- ক...কী...মানে...।
- তুমি যে ফুলিকে বিয়ে করতে চাইছো, বলি ইনকামের সোর্সটা কী...।
- শুধু আমিই যে ফুলিকে বিয়ে করতে চাইছি এ কথাটা তো ঠিক পূর্ণসত্য হলো না কাকু, ফুলিও আমায় বিয়ে করতে চাইছে। একেবারে ইকুয়াল ইন্টেনসিটি নিয়ে! কই, আমার বাবা তো ফুলির স্কুলমাস্টারি নিয়ে বেশি প্রশ্নট্রশ্ন করেনি।
- উনি প্রশ্ন করেননি কারণ ফুলি ওয়েল-এস্টাব্লিশড। খেটেখুটে পড়াশোনা করেছে, তারপর নিজের যোগ্যতায় চাকরি জুটিয়েছে। তোমার খবরটা তো জানা দরকার বাবা...।
- ইয়ে মানে, আমিও খুব খেটেখুটে পড়াশোনা করেছি। বলতে পারেন, ফুলির চেয়েও আমায় অনেক বেশি খাটতে হয়েছে। বিশ্বাস করুন, অঙ্ক কেমিস্ট্রি এ'সব আমার মাথায় কোনোদিনও ঢুকত না। ফুলি শুনেছি কথায় কথায় টপাটপ ইকুয়েশন ব্যালেন্স করে ফেলতো। কাজেই ফার্স্টক্লাস পেতে ফুলিকে যতটা খাটনি করতে হয়েছে, আমার পাশ করতে তার ডবল খাটতে হয়েছে। এ কথাটা ধ্রুবসত্য।
- বটে। তা গ্র্যাজুয়েশনটা পাশ করতে পেরেছো তো?
- নিশ্চয়ই! অনার্সটা পাইনি, কিন্তু পাশটা দিতে পেরেছি। ওই যে বললাম, মারাত্মক খাটনির ব্যাপার কিন্তু।
- তা, পাশ করে এখন কী করা হচ্ছে। সে'টাই তো তখন থেকে শুধোচ্ছি।
- আজ্ঞে, বিজনেস করছি।
- কীসের?
- মুদীর দোকান দিয়েছি। দোকানটা অবশ্য বাবার থেকে ধার নিয়ে দেওয়া। তা ছিন্নমস্তার কৃপায় বাবার সে ধার আমি শোধ করেছি। দোকানটা দিয়েছি ধরুন ওই সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই। আগামী সতেরোই শ্রাবণ আমার মাধবীলতা ভ্যারাইটি স্টোরের সাত বছর পূর্ণ হবে।
- মুদীর দোকান?
- আপনি ভাবছেন মাধবীলতা কে। আমার ঠাকুমা। দোকানঘরটা ঠাকুমারই ডোনেট করা তো...তাই...। গত বছর তিন দিনের জ্বরে চলে গেলেন। গ্রেট উয়োম্যান।
- মুদীর দোকান?
- আমার ফিলসফি হচ্ছে সঠিক দাম, সঠিক মান, সঠিক পরিমাণ। বুঝলেন, অনেস্টি না থাকলে ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি মুশকিল...।
- তুমি বড় বেশি কথা বলো।
- আমি কি মশলা-ডাল-চানাচুর বেচি ভেবেছেন? সে'সব তো নিমিত্ত মাত্র। আমি বেচি কথা। ওয়ার্ডস! কত খদ্দের তো স্রেফ সন্ধেবেলা দু'দশ মিনিট প্রাণখোলা গপ্প করতে চেয়ে এসে হাফ-কিলো গোবিন্দভোগ বা একশো গ্রাম পোস্ত কিনে ফিরে যায়। মেয়ের অ্যাডমিশনের অসুবিধে হচ্ছে বা অফিসের প্রমোশন ঝুলে রয়েছে, আমি মুদীর দোকানি কি ছাই বুঝি সে'সবের। কিন্তু তাঁরা গল্প করেন, আমি মন দিয়ে শুনতে শুনতে ফর্দ ঝালিয়ে নিই, আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সহদেব ডাল, বড়ি ওজন করে চলে। জেপ্টো বলে সাত মিনিটে মালপত্তর পোঁছে দেবো, আমি বলি তাড়া কী মশাই। আসুন, বসুন। দু'টো কথা বলি, দু'টো কথা শুনি। তবে না জমবে...।
- মুদীর দোকান চালিয়ে হাতে কত আসে প্রতি মাসে?
- তা আপনার আশীর্বাদে...।
- আমার আশীর্বাদ ফাশীর্বাদ কিস্যু নেই। সোজা কথা বলো দেখি, হাতে কত আসে প্রতি মাসে?
- মেডিকাল ইন্স্যুরেন্স আছে। বর্ষায় হপ্তায় একবার ইলিশ পাতে আসে। গতবছর একবার নর্থ বেঙ্গল আর একবার রাজস্থান ঘুরে এলাম। তবেই বুঝুন কতটা ঘ্যামে রয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী এর বেশি পয়সাকড়ি হাতে এলে বখে যাওয়ার একটা চান্স আছে।
- ফুলি এত স্টাবর্ন না হলে তোমায় আমি রিজেক্ট করতাম।
- আমার দোকানের চানাচুর আড়াইশো গ্রাম এনেছি আপনার জন্য। বড়জোড়া থেকে সোর্স করি বুঝলেন? বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট। চেখে দেখে বলুন যে আমার এক্সেলেন্সের প্রতি নজর আছে কিনা। আপনি ঠকছেন না, সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। যাক গে, এই সেই ঠোঙা। মাসীমাকে একটা বাটি দিতে বলুন না, চানাচুরটা ঢালি!
- তুমি কি বিয়ের পরেও এত বকবক করে চলবে?
- ও'টাই তো আমার ইউএসপি। মূলধন! এই গপ্পের শখ না থাকলে তো বছর চারেক আগে ফুলি এসে লাক্স সাবান চাইতো, আমি সে জিনিস হাতে তুলে নিয়ে দাম আদায় করে খালাস হতাম। কিন্তু তা তো হলো না বলুন! আমি বললাম, এই শীতে লাক্সের ভরসায় আটকে থাকলে তো চলবে না। এ'টা গ্লিসারিন সাবানের সময়। স্কিনকে বেপরোয়া ভাবে ট্রীট করলে চলবে কেন? আপনিই বলুন! ব্যাস, সেই এক কথা থেকে দু'কথা। ফুলি দেমাক নিয়ে শুধোলে আপনি কি ডার্মাটোলজিস্ট? আপনার লাক্স না পিয়ার্স সে তর্কে যাওয়ার দরকারটা কী? আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, ডিসেম্বরের ছ'তারিখ পেরোলেই আমার মা গ্লিসারিন সাবান ছাড়া কিচ্ছুটি বরদাস্ত করতেন না। আবার সেই মার্চ পড়লে তবে মার্গোতে ফেরত। ফুলি জানতে চাইলে আমার মা আছে কিনা! ফলত একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমার বলতে হলো যে আমি যখন ক্লাস সেভেনে তখনই হঠাৎ দিন তিনেকের জ্বরে...।
- এত বাজে কথা যে একজন মানুষ বলতে পারে...।
- রবীন্দ্রনাথ বলেছেন জানেন, কাজের কথার থেকে নাকি বাজে কথাতেই মানুষকে চিনতে সুবিধে হয়। এই ধরুন আমাদের পাড়ার ডাক্তার দত্ত; সোম থেকে বিস্যুদ সকালে আমার দোকানে এসে আধঘণ্টা বাজে-গল্প না করলে ওঁর মন বসে না। রাশিয়ার তেল, বলিভিয়ার চিকেন রোস্ট, তিব্বতের কালীমন্দির; এমন কত কী! নেহাত শুক্কুর শনি রবি উনি প্রাণায়ামের ক্লাস করতে যান তাই...।
- নাহ্। এ বিয়েতে আপত্তি করার দুঃসাহস অন্তত আমার নেই। ভাইটি, শোনো! ফুলি ছাতে আছে। তুমি বরং ওর সঙ্গে গিয়ে গল্প করো। বিয়ের আগে হবু-শ্বশুরের সঙ্গে এত খেজুরে আলাপ ভালো দেখায় না, কেমন?
No comments:
Post a Comment