Wednesday, January 31, 2024

ভালোবাসার

ভারতবর্ষে মানুষের গড় আয়ুর হিসেবে মাঝবয়স ইতিমধ্যেই পেরিয়ে এসেছি। আজ পর্যন্ত জ্ঞানত এবং অসতর্কতাবশত (যা পরে বুঝেছি) অনেক ভুল করেছি। বেশ কিছু ভুল অন্যায়ের গোত্রেও পরে। কিন্তু আমি যে মোটের ওপর স্নেহশীল মানুষ, এ বিশ্বাস অবিচল থেকেছে৷ নিশ্চিত থেকেছি যে আমার এ বিশ্বাস আমি আত্মস্থ করেছি নিজেরই গুণে। 

কোনওদিনও; নিজের ভালোবাসতে পারার প্রতি আস্থাটুকু কাঁপেনি৷ ভালোবাসার মানুষদের জন্য প্রাণপাত করতে পারি, এই ধারণা নিজের অজান্তেই চাপা অহঙ্কার হয়ে রক্তে মিশে গেছিল। সবচেয়ে বড় কথা, সে'সব ভালোবাসার মানুষদের সামান্য কষ্টেও আমি ভেঙেচুরে পড়তে পারি; এই নিশ্চিন্দিটুকু ছিল।

অথচ। এই মাঝবয়সের এ'পারে এসে টের পেলাম যে ভালোবাসার বিশ্বাসটুকু নিজের অন্তর থেকে অর্জন করতে পারিনি৷ আমার সে বিশ্বাস লালন করেছে, আগলে রেখেছে আমার কাছের মানুষজন; যারা আমায় ভালোবেসেছে৷ তাদের ভালোবাসা, তাদের অপত্য স্নেহকে নিজের মায়া-আদর হিসেবে দেখে এসেছি চিরকাল৷ অথচ তারা যে সমস্ত দিয়ে আমায় জড়িয়ে রাখলে, তার কদর না করে "দ্যাখো আমি কতটা ভালোবাসতে পারি"; সে বিশ্বাস পোস্টারে  ছেপে কত কাল্পনিক দেওয়ালে সেঁটে গেলাম। 

হঠাৎ টের পেলাম; যাহ্, তেমন ভালোবাসতে পারলাম না৷ যারা আমায় ভালোবেসে চিরকাল চুলে বিলি কেটে গেল, তাদের তোয়াক্কা করা হলো না৷ সেই 'হঠাৎ' যে কী কষ্টের, কী দমবন্ধ করা।

আর যদি ভালোবাসায় ফেরা না হয়? 
আর যদি কেউ আমায় জড়িয়ে কাঁদতে না পারে?
আর যদি কারুর পাশে বসে বলার ধক না থাকে, "এইত্তো আমি"?
আর যদি ঘরের ওম গায়ে না লাগে?


কোথায় যাই?
কোথায়ই বা যাব।
এসেছি,
এসে পড়েছি,
তাই দুম করে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ তো নেই৷ তা'ছাড়া ভালোবাসার কত ঋণ, সে'সব ঋণ ভুলেই বা যাই কোথায়?

অতএব, যেন থাকতে পারি।
যেন বুকের মধ্যে সহজ-সরল ভালোবাসা বুনতে পারি। এদ্দিনে হয়নি। এখনও আছে তো কিছু বছর।
যেন ভালোবাসার মানুষের জন্য প্রাণপাত করতে পারি; "এই দ্যাখো ভালোবাসি" বলে নয়।  এই ভালোবাসাটুকুর বাইরে আমার আশ্রয় নেই; সে'কারণে।

আর কোনও একদিন যেন খোকাকে কাছে টেনে বলতে পারি, "খোকা, কত ভুল। কত ভুল। কত ভুল। তবু জানিস, আমি ভালোবেসেছিলাম"।

একদিন যেন পারি।
একদিন। 

মেজমামার রিটায়্যারমেন্ট



আমার মেজমামা আজ রিটায়ার করল। অবসরগ্রহণ ব্যাপারটা ভারিক্কি শোনায়। রিটায়ার করাটাও অবশ্য তেমন মোলায়েম নয়৷ যা হোক; সে প্রসঙ্গ থাক।
আমার মেজমামার মত মিষ্টি মানুষ আর হয় না। কিন্তু মামাকে নিয়েও গল্প ফাঁদতে বসিনি৷

মামার স্কুল থেকে আজ একটা "ফেয়ারওয়েল" অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল৷ সে রীতিমতো স্টেজ-টেজ বেঁধে৷ স্কুলের সমস্ত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন৷ এক্কেবারে প্রাণের উৎসব, মামাকে সবাই সত্যিই ভালোবাসে৷ নিজের মামা বলে বলছি না, ভদ্রলোকের মধ্যে মায়া ব্যাপারটা প্রচুর পরিমাণে রয়েছে৷ মামা ক্লাসে পড়াত না, কিন্তু তা সত্ত্বেও স্কুলের ছেলেমেয়েরা যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মামাকে ঘিরে ধরেছিল; দেখে বেশ গর্ব হলো৷ ছোট ছেলেমেয়েরা ভালোবাসার কাঙাল, আমার মামার মত দু'চারজন মানুষ যেন সব ইস্কুলেই থাকে। 

যা হোক। যা বলতে এই লেখা। মামা আজ রকমারি উপহার পেয়েছে৷ প্রতিটাই রিটায়ারমেন্ট ক্লিশে মেনে। আর উপহারের ছবিগুলো দেখে বারবার মনে হচ্ছিল যে ক্লিশে ব্যাপারটাকে আমরা যতই হ্যাটা করি বা ইন্টেলেক্ট ফলিয়ে ধূলিসাৎ করে দিই; আত্মার যোগ থাকলে সে ক্লিশেতেই প্রাণের আরাম। মামা কী কী পেয়েছে তার একটা লিস্ট করে রাখছি। এই ভালোবাসার ফর্দ আমার ব্লগে থাক।

১। একট রবীন্দ্রনাথের পোট্রেট, ফ্রেম করা।

২। একটা তেলরঙে আঁকা ছবি, ফ্রেম করা।

৩। ছাত্রদের আঁকা মামার পোর্ট্রেট; ফ্রেম না করা।

৪। টাইটান কোম্পানির বানানো হাত ঘড়ি, সোনালি রঙের।

৫। একটা ইলেক্ট্রনিক দেওয়াল ঘড়ি।

৬। কলম৷ 

৭। স্কেচপেনের সেট।

৮। নোটবই।

৯। বই, তিনটে। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শতরূপে সারদা, আর শ্রীমদভগবদগীতা। 

১০। একটা রেডিমেড জামা, সাদা রঙের।

১১। এক সেট জামা-প্যান্টের পিস।

১২। শংসাপত্র (ফ্রেম করা)। চমৎকার বাঙলায় ভণিতা না করে করে লেখা। আমি বার বার পড়েছি সে'টা।

১৩। সাদা শাল।

১৪। প্রচুর ফুল।

১৫। কিছু চকোলেট।

১৬। এক বাক্স সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশ। 

কোনোটাই তেমন আহামরি দামী কিছু নয়, অথচ প্রত্যেকটাই অমূল্য৷ আমার মামার মধ্যে কোথাও এতটুকুও জলমেশানো নেই, কাজেই ওই জলভরা সন্দেশের বাক্স আর যাবতীয় ভালোবাসাটুকু তার প্রাপ্যই বটে৷ 

পিকনিক

বসার ঘরে জব্বর আড্ডা জমেছে। চা-য়ের কাপে দেদার চুমুকের পাশাপাশি তেলেভাজা চেবানোর কুচুরমুচুর সিম্ফনিতে সন্ধেটা ক্লাউড নাইনে চলে গেছে (মেজকাকার ভাষায়)।

মেজকাকা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে।
বড়দা সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে।
আমি সোফার পাশে মেঝেতে থেবড়ে বসে।


বড়দা: শীত শেষ হওয়ার আগে একটা হাইক্লাস পিকনিক করা দরকার৷

মেজকাকা: এই তোর এক বাজে বাতিক পিন্টু৷ কথায় কথায় পিকনিক বা ফিস্টি।

বড়দা: আর তোমার রোগ হলো যে কোনো ভালো প্ল্যান ফাঁদতে না ফাঁদতেই মুখ ভেটকে ফুট কাটা।

আমি: এই শুরু হলো।

বড়দা: তুই কি পিকনিকের ফরে না এগেন্সটে?

আমি: আমি খাওয়াদাওয়ার ফরে। অলওয়েজ।

মেজকাকা: খাওয়াদাওয়ার জন্য মাঠেঘাটের ধুলো খাওয়ার কী দরকার। সামনের রোববার আমি বাজার করব। তারপর কোমর বেঁধে হেঁসেলে ঢুকব, তোরা দু'জনে অ্যাসিস্ট করবি।

আমি: পয়েন্ট।

বড়দা: তুই থাম বিট্টু। ভারি এলে পয়েন্ট ধরে মাতব্বরি করতে। আচ্ছা মেজকা, একটা রোব্বার না হয় একটু বাইরে কাটালে। মনের জানালা খুলে দেবে, ফ্রেশ এয়ার এসে..।

মেজকা: ন্যাকা। মনের জানালা খোলার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ইউটিউব দেখা৷ পলিউটেড হাওয়ায় ব্যাডমিন্টন খেলে, দায়সারা রান্না করে হুজুগ সেলিব্রেট করার দলে আমি নেই।

বড়দা: কে দিব্যি দিয়েছে তোমায় ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য৷ তুমি না হয় সকাল থেকে কাঠের উনুনে মাঠে বসে রান্না কোরো৷। 

আমি: পিকনিক, ঘাস-ফুল-হাওয়া, খাওয়াদাওয়া খুবই ভালো ব্যাপার৷ কিন্তু ব্যাডমিন্টন আবার কেন৷ বড্ড ধকল৷

বড়দা: সাধে কী আর বলি ভোঁদাচন্দ্র। মেজকার সেক্রেটারি হওয়া ছাড়া তোর দ্বারা আর কিস্যু হবে না।

মেজকাকা: পিন্টু৷ তুই কি বিট্টুকে ইনসাল্ট করলি না আমাকে?

বড়দা: আমি একাই পিকনিকে যাবো।

মেজকাকা: সেই ভালো৷ রোববার তুই একা মাঠে বসে রান্নাবাটি খেল। আমি আর বিট্টু সকালে চাইনিজ চেকার খেলে দুপুরে রেঁধেবেড়ে মাংসভাত খাবো।

বড়দা: ডিসগ্রেসফুল!

মেজকাকা: আহা চটছিস কেন।

বড়দা: বিট্টুটা দুধের শিশু৷ তুমি বুড়োহাবড়া। মাঝখান থেকে তোমাদের পাল্লায় পড়ে পিকনিকহীন শীত কাটিয়ে আমার যৌবন নষ্ট হচ্ছে।

আমি: হ্যাঁ রে বড়দা, এইত্তো তুই ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে দীঘা ঘুরে এলি। এসেই আবার পিকনিক?

বড়দা: জ্যাঠামো করিস না৷ একটা ফ্যামিলি পিকনিক ছাড়া শীত চলে যাওয়া ব্যাপারটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়৷

আমি: ও মেজকা৷ চলো না৷ এক রাউন্ড পিকনিক করেই আসি৷ বড়দা এত করে বলছে..।

বড়দা: মেজকাকি থাকলে তোমরা আমায় এমন একঘরে করতে পারতে না৷

মেজকাকা: ন্যাকা! মেজকাকি বাপের বাড়ি গেছে, টেঁসে যায়নি৷ আর বলছি তো..সামনের রোববার তোকে আমি মাংস-ভাত খাওয়াব।

বড়দা: ধুস৷ বাদ দাও।

আমি: বড়দা, আর এক রাউন্ড তেলেভাজা নিয়ে আসি?

বড়দা: নাহ্৷ অম্বল।

মেজকাকা: দু'প্লেট তেলেভাজা খেয়েই অম্বল? ওই যৌবন দিয়ে হবেটা কী? বুড়োদের লাফিং ক্লাব জয়েন কর।

বড়দা: অন্যায় করেছি আমি পিকনিকের কথা বলে। প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনোদিন যদি তোমাদের আমি পিকনিকের কথা বলেছি..।

আমি: বড়দা, এই প্রতিজ্ঞা তুই এর আগে অন্তত বার সাতেক করেছিস।

মেজকাকা: শোন পিন্টু, পিকনিকের প্ল্যান কষা আর সেই কষা প্ল্যানে জল ঢালা - মনে রাখিস, সে'টাই হলো হাইয়েস্ট ফর্ম অফ পিকনিক।

বড়দা: ডিসগাস্টিং। আমি আসি।

মেজকাকা: যাবি? কিন্তু আমি যে ময়দা মেখে রেখেছি। আর ময়না ডুমো ডুমো করে আলু কুচিয়ে রেখে গেছে৷ 

বড়দা: চট করে ভাজো দেখি৷ লুচি খাওয়ার পর এই কূপমণ্ডূকদের আড্ডায় আমি আর পাঁচ মিনিটও বসতে চাই না৷

Monday, January 29, 2024

ভুল-কবি

একটা ভুল-ভুল রঙের টেবিল।
একটা কেতহীন ভুল-চেয়ারে বসে সে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ভুলকবিতার খাতায় খসখস করে লিখে যাচ্ছিলেন ভুলু দাস।

"ভুল" শিরোনামের একটা কবিতা মাথায় এসেছে। (জরুরী কথাটা বলতে ভুলে গেলে চলবে না; ভুলু আজ পর্যন্ত অন্তত তেরোশো কবিতা লিখেছেন - প্রত্যেকটার শিরোনামই "ভুল")। মাথায় কবিতা এলে, ভুলেও অন্যকোনোদিকে ঘেঁষেন না ভদ্রলোক। আর ভুলুবাবুকে যারাই ব্যক্তিগতভাবে চেনে তারা জানে যে কবিতা চেপে ধরলেই কেমন নেশাগ্রস্তের মত হয়ে পড়েন তিনি।

এই কবিতার নেশাটা সাধারণত এই "না বিকেল-না সন্ধে" গোছের সময়টাতেই চাগাড় দেয়৷ তাই দিনের এ সময়টাকে কিঞ্চিৎ সমঝে চলেন  ভুলুকবি৷ আধ-বিকেল আধ-সন্ধে মার্কা এই সময়টাকে ভুললগ্ন বলাটা অত্যুক্তি হবে কি?

লেখা শেষ হতে কোনোদিন মিনিট পাঁচেক লাগে৷ কখনও পাঁচ মাস ধরে একই ভুলপদ্যে আটকে থাকেন ভুলু৷ আর ভুল-কবিতা লেখা শেষ হলেই একটা বিচ্ছিরি গ্লানি এসে গ্রাস করে ভুলুকবিকে৷ অনুভূতিটা ভারি অদরকারি কিন্তু কিছুতেই সেই গ্লানিবোধটুকুকে পাশ কাটিয়ে ভুলকবিতার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়তে পারেন না কবি।

কান্না আসে।
মায়াবোধ আসে৷
আহা, সে কী মায়া৷ যা কিছু চেনা, যা কিছু সুপরিচিত; তা সে'সবে যতই ভুলচুক-খুঁত থাক- সমস্ত কিছুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তে ইচ্ছে করে৷ পুরনো বই, ফেলে আসা বন্ধু, মায়ের গন্ধ, অঙ্কভুলের খাতা; সমস্ত কিছুকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে৷

সেই ভুল-কান্নার ঘোর কেটে গেলে সদ্যলেখা ভুল-কবিতা প্রকাশ করার দিকে মন দেন ভুলু দাস৷ ভুল-কবিতার খাতা থেকে সদ্য লেখা "ভুল" শিরোনামের কবিতার পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে  সে'টাকে দুমড়েমুচড়ে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলা। 

ভুলুবাবু ওয়েস্টপেপার বাস্কেটটার একটা নির্ভুল নাম রেখেছেন; "ভুল প্রকাশনা"। 

Sunday, January 28, 2024

বিকেলের জানালা



জানালাটার সামনে মিনিট চারেক দাঁড়িয়েছিলেন অনন্ত৷ নিরবিচ্ছিন্ন ফোকাস নিয়ে সে জানালাটাকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছিলেন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। কাঠের পাটা পর পর সেঁটে চৌকো জানালাটা মজবুত ভাবে আঁটা। ও জানালায় ঠোকাঠুকি করলেও কেউ সাড়া দেবে না।

এ জানালা চিরকাল এমন কেঠো-মড়া হয়ে পড়ে ছিল না৷ এককালে এ জানালায় জোড়া পাল্লা ছিল, নীল রঙ করা। সে পাল্লা খুললে দেখা যেত লম্বা লোহার শিক, রঙ না করা। তারে ঝোলানো সস্তা কাপড়ের পর্দা; সে'টার রঙ আর ডিজাইন ছ'মাসে ন'মাসে পালটে যেত। ওই জানালা ঘেঁষা একটা টেবিল ছিল। টেবিলের ওপর বইখাতার অগোছালো স্তুপ। অজস্র পড়ার বইয়ের আনাচেকানাচে কয়েকটা কমিক্স, দু-তিনটে গল্পের বই আর কিছু স্পোর্টসস্টার পত্রিকার কপি৷ সেই স্পোর্টসস্টার উল্টেপাল্টে দেখলে টের পাওয়া যেত পত্রিকার বিভিন্ন পাতায় নির্বিচারে ব্লেড চলেছে, উড়ে গিয়েছে বিভিন্ন ছবি। বলাই বাহুল্য, সিলেবাসের বই-খাতা -পেন্সিলবাক্সের চেয়ে কদর বেশি ছিল সেই জঞ্জালগুলোর। 

দুপুর যখন গা-ছমছমে ভাবে নিরিবিলি,  তখন একটা টিঙটিঙে স্কুলপড়ুয়া টেবিলে থুতনি রেখে নানা রকমের অদরকারি কাজ আর পড়াশোনায় মন দিত। সেই দরকচা মারা জীবনে এক্সেলেন্সের স্পর্শ বলতে ছেলেবেলার ওই বিকেলগুলোই। কমিক্স, গল্পের বই, আর খেলার পত্রিকার মধ্যে ঘুরপাক খেত অজস্র দুপুর।

কিন্তু ওই নিয়মিত দুপুর-সাধনাগুলো আদতে ছিল অপেক্ষা। বিকেলের অপেক্ষা৷ দুপুরের আলো সামান্য নরম হলেই জানালার পাল্লায় বেজে উঠবে;
টট টাক-টট টাক-টট টাক-টট টাক-টট টাক। সেই একই সুরে, রোজ : ভট্টাইয়ের ডাক৷

পিলু সে ডাক শুনে হুঠ্ করে টেবিল ছেড়ে উঠবে৷ খটাস করে জানালার পাল্লা দু'টো খুলে যাবে। ওই জানালার পাল্লা খুলে ঘরে আলো টেনে নেওয়াটাই পিলুর "আসছি, দাঁড়া" বলা। এরপর দু'টো সাইকেল কচরমচর করে সেই জানালার খোলা পাল্লার পাশ দিয়ে হুশ্ করে বেরিয়ে যাবে। ওই ম্যাজিকটুকু না ঘটলে সে জানালায় বিকেল আসত না।

অনন্তবাবু জানেন জানালার ও'পাশে বা এ'পাশে আর কেউ বিকেলের অপেক্ষায় বসে নেই৷ বিকেলও আর সে জানালায় আটকে নেই। কাজেই মিনিট চারেকের বেশি সে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানেই হয় না।

সমরদার অন্ধকার

- বড় তাড়াতাড়ি সন্ধে হলো আজ। তাই না মন্টু?

- ভরদুপুর তো সমরদা। ঘরময় রোদ্দুর।

- ওহ্।

- শরীরটা কেমন বুঝছ?

- দিব্যি।

- মন?

- ওই। সন্ধে।

- ডাক্তারবাবুকে কল দেব একটা?

- থাক৷ অবস্থা এখনও এখন-তখন নয়৷ বেগতিক টের পেলে বলব, তখন ডাক দিস।

- জল খাবে?

- মন্টু৷ কত ভুল।

- তা আছে৷ থাক না৷ ঠিকঠাক কি কিছুই ছিল না?

- কে জানে ভাই৷ ভুলগুলো বাদ দিয়ে কোনও ভাবনা আসেনা মনে৷

- মাথা টিপে দিই?

- কেমন একটা গলা-বুক দলা পাকানো জ্বালা।

- চা করে দিই?

- মন্টু৷ কী কান্না পায়।

- কাঁদো না৷ ক্ষতি কী৷ আমি আছি তো।

- তুই আছিস বটে৷ এমন আঁকড়ে আছিস, তা'তেও মনকেমন হয়।

- আমি সরে গেলে নিশ্চিন্দি? সে সুখ তোমার কপালে নেই সমরদা। তুমি আমার মেসজীবনের গার্জেন, আমি বাঁধা পড়ে গেছি৷

- তুই বড় ইউসলেস।

- কফি খাবে?

- বড় অন্ধকার রে মন্টু৷ 

- অন্ধকারই তো। সেরে যাবে সমরদা৷ দেখো। 

- সেরে যাক৷ এত অন্ধকার ভালো নয়।

- ঘুমোও একটু।

- সেই ভালো। ঘুমোই৷ তুই গল্প বল মন্টু। মেসের গল্প। বলবি?

- চমৎকার আইডিয়া। সে বহু বছর আগেকার কথা বুঝলে..শীতের রাত্রি..কলকাতা অমন গা-কাঁপানো শীত কমই পড়ে। আমাদের মেসে তখন পড়াশোনা ডকে ওঠা সিনেমা-আড্ডা জমেছে। এমন সময় হয়েছে কী...।

Monday, January 15, 2024

বান্দ্রার বান্দা



বান্দ্রা স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে স্লো বোরিভলি লোকাল ধরে যোগেশ্বেরী। ও পথে আমায় মাঝেমধ্যেই ভিড়তে হয়৷ অফিস-ফেরতা সন্ধ্যে, মারাত্মক ভিড়। সে ভিড়ের চাপ মজবুত ভাবে ঠেকিয়ে রাখতে আমার অস্ত্র হলো দশটাকার এক প্যাকেট গরম চীনেবাদাম। 

বান্দ্রা-কুর্লা কম্পলেক্স থেকে আসা শেয়ারড ট্যাক্সিগুলো এসে দাঁড়ায় স্টেশন লাগোয়া চত্ত্বরে। সে ট্যাক্সি থেকে নামতেই পেটটা বাদামের খিদেতে চিঁচিঁ করে ওঠে। দু-তিনটে ঠেলা দাঁড়িয়ে থাকে, তারা বালিতে ভাজা বাদামের সুবাস উড়িয়ে প্ল্যাটফর্মমুখী জনসমুদ্রের মধ্যে চনমন ছড়িয়ে দেয়।

হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও একটা বাদামভাজা ঠেলার সামনে না দাঁড়ালেই নয়। ও'টা আমার অভ্যাস। তারপর টুপটাপ এক-একটা বাদাম মুখে ফেলে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম নম্বর একে নেম পড়া।

কানের ইয়ারফোনে বাছাই করা গান, চোয়ালে বাদাম-চিবোনো দুলকি। গোটা ব্যাপারটা মিলিমিশে তৈরি হয় 'মিউজিক'। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে একটা ব্যাপার মাঝেমধ্যেই টের পাই; জামার ঘাম আর শরীরের ক্লান্তি ছাপিয়ে যে'টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সে'টা হলো পেল্লায় শহরের পেল্লায় বোলচাল দেখে ভেবড়ে যাওয়া। 

কলেজে ভর্তি হয়ে যখন মফস্বল থেকে কলকাতা এসেছিলাম; চোখে-প্রাণে ঝিলিক লেগে গেছিল। এত এত মানুষ, ইয়াব্বড় বড় রাস্তাঘাট,  বিশাল বিশাল বাড়িঘরদোর। ঘিঞ্জি অথচ পিলে চমকে দেওয়া। সে ঝিলিক আজও ফিকে হয়ে যায়নি। তারপর এ শহর থেকে ও শহর তো নেহাৎ কম হলো না। কিন্তু এ বয়সেও শহুরে ভীড়ের বহর দেখলে পিলে চমকে ওঠে। মুগ্ধ হই, অল্পবিস্তর ভয়ও টের পাই৷

শহর ব্যাপারটাই বড্ড মায়ার। অথচ কোনো শহরেই আমার পাড়া নেই। স্রেফ মানুষজনের ভিড়ে, রাস্তাঘাটের হইহইরইরইতে আর ট্রেন-বাসের দৌড়ঝাঁপে আমার মুগ্ধতা আছে৷ আর আছে বিষণ্নতা।