Saturday, January 26, 2019

লস্ট বয় অফ সুদান


এ বই ছাব্বিশে জানুয়ারি পড়া শেষ হল, সে'টা একটা উপরি পাওনা।

১৯৯০। দক্ষিণ সুদানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম; কিমটং।  বিজলিবাতি বা গাড়িঘোড়া বা স্কুল সে গ্রামে ছিল না; শুধু এ'টুকু বললে সে গাঁয়ের অন্ধকার সঠিকভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। আসলে আমি কোনো কিছু বললেই সে পৃথিবীর যন্ত্রণাগুলো যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারব না। তার জন্য লোপেজের আত্মজীবনী 'রানিং ফর মাই লাইফ' পড়া ছাড়া গতি নেই।

ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে তখন সুদান তছনছ; লোপেপে (ভালো নাম; লোপেজ লোমং)  নামে ছ'বছরের এক শিশু কিমটং গ্রামের গীর্জা থেকে অপহৃত হয়। লোপেপে একা নয়, প্রতিদিন বহুসংখ্যক শিশুদের তুলে নিয়ে যেত যুযুধান সেনারা। যে পাশবিক পরিস্থিতিতে সেই অপহৃত শিশু ও কিশোরদের রাখা হত, তা'তে অনেকেই মারা যেত অত্যাচার ও অনাহার সহ্য করতে না পেরে। যাদের মধ্যে বেঁচে থাকার দুঃসাহস ও অমানবিক তাগদ থাকত; তাদের জোর করে ভর্তি করা হত সৈন্য হিসেবে। উইকিপিডিয়ায় 'লস্ট বয়েজ অফ সুদান' সার্চ করলে সে বিষয়ে কিছুটা জানা যায়। বাপ-মায়ের কোল থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল লোপেপেকে। তখন সে দুধের শিশু, বন্দী অবস্থার অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে তার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু বরাত জোরে সে পালিয়ে বাঁচে।

লোপেপে সীমানা পেরিয়ে এসে পৌঁছয় কেনিয়ার কাকুমা রিফিউজি শিবিরে। সে'খানে দশ বছর কাটায় লোপেপে। এই দশ বছরের যে বর্ণনা বইতে রেখেছেন লোপেজ লোমং, তা পড়ে শিউরে উঠতে হয়।  যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার যে ভয়াবহ ছবি তুলে ধরেছেন লোপেপে, তা যে কোনো পাঠককে বাধ্য করবে খাবারের প্রতিটি কণাকে বা সাধারণ প্যারাসেটামলের মত ওষুধকে অন্য মাত্রার সমীহ করতে। কেনিয়ার সেই শরণার্থী শিবিরে লোপেপেদের দিনে একবারের বেশি খাওয়া জুটত না, তাও আধপেটা। রিফিউজি, তাই শিবিরের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করার অনুমতিও ছিল না তাঁদের। হপ্তায় একদিন তাঁরা দিনে দ্বিতীয় বারের জন্য খেতে পারত; কারণ সে'দিন শিবির সংলগ্ন ময়লার স্তুপে কাকুমার অন্য প্রান্ত থেকে উচ্ছিষ্ট,ফেলে দেওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার এনে ফেলা হত। সেই ময়লার স্তুপেও চলত কাড়াকাড়ি, হাতাহাতি।  আর পাশাপাশি ছিল মৃত্যু; লোকজনের মরে যাওয়াটা প্রায় এলেবেলে পর্যায়ের একটা ব্যাপার ছিল। বইয়ের প্রথম অংশ লোপেপের সেই সংগ্রামের; অবশ্য সে সময় বেঁচে থাকা ব্যাপারটাই লোপেপের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মত ছিল। সে ধরেই নিয়েছিল বাপ মায়ের দেখা আর সে পাবে না। আর তার সমস্ত যন্ত্রণার মলম বলতে ছিল তিনটে ব্যাপার; ঈশ্বরে আস্থা, দৌড় আর ফুটবল।

বইয়ের পরের অধ্যায় লোপেপের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ছুটে যাওয়া নিয়ে। লোপেপে প্রথম অলিম্পিকের কথা শোনে পনেরো বছর বয়সে, প্রথম পাউরুটি চেখে দেখার সুযোগ পায় তারও পরে; যখন ভাগ্যের দুরন্ত মোচড়ে সে আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পায়। আমার খানিকটা মনে আছে প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সময় লালমোহনের উচ্ছ্বাস। লোপেজ 'লোপেপে' লোমং; ষোলো বছর বয়সে বহু কাঞ্চনজঙ্ঘা উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে শুরু করে যখন সে প্রথম জানতে পারে পেট ভরে যাওয়া বলে একটা ব্যাপার থাকে, বাথরুম বলে একটা ব্যাপার আছে, আছে পরিষ্কার কাপরজামা পরার একটা নিশ্চিন্দি। লোপেপের চোখ দিয়ে চারপাশের সাধারণ জিনিসগুলো দেখতে শুরু করলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। গত দু'দিন ধরে চানাচুরের একটা দানা প্লেটের বাইরে পড়লে লজ্জা হচ্ছে।এই লজ্জাটা শৌখিন এবং সাময়িক, সে'টাও স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।

বইয়ের বাকি অংশ জুড়ে 'ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা' আর ফেলে আসা মাটির টান। লোপেপের লেখায় একটা সরল প্রশ্ন বার বার উঠে এসেছে; জন্মসূত্রে পাওয়া পদবীর মতই, জন্মসূত্রে পাওয়া নাগরিকত্বের প্রতি আনুগত্যই দেশাত্মবোধের শেষ কথা হতে যাবে কেন? লোপেপের জীবন ও বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ ভাবে পালটে যায় এক আমেরিকান দম্পতির স্নেহে; আমেরিকায়। লোপেপেও আমেরিকাকে ভালোবাসতে কসুর করেনি; আমেরিকাকে ততটাই আপন করে নিয়েছে যতটা একজন সাতপুরুষ পুরনো মার্কিনীর পক্ষে সম্ভব। লোপেপে যেমন আমেরিকার ছত্রছায়ায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে, হয়ে উঠেছে সে দেশের অন্যতম সেরা ট্র‍্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলিট এবং বেজিং অলিম্পিকে মার্কিন পতাকাবাহক; আমেরিকাও ততটাই সমৃদ্ধ হয়েছে লোপেজ লোমংয়ের মত সুনাগরিক পেয়ে। নিজের পিতৃপরিচয়ের মতই, জন্মভূমি বেছে জন্ম নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নিজের পছন্দসই দেশ বেছে নেওয়ার পথটা সরল নয় কেন? লোপেজ পেরেছেন, বেশিরভাগ 'লস্ট বয়েজ অফ সুদান' পারেনি।

লোপেজ নিজের ফেলে আসা জগতকে মনে রেখেছেন, স্মৃতি আগলে রেখেছেন; বার বার ফিরে গেছেন। দেখেছেন যুদ্ধ থামলেও সে'খানকার অবিশ্বাস্য অন্ধকার ফিকে হয়নি এতটুকু। সে'খানে আজও সামান্য পেনিসিলিনের অভাবে শয়ে শয়ে শিশু মারা যাচ্ছে, আজও স্কুল নেই। আশা নেই, স্বপ্নও নেই। নিজের জন্মভূমিতে সেই আশা ও স্বপ্ন পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছের কথা লিখেছেন লোপেজ, আর লিখেছেন আমেরিকার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা। লোপেজের মত কিছু নিবেদিতপ্রাণ নাগরিক পেলে যে'কোনো দেশে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে যাবেই। এ বই পড়ে মনে হয়, একদিন সমস্ত দেশের ইমিগ্রেশন পলিসি ঢেলে সাজানো হবে। একটা ফুটবল টীমের স্কাউটরা যে'ভাবে গোটা দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে ভালো খেলোয়ার 'রিক্রুট' করতে, একটা দেশ আদর্শ নাগরিকদের খোঁজ করবে না কেন?

সবশেষে দু'টো কথা বলা দরকার।

এক, লোপেজের ঈশ্বর-বিশ্বাস। পাঠক নিজে ঈশ্বর-অবিশ্বাসী হতেই পারেন, কিন্তু লোপেজের ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করা অসম্ভব।  মাঝেমধ্যে মনে হবে লোপেজ যেন দাদার কীর্তির কেদার আর ঈশ্বর হলেন ভোম্বলদা; মাঝেমধ্যে ফাঁপরে ফেললেও, উতরে তিনিই দেবেন।

দুই, অলিম্পিকে মেডেল জেতা হয়নি লোপেজের। তবে হেরে যাওয়া রেসের শেষে গেয়েছিলেন আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত, তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন খেলা দেখতে আসা প্রচুর মার্কিনী দর্শক। এই অভিজ্ঞতার কথাটা লোপেজের ভাষায় পড়া দরকার। (প্রসঙ্গত, আজ দেখলাম দীপা কর্মকারের বই বেরিয়েছে, দেখা যাক)।

'হেরে যাওয়া রেস' বললাম কি? লোপেপে হেরে যাওয়ার বান্দাই নন।

Friday, January 25, 2019

মুঝে ইয়াদ আতি হ্যায়



"...অপনে দেশ কি মিট্টি কি খুশবু
মুঝে ইয়াদ আতি হ্যায়
মুঝে ইয়াদ আতি হ্যায়
কভি বেহলাতি হ্যায়
কভি তড়পাতি হ্যায়
মুঝে ইয়াদ আতি হ্যায়"।

মাটির টান, দেশের টান, ফেলে আসা সময়ের টান; এ'সবের মিশেলে বোধ হয় এমন সুরই তৈরি হয়। আর গানের কথায় এত সহজে কী ভাবে যে মায়ের আদর আর সোঁদা গন্ধ মিশিয়ে দেওয়া যায়; তা জাভেদবাবুই জানেন। পতাকা, পার্লামেন্ট আর সিলেবাসের ইতিহাস; এ'সবের বাইরে যে দেশটুকু; এ গান একান্তভাবে সেই দেশের।

প্রত্যেকটা মানুষ নিজের মধ্যে যত্ন করে বয়ে নিয়ে চলে একটা দেশ; 'আমি-রিপাবলিক'-
কারুর কাছে সংবিধান বলতে মায়ের সাতপুরোনো গানের খাতা, আবার কারুর কাছে আয়নার এক কোণে সাঁটা লাল টিপ।
কারুর পতাকা বলতে শিব্রাম, কারুর দেরাজে যত্নে রাখা ফেরত-না-দেওয়া রুমাল।
কারুর মুক্তিযুদ্ধ লোকাল ট্রেনের মান্থলিতে, কারুর ইতিহাস জমাট বেঁধে আছে অজস্র পোস্ট না করা চিঠিতে।

খোদ ভারতবর্ষের বুকের মধ্যে ধুকপুক করে চলেছে একশো কোটিরও বেশি দেশ। এ গান তেমন যে কোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠতে পারে। এই গানের মধ্যে আছে সেই অগুনতি দেশের জার্নাল। আর আছে সেই সমস্ত দেশের  কাছে ফিরতে চাওয়ার কাঙালপনা।

আমার দেশের চেহারার সঙ্গে আপনার দেশের চেহারায়
ও চরিত্রে বিস্তর ফারাক। যেমন মিনিবাসের জানালায় কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে যে মেয়েটি গা এলিয়ে বসে; তাঁর দেশে হয়ত সদ্য ভাঙা প্রেমের অনাবৃষ্টি। আবার প্রায় অনাহারে বেড়ে ওঠা যে কিশোর তেরো বছর বয়সে প্রথম পাউরুটি চুরি করেছে, তার দেশ জুড়ে তখন ফরাসী বিপ্লব মিইয়ে দেওয়া অভ্যুত্থান।

অনবরত নিজের দেশের স্মৃতি হাতড়ে চলা আর ক্রমশ  সে দেশ থেকে দূরে সরে যাওয়া; হারিয়ে যাওয়া; এই দোলাচল রয়েছে এ গানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। 'দেশ'য়ের রেসিপি একেকজনের কাছে এক এক রকম আর সঞ্চিত স্মৃতির হাত ধরে নিজের সে দেশকে চিনে নিতে পারাটা যে কী প্রবল ভাবে কলম্বাসিও! দেশকে চিনে নিতে পারার নিবিড় ভালোবাসা মেশানো সুরটুকু সবার বুকেই ইতিউতি বাজে; এ গান সেই সুরকে বড় মোক্ষম ভাবে ধরেছে।

এ'খানে সুরে বাজিমাত নেই, জলপটি আছে।
এ গানের কথায় বিদ্যুৎ নেই, আছে মায়ের কাঁধ;  যে'খানে থুতনি রাখলে সমস্ত জমাট বাঁধা অভিমান গলে জল হতে বাধ্য।

Thursday, January 24, 2019

মনোজ দত্তর চিঠি



- চিঠি? আমার নামে?

- অনিল হালদার আপনি হলে, ইয়েস।

- তোমায় দেখে তো ঠিক ক্যুরিয়র কোম্পানির লোক মনে হয় না হে..।

- ও মা। না না, আমি পোস্টম্যান বা কুরিয়রের লোক নই।

- তা'হলে আমার অফিস বয়ে এলে যে...।

- শুধু তাই নয়, আগাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসিনি। তাই আপনার সেক্রেটারি ঝাড়া তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন।

- খামের গায়ে তো কিছুই...।

- লেখা নেই..। জানি।

- এ চিঠি কার লেখা? তুমি নিয়ে এসেছ কেন?

- এত মন দিয়ে লিখলাম চিঠিটা, তাই ভাবলাম আমিই নিয়ে যাই। ওহ, আমার নাম মনোজ দত্ত।

- সশরীরেই যখন এলে, তখন চিঠির কী দরকার ছিল..ব্যাপারটা কী...। আজকাল ছেলেছোকরাদের ব্যাপারস্যাপার বোঝা দায়। চাকরীর আবেদনটাবেদন নয় তো?

- লেফাফা খুলে দেখুন না স্যর। 

- তোমার হাবভাব কেমন সাসপিশাস মনে হচ্ছে, খামে গোলমেলে কিছু নেই তো?

- গুড নিউজই আছে স্যার। খুলেই দেখুন না।

- নিজেই লিখেছ যখন, বলেই দাও কী আছে এতে। বৃদ্ধ বয়সে এই অকারণ কায়দা বরদাস্ত হয় না।

- আপনি এত স্কেপ্টিক কেন বলুন তো অনিলবাবু?

- আমি? স্কেপ্টিক? শোন হে ছোকরা, বাতিকগ্রস্ত হলে কলকাতার বুকে এত বড় ব্যবসা ফেঁদে বসতে পারতাম না। রেন্টেড টেবিল দিয়ে শুরু বছর কুড়ি আগে। আজ আট হাজার স্কোয়্যার ফিটের অফিস।  গারমেন্ট ইম্পোর্টে গত দশ বছরে শহরের আর কোনো ফার্ম এত প্রগ্রেস করেনি। আর ব্যবসায় এগিয়ে যেতে হলে নির্ভয়ে ডিসিশন নিতে হয়। আমায় স্কেপ্টিক বললে ধর্মে সইবে না।

- তা'হলে খুলেই দেখুন ন। খামে কী আছে।

- তোমার নামটা কী বললে যেন হে?

- মনোজ। দত্ত। নামটা চেনা ঠেকছে কি?

***

- মনোজ দত্ত, নামটা মনে পড়েছে। ট্যু লেট। বাট মনে পড়েছে।

- অন্ধকারে ঘরে আপনার মাথাটা দিব্যি খোলতাই হয় যায় দেখছি অনিলবাবু।

- এ জায়গাটা কোথায়?

- খামের ভিতর। অফ কোর্স।

- ওহ, ম্যাজিশিয়ান মনোজ দত্ত। অফ কোর্স। আমার তোমায় চট করে চিনে ফেলা উচিত ছিল।

- সং সেজে টুপি থেকে খরগোশ বের করা খোকাভোলানো ইউজলেস ফেলো। আপনার দেওয়া লম্বা কমপ্লিমেন্ট ভুলিনি স্যর।

- তাই আমায় খামের ভিতর পুরে ফেলতে এত বছর পর ফিরে এসেছ! ইডিয়ট। এ'সব তুকতাক আর শয়তানি ছাড়া যে তোমার আর কোনো মুরোদ নেই তা আমি আগেই বুঝেছিলাম। রিভেঞ্জ নিতে এসেছ! রাস্কেল। মেঘার নখের যোগ্য তুমি ছিলে না।

- রিভেঞ্জ? না অনিলবাবু। আদৌ না। প্রতিহিংসার জন্য আপনাকে টুপিতে হাপিশ করে সহজেই খরগোশ করে বের করতে পারতাম। সে এলেম আমার আছে। আপনি এ আর্টকে নীচু চোখে দেখতেই পারেন, তা'তে আর্টের কিছু এসে যায়না। আমি আর্টিস্ট স্যর, আমি রিভেঞ্জের মানু্ষ নই। আমি সত্যিই আপনার মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম জানেন, মেঘাও আমাকে ভালবেসেছিল।  আপনি ওকে বাধ্য করেছিলেন আমার থেকে দূরে সরে আসতে। তবে বিশ্বাস করুন, ওর আত্মহত্যার জন্য আমি আপনাকে দায়ী করিনি কোনোদিন।

- শাট আপ। ইডিয়ট। এত বছর পর এই ডার্ক ম্যাজিকে আমায় বিপদে ফেলবে ভেবেছ?

- না হালদারবাবু। আমি মেঘার ভালোবাসায় ফিরে এসেছি, আমি জানি আপনি বড় যন্ত্রণায় আছেন। আমারই মত। আমি আপনার জন্য এসেছি স্যর। থাকবেন আমার সঙ্গে এই জগতে? নাকি ফিরে যাবেন? ব্যবসায়, কলকাতায়, অফিসে, হেরে যাওয়া জগতে...। এ'খানে মেঘার সুবাস আছে; আমার ভালোবাসার জোরে তার সুবাস এখনও টিকিয়ে রেখেছি। থাকবেন এখানে? মেঘার সুবাস দু'জনে ভাগ করে কাটিয়ে নেব?

- কী হচ্ছে কী এ'সব!

- আপনি চাইলেই আমি আপনাকে খামের বাইরে ছেড়ে আসতে পারি। কিন্তু সে'খানে দেওয়ালে টাঙানো মেঘার ছবি আছে হালদারবাবু। মেঘা নেই। মেঘা এ'খানে আছে। আমার মধ্যে। থাকবেন প্লীজ?

- ফ্রড! এ'সব মিথ্যে!

**

ঝিমটি ভাঙতেই হালদারবাবু টের পেলেন টেবিলে কেউ বেনামী খাম রেখে গেছে। সেক্রেটারি কিছুই বলতে পারল না, এমন কী সিসিটিভিতেও কাউকে তাঁর ঘরে এ খাম নিয়ে আসতে দেখা যায়নি। ভোজবাজিই বটে।

হালদারবাবু মিচকি হেসে মাথা নাড়লেন; আজ মেঘার জন্মদিন। কতদিন মেয়েটার গায়ের মায়াবী গন্ধ এমন ভাবে নাকে এসে ঠেকেনি। কতদিন। মনোজ ছোকরাটার এলেম আছে। আর বেশি চিন্তা না করে উকিলকে ফোন করলেন অনিল হালদার; উইলের ব্যাপারটা ঠিকঠাক করে তারপর এ খাম খুলতে হবে। আজই।

জুতোবাজ



এক বন্ধু রেকমেন্ড করেছিল 'বিসনেস ওয়ার্স' পডকাস্ট। পেপসি-কোকের পর নাইকি এবং অ্যাডিডাসের বাজারদখলের লড়াই নিয়ে রোমহষর্ক কয়েকটা এপিসোড শুনেছিলাম। আর তার কয়েকদিনের মাথায় নজরে পড়ল এই বইটা; নাইকির ফিল নাইটের আত্মজীবনী। সোজাসাপটা ভাষা, কিছু কিছু জায়গায় প্রায় ডায়েরির মত গড়গড়িয়ে লেখা। আর সোজাসাপটা লেখার যে কী গুণ; মনে হয় টেবিলের ও'পাশে বসে কেউ গল্প বলছেন। এ চ্যাপ্টার থেকে ও চ্যাপ্টার যাওয়ার সময় মনে হয়; "এক মিনিট স্যার, চট করে চানাচুরের ডিবেটা নিয়ে আসি"।

এ'বারে র‍্যান্ডম অবজার্ভেশনগুলোঃ

১. আমেরিকানদের খেলাধুলোর প্রতি আগ্রহের সঙ্গে আমাদের কিছুতেই তুলনা চলে না। আগাসি বা ফিল নাইটরা ব্যতিক্রমী, তাঁদের দৃষ্টান্ত দিয়ে গড়পড়তা আমেরিকানদের বিচার করা অবশ্যই অনুচিত।  কিন্তু এই দু'জনের আত্মজীবনী পড়ে  বুঝেছি যে সে'দেশে স্পোর্টস ব্যাপারটা সিস্টেমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ভাবে মিশে আছে; বিশেষত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। এবং সবচেয়ে বড় কথা হল অলিম্পিয়ান বা সেলেব্রিটি হওয়ার লোভটুকুই স্পোর্টসের শেষ কথা নয়। আগাসির টেনিস বা নাইটের দৌড় নিয়ে গল্প লেখা হয় বটে কিন্তু তাঁরাই শুধু ক্রীড়াবিদ নন। অফিস ফেরতা মানুষের জগিংয়ে বেরোনো বা ব্যাডমিন্টন খেলতে যাওয়ার মধ্যেও রয়েছে সার্থকতা; সে'খেলাটুকুও সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার আছে, সে'টুকু খেলার মধ্যেও নিয়ম আর ভালোবাসা টিকিয়ে রাখাটা জরুরী। বিভিন্ন চাপে যতবার ফিল নাইট পর্যুদস্ত বোধ করেছেন; ততবার তিনি দৌড়েছেন মাইলের পর মাইল। ফিল নাইট ব্যবসায়ী হিসেবে যতটা সফল, তাঁর জীবন ততটাই সার্থক ক্রীড়াবিদ হিসেবে; যদিও তেমন মেডেলটডেল কোনোদিনই জোটাতে পারেননি তিনি।

২. প্রতিটা সফল ব্যবসার গল্প যত্ন করে বলতে পারলে বোধ হয় এমন কিছু রোম্যান্টিক  মুহূর্ত, অ্যাডভেঞ্চার ও ঘুরে দাঁড়ানোর রূপকথা ভেসে উঠবে যা যে কোনো নভেলের কান মুলে দিতে পারে। ফিল বড় যত্ন করে সমস্ত গল্প বলেছেন। কফিকাপ হাতে বারান্দায় বসে যে সুরে গপ্প ফাঁদা উচিত, সে'ভাবেই।

৩. ক্রমশ বিশ্বাস মজবুত হচ্ছে যে আত্মজীবনীতে নিজের কথা বলার চেয়ে ভালো স্ট্র‍্যাটেজি হচ্ছে আশেপাশের মানুষগুলোর কথা গুছিয়ে বলা। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, রাগ, প্রতিশোধ,  হাসিঠাট্টা; সমস্ত ফিল্টার দিয়ে নিজের চারপাশের মানুষগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখাতে পারলেই নিজের জীবনের গল্পটা দিব্যি বলা হয়ে যায়; এবং স্টাইল হিসেবে সে'টাই মনোগ্রাহী। ফিল এই কাজটা খুব ভালোভাবে করেছেন। প্রায় গোটা বই জুড়েই নিক একজন অবসার্ভার; ব্লুরিবন থেকে নাইকি হয়ে ওঠার গল্প এগিয়ে চলে অন্যদের সাফল্য আর ব্যর্থতায় ভর দিয়ে।

৪. ফিল বহু বছর লড়াই করবেন নিজের বাবার চোখে পুত্র-গর্বের ঝিলিক দেখতে।  আর বহু বছর পর বুঝবেন যে সে লড়াইটা অদরকারী ছিল। তবে সে যাত্রাপথটা অদরকারী ছিল না। আর সে যাত্রাপথের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর নিজের চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে নিজের বৃদ্ধ পিতার জন্য গর্বে। ফিলের বাবা ছিলেন ভুলেভ্রান্তিতে ভরা, ঠিক ম্যাথুর বাবার মতই। ম্যাথু কে? ফিল নাইটের বড় ছেলে, যার অকালমৃত্যুর ধাক্কা সহ্য করত হবে নাইটকে।

৫. নাইকির মাধ্যমে কিছু জবরদস্ত বন্ধু জুটিয়েছিলেন ফিল। নাইকির সাফল্য সে'সব বন্ধুত্বের গল্পও বটে। আর বড় চিত্তাকর্ষকভাবে সে'সব বন্ধুদের কথা বলেছেন ফিল। বন্ধুদের সাহায্যে  নাইকি তৈরি করেননি ভদ্রলোক, বরং নাইকির মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছেন সে'সব বন্ধুদের। খুঁজে পেয়েছেন জীবনসঙ্গিনীকে। এমন কি নাইকি নামটাও ফিলের দেওয়া নয়, বরং স্বপ্ন হাতড়ে সে নাম পেয়েছিলেন তেমনই এক বন্ধু। পড়তে দিব্যি লাগে সে'সব গল্প।

৬. জাপানি ও মার্কিনীদের তফাৎ, মিল ও ব্যবসায়িক রসায়ন নিয়ে বেশ জরুরী কিছু কথা রয়েছে এ বইয়ে।

৭. এক্সেলেন্সের প্রতি আনুগত্য; আমার আদৌ নেই। কিন্তু জবরদস্ত  মানুষজনের থাকে। সে জন্যেই আজকাল বিভিন্ন বায়োগ্রাফি পড়ার চেষ্টা করছি।  ভালো লাগে, মাঝেমধ্যে গায়ে কাঁটা দেয়। এক্সেলেন্সের একটা বড় দিক বোধ হয় মানুষকে সম্মান করতে পারা। এই একটা গুণের জন্যেই হাজার গলদ সত্ত্বেও  ফিল নাইটরা ব্যতিক্রমী; এ জন্যেই হয়ত তাঁদের জীবনী হয়ে ওঠে 'গ্রিপিং'। সেল্ফ-হেল্প বই আমার ধাতে সয় না, কিন্তু এ'বইগুলো বেশ চমৎকার।

ভাঙা প্রেম


প্রত্যেক ভাঙা প্রেমের শেষ দৃশ্যে এক থালা বিরিয়ানি থাকলে ভালো হয়৷ থালার একপাশে হেরো প্রেমিক, অন্যপাশে পর্যুদস্ত প্রেমিকা।

বিরিয়ানি সুবাসের পাশাপাশি ইতিউতি "খাচ্ছ না কেন?" ভেসে বেড়াবে বাতাসে। আর সরু চালচাপা-নরম আলুর মত ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবে "আর দেখা হবে না, না?"র ধান্দাবাজ প্রশ্ন।

বিরিয়ানি আর ভাঙা প্রেমে তাড়াহুড়ো চলে না, সে'টাই বাঁচোয়া।

রাজ্যপাট



- ভাই মন্ত্রী! ও মন্ত্রী!

- রাজাদা, ডাকছেন?

- আমার আর কে আছে ভাই?

- কেন? সিংহাসন আছে। এক ডিবে ইয়ারবাড আছে৷ মাইক্রোওয়েভে দেড়খন্ড পিৎজা আছে। আর আছে বালিশের ওয়াড়ে চায়ের ছোপ।

- তোমার আমি এত কদর করি ভাই মন্ত্রী,  অথচ তোমার যত চ্যাটাংচ্যাটাং কথা। নেহাত রাজ্যপাট সামলে রাখো। সকালে পোনামাছটা, বিকেলে সিগারেটটা এনে দাও; তাই বলে কি একটু মিঠে সুরে কথা বলতে নেই?

- আহ, রাজন। রাজপুরুষের অত নেকুপুষু হলে মানায় না।

- মনে বড় দুঃখ ভাই মন্ত্রী।

- দুঃখ? স্যাডনেস? ফ্যাঁচফোঁচ? হুহু?

- মান্নাদের গলা কাঁপুনির মত। সঞ্জীবের শেষ লাইনের মত। রোববার দুপুরের কলেজস্ট্রীটের মত।

- সরেস। রাজাদা, বড় বাজে বুকে। না?

- বড্ড বাজে। রীতিমত বাজে ভায়া। বুকে জমাট বেঁধে আসে। মনে হয় যদি ছাতে উঠে সাইকেল চালাতে পারতাম তা'হলে খানিকটা ভার লাঘব হত।

- আপনার দুঃখ ভল্যিউম উইদাউট ওয়েট নয় দেখছি৷

- হাই ডেন্সিটি মন্ত্রী।  হাই ডেন্সিটি।

- মায়ের কথা মনে পড়ছে?

- ছেলেবেলার দুপুরে মাকে জড়িয়ে শুতাম। বিকেলে তড়াং করে উঠে পড়তাম আমার প্রাণের বন্ধুর সাইকেলের কলিংবেলে। সব কন্ডেন্স করে গেছে ভাই।

- তা, এ দুঃখের গন্ধ কিছু টের পাচ্ছেন শাহেনশাহ?

- কনসেন্ট্রেট করলেই সে গন্ধ পাওয়া যায়। তবে ফ্লাকচুয়েট করে। কিছুক্ষণ আগেই ছিল পেট্রোলে শিউলি৷ এখন পাচ্ছি ফেনাভাতে টোস্টবিস্কুট।

- কী জানেন রাজাধিরাজ,  সুখ ব্যাটাচ্ছেলে বেশ কুকুরছানার মত চঞ্চল; এই হলুদ রবারের বল মুখ করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে তো অমনি আপনার হাঁটু জড়িয়ে ল্যাপ্টালেপ্টি আর কুঁইকুঁই। দুঃখ বেড়াল, সহজে ধরা দেবে না। তাকে খেলিয়ে খেলিয়ে বুকে তুলে নিলে তবে সেই গ্যাঁট হয়ে বসে জিরোবে, গালে গাল ঠেকিয়ে মৌজ করবে। কাজেই ব্যস্ত হবেন না রাজাদা, দুঃখকে জার্মিনেট করতে দিন।

- দেব?

- আলবাত দেবেন। দুঃখগুলো বড় না হলে আপনাকে সামলে রাখবে কে? দুঃখগুলো জড়িয়ে না থাকলে বাঁদরামির ভাইরাসে বখে যাবেন যে!

- ভাইমন্ত্রী, তুমি ছিলে তাই এ যাত্রা রাজ্যপাট টিকিয়ে রাখতে পারলাম। নয়ত কবেই ভেসেটেসে যেতাম...।

- আমি রাখারই বা কে আর ভাসাবারই কে। নদী যার, ডোবানোর ফন্দি যার; দুঃখের খড়কুটোও তারই দেওয়া। তা মহারাজ, সাইকেল না থাক; মাদুর তো আছে। যাবেন নাকি? ছাতে?

একুশে একুশ




হারারিদার লেখা পড়া মানে মগজকে সমুদ্রস্নান করিয়ে আনা। বই শেষ করার পর কিছুদিন অন্তত হারারি-মোডে সমস্ত কথাবার্তা,থিওরি,খবরকে অ্যানালাইজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সে ব্যাপারটা রীতিমত আননার্ভিং। এক বন্ধুর রেকমন্ডেশনে বছরখানেক আগে পড়েছিলাম সেপিয়েন্স। গত বছরের শেষে পড়েছি 'হোমো ডেউস' আর এ বছরের শুরুতে 'টুয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর দি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি'। এ দু'টো বই পরপর পড়ে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

হারারি থরেথরে কনসেপ্ট সাজিয়ে দেওয়ার লোক নন; কাজেই মুখে'উরিব্বাস' অথচ মনের মধ্যে অসহায় 'এ বই শেষ হচ্ছেনা' গোছের হাঁসফাঁস থাকার সম্ভাবনা নেই। ভদ্রলোক সম্ভবত চেয়েছেন তাঁর পাঠক অবজেক্টিভ আর সাব্জেক্টিভের তফাৎগুলো স্পষ্টভাবে চিনতে শিখবেন; অন্তত চেষ্টা করবেন। অসুবিধে হচ্ছে আমরা প্রায়শই ভেবে থাকি  সাব্জেক্টিভ আর অব্জেক্টিভের তফাৎ কী এমন হাতিঘোড়াডাইনোসোর; আমরা দিব্যি বুঝি। কিন্তু হারারিদা এই কনফিডেন্সের কলার নাচিয়ে ডিগবাজি খাওয়াতে ওস্তাদ। ব্যাপারটা কিন্তু নেহাত মজার নয়; কত কিছু নিয়ে আজীবন নিশ্চিন্তে ছিলাম, হারারিদা গোলমাল পাকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

এই যেমন রাজস্থানের কোনো নেতা বললেন 'সবার আগে আমার জাত, তারপর অন্যকিছু'। এ'টা শুনে আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগল; খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। আবার 'সবার আগে আমার দেশ, তারপর অন্যকিছু'; এ'টা শুনলে বেশ লাগে। কিন্তু দু'টোর মধ্যে কি আদৌ কোনো মিল নেই? তফাৎ থাকলে কোথায় আছে? হারারিদা এই সন্দেহগুলো বিশ্রীভাবে ইঞ্জেক্ট করেছেন। লিবারেলরা আদৌ কতটা লিবেরাল? প্রাইভেসি কি সত্যিই দরকারি? নাকি গুগলকে নিজের সমস্ত হাঁড়ির খবর বিলিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ যাতে গুগলের এআই আমায় আগাম বলে দিতে পারে কে আমার আদর্শ বন্ধু হতে পারে বা ভবিষ্যতে আমার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা? সন্ত্রাসবাদ কি আজকের দিনে আদৌ তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নাকি আমরা বাতিকগ্রস্ত; পরিসংখ্যান কী বলছে?

বিভিন্ন গল্পে, আলোচোনায়, থিওরির ডিসেকশনে; মোদ্দা কথাটায় বার বার ফিরে গেছেন হারারিদা - সাব্জেক্টিভ আর অব্জেক্টিভের ফারাকটা প্রত্যক্ষ করে আমরা সঠিক প্রশ্নগুলো করতে পারছি কিনা।

তবে একটা হারারিদার একটা থিওরির কথা উল্লেখ করতেই এতটা গল্প ফাঁদা। ভদ্রলোক বলছেন সমস্যা কোনো ইজমে নয়, সমস্যাটা সেই ইজম-বাদীদের অনমনীয় একরোখা বিশ্বাসে। অর্থাৎ আপনি অমুক-ইজমে আস্থা রাখতেই পারেন, কিন্তু আপনার সে আস্থাকে তখনই সিরিয়াসলি নেওয়ার প্রশ্ন আসবে যখন আপনি স্পষ্টভাবে বলতে পারবেন  অমুক-ইজমের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলোর সম্বন্ধে। কাজেই আপনার বিজেপি-কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম সমর্থনকে তখনই সিরিয়াসলি নেওয়া যেতে পারে যখন আপনি আপনার প্রিয় রাজনৈতিক দলের কুপ্রভাব সম্বন্ধে দিব্যি একটা মনোগ্রাহী লেকচার দিতে পারবেন। হিন্দুত্ববাদী হতে পারেন, ইসলামপন্থী হতে পারেন, সেকিউলার হলেও আপত্তির কিছু নেই; কিন্তু ওই, আপনাকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে আপনার স্টান্সের গড়বড়ে দিকগুলোর সম্বন্ধে।

আর নিজের মতামতের গড়বড়গুলো ঘেঁটে দেখা যে কী অস্বস্তিকর ভাই, কী বলব।

২৮১র বই



গতবছর শুরুর দিকে পড়েছিলাম সৌরভের বায়োগ্রাফি।  এ'বছরটা শুরু হল ভিভিএস লক্ষ্মণের জীবনী দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের বই পড়ার সময় খুব মারকাটারি ভাষায় ভেসে যাওয়ার আশা আমার থাকে না। বরং থাকে দু'টো স্পষ্ট চাহিদা;

এক, কেরিয়ারের টাইমলাইন গড়গড় করে আউড়ানো হবে না। বিশেষত লক্ষ্মণ, দ্রাবিড়, শচীন বা সৌরভদের ক্রিকেট জীবন সম্বন্ধে আমারা অনেকেই বেশ কিছুটা ওয়াকিবহাল; তাঁদের ব্যাপারে বিভিন্ন খবর, সাক্ষাৎকার ও প্রতিবেদনে ইন্টারনেটও রীতিমত সমৃদ্ধ। কাজেই আমাদের আগ্রহ না শোনা গল্পগুলোর প্রতি, তাঁদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর প্রতি। গসিপ নয়, কিন্তু তাঁর আশপাশের মানুষগুলো সম্বন্ধে উপলব্ধিগুলোও জরুরী। এ'ব্যাপারে নিজের বইটা ঠিক জমিয়ে তুলতে পারেননি শচীন (বা বোরিয়াবাবু)।

দুই, লেখার টোন হবে সৎ এবং নির্মেদ। অমুকের জীবনী পড়তে গিয়ে তমুকের কণ্ঠস্বর কানে এসে ঠেকলেই মুশকিল। ভালো কি মন্দ; সে প্রশ্নে না গিয়েই স্বীকার করে নিতে পারি যে সৌরভের বইটাতে এই সমস্যাটা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে; ও বই সৌরভের চেয়ে অনেক বেশি গৌতমবাবুর। মন খুলে গল্প বলার ব্যাপারটাই সৌরভের বইতে তেমন ভাবে পাইনি; অথচ বিভিন্ন সাক্ষাৎকার দেখে আমার মনে হয়েছে সৌরভ বেশ জমিয়ে গল্প শোনাতে পারেন।

আর এই দু'টো ব্যাপারেই লক্ষ্মণদার বায়োগ্রাফি শচীন ও সৌরভের থেকে অনেক এগিয়ে। তাছাড়া চ্যাপেল এবং জন রাইট; এই দু'জনের কোচিং নিয়েও বিভিন্ন অ্যানেকডোট চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন ভদ্রলোক।

এবং সবচেয়ে বড় কথা, ভালোমানুষদের ভালোমানুষির গল্প একটানা শুনতে শুনতে মনে হতে পারে সে ভালোমানুষি কিছুটা হলেও গায়ে পড়া এবং খানিকটা কালটিভেটেড। কিন্তু ভিভিএস সে'খানেই মন জয় করে নিতে পারেন; ভদ্রলোকের হিউমিলিটি অতুলনীয়। মানুষটা সত্যিই বড় ভালো (আমার মনে হল); প্রায় সঞ্জীবেস্ক সরল চরিত্র।

বাহবা প্রাপ্য  আর কৌশিকের যিনি লক্ষ্মণের সঙ্গে লিখেছেন। বাহারি ভাষা আর পোড়খাওয়া-লিখিয়ে-মার্কা কেরামতি ব্যবহার করে লক্ষ্মণের সারল্য আর স্টাইল গুলিয়ে দেননি তিনি।

খুনের গল্প


এক

অফিসের ক্যান্টিনে চারাপোনা বা ব্রয়লার কাহাতক সহ্য হয়। কাজেই সোমবারের তেতো ভাবটা কাটাতে আজ লাঞ্চের সময় বেরিয়ে তন্দুরি রুটি আর দু’বাটি মটন কষা খেয়ে ফিরছিলেন তাপসবাবু। মনোজের হাতে বানানো সরেস মিঠে পান একটা খেলে জিভে লেগে থাকা কষা মাংসের স্বাদের প্রতি যথাযথ স্যালুট জানানো হবে; অতএব তক্ষুনি অফিসে না ঢুকে মনোজের পান দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। অফিসের লাগোয়া যে খান দুই পানের দোকান নেই তা নয়, কিন্তু পান বানানোর ব্যাপারে মনোজের পরিমিতিবোধটা শ্রদ্ধা করেন তাপস সাহা ; কাজেই সঠিক পানের জন্য বাড়তি হাফ কিলোমিটার অনায়াসে হেঁটে যান তিনি। মনোজের দোকানে পৌঁছনোর আগেই ভবদুলাল গাঁয়েন লেনের নিরিবিলিতে থমকে দাঁড়াতে হল তাপসবাবুকে।
“এই যে তাপসবাবু, ও মশাই! শুনছেন? এক মিনিট প্লীজ”।

ট্র্যাকস্যুট আর স্পোর্টসশ্যু পরা এক ভদ্রলোক তার দিকেই ছুটে আসছিলেন। বেয়াড়া দুপুরে এমন জগঝম্প মেজাজে জগিং করতে বেরিয়েছেন; ব্যাপারটা অস্বস্তিকরই বটে।

- আমায় ডাকছেন?
- এই গলিতে আর ক’টা তাপসবাবুকে জোটাতে পারব বলুন। উফ, সেই কখন থেকে আপনাকে ডাকছি মাইরি। শোনার নামই নেই।
- সরি, আমি শুনতে পাইনি।
- শুনতে পাবেন কী করে? মাংস রুটি হোক বা সন্ধ্যের শিঙাড়া জিলিপি। সকালের ডালকচুরি হোক বা রাত্রের কাতলা কালিয়া ও গুড়ের পায়েস; খাবার দেখলে আপনার হুঁশ থাকে নাকি! নোলা সড়াক করে বেরিয়ে আসে আর মগজ ঝপাৎ করে বন্ধ। ডাক শুনবেন কী করে?
- এক্সকিউজ মি? চিনি না জানি না, এমন ভাবে কথা বলছেন কেন?
- ও মা! চিন্তা করবেন না। আমি কিছু মনে করিনি। বেশ করেছেন আমার ডাক শুনতে পাননি। রিল্যাক্স।
- দেখুন, আমি বলছি যে বলা নেই কওয়া নেই আপনি আমার সঙ্গে এমন দেমাক নিয়ে কথা বলছেন কোন সাহসে?
- দেমাক? ও মা। ভূতের আবার দেমাক।
- আপনি ভূত?
- রীতিমত। স্পষ্ট।
- গাঁট্টা মেরে সিধে করে দেব, দিনদুপুরে সং সেজে ভূত। ইয়ার্কি হচ্ছে? আর আপনি আমায় ডেকে ডেকে সাড়া পাননা?
- পাই না তো। এই গত হপ্তায় প্রতিটা দিন আমি আপনাকে ভোর পৌনে ছ’টায় ডেকেছি। কিন্তু কী খতরনাক ঘুম মশাই আপনার তাপসবাবু। পৌনে আটটা নাগাদ বৌদির খ্যাঁকখ্যাঁক শুরু না হলে বিছানা থেকে আপনাকে হাফইঞ্চিও নড়ানো যায় না যে।
- তবে রে শালা। বৌ তুলে কথা? তিন তলার ঘরের দরজা এঁটে শুই। নীচে কোলাপিসবল গেট আর চারটে গোদরেজের তালা। ওপরের দরজায় ট্রিপল ছিটকিনি। আর তুই কিনা আমায় রোজ ভোরে ডাকতে আসিস? মামদোবাজি?
- শুধু কি ঘুমের সময় ডেকেছি তাপসবাবু? গতকাল সন্ধেবেলা যখন হরেনদার দোকান থেকে কুড়ি টাকার ফুলুরি আর বেগুনি কিনছিলেন, কত করে ডাকলাম। আপনার সাড়া মেলেনি।
- তবে রে ব্যাটাচ্ছেলে! আমার পিছনে স্পাই হয়ে ঘুরঘুর করা! তুই জানিস আমার পিসতুতো ভাই লালবাজারের বাঘা অফিসার? আমার ছেলেবেলার বন্ধু মন্টুর ভায়রা হল গিয়ে এমএলএ? বল, বল কে তোকে আমার পিছনে লাগিয়েছে।
- ভূতকে পুলিশ আর এমএলএ দেখিয়ে কী হবে তাপসদা। তবে যাক, আজ অন্তত শুনতে পেয়েছেন। গুডবাইটা বলে যেতে পারব।
- গুডবাই? আপনি কে? কে আপনি? চট করে বলুন নয়তো...।
- কতবার বলব! ভূতকে চমকিয়ে লাভ নেই তাপসবাবু। বললাম তো রিল্যাক্স। আর আপনি কি সত্যিই আমায় চিনতে পারেননি?
- আমার চেনা উচিৎ ছিল?
- আলবাত চেনা উচিৎ ছিল। খুন করবেন অথচ যাকে খুন করলেন তাকে বেমালুম ভুলে মেরে দেবেন?
- যত পাগল অপোগণ্ড জোটে আমারই কপালে। আমি খুনি? বলতে লজ্জা করে না? কে রে তুই?

- রিল্যাক্স। আমি আপনার নিউ ইয়ারের হেলথ রেজোলিউশন; নিয়মিত জগিং আর পরিমিত খাওয়াদাওয়ার রেজোলিউশন। আমায় চিনতে যে পারবেন না তা বেশ জানতাম; জানুয়ারির অর্ধেক পেরিয়ে গেছে যে।

Tuesday, January 8, 2019

চুমু অ্যানোমালি

- হ্যালো হেডঅফিস!

- হ্যালো! কোন ইউনিট থেকে বলছেন? 

- দু'শো বাহাত্তর বাই এ বাই থ্রি জেড নাইন থ্রি।  

- দু'শো বাহাত্তর বাই এ বাই থ্রি জেড নাইন থ্রি? হেডঅফিসে আপনার কল তো বড় একটা আসে না...। 

- অত নরম ভাবে থাপ্পড় কষিয়ে কী হবে স্যার। সোজাসুজি বলুন আমি অকাজের। 

- না না, ও মা! আমি তেমন ভাবে বলতে চাইনি ভাই...।

- চাইবেন নাই বা কেন বলুন। বত্রিশ বছরের জীবনে আমি এই প্রথম হেডঅফিসে কল করেছি। আমি ব্রেনের রোমান্টিক-চুমু রেজিস্ট্রেশন ইউনিট, কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা মাইনর চুমুও স্মৃতি হিসেবে ফাইল করতে পারিনি মগজ হেডঅফিসের মেমরি রেজিস্টারে। খুলি-স্পেস নষ্ট করে চলেছি কেবল। 

- মনখারাপ করতে নেই ভায়া। মনখারাপ করতে নেই। তা আজ কী মনে করে? চুমু রেজিস্টার করার আছে নাকি? চুমু-রেজিস্টারে প্রথম এন্ট্রি আজ হবে নাকি?

- ইয়ে, ব্যাপারটা গোলমেলে। 

- গোলমেলে?

- অ্যানোমালি রিপোর্ট করার আছে হেডঅফিস স্যার। 

- ভাই দু'শো বাহাত্তর বাই এ বাই থ্রি জেড নাইন থ্রি ওরফে চুমু-সেন্টার। আপনি কি শিওর? চুমু নয়? অ্যানোমালি?  

- হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ঠোঁট এবং জিভ থেকে কোনও সিগনাল আসেনি। কিন্তু জানেন, আমার ইউনিট-মনিটরের সমস্ত গ্রাফ চুমুর মত লাফালাফি করেছে ঝাড়া আড়াই ঘণ্টা। একদম জিভে জিভ চুমু লেভেলের এক্সট্রিম রিপ্‌লস দেখা গেছে গ্রাফে। অবিকল স্মুচ এফেক্টস। 

- অথচ জিভ ঠোঁট থেকে কোনও সিগনাল নেই ভাই দু'শো বাহাত্তর বাই এ বাই থ্রি জেড নাইন থ্রি? আপনি?

- জিরো। চুমু রিপলস মনিটরে অথচ জিভ ঠোঁট চুপচাপ। তা না হলে আর কাঁদুনি গাইছি কেন হেডঅফিসদাদা। 

- কী মুশকিল। চুমু সেন্টারের মনিটরে চুমু-রিপ্‌লস দেখা গেছে, কাজেই মেমরি রেজিস্টারে তো এন্ট্রি করতেই হবে। এ'দিকে ঠোঁট আর জিভ থেকে কোনও সিগনালই নেই! লে হালুয়া। এন্ট্রি করব কী ভাবে। 

- ভাবুন স্যার। কী ডেঞ্জারাস ব্যাপার। এখন উপায়?

- দাঁড়ান। এরর্‌ লগ চেক করি। লাইনে থাকুন। 

- বেশ, দেখুন। 

- এই যে, পাওয়া গেছে। চুমু রেপ্লিকেটিং সিগন্যাল আপনি কোথা থেকে রিসিভ করেছেন সে'টা মালুম হয়েছে। যাক বাবা। 

- অ্যানোমালি আইডেন্টিফাই করা গেছে? মাইরি? 

- স্পষ্ট। আমাদের হিউম্যান ইউনিট আজ চুমু খায়নি তাই আপনি ঠোঁট বা জিভ থেকে কোনও সিগন্যাল পাননি। 

- তবে মনিটরে যত উত্তেজনা? স্মুচ সমান সিগন্যালস? 

- হিউম্যান ইউনিট পুরনো বইয়ের তাক সাফ করার সময় খুঁজে পেয়েছেন কলেজ জীবনের নোটের খাতা। আর সেই খাতার ভাঁজে রাখা ছিল... বারো তেরো বছর পুরনো এক জোড়া হলদেটে মিনিবাসের টিকিট আর আধ-ছেঁড়া এক জোড়া গানের অনুষ্ঠানের পাস; সুমনের গানের অনুষ্ঠানের। তো দশ বছর কলকাতার বাইরে থাকা হিউম্যান ইউনিট স্বাভাবিক ভাবেই কেঁপে ওঠেন সে পুরনো টিকিট আর পাসের কাগজ দেখে। ব্রেনের বিভিন্ন ইউনিটে এমার্জেন্সি সাইরেন ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হিউম্যান ইউনিট খামচে ধরেন সে টিকিট-জোড়া। সেই খামচে ধরাই চুমুর সিগনাল হয়ে আপনার ইউনিটের মনিটরে গিয়ে হামলে পড়ে। 

- ওহ, তাই এই অ্যানোমালি। চুমু নয়। 

- বলেন কী! এ যে রীতিমত চুমু ভাই দু'শো বাহাত্তর বাই এ বাই থ্রি জেড নাইন থ্রি ওরফে চুমু-সেন্টার! ঠোঁট আর জিভে এসে রোম্যান্স আটকে থাকবে তা কী হয়? হেডঅফিস মেমরির চুমু রেজিস্টারে আজই আপনার প্রথম এন্ট্রি হবে, কংগ্রাচুলেশনস!  

Thursday, January 3, 2019

কাহারবা নয়


রাতের বাতাসে বেশ ডিসেম্বরের ছ্যাতছ্যাত। গায়ে চাদর জড়িয়ে বসে রেডিও শুনছিলাম, মনে বেশ বৈঠকি আমেজ। টকমিষ্টি চানাচুরের কয়েক পেগ মুখে পড়তেই মান্নাবাবুর গলাটা কানে আরো মিষ্টি হয়ে ঠেকল বোধ হয়।

সমস্তই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল; দুম করে 'কাহারবা নয় দাদরা' গেল মাঝপথে থেমে। রেডিও থামেনি, বিজ্ঞাপন বিরতিও নয়৷ মান্নাবাবু গান থামিয়ে দুম করে জিজ্ঞেস করলেন;.

- কী ব্যাপার? মতিগতি ঠিক আছে?

- ইয়ে, আমায় বলছেন? (আমি তো থ)

- আর কাকে বলব শশীবাবু? বলি হচ্ছে না যে। আসর ঝুলে যাচ্ছে।

- আজ্ঞে আমি আপনার তবলচি শশী নই৷ আমি তো স্রেফ শ্রোতা, তাও রেডিওর বাইরে বসে। ওই কাহারবা দাদরার ইস্যুটা আপনি আপনার তবলচিকে কনভে করুন, কেমন?

- চোপ। যত ভুল কি তবলায়? গান শোনার ব্যাপার কি এতটাই এলেবেলে? হচ্ছে না আপনার দ্বারা, এমন বিশ্রীভাবে গান শুনছেন যে মনে হচ্ছে রেডিও থেকে বেরিয়ে এসে কান মুলে দিই।

- সর্বনাশ! আমি কী করলাম? মন দিয়েই শুনছিলাম যে। ওই যে 'গোলাপজল দাও ছিটিয়ে,  গোলাপফুলের পাপড়ি ছড়াও'...বড্ড দরদ দিয়ে ধরেছেন স্যার...আহা। খামোখা থামতে গেলেন..।

- খামোখা? বটে? এ'দিকে আপনি যে ভুল তালে চানাচুর চিবোচ্ছিলেন, সে বেলা? 

- আজ্ঞে?

- গানের তাল একদিকে, আর আপনার চানাচুর চেবানোর মচমচ যে অন্য পানে বইছে। দুনিয়াকে রসাতলে পাঠাতে আপনার মত দু'চারজন বেপরোয়া চানাচুর-চিবিয়েই যথেষ্ট। 

- তালে তালে চানাচুর চেবাবো?

- চানাচুর তৈরিই হয়েছে গানের তালে তালে চেবানোর জন্য। তাতেই গানের মুক্তি, চানাচুরের উত্তরণ। 

- আর আমি বেসুরে চানাচুর চিবিয়ে গান মাটি করছি?

- আলবাত।  সুরের ওঠা নামা অনুভব করুন, মনপ্রাণ দিয়ে। আর চানাচুরের প্রতিটি কণা সেই অনুভবে এসে মিশবে। তা না পারলে বাড়ির ওই চার ডিবে চানাচুর গঙ্গায় ভাসিয়ে আসুন। অসুরের হাতে ইয়ারবাড আর বেসুরোর মুখে চানাচুর বেমানান।

***

আমার বার বার মনে হয় যে 'কাহারবা নয় দাদরা' শুনতে শুনতে আমি হয়ত আড়াই সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে এই চানাচুর চেবানোর সুর-তাল-লয় যে ধরে ফেলেছি, তা কি মান্নাবাবুর ধমক ছাড়া হত? সুগায়কের সহশিল্পীদের মধ্যে একজন চানাচুর-চিবিয়ে-শ্রোতার গুরুত্ব অপরিসীম, তা আজ বেশ বুঝেছি। আর বেহালা শিখতে না পারার আফসোসটা কেটে গেছে, স্পষ্ট বুঝছি যে এ দুনিয়ায় বেহালাবাদকের চেয়ে গুণী চানাচুর-চিবিয়ের সংখ্যাটা অনেক কম।

Wednesday, January 2, 2019

ডক্টর মেওসজুস্কের কারখানা

- সরি, সরি মিস্টার মজুমদার। আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আসলে অ্যাসেম্বলি লাইনের একটা গণ্ডগোলে  ঘণ্টাখানেক প্রডাকশন বন্ধ ছিল, আর প্রডাকশন বন্ধ থাকলে যে কী সমস্যা। এত ডিমান্ড চারদিকে...। তা আমার আর্দালি ভুভজু আপনাকে কফি দিয়েছে তো?

- দু'কাপ শেষ করে ফেলেছি। আমি তো ভাবলাম আজ আর আপনার সঙ্গে দেখাই হবে না।

- না না, সে কী বলছেন। আপনি কলকাতার থেকে এসেছেন, আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ভারতবর্ষে আমাদের সাপ্লাই যাবে।

- আগ্রহ নিয়েই এসেছি, তবে কী জানেন ডক্টর মেওসজুস্ক, ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না ঠিক। যদিও অনেকেই আপনার এই কারখানার প্রশংসা করেছেন। আর যে জিনিস যদি জেনুইন হয় তা'হলে আর পাঁচটা জায়গার মত ভারতবর্ষেও এর চাহিদা তুঙ্গে থাকবে। কিন্তু..তবু কোথাও যেন একটা..।

- খটকা...তাই তো?  স্বাভাবিক। সরকারের হাজাররকম ত্যান্ডাইম্যান্ডাই আর অবিশ্বাস। কাজেই কালোবাজার ছাড়া এ জিনিস বাজারে ছাড়া গেল না। আর সে কারণে মাস-অ্যাওয়ারনেসের জন্য কিছুই করতেও পারলাম না। রিয়েলি স্যাড।

- তাই বলে ডক্টর মেওসজুস্ক, ভূতের কারখানা? সত্যি সম্ভব?

- রীতিমত সম্ভব। আর তার প্রমাণ এ'বারে আপনি হাতেনাতে নিয়ে যাবেন। এতদিনের এত রূপকথা, এত হাড়হিম করা গল্প; এ'বার সমস্তই রিয়ালিটি মিস্টার মজুমদার। আপনাকে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি দেওয়ার জন্য এমনি এমনি ডাকিনি, রীতিমত স্যাম্পেল দিয়ে ফেরত পাঠাবো।

- কিন্তু ব্যাপারটা হয় কী করে? আত্মাটাত্মার ব্যাপার তো শুনেছি..।

- বুজরুকি। পুরোপুরি বুজরুকি, বুঝলেন। আত্মাটাত্মা বলে কিছুই হয় না মশাই। সবই দেহ। আর ডিএনএ।   পুরো ফর্মুলাটা আপনাকে বলে দেওয়া যাবে না। সে'টা আমার নিজের পেটে লাথি মারা হবে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই বায়োটেকনোলজি আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কামাল। কারুর ডিএনএ সংগ্রহ করে,তার চারিত্রিক প্রোফাইল তৈরি করে একটা স্পেসিফিক অ্যালগোরিদমে ক্লোন করা৷ ক্লোন, কিন্তু অশরীরিরূপে।  ব্যাস, ভূত রেডি।

- জেনুইন ভূত?

- জেনুইন। এক ধরণের অমরত্ব বলতে পারেন। সে ভূত অবশ্যই চিপ আর ব্যাটারির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সে'সোলার ব্যাটারি দিনের বেলা আপনা থেকে চার্জ সংগ্রহ করে। তাদের বিনাশ নেই। এই ফ্যাক্টরিতে আমি একের পর এক অবিনশ্বর আত্মা তৈরি করে চলেছি মিস্টার মজুমদার। কড়ি ফেলে তেল মাখতে পারলে আর কাউকে এ দুনিয়া থেকে বিদেয় নিতে হবে না, অন্তত তাদের আত্মাটুকু থেকে যাবেই৷ তাদের ভূত তাদের অসম্পূর্ণ কাজগুলো শেষ করার চেষ্টা করবে, বদলা নেবে, ভালোবাসবে, ভয় দেখাবে।

- থ্রিলিং। থ্রিলিং। কিন্তু কে জানে ডক্টর মেওসজুস্ক, তবু ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আসলে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি নেওয়া তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়...হাতেনাতে ডেমোন্সট্রেশন না দেখলে...।

- প্রমাণ?

- প্রমাণ, আছে?

- আমার আর্দালি ভুভজু কেমন ভেসে ভেসে কফি দিয়ে গেল, সে'টা বোধ হয় খেয়াল করেননি,  তাই না?

- না মানে খবরের কাগজ পড়ছিলাম হয়ত, তাই ও কফি দেওয়ার সময় ঠিক...। তবে মুখটা দেখেছিলাম...সাদাটে ছিল বটে..কিন্তু...।

- এক মিনিট, এই দেরাজটা খুলে দেখাই..।

- এ'টা কী?

- এ'টা সুবিশাল ডিপফ্রিজ৷ দেখুন। ভিতরে অজস্র মমি। ডেডবডি না দেখলে ভূতকে ভূত বলে মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওই ডানদিকের বডিটা দেখুন...।

- ভু..ভু..।

- ও'ই আদত ভুভজু। ওর ভূতই আপনাকে কফি দিয়ে গেছে। এই কারখানায় তৈরি ভূত। আমার কারখানার সমস্ত কর্মচারীর দেহই এ'খানে আছে। মানুষ পোষার অনেক হ্যাপা, খরচও বেশি। কস্ট-কাটিংয়ের যুগ, বুঝতেই পারছেন।

- আর ভু..ভুভজুর পাশের... ও...ও..।

- আজ্ঞে হ্যাঁ মজুমদারবাবু, ও'টা আপনারই দেহ৷ প্রথম কফির কাপ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করেছিলাম, আর পরের কাপে বিষ ছিল। স্যাম্পেল নিয়ে না ফিরলে আপনি ভূত বিক্রি করবেন কী করে বলুন তো?