Wednesday, July 17, 2024

শিকারি



ক্যাম্পের বাইরে স্টোভের ওপর ছোট্ট সসপ্যানে স্যুপ চাপানো হয়েছে৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই ডিনার রেডি হয়ে যাবে, সঙ্গে থাকবে শহর থেকে বয়ে আনা পাউরুটি৷ মন্টু মণ্ডল মন দিয়ে বসে জোনাকি গুনছিলেন৷ জঙ্গলি বাতাসে বেশ একটা মিঠে ভাব, গরমের অস্বস্তি একেবারেই নেই৷ খাবারদাবার সেরে তবেই তাঁবুর ভিতর ঢুকে লম্বা হবে, তেমনটাই ইচ্ছে৷

ঠিক সেই সময়ই আমি তাঁর সামনে ঝুপ করে নামলাম৷ আপনার ভাবছেন কোথা থেকে নামলাম৷ ভূতেরা এমনিই নামতে ওপরে, তেনাদের কোনো মাচা, ব্যালকনি বা গাছের ডালের দরকার হয় না৷ ঝুপ করে নেমে আসাটাই আমাদের বিশেষত্ব৷ বলাই বাহুল্য মন্টুবাবু আমার উপস্থিতি টের পাননি। জঙ্গলে এসে মানুষ জন্তুজানোয়ার, গাছপালা, পোকামাকড় নিয়ে এমন শশব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ভূতটূত নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না৷ ভদ্রলোক আদেখলার মত তখন থেকে জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ এ'সব নেচারলাভারদের দেখলে গা-পিত্তি জ্বলে যায়। অবশ্য আমার গা না পিত্তি কোনোটাই আর নেই, আছে শুধু ঝুপ করে নেমে আসা।

আপনার হয়ত ভাবছেন মন্টু মণ্ডলকে আমি কী'ভাবে চিনি। তা'হলে বলি, আমি সমর, মন্টু মণ্ডলের বাড়িতে বছর সাতেক রান্না করেছি৷ ব্যাচেলর শৌখিন মানুষ; খেতেন কম, কিন্তু সমঝদার। তাঁর সঙ্গে গপ্প করে আর তাঁকে খাইয়ে দেদার সুখ৷ আমার রান্নার কদর করতেন আর আমায় বড় স্নেহ করতেন। সে স্নেহের সুযোগ নিয়ে নিয়মিত তার পকেট থেকে টাকাপয়সা সরিয়েছি৷ শেষের দিকে ভদ্রলোকের শখের অ্যান্টিক সংগ্রহ থেকে ছোটখাটো মালপত্তর তোলা শুরু করেছিলাম, ও ব্যাপারে আমার বিশেষ জ্ঞানগম্যি ছিল৷ মন্টু মণ্ডল লোক ভালো, তার ওপরে বেজায় পয়সাওলা৷ ছোটখাটো হাতসাফাই বছরের পর বছর চালিয়ে গেলাম কিন্তু সে'সব তার নজরে পড়লো কই৷ শেষে যখন মোগল আমলের নীলাটা সরালাম, তখন আর ভদ্রলোকের চোখের ঠুলির ওপর ভরসা করতে পারিনি৷ তা'ছাড়া ও জিনিস বেচে আমার পকেটে অন্তত সোয়া লাখ টাকা আসত,  মাস ছয়েক দিব্যি ফুর্তিতে কাটিয়ে দেওয়া যেত৷ তারপর দেখেশুনে আর এক পিস মন্টু মণ্ডল খুঁজে নিলেই হলো৷ 

কিন্তু কপালের ফের, মাঝরাত্তিরে মন্টুবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড়জোর দু'দশ পা গেছি, একটা পেল্লায় ট্রাক এসে পিষে দিয়ে বেরিয়ে গেলো৷ সেই থেকে এ জঙ্গলে এসে আস্তানা গেঁড়েছি৷ দু'দিন ধরেই বাতাসে মন্টু মণ্ডলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সে গন্ধের টানে গতকাল থেকে হন্যে হয়ে ঘুরছি, কিছু একটা যেন আমায় টানছিল৷ এখন মন্টুবাবুকে দেখে বুঝছি এ টান কীসের৷ ভদ্রলোকের অনামিকার আঙটিতে উজ্জ্বল হয়ে বসে আছে সেই নীলাটা যে'টা নিয়ে আমি ফস্কে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম৷ ও'টার দিকে তাকিয়ে থেকেও তৃপ্তি৷ আহা৷ 

ভদ্রলোক এ'বার সসপ্যানের ঢাকনা সরাচ্ছেন, স্যুপ হয়ে এলো বোধ হয়। 

ও'দিকে মন্টুবাবু ততক্ষণে পরিতৃপ্ত। তার জঙ্গল অভিযান সফল হতে চলেছে৷ দু'দিনেও সাড়া না পেয়ে হতাশ হতে শুরু করেছিলেন। সমর তাঁকে চিরকাল বোকা ঠাউরে গেল। একশো-দুশো টাকা নিয়মিত সরিয়ে আর দু'একটা পুরনো অ্যান্টিক সরিয়ে সে ভেবে বসলে যে তার মালিক কানা। এ'দিকে মালিকের যত টাকাপয়সা আর জমিদারি সবই যে ভূত তৈরি করে আর ডার্ক ওয়েবে ভূত বেচে; সে'টা যদি মূর্খ সমর বুঝতো। আর রাঁধুনি ভূতের যা দর, এই একটি বেচেই বছর পাঁচেক নিশ্চিন্দি৷ তদ্দিনে নতুন রাঁধুনি ব্যাটা তৈরি হয়ে যাবে জবাইয়ের জন্য৷ 

মিষ্টি হেসে সসপ্যানের ঢাকনাটা সরালেন মন্টু মণ্ডল৷ পাতি লোক বা খেলো ভূত কী করে বুঝবে যে এই সসপ্যান আদতে ঘোস্ট ক্যাচার?

(ছবি: জেমিনাই)

লেখার ভূত



বারো বাই দশ ফুটের ঘর৷ আসবাবপত্র বলতে একটা দেওয়াল জোড়া কাঠের বুকশেল্ফ, তা'তে বইপত্র এমনভাবে ঠাসা যে বাড়তি আর একটা পত্রিকাও গুঁজে রাখা যাবে না বোধ হয়। একটা স্টাডি টেবিল, তা'র ওপরে আর এক প্রস্থ বইয়ের স্তুপ৷ সঙ্গে দু'চারটে ডায়েরি, একটা রাইটিং প্যাড আর একটা সস্তা কলমে ভর্তি বাহারে পেনস্ট্যান্ড। টেবিলের পাশেই একটা ভারিক্কি চেহারার চেয়ার৷ ঘরের অন্যদিকে ছোটখাটো একটা সোফা, তার সামনে লাগসই সেন্টার টেবিল৷ সেন্টারটেবিলের ওপরেও কিছু বই৷

বেশিরভাগ বইই পুরনো, সেই পুরনো বইয়ের দলা-পাকানো গন্ধটা নির্মল দাসের মন্দ লাগছিল না৷ নির্মলবাবুর বয়স সত্তর পেরিয়েছে, মাথার চুল আশি শতাংশ পাকা। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি নড়বড়ে হয়নি আদৌ৷ তিনি খেয়াল করেছেন যে ঘরের সমস্ত বইই ফিকশন, সত্তর শতাংশ ইংরেজি৷ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সেই সোফায় গিয়ে বসলেন নির্মল। 

মিনিট দশেকের মাথায় সুবিমলের ডাকে চিন্তার সুতো ছিঁড়লো নির্মলবাবুর।

"মিস্টার দাস"?

"নমস্কার সুবিমল", সোজা হয়ে বসলেন নির্মল৷ 

"ব্যস্ত হবেন না"৷ সেন্টার টেবিলের নীচেই একটা ছোট বসার টুল ফিট করা ছিল। সে'টা টেনে নিয়ে সোফার উলটো দিকে বসলেন সুবিমল।

"আপনি চা খেয়েছেন নির্মলবাবু"?

"আপনার হাউসহেল্প অফার করেছিল৷ কিন্তু চা-কফির পাট আমি অনেকদিন তুলে দিয়েছি, তাই..."।

" আপনি কি জানেন আপনাকে আমি কেন ডেকেছি"?

"সুমিত আপনার সেক্রেটারি ছিল৷ কাজেই সে সম্বন্ধে যদি কিছু.."।

"সুমিত আপনার ছেলে বলে বলছি না৷ ওর মত এফিশিয়েন্ট মানুষ আমি খুব কম দেখেছি৷ আর হি ওয়াজ লাইক মাই ওয়ার্কিং পার্টনার৷ আমি কোনোদিনই ওকে নিজের সেক্রেটারি হিসেবে দেখিনি। নির্মলবাবু, ওর এই অসময়ে মৃত্যুটা.."।

"একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি সুবিমল"?

" হ্যাঁ, প্লীজ। বলুন না"।

"আপনি নিজে লেখক৷ এতগুলো বেস্টসেলার আপনার। অথচ এই ঘরের এতগুলো বইয়ের মধ্যে আপনার লেখা কোনো বইই রাখা নেই৷ কেন"?

"এ'টা আমার ফর্ট্রেস অফ সলিচুড বলতে পারেন৷ চারদিকে আমার প্রিয় বই৷ নিজের লেখা বই আমি নিজে তেমন পড়িনা৷ সে'সব ওই  বইয়ের দোকানের সাজানো শোকেসে দেখতেই ভালো লাগে"।

"হিউমিলিটি"।

"আমি সত্যিই নগন্য"।

"কী প্রয়োজনে আপনি ডেকেছিলেন যেন"?

"নির্মলবাবু৷ এই চেকটা আপনাকে দেওয়ার ছিল"।

"আর কেন। সুমির শ্রাদ্ধের সময়ও তো..এর আগেই তো আপনি অনেক দিয়েছেন৷ আই অ্যাম ভেরি গ্রেটফুল"।

"ও'রকম ভাবে বলবেন না৷ কতটুকুই বা দিয়েছি। এ'টাও সামান্যই৷ সুমিত ডিজার্ভড মাচ মোর"।

"শুধু এই চেক দিতে আপনি আমায় ডেকেছিলেন সুবিমল"?

"নির্মলবাবু৷ হয়ত একটা ব্যাপার আপনি জানেন না..সে'টা.."।

"সুমিত আপনার হয়ে গোস্ট-রাইট করত। বইগুলো আপনার নামে ছাপা হলেও সে'লেখাগুলো আপনার নয়"।

" ওহ। সুমিত কথাগুলো আপনাকে বলেছে? আমরা কিন্তু রীতিমতো একটা কনফিডেনশিয়ালিটি এগ্রিমেন্ট সই করেছিলাম। সুমিত এ ব্যাপারটা যদি আপনাকে জানিয়ে থাকে তা'হলে সে'টা মারাত্মক একটা ভায়োলেশন.."।

"সুমিত আমায় জানায়নি৷ কিছু মনে করবেন না সুবিমল, সুমিত মারা যাওয়ার পর আপনি যখন আমার বাড়িতে এলেন। আপনার চোখেমুখে আমি আতঙ্ক দেখেছি; স্বজন হারানোর দু:খ নয়৷ আর সুমিত যেহেতু সেক্রেটারি হয়েও ওয়ার্ক ফ্রম হোম বেশি করত আর সে কাজটার সিংহভাগ জুড়েই লেখালিখি; খানিকটা আন্দাজ আমি করেই ছিলাম৷ আমি সুমিতের বাবা আর শিক্ষক; দুইই৷ সুমিত সাহিত্যটা আমার কাছেই শিখেছে৷ ওর লেখার স্টাইল আমার জানা৷ আর আপনার বেস্টসেলার গুলো সমস্তই আমার পড়া৷ সুবিমল, অঙ্কটা বুঝতে আমার খুব অসুবিধে হয়নি"।

সুবিমল খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন৷ বৃদ্ধ নির্মল অল্প সময়ের জন্য চোখ বুজলেন৷ সুমির চলে যাওয়াটা তাকে বড় ভেঙে দিয়ে গেছে৷ বাপ-ব্যাটার সংসার, সে'টাও টিকল না৷ 

"নির্মলবাবু। এ নিয়ে আপনি হইচই বাঁধিয়েও তেমন কিছু করতে পারবেন না৷ আর নিতান্তই যদি জলঘোলা করতে চান, ফল সুবিধের হবে না"।

"সুবিমল। সুমিতের কথার খেলাপ আমি করব না৷ এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। তা'ছাড়া ভালো লিখে লেখক হওয়ার যুগ তো আর নেই৷ ফিনান্সিয়াল রিসোর্স, পিআর মাসল ইত্যাদি না থাকলে বেস্টসেলার বেরোবে কী করে। অতএব, আপনার সিক্রেট অক্ষত থাকবে, সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন৷ এর জন্য যদি কিছু সইসাবুদও করতে হয়..."।

"থ্যাঙ্কিউ নির্মলবাবু৷ আমার উকিল সামনের সপ্তাহে আপনার বাড়ি গিয়ে কাগজপত্রের ব্যাপারটা বুঝিয়ে আসবে৷ আর মাসে-মাসে এই চেক আপনার বাড়ি পৌঁছে যাবে। প্লীজ না বলবেন না"।

"হুম"।

"আর একটা বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার ছিল৷ বলতে পারেন রিকুয়েস্ট"।

" বলুন"।

"আমার একটা নভেল প্রকাশককে আগামী হপ্তার মধ্যে দেওয়ার কথা৷ থ্রিলার। প্রকাশকের পীড়াপীড়িতেই ও জিনিসে হাত দেওয়া হয়েছিল৷ নয়ত আমি..মানে..সুমিত রোম্যান্টিক লেখাতেই স্বচ্ছন্দ ছিল। তবে থ্রিলার লেখার সুযোগ পেয়ে ও নিজেও বেশ এক্সাইটেড ছিল৷ আমার ধারণা লিখেও ফেলেছিল৷ হয়তো ওর বাড়ির কম্পিউটারে কোথাও...। কিন্তু আমায় মেল করার আগেই এই.."।

"ওর কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড আমার জানা আছে৷ ও লেখা আমি খুঁজে আপনাকে পাঠিয়ে দেব"।

সুবিমল বিহ্বল হয়ে নির্মল দাসের হাত টেনে ধরলেন৷ 

"আমি যে কী বলে আপনাকে.."।

বৃদ্ধ নির্মল এই হঠাৎ-আবেগকে তেমন পাত্তা দিলেন না৷ 

বেরোবার মুখে সুবিমল ঢিপ করে একবার নির্মলকে প্রণাম করে নিয়ে বললেন, "নির্মলবাবু, সুমিত সত্যিই প্রতিভাবান লেখক ছিল। ব্রিলিয়ান্ট। বাবা হিসেবে আপনার গর্ব হওয়া উচিৎ"।

ফ্যাকাসে মুখে খানিকক্ষণ সুবিমলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন নির্মল দাস৷ কী বলবেন তিনি? জানিয়ে দেবেন যে সুমির কোনোদিনই ক্ষমতা ছিল না পাতে দেওয়ার মত কিছু লেখার? মা-মরা ছেলের বিদঘুটে সব শখ আর দ্যাখনাইয়ের যোগান দিতে বৃদ্ধ পিতাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলের হয়ে নিজের লেখাকে বিক্রি করতে হয়েছিল এক বেস্টসেলার ব্যবসায়ীর কাছে? অবশ্য সে বিক্রির টাকার এক কানাকড়িও কোনোদিন চোখে দেখননি তিনি৷ সুমিটা দিন দিন বড্ড নির্মম আর অর্থ পিশাচ হয়ে উঠেছিল। সুমি মারা যাওয়ায় ভেঙে পড়েছেন বৃদ্ধ পিতা৷ কিন্তু বুকপকেটের পেল্লায় চেকটা তার ভিতরের লেখক সত্ত্বাটাকে খানিকটা হলেও স্বস্তি দিল৷

"আসি" বলে বেরিয়ে পড়লেন নির্মল।

(ছবি: মেটা)

Tuesday, July 16, 2024

দত্তবাবুর মুক্তি



- গুড মর্নিং।

- আরে আপনি, আসুন। আসুন।

- তৈরি হয়ে নিন মিস্টার দত্ত৷

- মানে?

- মানে আপনার মুক্তি আসন্ন। আপনার সরকারের সঙ্গে আমাদের হাইকমান্ডের সমঝোতা হয়ে গেছে।

- ওহ্‌।

- এ'বার অন্তত আর অমন গোমড়া মুখে থাকবেন না।

- নাহ্‌৷ মানে ঠিক, বিশ্বাস হচ্ছে না...। গত সাতটা মাস এমন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কাটলো..। তবে এজেন্ট রস। আপনাকে ধন্যবাদ না জানালে চলবে না৷ এই অন্ধকারের মধ্যেও আপনি দিব্যি বন্ধুর মত পাশে ছিলেন।

- তৌবা তৌবা মিস্টার দত্ত৷ আপনাকে যে টেররিস্টের দল কিডন্যাপ করেছে, আমি তাদের কম্যান্ডার। আমায় বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিজেকে ছোটো করবেন না৷

- এজেন্ট রস। আমি কিন্তু আপনার মধ্যে একজন ভালোমানুষকে দেখেছি৷ এই ক'মাসে চাইলে আপনি আমার ওপর অকথ্য অত্যাচার করতে পারতেন। এ'সব না করে আপনি আমার সঙ্গে দু'বেলা গল্পগুজব করেছেন৷ দাবা খেলেছেন৷ আমার বউ-মেয়ের খবর পৌঁছে দিয়েছেন নিয়মিত। আর সবচেয়ে বড় কথা অন্য কেউ আমার ওপর তম্বি করতে এলে তাকে ঠেকিয়ে রেখেছেন।

- মিস্টার দত্ত। আপনাদের খাতার আমায় টেররিস্ট বলে দাগিয়ে দিয়েছেন বটে। হয়তো সে'টা নেহাৎ ভুলও নয়। তবে কী জানেন, যাই হই, পেটি মার্সিনারি তো নই। অসহায় বন্দীকে খুঁচিয়ে আনন্দ আমি কোনোদিনই পাইনি৷ আর আপনি তো গুণী মানুষ।

- আই মাস্ট সে, আপনার হাতের রান্নাও কিন্তু এ-ক্লাস৷ নয়ত আপনাদের ক্যাম্পের লপসি খেয়ে সাত মাস টানতে পারতাম না৷

- তৈরি হয়ে নিন৷ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ মিনিট দশেকের মধ্যে রওনা হবো।

- এজেন্ট রস৷ এইবারে অন্তত আপনার আদত নামটা যদি..।

- ব্যাপারটা গোপন রাখায় আমার তেমন স্বার্থ নেই দত্তবাবু৷ তবে আমাদের সম্পর্ক এই সাত মাসেরই ছিল৷ এজেন্ট রস আর মিস্টার দত্তের বাইরে নিজেদের টেনেহিঁচড়ে এনে কী লাভ৷ নিন, ক্যুইক৷ এ'সব ব্যাপারে দেরী করলে চলবে না৷ আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি৷ রেডি হয়ে হাঁক পাড়লেই চলে আসবো।

- এজেন্ট রস। থ্যাঙ্কিউ৷

- হুঁ। আমি আসি..।

- আপনার গ্রামের নামটা ইউসজ্বেক, তাই না?

- নামটা বেশ গোলমেলে। আপনি মনে রেখেছেন, ভালো লাগলো।

- সে'দিন আপনি ঠিকই বলেছিলেন রস। এ যুগে দাঁড়িয়ে ও গাঁয়ের মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, এই অন্যায় বরদাস্ত করা যায় না৷ একটা কথা দিয়ে যাচ্ছি; এর বিহিত এ'বার আমরা করবই৷ ফিরে যাই একবার৷ কোনো ট্যাঁফোঁ শুনছি না৷ সরকারের থেকে এ জিনিস আমি আদায় করবই৷

- থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার দত্ত৷ আপনি মানুষটা বড় ভালো। মেয়েদের স্কুল একটা হলে, গাঁয়ের মানুষের সত্যিই মঙ্গল হবে৷

- আপনার সঙ্গে হয়ত আর কখনও দেখা হবে না৷ কিন্তু আগামী একবছরের মধ্যে আপনার ছোট্ট দুই মেয়ে স্কুলে যাবে৷ কথা দিলাম৷

- রেডি হয়ে নিন৷

- আপনার থেকে একটু এক্সাইটমেন্ট আশা করেছিলাম কিন্তু৷ প্রগ্রেসের দাবীতেই তো আপনারা লড়াইয়ে নেমেছেন, তাই না?

- মিস্টার দত্ত। আপনাদের কিছু বোমারু বিমান গতকাল আমাদের ও'দিকের অন্তত দশখানা গ্রামকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে গেছে। হাইকম্যান্ড তারপরেই রণেভঙ্গ দেবে ঠিক করেছে৷ কেউ যদি বেঁচেই না থাকে, তবে প্রগ্রেস কাকে ছোঁবে।আর এই অসম লড়াই কহাতক টানা যায়৷ জানেন, আমাদের গাঁ-খানাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ আমার বউ আর মেয়ে দু'টোও এ যাত্রা আর বাঁচল না।

- এজেন্ট রস!

- তবে কিছু বাচ্চা মেয়ে এখনও পুড়ে ছাই হয়ে যায়নি৷ পারলে সরকারবাহাদুরকে ধরেবেঁধে স্কুলটা বানাবেন৷ কেমন?

- আমি..আই অ্যাম সরি।

- এ'বারে মুক্তি মিস্টার দত্ত৷ কঙ্গ্রাচুলেশনস টু ইউ অ্যান্ড ইওর গভর্নমেন্ট৷

গুপ্তর দীঘাযাত্রা

- গুপ্ত, শনিবারে একটা জরুরী পার্ফর্ম্যান্স রিভিউ মিটিং রেখেছি। আর রোববার দুপুরে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আইসব্রেকিং ইন্টার্যাকশন ফলোড বাই বিজনেস লাঞ্চ। বি প্রিপেয়ার্ড।

- সে কী স্যার, আমি যে প্ল্যান করে বসে আছি দীঘা যাব। দীঘার দীর্ঘ প্রিপারেশনও চলছে।

- দীঘা যাবে? কেন?

- সমুদ্র। মাছ ভাজা। সামান্য ইয়ে-পান। ওই একটু গানশোনা। একটু বই পড়া। প্লাস খানিকটা গড়িমসি।

- আরে, উইকেন্ড ওয়েস্টার্ন কনসেপ্ট; ওই সব করতে গিয়েই তোমরা বখে যাচ্ছ। এরচে' বরং পঞ্জিকা ধরে উপোষ করলে রক্ত পরিষ্কার হত, মনমেজাজ চাবুক হত।

- কিন্তু স্যার, ওয়ার্কলাইফ ব্যালেন্স বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি...।

- ফের ওয়েস্টার্ন কনসেপ্ট। গীতায় আছে কি ওয়ার্কলাইফ ব্যালেন্স ফ্রেজটা?

- ভেবে দেখলে স্যার, রিভিউ মিটিং ব্যাপারটাও কিন্তু ঘোরতর ওয়েস্টার্ন ইয়ে। কী নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছেন বলুন, আর কীই বা নিয়ে যাবেন। সবই যখন ফাঁকি, তখন কীসের রিভিউ, কীসের মিটিং।

- কর্মযোগ তো মিছে নয় ভাই গুপ্ত। সে কনসেপ্ট তো ঘোরতর দিশি।

- দিশি মত তো এ'টাও বলছে স্যার, কাজ করে যাও। ফলের আশা কোরো না। প্ল্যানিং মিটিং হলে তাও ভেবে দেখতাম, কর্মের ব্যাপারে মাথা ঘামানো স্বাস্থ্যকর। কিন্তু পার্ফর্ম্যান্স রিভিউ মানে তো ফলের গুণ-বিচার। সে যে ঘোরতর ভাবে ওয়েস্টার্ন ব্যাপার স্যার। আর ক্লায়েন্টকে বিজনেস লাঞ্চে না ডেকে বিজনেস উপোষ সাজেস্ট করুন। রক্ত পরিষ্কার হবে। রক্ত চুষে খেতে হলে তা ফিল্টার করে নেওয়াই ভালো।

- গুপ্ত। তুমি দীঘা যাও, বুঝলে। খামোখা কথা বাড়িয়ে কাজ নেই।

ডেডলাইন

একটা দু'মিনিটের কাজ। কোনও জটিলতা নেই। গোলমাল নেই। ফস করে সেরে ফেললেই হলো। অথচ হচ্ছিল না। "এই দু'মিনিটের কাজ তো। তা'ছাড়া ওই দু'মিনিটের সাবমিশন ডেডলাইন ধারেকাছে নেই, হাতে অঢেল সময়"।

এই মিটিং, সেই প্রেজেন্টেশন, অমুক মেমো, তমুক প্রপোজাল; কাজের মধ্যে রে-রে মেজাজ থাকতে হবে, টার্গেট ফেল হলেই গিলোটিন গোছের জৌলুস থাকতে হবে। তবেই না তৃপ্তি। অতএব সেই এলেবেলে দু'মিনিট দিনের পর দিন আড়ালেই পরে রইল।

কিছুদিন নির্বিবাদে কেটে যাওয়ার পর। আচমকা একদিন মাঝরাতের কাছাকাছি পৌঁছে, বাড়ির বিছানার নিশ্চিন্দিতে সে দু'মিনিটের দায়ের কথা মনে পড়লো। "নাহ্, আর ফেলে রাখলে চলবে না। আগামীকাল অফিস পোঁছেই..."। ডেডলাইনটা কবে যেন? মনের মধ্যে মৃদু সন্দেহ দেখা দিল। মোবাইলে ইনবক্স খুলে যাচাই করলাম, আজ মাঝরাত্তিরের আগে সাবমিশন না করলে দু'মিনিটবাবু ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাবেন। ঘড়িতে দেখলাম ০০ঃ০০ঃ০০ হতে আর বড়জোর মিনিট পাঁচেক।

তড়াং করে বিছানা ছেড়ে প্রায় উড়ে পৌঁছে গেলাম পাশের ঘরে রাখা ল্যাপটপের কাছে। কর্পোরেট এক্সেলেন্সের নিয়ম মেনেই দেখলাম ল্যাপটপে চার্জ নেই। চার্জার রয়েছে অন্য ঘরে। দে ছুট। দে ওয়াপস ছুট। হাতে তখন মিনিট চার। এক মিনিট চার্জ না খেয়ে ল্যাপটপ মিউমিউ করবে না।

অবশেষে যখন ল্যাপটপ খুলে সাবমিশন হলো, তখন দেখলাম রাত বারোটা বাজতে সাত সেকেন্ড বাকি। ভেবে গর্ব হলো যে দু'মিনিটের সরল সিধে কাজেও কেমন রক্তারক্তি জৌলুস যোগ করেছি। এই না হলে প্রোডাক্টিভিটি। বাড়ির লোকজন জানলে কী'রকম আহার-নিদ্রা-পাশবালিশআরাম ত্যাগ করে কোম্পানির সমস্ত বোঝা কাঁধে নিয়ে আমার পথচলা। মাঝরাত্তিরেও আমার মুক্তি নেই।

পার্কিনসন্স ল যে কী নির্মম আর কী নির্ভুল।

পুরনো ট্রেনের টিকিট আর মুম্বইয়ের বৃষ্টি



অফিস ব্যাগের মধ্যে ছাতা৷
ছাতার পাশে দু'খোপের টিফিনবাক্স৷
টিফিনবাক্স ঘেঁষে অফিসের আইকার্ড৷
আইকার্ডের ফিতেয় জড়ানো মানিব্যাগ।
মানিব্যাগে একটা পাঁচশো টাকার নোট দু'টো দুশো, আর তিনচারটে দশ-কুড়ির৷ কিছু খুচরো পয়সা৷ খানকয়েক কার্ড; ডেবিট, ক্রেডিট, আধার ইত্যাদি৷ কোনো এক ফোঁকরে একটা সাতপুরনো ট্রেনের টিকিট৷ বিবর্ণ, ছাপা অক্ষরগুলো এখন আর পড়া যায় না৷

বছর কুড়ি আগে ও'টিকিট এক অন্য মানিব্যাগে ঠাঁই পেয়েছিল৷ তা'তে ছিল বড়জোর চল্লিশ টাকা৷ আর কলেজের আইকার্ড৷ অদরকারি নানারকমের খুচরো কাগজে ঠাসা৷ সেই মানিব্যাগ ছিল পিঠে ঝোলানো প্যারাশুট কাপড়ের ব্যাগে৷ সে ব্যাগের মধ্যে জলের বোতল, দু'টো বই, খাতা-কলম। আর ছাতা৷

আজকের মতই, সে'দিনও বৃষ্টি ছিল, তাই টিকিটের মানিব্যাগে আর মানিব্যাগের পিঠের ব্যাগে চালান হওয়া৷ আজকের মতই, সে'দিনও ব্যাগ থেকে ছাতা বেরিয়ে আসেনি৷ কারণ দু'টো। প্রথমত, ছাতা খুলতে হওয়া পরাজয়, এ'টা কে কবে মজ্জাগত দিয়ছিল কে জানে৷ দ্বিতীয়ত, ভেজা ছাতার ছেয়ে বিশ্রী বোঝা আর কিছু হয় না৷

এই ক’বছরে কত দরকারি কাগজ, ডেবিট কার্ড, টাকা, জরুরী কত কিছু অবলীলায় হারিয়ে গেল। অথচ কোনো অদ্ভুত মন্ত্রবলে সে রেলের টিকিট টিকে রইল৷ কত মানিব্যাগ পেরিয়েও সে টিকিটের বিবর্ণতা এখনও উজ্জ্বল।

অব্যবহারের ছাতার মতই ও টিকিট এখন বুকে ভরসা জোগানো মাদুলি৷

মহাবিপদ



মরে গিয়ে মহাবিপদে পড়েছি বুঝলেন। এর চেয়ে বেঁচেই ভালো ছিলাম। বড়জোর অফিসে বড়সাহেবের আর বাড়িতে বৌয়ের মুখচোপা শুনতে হত দিনে দু-তিনবার। এ'ছাড়া ছিল নানারকমের ভয়; ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম ফেল করা, সেলস টার্গেট ঝুলে যাওয়া, কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া; আরো কত কী। কিন্তু মরার পর থেকে দেখছি দুশ্চিন্তা হাজারগুণ বেড়ে গেছে। রক্ত নেই, রক্তচাপ বাড়ছে। হৃৎপিণ্ড নেই অথচ বুকের মধ্যে ধড়ফড়। মহামুশকিলে পড়েছি। এ'বার একটু খোলসা করে বলি।

গতকাল রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ দু'পেগ হুইস্কিতে ভেসে আমাদের সাত তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে একটু দরদ দিয়ে গান ধরেছিলাম, "আমি যে জলসাঘরে"। দরদের ফোর্সটা একটু এ'দিক ও'দিক হয়ে গেল; কী'ভাবে যেন আমি ব্যালকনির রেলিং টপকে এক্কেবারে সোজা গিয়ে পড়লাম অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সুইমিং-পুলসাইডে। পুল-ভিউ ফ্ল্যাট কেনার এ'টা একটা বাড়তি সুবিধে, এই ধরণের দুর্ঘটনায় বেশ একটা সিনেম্যাটিক মাত্রা যোগ হয়।

ব্যাপারটা যা দাঁড়ালো; জলসাঘরের মেজাজ আর হুইস্কি মিলে কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি। যা হোক, এমন রক্তারক্তি একটা ব্যাপার ঘটে গেল; থানা-পুলিশ তো হবেই। ইন্সপেক্টর গুপ্তর মনের মধ্যে একটা অদম্য গোয়েন্দা বাস করে। বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি ওর মগজের মধ্যে ঢুকে দেখে এসেছি; সে'খানে আগাথা ক্রিস্টি আর আর্থার কনান ডয়েলের মাদুর পেতে পাশাপাশি বসে গল্পগাছায় ব্যস্ত। অতএব পেশায় ইন্সপেক্টর আর শখে গোয়েন্দা গুপ্তবাবু যে একটা সাদামাটা ব্যাপারকে সহজেই গুলিয়ে দেবেন, সে'টাই স্বাভাবিক।

মিনিট দশেক পায়চারী করে ইন্সপেক্টর গুপ্ত ঘোষণা করলে, "এ'টা যে দুর্ঘটনা সে'টা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না৷ আত্মহত্যা হতে পারে। এমন কী, খুনও হতে পারে"। আমার শ্যালক অমিয় সে'দিন সন্ধ্যে থেকে আমাদের সঙ্গেই ছিল, আমার গ্যাঁটের টাকায় কেনা হুইস্কি যতটা পেরেছে গিলেছে। বলাই বাহুল্য অমিয় ছোকরাটি হাড়বজ্জাত। কথায় কথায় বড় বড় বাতেলা এ'দিকে কাজের বেলায় লবডঙ্কা। ফিউশন রেস্টুরেন্ট চালানোর নাম করে বাপ-ঠাকুর্দার জমানো টাকাগুলো জলে দেওয়াটাই ওর প্যাশন। ইন্সপেক্টর গুপ্ত যেই বলেছে, "খুন", অমনি সে দুলে-দুলে সায় দিলে, "মার্ডার। মাই গড! জামাইবাবুর এলেম আছি মাইরি দিদি, মার্ডার হয়ে গেল? বিগ ব্রাদার দীনবন্ধু আইচ, তোমার এলেম আছে। আমাদের ফ্যামিলির জামাইদের মধ্যে ডাক্তার আছে, রঞ্জি খেলা ক্রিকেটার আছে, কিন্তু মার্ডার হওয়া কেউ এদ্দিন ছিল না৷ হোয়াট আ ডে। উই শুড অল বি প্রাউড"!

ও'দিকে আমার বৌ নীলা আপ্রাণ চেষ্টা করছিল একটু কান্নাকাটি করার। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছিল না। একটু সিনেমা-সিরিয়াল না দেখলে ওর চোখের জল ঠিক ফ্লো করতে চায় না। কিন্তু খুনের সন্দেহ যে একট অস্বস্তিকর ব্যাপার সে'টা বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি৷ খুন শুনেই মোবাইল থেকে মুখ তুলে হাউহাউ শব্দে ইন্সপেক্টর গুপ্তর দিকে তেড়ে গেলো, "কী বলছেন ইন্সপেক্টরবাবু। আমার স্বামী অমন দেবতুল্য মানুষ। তার কি কোনো শত্রু থাকতে পারে? তাছাড়া ঘরে এ সময় ছিলটা কে। আমি, আর অমিয়। আর আমাদের মেয়ে বুল্টি গেছে ওর মেজপিসির বাড়ি। এর মধ্যে কে খুন করবে ওকে"? বরাবরই দেখেছি, নীলার কথার মধ্যে একটা ধারালো ব্যাপার আছে। ইন্সপেক্টর গুপ্ত একটু থতমত খেলেন৷

" ইয়ে মানে", দু'পা পিছিয়ে গিয়ে বলতে শুরু করলেন গুপ্তবাবু, "রেলিঙটা তো যথেষ্ট উঁচু, ও'টা আলোগোছে মনের ভুলে ডিঙিয়ে যাওয়াটা ঠিক.."। শুনে মনে হলো ইন্সপেক্টর গুপ্ত হুইস্কি রস থেকে বঞ্চিত৷ নয়ত মাতালের উটকো ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলার ক্ষমতা সম্বন্ধে অকারণ সন্দেহ প্রকাশ করতেন না৷ ফের আমতাআমতা করে বলা শুরু করলেন, "তবে আপনারা বলছেন যখন..নিশ্চয়ই তাই হবে৷ দুর্ঘটনা.."। গুপ্তদারোগার মনের ভিতর পাতা মাদুরের ওপর তখন আগাথাদিদি আর আর্থারদাদা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছেন৷

নীলা আর একরাউন্ড অশ্রুহীন হাউহাউ দিয়ে ইন্সপেক্টরের পিলে চমকে দিয়ে বললে, "এমন সোনার সংসার। আমার দীনু অকারণ সুইসাইড করতে যাবে কেন"?

ইন্সপেক্টর গুপ্ত পত্রপাঠ বিষম খেয়ে জানিয়ে দিলেন "আপনার দীনুবাবুর পোস্টমর্টেম একটা হবে..তবে বোঝাই যাচ্ছে স্পষ্ট দুর্ঘটনা"। দুর্ঘটনার আশ্বাস নিয়ে নীলা মোবাইলে স্ক্রিনে নিশ্চিন্তে ফেরত গেল৷ অমিয় টলতে টলতে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে, ভাজাভুজি কিছু পড়ে আছে কিনা দেখতে।

এ'দিকে আমার শুরু হলো দুশ্চিন্তা৷ এত খাটুনি সব জলে না যায়৷ আমার দু'পেগ আর অমিয়র চার পেগের মাথায় মাতলমির অজুহাতে শালার গায়ে গিয়ে ঢলে পড়েছিলাম, সে আমায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়৷ অমিয়র নখগুলো জঙলি৷ আমি নিশ্চিত আমার ঘাড়ে অমন অদ্ভুতভাবে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর টাটকা নখের দাগ পাওয়া যাওয়ার ব্যাপারটা পুলিশকে ভাবাবে৷ আড়ালে অমিয়র ফোন হাতড়ে কিছু গর্হিত ইন্টারনেট সার্চও করে রেখেছি, "ক্যান আ পার্সন সার্ভাইভ আফটার ফলিং ফ্রম দ্য ইলেভেন্থ ফ্লোর"৷ ইন্সপেক্টর গুপ্ত কি অমিয়র ফোন বাজেয়াপ্ত করবে না? পুলিশ কি আমার ঘাড়ে অমিয়র ধাক্কা দেওয়া আঙুলের ছাপ বা নখের দাগ খুঁজে পাবে না?
মারাত্মক টেনশন হচ্ছে৷ মারাত্মক৷ অমিয় হয়ত পুরোপুরি ফাঁসবে না, কিন্তু একবারের জন্যও সামান্যতম সন্দেহ ওর ওপর এসে পড়লেই আমার শ্বশুরমশাই ওর পিছনে ক্যাঁক করে একটা কমল মিত্র অন স্টেরয়েড সুলভ লাথি কষাবেন৷ অন্তত বাপ-ঠাকুর্দার রেস্টুরেন্টের ব্যবসাটা নিশ্চিতভাবেই অমিয়র হাতছাড়া হবে গবেটত্বর জন্য৷ আর সে ব্যবসা নিশ্চয়ই নীলা পাবে৷ ওর পাওয়া উচিৎ। নীলা সত্যিই পারবে ও ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে৷ ও অমিয়র মত অকালকুষ্মাণ্ড নয়।

বিয়ের পর এতগুলো বছরে নীলার মেজাজটা ভারি তিতকুটে হয়ে গেছে৷ বাইরে থেকে সবাই দেখে ভাববে কী'রকম জাঁদরেল স্নেহহীন নিরেট মানুষ৷ আমি জানি নীলা এমনটা ছিল না চিরকাল, আমিই ওকে যথেষ্ট ভালো রাখতে পারিনি। মিইয়ে যেতে যেতে কেঠো হয়ে গেছে একসময়৷ ওর পরিবারের পুরুষরা ওকে তেমন পাত্তা দেয়নি কোনওদিন, বিয়ের পর আমিই বা কদর করলাম কই৷ ডাক্তার সান্যাল যে'দিন রিপোর্ট দেখে আমায় জানালেন যে আমার হাতে আর বড়জোর মাসচারেক, তখনই ঠিক করেছিলাম নীলার জন্য কিছু করার শেষ চেষ্টা একটা করতে হবে৷ আশা করি ডাক্তার সান্যাল রিপোর্টটা গোপন রাখার কথাটা ভুলবেন না।

এই মুহূর্তে ইন্সপেক্টর গুপ্ত নিজের কাজে ব্যস্ত৷
বেয়াদপ অমিয় রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পা ছড়িয়ে বেগুনি চিবুচ্ছে।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে নীলা একমনে মোবাইলের স্ক্রিন দেখে যাচ্ছে৷ ওর মনের মধ্যে একটু ঢুঁ মেরে দেখলাম; সে'খানে একটা নিরিবিলি বারান্দার গ্রিলে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে নীলা; কলেজে পড়া নীলা৷ সে বারান্দায় ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ ইচ্ছা হল ওকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু আমি তো ইচ্ছে-অনিচ্ছে পেরিয়ে বহুদূর চলে এসেছি৷ আচমকা সেই তরুণী নীলা ঘুরে তাকালো৷ ও নির্ঘাৎ আমায় দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু আমি দেখলাম ওর দু'চোখ ঝাপসা৷

একটা শেষ চেষ্টা করে দেখলাম নীলার হয়ে৷ ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াচ্ছে সে'টা না জানা পর্যন্ত আমার দুশ্চিন্তা কাটবে না।