Showing posts with label দিল্লী. Show all posts
Showing posts with label দিল্লী. Show all posts

Wednesday, December 6, 2023

জামা মসজিদের সিঁড়ি



শীতের সন্ধ্যে, সাতপুরোনো দিল্লী।
জামা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একশো সাতাশির নামতা পড়ছিলেন এক প্রৌঢ়, বাংলায়; উঁচু স্বরে, সুর করে। বেদম ভিড়, হট্টগোল; কিছুই তাঁকে টলাতে পারছিল না। পরনে ময়লা চেক হাফশার্ট, আর খয়েরি ফুলপ্যান্ট। গালে খোঁচা দাড়ি, অদ্ভুত শান্ত মুখ৷ 

"ইন্ট্রিগিং" শব্দটা মনের মধ্যে দু'বার আউড়ে নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন দীপকবাবু। মাসে একবার এ অঞ্চলে এসে নিজের মনে ঘোরাঘুরি করেন; প্রচুর হাঁটেন তিনি। স্ত্রী সোমা আর স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে ফুলিকে ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া না হলেও, এই পুরনো দিল্লীর গলি-ঘুপচিতে ঘুরতে বেরোনোর ব্যাপারে তিনি একটু প্রাইভেসি পছন্দ করেন, এ'টাই তাঁর 'মি টাইম'৷ সাধারণত রাস্তায় দাঁড়িয়ে নতুন মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করার লোক তিনি নন৷ কিন্তু আজ এই বাংলায় নামতা পড়া বৃদ্ধকে দেখে আগ্রহটা সামাল দিতে পারলেন না৷ এগিয়ে গিয়ে সটান দাঁড়লেন সে ভদ্রলোকের সামনে, নামতা আউড়ানো থমকে গেল।

- এক্সকিউজ মি স্যার৷ আপনি বাঙালি?

- নয়ত বাংলায় নামতা পড়াটা বাড়াবাড়ি হত।

- আমি দীপক চ্যাটার্জি। লাজপতের দিকে থাকি৷ 

- তা'তে কী?

- না মানে সরি৷ ওই, ইচ্ছে হল আলাপ করতে। 

- বেশ করেছেন৷ আমি যে কোন দিকে থাকি কে জানে।

- আপনার নামটা যদি..।

- আমায় কিছু খাওয়াবেন?

- নিশ্চয়ই! চলুন না৷ আল জওহরের রুটি-মাংস খেয়েছেন কি আগে?

- আল জওহরের রুটি-মাংস৷ এ'টা কি কোনো কবিতার লাইন দীপকবাবু?

- না না৷ ইয়ে, চলুন না খেয়ে আসি, রুটি মাংস! ওই সামনেই দোকানটা। চলুন৷ ভারি ইচ্ছে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে। 

- উম..গতকাল বিকেলে খিচুড়ি খেয়েছিলাম জানেন। চাঁদনি চৌকের এক শেঠ বড় আদর করে খাওয়ালে৷ আমি তাকে ক্যাপ্টেন স্কটের গল্প শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলাম কিনা। তা সেই খিচুড়ির ভার এখনও লাঘব হয়নি মনে হচ্ছে, কাজেই রুটি-মাংস গুরুপাক হয়ে যাবে৷ অল্প মিষ্টি খাওয়ান বরং।

- বেশ তো৷ ওই আল জওহরের উলটো দিকেই একটা গুমটিতে মারাত্মক ভালো শাহিটুকরা পাওয়া যায়৷ টপ-ক্লাস!

- শাহিটুকরা৷ কী সুন্দর নাম!  তাই না? রাজকীয়, অথচ ফুলের মত নরম।

- খেতেও অমৃত। চলুন না প্লীজ৷ ওই সামনের রাস্তাটার গোড়াতেই আছে..। কাছেই..।

- রাস্তা?

- ওই যে..।

- দেখুন ভালো করে, রাস্তা কই? ও'টা তো নদী। আলোমানুষদের নদী।

- এই সেরেছে।

- ফোকাস করুন। দেখতে পাবেন৷ ওই ভিড়ে হেঁটে এগোনো অসম্ভব। ভেসে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই বলি, ও'টা রাস্তা নয়, নদী। আচ্ছা দীপকবাবু..। আপনি তো সংসারি মানুষ, একা একা পালিয়ে বেড়ান কেন মাঝেমধ্যে?

- এক্সকিউজ মী?

- মাসে একবার এ'দিকে আসেন৷ ঘুরঘুর করেন৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখে প্রশান্তি নেই, হাঁটায় নিশ্চিন্দি নেই৷ সারাক্ষণ একটা ছটফট। ভালো আছেন?

- এই, আপনি আমায় ফলো করছেন নাকি?

- তা করি বটে৷

- কিন্তু আপনাকে আগে তো কোনওদিন দেখেছি বলে..।

- আজ দেখা দিলাম৷ তাই দেখছেন।

- আপনি কে বলুন তো?

- দীপকবাবু৷ সত্যিই চিনতে পারছেন না? 

- আদৌ না..।

- চিনতে পারছেন না?

- এক কথা কতবার বলব! আমি আসি।

- কোথায় আর যাবেন দীপকবাবু। শুনুন..।

- কী চাই..।

- আমার দিনটা আজ বড় মন-কেমনের। আজ ফুলির বিয়ে৷

- ফুলি?

- ফুলি। ফুলির বিয়ে৷ অথচ দেখুন, আমি বাড়িতে নেই৷ জামা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নামতা পড়ছি। অথচ আজ আমার বাড়িতে থাকা উচিৎ ছিল..মা-মরা মেয়েটাকে আজ অন্তত আগলে রাখা উচিৎ ছিল..কিন্তু..সোমা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমার যে কী হল, বাড়িতে আর মন বসে না..।

- শাটাপ! শাটাপ! ইউ ফ্রড..।

- আপনি চিৎকার করছেন কেন? আপনার চিৎকার তো কেউ শুনতে পাবে না৷ আপনি তো স্মৃতির ভাসমান একটু টুকরো মাত্র। এক অন্যধরণের শাহি টুকরা, এই রুখাশুখা বর্তমানে যার কোনও অস্তিত্বই নেই৷

- আপনি বদ্ধ উন্মাদ..।

- কে জানে। হতে পারি৷ তবে আমি নিজেকে জামা-বৈরাগী বলি, আপনি চাঁদনি বাউলও বলতে পারেন৷ এক পীরের আশীর্বাদে সময়ের ঢেউ পেরিয়ে পুরনো আমিকে খুঁজে বের করতে শিখেছি, তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়তে শিখেছি৷ তার প্রমাণ এই আমাদের আলাপ-আলোচনা। 

- আপনি চুপ করুন!

- শুধু একটাই কথা বলতে আপনাকে সময়ের এ'দিকটায় টেনে আনা দীপকবাবু; ভালোবাসার মানুষ বলতে তো ওই দু'টিই৷ ও'দের ছেড়ে একলা ঘুরে যতই শান্তি খুঁজুন, পাবেন কাঁচকলা। গেরস্থালির যে'টুকু যা হুড়মুড় তার বাইরে আপনার মুক্তি নেই৷ একদিন এ সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়ে একশো সাতাশির নামতা আপনাকে পড়তেই হবে৷ কিন্তু যে'কদিন হাতে আছে, তার এক মুহূর্তও নষ্ট হতে দেওয়া যবে না৷ ফুলি, সোমা বাড়িতে বসে আছে যে। স্রেফ ওই দু'টো মানুষই আপনার অপেক্ষায় বসে থাকে।  বাকি সমস্তটা এলোমেলো৷

**

চোখে মুখে জলের ঝাপটা পড়তে চোখ মেলে তাকালেন দীপকবাবু৷ জামা মসজিদের সিঁড়ির ওপর তাঁকে ঘিরে তখন একটা ছোটখাটো জটলা৷ গত মিনিট দুয়েক তাঁর জ্ঞান ছিল না।

উঠে দাঁড়ানোর পর নামতা পড়া কোনও বিটকেল বৃদ্ধের খোঁজ করার দু:সাহস তাঁর ছিল না৷ এ'বার সোজা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি, ফুলি আর সোমা অপেক্ষা করে বসে আছে৷ সামনের মাসে ওদের নিয়ে এসে একবার আল জওহরের মাংস-রুটি খাওয়াতেই হবে।

Monday, August 7, 2023

করোলবাগের চিঠি



- যাই বলুন মশাই! এক্কেবারে চ্যাম্পিয়ন কোয়ালিটির বিকেল। রোদের কোয়ালিটি নরম, বৃষ্টিশেষের মিঠে হাওয়া। রোম্যান্টিক-ম্যাক্স।

- তা গোলাপবাবু, হাওয়া যে মিঠে সে'টা ফ্লাইটে বসেই টের পাচ্ছেন?

- আগামী নভেম্বরে ফিফটু ক্রস করে ফিফটি থ্রিতে পড়ব৷ তা'ছাড়া অল্প বয়স থেকেই আমি বিকেলের ব্যাপারে অবজার্ভ্যান্ট। এই বলে রাখলাম গোলদারবাবু; ল্যান্ড করার পর টের পাবেন কী প্রিসাইসলি বিকেলের কোয়ালিটি অ্যাসেস্ করেছি।

- তা এমন হাইকোয়ালিটি বিকেল, এমন বিটকেল কাজে নষ্ট করা কি ঠিক হবে?

- প্রফেশনটাই তো বিটকেল গোলদারবাবু৷

- তা এই প্রফেশনে থেকে বিকেল অবজার্ভ করার আদেখলাপনা দিয়ে হবেটা কী।

- বাহ্। ফ্রিল্যান্স তোলাবাজির কাজ করি বলে কি বিকেলের ভালোমন্দের ব্যাপারে সেনসিটিভ হওয়া বারণ?

- দেখুন গোলাপবাবু৷ আপনার ভালো চাই তাই বলি৷ আর ঘণ্টা দুইয়ের মাথায় করোলবাগের ব্যবসায়ীর ভুঁড়িতে বন্দুকের নল চেপে পঞ্চাশ লাখ বের করবেন৷ সে'খান থেকে চল্লিশ ক্লায়েন্টেকে দিয়ে দশ পকেটস্থ করে রাতের ফ্লাইটেই আস্তানায় ফেরত৷ হাই-ফোকাসের কাজ, এক চুল এদিক ওদিক হলেই চালান হয়ে যেতে হবে৷ কাজেই এ'সবের মধ্যিখানে বিকেল-বিকেল করে নেত্য না করলেই আপনার মঙ্গল৷ 

- কিছু মনে করবেন না গোলদারবাবু। আপনি ভারি কাঠখোট্টা।  

- আমি আছি তাই আপনি ভেসে যাননি এদ্দিন।

- থামুন মশায়৷ করোলবাগ পৌঁছতে এখনও ঢের দেরী। তার আগে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এমন হাইক্লাস বিকেলের শোভাটাকে যত্ন করে অ্যাবসর্ব করা।

- তা সেই অ্যাবসর্ব করার প্রসেসটা কী?

- করোলবাগের রাস্তায় শুনেছি মারাত্মক লেভেলের মনভোলানো ছোলেকুলচে পাওয়া যায়৷ 

- এই একরোগ৷ কথায় কথায় খালি গেলার স্বপ্ন দেখা৷ ধুর। কাজের আগে অত খাইখাই করতে নেই। 

- আরে, খাওয়ার কথা কে বলছে। ইম্যাজিন করুন, এমন সোনালী বিকেল আর সন্ধ্যের আবছায়া এসে মিশছে। বাতাসে রোম্যান্টিক 'আমিই উত্তম আমিই উত্তম' মার্কা একটা মিহি ইয়ে। আর সেই দিলদার আবহে...।

- দিল্লীতে এসে উত্তমের বদলে মুঘলাই কায়দা নামালে হয় না? মখমলের ওয়াড় দেওয়া বালিশ বুকে চেপে শায়রি ভাঁজা বাদশার রঙিন মেজাজ?

- আপ রুচি রোম্যান্স মশাই৷ যা হোক৷ সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, ছোলেকুলচের সুবাস বুকে নিয়ে, সুমনাকে একটা চিঠি লিখব।

- সুমনা? গোলাপবাবু? ফিজিক্স অনার্স সুমনা?

- ফিজিক্স অনার্স সুমনা। 

- যে সামনে এসে পড়লে আপনার গলা দিয়ে ননস্টপ একটা নালায় লেংচে পড়া ঘোড়ার মত চিঁচিঁ শব্দ বেরোত?

- সেই সুমনা।

- তাকে চিঠি লিখবেন? সে কী! কয়েক যুগ ভদ্রলোকের সংস্পর্শ থেকে দূরে বাস করছেন। এখন কোথায় সুমনা, আর কোথায় ভাড়াটে গুণ্ডা গোলাপবাবু। ঠিকানা পাবেন কোথায়? 

- গোলদারবাবু৷ আপনার দ্বারা এ'সব ফাইন ব্যাপারস্যাপার বোঝা সম্ভব নয়। আরে সেরা চিঠিরা পোস্ট হয় না। ড্রয়ারের গোপন কোণায় বা বইখাতার ভাঁজে তাদের পুষে রাখতে হয়। 

- নাহ্৷ আজ আপনি ডোবাবেন দেখছি গোলাপবাবু।

- যদি সত্যিই মনোরোম বিকেলে; করোলবাগের রাস্তার ধারে বসে, ছোলকুলচার সুবাস ইন্সপায়ার্ড প্রেম-প্রেম চিঠি লিখতে গিয়ে তোলা আদায় ডুবে যায় গোলদারবাবু, তবে জানবেন এখনও বেঁচে থাকার ধক আছে এই শর্মার।

- এই সেরেছে!

***

ভদ্রলোকের যেমন কথা তেমনি কাজ। অটোরিক্সা করোলবাগ অঞ্চলে পৌঁছতেই অটোচালককে নবাবি মেজাজে বললেন গোলাপ গোলদার;

"অটোমশাই, ইধর কিসি খাতাকলম কা দোকান মে রুকিয়েগা। দু'টো চিঠি লিখনে কা শৌখিন কাগজ অউর এক গুলাবি খাম, মানে ইয়ে, এনভিলপ লেনা হ্যায়৷ কেমন"?

Saturday, July 1, 2023

দিল্লীওলা



দিল্লীওলা আমার অন্যতম প্রিয় ট্যুইটার হ্যান্ডেল। ছবির ভালোমন্দ বলার আমি কে। তবে যে ভালোবাসা নিয়ে তিনি দিল্লীর ছোট-ছোট টুকরোগুলোকে ফ্রেম-বন্দী করেন, সে'টাকে সেলাম না ঠুকে থাকা যায় না। তিনি একদিক দিয়ে যেমন ফটো-জার্নালিস্ট, অন্যদিকে ফটো-বাউলও গোছের একটা ব্যাজ পরিয়ে দিলেও দিব্যি মানাবে তাঁকে। আটপৌরে যা কিছু, তার মধ্যেই জাদুমন্ত্র খুঁজে বেড়ানো মানুষ এই ময়ঙ্ক অস্টেন সুফি ওরফে দিল্লীওলা।

অবশ্য আমি আদৌ তাঁকে চিনি না। যে'টুকু দেখেছি তা টুইটার টাইমলাইনেই। এক ক্লান্ত ছোলেকুলচেওলা, বেঞ্চির ওপর পড়ে থাকা একটা শুকনো পাতা অথবা দিল্লীর মেঘলা আকাশ; ওর যে'কোনও ছবির দিকে তাকালেই মনে হয় কী সাধারণ, অথচ কী মায়ার; নির্ঘাত কেউ গল্প লিখছে। আর ওর ক্যাপশনগুলো পড়লে হয়ত যে কারুর মনে হবে যে ফটো-বাউল কথাটা নেহাত ফেলনা নয়। দিল্লীওলার টাইমলাইনের দিকে তাকানোর পর বার বার মনে হয়, "আরে, আমার চারপাশে না জানি কত ম্যাজিক পড়ে আছে। আমিই এক বেওকুফ...পাত্তা না দিয়ে ক্রমাগত খিটখিট করে চলেছি"।

দিল্লী ছেড়েছি মাসখানেক হল। বম্বেতে বসে মাঝেমধ্যেই দিল্লীওলার ছবি দেখি, ক্যাপশন পড়ি। আর যত দেখি, তত মনে হয়, "ইন্টারেস্টিং! আমি তা'হলেও দিল্লীকেও ঠিকঠাক ভাবেই ভালোবেসেছি"।

প্রতিটা শহরের যেন এমন কিছু কবি-ক্রনিকলর জুটে যায়।

Thursday, February 16, 2023

ইউফোরিয়া



~~খিলখিলাতি হ্যায় উয়ো নদীয়া, নদীয়া মে হ্যায় এক নইয়া~~

জমজমাট সূর্যকুণ্ডের মেলা (সুরজকুণ্ড্‌ বলা উচিৎ নাকি?)। অফিসের পর সন্ধেবেলা বিস্তর ট্র্যাফিক ঠেলে সে মেলায় গেছি রকমারি জিনিসপত্র দেখতে, খাবারদাবারের দোকানগুলোয় পেট ভরাতে, আর সর্বোপরি ভিড়ে নাকানিচোবানি খেতে। মেলায় গিয়ে মানুষে যা করে আর কী। ও মা, গিয়ে শুনি সে'খানে পলাশ সেন গান গাইবেন, ইউফোরিয়ার শো শুরু হবে খোলা অ্যাম্পিথিয়েটারে, অবাধ প্রবেশ। "ধুম পিচক ধুম" ফেনোমেনাটা একসময় মজ্জায় এসে মিশেছিল। নিজেকে সঙ্গীত-বোদ্ধা বলে লোক হাসানোর মানে হয়না। তবে গানের প্রতি ভালোবাসায় খানিকটা অবুঝ না হলেও চলে না বোধ হয়। আমার ডানা গজানোর বয়সে সেই গান আবিষ্কার করি। এখনও মনে আছে, আমাদের স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে আমার কিছু ক্লাসমেট সে গান গেয়ে আসর জমিয়ে দিয়েছিল। সে বয়সে প্রথম প্রেমের হুহু, সেই হুহুর সঙ্গে যে'সব গান এসে মিশে গেছিল, তাদের মধ্যে এই ধুম-পিচক-ধুম অন্যতম। এ অভিজ্ঞতা আদৌ অভিনব নয়, আমার বয়সী অনেকেই এ ব্যাপারটা ধরতে পারবেন। চন্দননগরের অলিগলি দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি দুই বন্ধু, আর দু'জনে বিশ্রী বেসুরো গলায় চিল্লিয়ে গাইছি 'মায়েরি' বা 'ক্যায়সে ভুলেগি মেরা নাম'। স্বস্তির ব্যাপার হল যে নিজের বেসুর নিজের কানে বাজে না। যা হোক, এহেন ইউফোরিয়ার গানের আসর, সে নিশির ডাক উপেক্ষা করি কী করে। কাজেই আমরা দ্যাবা-দেবী সেই খোলা মঞ্চের সামনে চলে গেলাম। ভিড় সত্ত্বেও জায়গা বাগিয়ে নিতে অসুবিধে হল না।




~~কেহতা হ্যায় যো কহে জমানা, তেরা মেরা পেয়ার পুরানা~~

আমাদের আশেপাশে যারা বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়সই মনে হল আমাদের চেয়ে হয়ে বেশি খানিকটা কম অথবা বেশ খানিকটা বেশি। মোদ্দা কথা টীম 'নাইনটিজ'কে মাইনরিটিই মনে হল। যা হোক, একসময় স্টেজে একটা স্ফুলিঙ্গের মত উদয় হলেন পলাশ সেন, অকারণ সময় নষ্ট না করে গান ধরলেন। অমনি সেই ছোটবেলার গন্ধ-দৃশ্যগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। তেমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ওই সূরজকুণ্ডের হৈহল্লার মধ্যে কেউ বাংলার মফস্বলের বিকেল আর টিউশনি-ফেরত সাইকেলের ক্যাঁচরম্যাচর মিশিয়ে দিল যেন। আমরাও দিব্যি গালে হাত রাখে শুনতে আরম্ভ করেছিলাম। আচমকা মেজাজের সুতো ছিঁড়ে দিলেন পলাশ সেন নিজেই, বললেন "এই যে দাদা-বোনেরা, আপনারা কি গা এলিয়ে শুয়ে বসে গান শুনতে এসেছেন নাকি? রামোহ্‌ রামোহ্‌! আরে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ান দিকি। লম্ফঝম্প করতে হবে তো। আমি তো আর ভজন-গজল গাইতে আসিনি, চেল্লাতে এসেছি। কাজেই নেহাত আর্থ্রাইটিসের ঝামেলা না থাকলে, দাঁড়িয়ে পড়ুন, গর্জে উঠুন"। কী বলি, আমি ছাই গানটান বুঝি না। আমার ছেলেবেলার হিরো আওয়াজ দিচ্ছে, আমি সেলাম ঠুকবো; আমার কাছে ও'টাই হল গিয়ে মূল এন্টারটেইনমেন্ট। কাজেই ডাক্তার সেনের দাবীমত নির্দ্বিধায় সেই বাঁধানো সিমেন্টের বসার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে টের পেলাম, ইতিউতি দু'চারজন দাঁড়িয়েছেন বড়জোর, পাবলিকের গড়িমসি তখনও কাটেনি। মনেমনে চিৎকার করে উঠলাম, "এ কী! ক্লাসরুমের মধ্যে স্যার দাঁড়াতে বলেছেন! এর পরেও বসে থাকাটা কেমন বেয়াদপি"! যাকগে, সে বেরসিকদের পাত্তা না দিয়ে বেখাপ্পা ভাবে পলাশবাবুর গানের তালে ড্যাংড্যাং করে দু'হাত হাওয়ায় ছুঁড়তে শুরু করলাম।




~~যতন করে রাখিব তোরে মোর বুকের মধ্যে মাঝি রে~~

পলাশ সেন ধরলেন "ধুম পিচক ধুম"। আমরা যারা 'নব্বুইয়ের মাল' সে এলাকায় ছিলাম, তাঁরা সবাই খ্যাপা বাউলের মত দুলে চলেছি। আমরা সংখ্যালঘু হতে পারি, মধ্যবয়সী ভারে সামান্য ন্যুব্জ হতে পারি। তা বলে ইউফোরিয়ার গানে বিসর্জন-নাচের মোডে ঢুকে যাব না? আরে! পলাশ সেন চেঁচিয়ে বলছেন "আ রে মেরি ধড়কন আ রে"। এ ডাক শুনে কে না লাফিয়ে থাকতে পারে? অবাক হয়ে দেখলাম অনেকেই পারেন। পলাশ সেনও মহাঢিঁট মানুষ দেখলাম। বেশিরভাগ জনতা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াবেন না, পলাশবাবুও তাঁদের স্বস্তি দেবেন না। খুব হিসেব কষে, 'ধুম পিচক ধুম' গানের শেষে সামান্য ব্যাকফুটে গেলেন পলাশবাবু। ততক্ষণে ভদ্রলোকের রোখ চেপে গেছিল বোধ হয়। আচমকা একের পর এক নতুন হিট গান গাওয়া শুরু করলেন, ধরলেন হিট সব পাঞ্জাবি গান; এমন কি "কালা চশমা"ও বাদ গেল না। মাইরি, অমন মারাত্মক লাফঝাঁপ করে গেয়ে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক, অথচ গলায় ক্লান্তি নেই, সুরে দুলকির অভাব নেই। এই অ-ইউফোরিও ডিস্কোঝড়ে গলল পাথর। জমে উঠল আসর, মানুষজন সত্যিই মেতে উঠল, জমে উঠল গানের মেলা।


~~ Crescendo /krɪˈʃɛndəʊ/
the highest point reached in a progressive increase of intensity ~~

এরপরেই তুরুপের তাসটা বের করে আনলেন পলাশবাবু; ধারালো জাদুতে শ'পাঁচেক মানুষের পায়ের তলা থেকে কার্পেট উড়িয়ে দিলেন। গাইতে শুরু করলেন "মায়েরি"। আর এমন গাইলেন, যে স্রেফ ওই একটা গান শোনার জন্য শ'খানেক মাইল পথ হেঁটে যাওয়াই যায়। আর সে গানটাই গোটা সন্ধেটাকে অন্য স্তরে নিয়ে চলে গেল, সে'খান থেকে আর ফিরে তাকানোর উপায় নেই। গা ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরের একটা ঘণ্টা পলাশবাবু যদি খবরের কাগজ পড়েও শোনাতেন, তা'হলে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যেত। সবচেয়ে বড় কথা, ঠিক ওই মায়েরি পার্ফর্ম্যান্স থেকে নব্বুই-অনব্বুইয়ের তফাৎটা ধুয়ে-মুছে গেল। দর্শকাসনের প্রতিটা মানুষ তখন ইউফোরিয়ার সামনে নতজানু, এবং খানিকটা 'ইউফোরিক'ও বটে। আর সে গান শুনলে যেমনটা হওয়ার কথা আর কী, পলাশবাবুর গলার দাপট আর সে সুরের মায়া টেনে নিয়ে গেল কৈশোরের প্রেমে। এবং ভেবে অবাক হলাম, সেই ছেলেবেলার প্রেম আর ভালোবাসার মানুষে আটকে নেই। পাড়ার চেনা গলির ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দেওয়া হিরো ইম্প্যাক্ট সাইকেল, চেনা চায়ের দোকানের বেঞ্চি, পিঠে ঝোলানো পড়ার বইয়ের ব্যাগের মধ্যে রাখা টেনিসবল; সমস্তই বড় অনাবিলভাবে ফেরত এলো। পলাশ সেন ততক্ষণে শ্রোতাদের মনঃপ্রাণ দখল করে ফেলেছেন। আর নব্বুই ব্র্যান্ডের আমরা যেক'টি প্রডাক্ট ইতিউতি ছড়িয়ে ছিলাম, তাঁরা সবাই অন্যান্য মুগ্ধ শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে চলেছি, "কেমন দিলাম"? আসলে, আমরাই তো তখন ইউফোরিয়া।

Sunday, February 12, 2023

কমলা সুইটসের ভেজিটেবল চপ



টেস্টবাডঃ বুইলে ভাইটি, একটা ম্যাজিক টের পাচ্চি।
মনঃ কী রকম?
টেস্টবাডঃ মনে হচ্চে যেন নতুন ডানা পেইচি। উড়চি উড়চি উড়চি, উড়েই চলিচি।
মনঃ সে তো ভালো কথা!
টেস্টবাডঃ সিক্রেটটা জানতে চাইবেনা?
মনঃ নোলা ছুকছুকে আবার সিক্রেট কীসে৷ কী সাঁটালে?
টেস্টবাডঃ অমন গাম্বাট স্টাইলে ডায়লগ ছুঁড়বে না; কতবার এ'কথা বলিচি৷ নোলা চুকচুক, সাঁটানো; এ'সব আবার কী ধরণের ল্যাঙ্গুয়েজ? তুমি কি এমএলএ'র পোষা মাস্তান? শোনো, এই প্রবাসে মারাত্মক ভালো ভেজটেবল চপ পেইচি।
মনঃ এ'দিককার ভেজটেবল চপ? তা'তে কি আর সেই বাংলার ওম আছে?
টেস্টবাডঃ আরে আচে রে বাওয়া, ওম আচে, ওম পুরি আচে। হরি ওম আচে। চিত্তরঞ্জন পার্কের কমলা স্যুইটস থেকে খেলাম দু'পিস। অবিকল সেই ফেলে আসা পাড়ার চপের দোকান থেকে কেনা চপের স্বাদ ভাইটি। এক নম্বর৷ ছেলেবেলার সন্ধ্যে মনে পড়ে গেল৷ টিউশনি-স্যারের গাঁট্টা আর অঙ্কে গোল্লা মনে পড়ে গেল; এত অথেন্টিক সে চপের স্বাদ।
মনঃ পাড়া মনে পড়ে গেল? ছেলেবেলাও? এমন ধারালো সে চপের স্বাদ?
টেস্টবাডঃ নয়ত আর বলচি কেন..ও জিনিসে কামড় দিতে পারলে অহল্যাকে আর রামচন্দরের অপেক্কা করতে হতনা।
মনঃ কামড় শুধু চপেই পড়েনি দা'ভাই। পকেটেও পড়েছে।
টেস্টবাডঃ পকেটে কামড় পড়েচে? কী'রকম?.
মনঃ সাতাশ টাকার চপ।
টেস্টবাডঃ সাতাশ টাকায় এক জোড়া ভেজটেবল চপ খেলাম নাকি? ভায়া?
মনঃ সাতাশ টাকা জোড়া নয়, সাতাশটাকা পিস! চুয়ান্ন টাকায় দু'পিস চপ খেয়ে এলে দা'ভাই।
টেস্টবাডঃ ডানা ছাঁটা গেল। স্বাদে ভাটা পড়ল। কেমন দমে গেলাম৷ রোলটির দামে চপটি খেলাম ভাই?
মনঃ দমে যাওয়ার কী৷ বিদেশবিভুঁইয়ে থেকে, চপে ম্যাজিক কামড় দিয়ে ছেলেবেলার পাড়ায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ, ট্যাক্স দেবে না?
টেস্টবাডঃ নাহ্, ভেবে লাভ কী। বরং একটা বাউল ধরচি৷

Sunday, November 6, 2022

রামলীলা আর মেলা


নয়ডা স্টেডিয়াম লাগোয়া ময়দানে রামলীলার জবরদস্ত মেলা দেখে এলাম আজ৷ সে'খানে পৌঁছনো মাত্রই বেগুসরাইয়ে মেলা ঘোরার সুখস্মৃতি দিব্যি মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে গেল। হাইক্লাস মেলার সমস্ত রসদই ছিল। বিভিন্ন সাইজের নাগরদোলা, রকমারী খাবারদাবারের ঝলমলে সব স্টল, কচিকাঁচাদের হইহল্লা, আধবুড়োদের মাতব্বরি, খতরনাক মউত কা কুয়া, ছোটখাটো একটা সার্কাস, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর আয়োজন, জিলিপির দোকান; সাজসরঞ্জামের অভাব ছিলনা৷

যা বুঝলাম, নাগরদোলার টিকিটের দাম হুহু করে বেড়েছে৷ অবশ্য কোনও কিছুর দামই তো পড়তির দিকে নয়, নাগোরদোলাওলাদের আর কী দোষ। তবে খরচ বাড়লেও, তাতে মেলামুখো মানুষের আগ্রহ মিইয়ে যায়নি৷ আর যাই হোক, করোনায় দু'বছর দমবন্ধ করে বসে থাকার পর চলাফেরা জমায়েত হৈ-হুল্লোড় সবে শুরু হয়েছে যে।

গোড়াতেই বলেছি। এ মেলা খানিকটা বিহারের স্মৃতি উস্কে দিয়েছে৷ সেই উস্কানি পূর্ণতা পেল লিট্টির দোকানে এসে৷ লিট্টিদাদা ব্যস্ততাও চোখে পড়ার মত৷ ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজনের মেলায় লিট্টির এই সমাদর দেখে খানিকটা গর্বও হল বটে৷ বিহারের প্রতি আন্তরিক টানটা রয়ে গেছে দেখছি।

আমাদের ও'দিকে মফস্বলের মেলায় রোলের দোকানের যেমন দাপট, এ'দিকে সে দাপট বোধ হয় টিক্কিচাট গোছের স্টলগুলোর৷ দিল্লী, নয়ডার দিকে মানুষের চাটভক্তি চোখে পড়ার মত৷ আর শত-ব্যস্ততার মধ্যেও এই তরুণ চাট-আর্টিস্ট পোজ দিতে বা খেজুরে গল্প জুড়তে পিছপা হচ্ছেন না৷ সে উষ্ণতায় মনে হয়; কোভিডকে বোধ হয় আমরা সত্যিই খানিকটা দমিয়ে দিতে পেরেছি৷ খানিকটা অন্তত।
মিষ্টিমুখের আয়োজনও ছিল, গরম গুলাবজামুনের দেখলাম বেশ কদর৷ মিঠেপানের দোকানও জুটে গেল৷ বেশিরভাগ দোকানই সামাল দিচ্ছে অল্পবয়সী ছেলেপিলের দল; মেলার ভ্যাগাবন্ড দোকান বলে তাদের 'ফোকাস অন সার্ভিস এক্সেলেন্স' ফিকে হয়ে যায়নি৷ আর আজকাল একটা মস্তসুবিধে; ছোটখাটো দোকানেও ইউপিআই বা ডিজিটাল ওয়ালেট থেকে টাকা দেওয়া যাচ্ছে। কাজেই পকেটে তেমন টাকাপয়সা না থাকলেও দিব্যি টপাটপ গোলাপজাম সাফ করে দেওয়াই যায়।

খাওয়াদাওয়া-নাগরদোলা; এ'সব তো হল৷ এ'খানে এসে রামলীলার যাত্রাপালা (অবশ্য যাত্রা কথাটা এ'দিকে অচল) দেখবনা তা কী'করে হয়৷ ইয়াব্বড় মাঠ, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কালো মাথার গিজগিজ৷ আর পালার সে কী এনার্জি৷ ইমোশনের সে কী মার্ভেলাস টানাপোড়েন। আধমাইল দূরে দাঁড়িয়েও সে থ্রিল অনুভব করা যায়৷ আর জানা-প্লটে অভিনয় করেও যে এমন উত্তেজনা মাঠভর্তি দর্শকদের মধ্যিখানে ছড়িয়ে দেওয়া যায়; সে'টা ভেবে দু'একবার ব্রাভো বলতেই হয়। দূর থেকে দেখার একটা অসুবিধে হল খোকার হাইটের প্রবলেম। অগত্যা খোকাকে কাঁধে নিয়ে মিনিট পনেরো রামের বিয়ে দেখলাম৷ সীতার 'বিদাই'য়ের সময় জনকরাজার সে কী হৃদয়বিদারক বুক-চাপড়ানো কান্না; তা শুনে পাথুরে মানুষকেও নড়েচড়ে বসতেই হবে৷
শেষপাতে অত্যন্ত খারাপ (এবং পোড়া) তেলে ভাজা সুস্বাদু পাপড় চিবুতে চিবুতে বাড়ি ফিরলাম। অল ইজ ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল৷

চাউমিনের দিল্লী কলকাতা



দিল্লী আসার পর থেকে রকমারি চাউমিন 'ট্রাই' করে চলেছি৷

কলকাতার মত চাউমিন৷
আদৌ কলকাতার মত নয়; তেমন চাউমিন।
কলকাতার মত বানাতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেছে; সে'রকম চাউমিন।
কলকাতার মত কোনও মতেই নয় তবু কোথাও যেন একটা চেনা স্বাদ মিশে আছে; ও'রকম চাউমিন।
হাফ-কলকাতা হাফ-দিল্লী গুবলেট চাউমিন।
কলকাতা হতে হতেও হল না চাউমিন৷
দিল্লীর বুকে আলতো-বেহালা চাউমিন৷

এমন অন্তত সতেরো রকমের ভ্যারাইটি৷ ভেবেটেবে দেখলাম, কোনওটাই জিভে তেমন আপত্তিকর ঠেকেনি৷ বরাতজোরে যে'দিন কলকাতা ফিরে যাব, সে'দিন হয়ত আবার দিল্লীর ফিল্টারে বসিয়ে কলকাতার চাউমিনদের নতুন করে চেখে দেখা শুরু করব।

বার বার ফিরে যাওয়া



খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে যতই গালগল্প করি, ক্লাস এইট-নাইনের পর থেকে আমার টেস্টবাড আদৌ ইভলভ করেনি৷ কুইসিনটুইসিন নিয়ে বাছবিচারও কোনও কালেই ছিলনা৷ তেলঝাল টানটান, মশলাপাতি জমজমাট, ডুবো তেলে ভাজা বা তেড়ে কষানো; এ সমস্ত কিছুর প্রতিই আমার আগ্রহ অসীম৷ আর ওই গতানুগতিক সাতআটটা আইটেম আছে, যে'গুলোয় বারবার ফিরে যাই।

কম্বিনেশনের ব্যাপারেও আমার অত ধানাইপানাই নেই৷ এই যেমন বাটার নান দিয়ে বাটার চিকেন আর চিলি চিকেন৷ একগ্রাস বাটারচিকেন-নান আর তারপরেই চিলিচিকেন-নান৷ এই ভাবে একটানা..প্লেট সাফ না হওয়া পর্যন্ত। মাঝেমধ্যে কচাত কামড় ভিনিগারে চুবিয়ে রাখা ডুমোডুমো পেঁয়াজে। ও'টাই আমার কাছে অমৃত৷ চিত্তরঞ্জন পার্কের দিকে একটা ক্যালকেশিয়ান মেজাজের রেস্টুরেন্ট খুঁজে পেয়েছি৷ ইয়ে, বাঙালি রেস্টুরেন্ট নয়, কিন্তু ওই আমাদের ও'দিকের শহরতলির নর্থ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের রান্নাবান্না খানিকটা এমনই৷ দিল্লীতে বসে কোথায় অথেন্টিক পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্ট পাকড়াও করব, তা না৷ ছেলেবেলার ভালোলাগা স্বাদ খুঁজে হদ্দ হচ্ছি৷ ব্যাপারটা ভেবে মাঝেমধ্যে একটু দমে যাই বটে; জিভটা ম্যাচিওর করলনা৷

তবে, ভালোও লাগে।

মাইরি, বাটারচিকেন আর চিলিচিকেন যে কী সুন্দর আমে-দুধে মিশে যায় (মিশে যায় বলতে দু'টো ঝোল মিশিয়ে খাওয়া নয়৷ ওই, অলটারনেটলি)৷ আহা। নাক কুঁচকোবেন না প্লীজ৷ ওরকম কনট্রাস্টিং স্বাদের আসা-যাওয়ায় জিভ এক্কেবারে চাক্কুর মত ধারালো হয়ে ওঠে৷ চেখে দেখবেন৷

Saturday, February 19, 2022

সুন্দর নার্সারি




দিল্লীর সুন্দর নার্সারি যেমন সবুজ, তেমনই ছিমছাম৷ জানুয়ারির উইকেন্ড-ভিড়েও দেখেছি যে নিজেদের জন্য নিরুপদ্রব, ঘেসো এবং পরিস্কার এলাকা দিব্যি জুটিয়ে নেওয়া যায়৷ আজ একাই দুপুর-দুপুর ঝোল-ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম৷ প্রথমে ভাবলাম নতুন কোনও জায়গায় যাই, তারপর মনে পড়ল সুন্দর নার্সারির কাছাকাছিই রয়েছে নিজামুদ্দিন মার্কেট যে'খানে দিনকয়েক আগেই এসেছিলাম চমৎকার কাবাব খেতে৷ কাজেই নার্সারি ঘুরে সুন্দর কাবাব খেয়ে বাড়ি ফেরার প্ল্যানটাই যুক্তিযুক্ত মনে হল৷ 


প্রথম দিল্লী এসে যখন সুন্দর নার্সারির কথা শুনেছিলাম তখন ভেবেছিলাম  শৌখিন মানুষের ডালিয়া পিটুনিয়া আর ভালো কোয়ালিটির সার কিনবার জায়গা বোধহয়৷ ইতিহাস আর জেনারেল নলেজে কাঁচা হলে যা হয়৷ কিন্তু ভুল ভাঙার জন্য সশরীরে আসার দরকার নেই, গুগল করলেই হল৷ ষোলো শতকে মুঘলরা বানিয়েছিল পেল্লায় আজিম বাগ, সাহেবসুবোদের হাতে এ'খানে নার্সারি তৈরি হল ১৯১৩ নাগাদ৷ বর্তমানে নাকি শ'তিনেক রকমের গাছপালা রয়েছে এ'খানে৷ আমার মত অসবুজ গাম্বাট মানুষের জন্য অবশ্য গাছপালা মূলত চার রকমের; পেল্লায়, মাঝারি,  ছোটখাটো আর ঘাস-জাতিয়৷ কাজেই 'রেয়ার প্ল্যান্টস' দেখে লাফিয়ে ওঠার জ্ঞানগম্যি আমার নেই, যাদের আছে তাদের জন্য সুন্দর নার্সারি আরও উপভোগ্য৷ 


আমার জন্য সুন্দর নার্সারির মূল টান হল ওই সুবিশাল এলাকা, তাও আবার শহরের ঠিক মধ্যিখানে৷ এ বিষয়ে অবশ্য দিল্লীর জবাব নেই৷ লোধি গার্ডেন, সুন্দর নার্সারি ছাড়াও অজস্র এমন জায়গা রয়েছে যে'খানে হাত-পা ছড়িয়ে দিব্যি একটা বেলা কাটানো যায়; ভালোমন্দ খেয়ে, গা এলিয়ে গল্পের বই পড়ে ফেরা যায়৷ ভিড়ের চোটে এক বাড়ির লুচির পাশে অন্য বাড়ির চচ্চড়ি পড়ে যায়না৷  এই সুন্দর নার্সারিতে আর একটা দারুণ ব্যাপার হল কানে দিব্যি ঘণ্টাখানেক স্রেফ হেঁটেও কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে, গোটা ব্যাপারটাই একটা হাইক্লাস 'ওয়াক ইন দ্য পার্ক' আর কী৷


মাঝামধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন মোগলাই স্থাপত্য।  কোনওটাই পেল্লায় নয় তবে সুন্দর, যেমন সুন্দর বুর্জ (সুন্দর নার্সারি এই সুন্দরেই সুন্দর), সুন্দরওলা মহল, লক্কড়ওলা বুর্জ ইত্যাদি৷ সুন্দত বুর্জের সামনে যে সেন্ট্রাল অ্যাক্সিস এবং খানিকটা এগিয়ে যে জলাশয়, সে'সবই অতি চমৎকার৷ আর্কিটেকচার নিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই, তবে অন্য একট বিষয়ে নিজের ভালো লাগা জাহির করতেইব হয়৷ সবচেয়ে সুন্দর নার্সারির মধ্যের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে একটা দুর্দান্ত মিঠে আর মনোগ্রাহী নাম রয়েছে; ছোটা বাতাসেওয়ালা৷ ওই নামে একটা রেলস্টেশন, একটা হিলস্টেশন আর একটা গ্রাম্য মেলাও থাকা উচিৎ৷ এ'ছাড়া রয়েছে প্রচুর ফুল। আর লক্কড়ওলা বুর্জের সামনের গোলাপ বাগানটা অত্যন্ত চমৎকার।


যা হোক৷ সুন্দর নার্সারিতে আমার মূল টান অবশ্য শীতের দুপুরে ঘাসের ওপর চাদর পেতে গা এলিয়ে বসায় (এবং শোওয়ায়)৷ সঙ্গে সামান্য খানাপিনা না থাকলে আসর জমজমাট হয় না৷ গতমাসে যখন সবাই মিলে এসেছিলেম তখন সঙ্গে ছিল তিনকোণা পরোটা, ডিম কষা, কাশ্মিরি আলুর দম, গাজরের হালুয়া আর সি আর পার্ক থেকে কেনা রসের মিষ্টি৷ বিকেলের জন্য কফিও আনা হয়েছিল ফ্লাস্কে, সঙ্গে নিমকিটিমকি৷ 

আজ হুট করে একাই চলে আসায় সে আড়ম্বর বাদ পড়েছে৷ চাদরের বদলে ঘাসের ওপরেই গা এলিয়ে বসতে হয়েছে। তবে ইয়ারফোনে গান ছিল, আর ছিল বই৷ মুখ চালানোর জন্য এক প্যাকেট বাপি চানাচুর এনেছিলাম অবশ্য। দিল্লীতে এখন সেই কড়া ঠাণ্ডা আর নেই, দিব্যি আরামদায়ক দুপুরের রোদ৷ গান, বই সরিয়ে রেখে খানিকক্ষণ ঝিমটিও দেওয়া গেল৷ তরতর করে দুপুর গড়িয়ে গেল৷ সন্ধ্যে নামার আগে হাঁটাহাঁটি করে খিদেটাকে চাগিয়ে তুলতে হবে, নয়ত নিজামুদ্দিনের কাবাব-সাফারিটাই মাটি৷

Tuesday, September 7, 2021

স্মৃতি ও স্বাদ



স্বাদবোধ, সঙ্গীতপ্রেম, সাহিত্যপ্রীতি।
এ'সবকিছুই যদি স্প্রেডশিট আর আইনকানুন মেনে হত তা'হলে তো জীবনের প্রতিটি কণাই পিরিওডিক টেবিলের মত অমোঘ হয়ে রইত। অতি সাধারণকে 'এইটা আমার' বলে আঁকড়ে ধরার দুঃসাহস মানুষের আছে বলেই আমাদের ভালোবাসা এখনও অ্যালগোরিদমে বাঁধা পড়েনি৷।
স্বাদ প্রসঙ্গেই বলি৷
এক্সাইড ব্র্যান্ড আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মোমোর এক নিবিড় যোগাযোগ; সে'টা আজও দিব্যি টের পাই৷ প্যাভলভের কুকুর ঘণ্টার টুংটাং শুনলেই সুস্বাদু মাংসের কথা ভেবে লালা ঝরাতো৷ আর আজকাল কোথাও ভালো মোমো চাখা মাত্রই আমার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে কলেজ-বয়সের এক্সাইড-রবীন্দ্রসদন মোড়ের ছবি৷ সবুজ বা লাল প্লাস্টিকের প্লেটে মোমো আর কন্ট্রাস্টিং লাল বা সবুজ প্লাস্টিকের বাটিতে সাদা জলজলে স্যুপ৷ আমার প্রথম মোমো খাওয়া সে'খানেই৷ সে মোমোর আদত স্বাদ তেমন মনে নেই, মনে থাকার কথাও নেই। কিন্তু ওই; সুখস্মৃতি তো আর মিলিটারি নিয়মে কুচকাওয়াজ করে চলাফেরা করে না। জুলাই মাসের খতরনাক গরম আর ফুটপাথের প্রবল ঠেলাঠেলি উপেক্ষা করে হুসহাস করে আগুন গরম স্যুপ খাচ্ছি আর কলজে কাঁপানো ঝাল লঙ্কার সসে মোমোয় মাখিয়ে মুখে চালান করছি; এই হাই-ভোল্টেজ স্মৃতিতে সহজে মরচে পড়বে না৷
আবার ধরা যাক গ্রেভি চাউ৷ ২০০১ বা ২০০২, বড়বাজারের সরস্বতী (সম্ভবত) নামের এক রেস্তোরাঁয় আমি প্রথম গ্রেভি চাউমিন চেখেছিলাম। আমি ঝোলে-ভাতে চিরকাল মানুষ৷ হয়ত সে সূত্রেই ঝোল মাখানো চাউমিনের সঙ্গে অতি সহজেই যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল৷ বলাই বাহুল্য, সেই রেস্টুরেন্ট ঠিক আদর্শ চাইনিজ নয়৷ অর্থাৎ সেখানে পোলাও, দোসা, ফ্রায়েড রাইস সবই ছিল। তবে সাদাটে ঝোল ঝোল ব্যাপারের মধ্যে চাউমিন, সেই অনাবিল অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি৷ এরপর যখন কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজস্ট্রিট লাগোয়া মেসবাড়িতে গিয়ে উঠলাম, তখন পকেটে বাড়তি দু'পয়সা জমলে সূর্য সেন স্ট্রিটের বীণা রেস্টুরেন্টে গিয়ে গ্রেভি চাউ অর্ডার করতাম৷ অতি সাধারণ রেস্টুরেন্ট, কিন্তু সে সময় সে'টাই 'লাক্সারি'র পর্যায় পড়ত৷ সেই চাউয়ের গ্রেভি বিভিন্ন সসে পরিপূর্ণ, কটকটে ঝাল৷ তবে সে স্বাদের সঙ্গে সে'সময়ের ভালোবাসা মিশে আছে৷ মেসবাড়িতে থাকার সময় আর এক সহজ 'চাইনিজ' গন্তব্য ছিল খোকনদার কেয়ার অফ ফুটপাত চাউমিন স্টল। খোকনদা গ্রেভি চাউ বানাবে কী করে, কেতাবি গ্রেভি নুডলস সম্বন্ধে হয়ত ওর কোনও ধারণাই ছিল না৷ কিন্তু চাইলেই হাফ-প্লেট চাউমিনের ওপর এক হাতা চিলি চিকেনের লালচে ঝোল ছড়িয়ে দিত৷ সে' স্বাদও অনন্য। স্বাভাবিক কারণেই, মেসের জনতার জন্য খোকনদা ছিলেন পরমাত্মীয়৷ "আর একটু গ্রেভি দেব নাকি ভাই, চিলিটা একদম টাটকা নামিয়েছি", খোকনদার এই দরাজ 'অফারে'র স্মৃতিই আমার জন্ম-জন্মান্তরের চায়নাটাউন৷

Monday, August 9, 2021

দ্য মঙ্ক অফ মাসকাবারি



এক সময় মনে হত মনের মত রেস্তোরাঁ বা বইয়ের দোকান খুঁজে পাওয়ার মত আনন্দ আর হয়না৷ পছন্দের রেস্তোরাঁর নির্দিষ্ট একটা টেবিলের প্রতি বাড়তি মায়া তৈরি হত, জুটে যেত খাবারদাবারের অর্ডার নেওয়া পরিচিত হাসিমুখ৷ মাসে বারদুই সে'খানে গিয়ে গা এলিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্দি৷ খাবার স্বাদটাই সে'খানে শেষ কথা নয়, সে'খানে জমে উঠত আড্ডা৷ হুড়মুড় থাকত না, সে'খানে মেনুকার্ড ধরে "আজ কী খাব" ভেবে ভেবে হন্যেও হতে হত না; কারণ সমস্তটাই বড্ড পরিচিত৷ অথবা ধরুন, প্রিয় বইয়ের দোকানের ম্যানেজারের সঙ্গে খেজুর জুড়তে পারার অসীম তৃপ্তি; তিনি আমার পছন্দ বুঝবেন, আমার আব্দারগুলো মনে রাখবেন৷ একমাস সে'খানে ঢুঁ না মারলে পরেরবার জিজ্ঞেস করবেন, "অনেকদিন পর যে...ভালো একটা সাজেশন আছে৷ আগে চা'টা আসুক, তারপর বলছি"৷ সে বইয়ের দোকানের ছোট প্লাস্টিকের টুলটাই হচ্ছে থেরাপি চেয়ার৷ সে'টায় বসে একের পর এক নতুন বইয়ের পাতা উলটে যাওয়া; সেলুনে নবরত্ন তেল দিয়ে ঝাড়া আধঘণ্টা মাসাজ করালেও সে স্বস্তি মিলবেনা। 

কিন্তু, আজকাল মনে হয় আদত তৃপ্তি রয়েছে একটা মনের মত মাসকাবারির দোকান খুঁজে পাওয়ার মধ্যে৷ বয়স? সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা। তবে একটা জবরদস্ত সেকেলে 'যা চাইবেন তাই পাবেন' মার্কা দোকান, যে'খানে খরিদ্দার-দোকানির মধ্যে 'মাইডিয়ার' গল্পগুজবের সুযোগ রয়েছে, তেমন একটা মান্থলি ডেস্টিনেশন খুঁজে পাওয়ার মধ্যে যে হাইক্লাস নির্বাণ রয়েছে, সে'টা অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছেনা। 

ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে সুপার-স্মুদ মাখনে-ছুরি ব্যাপার আছে বটে, তবে আলাপচারিতার তেমন সুযোগ নেই৷ মালপত্তর ট্রলি-কার্টে ফেলো, বিলিং কাউন্টারে যাও, অফার-ডিসকাউন্ট বুঝে নাও, খেল খতম৷ প্রবল এক্সেল-শিট মার্কা অভিজ্ঞতা৷ কিন্তু এই একটা চমৎকার সাতপুরনো 'মম অ্যান্ড পপ স্টোর' খুঁজে ফর্দ ধরিয়ে দেওয়ার তৃপ্তিই আলাদা। দোকানের উদ্যোগী কর্মীরা সে ফর্দ হাতে চনমনে স্টাইলে কাজে লেগে পড়বেন৷ আর ক্যাশবাক্সের সামনে বসা কাকার সঙ্গে শুরু হবে গল্প, আউট-অফ-দ্যি-ফর্দ শৌখিন জিনিসপত্তরের আইডিয়া জুটবে তাঁর থেকেই৷ 

" বার্মা থেকে একটা বিশেষ ধরণের নুডল আনিয়েছি৷ ইন্সট্যান্ট নয়৷ তবে স্বাদে ইন্স্ট্যান্টলি কাত করবেই৷ নিজে টেস্ট করেছি তাই কনফিডেন্ট"। 
অথবা
"মুরুক্ক সম্বন্ধে আপনার আগ্রহ আমি নোটিস করেছি। একটা স্পেশ্যাল গার্লিক ফ্লেভারের মুরুক্কু আনিয়েছি৷ হোম-মেড। দু'বাক্স দিয়ে দিচ্ছি। আমার গ্যারেন্টি"। 
অথবা
"শুনুন, সিক্কিম থেকে বড় এলাচ এসেছে৷ আপনার ফর্দে আমিই অ্যাড করে দিয়েছি"৷ 

এমন গল্প-আড্ডায় মাসকাবারি এগোবে৷ ম্যানেজারবাবু মাঝে একবার ক্যাশবাক্স ছেড়ে আমার জিনিসপত্র প্যাক করার প্রসেসটা যাচাই করে আসবেন৷ শেষে বিল তৈরি হবে কলমে, লেটারহেডের নীচে সাদা পাতায়৷ ঢাউস ক্যালকুলেটরে হিসেব হবে৷ দু'হাজার একশো বাহাত্তর টাকা রাউন্ড অফ হয়ে যাবে দু'হাজারে৷ তিনহাজার দু'শো বাইশ তিন হাজারে৷ গল্পটা হয়ত ভালো জমবে যেদিন রাতের দিকে তাঁর দোকানে যাব, কর্মীরা দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় চালাচ্ছে, অন্যান্য খরিদ্দার নেই৷ টাকার লেনদেন শেষ, আমার মালপত্তরের ব্যাগ পাশেই রাখা৷ ক্যাশবাক্সে প্রণাম ঠুকে খানিকক্ষণ দিলদরিয়া গল্পে মজবেন দোকানি কাকা; সৎ উপদেশ দেবেন খান দুই, খাবার অভ্যাস রিফাইন করতে বলবেন, " ফর্দে অত প্যাকেজড ফুড...নট গুড..নট গুড" মার্কা মৃদু তিরস্কারও জুটে যেতে পারে৷ হয়ত কোনও একদিন দু'জনেই একসঙ্গে দোকান থেকে বেরোব, তিনিই বলবেন, "চলো, পার্কিং পর্যন্ত তোমার সঙ্গে হেঁটে যাই"। দোকানের বাইরের সম্পর্কে "আপনি" থেকে "তুমি"-তে প্রমোশন পাবো। 

এমন একটা মাসকাবারির দোকান কপালে জুটলেই- প্রাণের হেঁসেলে শুরু হবে আরাম-চচ্চড়ি রান্নার ব্যস্ততা।

Tuesday, July 20, 2021

কর্পোরেট বাউল, রামপ্রসাদ আর দিল্লীর বৃষ্টি



- এ যে ক্যাটস অ্যান্ড ডগস ভায়া৷

- ট্র‍্যাফিকে জবাই হওয়া ছাড়া গতি দেখছি না৷

- আহ্, তোমার খালি হাফ গ্লাস এম্পটি৷ ট্র‍্যাফিকের হয়রানিটাই দেখলে? বৃষ্টির পারকুইজিটগুলো অবহেলা করলে চলবে কেন৷ সাফিশিয়েন্ট মিঠে হাওয়া, গরমের হাঁসফাঁস গন, সন্ধ্যের ফুলুরি রাতের খিচুড়ি..। ফোকাস অন দ্য কন্ট্রোলেবলস, ট্র‍্যাফিক তোমার হাতে নেই৷ কিন্তু খিচুড়ির পাশের ডিমভাজার কোয়ালিটি তোমারই হাতে রয়েছে৷ 

- চাকরীবাকরী ছেড়ে কর্পোরেট ট্রেনিংয়ে ঢুকে পড়ুন সুদীপদা৷ এ'সব সুড়সুড়ি দিয়ে বেশ টুপাইস ইনকাম হবে৷

- আমি নিজেকে কী বলি জানো? কর্পোরেট বাউল৷ প্রমোশনে নেই, ল্যাং মারামারিতে নেই৷ দিনের কাজ দিনের মধ্যে মিটিয়ে নাও আর তারপর জীবনপুরের পথিক মোডে মানুষ কালটিভেট করে বেড়াও৷

- তা এই বৃষ্টিকে কালটিভেট করতে হলে কী করতে হবে?

- জ্যামের দিকে দাঁত খিঁচিয়ে বসে না থেকে বৃষ্টির ফ্লোটা ফীল করো ব্রাদার৷ এ তো আর কলকাতা নয় যে ঘ্যানরঘ্যানর বৃষ্টি আড়াই মাস ধরে চলবে৷ দিল্লীতে এমন বৃষ্টি সহজে জোটে না৷ সো মেক দ্য মোস্ট অফ ইট৷ 

- কলকাতা৷ হুঁহ্৷

- ঝেড়ে কাশো৷ 

- কলকাতায় থাকতে কলকাতার বৃষ্টিকে কম গালাগাল দিইনি৷ অথচ এখন মনে হচ্ছে এমন দিনে গড়িয়াহাটে দাঁড়িয়ে ইলিশের দরদাম করলে মন্দ হত না৷ তারপর দাস কেবিন থেকে মোগলাই প্যাক করিয়ে নেওয়া৷ নাহ্, এ'সব ভেবে একটু খারাপই লাগছে সুদীপদা৷ আমি অবশ্য একটু হোমসিক বাই নেচার। 

- কী জানো ভায়া, বৃষ্টি ব্যাপারটা স্মৃতি আর সিনেমায় যতটায় সুন্দর, ডেলি প্যাসেঞ্জারিতে ততটা নয়। তবে আদত নির্বাণটা কোথায় জানো? টু রিয়ালাইজ দ্যাট ডেস্পাইট দ্য ইনকনিভিনিয়েন্সেস; সাম ডে, ইভেন দিস রেইন শ্যাল বি মিসড। একদিন এই দিল্লীর বৃষ্টির জন্যেও বুকের মধ্যে একটা হাহাকার অনুভব করবে৷ হাজার বারো বছর ধরে আমরা চাষবাস করে চলেছি হে, এই চাকরীর ঘানিটানা তো হালের ফ্যাশন৷ বৃষ্টিকে ভয় পাওয়া, শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা; এ আমাদের মজ্জায়৷ বহুদিন পর জবরদস্ত বৃষ্টি দেখলে বুক চলকে ওঠাটাই সিভিলাইজেশ্যন৷ 

- নাহ্৷ কর্পোরেট ট্রেনার না হয়ে বরং বাবাজী-টাবাজীই হয়ে পড়ুন৷ তা এই বৃষ্টির সন্ধ্যেকে ভালোবাসতে হলে কী করনীয়? 

- বাড়ি ফেরার তাড়া না থাকলে চলো তোমায় রামপ্রসাদ মিশ্রর মির্চি পকোড়া খাওয়াই৷ রামপ্রসাদের পকোড়া হাইক্লাস, তবে সে একটা ঝাল মিষ্টি চাটনি অফার করে; সে'টা লেজান্ডারি৷ সে আদতে বলিয়ার মানুষ, এবং দিল্লীর জামাই৷ তার চুয়ান্ন বছরের জীবনে বেয়াল্লিশ বছর দিল্লীতে থেকেছে সে, অথচ আজও নিজের গাঁয়ের কথা ভেবে সে ছটফট করে৷ আর সেই ছটফটটুকুই সে চ্যানেলাইজ করে তার পকোড়া ভাজায়৷ সে এক আর্টিস্ট ভায়া, কড়াই না ধরে ক্যানভাস ধরলে আজ সে ওয়ার্ল্ড ফেমাস হত। আর রামপ্রসাদ আমার ডিয়ারেস্ট বৃষ্টিতুতো ভাই৷ যাবে নাকি তার কাছে? তোমার দাসকেবিন আর গড়িয়াহাটের অভাব মিটিয়ে দেব, আই প্রমিস। 

- এ'সব জিনিয়াসের খবর আপনি পান কী করে?

- শুয়োরে শুয়োর চেনে আর বাউল চেনে বাউল। চলো, এ'বার রামপ্রসাদের দোকানে হানা দেওয়া যাক৷ তোমায় দিল্লীর বৃষ্টি না চেনালেই নয়৷ 

Monday, October 5, 2020

পুরানি দিল্লী


২০০৭। দিল্লী।

একটা প্রেম দাঁড় করানোর কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রোজকার ক্লাস শেষ হতেই ছুট; সোজা গিয়ে ছ'শো একুশ নম্বর বাস ধরে কনট প্লেস। দেখাসাক্ষাতের ব্যাপারটা বেশিরভাগ দিন ও'খানেই সারা হত। তারপর ইনার সার্কেল আর আউটার সার্কেল জুড়ে মাইলের পর মাইল হাঁটা। 

একটানা অকারণ হাঁটা, অর্ধেক দুপুর আর পুরোটা বিকেল জুড়ে। অকারণ; কারণ ওই বয়সের প্রেম-প্রেম হাহুতাশকে লজিকের ফ্রেমে ধরতে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি। 

কনট প্লেসের বেশিরভাগ দোকানপাট আর রেস্তোরাঁই কলেজপড়ুয়াদের পকেটের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর৷ সে বয়সে কেএফসির মত রেস্তোরাঁতে ঢুঁ মারার কনফিডেন্সও ছিলনা৷ ওয়েঙ্গার্সের স্যান্ডউইচ বা কেভেন্টার্সের শেকও বড্ড দামী মনে হত। আমাদের ভরসা ছিল মূলত ফুটপাতের খাবার বিক্রেতারা৷  শিঙাড়া, বাদামভাজা, আলুচাট, চিপস, 'স্লাশ', বরফগোলা; এই'সব।  বুকে 'অষ্টমীতে প্রথম দেখা' মার্কা হুহু থাকলে আলুচাটের থেকেও চিকেনরোলের সুবাস পাওয়া যায়। দিব্যি উতরে যেত সেই দুপুর আর বিকেলগুলো।

শুধু কোনও কোনও দিন হাঁটাহাঁটির মধ্যে পেত প্রবল খিদে। প্রবল। সুতীব্র। সে বয়সে খিদেপেটে মনে হত; পারলে মরিচ ছড়িয়ে, মাখন মাখিয়ে চেয়ার টেবিল বা এনসাইক্লোপিডিয়াও চিবিয়ে খেতে পারি বোধ হয়। সেই হাইক্লাস খিদে যে আলুচাট বা বাদামভাজায় বধ হবে না, সে'টাই স্বাভাবিক।  

আমরা গোটা এলাকা চষে ফেলে এমন একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম যে'খানে দশ-পনেরো দিনে একবার লাঞ্চ করলে পথে বসতে হবেনা। আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট। সে'খানকার বোলচাল বেশি নয় আর রান্নাবান্না বেশ মশলাদার। আমাদের অবশ্য বেশি এক্সপেরিমেন্ট করবার ক্ষমতা ছিল না। একটা প্রবল ভাবে অ-চৈনিক চিলি চিকেন বানাতো তারা৷ তার সঙ্গে রুমালি রুটি দিব্যি জমে যেত। যে'দিন তেমন মেগা-খিদের খপ্পরে পড়তাম, সে'দিন আমরা গিয়ে বসতাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টে। এক প্লেট চিলি চিকেনের দাম ওই একশোটাকা মত ছিল, দশ পিস পাওয়া যেত। ছ'পিস আমার প্লেটে, চার পিস তার। রুমালি রুটিও বেশ সস্তাই ছিল।  ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট না থাকলে আমাদের মাঝেমধ্যে অমন আয়েস করে বসে গল্প করা হত না, হেঁটেই হদ্দ হতে হত। 

এক প্লেট চিলি চিকেন আর খান ছয়েক রুটি অর্ডার দিয়ে রহিসি মেজাজে গল্প শুরু হত। দশ মিনিটের মাথায় খাবার সার্ভ হয়ে যেত টেবিলে; সঙ্গে বোনাস - পুদীনার চাটনি আর কুচোনো পেঁয়াজ। ছ'টা রুটির চারটে আমার থালায়। 

খাবার আসা মাত্রই পেটের খিদে চারগুণ, চোখের সামনের জলজ্যান্ত প্রেমিকাটি আবছা হয়ে আসত। জীবনে পড়ে রইত শুধু ওই ছ'পিস চিলি চিকেন আর ছ'টা রুমালি রুটি। স্রেফ চিলি চিকেনের ঝোল ছুঁইয়ে চারটে রুমালি উড়ে যেত, তখনও চিকেনের টুকরোগুলো অক্ষত।  আরও দু'টো রুমালি চেয়ে নেওয়া হত। সাত নম্বর রুমালি শেষ হলে চোখের সামনে প্রেমিকার অবয়ব ফের স্পষ্ট হয়ে উঠত। সে তখনও দু'নম্বর রুমালি রুটি নিয়ে টুকুরটুকুর চালিয়ে যাচ্ছে। আট নম্বর রুমালিতে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে ভাসিয়ে দিতাম সেই 'একবার বলো উত্তমকুমার' লেভেলের আর্তি;
"তোমার থেকে হাফ-পিস চিলিচিকেন পাওয়া যাবে"?

ও'দিক থেকে হাফ-পিসের বদলে একটা গোটা পিসই উঠে আসত আমার পাতে। সে কী সহাস্য আস্কারা।  

মুখে বলতাম " আহা, এতটা আবার কেন"? অথচ মনের মধ্যে তখন চিত্রহার, রঙ্গোলী আর সুপারহিট মুকাবলা  একসঙ্গে ফায়্যার হচ্ছে।

**

বহুদিন পর গতকাল আবার গেছিলাম কনট প্লেসের ও'দিকে৷ এক জোড়া রুমালিতে ঘায়েল হওয়া সেই মানুষটাই ডেকে দেখাল; ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের রংটা এখনও পাল্টায়নি।

Thursday, August 13, 2020

অরূপ ঘোষালের শহর

- এক্সকিউজ মি।

- আপ মুঝে বুলা রহে হ্যায়?

- আরে হ্যাঁ রে বাবা। আপনাকেই বুলা রহে হ্যায়।

- আরে, আপনিও বাঙালি যে।

- নমস্কার। সঞ্জয় ঘোষ। 

- নমস্কার। আমি অরূপ ঘোষাল। কিন্তু দিল্লীর রাস্তার এই ভীড়ের মধ্যে আমায় বাঙালি বলে ঠাহর করলেন কী করে বলুন দেখি? আমার চেহারা বা পোশাকে তো আলাদা করে তেমন কিছু..।

- না না। চেহারা বা পোশাক নয়। তবে এই যে। এই যে ভাজাভুজিওলার ঠেলায় অমন লোভাতুর উঁকিঝুঁকি মারলেন এবং কয়েক সেকেন্ডের মাথায় উদাস হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে একটা প্রকাণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অর্থাৎ আপনার প্রাণ চপ তেলেভাজার জন্য আনচান করছে৷ কিন্তু এই বেসনে চোবানো পাউরুটি ভাজাকে ক্লাসিকাল তেলেভাজার মর্যাদা দিতে ঠিক মন সরছে না। বিড়বিড়ও করলেন খানিকটা। স্পষ্ট শুনতে পাইনি তবে লিপ-মুভমেন্ট ট্র‍্যাক করে মনে হল একটানা খানিকক্ষণ "ধুরশালা" বললেন।

- আপনিই বলুন না। এই ব্রেডপকোড়া দিয়ে কি ছাই বৃষ্টির বিকেলের জিভের সুড়সুড় মেটানো যায়? ব্যাটা পকোড়া-ভাজিয়ে আবার পুদিনার চাটনি মাখিয়ে সার্ভ করছে। টোটাল ডিসাস্টার।

- দিল্লী তা'হলে ঘুরতে আসেননি। পাকাপাকি ভাবে এসেছেন। আর সদ্য এসেছেন। বেশিদিন হয়নি।

- কলকাতা থেকে এই মাস দুয়েক হল এসেছি। ইয়ে, আপনি কি গোয়েন্দা নাকি মশাই? বুঝলেন কী করে?

- ঘুরতে বেরোলে বাঙালির আদেখলাপনার শেষ থাকে না। দিল্লী বেড়াতে এসে আপনি ব্রেডপকোড়াকে অমন রেগেমেগে উড়িয়ে দিতেন না। বরং 'যস্মিন দেশে যদাচার' বলে হাসিমুখে খেতেন এবং খাওয়ার আগে মোবাইলে ছবিও তুলতেন৷ কিন্তু আপনি নির্ঘাৎ দিল্লী এসেছেন বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে, পাকাপাকি ভাবে। কাজেই ইন্টেন্সলি 'বাংলা আমার জীবনানন্দ মোডে' রয়েছেন। ফুলুরিকে রিপ্লেস করতে গিয়ে যে আপনি যন্ত্রণাবোধ করবেন, সে'টাই স্বাভাবিক।

- আপনি কিন্তু ঘ্যাম লোক। আচ্ছা, আর একটা কথা বলুন। দিল্লী পাকাপাকি এসেছি, সে'টা কী'ভাবে ডিডিউস করেছেন বুঝলাম৷ কিন্তু আমি যে সদ্য এসেছি সে'টা কী ভাবে বুঝলেন?

- হেহ্। দাদাভাই, বছরখানেক যেতে দিন৷ এই রাস্তা-গলিঘুপচিগুলো নেভিগেট করতে আর গুগল ম্যাপের দরকার হবেনা। চেনা সবজিওলাকে দেখে হেসে মাথা নাড়বেন। যাতায়াতের পথের অদরকারী দোকানের দোকানিদের মুখগুলোও ক্রমশ মুখস্থ হয়ে আসবে৷ ছেলেমেয়ের ডাক্তার খুঁজে পাবেন৷ নিজের পেয়ারের পানের দোকান বেছে নেবেন। এক একটা শহরের বৃষ্টি এক এক রকমের মনখারাপ আর ভালোলাগা নিয়ে আসে; একসময় দিল্লীর বৃষ্টির হিসেবকিতেবও ঠাহর করতে পারবেন৷ আর যে কলকাতাটুকুকে আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন, সে'টুকু একসময় এই শহরেরই কোনও এক কোণে খুঁজে পাবেন। নতুন শহর একসময় সয়ে আসবেই। তখন দেখবেন। ব্রেডপকোড়াকে ভালোবাসতে না পারলেও, পরিচিতির স্নেহটাকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না৷ সেই স্নেহর বশেই হয়ত একদিন এক প্লেট ব্রেডপকোড়ার পাশে সামান্য পুদিনার চাটনিও চেয়ে নেবেন৷ স্নেহ অতি গোলমেলে জিনিস। বুঝলেন না। অতি গোলমেলে।

- হুম৷ আচ্ছা সঞ্জয়বাবু, খাবেন নাকি ব্রেডপকোড়া? সদ্য আলাপ হল, একটু চা আর ওই পকোড়া দিয়েই না হয়..। তবে, আমিই খাওয়াব কিন্তু..।

- ঝুলোঝুলিই যখন করছেন, তখন বলুন দেখি দু'প্লেট। আর হ্যাঁ, ওয়েলকাম টু দিল্লী। 

Monday, November 11, 2019

আনএথিকাল

পুজোর আদত ক'টা দিন পাণ্ডববর্জিত এলাকায় কাটিয়ে সবে এসে পৌঁছেছি দিল্লীতে।
পাড়ার পুজো মণ্ডপে থেবড়ে বসার শখ অপূর্ণ থাকল বলে দেবীদর্শন করব না, তা কি হয়? মনস্থ করলাম এ'খানেই এ প্যান্ডেল সে প্যান্ডেল ঘুরে প্যারামাউন্টের ডাব-সরবতের স্বাদ গড়িয়াহাটের বরফলেবুজলে মেটাব।

সবে পুজো দেখতে বেরোব এমন সময় শ্বশুরমশাই গদগদ সুরে জানতে চাইলেন;
"ডিনারটা তো বাড়ি ফিরেই সারবে নাকি"?

এমন আনএথিকাল প্রশ্ন শুনে থমকে গেলাম। মুখের মধ্যে একটা বিশ্রী তিতকুটে স্বাদ ছড়িয়ে পড়ল। এই বয়সের একজন নিপাট ভালোমানুষ পুজোয় ঘুরতে বেরোনোর কন্সেপ্ট সম্বন্ধে অবহিত নন?
ঠাকুর দেখে বাড়ি ফিরে ডিনার করব?
এরপর কি আলুপোস্ত দিয়ে পাউরুটি খাব?
প্যারামাউন্টে গিয়ে মশলা দোসার খোঁজ করব?
বর্ষা কেটে গেলে আনন্দমেলা পুজোসংখ্যা পড়ব?
লর্ডসের ব্যালকনিতে জোব্বা পরা সৌরভকে দেখে বাহবা দেব?

Wednesday, April 11, 2018

রোগনজোশ


আলজওয়াহরের মটন রোগনজোশ তাড়াহুড়োর মাথায় খেলে বোধ হয় মজাটাই মাটি। খানিক কাবাবটাবাব খেয়ে পেট আর জিভ তৈরি করে তবে রোগনজোশের বাটিটা টেনে নেওয়া উচিৎ। রুমালি রুটি সহযোগে, অবশ্যই।

কোমর বেঁধে ঝাল খাওয়াতে আমার কোনও আপত্তি নেই, তবে গাঁকগাঁক ঝালই যে মাংস রান্নার  শেষ কথা নয়, তা আলজওয়াহর জানে।

সেই রোগনজোশের নিখুঁত ভাবে কষানো, মাপা ঝাল দেওয়া ঝোল আর তা'তে অল্প টক হালকা মিষ্টি মিশেল। আহা, সেই তুলতুলে মাংসের টুকরো; রুটি-মাংসের দলা মেঘের মত জিভের ওপর চলা ফেরা করবে। হিংস্র মেজাজে গজগজ করতে করতে চেবানো এ ক্ষেত্রে পাপ। এ রোগনজোশে একটাই পলিসি: ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া।

একসময় মনখারাপ বাসা বাঁধবে। যন্ত্রণা নয়, বুকে টনটন নয়; বরং খুব ভালো কিছুর মধ্যিখানে যেমনটা হয়। পুরনোর গানের খাতার শেষ পাতায় রেনল্ডস ডটপেনে আঁকা আলপনার মত। শরীর মন এলিয়ে পড়বে; ভালোবাসায়।

খাওয়া শেষে মৌরি মিছরিতে মেজাজ নষ্ট অবান্তর। পোস্ট-রোগনজোশ মুখশুদ্ধি একটাই; নজরুল;
'পূর্ণ চাঁদের এমন তিথি; ফুল-বিলাসী, কই অতিথি..."।

(রোগনজোশের বাটি আসার পর পকেটে রাখা মোবাইলের কথা মনে ছিল না, ছবি তোলা তো দূরের কথা। এমনই তার সুবাস)।