Thursday, December 4, 2025

মিনিবাস ও মনুদা

আজ বছর সাতেক পর মনুদার সঙ্গে দেখা অফিস-ফেরতা মিনিবাসে। এককালে দু'জনে সহকর্মী ছিলাম। আচমকাই চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কেন ছেড়েছিলেন? সে প্রশ্নের উত্তর আদায় করারও বিশেষ সুযোগ দেননি। এইচআরের শশাঙ্ক বলেছিল "পার্সোনাল রীজনস"; আরে, জীবনের সব রীজনই যে পার্সোনাল। যা হোক, মনুদার চেহারা বিস্তর পাল্টেছে তা নয়। সেই একই হাসিখুশি গোলগাল চেহারা, মুখে সামান্যতম বয়সের ছাপও যোগ হয়নি। শুধু ফিটফাট শার্ট ট্রাউজারের বদলে টিশার্ট আর ঢলা প্যান্ট। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ভিড়ে, দু'হাত দূরের সীট থেকে মনুদাই হাত নেড়ে ডাকলেন। আমি সামান্য এগিয়ে পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম।

- কেমন আছ দিবাকর?
- দিব্যি! আপনি?
- চমৎকার। তোমার কাঁধের ব্যাগ আর বাসের রুটে মালুম হচ্ছে যে আমাদের সেই ম্যাঙ্গো লেনের অফিসেই আছো।
- এ'ছাড়া আর গতি দেখি না। আপনার কী ব্যাপার বলুন দেখি মনুদা, এক্কেবারে ভ্যানিশ হয়ে গেলেন...।
- ফেয়ারওয়েলটা আদায় করা হয়নি বটে তোমাদের থেকে। বেশ নিজের ব্যাপারে দু'চারটে ভালো ভালো কথা শোনা যেত।
- আপনি এখন আছেন কোথায়?
- বৈদ্যবাটি।
- বৈদ্যবাটি! আপনার সেই রাজারহাটের পেল্লায় ফ্ল্যাট?
- চাকরীর সঙ্গে সঙ্গে সে'টাকেও বিদেয় করে দিলাম।
- সন্ন্যাসটন্ন্যাস নিয়েছেন নাকি?
- বৈদ্যবাটি জল-হাওয়া মন্দ নয় তবে সে'টাকে হিমালয় ভাবাটা বাড়াবাড়ি। তা অফিসের বাকি সবাই কেমন আছে? ফিনান্সের গুপ্তর বিয়েথা হলো?
- নাহ্‌। গুপ্তদা এ'বারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
- তা'তেই মঙ্গল।
- একদিন অফিসে আসুন না। পুরনো মানুষদের সঙ্গে খানিকক্ষণ আড্ডা দিলে মন্দ লাগবে না।
- সময়-সুযোগ পেলে একদিন আসবো'খন।
- তা, হঠাৎ বৈদ্যবাটি কেন? আপনার বাড়ি তো শুনেছিলাম মুর্শিদাবাদের দিকে।
- কার বাড়ি যে কোনদিকে ভায়া, তা ঠাহর করা বড় মুশকিল। তবে সন্ন্যাসের ব্যাপারটা পুরোটা মিথ্যে নয়।
- সে'খানে আখড়াটাখড়া কিছু খুলেছেন নাকি? আমি তো ভাবতাম আপনি এথেইস্ট।
- আসলে সুমির ক্যান্সারটা এমন অ্যাগ্রেসিভ স্টেজে ধরা পড়লো। বাড়ি-ঘরদোর বেচে দিয়েও মাস ছয়েকের বেশি টানা গেলো না। ঝোঁকের বশে মার্কিন প্রদেশেও গেছিলাম। লাভের লাভ কিছু হলো না। যা ছিলো সব দিয়ে তাঁকে ধরে রাখতে পারলাম না। বৈদ্যবাটিতে সুমির বাপের ভিটে ফাঁকা পড়েছিলো। তাই...।
- ওহ, আমরা কেউই অফিসে এত কিছু জানতেই পারলাম না...।
- জানলে বিচলিত হতে। কাজের কাজ কিন্তু কোনো কিছুই করা সম্ভব হতো না।
- হয়তো। তবু, এত সব কিছু চেপেচুপে রাখার কী দরকার ছিলো মনুদা।
- চেপেচুপে রাখলাম এদ্দিন। অথচ মানুষ কী বিচিত্র দ্যাখো, আজ সামান্য মিনিবাসের দেখায় গড়গড় করে কত কথা বেরিয়ে এলো

মিনিট দশেক পর মনুদা নেমে যাওয়ার সীটটা আমি দখল করলাম। ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়েছে। কথাবার্তা হবে হয়তো। ক্যান্সারের খরচপত্রের খবর আমার অজানা নয়, তবে মনুদার মুখে সে খরচের বহরটা শুনে আবারও বুক কেঁপে উঠলো। মনুদার মনে নেই হয়তো, আমার স্ত্রীর নামও সুমি। আমার সুমির যাতে কলকাতা না ছাড়তে হয় সে ব্যবস্থাটা আমার করে রাখতেই হবে। হিসেব কষে দেখেছি আজ গোটা দুপুর; মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স যা আছে তা'তে কোনো চিকিৎসাই সুবিধেমত হওয়ার নয়। বরং যতটা পারা যায় চেপেচুপে যাওয়াই ভালো। সব যখন মাস চারেক পর স্পষ্ট হবে, তখন সুমি চাইলেও আমাদের টালিগঞ্জের ফ্ল্যাট বেচে আর ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভেঙে আমায় চিকিৎসার দিকে ঠেলে দিয়ে কোন লাভ করতে পারবে না। কিন্তু এ খবর এখনই ফলাও হলে কী হবে কিছু বলা যাচ্ছে না। বড়জোর বছর খানেক বাড়তি থাকার জন্য বুবলুর ফিউচারটা ভাসিয়ে দিলে চলবে না কিছুতেই। বাস থেকে নেমে কাঁধের ব্যাগ থেকে বায়োপসি রিপোর্টটা ফোলিও থেকে বের করে ছিঁড়েখুঁড়ে একটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে একটা পেল্লায় ক্যাডবেরির প্যাকেট কিনলাম। মা-ছেলে দু'জনের স্যুইট-টুথই যে কী মারাত্মক ধারালো! সামনের সপ্তাহে একবার বৈদ্যবাটি যাওয়ার প্ল্যান করতে হবে। কাউকে অন্তত মন খুলে সমস্ত কথা না জানালেই নয়।

No comments: