সাদামাটা সমস্যাগুলোকে পেল্লায় প্রমাণ করতে গিয়ে আমরা এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে জীবনের আদত জটিলতাগুলো নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করা হয়না। অদরকারী ব্যাপারস্যাপারে গা ভাসিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে আর এ'দিকে জীবনের দরকারি বিষয়গুলোকে ধামাচাপা দেওয়াটাকে আমরা প্রায় আর্টের পর্যায় নিয়ে গেছি। কিন্তু গা বাঁচিয়ে এ'ভাবে আর কদ্দিন চলবে?
অতএব আজ আমি বাদামসমস্যাটার কথা বলি। রোজ অফিস ফেরতা বি-কে-সি থেকে বেরিয়ে ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়েতে উঠি বান্দ্রার কাছে। সন্ধে মানেই বিশ্রী ট্র্যাফিক জ্যাম। তবে মাঝেরহাটের ব্রিজভাঙা বেহালায় স্টিয়ারিং ঠেলেছি বেশ কয়েক বছর, ও'সব জ্যামফ্যামকে আমি পাত্তা দিইনা। অডিওবুক, গান ইত্যাদির জমানায় রাস্তায় ভিড় তো না; লক্ষ্মী। তা, বান্দ্রা এলাকা ছাড়িয়ে অল্প এগোলে ভিড় আরও জমাট হয়। আর এক্সপ্রেসওয়ে সান্তাক্রুজের মুখে পড়তেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাদামওলা এগিয়ে আসেন (বৃষ্টি তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না, বম্বের স্পিরিট ইত্যাদি)। কাগজে মোড়ানো 'প্যাকেট', দশ টাকার ও কুড়িটাকার ইউনিটে। আমি নিয়ম করে দশের দু'প্যাকেট কিনি। ওই একটাই আ্মার নিয়মিত নন-ডিজিটাল খরচ। যা হোক, টুকটুক করে বাদাম খেতে খেতে এগোনো। প্রতিটা দানা হিসেব করে খাই, এককুচি বাদামও এ'দিন ও'দিক হওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিটা মুচুরমুচ মন দিয়ে শুনি এবং অনুভব করি। দু'নম্বর প্যাকেট শেষ হওয়া মানে এয়ারপোর্ট অঞ্চল পেরিয়ে গেছি। একদম অঙ্কের হিসেব। আর সে অঙ্ককে অবহেলা করেই বিশ্রী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো। ভারী অস্বস্তিকর।
গোলমালের সূত্রপাত বাদামদাদাদের দু'টো দশের বদলে একটা কুড়ির প্যাকেট গছাতে যাওয়ায়। কী মুস্কিল, রোজই সেই এক ঘ্যানঘ্যান। আমার দশেরদু'প্যাকেট নিতে ভালো লাগে। এক প্যাকেট শেষ করে বেশ জল-চুমুকের ইন্টারভ্যাল নিয়ে পরের প্যাকেট খোলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা আমি নিশ্চিত ছিলাম দু'টো দশের প্যাকেটে বাদামের পরিমাণ নিশ্চয়ই একটা কুড়ির প্যাকেটের চেয়ে বেশি। তেমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু ওই, মানুষের মন ভারী বিষাক্ত; সন্দেহে ভরা। অতএব পরিমাণ ব্যাপারটা ঝালিয়ে না দেখলে চলছিল না। স্রেফ জ্ঞানার্জনের জন্য দু'টো দশ আর একটা কুড়ি প্যাকেট কিনলাম। দু'টো একই রকম কাচের গেলাসে ঢাললাম। এবং, অবাক হলাম। একটা কুড়ির প্যাকেটে বাদামের পরিমাণ দু'টো দশের কোয়ান্টিটির চেয়ে অন্তত ১০% বেশি। পৃথিবীটা দুলে উঠলো; আফটার অল আমি মানুষ।
গোলমালটা বয়েলিং পয়েন্টে পৌঁছে গেলে যখন আজ পঞ্চাশ টাকার নোট আর পুরনো খদ্দের দেখে বাদামদাদা পঞ্চাশে তিনটে কুড়ির ঠোঙা অফার করলে। বাজিয়ে দেখলাম, কিন্তু পঞ্চাশে ছ'টা দশ টাকার প্যাকেট দিতে কিছুতেই রাজী হলে না। ঘায়েল হতেই হলো। নিলাম আজ পঞ্চাশে তিনটে কুড়ির প্যাকেট। তিন দিনের বাদামের হিল্লে হয়ে গেলো, প্লাস সামান্য বাড়তি বাদাম। আজকালকার ডেঁপো ছেলেমেয়েরা বলবে "টোটাল উইন"। যুক্তি বলবে "বাহ, ভাই তন্ময়, এই তো চাই"। অঙ্ক বলবে "ব্রেভো বন্ধু। সাবাশ"। কারণ অজস্র ঠোঙা বাদাম-কিনিয়ের কাছে সবটুকুই তো ছকে বাঁধা, হিসেব এ'দিক ও'দিক হওয়ার উপায় নেই।
দিব্যি স্টিফেন ফ্রাইয়ের কণ্ঠে ইলিয়াডের গল্প শুনতে শুনতে স্টিয়ারিং হাতে আল্ট্রা ঢিমেতালে এগোচ্ছিলাম। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দুটো দশের প্যাকেট শেষ হয়। আজ যখন এয়ারপোর্টের বোর্ড দেখলাম তখন বুকের ভিতরটা ছ্যাঁকা খেলো যেন। হা ঈশ্বর, আমার হাতে তখন অর্ধেক উড়ে যাওয়া তিন নম্বর কুড়ি টাকার বাদামের প্যাকেট। কোথায় যুক্তি, কোথায় অঙ্ক। ভুলে গেছিলাম যে বাদাম-কিনিয়ে মহশয় অতিশয় সমঝদার কিন্তু বাদাম-খাইয়ে বাবাজী মহাফেরেব্বাজ।
সাজানো হিসেব শুকিয়ে গেলো। কাল থেকে আবার নতুন ভাবে ব্যূহ-রচনা।
No comments:
Post a Comment