Wednesday, April 29, 2020

পেন্টাগনের চোখে


- আরে! এ'টা কী?

- একটা সাধারণ রিমোট চিনতে অসুবিধে হচ্ছে হে?

- না মানে, আপনার ঘরে তো টিভি বা রিমোটচালিত কিছুই নজরে পড়ছে না..।

- রিমোট বলতেই টিভি মনে পড়ে। এই না হলে নাইনটিজ কিড। নাহ্, তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া মানে চানাচুর জলে ভিজিয়ে খাওয়া। 

- বলুন না, কীসের রিমোট এ'টা?

- ও'টা দিয়ে আমি সেল্ফি তুলি।

- সেল্ফি? কিন্তু আপনার মোবাইল...।

- আমি মোবাইলে সেল্ফি তুলব? আমি? হাসালে। 

- তবে? তা'হলে এই রিমোট দিয়ে..?

- ওই রিমোট দিয়ে আমি ড্রোন ওড়াচ্ছি। সে ড্রোন গোটা দুনিয়া অবজার্ভ করে চলেছে আর আমায় খবর পাঠিয়ে চলেছে। ঘোরাঘুরির বয়স তো আর নেই, সে ড্রোনের দেওয়া খবরাখবরের ওপর নির্ভর করেই বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বাতলে দিতে হয় আজকাল। তা সেই খবর দেওয়ার কাজটা সে ড্রোন বাবাজী বেশির ভাগ সময় আড়াল থেকেই করে। আর মাঝেমধ্যে বিভিন্ন মোলায়েম অ্যাঙ্গেল থেকে আমার ছবি তুলে  আমায় পাঠাচ্ছে। আমার ছবি তোলার সময় অবশ্য সে ড্রোনকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। 

- কিন্তু মেসের কেউ তো সে ড্রোন..।

- দেখেনি। জানি। তোমরা দেখতে পাওনি, সে'টাই তো স্বাভাবিক। ঘনশ্যাম দাসের ড্রোন তো আর ছেলেমানুষের ঘুড়ি নয় যে মেসের কচিছেলেরা তা দেখে হাহুতাশ করবে আর পদ্য লিখবে৷ সে ড্রোন তোমাদের চোখে পড়ার কথাও নয়৷ তবে পেন্টাগনের চোখে পড়েছে..এই আর কী।

গুরু আর হিমালয়

- পটা। অ্যাই পটা। আরে অ্যাই পটা!

- গুরু, অত চেঁচিও না। যোগব্যায়ামের ফোকাস নষ্ট হচ্ছে।

- নেকুচন্দর খাসনবীশ, যোগব্যায়ামের ফোকাস নষ্ট। বলি মান্থ এন্ডের রেভিনিউ স্টেটমেন্ট কই।

- কী হবে ও'সব দিয়ে বলো গুরু৷ তার চেয়ে বরং চলো; স্টকের আমতেল দিয়ে কষে মুড়ি মাখি। দু'জনে মিলে চিবুতে চিবুতে গপ্পগুজব করব, চারটে ইলিশ শ্যামল মিত্তিরের গান গাইব; ব্যাস, আজকের সন্ধ্যেটা আলগোছে কেটে যাবে।

- তোকে পিটিয়ে তক্তা করে দিতে পারলে তবে আমার শান্তি হয়। মাসের শেষ, ব্যবসার হিসেবকিতেব না করে হারমোনিয়াম বাজাব? মা লক্ষ্মী জুতোপেটা করবে যে।

- লকডাউন চলছে গুরু। খামোখা চাপ নিতে যেও না, এ করোনার বাজারে মা লক্ষ্মীও স্যাটাস্যাট নেমে আসতে পারবেন না৷ তা বলছিলাম, মুড়িতে কিন্তু অল্প কাঁচালঙ্কা কুচি না দিলে আমার চলবে না।

- শাটাপ পটা। শাটাপ। আমরা এ'দিকে মুড়িমাখা গিলি আর ও'দিকে দয়ালগুণ্ডার সিন্ডিকেট আমার মার্কেট ক্যাপচার করে নিক আর কী।

- আরে ধ্যাত্তেরি। কীসের মার্কেট ক্যাপচার করবে? কিডন্যাপিংয়ের বাজারে ঘুঘু চড়ছে। কেউ ছাই বাড়ি থেকেই বেরোচ্ছে না তায় তাদের কিডন্যাপিং।  আবার ছেলেরাও কিডন্যাপফিডন্যাপ করতে চাইছে না, কোন মাল কী বিষ ভাইরাস নিয়ে ঘুরছে তা বোঝা মুশকিল। বাজারে লোকজন মাঝেমধ্যে জমছে বটে তবে এই এক মিটারের তফাতে দাঁড়িয়ে পকেটকাটা যে অসম্ভব গুরু; কাজেই সেখান থেকেও রেভিনিউ কাঁচকলা। আর অন্যদিকে পলিটিক্সের ঝিঙ্কু দাদারা আর কালাটাকা ওড়ানো বিজনেসম্যান জ্যেঠুরাও সবাই নেতিয়ে পড়েছে; কাজেই ক্যালানির অর্ডারও তেমন আসছে না। মার্কেটফার্কেটই কিছু নেই; তা'তে কীসের কম্পিটিশন আর কীসের মান্থ এন্ড স্টেটমেন্ট।

- অমন কড়া কথা মুখের ওপর বলতে নেই পটা।

- কড়া। কিন্তু খাঁটি গুরু।

- টাকাপয়সা নিয়ে ভাবিনা রে পটা। টাকাপয়সা নিয়ে ভাবিনা। আমি নির্লোভ নির্লিপ্ত মানুষ। আজ বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছিস; তোফা তোফা করে খাব। কাল সাবু মেখে খাওয়াবি, তাও সোনামুখ করে খেয়ে নেব। পরশু বলবি লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে হিমালয়ের দিকে চলে যেতে, হাসিমুখে কেটে পড়ব।  চিন্তা শুধু একটাই; প্র‍্যাক্টিসের অভাবে এই হাইক্লাস স্কিলগুলো যেন হারিয়ে না যায়।

- সে' চিন্তা অবিশ্যি নেহাৎ ফেলনা নয় গুরু। হাঁটুর হাড় কীরকম গুঁতো মেরে ভাঙলে মানুষ সহজে সারেন্ডার করে সম্পত্তির কাগজে সই করে দেবে, ব্লেড কোন অ্যাঙ্গেলে চালালে হিপপকেটের মানিব্যাগ টুসটুসে আমের মত খসে পড়বে; এ'সব স্কিল তো আর ঘরে বসে পালিশ করা যায় না। 

- আমাদের কী হবে বল তো পটা?

- ছাতুর যা স্টক আছে, আরও মাস দেড়েক চলে যাবে। তারপর হিমালয়টিমালয় নিয়ে ভাবব'খন৷ 

- আমাদের ব্যাঙ্কে কত আছে রে পটা?

- ব্যাঙ্কে? হোয়াইট মানি? সাতশো চুয়ান্ন টাকা। গতমাসেই পাসবই আপডেট করিয়ে এনেছিলাম। 

- আর ওই সোফার নীচে আমাদের ওই গোপন গর্তে লুকোনো টাকা?

- ক্যাপিটাল? বত্রিশ লাখ বাহাত্তর হাজার তিনশো উনিশ টাকা। পরশুই গুনলাম তো। তা, তোমার মতলবটা কী বলো তো গুরু?

- টাকাটা থলেতে ভরে নিয়ে আয়।

- সে কী! 

- যা বলছি তাই কর পটা। ক্যুইক।

- কিন্তু করবেটা কী?

- কারা যেন কমিউনিটি কিচেন খুলেছে। শহরজুড়ে, অনেকগুলো। কত মানুষের স্টকে নাকি আমতেল নেই, মুড়ি নেই, এমন কি ছাতুও ফুরিয়েছে। মধুমাস্টারই বলল আমায়। ওই বত্রিশ লাখ বাহাত্তর হাজার তিনশো উনিশ ওদের হাতে তুলে দিলেই বরং...।

- তুমি খেপেছ গুরু? ওই মধুমাস্টার এক খ্যাপা আর তার পাল্লায় পড়ে তোমারও মাথাটা গেছে। শুরুতেই বুঝেছিলাম তোমার কোনও মতলব আছে। শুনে রাখো, ও টাকা প্রাণ থাকতে আমি তোমায় নিতে দেব না।

- শাটাপ পটা। তোর এত বড় সাহস? গুরুর মুখে মুখে তর্ক? তুই না আমার চ্যালা?

- দলে নেওয়ার সময় তুমি ব্লেড দিয়ে আঙুলের ডগা চিরে রক্ত নিয়ে শপথ করিয়েছিলে গুরু। কিডন্যাপিং, পকেটমারি আর গুণ্ডমি ছাড়া আমাদের কোনও ধর্ম নেই, ট্রান্স্যাকশনও নেই। থাকতে পারে না। তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ গুরু। ছিঃ ছিঃ, মধু মাস্টারের পাল্লায় পড়ে শেষে কিনা তুমি দানধ্যান করবে? এই তোমার এথিক্স গুরু? চ্যারিটি? ধর্মে সইবে? ছিঃ, তোমার সমস্ত শিক্ষা মিথ্যে। 

- আহ, কতবার বলব পটা। অমন কড়া কথা মুখের ওপর বলতে নেই। নেই। 

- কড়া কিন্তু খাঁটি।

- মধুমাস্টার বারবার বলছিল রে, মানুষের বড় কষ্ট৷ ওই টাকাগুলো যদি মাস্টারের হাতে তুলে দেওয়া যেত তা'হলে..।

- তার আগে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে গুরু৷ বিজনেসের টাকা বিজেনেসেই লস খেয়ে গোল্লায় যাক, তা'তে ক্ষতি নেই। কিন্তু এ টাকা দানধ্যানের জন্য বিলিয়ে দিলে আমি গলায় দড়ি দেব। 

- গলায় দড়ি? ভর সন্ধ্যেবেলা অমন কথা তুই বলতে পারলি পটা? ছেলেবেলা তোকে কোলেপিঠে মানুষ করেছি। নিজের হাতে পকেটকাটা শিখিয়েছি, নাকে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল চেপে ধরা শিখিয়েছি, বন্দুক বাগিয়ে চমকানো প্র‍্যাক্টিস করিয়েছি; আর আমায় শেষে কিনা তোর মরা মুখ দেখতে হবে! চুলোয় যাক মধুমাস্টার। দিস না তুই ওই টাকা। তার চেয়ে বরং মুড়িই মাখ। আর আন দেখি হারমোনিয়াম, আসর বসাই।

- যাক। বাঁচালে। তুমিই তো বলো গুরু, সবার আগে নিয়ম। নিয়ম ফেল করলেই দল ডুববে। গুরু হয়ে তুমি নিজেই নিয়ম ভাঙবে তা আমি কী করে হতে দিই বলো। যাকগে, তুমি মিনিটখানেক বসো। আচমকা মনে পড়ল মুড়ির টিন ফাঁকা পড়ে আছে। আমি হৃদয়দার দোকান থেকে দু'প্যাকেট মুড়ি নিয়ে আসি৷ চিন্তা নেই, মুখে মাস্ক পরে বেরোব, করোনাকাকার নজর আমার ওপর পড়বে না। 


***

- কী বলছ তুমি মধু মাস্টার! তুমি পটাকে দেখেছ?

- এইত্তো, খানিক আগেই। বিশুর চায়ের দোকানের পিছন দিকটায়। পটাই তো সেধে এসে কথা বললে তো। আর ওই তো আমায় তোমার কাছে পাঠালে। 

- দ্যাখো কাণ্ড মাস্টার। দ্যাখো কাণ্ড। এদিকে আমি ভয়ে কাঠ। ভর সন্ধ্যেবেলা বেরোল মুড়ি আনতে আর তারপর টানা তিনদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। এক্কেরে গায়েব। এ'দিকে চিন্তায় আমি মরি আর কী। আসুক শালা এদিকে, ওর চামড়া তুলে যদি আমি গামছা না বানিয়েছি তো...।

- যাকগে, আমায় বলল এ চিঠিটা তোমায় দিতে। তাই তোমার কাছে এলাম কেষ্ট। 

- চিঠি? মাস্টার?

- এই সেই চিঠি।।


***

গুরু, 

আপনার স্যাঙাৎ শ্রীমান পটাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। বত্রিশ লাখ বাহাত্তর হাজার তিনশো উনিশ টাকা মুক্তিপণ না দিলে তার লাশ আপনার বাড়ির সদর দরজার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। পুলিশে খবর দেবেন না, তাতে গোলমাল বাড়বে বই কমবে না।

মুক্তিপণের টাকাটা যেন অবিলম্বে মধুমাস্টারের হাতে নগদে তুলে দেওয়া হয়। আবারও বলছি, ওপরচালাকির ফল ভালো হবে না।

ইতি,

শ্রীপটা ওরফে নেকুচন্দর খাসনবীশ। 

পুনশ্চ ১ঃ 
তুমিই তো বলো গুরু; আমাদের ব্যবসা কালো কিন্তু হিসেবকিতেব পাকা। কিডন্যাপিং পকেটমারি গুণ্ডামির আয় ওই টাকা; আমাদের কালো ব্যবসার মূলধন। সৎকাজে ব্যয় করলে লোক হাসানো হবে যে। তার চেয়ে এই ভালো, উৎপাতের ধন চিতপাতে গেল। তাছাড়া তিনদিন আড়ালে থেকে ফলো করেছি মধুমাস্টারকে, লোকটা সত্যিই ভালো। ওর দলের লোকজনও মন্দ না। খেটে কাজ করে, লোকের উপকারই করে বেড়ায়। টাকাটা মুক্তিপণ হিসেবে দিলে বরং মধুমাস্টারের কাজেও লাগবে আবার তোমার গায়ে পুণ্যের কালোদাগ লাগবে না। 

পুনশ্চ ২ঃ

মধুমাস্টারের দলে লোক দরকার গুরু। কত কাজ। বিশেষ দরকার রাঁধুনির।  তোমার খিচুড়ি রান্নার হাতটা তোফা। আর নিজের মুখে আমার রান্না লাবড়ার গুণগান করতে বাঁধছে৷ কী বলো? 

হিমালয় তো সবার কপালে থাকে না, এদের সঙ্গেই ঝুলে পড়বে নাকি? 

Tuesday, April 28, 2020

নিতাইদার আত্মজীবনী



- নিতাইদা গো..। 

- সিগারেট চেয়ে লাভ নেই ভাইটি। বাক্স খালি। এই দ্যাখ।

- আহ, ধান্দা ছাড়া কি তোমায় মাইডিয়ার টোনে ডাকতে নেই গো? কত রেস্পেক্ট করি তোমায়।

- মদে রেস্পেক্ট-ভালোবাসার পরিমাণ সামান্য বাড়ে বটে।

- পেটে দু'পেগ রাম পড়েছে বলে বলছিনা নিতাইদা। এই যে ছ'সাত মাস অন্তর কলকাতা আর সংসার ছেড়ে তোমার এই মগরার ব্যাচেলর প্যাডে দু'রাত কাটিয়ে যাই, তার মূলে কিন্তু ওই; ডীপ অ্যান্ড সিনসিয়ার রেস্পেক্ট। আর অন টপ অফ দ্যাট..আ বুক ফুল অফ ভালোবাসা। 

- বুঝলি পলাশ, তোর মত ছেলেবেলার চ্যালাচামুণ্ডাদের আনাগোনা আছে বলেই...আমার এই একার গেরস্থালীও গুলজার রয়েছে।

- নিতাইদা, তুমি এই স্কুলমাস্টারি নিয়ে পাড়া ছাড়ার পর থেকে গোটা পাড়াটাই কেমন ম্যাদা মেরে গেল। দলের ছেলেপিলেরাও সবাই চাকরীবাকরি নিয়ে এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল..।

- পাড়ার কথা আমারও খুব মনে পড়ে রে।

- তা'হলে আর আসো না কেন?

- বাপ-মা নেই। তোরা এখনও ভুলিসনি, এখানে মাঝেমধ্যেই ঘুরে যাস। আর ফিরব কী জন্য বল।

- তোমার মনে পড়ে নিতাইদা? তোমার ক্যাপ্টেনসি আর অফস্পিনে ভর দিয়ে আমরা টানা তিন বছর টুর্নামেন্ট জিতেছিলাম? 

- ওই সেই ভবতারণ সমাদ্দার স্মৃতি ট্রফি তো? ফাইনালিস্টদের পিকনিক করার জন্য টাকাও দেওয়া হত মাইরি। 

- হরেনদার দোকানে গেলেই এখনও ও তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।

- ওর বানানো চা আর পোচের স্বাদ ভোলবার নয়।

- আর টুপাইদির সঙ্গে কম্পিটিশনে খাওয়া ফুচকা? তার স্বাদ? 

- টুপাই। টুপাই। 

- ব্যথা পেলে?

- ব্যথা যে'টুকু পেলাম তা ফুচকার কথা মনে করালি বলে রে। পাড়ার বিনোদদার ফুচকা খেয়েছি বলেই বলছি, বিনোদদার ট্রেনে কাটা পড়াটা ফুচকা-শিল্পের জন্য যে কী ভীষণ  ড্যামেজিং...ভাবলেই শিউরে উঠি। 

- তোমার পেটেও তো দু'পেগ পড়েছে দাদা৷ টুপাইদি সম্পর্কের ব্যথাটুকু একটু ঝেড়ে কাশো না।

- তোদের সবার কানটান মুলে ক্যালকুলাসে মোটের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছিলাম৷ শুধু টুপাইটার ফাউন্ডেশন এতটাই উইক ছিল...তেমন কিছু করা গেল না। আচ্ছা, ওর একটা মেয়ে হয়েছে না? আশা করি ওর মেয়ে অন্তত ওর ক্যালকুলাস-ইগনোরেন্সটা ইনহেরিট করবে না। 

- একটা কথা বলি গো নিতাইদা?

- পেটে কথা চেপে রাখলে ওল্ড মঙ্কের ইনসাল্ট রে পলাশ। চটপট বলে ফেল।

- তুমি এককালে তো লেখালিখি কম করতে নাম। কত পত্রপত্রিকায় সে'সব নিয়মিত ছাপাও হত। তা, নিজের বায়োগ্রাফি একটা লেখো না৷ তোমার লাইফে যে কী লেভেলের মশলা লুকিয়ে আছে তা তো আর আমার অজানা নয়। এক্কেবারে জম্পেশ হবে কিন্তু। 

- আমার জীবনী? 

- ইয়েস। তোমার জীবনী তো রীতিমত নভেল। লেখোই না। আমার ব্রাদার ইন ল'টি আজকাল পাবলিশার হিসেবে বইপাড়ায় কিঞ্চিৎ সুনাম অর্জন করেছে...তুমি যদি লেখ তা'হলে আমি বলে কয়ে...।

- সে কাজ অলরেডি করে রেখেছি।

- তোমার জীবনী? আইশ্লা...রেডি?

- টোটালি। তবে লিখেটিখে নয়। ফর্ম্যাটটা অন্য। 

- মাথায় রাম রাম ঝিমঝিম, হেঁয়ালি সইবে না নিতাইদা। কই তোমার বায়োগ্রাফি? দেখাও দেখি।

- একটা জবরদস্ত কোলাজ ফর্মে রয়েছে।

- কোলাজ?

- কোলাজ। ওই দ্যাখ।

- ও'টা...? ওই বেঢপ বুকশেল্ফগুলো? 

- ইয়েস। আমার বায়োগ্রাফিকাল কোলাজ।

- মাইরি নিতাইদা, আমি বেশি মাতলামি করছি না তুমি করছ, কে জানে।

- না রে পলাশ।  মাতলামি নয়। প্রতিদিনই এই বুকশেল্ফের দিকে আমি একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। ওই যে, নীচের দিকে দেখ; রাদুগা প্রকাশনীর রাশিয়ান রূপকথার বই। আমার দাদু ছেলেবেলায় কিনে দিয়েছিলেন; তখনও আমি পড়তে শিখিনি, শুধু পাতা ওল্টাতাম আর ছবি দেখতাম হাঁ করে। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলেদের মহাভারত দিদার দেওয়া, কী'ভাবে যে বইয়ের ভিতরে সতেরো নম্বর পাতায় দিদার রান্না করা হাতের হলুদের ছোপ লেগেছে জানিনা। খুব আবছা একটা দৃশ্য মনে পড়ে; দিদা রান্না করছে আর আমি একটা ছোট্ট কাঠের টুলের ওপর বসে ওই বই নাড়াচাড়া করতে করতে দিদাকে হাজার রকমের প্রশ্ন করছি৷ আর ওই বইটা দ্যাখ, ওই যে নীল বাঁধাইয়ের। ওটা অস্কার ওয়াইল্ডের সেল্ফিশ জায়ান্ট আর অন্যান্য নির্বাচিত গল্প। ক্লাস সেভেনের অঙ্ক পরীক্ষায় হাইয়েস্ট নম্বর পাওয়ার জন্য প্রাইজ। ওই বই ছুঁয়ে আমি টের পেয়েছিলাম আমি অঙ্ক ভালোবাসি। প্রসেসটা বোঝানোর ভাষা আমার নেই, তবে ভালোবাসা যেমনটা হওয়া উচিৎ আর কী; ভালোবাসি, ব্যাস৷ সেই প্রাইজ পাওয়ার দুপুরটা আমার আজও মনে আছে; অঙ্কের মাস্টার মধুময় স্যার স্টেজে সেদিন সে বই হাতে তুলে দিয়েছিলেন আবার স্টেজে দাঁড়িয়েই কানও মলেছিলেন পরীক্ষায় একটা কেয়ারলেস ভুলের কথা মনে করিয়ে। এ'বার এই শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনীর বইটা দ্যাখ, ওই যে, ওপরের তাকের ডান কোণে। বাবা আমার মধ্যে ইতিহাসের প্রতি সমীহ ইঞ্জেক্ট করেছিল ওই বই থেকে পড়ে শুনিয়ে। শরদিন্দুর গল্পের ঘাড়ে বাবা চাপিয়ে দিতেন নিজের কিছু ফ্যাকচুয়াল ফুটনোট। বাবার কণ্ঠস্বর কানের মধ্যে গমগম করে ওঠে জানিস; ওই বইটার দিকে তাকালেই। মা আর আমি প্রায় একসঙ্গে পড়েছিলাম লোটাকম্বল; তখন আমি ক্লাস নাইনে বোধ হয়। এই বই পড়ার ব্যাপারে আমাদের বাড়িতে অদ্ভুত সাম্যবাদ ছিল। আমি কোনওদিন শুনিনি, ছোট বলে অমুক বই পড়তে পারব না। ওই দেখ, মাঝের তাকে ওই ছেঁড়া মলাটের লোটাকম্বলটা রাখা আছে। মা যেদিন মারা গেল, শ্মশান থেকে ফিরে গোটা রাত আমি শুধু সঞ্জীব পড়েছিলাম জানিস। সে সব কটা বইই মজুদ আছে, সে রাত্রের কান্না আর গন্ধ সমস্ত ওই বইগুলোয় জড়িয়ে। আর ওই যে শিব্রাম সমগ্রটা...দেখেছিস? হ্যাঁ ও'টা। ওইটে ছিল আমার প্রথম প্রেমের এনভেলপ।

- কী? কীসের এনভেলপ?

- টুপাই ওই বইটা ধার নিয়েছিল পড়বে বলে। ফেরত পাওয়ার পর দেখি পাতার ফাঁকে একটা দু'পাতার চিঠি। টুপাইয়ের ক্যালকুলাস নড়বড়ে হতে পারে, কিন্তু ওর হাতের লেখা সত্যিই মুক্তোর মত। আর আমার সব মিলে একশো তেরোটা চিঠি লিখেছিল; কোনওদিনও একটাও বানান ভুল করেনি। যাকগে। ওই যে পুরনো পুজোসংখ্যাগুলো দেখছিস; আমি প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি উপন্যাস কোন দিন কাদের পাশে বসে শেষ করেছি, সবটুকু গড়গড় করে বলে যেতে পারব। আর এই যে, দ্বিতীয় তাকে জ্বলজ্বল করছে দ্যাখ।  আমার পাড়া ছাড়ার ফেয়ারওয়েলে তোরা...অর্থাৎ মাই ডিয়ারেস্ট চ্যালাচামুণ্ডাসরা এই আধবুড়োকে হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল আর নন্টে-ফন্টে সমগ্র উপহার দিয়েছিলিস। ওল্ডমঙ্কের বোতল আমার একা খুলতে ইচ্ছে করে না, তাই একা থাকলে নারায়ণ দেবনাথই আমার জন্যআইডিয়াল ফর্ম অফ স্কচ। কারণ ওই কমিক্সের বইগুলোর প্রতিটি পাতায় রয়েছে ভবতারণ সমাদ্দার স্মৃতি ট্রফি জেতানো উত্তেজনা। 

- হেহ্। বুঝলাম।

- দ্যাখ পলাশ। মোদ্দা কথা হল, আমার এই বাড়ির খানতিনেক বইয়ের শেল্ফ জুড়ে যে শ'চারেক বই রয়েছে; সেগুলোর আত্মাকে আমি লেখক ও প্রকাশকের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের পোষ্য করে রেখেছি। ওগুলো এখন শুধুই আমার হয়ে,আমার জন্য আমার গল্প বলে। সে গল্পগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে একটা চমৎকার বায়োগ্রাফি তৈরি হয়। অ্যাকশন, থ্রিল, রোম্যান্স, ট্র‍্যাজেডি, ইমোশনাল ওভারডোজ; কী নেই সে'খানে। যাকে বলে;  রীতিমতো সিনেম্যাটিক। রোজ আমি এই বইগুলোর সামনে এসে দাঁড়াই আর নিজের জীবনের এক একটা চ্যাপ্টার সিনেমার মত চোখের সামনে ভেসে ওঠে।  আলাদা করে লেখালিখি করে, প্রকাশক ধরে, পাঠক পাকড়াও করে এ ম্যাজিক নষ্ট করার মানে হয়? তুইই বল?

ট্র‍্যায়ো

কে যেন বললে যে প্রতিদিন সকালে খালিপেটে একটানা দশ মিনিট কমল মিত্রর ডায়লগ শুনলে নাকি "ইমিউনিটি বাড়ে"।

***
"সামনের ছুটিতে পাহাড়ে যাব" ইস কুল।

অবশ্যই। নিঃসন্দেহে। 

তবে।
তবে। 

"একটা গোটা দিন পাহাড়ি সান্যালের পান্তুয়া মেজাজের অভিনয় দেখে কাটিয়ে দেব" ইস কুলার৷

***
গলায় তরোয়ালের কোপ পড়লে ছবি।

ও'দিকে আল্ট্রা-ধারালো সারকাজমের কোপ পড়লে ছবি বিশ্বাস।



বৃষ্টি ও মাদুর


হুড়মুড় করে ঘরের উত্তর দিকের জানালাটা বন্ধ করার আগেই বিছানার অর্ধেকটা ভিজে গেল বৃষ্টির ঝাপটায়। কয়েক সেকেন্ডের বৃষ্টিতেই বালিশ তোষক সব সপসপে।

একরাশ বিরক্তি চেপে ধরেছিল অমিয়কে। একে অফিসের কাজের চাপে জেরবার অবস্থা, তারপর রোজ ফেরার পথে অটোর লাইনে হয়রানি, বাসের ভিড়ে ধ্বস্তাধস্তি আর বাড়ি ফিরে হাত পুড়িয়ে ভাতেভাত রান্না করা। শরীরে এতটাই ক্লান্তি নিয়মিত জমা হয় যে রাত্রে খাওয়া সেরে ফেলার পর টেলিভিশন বা গল্পের বইতে মন বসানোও দায় হয়ে পড়ে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই যেন শান্তি। অথচ কয়েক মুহূর্তের অবহেলায় বিছানাটাই ভিজেটিজে মাটি হল। ধুত্তোর।  এই এক কামরার ঘর, ওই খাট আর মায়ের রেখে যাওয়া আলমারিটা বাদে আসবাব বলতে আর কিস্যুই নেই; সামান্য সোফাও নেই যে সে'খানে লম্বা হয়ে অমিয় রাতটা কাটিয়ে দেবে।

ক্লান্তি, ঘুম আর জিভে লেগে থাকা নিজের হাতে পোড়ানো ভাতের স্বাদ; সব মিলে অমিয়র যে কী বিশ্রী লাগছিল। কোনও রকমে মেঝেতে একটা চাদর পেতে শুয়ে পড়লে সে। 

নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ছবিটার দিকে চোখ যেতেই বুকের ভিতর কেমন একটা চিনচিনে ভাব দলা পাকিয়ে উঠল অমিয়র। যদ্দিন মা ছিল, তদ্দিন এ সংসারে কেমন যেন সংসারের সুবাস লেগেছিল। মাসকাবারি ছিল, আলমারিতে ন্যাপথালিনের গন্ধ ছিল, এক চিলতে রান্নাঘরটায় পরিপাটি শান্তি ছিল। মায়ের ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে শুলো অমিয়।

মেঝেয় পাতলা চাদর পেতে শোওয়া, কেমন যেন একটা কনকনে ছ্যাঁত অমিয়র গা বেয়ে উঠে আসছিল। সে দিব্যি বুঝছিল আজ রাত্রে আর কপালে ঘুম নেই। এমন সময় মোবাইলটা উঠল বেজে।

- হ্যালো।

- আমি।

-  মিনু, এত রাত্রে? কী ব্যাপার..।

- না মানে, তেমন কিছু না। 

- সব ঠিক আছে তো? তোর বর মেয়ে?

- আমার জন্য অত চিন্তা থাকলে নিজে ফোন করে আমার খবর নিতিস অমু।

- তাই বলে এই রাতবিরেতে...।

- জানি। কল করা উচিৎ নয়। শুধু ওই..।

- শুধু কী?

- আমাদের বিয়ে যে হয়নি তার দায় কিন্তু একা আমার নয় অমু।

- এদ্দিন পর সে'টা বলতে...এত রাত্রে..।

- এদ্দিন পর মাঝেরাতে ফোন করে সে'সব বাজে কথা বলতে আমারও ভারী বয়ে গেছে। তাছাড়া আমি বেঁচেছি তোর পাল্লায় না পড়ে। কিন্তু তুই পারলি কী করে রে মাসীমার মারা যাওয়ার খবরটা আমায় না দিতে? নেহাত গত মাসে পুলুদি ফোন করে জানালো...।

- আসলে আমি ভাবলাম..।

- তুই ভাবলি মিনু কোথাকার কে যে তাকে জানাতে হবে। যাক গে, বেশ করেছিস।  আর তুইই বা আমার কোথাকার কে রে অমু? কেউ না। এই ছেলেবেলা থেকে তোকে চেনাটাই হয়েছে দোষ। 

- কী যে তখন থেকে বলে চলেছিস..।

- শোন। গুগলে দেখলাম তোদের পাড়ায় প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে। জানালা খুলে হাওয়া খাওয়ার শখ নিশ্চয়ই এখনও যায়নি? আর সময়মত জানালার পাল্লা বন্ধ করার বুদ্ধিটুকুও নিশ্চয়ই তোর নেই৷ বুদ্ধি থাকলে কি আর তুই মেজকাকার দেওয়া অত ভালো চাকরীটা রিফউজ করতিস? যাক গে। আমার আর কী৷  তোর বিছানাপত্তরের ভিজেটিজে একাকার অবস্থা নিশ্চয়ই। এখন রাত কাটা ওই ড্যাম্প ধরা বাড়ির মেঝেয় শুয়ে। 

- না মানে...ইয়ে...।

- অবশ্য তুই লাটসাহেব তো। কতটুকুই বা নিজের বাড়ির আর মায়ের খবর রাখতিস। তোর মা যে আলমারির পিছনে মোটা মাদুরটা গুটিয়ে রাখতেন, সে খবর তো রাখিস না৷ সে খবর রাখলে তোকে মেঝেয় শুয়ে রাতভর ছটফট করতে হত না। দিব্যি মাদুরের ওপর শুয়ে আরামসে ঘুম দিতে পারতিস। সে'টুকু বলতেই এত রাত্রে...।

- তোর এই জ্যাঠামোগুলো এ'বার ছাড় মিনু। আমার মায়ের মাদুরের কথা আমার মনে থাকবে না, থাকবে তোর? নিজেকে ভেবেছিস কী তুই?

- না আসলে..।

- আমি জানিনা সে মাদুর কোথায় রাখা আছে? তুই ভাবিস কী আমায়? অফিসে দশটা লোক চরিয়ে খেতে হয় রে আমায়, নেহাত গবেট নই।

- শোন অমু...আমি কিন্তু..।

- শোন। এমন দুমদাম অসময়ে আর ফোন করিস না। জেনে রাখ; আজ মোটেও জানালা বন্ধ করতে আমার দেরী হয়নি।  দিব্যি বিছানায় পাশবালিশ জড়িয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে নাক ডাকছিলাম...মাঝখান থেকে তোর ফোন এসেই ঘুমে বিশ্রী ব্যাঘাত ঘটল..।

- সরি। রাখি।

- রাখ।

ফোন কেটে অমিয় সোজা চলে গেল আলমারিটার কাছে৷ 

কী আশ্চর্য,  সত্যিই আলমারির পিছনে যত্ন করে গুটিয়ে রাখা মায়ের সেই মাদুরটা। মেঝেয় মাদুর পেতে গা এলিয়ে দিতেই দু'চোখ ভেঙে ঘুম নেমে এল; আহ্, মায়ের গন্ধ।

গুরুপদর সাপ্লাই


- নিশিকান্ত নাকি?

- আজ্ঞে।

- তুমি আবার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। ভিতরে এসো, এসো।

- আজ্ঞে।

- ওই মোড়াটা টেনে বসো দেখি। 

- আজ্ঞে...বসব?

- ও। তোমার তো আবার দাঁড়ানোও যা, বসাও তাই৷ 

- আজ্ঞে।

- তা শরীরটরীর ভালো তো?

- আজ্ঞে? শরীর?

- আহা তাই তো। তোমার আবার শরীর। বয়স হয়েছে তো৷ মাথাটাথা গুলিয়ে যায় মাঝেমধ্যেই।

- আজ্ঞে...বিরানব্বুই আর এমন কী..।

- বাতের ব্যথাটা এমন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে আজকাল...বুঝলে বাবা নিশিকান্ত...।

- আজ্ঞে..দেব নাকি পা টিপে?

- গলা টেপার বদলে মানুষের পা টিপবে ভাই নিশি? ধর্মে সইবে?

- কী যে বলেন..আজ্ঞে। যবে থেকে আপনার শ্রীচরণে ঠাঁই পেয়েছি...ও'সব শয়তানি ছেড়ে দিয়েছি।

- তা দিয়েছ বটে। শোন বাবা নিশিকান্ত, এসেছই যখন...কুকারে একটু চাল আর আলু চাপিয়ে দিয়ে যেও। ভয় নেই, আগুন জ্বালতে আমি এখনই বলব না। তুমি তৈরি হওনি এখনও। তুমি শুধু চাপিয়ে দিয়ে যেও। আমি উনুন জ্বেলে নেব'খন।

- আজ্ঞে। আসলে...আগুনের ভয়টা এখনও ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারিনি৷ 

- অঙ্কে প্র‍্যাক্টিস আর তন্ত্রে সাধনা...এই দুইয়ে ফাঁকি দিলে চলবে না। 

- আজ্ঞে...ফাঁকি ঠিক দিইনি। সাধনায় কাঠখড়ও কিছু কম পোড়াচ্ছিনে। কত দিন চেষ্টা করার পর গিয়ে গলা টেপার লোভ ছাড়তে পেরেছি। দুমদাম মানুষের পিলে চমকে ফুর্তি করার অভ্যেসও..ইয়ে...আগের মত নেই। সামান্য মাছের আঁশের পচা গন্ধ শুঁকে একটু ফুর্তি করতাম...তাও ছেড়েছি বছর দুই হল। শুধু শ্মশানের বাইরে আগুন দেখলে এখনও বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে....। ফাঁকিবাজ হলে, এ'সব কি হত আজ্ঞে?

- বলি যে মন্ত্রটা দিয়েছিলাম, সে'টা রাতে আড়াইশোবার আওড়াচ্ছ কি?

- ওই যে..খ্যাটিম্যাটি খ্যাংখ্যাং জবাট্যাং মাংটক...আকিসুকি কুলঘুল জিল্যাটাং ভড়কক? আজ্ঞে?

- ওইটাই...তা, মন্ত্রটা আওড়ানো হচ্ছে কি? প্রতি রাতে? আড়াইশোবার?

- তা হচ্ছে। কোনও কোনওদিন হয়ত বার চল্লিশেক বার কমবেশী হয়ে যায়।

- সাধনায় কম বেশি চলে না হে। চলে না। দেখ নিশিকান্ত, এক ভূতকে নিয়ে এত বেশি সময় নষ্ট করলে আমার চলবে কেন? আরও কতজন লাইনে রয়েছে জানো?

- আজ্ঞে, আপনার দয়াদৃষ্টি থেকে এ অধমকে বঞ্চিত করবেন না যেন৷ আমি আজ থেকেই হাজারবার করে সে মন্তর পড়ব। আর ছ'মাসের মধ্যে নিজের হাতে আপনার স্টোভ জ্বলে আপনাকে বেগুনি ভেজে, খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াব। 

- সাধনায় ফাঁকি চলে না, বাড়াবাড়িও না। পাক্কা আড়াইশো বার, রোজ রাতে। 

- যে আজ্ঞে। আমি প্রমাণ করে ছাড়ব যে আমি ভূতমাস্টার গুরুপদ হালদারের যোগ্য ছাত্র। 

- গদগদে আর বাঁচিনা। যাও, গিয়ে হাঁড়িটা বসাও।

**

- দেখুন গুরুপদবাবু, আমার ফ্যাক্টরিতে ডিমান্ড যে'ভাবে বাড়ছে...আপনার থেকে সাপ্লাই তেমন ভাবে পাচ্ছি কই বলুন। অন্য ভূত ট্রেনারের কাছে না গেলে আমার বোধ হয় আর চলবে না। আফটার অল, আই হ্যাভ আ বিজনেস অ্যান্ড আ ফ্যাক্টরি টু রান। 

- অমনটি বলবেন না মিস্টার চ্যাটার্জী। অমনটি বলবেন না। আপনার সোদপুরের ফ্যাক্টরির সমস্ত লেবার ভূত আমিই সাপ্লাই দেব, ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আজকাল দু'চারটে ভূত এমন ত্যাঁদড় বেরোয়...তাদের ট্রেন করতে দিনের পর দিন...।

- ও'সব অজুহাত শুনলে আমার চলবে কী করে গুরুপদবাবু? একটা ভূত সাপ্লাইয়ে দেরী করা মানে তার বদলে আমায় একশোটা রোবট ডেপ্লয় করতে হয়৷ এদিকে একটা ভূতের মেন্টেনেন্সের তুলনায় একটা রোবট মেন্টেন করার খরচ দশগুণ বেশি। অর্থাৎ আমার লেবার কস্ট দাঁড়ায় থাউজ্যান্ড টাইমস মোর। আপনার এক একদিনের দেরী আমার প্রডাকশন কস্ট কী ভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে সে খেয়াল আছে?

- প্লীজ স্যার। আপনার এদ্দিনের সাপ্ল্যায়ার আমি, আর একটা সুযোগ দিন। ত্যাঁদড় হলেও কয়েকটা সুপার-এফিশিয়েন্ট ভূত তৈরি করতে পেরেছি বুঝলেন। নিশিকান্ত বলে একটা ভূত...যখন প্রথম পাকড়াও করি তখন এক্কেরে হাবাগোবা ছিল। এখন ওই একটি ভূতে আপনার তিনশো রোবট চিৎপটাং হয়ে যাবে; না হলে গুরুপদ হালদারের নাম পাল্টে নেতুরাম রাখবেন'খন।

- দেখুন, আমি কথায় নয়৷ কাজে বিশ্বাস করি। ভূতের এফিশিয়েন্সি বেশি হলে, আপমার কমিশনও বাড়বে। কিন্তু আই ওয়ান্ট দেম ক্যুইক।

- হেহ্ হেহ্...হবে হবে। আচ্ছা চ্যাটার্জিবাবু,আপনার মনে পড়ে? এজ এখন ভূত লেবারদের নিয়ে যেমন টানাটানি, এককালে রোবটদের নিয়েও ইন্ডাস্ট্রিদের এমনই হ্যাংলামো ছিল? এখন আমাদের মত ভূত ট্রেনারদের যে অল্প ইয়েটিয়ে একটু হয়েছে, সে'কালে দেখতাম রোবট ম্যানুফ্যাকচারারদের কী সাংঘাতিক রোয়াব।

- ইট ইজ অল আ গেম অফ কস্ট মিনিমাইজিং গুরুপদবাবু৷ লেবারটেবার  এমনিতে পেটি ইস্যু। ইকনমিতে আসল খেল জমে ক্যাপিটাল আর কনসিউমারের মধ্যে। লেবার ব্যাপারটাকে মাথায় উঠতে দিলেই লায়াবিলিটি; তাদের এফিশিয়েন্সি হতে হবে গগনচুম্বী অথচ তাদের পিছিনে খরচ হতে হবে মিনিমাম। মানুষ শ্রমিকের হাজার বায়নাক্কা, তাই ইন্ডাস্ট্রি সোজাসুজি ও'সব হ্যাপা বাদ দিয়ে রোবটে চলে গেল।  কিন্তু সে'টাও তো এখন ইতিহাস, প্রায় মান্ধাতা আমলের ঘটনা। এ'টা তো আর টুয়েন্টি ফিফটি নয়, দিস ইজ আ নিউ ওয়ার্ল্ড। নিউ অর্ডার। ফ্যাক্টরিতে রোবটের চেয়ে ভূতের পিছনে খরচ অনেক কম, আর ভূতের বেগার খাটার ক্ষমতাও অনেক বেশি। রোবটদের মত ফিজিক্সের নিয়ম নিয়ে আদেখলামো নেই ভূতেদের মধ্যে আফটার অল৷ আমি আপনাকে লিখে দিচ্ছি গুরুপদবাবু, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে থেকে সমস্ত রোবট লেবার উবে যাবে, জাস্ট লাইক হিউম্যান লেবার। শুধু ভূতের বেগার খাটনিতে সমস্ত ইন্ডাস্ট্রি চলবে।

- এমনটাই তো প্রকৃতির নিয়ম৷ গতকাল ছিল রোবট, আজ আছে ভূত, আগামীকাল হয়ত অন্য কিছু এসে শ্রমিক সাজবে।

- ওই যে বললাম। কস্ট মিনিমাইজিং ইজ দ্য রিয়েল গেম গুরুপদবাবু। তাতেই গোবেচারা ক্যাপিটালিস্টদের সামান্য মুনাফা থাকবে আর নিরীহ কনজিউমারদের হাতে ডিসপোজেবল ইনকাম আর একটু বাড়বে। সে যাকগে...ইয়ে...আমি একটা রিউমর শুনেছি।

- গুজব? আজ্ঞে...কী রকম?

- এই গভর্নমেন্ট ইকনোমির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সদিচ্ছেও আছে৷ শুনেছি তাঁরা ভাবছে যে দেশের মধ্যে যাদের কনজিউমার হিসেবে র‍্যাঙ্ক সবচেয়ে নীচের দিকে, তাঁদের মধ্যে নাকি র‍্যান্ডম স্যাম্পেল সিলেক্ট করে কম্পালসরি সুইসাইড করানো হবে; প্রতি বছর। কোন বছর কত কম্পালসরি সুইসাইড করানো হবে সে'টা ডিপেন্ড করছে লেবার ডিমান্ডের ওপর। সুইসাইড করানো হবে স্ট্যান্ডার্ড ভূত জেনারেটিং প্র‍্যাক্টিস অনুযায়ী যাতে টপ কোয়ালিটি ভূত তৈরি করা যায়। আপনার তো সোর্স আর সর্ষে নিয়েই কাজ৷ আপনার কাছে কোনও খবর আছে? আপনার সোর্স কী বলে?

- ব্যাপারটা গুজব নয় চ্যাটার্জিসাহেব। খবরটা পাকা। সামনের সেশনেই পার্লামেন্ট বিলটা পেশ করবে মনে হয়। ইয়ে, এক্কেরে হাঁড়ির খবর৷ তবে এখনই পাঁচকান করবেন না যেন। সরকারবাহাদুর বুঝেছেন যে ভূতের সাপ্লাই না বাড়লে জিডিপির পক্ষে টগবগিয়ে ছুটে চলা সম্ভব নয়। 

- আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক গুরুপদবাবু৷ নাহ্, গভর্নমেন্টের প্রশংসা করতেই হবে হোয়েন ইট ইজ ডিউ। হাড়হাভাতে লো-র‍্যাঙ্কিং কনজিউমারের বদলে যদি কিছু টেরিফিক কোয়ালিটির ভূত পাওয়া যায়; তাতে সত্যিই দেশের ও দশের মঙ্গল। কী বলেন?

- বটেই তো। বটেই তো।

দ্য গ্রেট পয়লা বৈশাখ


ভাই বংপেন,

শুভ নববর্ষ। 

পয়লা বৈশাখটা দিব্যি কাটল। জলখাবারে ওই...খান পাঁচেক লুচিই খেলাম। সঙ্গে বেগুনভাজা, মাখা সন্দেশ আর বোঁদে। দুপুরের ব্যাপারটাও মোটের ওপর ছিমছামই ছিল; কষা মাংস, মৌরলার ঝাল আর মেজজ্যেঠিমার রেসিপিতে বানানো প্লাস্টিকের চাটনি। সন্ধ্যেবেলা নারকোল দিয়ে মুড়িমাখাটা বেশ মাখোমাখো হয়েছিল কিন্তু। নয়ত একবাটির বদলে আলগোছে সোয়া দুইবাটি সাবাড় হয়ে যায়?

ডিনারে জনা কয়েক বন্ধুর আবির্ভাব ঘটবে, তাই সাহস করে বিরিয়ানিটা বাড়িতেই বানিয়ে ফেললাম। থামস আপের বোতল আর রসগোল্লার হাঁড়ি অবিশ্যি বন্ধুরাই আনছে। 

তা বন্ধুরা এসে পড়ার আগে ভাবলাম তোমায় দু'কলম লিখেই ফেলি। বয়সে যেহেতু আমি তোমার চেয়ে পাক্কা এক বছর বড়, তাই গায়ে পড়ে একটা উপদেশ দিয়ে এ চিঠি শেষ করি;

গত পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যেবেলায় সাহস করে খোলা ম্যাগির সেই শেষ প্যাকেট, তার ঋণ কোনওদিনও ভুলো না। কেমন?

আশীর্বাদ নিও।

ইতি বংপেন।

পয়লা বৈশাখ,  ১৪২৮।

প্রধানজী



কোন গানের সুর যে কখন কীভাবে মনে ধরে।
কোন বাতেলা যে কখন ইন্সপিরেশন বলে মনে  ঠেকে। 
কোন ক্লিশে যে কখন "আরে, এইত্তো আমরা" বলে পিঠে হাত রাখে।
কোন সাদামাটা সিনেমার দৃশ্য থেকে কখন কী'ভাবে যে স্কুল-ছুটির দুপুরে পড়া গল্পের বইয়ের পাতার গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়।
কোন অগোছালো খটখটে সম্পর্কের গায়ে আচমকা কীভাবে যে ইয়ারদোস্তির উষ্ণতা এসে স্পর্শ করে। 
কে যে কখন কোন বেনিয়মের আবডালে সংসার খুঁজে পায়;

অঙ্ক কষে সে'সব বিটকেল হিসেবের তল পাওয়া যাবে ভেবেছেন?

নেকুচাঁদের বৌ



- এহ্ হে।

- আবার কী হল?

- ফের একই কেস রে বউ। দিয়েছি একখাবলা নুন বেশি। 

- ও ঠিক খেয়ে নেব'খন।

- কতবার বলি, এ লাপসি তুইই রান্না কর। আমায় বরং ঘর মুছতে দে। এ'বার খা নুনের ঝোল উইথ আ হিন্ট অফ চালডাল।

- আমার অত নোলা নেই। আমি দিব্যি সাপটে খেয়ে নেব।

- ভারী তো রোজ রাজভোগ খাচ্ছি। তায় আবার নোলা। মেনুর কী বহর; দিনের পর দিন দুপুরে খিচুড়ি, রাতে ফেনাভাত। উফ! আর উইকেন্ড রাত্রির বুফেতে আবার বোনাসঃ এক চামচ করে ঘি। 

- ঘি? তাও এ'বার ফুরোবে। 

- কী ভাইরাস ছড়ালো রে বউ, খাওয়াদাওয়াটা এক্কেরে গেঁজে গেল। তাই না রে?

- আর ক'দিন পর এই রাজভোগও জুটবে না।

- আশ্চর্য কী। একের পর এক হপ্তা যায় অথচ ভাইরাস বাবাজীর তাণ্ডব আর থামে না৷ ছ'মাস হতে চলল গোটা দেশ গৃহবন্দী। এ'দিকে বাজারে আর আলু পেঁয়াজও নেই। সরকারের রেশন আছে, তাই দু'হাতা করে খিচুরি ফেনাভাত পাতে পড়ছে৷ সত্যিই, আর ক'দিন পর হয়ত...। 

- হরিমটর। আমি আর তুই তখন ব্যালকনিতে জড়াজড়ি করে বসে বিরিয়ানির কথা ভাবব, কেমন?

- একটা টেরিফিক আইডিয়া এসেছে মাথায়! 

- আবার কী!

- বুঝলি বৌ, ওই যখন কিস্যু থাকবে না... আমরা তখন প্ল্যানচেটে বিরিয়ানির গন্ধকে টেনে নামাবো। 

- প্ল্যানচেটে বিরিয়ানি? মাইরি?

- বিশ্বব্যাপী রেশনের দুনিয়ায় সে কি আর বেঁচে আছে রে বৌ? বেঁচে থাকতে নেই৷ নেই রে নেই। আমার আত্মাটাত্মায় বিশ্বাস এদ্দিন ছিল না তবে আচমকা গজিয়েছে। ভাইরাস-খেকো এ দুনিয়া থেকে বিরিয়ানিকে চলে যেতে হল বটে, কিন্তু তাই বলে তাঁর আত্মাটুকুর প্রতিও যদি বিশ্বাস না থাকে, তা'হলে বাঁচব কি নিয়ে রে বৌ? আর তাঁর আত্মায় যেহেতু ষোলো আনা বিশ্বাস আছে, বিরিয়ানির থালা প্ল্যান করে চেটে খাওয়ার সুযোগ না থাকলেও,  সেই বাউল সুবাসকে কি প্ল্যানচেটে টেনে নামাতে পারব না রে? বল তুই, যদি মনেপ্রাণে ডাকতে পারি, তা'হলে আমরা পারব না?

- শোন। একটা কথা ভুলিস না; আনন্দ মরা নহি। আনন্দ মরতে নহি৷ 

- আহা বৌ। আহা। এই সেন্টিমেন্টগুলো বুঝিস বলেই তো রোজ একবার তোর সঙ্গে মালাবদল করতে ইচ্ছে করে।

- নেকুচাঁদ। বালতির জল পাল্টে এ'বার সামনের ঘরটা মুছে আয়। আমি দেখি খিচুড়িটাকে কোনওভাবে রিপেয়ার করতে পারি কিনা।

অগ্নীশ্বর ও সিনেমায় মৃত্যু


সিরিজে ট্যুইট করা। ট্যুইটই রইল; সাতটা পরপর সাজানো।

***

সিনেমায় দেখা কোন মৃত্যু মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে? দিনদুয়েক ধরে সেই মর্মে একটা পোস্টার 'কোট' করে অনেকেই নিজেদের সিনেমা স্মৃতি ঘেঁটে ট্যুইট করছেন। 
আমি গতকাল লিখেছিলামঃ
ডাক্তার অগ্নীশ্বর মুখুজ্জ্যে। হঠাৎ মনে হল, ব্যাপারটা এক কথা সেরে ফেলার সুযোগ তেমন নেই। (১)

"অগ্নীশ্বর" সিনেমায় অজস্র ভুলচুক নিশ্চয়ই আছে। ক্ষেত্র বিশেষে "বাড়াবাড়ি" ও কম নেই তবে সে বিশ্লেষণ করবেন সিনেমার ছাত্ররা। আমাদের কাজ নিজের ভালো লাগাগুলকে আঁকড়ে রাখার। একমুঠো শিউলি হাতে মৃত্যুর আগে ডাক্তারের বলা কথাগুলো বড় নাড়া দিয়েছিল। (২) 

অগ্নীশ্বর নিজের ডাক্তারি জীবন কাটিয়েছেন মানুষের সেবায়। একদিকে তাঁর ধারালো ব্যক্তিত্বের নিরেট বর্মে বহু মানুষের কোমলতা ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেছে আবার অন্যদিকে দেশের মানুষের গোঁড়ামি, ভণ্ডামি, যুক্তিহীনতা ও কুংস্কারে বারে বারে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তিনি নিজে। (৩) 

কিন্তু হাজার ক্ষতবিক্ষত হয়েও, পাহাড়প্রমাণ বিরক্তি নিয়ে ঘর ছেড়েও;
মারা যাওয়ার ঠিক আগে অগ্নীশ্বর স্বীকার করে যাচ্ছেন যে ফের জন্মানোর সুযোগ পেলে তিনি এই দেশেরই মাটিতে..এই মানুষগুলোর মধ্যেই ফিরতে চান। (৪) 

সিনেমাটা যখন প্রথম দেখি তখন বড় জোর ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। একজন নিরেট যুক্তিবাদীর এমন শেষ আকুতির মধ্যে যে কী অপূর্ব স্নেহপূর্ণ 'ন্যাশনালিজম' টের পেয়েছিলাম। তাতে অন্যের কলার টানা নেই, যুক্তির শৈথিল্য নেই অথচ মায়া আছে।  আর আছে মানুষের জন্য অল্পবিস্তর কাজ করবার অদম্য ইচ্ছে৷ (৫) 

অগ্নীশ্বর সিনেমার শেষের দিকে রয়েছে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী অগ্নীশ্বরের গৃহত্যাগ ও তীর্থভ্রমণ। মোগলসরাইয়ের স্টোরবাবুর ছেলে মাকে কাঁধে নিয়ে তীর্থে বেরিয়েছে; তা দেখেই তাঁর ঈশ্বরদর্শন সম্পূর্ণ হয়৷ সিনেমায় এ সময় জুড়ে একদিকে রয়েছে গঙ্গা স্তোত্র আর অন্যদিকে ধনধান্য পুষ্পে ভরা। (৬) 

শেষ দৃশ্যে অগ্নীশ্বরের চিতার আগুন আর "ভাইয়ের মায়ের এতো স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ,
ও মা তোমার চরণ দুটি বুকে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি"।
ক্লাস সেভেনে কেঁদে ফেলেছিলাম৷ আজও...ইয়ে। চোখে বালিটালি পড়ে যায় আর কী। (৭- শেষ) 

(অগ্নীশ্বর চট করে মনে পড়ল তাই গড়গড় করে বলে গেলাম। তবে এর বাইরে আরও কত যন্ত্রণা আর কবিতা আছে। পথের পাঁচালিতে দুর্গা বা পলাতকে হরিমতির মৃত্যু; ভাবলেই ভেঙেচুরে পড়ার জোগাড় হয়)।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন -১২


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ১২

***

আজ গোটাদিন লুঙ্গির ওপরে ফর্মাল জামা, ভারিক্কি টাই আর রিভিউমিটিং মার্কা-মেজাজ চাপিয়ে ঘরময় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অনিরুদ্ধবাবু। 

সকালবেলার দিকে বাসন ধুতে গিয়ে মনের ভুলে  নিজের টাইয়ের ডগাটা ভিম-বারে রগড়ে দু'টো কড়াই মেজে ফেললেন।  

দুপুরের লাঞ্চ থালায় নয়, বেড়ে নিলে অফিসের সুবাস মাখানো হলুদ টিফিন বাক্সটায়। 

টিভির রিমোটটা কোথায় আছে জানতে চেয়ে বাবাকে একটা কড়া মেমোও পাঠিয়ে ফেললেন।

মাছের ঝোলটা কেমন হয়েছে জানতে চাওয়ায় বৌকে "দিস ইজ টু সার্টিফাই" বলে একটা চমৎকার টেস্টিমোনিয়াল লিখে দেওয়ার ব্যাপারেও পিছপা হলেন না।

***
ট্রেনে-বাসে ভিড় সমেত একটা সুস্থ সোমবার এ'বার না এলেই নয়।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ১০


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ১০

অফিসের উল্টো দিকে চায়ের দোকানের বেঞ্চিটায় বসে ফের একদিন ডিমপাউরুটি খাব। 
ডবল ডিম, নরম ভাবে ভাজা, বাড়তি কাঁচা লঙ্কা কুচি। 

এক কামড়ে দিয়েই দোকানি-দাদার দিকে তাকিয়ে বলব "পার্ফেক্ট হয়েছে কিন্তু"। দাদা স্মিত হেসে বলবেন; "আপনার তো আবার চায়ের অভ্যেস নেই"। 

ওঠার মুখে সামান্য মিষ্টিমুখ না হলেই নয়, কাজেই দু'টো প্রজাপতি বিস্কুট নেওয়া যাবে'খন। একটা আমার, আর অন্যটা বেঞ্চির পাশে গা-এলানো নেড়িকুমারের।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ১১



ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ১১

ছুঁচোর ডন মার্কা খিদেয় পেটের আনচান অবস্থায় আবার একদিন চোখে পড়বে একটা ছোট্ট ধাবা।হঠাৎ করেই। ছোট্ট কিন্তু অপরিষ্কার নয়, ঘিঞ্জি অথচ দম বন্ধ করা নয়। উনুনের ধোঁয়া আর ডালঝোল মেশানো গন্ধে বাতাস ভারী।  একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসতেই ক্যাশবাক্সের পিছনে বসা গম্ভীর ম্যানেজারকাকা এক হাসিখুশি ছোকরাকে তলব করবে
"কোণের টেবিলটা থেকে অর্ডার নিয়ে আয়"।

ব্যস্ত চনমনে মেজাজের ছোকরাটি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই গড়গড় করে বলে যাব;

"দু'টো করে রুটি আর জবরদস্ত দু'প্লেট ডিম তড়কা দিও তো ভাই। ঝাল কড়া হবে তবে শুকনো লঙ্কার বাড়াবাড়ি নয়,  কাঁচালঙ্কা৷ আর একটু ক্যুইক, কেমন"?

ছোকরা মাথা নাড়বে। আর হেসে শুধোবে;
 
"আর থামসআপ? থামসআপ দেব না"?

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৯


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৯

কত পুরনো অভ্যেস এ'বারে সত্যিই আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। 
ফেলতেই হবে।
জিলিপি, সন্দেশ নিয়ে আপাতত ভাবনাচিন্তা না করতে হলেও, লারেলাপ্পা বোলচালগুলো এ'বার ছাড়তেই হবে।

"মনডে ব্লুজ" বিষয়ক শৌখিন সস্তা ঠাট্টাগুলোও এ'বার বাদ না পড়লেই নয়।

হাল না ছাড়ার গানটা ভাগ্যিস থেকে যাবে। ভাগ্যিস।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৮

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৮

- কাণ্ডটা দেখেছেন ফেলুবাবু? এক বাবাজী করোনা আটকাতে মেডিটেশন টিপ্স অফার করছে। হাতটাত ধোয়া আর আইসোলেশন তো অনেক হল, তুকতাকটাও ট্রাই করব নাকি মশাই? বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি বলুন।

- তবে আর কী, এ'বার উটের জন্য ম্যাগনিফায়িং গ্লাস বিক্রি করার ব্যবসাটাও চালু করে ফেলুন।

- উ....উটের? ম্যা...ম্যাগনিফায়িং গ্লাস? কে....কেন?

- কাঁটা বেছে খেতে সুবিধে হবে।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৭



- একটা জব্বর গান শুনবে?

- প্লীজ না! ঘর থেকে যে হুট করে বেরিয়ে যাব তারও উপায় নেই। আইসোলেশনে এ যন্ত্রণা সইবে না।

- একটা চমৎকার বাউল ধরব ভেবেছিলাম কিন্তু। 

- তার চেয়ে বরং মুড়ি মাখো।

- তা, সে অবশ্য মাখাতেও একটা মিউজিকাল ইয়ে আছে বটে। আঙুলে ছন্দ না থাকলে মাখায় মাখোমাখোনেস আসে না।

- সবার সুর কি কণ্ঠে?

- আমার সুরের দৌড় ওই চানাচুরমুড়ি তক?

- হেহ। আচ্ছা, বাউলটা হোক। তারপর মুড়ি।

- জোর করছ যখন, ধরি। কেমন? 

- আমি জোর করেছি?

- মুখের কথাটাই কি সব গো? তোমার মনের ইচ্ছের কি কোনও দাম নেই? রেখেছ বাউল করে, গেরস্ত করোনি।

- ন্যাকাপনা!

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৬


- হবে গো হবে।

- কী হবে?

- নিজের স্যানিটাইজড হাতে স্পষ্ট দেখতে পারছি।

- কী আছে?

- পাহাড়। এ' ভাইরাস ব্যাটাচ্ছেলের মাস্তানিটাই শেষ কথা নয়।

- সঙ্গে আছি। ইন সিকনেস অ্যান্ড ট্র‍্যাভেল।

- প্লীজ,কাঠের বাড়িতে থাকব।

- সে'খানে ছবির মত ব্যালকনি!

- লাঞ্চের পর রোদ পিঠে বসব সেখানে; সঙ্গে তালমিছরির ডিবে।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৫


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৫

- হবে গো হবে।

- কী হবে?

- নিজের স্যানিটাইজড হাতে স্পষ্ট দেখতে পারছি।

- কী আছে?

- পাহাড়। এ' ভাইরাস ব্যাটাচ্ছেলের মাস্তানিটাই শেষ কথা নয়।

- সঙ্গে আছি। ইন সিকনেস অ্যান্ড ট্র‍্যাভেল।

- প্লীজ,কাঠের বাড়িতে থাকব।

- সে'খানে ছবির মত ব্যালকনি!

- লাঞ্চের পর রোদ পিঠে বসব সেখানে; সঙ্গে তালমিছরির ডিবে।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৪


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৪

- সব চুকেবুকে যাক! তারপর কেল্লায় গিয়ে রাজারাজড়ার মত তম্বি করে আসব।

- কেল্লাফতে প্ল্যান করলেই হবে? দুজনে মিউচুয়ালফান্ডে যা রেখেছিলাম, সব ডকে। কপালে সেই ব্যান্ডেল চার্চ।

- সিংহকে নটেশাক দেখিও না তো! করোনা কাটলেই কেল্লা চলো।

-কানের দুল বরং পরের বছর।

- আমার কোটও।

- চলো কেল্লা।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ২


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ২

- এসব কেটে গেলে একদিন পাহাড়ে যাবো, কেমন?

- জরুর। জরুর। 

- খুব শিগগিরি এসব কেটে যাবে, তাই না?

- জরুর। জরুর। 

- তারপর স্বস্তি। ট্রেনের আপার বার্থে শুয়ে বই পড়তে পড়তে শিলিগুড়ি। 

- অথবা দিল্লী। 

- তারপর দার্জলিং। 

- অথবা লাদাখ। 

- কেটে যাবে এসব, তাই না?

- জরুর। জরুর।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৩


ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ৩

-এমন একটা বেঞ্চি খুঁজে বের করতে হবে বুঝলে। 

-সঙ্গে ফ্লাস্কে একটু কফি। 

-মন্দ নয়। 

-চীজ স্যান্ডউইচ। 

-তোমার আবার বাড়াবাড়ি। 

-আইসোলেশনে টানা ফেনাভাতে রয়েছি,একটু ভাবতে দাও। 

-বেশ স্যান্ডউইচ। আর বাঁটুল সমগ্র। 

-চুমু। চুমু।

-সব সামলে উঠব আমরা, কী বল?

-আলবাত। চুমুর দিব্যি।

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ১

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন - ১

***

মহামারীর মধ্যে দাঁড়িয়ে টের পাচ্ছি নিজেদের মধ্যে কৃতজ্ঞতা-বোধের কী নিদারুণ অভাব এদ্দিন জমেছিল।

এই দুর্দিনে বাড়ির জলের ফিল্টার বিগড়লো। ফোন করতেই অ্যাকুয়াগার্ডের কর্মী রাণাবাবু এসে পড়লেন চটজলদি, মুখে মাস্ক পিঠে ভারী ব্যাগ।

চাকরীর দায়।

কৃতজ্ঞতায় নুয়ে না পড়ে উপায় আছে?

***

হাত ধুয়ে ধুয়ে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আর ক'দিন এ'ভাবে চললে বাড়ির সাবানগুলো নিজের হাত দিয়ে ঘষে সাফ করে দিতে পারব।

***

একটা জরুরী ওষুধ সংগ্রহের জন্য বেরিয়েছিলাম। তড়িঘড়ি ফেরার পথে দেখলাম মিষ্টির দোকানে ভীড়, রোল-চাউমিনের জন্য হুড়মুড়, এমন কী মোবাইলের দোকানে ক্রেতাদের ব্যস্ততা। 

জানি ব্যবসা বন্ধ মানে কত মানুষের পেটে   টান পড়বে। সব বুঝি। কিন্তু এই ভীড় দেখে গা শিউরে উঠছে।

***

বিভ্রান্ত হব না।
হাত ধোব।
বাতেলা ঝাড়ার স্বার্থে নিয়ম/সতর্কতা অমান্য করব না।
হাত ধোব।
গাঁজাখুরির বানান 'সায়েন্স' নয়, সে'টা মাথায় রাখব।
হাত ধোব।
খেজুরে দরকারে বাড়ির বাইরে পা রাখব না।
হাত ধোব।
হেল্পলাইনগুলো সম্বন্ধে সচেতন থাকব।
হাত ধোব।
কন্সপিরেসি থিওরি কপচাব না।
হাত ধোব।

***

সাবান যে কাজ বেশি হয় তা নিয়ে সন্দেহ নেই।তাছাড়া মানসিক ব্যাপারটাও দেখতে হবে তো। 

স্যানিটাইজারের স্বভাব বড় চাপা। ছুমন্তর গোছের কাজ, এই আছে এই নেই। তুলনায় হাত সাবানের ফেনায় ভরে যাওয়া যে কী অপরিসীম তৃপ্তির; কনফিডেন্সের বেলুন রীতিমতো ফুলেফেঁপে ওঠে।

Wednesday, April 22, 2020

আলমারি

চারুশিলা আজ আনন্দে ডগমগ; তিনি সকাল থেকে কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পর্যন্ত পারছেন না। একবার ছুটে ঝুল-বারান্দায় গিয়ে নীচে রাস্তার দিকে উঁকি মারছেন তো পরক্ষণেই আবার হেঁসেলে ঢুকে কমলার মাকে রান্নার  খুঁটিনাটি টেনে হাজারটা প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলছেন৷ ঘরের সমস্ত আসবাব নিজের হাতে বারবার পুছেও যেন ঠিক তৃপ্ত হতে পারছেন না। 

মাঝেমধ্যেই দেওয়াল ঘড়ির দিকে  উদগ্রীব হয়ে তাকাচ্ছেন তিনি; অথচ কাঁটা যেন এগোতেই চায় না ছাই। এই সোয়া বারোটা, এই বারোটা সাতাশ, এই বারোটা বত্রিশ৷ কখন যে পৌনে পাঁচটা বাজবে, তখন খোকার ট্রেন ঢুকবে স্টেশনে৷ রেলস্টেশন থেকে  বাড়ি পৌঁছতে খোকার আরও মিনিট চল্লিশেক সময় লাগবে। 

কতদিন পর। কতদিন পর খোকা ফিরছে৷ প্রায় বছর খানেক পর বাড়ি ফিরছে খোকা কিন্তু মায়ের মনের ভিতর এমন তোলপাড়; যেন কত যুগ পর ফের খোকাকে দেখবেন তিনি। নতুন চাকরীর এমনই চাপ যে বছরখানেক বাড়িমুখো হতে পারেনি খোকা; এদ্দিন পর কয়েকদিনের ছুটি পেতেই সে ফিরছে।

খোকার ঘর, বিছানাপত্র সব নিজের হাতে সাজিয়েগুছিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ নিজের শোওয়ার ঘরে গেলেন চারুশিলা। আলমারি বোঝাই শাড়ি অথচ খোকা না থাকলে তার সে'সব ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করে না। খোকার বাবা প্রায়ই বকাঝকা করেন, বলেন "এ দুনিয়ায় তুমিই কি একমাত্র মা নাকি যার ছেলে চাকরীর জন্য ঘরছাড়া"? কিন্তু তাঁর মন সরে না তাতে। আলনার ঝুলে থাকা কয়েকটা আলুথালু শাড়ি উল্টে পাল্টে পরেই বছর খানেক কেটে গেছে। আজ বহুদিন পর চারুশিলার ইচ্ছে হল আলমারিটা খুলে ভালো একটা শাড়ি বের করে পরতে৷ আজ খোকা ফিরছে বলে কথা। 

এদ্দিন পর আলমারিটা খোলার কথা ভেবে চারুশিলার যে কী ভালো লাগছিল। শাড়ি আর ন্যাপথালিন মেশানো গন্ধ, সোনাগয়না রাখা লকার; সব মিলে এই সাতাশ বছর পুরনো নিজের বিয়ের আলমারিটা চারুশিলার বড্ড প্রিয়। কত অলস দূপুর তার কেটেছে এ আলমারির পাল্লা হাট খোলা রেখে বিভিন্ন শাড়ি ঘাঁটতে বা সোনাগয়নার গায়ে হাত বুলোতে৷ একসময় দিনে অন্তত একবার এ আলমারি তিনি ঘাঁটতেন আর প্রাণ ঢেলে গোছাতেন। শুধু খোকা যাওয়ার পর এমন মনমরা হয়ে পড়লেন যে আলমারির কথা তার মনেও পড়ত না। 

এদ্দিন পর আলমারি খোলার কথা মনে পড়তেই চারুশিলা বুকের মধ্যে একটা বাড়তি চনমন বোধ করলেন। বিছানার তোশকের নীচ থেকে চাবিটা বের করে এগিয়ে গেলেন আলমারিটার দিকে। 

আলমারি পাল্লাটা খুলতেই একটা ঝোড়ো হাওয়ায় চারুশিলার চারপাশটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। মাথাটা গেল ঘুরে, একটা বিশ্রী গা গোলানো আনচান চেপে ধরল তাঁকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর যখন দৃষ্টির ঝাপসা ভাবটা কেটে গেল; তখন চারুশিলা টের পেলেন তাঁর গলাটা শুকিয়ে কাঠ। কারণ আলমারির পাল্লা খুলে তিনি শাড়ি গয়নার সম্ভার নয়, দেখতে পেলেন নিজের শোওয়ার ঘরটাকেই৷ কিন্তু শোওয়ার ঘর, ওই খাট, ওই দেওয়াল ঘড়ি; এ'সব তো তাঁর পিছনে থাকার কথা। আলমারির মধ্যে শাড়ি গয়নার বদলে তাঁর শোওয়ার ঘরটা উঠে এলো কী করে৷  চারুশিলা মাথার ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মন্ত্রাবিষ্টের মত নিজের আলমারির ভিতরে পা বাড়ালেন তিনি। অথচ আলমারির ভিতরে নয়, চারুশিলা এসে দাঁড়ালেন নিজের শোওয়ার ঘরেই। এই পালঙ্ক, এই মেঝে, এই জানালা; সবই তাঁর সুপরিচিত।

আর ঠিক তখনই তাঁর চোখ পড়ল সামকে দাঁড়ানো দু'জনের দিকে। দু'জনের একজন খোকা; খোকার সামনে তিনি দাঁড়িয়ে অথচ খোকা  যেন তাঁকে দেখতেই পারছে না। খোকার দৃষ্টি বিহ্বল,  ছলছলে। "খোকা" বলে প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইলেন চারুশিলা অথচ মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোল না কারণ ততক্ষণে তাঁর দৃষ্টি টেনে নিয়েছে খোকার পাশে দাঁড়ানো ওই বিশ্রী মানুষটা। 

মানুষটা চারুশিলার পরিচিত নয় কিন্তু ভদ্রলোকের দিক থেকে কিছুতেই চোখ সরানো যায় না যেন। মানুষটার লাল চাদরে মোড়া দীর্ঘ দেহর দিকে তাকিয়ে চারুশিলার গোটা গায়ে কেরোসিনে পোড়া জ্বলুনি শুরু হল৷ তিনি চেঁচিয়ে বলতে চাইলেন "খোকা আমায় তুই এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দে" অথভ কিচ্ছুটি বলতে পারলেন না৷ চারুশিলার মনে হল যেন তাঁর দেহটা ছিঁড়েখুঁড়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। 

খোকার পাশে দাঁড়ানো মানুষটা ততক্ষণে বরফঠাণ্ডা সুরে বিড়বিড় করতে শুরু করেছে;

"সুবিমলবাবু, আপনি তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু আমি পেরেছি। হ্যাঁ আপনার মাকে আমি দেখতে পেরেছি। এদ্দিনে তাঁর মুক্তির পালা। বছর পাঁচেক আগে ঘটেছিল তো দুর্ঘটনাটা? ওই যে, আপনার যে বিকেলে।বাড়িতে ফেরার কথা ছিল, সেই দুপুরেই তো? আপনাকে না দেখতে পাওয়ার দুঃখ পুষে এদ্দিন এ আলমারিতে বন্দী ছিলেন মা। আজ তাঁর মুক্তি। সামান্য ছটফট আছে বটে, কিন্তু মুক্তি এ'বার আবশ্যম্ভাবী। আলমারি কেন, সিন্দুকের আড়ালে থেকেও গুপি তান্ত্রিকের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়"।

Friday, April 3, 2020

সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং


- মিস্টার চৌধুরী...হ্যালো...মিস্টার চৌধুরী...ক্যান ইউ হিয়ার মি? মিস্টার চৌধুরী...হ্যালো...হ্যালো..।

- হ্যালো..অভিষেক নাকি...।

- যাক...আধঘণ্টা ধরে হাঁকডাক করেও আপনার সাড়া না পেয়ে খুব নার্ভাস হয়ে গেছিলাম...।

- আমার এদিকের স্ক্রিনটা হ্যাং করে গেছিল। তার বেশি কিছু নয়...। তা তুমি কী ভাবলে..বুড়ো অক্কা পেয়েছে বোধ হয়..তাই না?

- ছি ছি, ও কথা মুখে আনবেন না প্লীজ।

- মুখে না আনলে কি ভবিতব্য আটকে থাকবে হে? মেঘে মেঘে বেলা তো কম হল না৷ সামনের শনিবার একশো দুইয়ে পড়ব। আর কদ্দিন বলো।

- বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রনেতারা আপনার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন, এ তো আপনার অজানা নয় মিস্টার চৌধুরী। আধুনিক মেডিকাল সায়েন্স দুনিয়া ওলটপালট করে দিচ্ছে আপনার জন্য...।

- তোমার রাষ্ট্রনেতাদের বোলো যে আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ কিন্তু বয়সের ভারে এ'ভাবে ন্যুব্জ হয়ে একাকী আর দিন কাটেনা। আমার এ'বার মুক্তির প্রয়োজন হে।

- এমন বলছেন কেন মিস্টার চৌধুরী...গোটা পৃথিবী জুড়ে আপনার যে সমাদর...দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ আপনাকে এত ভালোবাসে...। আপনি তো আমাদের কাছে ঈশ্বরতুল্য।

- কিন্তু এই বন্দীদশা যে আর সহ্য হয় না অভিষেক।  এত খ্যাতি, এত ভালোবাসা; সবই আজকাল যন্ত্রণার মত ঠেকে। প্রাইমমিনিস্টারকে বলো এ'বার আমার মুক্তির প্রয়োজন। 

- অমন করে বলবেন না মিস্টার চৌধুরী। আর আপনি নিজেকে বন্দী বলে কেন ভাবছেন..স্রেফ সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বই তো নয়। 

- বাহাত্তর বছরের সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং..এর চেয়ে জেলে পচলে যন্ত্রণা কম হত হে।

- আপনার সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বাহাত্তর বছর হতে চলল? সেভেনটি ট্যু? ভাবলেই কেমন..।

- গায়ে কাঁটা দেয় না গা গুলিয়ে ওঠে?

- সমীহ হয়।

- বাহাত্তর বছর। ভাবলে কেমন আশ্চর্য লাগে যে সেই খুনে ভাইরাস পৃথিবীতে আজ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর কেউ তার থেকে নিজেকে বাঁচাতেও পারলে না...কেউ না। নট আ সিঙ্গল সোল..।

- কিন্তু আপনি পেরেছেন..। গোটা বিশ্বে...মানব।ইতিহাসে একা আপনি।

- কারণ আজ থেকে বাহাত্তর বছর আগে একা আমি এই খুনে ভাইরাস আর তা ঠেকাতে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম।

- সে জন্যেই তো পৃথিবীর সমস্ত স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের বইতে আপনি নায়কের  মত জ্বলজ্বল করছেন মিস্টার চৌধুরী। 

- নায়ক। তা বটে। এখন আমায় নিয়ে আদেখলপনা কম দেখি না। অথচ এই আমাকেই এককালে গোটা পৃথিবীর মানুষ মিলে হেনস্থা করেছে। যে ভাইরাসের আক্রমণে জ্বর হয় না, কাশি হয় না, কেউ মারা যায় না; তার সংক্রমণের ভয়ে ইকনমি ডকে তুলে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং..? এ যে উন্মাদের প্রলাপ। এ ভাইরাসে কী আর এমন হয়; স্রেফ সঙ্গীত তৈরির ক্ষমতা চলে যায়। এই অ্যান্টি মিউজিক ভাইরাস কোনও অদ্ভুত তন্ত্রবলে মানুষের সুর তৈরির ক্ষমতা শেষ করে দেয়; এর জন্য ইকোনমি লাটে তোলা? নৈবচ। এই  আজ যারা আমায় মাথায় তুলে নাচছে, তাক্বদের বাপ-ঠাকুর্দার দলই এককালে আমায় দুয়ো দিয়েছে। খ্যাপা মিউজিশিয়ান বলে আমায় নিয়ে মিম বানিয়ে ফেসবুক ভারি করেছে।

- আসলে...সত্যিই যে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই সংক্রমিত হতে পারে আর কেউই যে এ ভাইরাসকে রেসিস্ট করতে পারবে না..তেমনটা বোধ হয় সে সময় কেউই আঁচ করতে পারেনি।

- কারণ সে সময়ের মানুষ ছিল অত্যন্ত বাতেলাবাজ আর কুচুটে। যাক, যা হওয়ার তাই হয়েছে, সে ভাইরাসের আত্মপ্রকাশের দেড়বছরের মাথায় গোটা পৃথিবীতে এমন একটাও মানুষ পড়ে রইল না যে সুর বাঁধতে পারে।

- আর কোনওদিন তেমন মানুষ আসবেও না। এ ভাইরাস এখন প্রতিটি মানুষের দেহে, এ গ্রহের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে। আর আমাদের মুক্তি নেই।

- বেশ হয়েছে। এমন বেপরোয়া জাতের এই হওয়া উচিৎ। নাও, ঠ্যালা বোঝো এ'বারে৷ সাধের ইকোনমি ধুয়ে জল খাও এ'বারে। গান তৈরি করতে না পারাটা যে একটা সোশ্যাল ক্যান্সার, ব্যাটাগুলো এদ্দিনে বুঝেছে। 

- ক্যান্সারই তো। আর সে ক্যান্সারে একমাত্র আশার আলো যে আপনিই। বাহাত্তর বছর হোম আইসোলেশনে থেকে আপনি আজও মানুষকে নিত্যনতুন সুর উপহার দিয়ে চলেছেন৷ আপনি না থাকা মানে..এ দুনিয়া থেকে সুর উবে যাওয়া...।

- ইকোনমি তো ফুলেফেঁপে উঠবে। আমার সুরও যখন থাকবে না তখন লোকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাক্টিভিটি আরও খানিকটা বেড়ে যাবে। তা নিয়েই না হয় নাচানাচি কোরো সবাই মিলে।

- আপনাকে ছাড়া যে পৃথিবীটাই অন্ধকার হয়ে যাবে মিস্টার চৌধুরী।  আপনি নিশ্চয়ই সে'টা চাইবেন না।

- এদ্দিন চাইনি। কিন্তু আজ..।

- আজ? 

- আজ মনে হচ্ছে যাক, সবাই গোল্লায় যাক। কিন্তু মরার আগে আমি একটা দিনের জন্য অন্তত এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভিড়ে মিশে যাই৷  মিষ্টির দোকানের ভিড় ঠেলে গিয়ে দু'টো কচুরি চেয়ে খাই বা মাছের বাজারে হুড়মুড়ে কোয়ালিটি ট্যাংরা খুঁজে বের করি। বাজারের হট্টগোল, ভরা স্টেডিয়ামের হইহই; মরার আগে এ'সব একবার স্পর্শ না করলেই নয় হে অভিষেক। পিএমকে বলো...আমার মুক্তি চাই। 

- তার তো উপায় নেই মিস্টার চৌধুরী। 

- তোমাদের ছেলেপিলেদের ইস্কুলের বইয়ের অবিসংবাদিত নায়ক আমি, আমারও ইচ্ছামুক্তি নেই?

- আপনার বাড়িটা হচ্ছে ওয়ার্লডস মোস্ট প্রটেক্টেড প্লেস মিস্টার চৌধুরী।  একমাত্র প্রটেক্টিভ স্যুট পরা মেডিকাল টীম ছাড়া কারুর ক্ষমতা নেই ও বাড়িতে ঢোকে। আর আপনারও ক্ষমতা নেই বাড়ি ছাড়ার। অ্যান্টিমিউজিক-ভাইরাস মুক্ত শেষ মানুষ হিসেবে, সে অধিকার আপনি খুইয়েছেন। সরি।

- কীসের সমীহ অভিষেক। আমার প্রতি তোমাদের কীসের ভালোবাসা। 

- সে যাকগে। মিস্টার চৌধুরী, যে কথা বলার জন্য আপনার সঙ্গে কনেক্ট করেছি৷ আমাদের প্রাইমমিনিস্টার আগামীকাল নতুন ক্যাম্পেন লঞ্চ করছেন, সামনেই ভোট কিনা। একটা থীমসং লেখা হয়ে গেছে, উনি নিজেই লিখেছেন। আপনাকে এ'বার সুরটা করে দিতে হবে। চটপট চাই কিন্তু। কেমন?  

(ছবি সূত্রঃ Independent)