Showing posts with label গান. Show all posts
Showing posts with label গান. Show all posts

Sunday, June 1, 2025

হেমন্তবাবুর আশ্বাস



মিউজিক সিস্টেম থেকে ভেসে এলেও হেমন্তর কণ্ঠস্বর হেলাফেলা করা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক "এই করেছ ভালো" বলেছেন মানে সে'টাই ফাইনাল ট্রুথ। এরপর আর 'এ'টা হচ্ছে না, সে'টা পাইনি' বলে দু:খ করার কোনো মানেই হয় না। 'ভালো', 'সুন্দর', 'দারুণ' এইসব বিশেষণ দিয়ে হেমন্তবাবুকে দাগিয়ে দেওয়ার দু:সাহস আমার মত সঙ্গীতহীন মানুষের অন্তত নেই। ওঁর গলায় কেমন একটা ব্যাপার আছে যাতে মনে হয় পাশে বসেই কেউ গাইছেন। আর তাঁর কণ্ঠে রয়েছে সুপারসিরিয়াস ইমপ্যাক্ট, গান-শুনিয়ের সামান্যতম ফিচলেমোও সে গানের ধবধবে সাদা চিকন-কাজের টেবিলক্লথে ঝোল ছিটিয়ে দিতে পারে। জনগনমন কানে এলেই যেমন দাঁড়িয়ে পড়া, হেমন্ত কানে এলেই তেমনই সজাগ ও শান্ত না হয়ে উপায় নেই।

সেই হেমন্ত যখন রবীন্দ্রনাথের লাইন তুলে বলছেন "এই করেছ ভালো, নিঠুর, এই করেছ ভালো। এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো" - তখন দুনিয়ার ভার মাথা নুইয়ে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। নয়তো যেন রবীন্দ্রনাথকে নয়, হেমন্তবাবুকে ইনসাল্ট করা হবে; আর সে'টা হলে পৃথিবী স্পিন ছেড়ে রিভার্সসুইংয়ের দিকে ঝুঁকবে। হেমন্তর গলা বুকের ভিতরের লিখে দিচ্ছে "আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার এ দীপ জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো"। আমি পুড়লে পোড়া থার্মোকলের গন্ধ ছাড়া কিছুই বেরোয় কিনা জানা নেই, তবে তা নিয়ে অভিযোগ জানানোর আমি কে। হেমন্তবাবু অমনভাবে বলছেন যখন এই ভালো। যা হচ্ছে বেশই হচ্ছে; খামোখা ঘ্যানঘ্যান বাড়িয়ে কী আর হবে।

রবীন্দ্রনাথকে বোঝার মত বোধবুদ্ধি নেই, হেমন্তকে অ্যাপ্রিশিয়েট করার মত সুর নেই। এলেবেলে মানুষ, তাঁর এলোমেলো দু:খ। নেহাৎ হেমন্ত অমন যত্ন করে পিঠে হাত রাখার আশ্বাসে গাইছেন, "বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো, এই করেছ ভালো"। তাই আমারও নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া: "ওউক্কে, ঠিক হ্যায়, এই ভালো, এই বেশ"।

Thursday, November 21, 2024

ভালোবাসার গান

ভালোবাসার গান৷

তা'তে ওই কথাটা ঠিক দাঁড়ায়নি।
ওই লিরিক্সটা বড্ড ন্যাকা ন্যাকা।
এমন ভাবে কেউ গায় নাকি।
ও'রকম গদগদ প্রেমের গান শুনলে গা জ্বলে।

কত গান আমরা নস্যাৎ করে দিই সে'গুলো আমাদের কানে যথেষ্ট "স্মার্ট" ঠেকে না বলে (আমিও করি)। অথচ গান ব্যাপারটা কী ভীষণ ব্যক্তিগত একটা ম্যাজিক, কোন সুর কোন অসতর্ক মুহূর্তে প্রফেট হয়ে পাশে এসে দাঁড়াবে তা কেউ আগে থেকে আঁচ করতে পারে না৷
"সেই তো আবার কাছে এলে" গানটার লিরিক্স নিয়ে বেশ কিছু ঠাট্টা শুনেছি৷ কখনও সে ঠাট্টায় হয়ত যোগও দিয়েছি৷ অথচ আজ সেই কথাটাই যখন এক প্রবাসীর তোলা হাওড়া ব্রীজের ফটোর ক্যাপশন হিসেবে দেখলাম, সে সুরটা বুকের ভিতর মোচড় দিল৷ গান, গানের ম্যাজিক, আর সে ম্যাজিক আবিষ্কার করা; বড়ই ব্যক্তিগত একটা প্রসেস।

আশীর্বাদ

- আসি মাস্টার!
- আসবি?
- আর কত। এ'বারে দেখি, করেকম্মে খেতে হবে তো, নাকি৷
- আয়।
- বেরোনোর মুখে ভালো দেখে একটা আশীর্বাদ করো দেখি। আর কোনোদিন দেখা হয় কি না হয়..।
- ভালো দেখে আশীর্বাদ? সে'টা কেমন?
- এই যেমন, আর কিছু না হোক, ভালো গান যেন শুনতে পারি। ভালো গান চিনে নেওয়ার কান যেন তৈরি হয়৷
- আশীর্বাদ করলাম, ভালো গানেরা যেন তোকে খুঁজে নেয়।

Saturday, July 1, 2023

খ্বাব ও হকিকত



রাতের বৃষ্টি। স্লগওভারের ঝমঝম পেরিয়ে এ'বার ঝিরঝিরিয়ে ধরে খেলার সময়৷ ইতিমধ্যে মিঠে হাওয়া খেল জমিয়ে দিয়েছে৷ সবচেয়ে বড় কথা; বৃষ্টির ঝাপটার চোটে জানলা-দরজা বন্ধ করে গুমোট ঘরে বসে গজরগজর করতে হচ্ছে না৷ বারান্দায় পাতা মোড়ার কদর তখন আলেকজান্ডারের সিংহাসনের চেয়ে বেশি৷

সেই একটানা ঝিরিঝিরিতে সঙ্গত দিচ্ছেন মেজদার সন্তোষ টেপরেকর্ডার থেকে মাপা ভল্যুমে ভেসে আসা কিশোরকুমার; "খ্বাব হো তুম ইয়া কোই হক্যিকত"। মাপা ভল্যুম, অর্থাৎ যা শুনে বাবা এই রাতের বেলা এসে টেপরেকর্ডার ঝুলবারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলবেন না৷ কিশোরকে মাঠে আলগা ছেড়ে দিয়ে মেজদা অবশ্য ঘ্যাঁতঘ্যাঁত করে ঘুমোচ্ছে।

ও'দিকে রাজাধিরাজ বাপ্টুকুমার তখন ব্যালকনির মোড়া আলো করে বসে রাতের রাজ্যপাট পরিচালনা করছেন৷ দু'দিনের মাথায় টেস্ট পরীক্ষা, বাপ্টু জানে ওর চোদ্দপুরুষের ক্ষমতা নেই তাকে সসম্মানে উতরে দেওয়ার৷ কিন্তু এই জমাট বৃষ্টির রাতের ওয়ানডেটা সামান্য টেস্টের চিন্তায় নষ্ট করাটা নির্ঘাৎ গবেটামো হবে৷

উলটোদিকের ব্যালকনিটা খালি, সে ব্যালকনি ঘেঁষা কাচের জানলার গায়ে আলো দেখে বোঝা যাচ্ছে যে জোর পড়াশোনা চলছে। বাপ্টু জানে যে কাচের ও'পাশে খ্বাবদেবী দুলে-দুলে পড়ছেন; তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন কিলোকিলো নম্বর বাগানোর উদ্দেশ্যে৷ আর এই ব্যালকনিতে মোড়াশ্বর বাপ্টুকুমার হকিকতের অঙ্ক কষে যাচ্ছেন; খ্বাব ব্যালকনির আলো নেভানো হয়নি, পড়ার শেষে নিশ্চয়ই সে আলো নেভাতে সে বাইরে আসবে৷ নিশ্চয়ই আসবে; ওই ব্যালকনির আলোর স্যুইচ যে ব্যালকনির দেওয়ালেই।

এ'দিকে হকিকত ব্যালকনির বাল্বটা দিনতিনেক আগেই কেটেছে। বড়দার দেওয়া বাল্ব কেনার টাকা চপ খেয়ে উড়িয়ে কী মারাত্মক মুখচোপাটাই না সহ্য করতে হয়েছে বাপ্টুকে। কাজেই এ ব্যালকনি ঘুটঘুটে অন্ধকার, ও ব্যালকনি আলোয় আলোময়। ঘরের ভিতর থেকে মেজদার ঘুম জড়ানো গলা ভেসে এলো, "না পড়ে বারান্দায় বসে গুলতানি মারা? ভিতরে আয় ইডিয়ট"। পরক্ষণেই নাক ফের ডাকার শব্দ; বাপ্টুর নিরেট হকিকত থেকে হকিকততর হয়ে চলে৷ তা'ছাড়া বৃষ্টির রাত যতটা রোম্যান্টিক, ততটাই বিটকেল হল বেয়াদপ মশাদের কামড়।

বাহাত্তর নম্বর মশার কামড় হজম করার পর উল্টো দিকের ব্যালকনির দরজা ফটাস করে খুলে যায়৷

***

দরজা খোলার কেঠো শব্দে চমকে ওঠেন বাপ্টুকুমার ওরফে বাবু হকিকত। খ্বাবদেবী পাশে এসে দাঁড়ানোয় তাঁর সম্বিত ফিরে এসেছে।

- সে এক বয়স ছিল, জানো৷ কতবার রাত জেগে ব্যালকনিতে বসে মশার কামড় খেয়েছি। কখন তুমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য বেরিয়ে আসবে। কখন, কখন!

- তোমার সে অধ্যবসায় সংসারে থাকলে বর্তে যেতাম।

- সে অধ্যাবসায় পড়াশোনায় থাকলেও নোবেলটোবেল পেয়ে যেতাম বোধ হয়। অবশ্য, নোবেল দিয়ে ছাই করতামটা কী। এই ভালো।

- বটে? নেহাৎ প্রেমিক হয়েছ বলে নোবেল ছেড়েছ?

- ন্যাচারালি। দেয়ার আর মোর নোবেল লর্যিয়েটস দ্যান নাম্বার অফ ব্যালকনিস্টস যারা হকিকতের বুলডোজারের নীচে নিজের খ্বাবকে শুইয়ে দেয়নি। উই আর রেয়ার।

- ন্যাকা!

- সে যাই বলো, প্রেমের দুনিয়ায় আমিই আলেকজান্ডার! যাক, এই বৃষ্টির রাতে তোমায় জরুরী গান শোনাই বরং৷ ওকে গুগল, প্লে "খ্বাব হো তুম ইয়া কোই হকিকত বাই কিশোরকুমার"।

Saturday, February 25, 2023

কবিতা কাহারে বলে, গান কাহারে বলে



মগজ ব্যাপারটা যে কী ধুরন্ধর চিজ। আর আমার মত গাম্বাট মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের মাথাই যথেষ্ট।

আমার বুকশেলফে, কোনও অজানা কারণে কয়েকটা কবিতার বই আছে। কলকাতার কম্বলদের মতই, সে'সব বইদের সচরাচর ঘাঁটানো হয়না। আবার কলকাতার মানুষের মতই, আজ হঠাৎ উথলে ওঠা হুজুগের বশে সে'সব কম্বল...থুড়ি বইদের তাক থেকে নামালাম। উল্টেপাল্টে দেখেটেখে, ধুলোটুলো ঝেড়ে তাকের বই তাকে ফেরত যাবে, তেমনটাই হওয়ার কথা। কী মনে করে দু'একটা কবিতা পড়ার চেষ্টা করলাম। খানিকটা শক্তি, খানিকটা সুনীল, খানিকটা শঙ্খ। নিজের ওপর গর্ব হচ্ছিল, কবিতা পড়ছি ভেবে। আরে, কবিতা মানে গানই তো, সুরটাকে নিজের মত মনে মনে বসিয়ে নিলেই অ্যাপ্রিশিয়েশন ব্যাপারটা তরতরিয়ে বইবে। 

যা হোক, সে'সব কবিতার বইয়ের ফাঁকে একটা বই ছিল রবিস্যারের শ্রেষ্ঠ কবিতার। সে'গুলো বেছে নিয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলি স্বয়ং। বইয়ের শুরুতে একটা চমৎকার মুখবন্ধ লিখেছেন সুনীল; শিরোনাম - "রবীন্দ্রনাথ এবং আধুনিক কবিতা"। কবিতা বুঝিনা, তায় আবার আধুনিক। রবীন্দ্রনাথ বুঝি, সে'কথা বলার দুঃসাহসও নেই। তবে বাংলা ভাষাটা যেহেতু খানিকটা বুঝি, তাই মুগ্ধ হয়ে পড়াটা ঠেকায় কে।

তা সেই বইয়ের দ্বিতীয় কবিতা একটা গান; সখী, ভাবনা কাহারে বলে। অনেকের মতই, এ গানটা আমার মুখস্থ; কমা, ফুলস্টপ, হাঁচি, বিষম সহ। আমার গলায় সুর নেই, প্রাণে কবিতা নেই; অথচ এ গান গাইতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কাজেই, কবিতা হিসেবে এই গানটা বইয়ের পাতায় ছাপা আছে দেখে প্রথমেই মনে হল; এ পড়ে হবেটা কী, পুরোটাই কণ্ঠস্থ তো। চোখ বুজলেই এ গান কানে-বুকে বেজে উঠবে; মায়ের গলায়, শ্রাবণী সেনের গলায়। সে গান আবার বইতে পড়তে যাব কেন?

তবু। মানুষ হয়ে জন্মেছি যখন, হিসেবের বাইরে পা না রাখলে চলবে কেন? শুরু করলাম পড়া। এ'খানেই সেই মগজের চমক। আমি যা লিখছি তা হয়ত গোটাটাই অযৌক্তিক; তবে যুক্তিবাজ হলে কী আর ব্লগ লিখে লিঙ্ক শেয়ার করে মানুষজনকে জ্বালিয়ে মারি। কাজেই লিখেই রাখি। কী অদ্ভুত, মুখস্থ একটা গান; সে'টাকে যখন সাদা কাগজের ওপর কালো ছাপা অক্ষরে পড়ছি; কানের বদলে চোখ অ্যাক্টিভেট হচ্ছে, চেনা সুর আবছা হয়ে একটা অন্য রিদম আবিষ্কার করছি এ লাইন থেকে ও লাইনে যাওয়ার সময়। এ গানের সুরের ম্যাজিক বর্ণনা করার দুঃসাহস আমার নেই। কিন্তু কবিতাটা পড়তে গিয়ে, সে সুর সরে গিয়ে যে'টা পড়ে রইল; সে'টাকেও একটা অন্য জাতের জাদু হিসেবে মগজ চিনে নিল। প্রতিটা শব্দই পূর্বপরিচিত, অথচ পড়তে গিয়ে দেখলাম তারা সক্কলে অন্য মেজাজে উঠে দাঁড়ালে। গানের মানে পালটে গেল না, তবু সে কবিতাটা গানের থেকে আলাদা হয়ে ধরে দিল যেন। সে লেখা সুরের সঙ্গে মিলে একটা জলতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে বটে, কিন্তু কথাগুলো সুরের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। সুর বাদেও তাদের অস্তিত্ব জোরালো; জমজমাট।

একটা নতুন কবিতা পড়ে ফেলল মগজ। বহুবার শোনা গানটার সঙ্গে যাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না কিছুতেই। ভাগ্যিস সুনীলবাবু এ গানকে "রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা"র বইয়ের প্রথম দিকেই চালান করেছেন। নয়ত টের পেতাম কী করে সুরের পরিচয়টাই কবিতার জন্য শেষ কথা নয়? আর আমাদের মত গদ্য-গাম্বাটদেরও কবিতার জগতে স্থান আছে, সে'টাকেও ক্লেম করতে হবে তো।

Thursday, February 16, 2023

ইউফোরিয়া



~~খিলখিলাতি হ্যায় উয়ো নদীয়া, নদীয়া মে হ্যায় এক নইয়া~~

জমজমাট সূর্যকুণ্ডের মেলা (সুরজকুণ্ড্‌ বলা উচিৎ নাকি?)। অফিসের পর সন্ধেবেলা বিস্তর ট্র্যাফিক ঠেলে সে মেলায় গেছি রকমারি জিনিসপত্র দেখতে, খাবারদাবারের দোকানগুলোয় পেট ভরাতে, আর সর্বোপরি ভিড়ে নাকানিচোবানি খেতে। মেলায় গিয়ে মানুষে যা করে আর কী। ও মা, গিয়ে শুনি সে'খানে পলাশ সেন গান গাইবেন, ইউফোরিয়ার শো শুরু হবে খোলা অ্যাম্পিথিয়েটারে, অবাধ প্রবেশ। "ধুম পিচক ধুম" ফেনোমেনাটা একসময় মজ্জায় এসে মিশেছিল। নিজেকে সঙ্গীত-বোদ্ধা বলে লোক হাসানোর মানে হয়না। তবে গানের প্রতি ভালোবাসায় খানিকটা অবুঝ না হলেও চলে না বোধ হয়। আমার ডানা গজানোর বয়সে সেই গান আবিষ্কার করি। এখনও মনে আছে, আমাদের স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে আমার কিছু ক্লাসমেট সে গান গেয়ে আসর জমিয়ে দিয়েছিল। সে বয়সে প্রথম প্রেমের হুহু, সেই হুহুর সঙ্গে যে'সব গান এসে মিশে গেছিল, তাদের মধ্যে এই ধুম-পিচক-ধুম অন্যতম। এ অভিজ্ঞতা আদৌ অভিনব নয়, আমার বয়সী অনেকেই এ ব্যাপারটা ধরতে পারবেন। চন্দননগরের অলিগলি দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি দুই বন্ধু, আর দু'জনে বিশ্রী বেসুরো গলায় চিল্লিয়ে গাইছি 'মায়েরি' বা 'ক্যায়সে ভুলেগি মেরা নাম'। স্বস্তির ব্যাপার হল যে নিজের বেসুর নিজের কানে বাজে না। যা হোক, এহেন ইউফোরিয়ার গানের আসর, সে নিশির ডাক উপেক্ষা করি কী করে। কাজেই আমরা দ্যাবা-দেবী সেই খোলা মঞ্চের সামনে চলে গেলাম। ভিড় সত্ত্বেও জায়গা বাগিয়ে নিতে অসুবিধে হল না।




~~কেহতা হ্যায় যো কহে জমানা, তেরা মেরা পেয়ার পুরানা~~

আমাদের আশেপাশে যারা বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়সই মনে হল আমাদের চেয়ে হয়ে বেশি খানিকটা কম অথবা বেশ খানিকটা বেশি। মোদ্দা কথা টীম 'নাইনটিজ'কে মাইনরিটিই মনে হল। যা হোক, একসময় স্টেজে একটা স্ফুলিঙ্গের মত উদয় হলেন পলাশ সেন, অকারণ সময় নষ্ট না করে গান ধরলেন। অমনি সেই ছোটবেলার গন্ধ-দৃশ্যগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। তেমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ওই সূরজকুণ্ডের হৈহল্লার মধ্যে কেউ বাংলার মফস্বলের বিকেল আর টিউশনি-ফেরত সাইকেলের ক্যাঁচরম্যাচর মিশিয়ে দিল যেন। আমরাও দিব্যি গালে হাত রাখে শুনতে আরম্ভ করেছিলাম। আচমকা মেজাজের সুতো ছিঁড়ে দিলেন পলাশ সেন নিজেই, বললেন "এই যে দাদা-বোনেরা, আপনারা কি গা এলিয়ে শুয়ে বসে গান শুনতে এসেছেন নাকি? রামোহ্‌ রামোহ্‌! আরে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ান দিকি। লম্ফঝম্প করতে হবে তো। আমি তো আর ভজন-গজল গাইতে আসিনি, চেল্লাতে এসেছি। কাজেই নেহাত আর্থ্রাইটিসের ঝামেলা না থাকলে, দাঁড়িয়ে পড়ুন, গর্জে উঠুন"। কী বলি, আমি ছাই গানটান বুঝি না। আমার ছেলেবেলার হিরো আওয়াজ দিচ্ছে, আমি সেলাম ঠুকবো; আমার কাছে ও'টাই হল গিয়ে মূল এন্টারটেইনমেন্ট। কাজেই ডাক্তার সেনের দাবীমত নির্দ্বিধায় সেই বাঁধানো সিমেন্টের বসার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে টের পেলাম, ইতিউতি দু'চারজন দাঁড়িয়েছেন বড়জোর, পাবলিকের গড়িমসি তখনও কাটেনি। মনেমনে চিৎকার করে উঠলাম, "এ কী! ক্লাসরুমের মধ্যে স্যার দাঁড়াতে বলেছেন! এর পরেও বসে থাকাটা কেমন বেয়াদপি"! যাকগে, সে বেরসিকদের পাত্তা না দিয়ে বেখাপ্পা ভাবে পলাশবাবুর গানের তালে ড্যাংড্যাং করে দু'হাত হাওয়ায় ছুঁড়তে শুরু করলাম।




~~যতন করে রাখিব তোরে মোর বুকের মধ্যে মাঝি রে~~

পলাশ সেন ধরলেন "ধুম পিচক ধুম"। আমরা যারা 'নব্বুইয়ের মাল' সে এলাকায় ছিলাম, তাঁরা সবাই খ্যাপা বাউলের মত দুলে চলেছি। আমরা সংখ্যালঘু হতে পারি, মধ্যবয়সী ভারে সামান্য ন্যুব্জ হতে পারি। তা বলে ইউফোরিয়ার গানে বিসর্জন-নাচের মোডে ঢুকে যাব না? আরে! পলাশ সেন চেঁচিয়ে বলছেন "আ রে মেরি ধড়কন আ রে"। এ ডাক শুনে কে না লাফিয়ে থাকতে পারে? অবাক হয়ে দেখলাম অনেকেই পারেন। পলাশ সেনও মহাঢিঁট মানুষ দেখলাম। বেশিরভাগ জনতা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াবেন না, পলাশবাবুও তাঁদের স্বস্তি দেবেন না। খুব হিসেব কষে, 'ধুম পিচক ধুম' গানের শেষে সামান্য ব্যাকফুটে গেলেন পলাশবাবু। ততক্ষণে ভদ্রলোকের রোখ চেপে গেছিল বোধ হয়। আচমকা একের পর এক নতুন হিট গান গাওয়া শুরু করলেন, ধরলেন হিট সব পাঞ্জাবি গান; এমন কি "কালা চশমা"ও বাদ গেল না। মাইরি, অমন মারাত্মক লাফঝাঁপ করে গেয়ে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক, অথচ গলায় ক্লান্তি নেই, সুরে দুলকির অভাব নেই। এই অ-ইউফোরিও ডিস্কোঝড়ে গলল পাথর। জমে উঠল আসর, মানুষজন সত্যিই মেতে উঠল, জমে উঠল গানের মেলা।


~~ Crescendo /krɪˈʃɛndəʊ/
the highest point reached in a progressive increase of intensity ~~

এরপরেই তুরুপের তাসটা বের করে আনলেন পলাশবাবু; ধারালো জাদুতে শ'পাঁচেক মানুষের পায়ের তলা থেকে কার্পেট উড়িয়ে দিলেন। গাইতে শুরু করলেন "মায়েরি"। আর এমন গাইলেন, যে স্রেফ ওই একটা গান শোনার জন্য শ'খানেক মাইল পথ হেঁটে যাওয়াই যায়। আর সে গানটাই গোটা সন্ধেটাকে অন্য স্তরে নিয়ে চলে গেল, সে'খান থেকে আর ফিরে তাকানোর উপায় নেই। গা ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরের একটা ঘণ্টা পলাশবাবু যদি খবরের কাগজ পড়েও শোনাতেন, তা'হলে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যেত। সবচেয়ে বড় কথা, ঠিক ওই মায়েরি পার্ফর্ম্যান্স থেকে নব্বুই-অনব্বুইয়ের তফাৎটা ধুয়ে-মুছে গেল। দর্শকাসনের প্রতিটা মানুষ তখন ইউফোরিয়ার সামনে নতজানু, এবং খানিকটা 'ইউফোরিক'ও বটে। আর সে গান শুনলে যেমনটা হওয়ার কথা আর কী, পলাশবাবুর গলার দাপট আর সে সুরের মায়া টেনে নিয়ে গেল কৈশোরের প্রেমে। এবং ভেবে অবাক হলাম, সেই ছেলেবেলার প্রেম আর ভালোবাসার মানুষে আটকে নেই। পাড়ার চেনা গলির ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দেওয়া হিরো ইম্প্যাক্ট সাইকেল, চেনা চায়ের দোকানের বেঞ্চি, পিঠে ঝোলানো পড়ার বইয়ের ব্যাগের মধ্যে রাখা টেনিসবল; সমস্তই বড় অনাবিলভাবে ফেরত এলো। পলাশ সেন ততক্ষণে শ্রোতাদের মনঃপ্রাণ দখল করে ফেলেছেন। আর নব্বুই ব্র্যান্ডের আমরা যেক'টি প্রডাক্ট ইতিউতি ছড়িয়ে ছিলাম, তাঁরা সবাই অন্যান্য মুগ্ধ শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে চলেছি, "কেমন দিলাম"? আসলে, আমরাই তো তখন ইউফোরিয়া।

Sunday, January 29, 2023

অচ্ছা সিলা

বন্ধুরা জানালে "অচ্ছা সিলা দিয়া তুনে মেরে পেয়ার কা" গানটার রিমেক হয়েছে। ভালো কথা। তবে এই ধরণের গানের রিমেক খুব ভালো হলেও এড়িয়ে থাকব, তেমনটাই ইচ্ছে। এই ধরা যাক "মেরা দিল ভি কিতনা পাগল হ্যায়"; ওটার রিমেকও করতেই পারে কেউ। সে'টা দুর্দান্ত হলেও হতে পারে। আমি শুনব না। গুরুদেবের বারণ আছে। "অচ্ছা সিলা"ও খানিকটা সে পর্যায় পড়ে। কাজেই বন্ধুদের পাঠানো গানের ইউটিউব লিঙ্ক ক্লিক করলাম না।
এতক্ষণ পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল। এরপর বন্ধুরা জানালে যে "অচ্ছা সিলা দিয়া তুনে"-তে আইটেম নাচ ঢোকানো হয়েছে। এই ইনফরমেনশনটা পেয়ে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেছি। সোনু নিগম কাঁদাচ্ছেন, কৃষ্ণকুমার কেঁদে ভাসাচ্ছেন, স্কুল-প্রেমে লেংচে চলা বুক ফেটে চৌচির হচ্ছে। আমার কাছে এই হচ্ছে গানটার আর্কিটেকচার। এ'বার এই ট্র্যাজিক ত্রিভুজের মাঝে আইটেম ডান্স ঢোকানো চাট্টিখানি কথা নয়।
এ গানের রিমেক শোনার ইচ্ছে নেই, অথচ এই মিস্ট্রিটাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছেনা। সাংঘাতিক সমস্যা।

আসছে শতাব্দীতে



"আসছে শতাব্দীতে"। সন্ধ্যার কণ্ঠ আর সুমনের কথা, সুর; এ'রা নেহাতই সহশিল্পীর দলে। মঞ্চ আলো করে দাঁড়িয়ে একজন অগোছালো কিশোর। যার কণ্ঠে সুর নেই, কবিতায় দখল নেই; কিন্তু গানের প্রতি ভালোবাসা আছে৷
সে কিশোর শ্রোতা, অথচ সমস্ত লাইমলাইট তারই ওপরে৷ কারণ সেই একমাত্র শ্রোতা, মায়েস্ট্রো সেই। সুমন আর সন্ধ্যায় ভর দিয়ে একশো বছর তফাতে থাকা একজন কেউ সেই ভ্যাবলাটে কিশোরের কাছে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। না না, গানের কথাটুকু ক্যামোফ্লাজ, সেই অন্য-সময় থেকে পাঠানো মেসেজ কোড করে রাখা আছে সুরে৷ সন্ধ্যা-সুমন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সে সুর সেই কিশোরের মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, পারলে রক্তে চালান করে দিতে।
কিশোরের ছটফট বেড়ে চলে৷
মনের ভিতর সে কী বিশ্রী অথচ ভালোলাগা আনচান৷
এ সুর এত চেনা কেন?
এত ভালোবাসা কেন এই গানে?
কে ডাকছে?
সে ডাক এত মায়ার কেন?
আহ, সে যে কী অপার্থিব স্নেহ। কী টান।
***
- বুঝুলে ভাই আওদব্দভ্বহ৷ আশা একটা আছে৷
- আশা আছে বলছ আবাভ্ব ?
- আছে।
- গোটা ভ্যাকিওসমসে কেউ যদি পারে তুমিই পারবে৷ কিন্তু উপায়টা কি? কত হাজার বছর ধরে চেষ্টা করেও তো আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি৷ আজ হঠাৎ কী ফন্দি আঁটলে?
- গ্রহটা তো আর পাশের পাড়াতেই নেই৷ ঢের দূরে৷ তাছাড়া তাদের রকমসকমও আমাদের ধারার নয়৷ কাজেই সময় লাগাটা স্বাভাবিক৷ তবে এদ্দিনে সত্যিই একটা সলিউশন পেয়েছে আওদব্দভ্বহ।
- ইয়াইয়াজ ওয়েভের মাধ্যমে কিছু?
- খানিকট তাই। তবে সে গ্রহের বাসিন্দারা ইয়াইয়াজ সোজাসুজি আঁচ করতে পারবে না। অন্যপথে তাদের কাছে পৌঁছতে হবে৷
- তবে? কোন পথে?
- তাদের ররকমসকম আমাদের চেয়ে একদমই আলাদা৷ যোগাযোগের প্রসেসটা তাই এত খটমটে। তবে একটা মোক্ষম মিল পাওয়া গেছে।
- কী মিল?
- ও'খানেও সুরের ব্যবহার চলে।
- বটে? ওরা সুরের ব্যবহার যানে?
- জানে। তবে আমাদের মত সুর দিয়ে যন্ত্রপাতি চালাতে পারেনা তার৷ সুর ব্যাপারটা তাদের কাছে শৌখিন ব্যাপার৷ এ'বার আমাদের পাঠানো ওয়েভ তাদের কোনও একটা সুরে মিশিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে।
- বলো কী আবাভ্ব! সে'টা সম্ভব?
- নয়ত আর বলছি কেন? অলরেডি একটা ট্রায়াল ওয়েভ ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা একটাই৷ হিসেব কষে দেখলাম, আমার পাঠানো ওয়েভ সে গ্রহের হিসেবে একশো বছর পর তাদের কোনও সুরে গিয়ে মিশবে।
- সে'টা আমাদের হিসেবে কতক্ষণ?
- আমাদের গ্রহের একবেলা৷ বড়জোর৷
- তবে আর কী৷ খিচুড়ি ডিমভাজা চাপিয়ে দিয়ে অপেক্ষা শুরু করি। দেখা যাক তোমার ওয়েভ তাদের সুরের আড়াল পেরিয়ে সে গ্রহের কাউকে ঘায়েল করতে পারে কিনা৷ কিছু ইন্টারগ্যালাক্টিক প্রতিবেশী না পেলে আর সত্যিই চলছে না।

Saturday, December 31, 2022

দুই-চার-চার দাদা



- এ'টা কি ট্যু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন?
- হ্যাঁ। ঠিকই। কাকে চাই?
- দিন না ডেকে বেলাকে একটিবার।
- একটু হোল্ড করুন...।
- মিটার যাচ্ছে বেড়ে...।
- এই সেরেছে...ডাকছি তো...একটু ধরুন...।
- এই পাবলিক টেলিফোনে...।
- আরে হ্যাঁ, ডাকছি তো...।
- জরুরী খুব জরুরী দরকার...।
- সে তো বুঝলাম, কিন্তু গানটা না থামালে...।
- হ্যাল্যোওওও...ট্যু ফোর ফোর...?
- যাচ্চলে, আরে আগে ডাকতে দেবেন তো নাকি...।
- ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন!
- লে হালুয়া।
- বেলা বোস তুমি পারছ কি শুনতে!
- আরে বেলাকে ডাকতে পারলাম কই যে ফোন ধরে শুনবে!
- দশবারোবার রং নাম্বার পেরিয়ে তোমায় পেয়েছি...।
- কাঁচকলা পেয়েছেন মশাই। গানের আবেগে বেলা কে হাঁক দেওয়ার সুযোগটুকুও দিচ্ছেন না তো। আগের ওই দশবারোবার রং নম্বরগুলোতেও জলসা বসিয়েছিলেন নাকি? টেলিফোন বুথের তো পোয়াবারো!
- দেব না কিছুতেই আর হারাতে...।
- আরে ছাই হারাবেন! আগে পেলে তারপর তো হারাবেন! বাপ রে বাপ! গানের কী ঠেলা!
- হ্যালোওওওওওও ট্যু ফোর ফোর ওয়ান...।
- বয়ে গেছে আমার কাউকে ডাকতে...।
- ...ওয়ান থ্রি নাইন...!
- রং নাম্বার!
*খটাস*

তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই



আমি উপলবাবু মানুষটাকে আদৌ চিনিনা৷ তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় শুধুই তাঁর গানের মাধ্যমে। গানের সঙ্গে জুড়ে যায় তাঁর কিছু আঁকাআঁকি আর খুচরো লেখালিখি। কোনও কারণে আমার ধারণা হয়েছে যে ভদ্রলোক মুখচোরা৷ এ যুগে (বা হয়ত সব যুগেই) মুখচোরা মানুষদের নিয়ে মারাত্মক সমস্যা; গোলমেলে হইচইয়ের মধ্যে তাঁদের দামী মিনমিনগুলো অক্লেশে হারিয়ে যায়, এবং সে হারিয়ে যাওয়াতে তাঁদের কোনও হেলদোল থাকে না৷ সেই উপলবাবুর একটা জরুরী মিনমিন, অর্থাৎ একটা নতুন গান (আমি প্রথম শুনলাম, সে অর্থে নতুন), স্রেফ বরাতজোরে এই দু'দিন আগে হুট করে কানে এলো৷ একটা অন্যায় হল, গানটা (এবং গানের অ্যালবামটা) উপলবাবুর একার নয়; তাঁর সঙ্গে জম্পেশভাবে রয়েছেন নীলাঞ্জনবাবু৷

ইউটিউব মিউজিক যে'ভাবে এ'গান থেকে ও'গান বেয়ে আপনা থেকেই তরতরিয়ে এগিয়ে চলে, তেমনই যাচ্ছিল৷ পরপর পুরনো বাংলা ব্যান্ডের গান বাজছিল। আমি ঘাড়-মাথা দুলিয়ে আহা-বাহা করে যাচ্ছিলাম৷ এমন সময় সুট করে এই "তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই" গানটা প্লেলিস্টে ঢুকে পড়ল৷

সরলসিধে নির্ভেজাল প্রেমের গান; সে গানের সুরে মনে হয় কলজেকে কলেজে ফেরত পাঠাই৷ সে গানের কথায় মনে হয় সেই সরল বয়সে ফিরে যাই যে'সময় নাক সিঁটকে খুঁতখুঁত করে দিন গুজরান করতে হত না; সহজ জিনিস সহজেই ভালো লাগানো যেত৷ সেই বয়স, যে বয়সে "অমুকটা ন্যাকামি, তমুকটায় ডেপথ নেই" গোছের জ্যাঠামো প্রাণকে ওষ্ঠাগত করে তোলেনি৷ এই গানটা সেই সারল্য উস্কে দেওয়া গান৷ প্রেমের গান।

"তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই
সারা বছর ধরে মেঘ জমাই"

কী সুন্দর যে গানটা, কী ভীষণ ভালো! আমার মারাত্মক সুন্দর লেগেছে, অত্যন্ত ভালো লেগেছে৷ আর গান ভাললাগাটা লাগামছাড়া হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

Sunday, June 19, 2022

চালশে আর ফার্স্টইয়ারি



সুমনবাবুর চালশে গানটা প্রথম শুনেছি কৈশোরে৷ আমার অন্যতম প্রিয় 'সুমনের গান'। আজও এ গানটা আমার কৈশোরের গান। কলেজের গান৷ হাইস্কুলে থাকতে বাড়ির ফিলিপ্স টেপরেকর্ডারে এ গান বাজত। পরে কলকাতার মেসে বসে সস্তায় কেনা এফএম রেডিওতে সে গান মাঝেমধ্যেই শোনা যেত৷ সে বয়সে, গানটা গুনগুন শুরু করলেই আশেপাশের চালশেদের প্রতি অস্ফুট "আহা, উঁহু"-ভাব টের পেতাম৷ একটা প্রবল সিমপ্যাথি। 

মনে হত, "আহা রে, কত গুঁতোগাঁতা খেয়ে এ বয়সে এসে পৌঁছেছেন৷ মাঝবয়সী খিটমিটগুলোয় না জানি তাদের কতশত স্ট্রাগল আড়াল হয়ে যাচ্ছে"।  ফার্স্টইয়ারি মেজাজের সিংহাসনে বসে ভাবতাম, "আফটার অল, এই বাবা-জ্যাঠা-কাকা-মামাদের তো ইয়ুথটাই গন৷ লোহা চিবিয়ে হজম করার দম আর নেই৷ বেনিয়মে বন্ধুদের হুল্লোড় নেই। সোমবার বিকেলের কলেজ স্কোয়্যারের ঘটিগরম নেই৷ প্রেমের চিঠি নিয়ে ফলাও করে মেস-বৈঠক বসানোর সুযোগ নেই৷ বাজে গল্পে রাতকাবার করার ধক নেই৷ পুজোয় লম্বা ছুটি নেই৷ এদের আর আছেটা কী। আহা রে, এ'দের জীবনটাই তো ফিনিশ হয়ে গেছে৷ পড়ে আছে শুধু গাদাগুচ্ছের রেস্পন্সিবিলিটি"। ব্যাস, এইসব ভাবনাকে আরও একটু উস্কে দিত সুমনের এই গান৷

এ'বারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, আজও এই গানটা আমি সেই ফার্সইয়ারি ছেলেবেলার কান ছাড়া শুনতে পারিনা৷ এমন অনেক গানই রয়েছে অবশ্য, যে'গুলো শিল্পী, সুর, কথার ওপরে গিয়ে স্মৃতি-ফসিল হয়ে রয়ে গেছে৷ কে সুমন, কীসের দামী লিরিক্স, কীসেরই বা মনকেমনের সুর- চালশের গানে সেই ক্লাস টুয়েলভ বা কলেজের বিকেল-রাত্রির গন্ধ লেগে৷ সেই গন্ধই সে গানের আইডেন্টিটি। এ'সব গান একটু মন দিয়ে শুনলে এখনও ক্যালকুলাসের ভয়টা বুকের মধ্যে ছ্যাঁতছ্যাঁতিয়ে উঠবে বোধ হয়৷ যাক গে, এই চালশের গান শুনলে এখনও ওই ফার্স্টইয়ারি একটা কণ্ঠস্বর ভারী মিহি স্বরে আহা উঁহু করে বলে, "আহা রে, যাদের বয়স চল্লিশ পেরোল তাদের কী দুঃখ গো৷ প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়ে চিন্তা করেই দিন গুজরান করতে হয়, কলেজ ফেস্টের খোঁজখবর আর তাদের নিরেট জীবনে দাগ কাটে না৷ জোড়া রোল খাওয়ার বদলে তারা একটা ভেজিটেবল চপ ইন্সটলমেন্টে খায়৷ ইশ৷ আর এরা বেপরোয়া বিরিয়ানিতে রইল না, সুবোধ স্যান্ডুইচে এসে ঠেকেছে৷ দলবেঁধে দীঘা যাবে কী, গ্রুপ ইন্সুরেন্স ছাড়া আর কোনও ভাবনায় এদের স্বস্তি নেই৷  এদের জন্য কী মনকেমন গো"। 

সমস্যা হল, সে সিমপ্যাথির বেলুনে সুট করে চুপসে দেয় অন্য একটা গাম্বাট কণ্ঠস্বর, " ওরে আমার কচি খোকা এলেন হে৷ এ'সব ভাবনা হাউই নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? অম্বলের ওষুধ কি তোমার গ্র‍্যান্ডফাদার খাবে"? অমনি, বুকের মধ্যে বরফঝড়।   এই গান যে আর 'ওদের' জন্য লেখা নয়। এ গান এখন ডাইরেক্ট আমার এবং আমাদের৷ আমি আর এ গানের অডিয়েন্স নই, সাবজেক্ট৷ আমি আর "আজকে যে.."র দলে নেই৷ সুট করে "কালকে সে.." টীমে এসে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছি৷ চল্লিশ আসছে, ছোটবেলার সুমন দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই৷

Wednesday, June 1, 2022

সব আমাদেরই জন্য



কাল রাত্রে আমার বয়সী (বা খানিকটা ছোট এবং খানিকটা বড় যারা) বহুমানুষ ছোটবেলার বন্ধুদের কথা ভেবেছেন। টিউশনি, ছুটির দুপুর, বিকেলের খেলার মাঠ। প্রেম-ট্রেম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার, ধেড়ে বয়সে এসে সেই পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যে বড়সড় মনমালিন্যগুলো ঘটেছে, কাল মাঝরাতের দিকে সে'গুলোকে আচমকাই খেলো মনে হয়েছে। হয়ত, অন্যদের হয়ে নিশ্চিত হয়ে আর কী ভাবে বলি। কাল হয়ত অনেকেই ভেবেছেন ছেলেবেলার সে'সব দুর্দান্ত স্মৃতিগুলো তরতাজা থাকতে এইসব বুড়োটে ধান্দাবাজ ঝগড়াদের পাত্তা দেওয়ার কোনও মানেই হয় না। আর সেই সব সাতপাঁচ ভেবে ভেবে সে কী বিস্তর মনখারাপ। হয়ত কাল রাতের চিন্তাগুলো আজ সকালেই অফিস-কাজকর্মের ঠেলায় ধুয়ে মুছে সাফ, কিন্তু সে মনভার ফেলনা নয়।

আমাদের দুঃখের সমস্তটুকুই যে কেকে নয়। তাঁর ফেলে যাওয়া গানগুলোর গুণগত পরিমাপই তো শেষ হিসেব নয়। আমার মত মানুষ ছাই গানের বোঝেই বা কী। কিছু গানের সুর সামান্য বেয়াদপ।
সে'সব সুরের ধাক্কায় কত কী মনের মধ্যে উদয় হয়;
কত বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার দুঃখ,
ছোটবেলার সুপরিচিত নিরিবিলি রাস্তাগুলো চিরে এগিয়ে যাওয়া সাইকেলের প্যাডেলের মচরমচর কানে ভেসে আসার দুঃখ,
কত অদরকারী তিক্ততা বয়ে বেড়ানোর আফসোস।

এই সব মিলে বুকের মধ্যে হুহু, তার মধ্যে কেকে কম, আমরা নিজেরাই বেশি। আর সে'জন্যই কেকে অনন্য। কালই হঠাৎ আমরা অনেকে টের পেলাম যে কোন ফাঁকে যেন ভদ্রলোক নিজেরই কয়েকটা গান দিয়ে আমাদের বহু জরুরী স্মৃতিতে মলাট দিয়ে গেছেন।

Monday, February 7, 2022

আহ্! মিউজিক!



কী বিদঘুটে স্বপ্ন রে বাপ! শীতের রাতের জবরদস্ত ঘুম গেল বিশ্রীভাবে চটকে৷ তবে ঘুম ভাঙলই যখন, তখন লিখেই রাখি। কী দেখলাম স্বপ্নে?

একটা সুপরিচিত পেল্লায় হলঘর৷ অবিকল যেন কফিহাউসের মত, এমন কি রবীন্দ্রনাথের ঢাউস ছবিটাও দিব্যি দেওয়াল আলো করে রয়েছে৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে'ছবিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, পায়চারি করছেন। ফ্রেম থেকে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে যাচ্ছেন আবার ফেরত আসছেন৷ যাচ্ছেন, আসছেন, যাচ্ছেন, আসছেন৷ আর মাঝেমধ্যেই ফ্রেমের বাইরে কার দিকে যেন তাকিয়ে স্মিত হাসছেন। 

চেয়ারগুলো টেবিলগুলো সবই ফাঁকা, খিটখিটে ওয়েটারদাদাদেরও দেখা নেই৷ শুধু বিদঘুটে জোব্বা গায়ে চাপিয়ে এক দাড়িয়াল সাহেবসুবো মানুষ রবীন্দ্রনাথের ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে, টেনিস ম্যাচ দেখার মত রবীন্দ্রনাথের পায়চারি দেখে চলছেন তিনি। ভদ্রলোকের মুখে একটা মিঠে আনন্দের ছাপ, আর চোখে একটা মজাদার ঝিলিক৷ রবীন্দ্রনাথও মাঝেমধ্যে পায়চারি থামিয়ে তাঁর দিকে চেয়েই হাসছেন।

বেশ খানিকক্ষণ পায়চারির পর ফ্রেমের মধ্যেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বসলেন৷ ফ্রেমের বাইরে হলঘরে দাঁড়ানো সেই সাহেব দাড়িয়ালও এ'বার একটা কফিহাউসিও চেয়ার টেনে বসে মুখে লেবুলজেন্সের মত কিছু একটা দিলেন৷ 

রবীন্দ্রনাথই কথা বলে উঠলেন।

- গরীব বাঙালির কথা বাসি করে মনে ধরালে ভাই ডাম্বলডোর?

- গুরুদেব, আপনার কথা আমি পাত্তা দেব না? আমার ঘাড়ে অতগুলো মাথা নেই, পায়ে অতগুলো মোজাও নেই৷ তবে আমাদের কিনা আঠারো মাসে বছ্র, তাই সিলেবাস পাল্টাতে কিছুটা দেরী হয়ে গেল৷ যাক গে, এখন ব্যবস্থা পাকা৷ আর তাই খবরটা আপনাকে দিতে আসা৷ 

- তুমি নিশ্চিত তো?

- হ্যাঁ। হগওয়ার্টসের ছেলেমেয়েরা এ জাদু না শিখলে সমস্তই মাটি৷ 

- যাক৷ তোমার স্কুলের সিলেবাসে এদ্দিনে তা'হলে সঙ্গীত ঠাঁই পেল৷ স্টাডি অফ মিউজিক..বাহ্ বাহ্। 

- গুরুদেব৷ নামটা একটু নিজেদের মত সাজিয়ে নিয়েছি৷ স্টাডি অফ মিউজিক নয়৷ স্টাডি অফ ব্রাইট আর্টস৷ 

- কিন্তু, সে কি আর পারবে সে তোমার স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়াতে? দেরী করে ফেললে ভাই আলবাস৷ 

- কাথবার্ট দিব্যি পেরেছে মরার পরেও ক্লাস নিতে। আর ম্যাজিকের হিসেবে লতা তো অনেক এগিয়ে৷ ও নিয়ে ভাববেন না৷ মাগলরা তাকে যতই ভালোবাসুক, তার আসল কদর কিন্তু হগওয়ার্টসেই হবে।

- বেশ৷ মঙ্গল হোক৷ তুমি নিশ্চিত হলেই হল। 

- গুরুদেব,হগওয়ার্টস আজ একধাপ এগিয়ে গেল৷ 

- এগোবেই তো৷ কতবছর আগে, হগওয়ার্টসে বসে সুরে ঘায়েল হয়ে তুমিই তো  বলেছিলে ভাই, "Ah Music, A Magic Beyond All We Do Here"।

Wednesday, January 19, 2022

চলো অঞ্জন!



অঞ্জন দত্তর গান নিয়ে কোনও গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনাকে কোনওদিনই পাত্তা দিইনি৷ নিন্দে তো নয়ই, অন্যের প্রশংসার সঙ্গে তাল মেলানোরও প্রয়োজন বোধ করিনি৷ অঞ্জনবাবুর গান একটা অভ্যাসের মত জুড়ে গেছিল৷ তার ভালোমন্দ হয়না, ডিসেকশন হয়না৷ ভালো লাগা থাকে। আর গানের ক্ষেত্রে, সেই ভালোলাগাটুকুই বোধহয় একমাত্র ডিসিপ্লিন, অন্তত আমার মত অতিপাতি মানুষের জন্য৷ 

প্রথমবার অঞ্জনবাবুর গান ক্যাসেট ধার করে শোনা৷ স্কুলবয়সে৷ সে'সব গান প্রথমবার শুনেই লাফিয়ে ওঠার নয়৷ 'ওয়াহ তাজ' বলে সেলাম ঠোকার নয়৷ কিন্তু৷ অঞ্জনবাবুর গানগুলোয় রয়েছে বার বার ফিরে যাওয়ার সুর৷ আর স্কেল-বসানো সোজাসাপটা সরলসিধে কথা৷ প্রথম শোনায় যে ক্যাসেট 'ঠিকই আছে' মনে হয়েছে, বাহাত্তর নম্বর শুনানির সময় সেই ক্যাসেটই ইয়ারদোস্ত৷ 

ভদ্রলোকের বেশ কিছু গোবেচারা গান রয়েছে৷ একসময় তারা মাঝেমধ্যেই টেপরেকর্ডারে বাজছে৷ বিরক্ত করছে না, আবার মনে ইয়াব্বড় দাগও কাটছে না৷ কিন্তু আচমকা একদিন খেলা ওলটপালট৷ হয়ত কেমিস্ট্রির খাতার পিছনে মন দিয়ে বুক ক্রিকেটের স্কোর লিখছি৷ তখন দুম করে টের পেলাম - আরে! "শুনতে কি চাও তুমি"র সুরে কী দারুণ মায়া৷ কী অপূর্ব স্নেহ৷ আর কী, অমনি সে গানের সঙ্গে দোস্তি হয়ে গেল৷ 

ব্যাপারটা ঠিক কীরকম? ধরুন আপনি সন্ধ্যে ছ'টা বেয়াল্লিশের ব্যান্ডেল লোকালের ডেলিপ্যাসেঞ্জার। ইঞ্জিনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাটি আপনার নিয়মিত অফিস-ফেরতা ঠাঁই। সেই কামরায় এক মুখচোরা মিষ্টি স্বভাবের ভদ্রলোকের সঙ্গে রোজই দেখা হয়, চোখাচোখির আলাপ৷ 'সব ভালো তো' গোছের ইশারা রোজই আদানপ্রদান হয়,থাকে মাথা নাড়া প্রত্যুত্তর৷ আচমকা একদিন, হঠাৎ সেই মুখচোরা মানুষটি যেচে এসে আলাপ জমাবেন৷ তখন জানা যাবে আপনাদের দু'জনেরই ওলসেদ্ধ দিয়ে ভাত মেখে খেতে ভালো লাগে, আর ভালো লাগে দীঘা, আর শীর্ষেন্দু, আর আশাপূর্ণাদেবীর লেখা৷ ব্যাস, জমে গেল বন্ধুত্ব৷ তেমনই, অঞ্জনবাবুর সবচেয়ে প্রিয় গানগুলোও একদিন অতর্কিতে এসে আলাপ জমিয়েছে, এবং তল্পিতল্পা সমেত থেকে যায়৷ 

আর থেকে যাওয়া মানে থেকে যাওয়া? এক্কেবারে জাঁকিয়ে বসেছে৷ কাজেই চৌধুরীদের  একুশতলার নির্লজ্জ ঝগড়াঝাটি এখন আমার সুপরিচিত৷ বাবা-মায়ের সিনেমা ফেরত রোলটা ডাবল এগ ডাবল চিকেন, আমার অন্তত সে'টাই বিশ্বাস; আর খোকার ডিনারের ট্যালট্যালে ঝোলের হলদেটে বিস্বাদ রংটাও আমি দিব্যি চিনি; অঞ্জনবাবুর সুরের মধ্যে দিয়ে৷ আমি মাঝেমধ্যেই গুগলম্যাপে বেনিয়াপুকুর আর বেহালা যাওয়ার রুট দেখি৷ কমলা এজেন্সির ছোট্ট অফিসের কোণে অর্ণবের কাগজ বোঝাই টেবিলটা আমি ভীষণ চেনা, সেই টেবিলের পিছনের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটাও আমি চিনে রেখেছি; ডাল লেকের ওপর শিকারা। আর বৃষ্টিতে চটি ছিঁড়ে যাওয়ার মধ্য যে চিনচিনে সুরটা মিশে থাকে, সে'টা আমি দিব্যি চিনি। 

এমন কত হাজার চেনাজানা, পরিচিতি, স্নেহ-মায়া সুট করে গছিয়ে দিয়েছেন অঞ্জন৷ তার গানগুলো আমাদের এই এলেবেলে জীবনের লাগসই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, এ নিয়ে আমার কিন্তু কোনও সন্দেহই নেই৷ 

Monday, December 27, 2021

শ্যামল ডিলান তুকতাক



- এই যে৷
- আরে, তুমি? কী আশ্চর্য!
- চলে এলাম, ইচ্ছে হল৷ অবাক হওয়ার কী আছে!
- বসো।
- বসি, কেমন?
- একশো বার৷
- থ্যাঙ্ক ইউ।
- এই বেঞ্চটা বড় মায়ার৷ তাই না?
- যা শীত৷ বাপ রে৷ হাড় কনকনের মধ্যে মায়াটায়া টের পাচ্ছি কই৷
- হেহ্৷
- অনি কেমন আছে?
- দিব্যি৷ শখের প্রাণ৷ আজকাল হঠাৎ বাগানের শখ চেপেছে৷ হপ্তায় দু'দিন অফিস কামাই করছে পেয়ারের গাছেদের দেখভাল করতে৷ চাকরী বেশিদিন টিকলে হয়৷
- লোকটা খ্যাপাটেই রয়ে গেল৷
- আর নিপা?
- গোটা দিন ক্লাসে ছাত্র পড়ানো৷ সন্ধের পর নিজের পড়াশোনা, রিসার্চ৷
- ও'ও কিন্তু কম খ্যাপাটে নয়৷
- খ্যাপাটে না হলে ওই শীতের রাত্রে এই পাহাড়-পাড়ার এই বেঞ্চিতে বসে আর এক খ্যাপার সঙ্গে কেউ গল্প জোড়ে?
- তাই তো। আচ্ছা, নিপা এখন কী করছে বলো তো?
- মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করছে৷ কানে ইয়ারফোন। চোখ বোজা৷ আর তোমার অনি? সে কোথায়?
- শাল জড়িয়ে ছাতে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ৷ ওল্ড মঙ্কের ঝিমঝিম। আর যথারীতি কানে ইয়ারফোন৷ চোখ বোজা৷
- আহ্। অফ কোর্স৷ তাই তো আমাদের দেখা হল৷
- বেঞ্চিটা সত্যিই মায়ার।
- ব্যাপারটা দিব্যি।
- আর খানিকটা ভূতুড়ে৷
- হেহ্ হেহ্।
**
- তা'হলে ছুটি শেষ!
- শেষ৷
- কাল থেকে ফের শহর৷ দৌড়ঝাঁপ৷ আমার সেই চাকরী৷ তোমার সেই কলেজ৷ ধুত্তোর।
- সত্যিই।
- নিপা, বিয়েটা কবে করছি আমরা?
- অনিবাবু যবে সিরিয়াসলি প্রপোজ করবেন, অমনি৷
- বাহ্৷ এখন বুঝি সিরিয়াস নই?
- কাঁচকলা।
- দু'দিন সময় দাও৷ সিরিয়াস প্রপোজাল দেখবে কাকে বলে।
- আচ্ছা, অনি! যদি আমারা দূরে সরে যাই?
- তুমি বড় পেসিমিস্ট নিপা।
- সে দুশ্চিন্তা কখনও তোমার হয় না?
- দাঁড়াও৷ জন্মজন্মান্তরের একটা সলিউশন তৈরি করে যাই৷ তোমার ইয়ারফোনে একটা গান পজ্ করা আছে৷ তাই না? যে'টা এ'খানে হেঁটে আসার সময় শুনছিলে? আমায় দেখে যে'টা থামালে?
- ডিলান।
- তোমায় দূর থেকে দেখে আমিও কান থেকে ইয়ারফোন সরালাম। আমি শ্যামল মিত্তিরে আটকে ছিলাম৷ এ'বার আমায় তোমার ফোন-ইয়ারফোন দাও, আমি ডিলানের গানটা শুনে শেষ করি৷ তুমি আমার শ্যামল সামাল দাও।
- তা'তে কী হবে?
- হাইক্লাস তুকতাক নিপা। তুমি আর আমি যদি ফস্কেই যাই, কোনওদিন যদি সে দুর্ঘটনা ঘটেই যায়..। এই দু'টো গান আমাদের হয়ে মাঝেমধ্যেই এই কার্শিয়াংয়ের বেঞ্চিতে এসে বসবে। নোটস এক্সচেঞ্জ করে সরে পড়বে।
- তুমি একটা অখাদ্য।
- কলকাতায় ফিরে একটা সুপারসিরিয়াস প্রপোজাল দিয়ে তোমায় জাস্ট ঘাবড়ে দেব৷ তখন আর অখাদ্য মনে হবে না!
- দাও দেখি তোমার শ্যামল মিত্র৷ আর এই নাও, ডিলান৷