Thursday, August 31, 2017

ফেরত

- এই যে।
- এই! এ কী! দিদিইইইই...।
- অত ভয় পেলে চলে অপুবাবু?  আর কথায় কথায় দিদিকে ডাকা যে ভালো শোনায় না।
- কিন্তু তাই বলে...।
- তাই বলে কী? আমি স্টীমইঞ্জিন বলে কি আমার কথা বলা বারণ? সারাক্ষণ শুধু ভোঁসভোঁস করতে হবে?
- কথা বলা ইঞ্জিন?
- শুধু কথা বলাটাই দেখলে? রেললাইন ছেড়ে কাশবনে নেমে এসে দুদ্দাড় ছুটতে শুরু করলাম, সে'টা বুঝি কিছু নয়?
- কী মুশকিল, কী ভয়ানক।
- বাহ্, পাহাড় মহম্মদের কাছে ছুটে এলেই মুশকিল?
- রেললাইন থেকে নামলেন কেন?
- ফেরত দেওয়ার ছিল।
- ফেরত?
- হাতের শক্ত মুঠো।
- দিদি?
- দিদি আর কদ্দিন তোমায় মুঠোয় ধরে রাখবে অপুবাবু? এ'বার নিজের মুঠো শক্ত করো। খোকাকে  নিয়ে এসো। আমি বেঢপ কয়লা কালো ইঞ্জিন হতে পারি কিন্তু সে খোকার কাজল কালো টলটলে চোখ। এক কাশবন ছুটোছুটি পড়ে রয়েছে, ফেরত নিয়ে এসো। কালকেই চলে যাও।
- কাজল আসবে?
- নয়তো ফেরত দিতে এ'লাম কেন?
- আর দিদি?
- সেই তো আমায় টানতে টানতে রেললাইন ছাড়িয়ে নিয়ে এলো, অপুকে দেখাতে। এখন আসি, কেমন?

Wednesday, August 30, 2017

বরিশাল

বরিশাল।

স্বাধীনতার খানিক আগেই হবে হয়ত। দাদু তখন স্কুলে, আন্দাজ করতে পারি ক্লাস সেভেন কী এইট। শহরজুড়ে উত্তেজনা।
হিন্দু মুসলিম। মার দাঙ্গা।
তার ওপর শুরু হল ভয়াবহ কলেরার প্রকোপ।

মোদ্দা কথা হল মরে যাওয়াটা খুব একটা তাবড় ব্যাপার নয় সেই সময়। মাঝেমধ্যেই খবর আসে। খুব সুপরিচিত কেউ; গতকাল হয়ত ছিলেন- আজ নেই।

ওই মৃত্যুর পরিবেশে দাদু অঙ্ককে আঁকড়ে ধরতে শিখেছিলেন। পরিচিত কেউ মারা যাওয়ার রাতগুলো দাদু রাতভর অঙ্ক প্র‍্যাক্টিস করে কাটিয়ে দিতেন।

অঙ্ক। রাতভোর হওয়া পর্যন্ত। যতক্ষণ না মগজ নুয়ে পড়ে অবশ হয়ে। ভয়বাহ ব্যাপার হল অনুশীলনী কম পড়তে শুরু করেছিল।

"দাদা, যাস না। যাস না। নতুন ক্লাসের নতুন বই আসুক, তখন না হয় অন্য বাহানা খুঁজে নিস"।
একান্নবর্তী পরিবার, মানুষজন বড় কম ছিল না।

অঙ্ক দাদুকে বিট্রে করেনি কখনও। দাদু অঙ্কের মধ্যে বাড়ির গন্ধ পেত হয়ত।

চন্দননগরের প্রাইভেট নার্সিংহোমে শুয়ে দাদুর শেষ দিনের গল্পের বেশ কিছুটা জুড়ে ছিল ক্রিকেট, বরিশাল, অঙ্ক আর সলিচিউড অফ আলেক্স্যান্ডার সেলকার্ক।

"অঙ্ক বইয়ের অনুশীলনী শেষ হয়ে আসছে, সে যে কী ভয় ভাই। অঙ্কের বাইরে কোথায় যাব? বরিশাল। জ্যাঠাইমা।  জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনে মিলে গোটা বাড়ি সরগরম; সমস্ত শান্ত হয়ে আসে। সমস্তটা অন্ধকারে। নীচের একটা ঘরের একটা টেবিলে রাতের পর রাত কেটেছে। অনুশীলনীর পর অনুশীলনী। আমার ফেলে আসা দেশ বলতে ওই টেবিল চেয়ারটুকুই"।

দাদু অঙ্কের প্রতি আনুগত্য আমায় দিয়ে যেতে পারেননি। সেলকার্কের গল্প বলেছিলেন;

I am monarch of all I survey; 
My right there is none to dispute; 
From the centre all round to the sea 
I am lord of the fowl and the brute 
O Solitude! where are the charms        
That sages have seen in thy face? 
Better dwell in the midst of alarms, 
Than reign in this horrible place.

তাঁদের

ভালোবাসা শব্দটা অবহেলায় ব্যবহার করতে নেই।

তবে যাদের মানিব্যাগের চোরাইখাপে টুথপিক থাকে,

যারা বিরিঞ্চিবাবা কোট করে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিয়ে থাকেন,

যারা ক্রমাগত আইআরসিটিসিতে লগ ইন করে বাড়ি ফেরার সুবাস পান,

যাদের চোয়াল সাপলুডোয় হেরে শক্ত হয়,

যারা কবিতা লেখেন পরাশর বর্মা হতে চেয়ে,

যাদের রাগের লোহা পোস্টকার্ডের সুতোয় কাটে,

তাঁদের একটুআধটু বাসতে হয়। হয়।

এক্সকিউজ মি

- দাদা, এক্সকিউজ মি।
- কিছু বলবেন?
- একটা মাইনর ব্যাপার ছিল।
- টুক করে বলে ফেলুন।
- বলছিলাম যে, ইয়ে, আপনার বাঁ পা আমার ডান পায়ের ওপর রয়েছে।
- আপনার বাঁ পা কি মাটিতে রয়েছে?
- জুতোর সোল মোটা, তাই ঠিক টের পাচ্ছি না।
- আপনার জুতোর সোলের ওজন আপনার বাঁ'দিকের ভদ্রলোকের ডান পা ঠিক টের পাচ্ছে। আমার ডান পায়ের ওপর যেমন পাশের বৌদির ছুঁচলো হিল। জুতো নয়, চটি। কাজেই ব্যথার ডিগ্রীটা আশা করি বুঝতে পারছেন।
- ওহ। সরি।
- ইট ইস ওকে।
- লাইনটা মুভ করছে না কেন বলুন তো?
- আপনি বোধ হয় ক্যালক্যাটার নন, তাই না?
- উখড়া,  আসানসোলের দিকে।
- বুঝেছি। প্যান্ডেল হপিংয়ের জন্য জীনকে মিউটেট করাতে পারেননি। স্পীড কমফর্ট কমনসেন্সের মত অদ্ভুত সব জিনিস এক্সপেক্ট করছেন।
- সরি।
- ইট ইস ওকে।

Tuesday, August 29, 2017

রিভিউ

- হ্যালো, খোকা!
- হুঁ। বলো।
- এ'বারেও ছুটি পাবি না রে?
- সব জানোই তো মা।
- জানি। তবু, ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করতে।
- বেশ করেছ জিজ্ঞেস করে।
- তোর বস তো বেশ ভালোমানুষ,  দেখ না একবার বলে কয়ে যদি..।
- ওই সময় রিভিউ আছে মা। না থাকলে আমারই ক্ষতি।
- জানি। জানি। তবু। বলে ফেলি।
- বেশ করো বলে ফেলো।
- খোকা জানিস, দত্ত বাড়ির ছোট মেয়ে পাড়ায় এসেছে..পুজো পর্যন্ত থাকবে। ওর ছেলেটা যে কী মিষ্টি হয়েছে..। আজ বাড়িতে এসেছিল। গিন্নীবান্নি হয়ে গেছে সে এখন। ছেলেটা সবার কোলে যায়...।
- মা।
- তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল।
- আমি তো তোমায় এত কথা জিজ্ঞেস করিনি মা।
- বলে ফেলি।
- আচ্ছা। বেশ করো বলে ফেলো।
- আসবি? খোকা? কদ্দিন পুজোয় বাড়ি ফিরিস না। উৎসব পার্বনের দিনে ঘরটা একদম...।
- রিভিউ। প্রমোশন। কত কিছু!

***

- তুই কলেজ ফাঁকি দিয়ে চলে এলি?
- আমার দ্বারা পেল্লায় কেরিয়ার টেরিয়ার হবে না রে। একটা বেশ পোস্ট অফিসে ক্লার্কের হব। দশটা পাঁচটা। তুই হবি কোনও হেডমিস্ট্রেস।
- বাবু, তুই এমন কেন রে? সেমেস্টার পরীক্ষা বাদ দিয়ে কেউ পুজোয় বাড়ি ফেরে?
- পুজোয় কেউ কেরিয়ার ভাবে?

***

"পুজোয় কেউ কেরিয়ার ভাবে"? নবমী সকালে, নাগপুরের কোয়ার্টারের ছাতে; তিন নম্বর আর্নড লীভ নষ্ট করতে করতে ভাবছিলেন চ্যাটার্জীবাবু।

একটানা রিভিউ চলে এসএমএসে;

" এ'বারেও আসবি না বাবু? আমার সঙ্গে কি আর কোনওদিনও দেখা করতে নেই"?

Tuesday, August 22, 2017

গানের খাতা

- ডাক্তার।
- আরে দত্তবাবু যে,কী ব্যাপার? এই শেষ বেলায় কী মনে করে?
- চিন্তায় ছিলাম এত রাত্রে তোমার চেম্বার খোলা পাব কী না।
- বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তা কী ব্যাপার? হাঁটুটা বেশি ট্রাবল দিচ্ছে?
- হাঁটু যেমন তেমন আছে হে ডাক্তার, সমস্যা অন্য।
- কী সমস্যা?
- জ্বর জ্বর ভাবটা কমছে না। টেম্পারেচার তেমন নেই, কিন্তু ভিতর ভিতর একটা যে ইয়ে রয়েই গেছে।
- দেখি, পালস দেখি দত্তবাবু।
- মড়ার আবার পালস কী হে?
- তাও তো বটে। আমারই মাথাটা গেছে।
- জিভ দেখি।
- মুখ দু'দিন ধরে এত তিতকুটে হয়েছিল...জিভটা খুলে রেখেছি। ভেবেছিলাম আজ বেরোনোর আগে পরে বেরোব কিন্তু মনে ছিল না। আসলে স্ট্রেস কমাতে কয়েক জিবি মেমোরি ব্রেন থেকে সরিয়ে আলমারিতে রেখে দিয়েছি কিনা, তা'তেই সমস্যা। সঠিক সময়ে সঠিক কথা কিছুতেই মনে পড়ছে না।
- পালস নেই, জিভ নেই। খানিকটা মেমোরিও মিসিং। মুশকিল হল তো।
- তোমার এদ্দিনের এক্সপিরিয়েন্স, দিয়ে দাও না দু'দাগ যা হয় কিছু।
- জ্বর জ্বর ভাব?
- প্রচণ্ড রকমের ম্যাজম্যাজ। গায়ে অল্প ব্যথা। একটা ভূত-বেল্যেডোনা গোছের কোনও বড়ি যদি...।
- নাহ্, এ যা দেখছি ওঝাও-হোমিওপ্যাথিতে কাজ হবে না...।
- সামান্য ফিভারের জন্য ছুরি কাঁচা ধরবে ডাক্তার?
- সিম্পটম তো তাই বলছে। ভিটামিন এম'য়ের অভাব, তা'তেই গায়ের টেম্পারেচার বাড়ছে।
- ভিটামিন এম?
- মড়াদের থাকে।
- এম ফর মড়া?
- না, এম ফর মিউজিক-মেমরি। আপনাকে গান টানছে। তাই এই জ্বর।
- উপায়?
- গানের কোনো স্মৃতিতে না ফিরতে পারলে মড়াদেহ ঝরঝরে হবে না মোটেও।
- গানের স্মৃতি? আছে, উপায় আছে। মায়ের গানের খাতাটা যদি...।

***

- খোকা! কাঁদছিস কেন?
- তোমার গানের খাতা মা! তোমার গন্ধ।
- খুঁজে পেলি তাহলে?
- সবাই বড় অযত্নে রেখেছিল মা তোমায়, আর এই এত দামী খাতাটাও..।
- তোর মায়ের গানের খাতা,  অন্যের কাছে দামী হবে কেন? তাও ভালো ওঝার কথায় ফেরত এলি..। দু'দণ্ড দেখতে পেলাম।
- ওঝা? হেহ্, আমাদের ও'দিকে ও ব্যাটাই আবার ডাক্তার। সেই বললে, আমার নাকি ভিটামিন-এম'য়ের অভাব। গানের সুবাস দরকার, নয়ত জ্বর কাটবে না। ভোর হল বলে, যেতে হবে। গাইবে? ওই যে 'তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার। তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার'।

***

- মা, তোমার জ্ঞান ফিরেছে তা'লে। সুস্থ বোধ করছ?
- কে..কে?
- আমি গো, সুজন ওঝা। খোকাকে দেখে কেমন লাগল মা? তাকে গান শুনিয়ে মন শান্ত হল?
- খোকার...খোকার জ্বর...।
- সে এখন দিব্যি ফুরফুর করছে। ভাগ্যিস তুমি গানের খাতাটা এনেছিলে মা, নয়তো তাঁকে নামানো সহজ হত না গো..।

Monday, August 21, 2017

গোপন বোতল

- হ্যাঁ রে গুপে..একটা কথা অনেস্টলি বলবি আমায়?
- কী ব্যাপার মামা? তুমি এত সিরিয়াস টোনে কথা বলছ কেন?
- কারণ সাব্জেক্টটা সিরিয়াস তাই।
- কী ব্যাপার?
- তুই মদ খাস?
- ছিহ্! মদ? রামোহ্! মাকে প্রমিস করেছি ও'সব ছোঁব না।
- রিয়েলি? দিদিকে প্রমিস করেছিস? র‍্যামোহ্? বটে?
- তোমায় ছুঁয়ে বলব?
- পাগল নাকি রে! ডাক্তার এমনিতেই বলেছে কোলেস্টেরল অ্যালার্মিং ডায়রেকশনে বয়ে চলেছে।
- মাইরি গো। সে'বার অফিস পিকনিকে এক চুমুক বিয়ার খেয়ে কী বিশ্রী লেগেছিল। তারপর থেকে পার্টিফার্টিতেও বড় জোর লাইম সোডা, তাও আবার স্যুইট।
- গুড বয় গুপে।
- থ্যাঙ্ক ইউ মামা।
- ইয়ে, তোর ওই দেরাজে কেউ ভুলে একটা জনি ওয়াকারের বোতল ফেলে গেছিল।
- দেরাজ? আমার? মাইরি?
- নট টু ওয়ারি। ও আমি সরিয়ে নিয়েছি। এই ব্যাগে রেখেছি। যাওয়ার পথে কোনও ঝোপঝাড় দেখে ফেলে দেব।
- মামা, আমি থাকতে তুমি কেন কষ্ট করবে?
- কষ্ট কী? নাথিং। নাথিং। ঝোপঝাড় কত চারদিকে।
- কী দরকার। তুমি নিজে কোনও দিন মদের বোতল ছুঁয়ে দেখোনি, এই সেদিনই তুমি দিদার সামনে গল্প করছিলে।
- তা অবশ্য ঠিক। মদের বোতল মানে নরকের আধার কার্ড।
- তা বোতলটা রেখেই যাও।
- কী ভাবে এলো বল তো বোতলটা? দেরাজে?
- আমি তো আকাশ থেকে পড়ছি। বিশ্বাস করো। কেউ তুকতাক করছে না তো মামা?
- তুকতাক? হতে পারে। তবে এ বোতল বরং আজ ঝোপঝাড়ে ফেলে আসাই ভালো। এই বোতল ফেলে আমি বরং দু'লিটারের ফ্যান্টা নিয়ে আসব।
- আমি মরে গেছি মামা? আমি থাকতে তুমি বাইরে যাবে কষ্ট করে?
- যাব না?
- পম্পফ্রেট ভাজা খাবে মামা? ফ্যান্টা দিয়ে?
- পমফ্রেট এনে রেখেছিস?
- ম্যারিনেটও করাই আছে।
- ও। আচ্ছা। ওই কাজুর প্যাকেট দেখছি...।
- ওই...ফ্যান্টার সঙ্গে খাওয়ার জন্যে।
- তুই ফ্যান্টা সত্যিই ভালোবাসিস গুপে।
- ওই। নরনাং মাতুলং কী যেন।
- কথাটার মানে জানিস?
- মানুষ মামার মতই হয়...।
- ঠিক, অর্থাৎ মামা ঝোপ হলে...।
- ভাগনে ঝাড়।
- হেহ্। তা'হলে মামা, দেরাজের বোতলটা...।
- ঝোপঝাড়েই যাক।

জনি ওয়াকারের বোতলটা প্রতি রোববার ফ্যান্টায় রীফিল হয়ে চলে।
প্রতি রোববার মামার হুমকি।
প্রতি রোববার গুপের পমফ্রেট টোপ।

জনি ওয়াকার-ফ্যান্টায় মাতাল না হলে প্ল্যানচেট জমে না, প্ল্যানচেট না জমলে মামা ভাগ্নে নিজেদের মায়দের ডেকে হপ্তার ফিরস্তি শোনাবে কী করে?

Sunday, August 20, 2017

নতুন গান

এই যে বেঁচেবর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
এই যে চায়ের কাপে নিজের পছন্দ মত পরিমাণে চিনি মিশিয়ে নিচ্ছি।
খবরের কাগজের পাতা উলটে  চুকচুক করে চলেছি।
বসের মুখ গোমড়া হলেই মাথা চুলকে হদ্দ হচ্ছি।
এই যে প্রতিবেশীর পর্দার রঙ ক্যাটক্যাটে বলে মনখারাপ করছি।

এই যে সভ্যতায় গা এলিয়ে মৌজ করতে পারা। টেবিল চাপড়ে রেগে উঠতে পারা। এই যে মনের মধ্যে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়ে তৈরি হলে শীতের রাতের মিয়ানো বেড়ালের মত কাঠের পেটির আস্তানা খোঁজা। সন্ধে সাতটা পঞ্চাশের আপ ব্যান্ডেল লোকালের জানালার প্রতি এই যে প্রপঞ্চময় মায়া।

সব মিলে ইংরেজিতে যাকে বলে 'মাচ্ কভেটেড' এই মানবজীবন।
এই মানবজীবনের কচুপাতায় চকমকে মুক্তোর দানার মত যদি কোনও পাওনা থাকে তবে তা হল একটা নতুন গানকে দুম করে ভালোবাসতে পারা।

সুর মানেই প্রশান্ত মহাসাগর এ থিওরি আদ্যোপান্ত বাতেলা। আবার অমুক সুরে দুনিয়া মজছে বলেই আমিও ভেসে বেড়াবো তেমন নিউটনি আইনও খাটে না।

একটা নতুন গানকে আচমকা 'প্রিয়' বলে চিনতে পারা, এ'টাই সুপারপাওয়ার, এতেই নির্বাণ। একদম অচেনা অজানা কোনও সুর; প্রথম শোনা এক ঝাঁক কথার সিঁড়ি বেয়ে ছাতে উঠে পায়চারী করতে করতে গান হয়েছে। তার সামনে এসে ঝপাৎ করে বলতে পারা "যাক্, দেখা হলো তাহলে। খবর সব ঠিকঠাক"?

গানও তো মানুষ গোছেরই। তাদেরও ভালো মন্দ, পছন্দ অপছন্দ, ঠিক বেঠিক, শাড়ি ফতুয়া, কান্না গোপন চুমু, কবিতা বোধ খিস্তি; সবটুকুই রয়েছে। কথার আদর, সুরের স্নেহ আর কণ্ঠস্বরের মেরুদণ্ডে তাদের স্পষ্ট হয়ে ওঠা।

এই সবকিছু মিলে কিছু গান দুম করে এসে কড়া নাড়ে। "কউন হ্যায়" হাঁক পাড়বার আগেই খেয়াল হয় 'দরজাটা কোথায়"?
তারপর খানিক খোঁজখবরে হদিশ মেলে গোপন কুঠুরির। সে কুঠুরির গায়ে নক্সা করা সেগুন কাঠের দরজা। কুঠুরিটা যে আছে সে খবরই এদ্দিন জানা ছিল না। হঠাৎ একটা বেমক্কা গান এসে নিদান দেয় "ইয়ে দরওয়াজা খোলিয়ে জনাব"। পিতলের ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলে দিতেই গানের সুর, কথা, কন্ঠ হুশহাশ সে কুঠুরিতে রোদ নিয়ে ঢুকে পড়ে।

মনের তলে দিব্যি কত কিছু জমা থাকে; কত মাদুর পাতা মন খারাপ, কত আতরে ভেজা তুলোর মত ব্যথা, কত বৃষ্টি ধোয়া রাস্তার মত ভালো লাগা, কত দেশলাই বাক্সে ঠেসে ভরে রাখা সুপারনোভা সাইজের অভিমান; একেকটা নতুন গান ভালোবেসে এক একটা নতুন গল্প তৈরি করে যায়।

'অলির কথা শুনে বকুল হাসে' প্রথম শুনেছিলাম দাদুর ফিলিপ্সের রেডিওতে। সে গানে আজও শীতের রাত্রির গন্ধ লেগে আছে। মায়ের গলায় প্রথম শোনা 'এমনই বরষা ছিল সেদিন'; হাতে গরম মনখারাপি সুর। ক্লাস নাইনের একটা  বিকেলে, এক স্কুলের বন্ধুর চিলেকোঠার ঘরে  প্রথম শুনেছিলাম 'তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনও'; বিকেলের গন্ধে আজও বেমক্কা বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। বা সোজাসুজি সে ভদ্রলোকের কণ্ঠে শোনা "বন্ধুরা, বিশ্বাস করুন আমি মানুষটা হিংসুটে নই মোটেও। তবু আমার ভীষণ মন খারাপ হয় এই ভেবে যে এই লাইন দু'টো আমার লেখা নয় - 'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো'"; প্রেসিডেন্সির ডিরোজিও হল, বছরটা সম্ভবত ২০০২।  
অথবা মাঝরাতের ছাতের অবকাশে আর গোল্ডফ্লেকিও সুবাস মিশিয়ে শোনা 'তেরে খত্ আজ ম্যায় গঙ্গা মে বহা আয়া হুঁ, আগ বেহতে হুয়ে পানি মে লগা আয়া হুঁ'।

মোদ্দা কথা হলো কিছু কিছু গান শুনেই 'আরে, এ'টা তো আমার' বলে জড়িয়ে ধরতে পারা; এই ক্ষমতাটুকু যদ্দিন আমাদের আছে তদ্দিন যুদ্ধটুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মানুষামি ঘুচবে না।

পুনশ্চ - চন্দ্রাণীদেবীর 'তোমাকে বুঝি না প্রিয়' গানটা শুনে যে দুম করে ভালো লাগা (যুক্তি জানি না, গানের কতটুকুই বা বুঝি), তার পরিপ্রেক্ষিতে এই বেমক্কা র‍্যান্ডম র‍্যান্ট

Friday, August 18, 2017

দেবু আর ব্লু-হোয়েল কিউরেটর

- দেবু...।

- এক্সকিউজ মি?

- আমি ব্রাউনজিব্রা।

- ওহ্‌, স্যর...।

- বসো বসো...দাঁড়ালে কেন? আমি তোমার ক্লাসটীচার নই। বসো।

- থ্যাঙ্ক ইউ।

- কেমন আছ?

- আছি স্যর।

- টেন্স?

- ওই। না মানে...ঠিক টেন্স না...এক্সাইটেড।

- তুমি ক্লাস নাইনে পড়ো, তাই না?

- ক্লাস নাইন। হ্যাঁ স্যর।

- বাড়িতে বাবা মা আর ছোট বোন। তাই তো?

- আছে তিন জন।

-  হুঁ। কোল্ড কফি অর্ডার করি?

- আচ্ছা।

- ওয়েটার, দু’টো কোল্ড কফি। এ’বার বলো।

- আমি ভেবেছিলাম...।

- কী ভেবেছিলে দেবু?

- আমি ভেবেছিলাম ব্রাউনজিব্রা বাংলা বলতে পারে না।

- হেহ্‌। দেবু, সাবজেক্টে যে ভাষায় স্বপ্ন দেখে আর চিন্তা করে; সে ভাষা ভালো ভাবে জানা না থাকলে কিউরেটর হওয়া যায় না।

- ওহ্‌। হ্যাঁ। তা বটে।

- ইউ লুক টায়ার্ড।

- একটু।

- ঘুমোনোর সুযোগ হচ্ছে?

- রাতে নয়। দিনেদুপুরে কখনও সখনও। এই, ঘণ্টা দুয়েক করে।

- হুম।

- কেমন লাগছে?

- টানছে।

- কী’রকম দেবু?

-  আমি আরও কষ্ট সহ্য করতে পারি। এ’গুলো জাস্ট কিছুই না। বিশ্বাস করুন।

-  জানি।

- আমার সবসময় বড্ড পিপাসা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ছুটে যাই। বুকের ভিতর ধড়ফড়। সব সময়। অথচ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না অন্য কারুর সঙ্গে। গত কয়েক মাসে আমার শুধু আপনার সঙ্গেই কথা হয়েছে ব্রাউনজিব্রা।

- স্বাভাবিক। আমি তোমার কিউরেটর। আমায় তো বলতেই হবে দেবু। বলো। নিশ্চিন্তে।

- আমি জানতাম যে কিউরেটরের সঙ্গে কোনওদিন দেখা করা সম্ভব না।

-  সব খেলার নিয়মে রদবদল হয়। সে’টাই স্বাভাবিক। এক সময় ক্রিকেটে মিডল স্টাম্প থাকত না, সে’টা জানো?

- বল গলে গেলে?

- নট আউট। সে এক মহাসমস্যা। কাজেই নিয়ম ধীরে ধীরে পালটে যাবে, সে’টাই স্বাভাবিক।

- আমাদের বাড়ি তিন তলা। ছাতের উত্তর কোণে ঝুঁকলে দেখা যায় ফুটপাথ, টগরগাছ।

- টানে?

- খুব। টগর গাছের পাশে একটা লেটারবক্স। মরচে পড়ে গেছে। ছোটবেলায় লেটারবক্সটাকে ভয় পেতাম, মনে হত ও’টায় ভূত থাকে।

- আর এখন?

- টানে। খুব। সেই ভূতটা টানে।

-  কার ভূত দেবু?

-  আমারই। লেটারবক্সে থাকত। অনেক আগে থেকেই। ওইটুকু একটা লেটারবক্সেও ও বেশ ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। আমার ইচ্ছে করে ও’দিকে নেমে যেতে।
ব্রাউনজিব্রা...।

- কোল্ডকফিটা খাও।

- থ্যাঙ্কস। আচ্ছা, ব্রাউনজিব্রা...।

-  কিছু বলবে?

-  আগামীকাল আমার চ্যালেঞ্জের পঞ্চাশ নম্বর দিন। ব্রাউনজিব্রা...।

- হাতের ঘা কেমন আছে দেবু?

- এই যে। হাতে যে কোড লেখার কথা ছিল। দেখুন। ঘা শুকিয়ে গিয়ে আরও স্পষ্ট হয়েছে।

- কেমন আছ দেবু?

- মাঝেমধ্যেই হাত পা কাঁপে স্যর। রাগ হয়।

- কার ওপর? বাবা? মা? স্কুলের বন্ধুরা?

- ওই পোস্টবাক্সটা, কাল ওখানে নামার কথা। আপনি আমায় সময় বলে দেবেন। ঝাঁপ দেওয়ার। আর কোথায় সেল্ফি পাঠাবো। মিস্টার ব্রাউনজিব্রা, প্লীজ।

- ঝাঁপ। হাড়গোড় ভাঙচুর। হেমোরেজ। দু'মিনিট বা দু'ঘণ্টার কষ্ট। ব্যাস? এ'টুকুই?

- আলটিমেট লেভেল অফ ব্লু হোয়েল। সেই মুহূর্তটা, সেই শেষ সেলফির মুহূর্তটাই  হল পার্ফেকশন মিস্টার ব্রাউনজিব্রা। আর কিছুই ইম্পর্ট্যান্ট নয়।

- সিলি।

- সিলি?

- ব্লু হোয়েল অত্যন্ত নরম ব্যাপার দেবু। চ্যালেঞ্জ হিসেবে বেশ এলেবেলে।

- এ'টা আপনি বলছেন? দ্য ফাইনেস্ট ব্লু-হোয়েল কিউরেটর ইন দ্য কান্ট্রি?

- এক্স-ব্লু হোয়েল কিউরেটর।

- আপনি ব্লু হোয়েল ছেড়ে দিয়েছেন? মিস্টার ব্রাউনজিব্রা! তা'হলে আমায় এ'ভাবে টেনে আনার মানে কী?

- ব্লুহোয়েল। সাময়িক যন্ত্রণা। আবছায়া, কিন্তু যথেষ্ট অন্ধকার নয়। ব্লুহোয়েল খেলে কেউ প্রতি নিয়ত অন্যদের গলা কেটে ফেলতে চায় না। একটা দুর্গন্ধময় দমবন্ধ করা পরিবেশে বছরের পর বছর...সে'টার মুখোমুখি দাঁড়ানো...মাচ বিগার চ্যালেঞ্জ।

- তা'তে পার্ফেকশন কই?

- দুর্গন্ধময় দমবন্ধ করা পার্ফেকশন। লেটারবক্সের ভিতরটা হয়ত তেমনই,  সে'রকমই একটা নতুন চ্যালেঞ্জ আমি তৈরি করছি।

- নতুন চ্যালেঞ্জ?

- আর এ চ্যালেঞ্জ সবাই উন্মাদের মত খেলবে দেবু। এ হল সেই চ্যালেঞ্জ যার তুলনায় ব্লুহোয়েল নস্যি। এমন চ্যালেঞ্জ যাতে প্রতিমুহূর্তে মনে হবে তুমি ছাতের পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছ। প্রতি মুহূর্তে মাথায় দপদপ, প্রতি মুহূর্তে শেষ হয় যাওয়ার ভয়। প্রতি মুহূর্তে মনে হবে এই বুঝি কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল...।

- কে? কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে?

- যে কেউ হতে পারে। বন্ধু বা বাবা বা মা...বা অন্য কেউ...। যে কেউ...। এক এক সময় মনে হবে ধাক্কা খাওয়ার একটানা ভয়ের চেয়ে...।

- মরে যাওয়া ভালো?

- খেলবে দেবু? এই নতুন চ্যালেঞ্জ?

- খেলব! কী চ্যালেঞ্জ এ'টা?

- তুমি পারবে দেবু? এই চ্যালেঞ্জ কিন্তু ব্লুহোয়েলের মত ঠুনকো নয়, আর খেলবেও বহু ছেলেমেয়ে..।

- পারব স্যর। পারব! চ্যালেঞ্জটা আদতে কী?

- ব্রাউনজিব্রা ছাড়াও আমার একটা কেতাবি পরিচয় আছে, একটা প্রফেশন আছে। সে সুযোগ নিয়েই আমি দমবন্ধ করা এই চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছি। হাজারে হাজারে ছেলেমেয়েকে আমি এই চ্যালেঞ্জের চাপে...।

- আপনার চোখ দু'টো আচমকা বড্ড লাল দেখাচ্ছে স্যর।

- সরি, একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তাহলে দেবু, খেলবে এই নতুন চ্যালেঞ্জ?

- খেলব। চ্যালেঞ্জটার নাম কী?

- চ্যালেঞ্জটার নাম? সিলেবাস। সিলেবাস! তোমাদের ক্লাস টেনের নতুন সিলেবাস আমিই তৈরি করছি..ওই..প্রফেশনালিই সুযোগটা পেয়ে গেলাম। হাজারে হাজারে সিলেবাস-কিউরেটর ছড়িয়ে রয়েছে তোমার চারদিকে। প্লে ওয়েল। অল দ্য বেস্ট ফর ইওর আপগ্রেডেড চ্যালেঞ্জ দেবু। হ্যাপি সিলেবাস।

Tuesday, August 15, 2017

উইন - উইন

- কত চাই?

- কী কত?

- চেকবই সঙ্গে এনেছি।

- কেন?

- তোমায় আমার কাজটা করে দিতে হবে সমীর।

- আপনি ভাবলেন কী করে মিস্টার সেন যে টাকার বিনিময়ে আমি মোহনদাকে খুন করব?

- কারণ সে'টাই তোমার পেশা!

- কিন্তু শিকার পছন্দসই না হলে আমি খুনখারাপি করি না। আপনি জানেন আমার রক্ত দেখলে গা গুলোয়? নেহাত পেটের দায়ে...।

- মোহন সিংকে খুন করতে তোমার আপত্তিটা কোথায়? সে তো নিজেও একটা মার্ডারার!

- লাইনের লোকে কী বলে জানেন? মোহন সিং হল আচরেকর, আর সমীর হল তেণ্ডুলকর।

- মহাভারতে যুধিষ্ঠির দ্রোণকে শায়েস্তা করেনি?

- দ্রোণ কাঠি করছিল। উপায় ছিল না।

- আর এ ক্ষেত্রে মোহন সিং তোমার মার্কেট শেয়ার নষ্ট করছে।

- আপনার জ্বালার কারণ আমার মার্কেট শেয়ার নয় মিস্টার সেন। আপনি জ্বলছেন কারণ মোহন সিং আপনার বিজনেস রাইভাল দত্তর হয়ে কাজ করছে।

- অবভিয়াসলি সে'টাই আমার কনসার্ন। কিন্তু সমীর, সিচুয়েশনটা উইন উইন। এ কাজ হয় তুমি করবে নয়তো অন্য কেউ...মাঝখান থেকে তোমার রেভেনিউ কমে যাবে।

- কেন বাতেলা ঝাড়ছেন স্যার? মোহন সিংকে আমি ছাড়া কেউ ছুঁতে পর্যন্ত পারবে না।

- দশ পাবে। পুরোটা অ্যাডভান্স।

- আপনি আজ আসুন মিস্টার সেন।

- ফিফটিন। সমীর, প্লীজ। এই যে চেকবই। আচ্ছা, দরকারে কুড়ি! কুড়ি দেব তোমায়।প্লীজ।

- এক কোটি দিলেও আমার মত পাল্টাবে না মিস্টার সেন।

- তুমি জানো না মোহন সিং তোমার দলের অন্তত দশ বারো  জনের লাশ ফেলেছে এদ্দিনে?

- দশ বারো? সতেরো।

- তবুও তুমি...।

- মোহন সিংকে খুন করব না। এ'বারে আসুন। আজ টিভিতে দিওয়ার দিয়েছে।

**

- হ্যালো!

- ব্যস্ত?

- বলুন দত্তবাবু।

- খবর আছে।

- শুনি।

- সেন ওর পোষা গুণ্ডাটাকে লাগিয়েছে তোমার খুন করতে। দশ লাখ অফার করেছে।

- বিশ।

- বিশ?

- দশ নয়, বিশ লাখ অফার করেছে।

- তোমার কাছে খবর এসে পড়েছে? যাক গে,  আমি তোমায় তিরিশ দেব। ওই সমীর গুণ্ডাকে সাফ করে দাও দেখি। চটপট।

- হবে না।

- হবে না? মোহন মার্ডারার বলছে খুন করতে পারবে না?

- বিজনেস টাইকুন দত্ত কানে কম শুনছে?

**

- ভাই মোহন, তোমার লাশে বিশ লাখ।

- ভায়া সমীর, তুমি মরলে তিরিশ।

- এক খুনে...।

- পঞ্চাশ লাখ।

টিভিতে তখন 'কেহ দু তুমহে, ইয়া চুপ রহু' ফুল ভল্যুমে বেজে চলেছে, আয়না ভাঙার শব্দটা তাই ঘরের বাইরে গেল না।