্যাক্স করছি।
- তোর ভয় করছে।
- ধ..ধুস। আসলে..এ'ভাবে বসলে ইকুলিব্রিয়ামটা নষ্ট হবে না। তাই।
- তোর গলা কাঁপছে।
- ন..না রে ঝুমি। খুব হাওয়া তো। খুব। প্লাস এই মুভমেন্টটা..সব মিলে তোর কানের মধ্যে যে ভাইব্রেশন হচ্ছে..।
- আর এই যে...তোর হাত বরফের মত ঠাণ্ডা..।
- হা..হাত?
- বরফের মত।
- ও। ও আমার বডি টেম্পারেচার একটু..একটু..কমের দিকে। থার্মোমিটারে নিরানব্বুই মানে..মানে আমার ধুম জ্বর।
- তুই ভালো করে চোখ খুলতে পারছিস না অনি।
- ম..মিঠে..মিঠে হাওয়া..আরামে চোখ বুজে আসছে..।
- তোর মুখ শুকিয়ে গেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঠিক করে তাকাতে পারছিস না। থামাতে বলব? চিৎকার করলেই হবে।
- ধ..ধুর..আমি তো ভাবছিলাম..আরও বার চারেক ঘুরব।
- এত ভয় যখন নাগরদোলায় উঠতে গেলি কেন?
- ভয়? ছোহ্! আমি..আমি দাবা খেলতে পারি এ'খানে বসে..ই..ইজি।
- তুই এত বড় গাধা কেন রে?
**
"অনি। কেমন আছিস?"
এই ফোনটা ছ'মাসে ন'মাসে একবার আসে অনির মোবাইলে। অফিস মিটিং, ডাক্তারের চেম্বার, বাজারঘাট; যে'খানেই থাক সে ফোন অনি ধরবেই। অবশ্য কথা বেশি দূর এগোয় না৷ কিন্তু বছর কুড়ি আগের সেই পাড়ার মেলার গন্ধ নাকে এসে ঠেকে; হাওয়াই মিঠাই, আলুর চপ মেশানো।
এই ফোনটা এলেই নাগরদোলায় বসা ধুকপুক ফেরত আসে। অনি টের পায় নিজের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
তবে ভয়ের চোটে ঝুমির হাত টেনে ধরা আর নেই।
আছে শুধু অনির গলা-বুক শুকিয়ে যাওয়াটা।
আর আছে অনির তলপেট ফাঁকা হয়ে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা।
আরও একটা ব্যাপার উবে যায়নি। ফোন রাখার আগে ও'পাশ থেকে ভেসে আসা চাপা ধমকঃ "তুই এত বড় গাধা কেন রে"?
**
- অনি, আজ টিউশনির পর সবাই মিলে মেলায় যাব। তুই যাবি তো?
- সদাগোপান রমেশের পোস্টার পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। রেয়ার। কলেক্ট করতে হচ্ছে।
- আমরা নাগরদোলায় চড়ব, কেমন? ওই ঢাউসটায়। একসঙ্গে। পাশাপাশি।
- নাগরদোলায়?
- হ্যাঁ। সবার সামনে তোকে আলাদা করব বলতে পারব না। চুপচাপ পাশে এসে বসবি।
- নাগরদোলাফাগরদোলা আমার পোষায় না।
- তুই ভয় পাস?
- ভয়? কী যে বলিস তুই ঝুমি। ব্যাপারটা অত্যন্ত জুভেনাইল। হাস্যকর।
- তুই এত বড় গাধা কেন রে?

হুতোমবাবু ও দাদা

- দাদা, হয়ে গেছে।
- হয়ে গেছে হুতোম?
- ঘরদোর সাফসুতরো। বাসনপত্র মেজে রেখেছি৷ বাথরুমের চারটে বালতিতে জল ভরে রাখা আছে৷ তোমার ওষুধের স্টক রিফিলিড৷ ডিনারে আলু পটলের তরকারি আর মাগুরের ঝোল৷ ফ্রিজে রাখা আছে৷
- তুই প্রতিবারই বড্ড বেশি পরিমাণে রেঁধে যাস৷ শেষে দু'বেলা ধরে খেতে হয়৷
- এমন হাইক্লাস রেঁধেছি দাদা, কম পড়লে হাত কামড়াতে।
- তোর তুলনা নেই হুতোম। তুই মার্ভেলাস।
- দাদা, এ'বার আমি আসি?
- বেরোবি?
- বেরোব না? সাতাটা বাজে৷ ট্যাক্সি নিলেও ফিরতে ফিরতে সেই রাত ন'টা৷ টিভি সিরিয়াল মিস হয়ে যাবে দাদা।
- শোন না হুতোম, আজ থেকেই যা না৷
- থেকে যাব? তা হয়না৷
- অদ্ভত গোঁয়ার গোবিন্দ তুই৷
- এ'টা গোঁয়ার্তুমি? যে বাড়ি থেকে বাবা আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে, সে বাড়িতে আমি রাত্রিবাস করব? নেভার৷ দ্যাখো দাদা, আমি আসি তোমার টানে৷ একা মানুষ, অসুস্থ৷ মায়ের পেটের ভাই না দেখলে আর দেখবেটা কে৷ কিন্তু তুমি আমায় রাত্রিবাস করতে বলবে না৷ খবরদার।
- বাবা বুড়ো বয়সে অভিমানে কী না কী বলেছে, তার জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে দিবি?
- বুড়ো সাংঘাতিক ধান্দাবাজ ছিল৷ সবে হিসেব করে বলেছে৷ আমায় স্ক্যান্ডালকুমার আর গবেটগ্যাম্বলার বলে খোঁটা দেওয়া? না হয় নিজের মাইনের দু'পয়সা জুয়ায় উড়িয়েছি৷ তার জন্য একটা দামড়া লোককে মাঝরাতে বাড়িছাড়া করবে?
- বাবা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল বটে৷ কিন্তু যে বেঁচে নেই, তার ওপর রাগ পুষে রাখবি রে?
- দাদা, আসি৷ আর এ'বার আয়া চেঞ্জ করো দেখি৷ এত কামাই করে। রোজ রোজ তো আর এদ্দূর ছুটে আসা সম্ভব হয়না৷
**
হুতোমবাবু সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে সামনের পানদোকান থেকে একটা খয়ের ছাড়া সাদা পান কিনে মুখে দিলেন৷
দাদাকে দেখতে এসে প্রতিবারই রান্নাঘরে ঢোকেন তিনি৷ নিজের হাতে দাদাকে রেঁধে খাওয়ানোর যে আনন্দ৷ আহা৷ বাবার কথা মনে পড়ে৷ হুতোমের হাতের রান্না পেলে বাবা রেস্তোরাঁর খাবারদাবারও পাশে সরিয়ে রাখতেন৷ কতবার মাকে ঠেস দিয়ে বাবা বলেছেন, "তোমার ছোটছেলের থেকে রান্নার টিপস নিলে পারো তো"৷ মা মিচকি হাসতেন; বড় নরম মানুষ ছিল মা৷ বড় মায়ার৷
প্রত্যেকবার বাড়ি ফিরে দাদার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে রান্না করেন হুতোম। প্রতিবার দুটো মানুষের জন্য রান্না করেন। কতবার মনে হয় "আজ থেকেই যাব। দুই ভাই মিলে এঁটো হাতে গপ্প জুড়ব"। কোনওবারই থাকা হয়না।
তবে হুতোমবাবু নিশ্চিত, একদিন ঠিক তিনি টিভি সিরিয়ালের টানে হুড়মুড় করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন না। দু'জনের জন্য করা রান্না দাদাকে দু'বেলা জুড়ে একলা খেতে হবে না।