Saturday, April 27, 2019

ওয়ার্নবাবুর বই


ফিল নাইটের ব্যাপারে আগে তেমন কিছু জানতাম না, যতটুকু জেনেছি ও চিনেছি; সে'টা ভদ্রলোকের চমৎকার আত্মজীবনীটা পড়ে। সে তুলনায় শেন ওয়ার্ন স্বাভাবিক ভাবেই বেশ কিছুটা পরিচিত। এবং পরিচিত বলেই তেমন কেউ রেকমেন্ড না করলেও বইটা পড়ে ফেলার আগে বেশি ভাবতে হয়নি। ফিল নাইটের আত্মজীবনী খুব ভালো লেগেছিল কারণ নাইট নিজের কথা বলতে গিয়ে ফোকাস করেছেন তাঁর চারপাশের মানুষের ওপর; সে'সব মানুষের চরিত্র যত ফুটে উঠেছে, পাঠকের কাছে তত স্পষ্ট হয়েছে নাইটের জীবন। এ'দিকে ওয়ার্নের বায়োগ্রাফি জুড়ে ওয়ার্ন দ্য রকস্টার, ওয়ার্ন দ্য ফাইটার, ওয়ার্ন দ্য ট্র্যাজিক হিরো এবং সর্বোপরি ওয়ার্ন দ্য অজি। ওয়ার্নের ক্রিকেট জীবনের অন্যতম গোলমেলে অধ্যায় বুকির থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনাটা। সে সম্বন্ধে ওয়ার্ন বেশ কিছু স্পষ্ট ইনফরমেশন দিয়েছেন বটে কিন্তু নিজের পক্ষে যে যুক্তিগুলো সাজিয়েছেন তা আমার অন্তত বেশ কাঁচা মনে হয়েছে। আর বই জুড়ে মাঝেমধ্যেই উঁকি মেরেছে তাঁর ধারালো নাক উঁচু মেজাজ; বিশেষত ড্যারিল কালিনান প্রসঙ্গে (অপ্রাসঙ্গিক ভাবেও তাঁকে কম খোঁচা মারেননি ওয়ার্ন)।

তবুও, এই বই আমি এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি এবং সবচেয়ে বড় কথা; স্বীকার করে নিয়েছি যে সাদায় কালোয় শেন ওয়ার্নদের বিচার করা মুশকিল। ভদ্রলোকের ঘ্যামকে কুর্নিশ না করে থাকা যায় না; খানিকটা ভক্তই হয়ে গেলাম বোধ হয়। এ বইকে 'মাস্ট রীড' (আমার মনে হয়েছে) কেন?

১। স্পিন বোলিংয়ের শিল্প নিয়ে ওয়ার্ন কথা বলতে শুরু করলে মনে হয় দুনিয়ার বাকি সব কিছু মুছে যাক; শুধু এ'টুকুই টিকে থাকুক। যে প্যাশন আর কঠোর মনঃসংযোগের গল্প শেন এ বইতে শুনিয়েছেন তা'তে চমৎকৃত হতেই হবে। উনি যখন স্পিন বোলিংয়ের টেকনিক নিয়ে আলোচনা করেছেন; আঙুল এবং হাতের তালুর পজিশনের কথা বলেছেন বা নিজের রান-আপ বিশ্লেষণ করেছেন; তখন ক্রিকেট-গবেট হয়েও আমার মনে হয়েছে হাতের কাছে একটা ক্রিকেট বল থাকলে একটু ফ্লাইট দেওয়ার চেষ্টাচরিত্র করে দেখা যেত। তাঁর স্পিন-কাহিনীকে অন্য স্তরে নিয়ে গিয়ে আলোচনা করেছেন ওয়ার্ন যখন তিনি স্পিন বোলিংয়ের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। লালমোহন হলে স্বীকার করতেন; "থ্রিলিং ব্যাপার মশাই"। স্পিন বোলিং স্রেফ প্রতি বলে উইকেট পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা নয়, বিভিন্নভাবে একজন ব্যাটসম্যানকে প্রস্তুত করতে হয়, এবং তারপর নিকেশ করতে হয় মোক্ষম চালে। বেয়নেটে ফালাফালা করে দেওয়ার গল্প স্পিন নয়, বরং নাকে নাক ঠেকিয়ে আদর করতে করতে একটা ধারালো ছুরি এমনভাবে গলায় ছুঁইয়ে দিতে হবে যেন কেউ গলায় পালক বুলিয়ে দিল; আর অমনি ঝরে পড়বে তাজা গরম রক্ত।

২। ইংলিশ ক্রিকেট কালচার। লক্ষ্মণের আত্মজীবনীতেও প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে সাহেবদের নিখাদ ক্রিকেট ভালোবাসার কথা আর সে ভালোবাসা থেকে তাঁদের ঘরোয়া ক্রিকেটও বঞ্চিত নয়। লক্ষ্মণের মতই তরুণ শেনও ক্রিকেটের গভীরে প্রবেশ করেন ইংল্যান্ডেই। আর অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ানদের খেলাধুলোর প্রতি ভালোবাসা, তাঁদের অধ্যবসায়। অজিরা একবগগা, ব্রিটিশরা নাকউঁচু; এ'সব জেনারালাইজেশনের মধ্যে যুক্তি খুঁজে লাভ নেই, তবে তাঁদের ক্রীড়া সংস্কৃতির সামনে আমাদের মাথা নুইয়ে দাঁড়াতেই হবে।  খেলা সাহেবদের কাছে ছেলেখেলার ব্যাপার নয়; ওয়ার্নের বইতে সেই কালচারের বিভিন্ন ভাবে আলোচিত হয়েছে। 

৩। বিভিন্ন ম্যাচ সিচুয়েশন ওয়ার্ন যে'ভাবে বর্ণনা করেছেন তা লাজওয়াব। এ ক্ষেত্রে অনেকটা প্রশংসা প্রাপ্য আমার প্রিয় ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাসের যিনি ওয়ার্নের হয়ে এই বই লিখেছেন। তবে এই বই যে মার্ক নিকোলাসের ভাষার খেল নয়, আগাগোড়াই ওয়ার্নের; তা স্পষ্ট। গ্যাটিং  বল থেকে সাতশো নম্বর উইকেট; শেনের পিওভি থেকে স্পষ্ট দেখা যায় পিচের রঙ, অনুভব করা যায় ঘাম, উত্তেজনা আর কপালে উড়ে আসা চুল।

৪। ওয়ার্নের ক্রিকেট মস্তিষ্ক আর তাঁর যাবতীয় মাইন্ড-গেম; স্রেফ এ'টুকু নিয়েই একটা নেটফ্লিক্স সিরিজ হতে পারে বোধ হয়। "দ্য বেস্ট ক্যাপ্টেন দ্যাট অস্ট্রেলিয়া নেভার হ্যাড"। সেই ক্যাপ্টেনকে একটানা বেশ কিছু বছর পেয়েছিল হ্যাম্পশায়ার আর কিছুদিনের জন্য রাজস্থান রয়্যালস। ক্যাপ্টেন ওয়ার্ন বলেছেন টীম তৈরির গল্প, বিপক্ষের মাথার মধ্যে ঢুকে সিঁদ কাটার গল্প। টোটকা দিয়ে বুঝিয়েছেন কেভিন পিটারসনের মত ম্যাভেরিককে বা ব্র্যাডম্যান-কাইফকে (হেহ্‌) কী ভাবে সামলাতে হবে। অধিনায়কত্ব প্রসঙ্গে বলা দরকার; সৌরভ সম্বন্ধে ওয়ার্ন যা বলেছেন তা দাদা-ভক্তদের যে 'থ্রিলিং' লাগবেই সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।

৫। অস্ট্রেলিয়ান টীমের গালগল্প আর টানাপোড়েনের কথা যে'ভাবে বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে 'গ্রিপিং'। ওয়ার্ন বেশ চাঁচাছোলা ভাবে সব কিছু বলে যেতে পারেন,কাজেই স্টিভ, বুকানন বা গিলক্রিস্টের সঙ্গে তাঁর মনমালিন্যের গল্পগুলো বেশ 'ছাল ছাড়ানো নুন মাখানো' লেভেলের। বিশেষত বুকাননের সঙ্গে তাঁর গুঁতোগুঁতির ঘটনাগুলো ওয়ার্ন যে'ভাবে বলেছেন তা অত্যন্ত উপভোগ্য (বুকাননের কর্পোরেট ট্রেনিং মডিউলগুলো ওয়ার্ন যে'ভাবে ছারখার করতেন, তা খানিকটা কমিকও বটে)। স্টিভ ও'র  সঙ্গে ওয়ার্নের মতানৈক্য সোজাসুজি দুই ধরণের জীবনধারার সংঘাত। ওয়ার্ন টিম অস্ট্রেলিয়ার প্রতি যে অনুগত ছিলে তা নিয়ে সন্দেহের বিশেষ কারণ নেই কিন্তু স্টিভ-গিলিদের ব্যাগি-গ্রিন স্তুতি বা 'ডিফাইনড স্কোপ অফ প্যাট্রিওটিজম' কে পাত্তা দেওয়ার বান্দা ওয়ার্ন ছিলেন না। আর পাত্তা দিলে তিনি আর যাই হোক ওয়ার্ন হতে পারতেন না। ইয়ে, খেলার বাইরে গিয়ে শচীন সম্বন্ধেও দু'চারটে কটু কথা শেনদাদাকে বলতে হয়েছে; কী এবং কেন সে'টা বললে স্পয়লার দেওয়ার হয়ে যাবে।

৬। জিনিয়াস হয়ে ওঠার 'প্রসেস' আর ট্র্যাজিক পরিণতিগুলো নিয়ে বেশ খোলতাই ভাবে কথা বলেছেন ওয়ার্ন। এই গোটা বইয়ে ওয়ার্নের সুর ভীষণ সোজাসাপটা। কিছুক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে ডিফেন্স  করেছেন বটে, তবে বইয়ের ফ্লো নষ্ট হয়নি তা'তে। ওয়ার্ন যে ওয়ার্ন হয়েই ফুটে উঠেছেন; সে'টাই এই বইয়ের সার্থকতা।

এই হাফ-ডজন কারণে ভর দিয়েই আবারও বলব; আমার এ বই পড়ে মনে হয়েছে "বাহ্‌, দুর্দান্ত"।

গিন্নী


- নরেন। নরেন!

- আরে দাসবাবু। এই ভরদুপুরে?

- বুড়োদের কি দুপুরবেলা বেরোতে নেই? তোমার ভাতঘুমে ব্যাঘাত ঘটালাম দেখছি। তা দোকান খুলে না ঝিমিয়ে,  দুপুরবেলা দোকান বন্ধ করে নাক ডাকলেই পারো তো।

- পুরনো অভ্যাস। অবশ্য মুদির দোকানে বিক্রিবাটা আজকাল কমের দিকেই। আর দুপুরে তো প্রায় কেউই..আপনাকে কী দেব?

- চা পাতা রাখো? ভালো কোয়ালিটির কিছু? বড় দোকান ছাড়া আমার প্রেফার্ড কোয়ালিটি পাওয়া দায়, কিন্তু বাড়ির কৌটো নিঃশেষ, আর্জেন্টলি কিছু না নিলে...।

- আমার কাছে আড়াইশো হাফকিলোর প্যাকেট কিছু আছে। তবে কোয়ালিটি আপনার কেমন লাগবে বলতে পারিনা। হাফডাস্ট, তেমন দামী নয়।

- আড়াইশোর একটা প্যাকেট দিও, যা ভালো মনে হয়। আর দু'শো গ্রাম গুড়ের বাতাসা।

- দিচ্ছি।

- আর শোনো, চানাচুর আছে? কড়া ঝাল কিছু?

- প্যাকেট করা না লুজ?

- ঝাল কোনটায় বেশি?

- লুজটায়। ওই যে, আপনার সামনেই যে'টা বয়ামে রাখা আছে।

- বেশ। ও'টা আধকিলো মত দিয়ে দাও।

- দাসবাবু, আজ আপনি নিজে বেরিয়েছেন জিনিসপত্র নিতে; আপনার সাগরেদটি কই?

- হরি? রাস্কেলটার নাম নিও না। ওর মুখ দেখলে আমার আজকাল জুতোপেটা করতে ইচ্ছে করছে।

- সে কিছু গোলমাল করেছে কি?

- করবে কী আবার। বাড়িতে চা পাতা ফুরিয়েছে অথচ তার কোনো হেলদোল নেই। এ'দিকে গতকাল রাত্রে কচুরশাক এমন জোলো রান্না করেছে যে মনে হচ্ছে মুখদর্শন করলে জীবন বিস্বাদ হয়ে পড়বে। অথচ দ্যাখো নরেন, হরির রান্নার হাত তো মন্দ নয়। আমার গিন্নী ওকে একদিকে যেমন ধেড়ে বয়সে প্রাণপাত করে ইংরেজি গ্রামার পড়িয়েছে, তেমনি মনপ্রাণ ঢেলে রান্না শিখিয়েছে। গিন্নী বেচারি আরো বছর তিনেক বাঁচলে হরিকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করিয়ে ছাড়ত। অথচ কোনো অ্যাপ্লিকেশন বা ফোকাস নেই ইডিয়টটার। আজ দুপুরের ছানার ডালনাতেও দেখলাম মশলা ঝোলে মেশেনি। ওকে আমি পারলে জেলে দিতাম গিন্নীর স্কুলিংকে এমন ভাবে ইনসাল্ট করার জন্য।

- অন্যায়ই বটে। তবে হরি ছেলে ভালো, আপনাকে মান্যি করে বেশ।

- থামো থামো। তোমায় আর ওর হয়ে বাটপাড়ি করতে হবে না। আর আমি ওর বেয়াদবি সহ্য করব না। গিন্নী গ্রাম থেকে একটা কালসাপ তুলে এনেছিল। হাড় জ্বালিয়ে শেষ করলে।

- এই যে আপনার জিনিসগুলো। খাতায় লিখে রাখছি। মাসের শেষে টাকা নিয়ে আসব।

- বেশ। আর শোনো, তোমার কাছে চকোলেট আছে?

- দশ কুড়ি টাকার কিছু?

- খুব ভালো কিছু?

- আমার কাছে ভালো বলতে এ'টা। ক্যাডবেরির। কিন্তু দাসবাবু, আপনার তো শুগার! এই বাতাসা আর চকোলেট...।

- ওই চকোলেট ছ'টা দাও। আর শুগার আমার শরীরে, হরি পারলে বাতাসার গুদাম চেটেপুটে সাফ করে ফেলতে পারে।

- ওহ্..।

- পরশু থেকে ওর উচ্চমাধ্যমিক।  চল্লিশ বছরের খোকা এই নিয়ে তিনবার এগজ্যাম দেবে। ছি ছি, আমার লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে। গিন্নীর নামে আর একবার গয়া গিয়ে পিণ্ডি দিতে হবে যদি আবারও ফেল করে। অপোগণ্ড। ব্ল্যাকশিপ কোথাকার। অথচ গিন্নী বলত হরিকে নাকি ও গ্র‍্যাজুয়েট করে ছাড়বে। যত বাজে কথা বলত বুড়ি।

- এই যে, চা, বাতাসা, চানাচুর আর চকোলেট।

- হরিকে আমি বলে রেখেছি। পরীক্ষার এই ক'দিন পাড়ার দোকান থেকে রুটি সবজি আনিয়ে খাবো, সে পড়ার বই ছেড়ে উঠলেই বেধড়ক লাঠিপেটা করব। তা বাদে ধরো দুপুর রোদে বেরিয়ে সর্দি লাগানো বারণ। বাতাসা হচ্ছে পড়ার সময় মুখে দিয়ে চুষবার জন্য, এনার্জাইজার; এমনিতেও গুড়ের বাতাসা হরির ছেলেবেলা থেকেই খুব প্রিয়। তাছাড়া রাতের দিকে পড়ার মাঝে ঘুম পেলে কড়া ঝাল চানাচুর হাফ-বাটি; অব্যর্থ। প্লাস প্রতি পরীক্ষার শেষে একটা গোটা চকোলেট। ফর্মুলাটা গিন্নীর; খুব এফেক্টিভ।

- তা বটে।

- ওহহো, নরেন। তোমার নজরে কোনো ভালো ছেলে আছে? আমার দেখভাল করবে, গোটাদিন সঙ্গে থাকবে। রান্নাবান্না করবে।

- হরিকে তাড়াবেন নাকি?

- হরিকে তাড়ালে গিন্নী নেমে এসে গলা টিপবে ভাই। তবে গিন্নীর বড় ইচ্ছে ছিল হরি অফিসে কাজ করবে, বাবুটি হয়ে। পাটনায় আমার এক আত্মীয়ের ফার্মে তার চাকরির ব্যবস্থা সেই কবে থেকে করা আছে, শর্ত শুধু একটাই; আগে সে ব্যাটাকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতে হবে। কিন্তু গবেটটা বছরের পর বছর ফেল করে যাচ্ছে, কী মুশকিল বলো দেখি। তবে এইবারে বুঝলে নরেন, ওর প্রেপারেশন আমি কড়াভাবে সুপারভাইজ করেছি, আমি নিশ্চিত ও পাশ করবেই...। যাকগে, ভালো ছেলের খোঁজ পেলে জানিও, কেমন?

 ***

প্রতিবার উচ্চমাধ্যমিকের সময় এলেই বুড়োবাবুর পাগলামো বাড়ে। তবে তাঁকে নিরস্ত করতেও মন সরে না হরির।  গিন্নীমার প্ল্যান মত বাবু তাকে পাটনায় পাঠিয়ে সাহেবি কেতায় চাকরী করাতে চান, কিন্তু বুড়োকে একা রেখে গেলেও কি গিন্নীমা শান্তি পাবেন?

বাবু বাইরে বেরোলে মাঝেমধ্যে দেওয়ালে টাঙানো গিন্নীমার বিশাল ফোটোটা নামিয়ে আনে হরি। ফটোফ্রেমের পিছনে লুকনো নিজের দু'বছর আগে পাওয়া উচ্চমাধ্যমিক পাশের সার্টিফিকেটটা বের করে আনে সে।

সেকেন্ড ডিভিশন। গিন্নীমার বড় ইচ্ছে ছিল সে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করবে। কিন্তু কত কিছুই তো পুরোপুরি হয়না, খাপছাড়া হওয়াগুলোই বা কম কীসে। গিন্নীমার কথা মনে এলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আর চোখ ঝাপসা হলেই সে'দিন তার হাতের রান্নার স্বাদ পানসে হয়ে পড়বেই।

Saturday, April 20, 2019

কে হবে সেরা!

বিচারক ১ - আসর মাতিয়ে দিলি রে ভাই৷ কী বুকনি! কী বাতেলা! আর বাজে কথা বলার কী কনফিডেন্স।

প্রতিযোগী (নতশির, বুকে হাত) - থ্যাঙ্কিউ স্যার, থ্যাঙ্কিউ।

বিচারক ১ - তিরিশ মিনিটের বক্তৃতায় তুই অন্তত বেয়াল্লিশখানা মিথ্যে বলেছিস। আমি গুনেছি।  কিন্তু একবারের জন্যেও তোর গলা কাঁপেনি। শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছে ভাই। উফফফ্।

সঞ্চালক - গায়ে কাঁটা?  কই দেখি গাঁজাদা!

বিচারক ১ (হাতের জামা গুটিয়ে) - এই দ্যাখো। আমি থ্রিলড। আমি আপ্লুত। ও এত জেনুইনলি সব মিথ্যে প্রতিশ্রুতিগুলো পাবলিককে ছুঁড়ে মারছিল যে আমার ইচ্ছে করছিল ওকে ভাষণের মধ্যেই জড়িয়ে ধরি।

সঞ্চালক - তা'হলে তোমার তরফ থেকে দশে দশ?

বিচারক - দশে সোয়া দশ দেওয়া গেলে তৃপ্তি পেতাম। তবে অঙ্ক ব্যাপারটা এমন ত্যাঁদড়..। ওই দশই থাক।

প্রতিযোগী (নতশির, বুকে হাত) - থ্যাঙ্কিউ স্যার, থ্যাঙ্কিউ।

সঞ্চালক - একটা সানসেট চব্যনপ্রাশ মার্কা জোরে হাততালি হয়ে যাক।

প্রতিযোগী (নতশির, বুকে হাত, ক্যামেরা জুম করলে দেখা যাবে চোখের চিকচিক) - থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ।

সঞ্চালক - এ'বার চলে যাব পরের বিচারক গুলতানিদিদির কাছে।

বিচারক ২ - ও যখন ভাষণের সময় মাইক্রোফন খামচে আঙুল নাচাচ্ছিল, তখন ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ওই পারবে। ও ঠিক পারবে। ও পারবে সংবিধানের বই নিয়ে খাটের পায়ার নীচে গ্যাটিস দিতে। ওর ভাষণের গুণে এই মঞ্চ আজ সত্যিই ব্রিগেড হয়ে উঠেছিল। ওর জন্য রইল আমার স্ট্যান্ডিং ওভেশন। (দাঁড়িয়ে পড়ে হাততালি)

প্রতিযোগী (নতজানু, নতশির, বুকে হাত) - থ্যাঙ্কিউ দিদি, থ্যাঙ্কিউ।

বিচারক ২ - আই লাভ ইউ রে। তুই কী করে পারিস এত বিষাক্ত সুরে বক্তৃতা দিতে? অনেক আদর নিস বাবু। তবে আমার আরো একটু আবদার আছে। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, বাতেলা এ'সব তোর যথেষ্ট পাঞ্চ ছিল। গুড। এমন কী প্রতিপক্ষের চরিত্র তাক করে কাদাও কম ছুঁড়িসনি। কিন্তু ধর্ম নিয়ে সুড়সুড়িটা বাদ দিলি কেন? ওই ব্যাপারটায় তোর আত্মবিশ্বাস এখনও নড়বড়ে কি? ভুলে যাস না সামনের রাউন্ডগুলো কিন্তু আরো কঠিন হবে৷ ক্রিটিসাইজ করছি না, স্রেফ সাজেশন একটু ভেবে দেখিস।

প্রতিযোগী (চিন্তিত মুখ, তবু নতশির, তবু বুকে হাত) - থ্যাঙ্কিউ দিদি, থ্যাঙ্কিউ।

সঞ্চালক - গুলতানিদিদি, এ'বার নম্বরটা শুনি।

বিচারক ২ - দশে দশ। আর প্রতিপক্ষের নামে মিথ্যে খিস্তি দারুণ দাপটের সঙ্গে ছড়ানোর জন্য আমার পক্ষ থেকে একটা বোনাস চুমু। মুয়াহ্।

সঞ্চালক - ফাটাফাটি। কুড়িতে কুড়ি। একটা সানসেট চব্যনপ্রাশ মার্কা জোরে হাততালি হয়ে যাক।

প্রতিযোগী (নতশির, বুকে হাত, ক্যামেরা জুম করলে দেখা যাবে চোখের চিকচিক) - থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ।

সঞ্চালক - এ'বারে বুথদখলকাকু, তুমি বলো তোমার কেমন লেগেছে ওর ভাষণ।

বিচারক ৩ - এই মঞ্চটা অনেক উঁচু।  অনেক।  অনেক। গাঁজা, গুলতানি প্রশংসা করেছে, আমি শুনেছি। ওদের বিচার আমার সর আঁখো পর। কিন্তু...। কিন্তু কিছু করওয়া সচ্ আমায় বলতেই হবে।

প্রতিযোগী - (মুখের ওপর কালচে নীল আলো, নতশির)

বিচারক ৩ - মিথ্যে প্রতিশ্রুতি,  বাজে বাতেলা, খিস্তিখেউড়; এ'সব তুই ভালোই নিভিয়েছিস। কিন্তু বেটা, পলিটিকাল র‍্যালিতে পাবলিক আরো বেশি কিছু চায়। কুছ এক্সট্রা। মানছি এ যুগে ডাইরেক্ট লার্জ স্কেলে লাশ ফেলার প্রমিস করা আসান নয়। কিন্তু চাপা থ্রেট দিবি না? নীচুতলার কর্মীরা মোটিভেটেড হবে কী করে? এত টাকা দিয়ে তবে গুণ্ডা পুষবে কেন পার্টি? ভুলে যাস না এ মঞ্চটার নাম "কে হবে বাংলার সেরা ব্রিগেড-নেতা"! যে সেরা, তারা কাছে সব রকম ওয়েপন থাকতে হবে।

বিচারক ১ - এ জন্যেই বুথদখলকাকু গুরুদেব। (উঠে এসে বিচারক ৩য়ের হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম)।

বিচারক ২ - (উঠে এসে বিচারক ৩য়ের হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম)

সঞ্চালক - (বিচারক ৩য়ের হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম)

(ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিনে 'মঙ্গলদীপ জ্বলে অন্ধকারে দু'চোখ আলোয় ভরো প্রভু')

বিচারক ৩ (প্রতিযোগীর দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে) - তবে তুই ভালোই বলেছিস। তোর এমপি হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্তু এই মঞ্চ থেকে যে সেরা হবে সে শুধু ব্রিগেড কাঁপাবে না, সে দেশ আর রাজ্য কাঁপাবে মন্ত্রী হয়ে। ইফ পসিবল চীফমিনিস্টার বার প্রাইমমিনিস্টার হয়ে। নিজেকে এই ওয়াদাটা কর আর নেভা। বুঝেছিস?

প্রতিযোগী - (নতশির, বুকে হাত, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন)

বিচারক ৩ - আমার তরফ থেকে তোর জন্য দশে নয়। পরের বার যেন দশে দশ হয়। ভাষণে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার কথা বলতে হবে।

সঞ্চালক - ফাটাফাটি। তিরিশে উনত্রিশ। একটা সানসেট চব্যনপ্রাশ মার্কা জোরে হাততালি হয়ে যাক।

প্রতিযোগী (নতশির, বুকে হাত, ক্যামেরা জুম করলে দেখা যাবে চোখের চিকচিক) - থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ।

Tuesday, April 9, 2019

দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ থার্ড রাইখ প্রসঙ্গে



রাইজ অ্যান্ড ফল অফ থার্ড রাইখ। সাতান্ন ঘণ্টার অডিও বই, শুনলাম প্রায় দেড় মাস সময় নিয়ে। ভাবনাচিন্তা রসদ প্রচুর জুটেছে , কিন্তু সে'সব গুছিয়ে যত্ন করে লিখতে পারলে হয়। এ বইয়ের ব্যাপারে রিভিউ-মূলক কিছু বলার ক্ষমতা (বা পড়াশুনো) আমার নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে আমার আগ্রহ বহুদিনের; আর এই বইটা পড়ার আগে এ বিষয়ে আমার যাবতীয় জ্ঞানের উৎস মূলত ছিল নেটফ্লিক্স, ইউটিউবে দেখা বেশ কিছু ডকুমেন্টারি এবং ইন্টারনেটের পড়াশোনা (সে পড়াশোনা পুরোটা আনতাবড়ি নয়, বেশ কিছুটা হিসেব করেই পড়া)। আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির মত কিছু বই অথবা শিন্ডলার্স লিস্টের  মত হলোকস্ট বিষয়ক বেশি কিছু সিনেমা আমরা অনেকেই পড়েছি/দেখেছি তবে সে’গুলো সামগ্রিক ভাবে ‘ইনফরমেশন-রিচ্‌’ নয়। 

আগে এই বইয়ের ব্যাপারে দু’চারটে কথা বলি। 

১। বইয়ের দৈর্ঘ্য ঘাবড়ে দেওয়ার মত, কিন্তু বইয়ের ভিতরে ঢুকে যেতে পারলে পাঠক বুঝতে পারবেন যে থার্ড রাইখকে সম্যকভাবে বুঝতে গেলে অসীম ধৈর্যের কোনও বিকল্প নেই। দুম করে একজন ক্যারিসম্যাটিক খুনে মানুষ গোটা জাতকে হিপনোটাইজ করে ক্ষমতা দখল করলে এবং গোটা ইউরোপকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিল; ইতিহাস ততটা স্কেল-বসিয়ে-পেন্সিল-টানা'র মত সরল নয়। নাৎসি সন্ত্রাসের দায় মুষ্টিমেয় কিছু উন্মাদের ঘাড়ে চাপিয়ে 'আহা উঁহু' করলে রীতিমত অন্যায় হবে। এই বিপর্যয়ের পিছনে জার্মান জাতের ভূমিকা, ইউরোপের অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মদত বা পিঠ-বাঁচানো আশকারা; এই সমস্ত দিকগুলোর ওপর অলোকপাত করেছেন লেখক। এবং সে কাজের জন্য তিনি অনবরত ব্যবহার করেছেন 'হার্ড এভিডেন্স'।  

২। অ্যাডলফ হিটলারের সাধারণ সৈনিক থেকে জার্মানির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা এবং তাঁর নষ্ট হয়ে যাওয়া, নাৎসি মত্ততার শুরু এবং শেষ; সমস্তটাই সোজাসাপটা মোগাম্বো এলো, মোগাম্বো গেলো গোছের মুগুর পেটানো মোটা দাগের গল্প নয়। এর মাঝে রয়েছে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং বিভিন্ন ইডওলজির টানাহ্যাঁচড়া। সেই টানাহ্যাঁচড়াগুলো সম্বন্ধ খানিকটা ভাসাভাসা ধারনা ছিল, এই বইতে সে’সব বিষয়ে বিশদ (এবং মনোগ্রাহী) আলোচনা রয়েছে। 

৩। নাৎসি ইতিহাস ‘রিকন্সট্রাক্ট’ করতে গিয়ে লেখক পদে পদে কোট করেছেন সরকারি দলিল দস্তাবেজ, বিভিন্ন ডায়েরির পাতা, সে’যুগের বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট, বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, বই ইত্যাদি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় এবং ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল পর্যন্ত লেখক যে মর্মান্তিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন; তা'তে দুর্দান্ত ভাবে ব্যবহার করেছে মাপা প্রমাণ এবং ধারালো সব যুক্তি যা নিশ্চিতভাবেই বিস্তর পরিশ্রম করে যোগাড় করতে হয়েছে। অতএব অসংখ্য ফুটনোট এ বইয়ের এক অবিচ্ছেদ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

৪। ইহুদী নিধন এবং খুনে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো নিয়ে বেশ কিছু লেখা আগেই পড়েছি, প্রচুর ডকুমেন্টারি এবং সিনেমাও রয়েছে। ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক অধ্যায় হয়ত খুব বেশি নেই; কাজেই এ নিয়ে যে প্রচুর হৃদয় নিঙড়ানো লেখালিখি হবে; সে’টাই স্বাভাবিক এবং উচিৎ। এ বইতেও সে’সব নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেছেন লেখক। কিন্তু তা মূল যুদ্ধের ইতিবৃত্তকে ঢেকে দেয়নি। হিটলার তাঁর ইহুদী নিধন বা ফাইনাল সলিউশনের ভয়াবহতার জন্য যুদ্ধে হারেননি। তেমনি, স্রেফ মানবিকতার হয়ে লড়ে জেতেনি ব্রিটেন, রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মর্মান্তিক হলেও সে'টাই সত্যি। যুদ্ধের হারজিত নির্ধারিত হয়েছিল বরফ-শীতল ‘স্ট্র্যাটেজি-গেম’য়ে। যাবতীয় শয়তানি সত্ত্বেও হিটলার দিব্যি পার পেয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু পারেননি সেই স্ট্র্যাটেজির দোষে। থার্ড রাইখের ভেঙে পড়ার পিছনে রয়েছে সামরিক নীতির ভুল। অবশ্য হিটলারের সামরিক -মাস্টারস্ট্রোকই একসময় নাৎসি জার্মানিকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য। অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে সেই সামরিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক। 

৫। নাৎসিদের ক্ষমতায় আসা, হিটলারের আগ্রাসন, মুসোলিনির সঙ্গে আঁতাত, পোল্যান্ড ও ফ্রান্স দখল, রাশিয়া আক্রমণ, জাপান আর আমেরিকার যুদ্ধে যোগদান; এ’সব বহু আলোচিত বিষয়। এই বইতে সে’সব সম্বন্ধে সবিস্তারে জানাই যায়। কিন্তু নাৎসিদের আগ্রাসনের মুখে পড়া অন্যান্য দেশের ইতিহাস ঘাঁটলেও বেরিয়ে আসবে চমৎকৃত হওয়ার মত বহু ঘটনা, দুর্দান্ত কিছু চরিত্র। সে'খানেও রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা ও দুঃসাহসের ট্র্যাজিক বহু গল্প। অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, নরওয়ে এবং আরও কত দেশকে দাঁড়াতে হয়েছিল ধ্বংসের মুখে; ইতিহাসের সে'সব জরুরী অংশগুলো এ বইতে উপেক্ষিত হয়নি, আগ্রহী পাঠক হিসেবে সে'টা একটা বড় পাওনা। 

৬। বইয়ের শেষ প্রান্তে এক জায়গায় লেখক হিটলারকে বলেছেন “ম্যাড জিনিয়াস”। সেই ‘ম্যাডনেস’ হিটলারকে টেনে তুলেছিল সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে এবং সেই ম্যাডনেসই আবার হিটলারকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল, রেহাই পায়নি জার্মানিও:। সঙ্গে দুরমুশ করেছিল ইউরোপের একটা বড় অংশকে। সেই ‘জিনিয়াস’কে বইয়ের পাতায় স্পষ্ট ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছেন লেখক। তাঁর ইডিওসিঙ্ক্রেসি, তাঁর পাগলামো, তাঁর মেগালোমেনিয়া, তাঁর পাশবিক চিন্তাভাবনা, তাঁর সামরিক মেধা, তাঁর একগুঁয়েমি আর সর্বোপরি তাঁর বীভৎস পরিকল্পনাগুলো; সব মিলে যে রুবিক কিউব, তা নিখুঁত ভাবে সাজিয়েছেন লেখক। 

৭। হিটলার নিঃসন্দেহে জিনিয়াস। কিন্তু এক জিনিয়াসের শয়তানিতে একটা গোটা দেশ ভেসে যেতে পারে? না। খুনে রাষ্ট্রনেতারা তিলে তিলে গড়ে ওঠেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে। তাঁকে গড়ে তোলেন তাঁর রাষ্ট্র। সেই জার্মান রাষ্ট্রের কথা বিশদে লেখা হয়েছে এ বইতে। সবিস্তারে বলা হয়েছে জার্মানির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা। যথেষ্ট ডেটা দিয়ে মজবুত ভাবে পরিবেশিত সমস্ত যুক্তি দিয়ে দেখানো হয়েছে কী’ভাবে ভার্সেই চুক্তি থেকে ওয়েমার রিপাবলিক হয়ে জার্মানি ভেসে গেছিল নাৎসি  উন্মত্ততায়। এ বই সেই জার্মানি এবং গোটা জার্মান জাতের তিন দশকের বায়োগ্রাফিও বটে। 

৮। যুদ্ধ-চলাকালীন জার্মানিতে খোদ হিটলারের বিরুদ্ধে প্রচুর চক্রান্তও হয়েছে। সে’সব ‘হাই ট্রিজন’ বিষয়ক রোমহর্ষক সব গল্প রয়েছে এ বইতে। 

৯। নাৎসিদের ডালপালা ছড়ানোর সময় ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকাটা যে হিটলারকে কতটা মদতপুষ্ট করেছে, তা সবিস্তারে বলা হয়েছে। নিজেদের পিঠে আগুনের ফোসকাও দিব্যি হজম করে নিয়েছিল এই দুই দেশ, মেকি শান্তি বজার রাখার অলস লোভে। গায়ে দাউদাউ করে আগুন লাগার পর তারা জেগেছে, কিন্তু ততক্ষণে হিটলার বাঁধনছাড়া। আর এ বইয়ের অনেকটা জুড়ে আছে স্তালিনের রাশিয়া। তারা হিটলারের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলেছে বহুদিন; কিছুটা সমীহ করে আর অনেকটা লোভে। পোল্যান্ড  দখলে স্তালিনের ভূমিকাও কম ভয়াবহ নয়। এ’সব ভাসাভাসা ভাবে সবাই জানেন; কিন্তু এ বইতে 'সুপারপাওয়ার'দের সে’সব ব্যর্থতাই হয়ে উঠেছে টানটান উপন্যাস ও ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির রসদ। আর সেই টানটান উপন্যাসের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে দুর্দান্ত কিছু গল্প; যেমন মলোটভের সঙ্গে হিটলারের মোলাকাতের তুখোড় বর্ণনা। পাশাপাশি রয়েছে হিটলার মুসোলিনির ট্র্যাজি-কমিক ধান্দাবাজ আদানপ্রদান ও গোলমেলে বন্ধুত্বের রসালো বিশ্লেষণ।    

মোদ্দা কথাটা হল, এ বই পড়তে হলে ইতিহাসের গুরুগম্ভীর ছাত্র হওয়ার কোনও দরকার নেই। সাধারণ রাজনৈতিক ‘কিউরিওসিটি’ থাকলেই উইলিয়াম শিরার সাহেবের এ বই প্রচুর ভাবনা চিন্তার রসদ জোগাবে। লেখক অতি-খ্রিস্টান এবং বইয়ের কিছু জায়গায় তাঁর হোমোসেক্সুয়ালিটির প্রতি বীতরাগ বিশ্রী ভাবে ফুটে উঠেছে বটে। কিন্তু বইয়ের মূল বক্তব্য এবং রিসার্চ সম্ভবত তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।  

বইটা কয়েকদিন আগে শেষ করেছি। কিছু কিছু বিষয় নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা মাথায় ভিড় করছে। সে ভাবনাচিন্তাগুলোর অন্যের তেমন কাজে না লাগুক, নিজের রেফারেন্সের স্বার্থেই লিখে রাখা জরুরী। 

ক। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং তাদের মতবাদের প্রতি নিজেকে/নিজেদের অন্ধভাবে সঁপে দেওয়া যে কী নিদারুণ, তার জ্বলন্ত উদাহরণ নাৎসি জার্মানি। ক্ষমতায় যিনি রয়েছেন তাঁকে নিন্দের তোপের মুখে ফেলাটা বেঠিক তো নয়ই, বরং সে'টাই কর্তব্য। বিরোধীরা যেমন বিভিন্ন কারণে (হয়ত বা) সমান দোষে দুষ্ট, কিন্তু তবু নিন্দে-মন্দর ধারালো তরবারি মূলত তাক করে রাখতে হবে সরকারের দিকেই। কেন? কারণ যাবতীয় 'রিসোর্স' তাঁদের কবজায়। পুলিশ ,সেনাবাহিনী, সরকারি কোষাগার এবং আইন যাদের হাতে রয়েছে; তাঁদের যদি সমালোচনায় অনীহা দেখা দেয় তা'হলেই বিপদ। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিন্দে সহ্য করতে হবে বৈকি, আর দেশের প্রধানমন্ত্রীর সহ্য ক্ষমতা হতে হবে আরও বেশি। এমন কী শুধু নিন্দে হজম করেই সরকারের কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না; তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে যাতে বিরোধী মতবাদগুলো নিশ্চিন্তে ডানা মেলার সুযোগ পায়। সম্ভবত, নাগরিক হিসেবে এ'টাই হওয়া উচিৎ আমাদের মূল দাবী। রাজ্যের তৃণমূল সরকার বা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে তাই সবচেয়ে বেশি ক্ষুরধার সমালোচনা শুনতে হবে এবং সবার চেয়ে বেশি দায়ভার গ্রহণ করতে হবে; সে'টাই স্বাভাবিক। এবং বিজেপির বদলে যদি কংগ্রেস বা তৃণমূলের বদলে সিপিএম হলেও দাবীটা যেন একই থাকে। 

খ। এক দাগে গোটা জাতকে দাগিয়ে দেওয়া বেশ বিপদজনক। এ অভ্যাস আমাদের সকলের আছে। বাঙালির কোনও অংশে কম নেই। সেই অভ্যাস থেকে তৈরি হয় বিশ্রী হাসি-ঠাট্টা যা অতি সহজেই 'জেনারালাইজ' করে আঘাত হানে বিভিন্ন জাত/ধর্ম/ভাষার মানুষের প্রতি। আর সেই হাসি-ঠাট্টার  আড়ালে বাড়তে থাকে বীতরাগ, চেগে ওঠে ঘেন্না। সেই জাতিগত ঘেন্না যে কী ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই থার্ড রাইখ।

গ। হিটলার এবং ফাইনাল সলিউশনের মত হিংস্র উন্মাদনার ব্যাপারে জানলে বা শুনলে আজ আমাদের গা-ঘিনঘিন করে ওঠে, স্বাভাবিক। কিন্তু পাশাপাশি গা শিউরে ওঠে এ'টা ভাবলে যে ভাগ্যিস হিটলার যুদ্ধে হেরেছিলেন তাই তাঁর শয়তানিগুলো গোটা বিশ্বের সামনে প্রকট হয়েছিল। কতশত হিটলার হয়ত যুদ্ধে জিতে নিজেদের কুকর্মগুলোর ওপর দিব্যি পালিশ মেরে সুখে থেকেছেন/আছেন। এ'টা ভাবলেই হাত পা ঠাণ্ডা হওয়ার যোগাড় হয়। 

আরও বেশ কিছু এলোমেলো ভাবনা চিন্তা লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সহজ ভাষায় 'বইটা পড়ে দেখুন' বলার বদলে এতটা পাঁয়তারা কষে এমনিতেই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি বলে মনে হচ্ছে, লেখাটা অহেতুক লম্বা না হয় নাই করলাম।  

Thursday, April 4, 2019

আলুসেদ্ধ-রাইখ


- বুঝলে ভায়া রুমমেট, শুকনোলঙ্কা ভাজা দিয়ে আলুসেদ্ধ মাখব আজ।

- রাজভোগ বলতে তো ওই মন্টুদা। যেদিনই রান্নাঘরে ঢুকবে সে'দিনই কপালে শুধু ডাল, ওমলেট। ঝোলভাত খেতে হলে সেই আমাকেই কড়াই ঠেলতে হবে।

- অমন নেগেটিভলি প্যানপ্যান কোরো না তো। এ আলুসেদ্ধর গন্ধ অমরাবতীতে পৌঁছলে ইন্দ্র সাদাহাতি হাঁকিয়ে নেমে আসত। তুলতুলে মাখা, ঘি আর সর্ষের তেল মিশিয়ে। আর তারপর ভাজা শুকনো লঙ্কার পাঞ্চ। এক খাবলা লালচে হলুদ রঙের ড্যালা থালার পাশে থাকলে রুইমাছের দিকেও তাকাতে ইচ্ছে করবে না।

- আমার তো কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধই ভালো লাগে। অত শুকনো লঙ্কার ঝাল হজম হয়না।

- আইপিএল দেখে দেখে তোমার কলজে উইক হয়ে গেছে ভাই। রমেশ সিপ্পির সিনেমা দ্যাখো, ঝাল অ্যাবসর্ব করার ক্যাপাসিটি বাড়বে।

- অন্তত ডিমের ঝোল করো না মন্টুদা। প্লীজ। মনের সুখে দু'টো ভাত মেখে খাওয়া যাবে।

- প্র‍্যাক্টিসিং ব্র‍্যাহ্মিন আমি। পাঁঠা ছাড়া ঝোল রাঁধব? বলো কী! তেন্ডুলকারকে দিয়ে লুডো খেলাবে ভাই?

- তুমি পলিটিক্সে নামো, বুঝলে।

- আমি নামলে হে, সব্বাইকে শায়েস্তা করব ফেলতাম। ব্রিগেডে সভা ডাকতাম, বুঝলে? ব্রিগেডে। ভীড়ের প্রত্যেকের জন্য ইয়াব্বড় এক থালা ভাত, পেঁয়াজ দেওয়া মুসুর ডাল আর আমার স্পেশ্যাল আলুসেদ্ধ। পাতের শেষে তালমিছরি, পেট ঠাণ্ডা রাখার জন্য।

- অন্যেরা বিরয়ানি খাওয়ায়, তোমার দল আলুসেদ্ধ-ভাত খাওয়ালে লাটে উঠবে যে।

- তোমার মুণ্ডু। বাতেলা আর ওই ডালডা বিরিয়ানি, দুইই গুরুপাক। আর নিজের হাত মাখা বিরিয়ানি, তা'তে কী পরিমাণে  দরদ রয়েছে ভেবেছ?  লোকে 'যুদ্ধ নয় আলুসেদ্ধ চাই' কোটেশন বুকে উল্কি করাত। সে আলুসেদ্ধ মাখার ইউটিউব ভিডিওই হত আমার ম্যানিফেস্টো; পাইড পাইপার হতে সময় লাগত না। পাঁচ বছরে চীফমিনিস্টার, সাতে প্রাইম। এ মখমলে আলুসেদ্ধর গুণে সবাই সাবমিট করত হে। সবাই পায়ের সামনে "যেয়াজ্ঞা" বলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ত। সবাই। জিরো অপোজিশন।

- আলুসেদ্ধ ফ্যাসিস্ট?

- এফেক্টিভ। ভেবে দ্যাখো, পাকিস্তানের উজির-এ-আজম যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন।  থমথমে পরিস্থিতি, যুদ্ধ রুখতে শেষ চেষ্টা; শিমলায় মিটিং। টেবিলের ও'পাশে যুদ্ধংদেহী প্রাইমমিনিস্টার গজরগজর করে চলেছেন, এ পাশে আমি একগাল হাসি নিয়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা পরে অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় আলুসেদ্ধ মেখে চলেছি। ঘর জুড়ে ভাজাশুকনোলঙ্কার সুবাস। এই তোমায় বলে রাখলাম আমি, সবাই তোমার মত পাষাণ নয়; আধঘণ্টার মাথায় পাকিস্তানি প্রাইমমিনিস্টার যদি 'সরি স্যার, কিছু মনে করেননি তো"? বলে রণেভঙ্গ না দেয়, তবে আমার নাম মন্টু মিত্র নয়। সিকিউরিটি কাউন্সিলের সীটে আমার জন্য সবসময় রুমাল পাতা থাকবে, সে'খান পর্যন্ত পৌঁছে দেবে আমার আলুসেদ্ধ মাখা। সমস্তটাই দরদের ব্যাপার ভাই, অনেকটা গানের মত।

- বাহ্,  আলুসেদ্ধ রাইখ।

- ঠাট্টা করছ?

- নাহ্, ভাবছি আজকের রান্নাটাও আমিই করি মন্টুদা। আমার হাতের ডিমের ঝোল তোমার মুখে রুচবে তো?

- অমন করে বলছ, না করি কী করে। আমি দরদের কাঙাল যে। ব্রিগেডে আমার আলুসেদ্ধর পাশাপাশি লাঞ্চের বাক্সে তোমার ডিমের ঝোলও রাখব ভায়া। রাজ্যে হোম মিনিস্ট্রিটা তোমার। সেন্টারে গেলে ডিফেন্স। পোর্টফোলিও পছন্দ হয়েছে?

Monday, April 1, 2019

এপ্রিল ফুল

জয়ন্ত সমাদ্দার লোকটা যে সুবিধের নয় তা আমি আগেই আঁচ করেছিলাম। বছর দুয়েক আগে সে আমাদের অফিসে জয়েন করেছিল। আমার চেয়ে বয়সে বছর খানেক ছোটই হবে, এখনও চল্লিশে ছুঁয়েছে বলে মনে হয়না। এমনিতে হাসিখুশি আর চটপটে; আড্ডা জমাতেও ওর জুড়ি নেই। আর তার নেশা বলতে হিন্দি সিনেমা আর জর্দা পান। সবসময় জাবর কেটে চলেছে; আড্ডায় বসলে নিজের পকেট থেকে পান বিলি করে লোকের মন জয় করতেও ওর জুড়ি নেই। তবে যে ব্যাপারটা আমার বিরক্তিকর ঠেকে তা হল ওর অকারণে ফাজলামোর অভ্যাসটা। লাঞ্চ-টাইমে লোক-ঠকানো বাজে গল্প যা কিছু ফেঁদে বসে তা নিতান্ত নিরস অবশ্য নয়, কিন্তু গত বছর পয়লা এপ্রিল সে আমার সঙ্গে যা করেছিল তা ক্ষমার অযোগ্য।

সে’দিন সকালে অফিস পৌঁছেই দেখি টেবিলের ওপর বড়সাহেবের চিঠি; তা পড়ে তো আমার চক্ষু-চড়কগাছ। আমি নাকি একটা জরুরী ফাইলে বড়সড় ভুল করে ফেলেছি, তা’তে কোম্পানির লাখ-খানেক টাকা ক্ষতি হয়েছে। সে কারণে আমার একমাসের মাইনে কাটা হবে। তার ওপর আমায় শো’কজও করা হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে সদুত্তর দিতে না পারলে সাসপেনশন; বরখাস্তও হতে পারি। কথা নেই বার্তা নেই; এমন আকস্মিক খবরে স্বাভাবিক ভাবেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হার্ট-অ্যাটাক যে হয়নি তা চোদ্দপুরুষের  ভাগ্যি। কতবার মনে করার চেষ্টা করলাম কোন ফাইলের কাজে তেমন গোলমেলে ভুল হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না। এ’দিকে এই বাজারে চাকরী নিয়ে টানাটানি পড়লে যে কী বিশ্রী ব্যাপার হবে তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। একটানা সতেরো বছর এই কোম্পানিতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছি; কী কারণে এমন ভাগ্য বিপর্যয় ঘটল তা কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলাম না। সাতপাঁচ ভাবনাচিন্তা করেও কূলকিনারা না পেয়ে অবশেষে রওনা দিয়েছিলাম বড়সাহেবের চেম্বারের দিকে; তাঁর হাতেপায়ে ধরে এর একটা বিহিত করতেই হবে। বড়সাহেবের চেম্বারের ঠিক বাইরে আমার জামায় একটা হ্যাঁচকা টান পড়ায় ঘুরে দেখি জয়ন্ত সমাদ্দার; মুখে হাড়জ্বালানো বিশ্রী হাসি।
“আরে দত্তদা, সক্কাল সক্কাল বড়সাহেবের ঘরের দিকে কী মনে করে”
বুঝতে পারছিলাম না আমার ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা সমাদ্দারকে জানানো ঠিক হবে কিনা, তবে আজ বাদে কাল সবাই জানবেই। খোলাখুলিই বললাম;
“কিছুই বুঝতে পারছি না ভাই, সকাল বেলা অফিসে এসে দেখি আমার টেবিলের ওপর এই শোকজের চিঠি রাখা। খোদ বড়সাহেবের সই করা। কী এমন গোলমাল করেছি যে... “।
আমার কথা শেষ করার আগেই জয়ন্ত সমাদ্দার বিশ্রীভাবে হেসে উঠেছিল, ওর কালচে-লাল দাঁতগুলোকে তখন রীতিমত হিংস্র মনে হচ্ছিল।
“দত্তদা, আপনি অল্পেতেই বড্ড কেঁপে যান। সে সুযোগ নিয়েই আমি একটু মস্করা করার প্ল্যান কষেছিলাম। বড়সাহেবের  সইটা আসল নয়, ও চিঠি আমারই লেখা। প্র্যাক্টিকাল জোক, কিছু মনে করবেন না। আজকের দিনটা খেয়াল করেছেন তো? পয়লা এপ্রিল, ফুলস ডে”!

ততক্ষণে আমার মাথার ভিতর আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল। এই সে’দিনের ছোকরার এত বড় সাহস? সমাদ্দারও হয়ত তখন বুঝতে পেরেছিল যে কাজটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে; কারণ যাই হোক, বড়সাহেবের সই জাল করাটা তো রীতিমত অপরাধ। এপ্রিল ফুলের ঠাট্টার জন্যেও সে’টা করা রীতিমত অনুচিত হয়েছে। আমিও ঠিক সেই সুযোগটাই নিলাম; সে চিঠি নিয়ে গিয়ে সোজা কমপ্লেন ঠুকে দিলাম বড়সাহেবের অফিসে। সমাদ্দার বাজে-ঠাট্টার জন্য তাঁর সই জাল করেছে শুনে তিনি তো একেবারে তেলে-বেগুন; উলটে জয়ন্ত সমাদ্দারকে শো-কজ করলেন তৎক্ষণাৎ। আর আমার সামনেই তাকে ডেকে যা-নয়-তাই বলতেও ছাড়লেন না। রাগের মাথায় অভিযোগ জানালেও, বড়সাহেব যে এতটা কঠোর কিছু করে ফেলবেন সে’টা আমি ঠিক ভাবতে করতে পারিনি। সে’দিন জয়ন্ত সমাদ্দারকে লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইতে হয়। গোটা অফিসের সামনে তাঁকে বেশ অপমানিত হতে হয় আর সে’টা যে সে হজম করতে পারেনি তা বুঝতে পারি যখন সে একমাসের মাথায় ইস্তফা দেয়। একটু যে খারাপ আমার লাগেনি তা নয়, তবে বাড়াবাড়িটা যে সে নিজেই করেছিল সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

জয়ন্ত সমাদ্দারের কথা প্রায় ভুলেও গেছিলাম। বহুদিন পর তার কথা মনে পড়ল পার্সেলটা পেয়ে। জুতোর বাক্সের সাইজের পার্সেলটা আমি পাই আজ বিকেলে; বেশ হাল্কা; সঙ্গে একটা পোস্টকার্ড।

“দত্তদা,
আজ আবার পয়লা এপ্রিল। এই দিনটাই আদর্শ ক্ষমা চাওয়ার জন্য। বোকা আপনি নন দাদা, বোকা আমিই। একবছর আগে একটা চরম ভুল করে ফেলেছিলাম। অবিশ্যি স্রেফ ঠাট্টাই করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু পরিমিতি বোধ আমার কোনও কালেই নেই। আপনাকে বড্ড বিব্রত করে ফেলেছিলাম সে’দিন। অফিসে মুচলেকা দিয়ে যে ক্ষমা চেয়েছিলাম তা ছিল অন্তঃসারশূন্য। তাই এই পোস্টকার্ড পাঠালাম।
বড্ড মনখারাপ নিয়ে চাকরীটা ছেড়ে ছিলাম, তবে এখন ভালোই আছি।  ঈশ্বর চাইলে আমি নিশ্চিত আমাদের আবার দেখা হবে। তখন গল্পাআড্ডা হবে’খন। আপাতত একটা ছোট উপহার পাঠালাম আপনার জন্য। ফিরিয়ে দেবন না।
ইতি আপনার প্রাক্তন সহকর্মী এবং চিরকালের বন্ধু,
জয়ন্ত সমাদ্দার”।

বলাই বাহুল্য, আমি নিশ্চিত এই পার্সেলের মধ্যে কোনও গোলমাল রয়েছে। পার্সেল আসার সময় আমি থাকলে তা ফিরিয়েই দিতাম, কিন্তু যখন এ’টা আসে তখন আমি বাড়ির বাইরে। আর আমার ব্যাচেলর-প্যাডের অধীশ্বর নন্দ “দাদাবাবুর নামে পার্সেল” শুনে হাসি মুখে তা পোস্টম্যানের থেকে রিসিভ করে নিয়েছে। নন্দকে আমার চাকর বললে ওকে ছোট করা হবে। ওই আমার লোকাল গার্জেন প্রায়। গত কুড়ি বছর ধরে আমার সঙ্গে আছে, তবে গ্রামের সারল্য এখনও যায়নি। আমার প্রতিটি কথা বেদবাক্য মনে করে মান্যি করে।

বাক্সে আরডিএক্স গোছের কিছু হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। জয়ন্ত সমাদ্দার গোলমেলে হতে পারে, ফাজিল হতে পারে; কিন্তু খুনি নয়। কিন্তু কিছুতেই নীল কাগজে মোড়া  সে বাক্সটা খোলার সাহস আমি পাচ্ছিলাম না। আমার শোওয়ার ঘরের টেবিলের ওপর মোড়ক-সহ রেখে দিয়েছি; নন্দ একবার খোলার কথা বলেছিল, তাকে কড়া সুরে নিরস্ত করেছি। প্রায় ধমক দিয়ে নন্দকে বলেছিলাম; “খবরদার! এ বাক্স আমি অনুমতি না দিলে কেউ যেন না খোলে, বুঝেছিস”? অনুগত ছাত্রের মত মাথা নেড়েছিল নন্দ।

****
ঘুম যখন ভাঙল তখন বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িতে দেখলাম সকাল সাড়ে ন’টা। কী মুশকিল, এত বেলা হয়ে গেছে অথচ ঘরের মধ্যে নিকষ অন্ধকার। এই সময় আমার এই শোওয়ার ঘর রোদে ভরে যাওয়ার কথা। শশব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নামতেই টের পেলাম এ’টা আমার শোওয়ার ঘর নয়। খাটটা ছাড়া অন্য কোনও আসবাবপত্র ঘরের মধ্যে নেই। এমন কী সেই টেবিলটা যার ওপরে নীল কাগজে মোড়া পার্সেল ছিল; সে’টাও হাওয়া।

“নন্দ” বলে বার তিনেক হাঁক পাড়লাম, কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। তবে রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম যখন দেখলাম এই ঘরে না আছে কোনও জানালা আর না আছে কোনও দরজা। এমন কী কোনও ঘুলঘুলিও চোখে পড়ছে না। এখানে আমি এলাম কী করে?

আমার কেমন গা গুলিয়ে আসছিল যেন। একটা প্রবল অস্বস্তি আমায় চেপে ধরেছিল। সেই অন্ধকার ঘরে পায়চারী করতে করতে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে মেঝেটা সিমেন্টে বাঁধানো নয়, মাটিরও নয়। কিন্তু বিস্তর গুঁতোগুঁতি করেও মেঝে বা দেওয়ালের কোনও ক্ষতি করা যাচ্ছে না।

***

কতক্ষণ বা কত ঘণ্টা বা কতদিন কেটেছে আমি জানি না। হাতঘড়িটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি ঘরের এক কোণে; সময়ের হিসেবে এ’খানে অদরকারী এবং বিরক্তিকর।। অবাক লাগছে এই ভেবে যে খিদে বা ঘুম; আমার কোনটাই পাচ্ছে না। প্রবল অবসাদে শরীর মন ভারী হয়ে এসেছে। খাটের এক কোণে পড়ে রয়েছি। ভাবনা আর লজিক; দু’টোই মনে হয় ক্রমশ বিকল হয়ে আসছে।

***

আজ প্রথম ঘরের ছাতের ওপর থেকে আমি কোনও কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। চেনা মানুষ।

“দাদাবাবু গো, পুলিশ আসার আগেই আমি তোমার এই বাক্স সরিয়ে রেখেছি। ওর জানতেও পারবে না এই নীল কাগজে মোড়া বাক্সের কথা। বেশ করেছি আমার নিজের কাছে লুকিয়ে রেখে, তাই না? পুলিশ যেই শুনত যে এ বিটকেল বাক্স বাড়িতে আসার রাত থেকেই তুমি বেপাত্তা, অমনি তারা এ বাক্স খুলে দেখতে চাইত । এ’দিকে তুমিই তো  বলে গিয়েছ যে তুমি অনুমতি না দিলে যেন কেউ এ বাক্স না খোলে। নন্দ থাকতে তোমার কথার খেলাপ কখনও হবে না, দেখো। কিন্তু আমি বড় একা হয়ে গেছি গো দাদাবাবু, তুমি ছাড়া যে আমার কথা বলার কেউ নেই। কবে ফিরবে? বাধ্য হয়ে একা একা বিড়বিড় করে যাই। তাড়াতাড়ি ফিরে আসো দেখি, তোমায় বড়ি দিয়ে ট্যাংরার ঝোল রেঁধে খাওয়াবো”।

নন্দর কথাগুলো ছাতের এককোণ থেকে ভেসে আসছিল, কিন্তু আমি জানি যে আমি চিৎকার করলেও নন্দ আমার কণ্ঠস্বর কিছুতেই শুনতে পাবে না। (ওপরে বহৃত ছবিটা www.deviantart.com থেকে নেওয়া)