কাঠমিস্ত্রি হিসেবে ভজনের সুনাম রাজ্যের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল একসময়। বিশেষত আরামকেদারা আর পালঙ্ক বানানোর ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ভজনের বয়স বড়জোর চব্বিশ অথচ তাঁর হাতের কাজের প্রশংসা রাজার কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছিলো। ভজনের বানানো আরামকেদারা আর পালঙ্ক নাকি দেব-ভোগ্য ব্যাপার। কিন্তু রাজার কান তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, তাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকে রাজার গোলমেলে মেজাজ। অতএব সেই সুনামই ভজনের কাল হলো। একদিন রাজা ঠিক করলেন যে ভজনের বানানো পালঙ্ক রাজকন্যাকে উপহার দেবেন। কথা মত ভজনের কর্মশালায় রাজার 'অর্ডার' পৌঁছে গেলো, বড় টাকা দিয়ে বায়নাও করা হলো। রাজার অর্ডার বলে কথা, এমন এক পালঙ্ক যাতে রাজকুমারী ঘুমোবেন। কাঠ সংগ্রহের কাজে অন্যকে ভরসা না করে নিজেই কুড়ুল কাঁধে জঙ্গলে গেলো ভজন। চারটে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে কাঠ এলো। ছেনি-হাতুড়ি ইত্যাদি সরঞ্জাম প্রস্তুত। শুভদিন দেখে কাজে হাত দিলেই হয়। এমন সময়; ভয়ানক ঝড়বৃষ্টিতে ভজনের কর্মশালার চালাঘর ভেঙেচুরে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। ভিজে কাঠ দিয়ে কাজ শুরু করা চলে না। এ'দিকে মাসখানেক সে বৃষ্টি থামলো না, সূর্যের মুখও দেখা গেলো না। ও'দিকে রাজরাজড়াদের অত বুঝদার হলে চলে না, পালঙ্কের কাজ শুরু না হওয়ায় রাজামশাই রেগে ফায়্যার হয়ে রাজপুরোহিতকে বললেন, "ওই ব্যাটাচ্ছেলেকে আমি কোতল করতে পারতাম। কিন্তু তার চেয়েও বড় কোনও শাস্তি দিতে চাই। ওর গলা কেটে হাত পা ভেঙে আমি শান্তি পাবো না। রাজকন্যার জন্মদিনে ও খাট আমার উপহার দেওয়ার কথা। এখন কোনও স্বর্ণকারকে দিয়ে পাতি সোনারূপোর খাট বানিয়ে বেচারিকে আমার তুষ্ট করতে হবে। যাক গে, রাজপুরোহিত, তুমি ব্যাটাচ্ছেলে ভজনকে এমন জম্পেশ একটা অভিশাপ দাও যাতে ওর মৃত্যুর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হয়"। আর রাজপুরোহিতেরও বলিহারি। তাঁর কাজই হলো ওই, রাজার স্বপ্ন অ্যানালাইজ করে আগডুম বাগডুম বলা অথবা এলেবেলে মানুষকে অভিশাপ দিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলা।
রাজপুরোহিতের অভিশাপে ভজন কাঠের কাজ গেল এক্কেবারে ভুলে। সে বেচারি একলা কাজ-পাগলা মানুষ। কাঠের কাজই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। সেই কাঠের কাজের তপস্যা ভুলে যাওয়ায় সে কেমন খ্যাপাটে হয়ে গেলো। ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিলো। মাঝেমধ্যে নিজের ছেনি-হাতুড়ি ধরে দেখতে গেলেই হাতে জ্বালা অনুভব করতো। জমিয়ে রাখা কাঠের দিকে চোখ পড়লেই শিউরে উঠতে হত। অসহ্য যন্ত্রণায় দিন কাটছিলো। ক্রমশ মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎটুকুও বন্ধ করে দিলো। সে ভুলে গেল কাঠের কাজের স্মৃতি, পালঙ্ক তৈরির কথা। রাজার অর্ডার আর রাজপুরোহিতের অভিশাপ, সবই মনের মধ্যে থেকে হারিয়ে গেলো। দু'দলা সেদ্ধ-ভাত কোনোদিন খেত, কোনোদিন খেত না। এমন সময় একদিন দুপুরবেলা, যখন সে তাঁর খাটের পাশের জানালায় থুতনি রেখে বসেছিল, তাঁর আলাপ হলো কনিয়ার সঙ্গে। কনিয়া একটি চড়ুইপাখি। সে নিজেই সেধে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে আলাপ জমিয়েছিলো। ভজনের ধারণা ছিলো চড়ুইপাখিরা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, এবং তাঁদের কিচিরমিচিরের মানেও মানুষ ধরতে পারে না। কী অদ্ভুত, কনিয়ার সঙ্গে আলাপ জমাতে ভজনের কোনও অসুবিধেই হলো না। ভজনের মনে হলো তাঁরা মাথাটা গেছে হয়তো, নইলে কিনা সে পাখির সঙ্গে গল্প জুড়তে পারে? কিন্তু কনিয়া এমন সদালাপী, সে'সব বাজে ভাবনাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না সে। অনেকদিন পর এই কনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পেরে যে বুকের মধ্যে সামান্য বল পেলো ভজন। এইভাবে মাসদুই কত গল্প চললো, কনিয়ার প্রশ্ন শেষ হতেই চায় না। পাশাপাশি ভজনের গল্পও শেষ হতে চায় না যেন। গল্পে গল্পে কী'ভাবে যেন ভজনের ঘায়ে মলম পড়া শুরু হলো। হঠাৎ একদিন টের পেলো যে আশেপাশে পড়ে থাকা কাঠের টুকরোর দিকে তাকিয়ে সে আর শিউরে উঠছে না। এ'ভাবেই হঠাৎ একদিন সে কনিয়াকে বলে উঠলো, "জানো কনিয়া, আমি এককালে এ রাজ্যের সেরা কাঠমিস্ত্রি ছিলাম। আর...আর...আর সে কাজ বোধহয় আমি একদম ভুলে যাইনি"। সে কথা শুনে কনিয়ার সে কী ডানা-ঝাপটানো আনন্দ।
দিন কয়েকের মাথায় ফের কাজে বসলে ভজন। রাজকন্যার পালঙ্কটা এ'বারে বানিয়ে না ফেললেই নয়। সন্ধে পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকে ভজন, গোটা ঘর জুড়ে টুকুর টুকুর ঠুকঠাক দুমদাম শব্দ; সে শব্দগুলোকে গানের মত এসে ঠেকে ভজনের কানে। আর সেই গানে নিজের কিচিরমিচির দিয়ে তাল মেলায় কনিয়া। তিন হপ্তার মাথায় একদিন; অপরূপ সে পালঙ্কে শেষ পালিশ চালিয়ে জানালার দিকে তাকাতে ভজন টের পেলে কনিয়া আর নেই, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আবার সে আসবে আলো ফুটলে। কিন্তু কী আশ্চর্য, পরের দিন সকাল হলো, সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যে। কনিয়া আর এলে না। ফিরে পাওয়া আনন্দ ফের ম্লান হয়ে গেল যেন, মুষড়ে পড়লে ভজন। দিনের হপ্তা গেল, কনিয়া কই?
হপ্তাখানেক পর, দুপুর নাগাদ। কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে হতবাক ভজন। সামনে যে অপার্থিব সুন্দরি দাঁড়িয়ে, তাঁর রূপের বাহার আর পোশাক-আভরণের জেল্লা দেখলে বোঝাই যায় এ নিশ্চয়ই এ রাজ্যের রাজকন্যা।
শশব্যস্ত হয়ে নুইয়ে দাঁড়ালে ভজন।
"আমার পালঙ্ক তো তৈরি, তবু আমায় ডাকলে না কেন"?
"আপনি...আপনি কী করে জানলেন এ পালঙ্ক তৈরি"?
"আমি যে কনিয়া। তোমার কনিয়া। আমার বাবার বিশ্রী খামখেয়ালের বশে রাজপুরোহিতে তোমায় অভিশাপ দিলে। দেবতা সে অভিশাপ ঠেকাতে পারেনি কিন্তু ব্যাপারটা ভালো চোখেও দেখেনি। দেবতা বাবা ও রাজপুরোহিতকে শায়েস্তা করতে আমায় চড়ুইপাখি বানিয়ে দিলে। এও বললে যে ভজনকে কাজে ফেরাতে না পারলে আমার মুক্তি নেই"।
"ওহ..."।
"অভিশাপ মিথ্যে হওয়া বড় সহজ কথা নয়। আমি ততদিন তোমায় কাজের দিকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি যতদিন শুধু নিজের মুক্তি কথা ভেবেছি। পেরেছি...তখনই পেরেছি...যখন...।
"যখন"?
"যখন আমি তোমায় ভালোবেসেছি, ভজন। মন দিয়ে ভালোবেসেছি, তাই তোমায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। এ'বার এ পালঙ্ক আমায় দাও, আর আমার ভালোবাসাটুকু নাও"।
"রাজকুমারী, এ পালঙ্ক আপনার জন্যই। আপনার ভৃত্যদের পাঠিয়ে দেবেন, এ পালঙ্ক তাঁরা রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবে"।
"কিন্তু আমি তো পালঙ্কের জন্য আসিনি ভজন..."।
"আপনি আসুন রাজকন্যা, আর আমায় আপনি ক্ষমা করবেন"।
"কিন্তু ভজন..."।
"আপনি রাজকন্যা, মহীয়সী। ইয়ে, সমস্যাটা হলো, আপনি যে আমার কনিয়া নন"।
রাজকুমারী বিদায় নিলে সদর দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্তে একটা আরামকেদারা ঘষামাজার কাজে মন দিলেন ভজন।
***
(ছবি: জেমিনাইতে বানানো)
No comments:
Post a Comment