Saturday, September 29, 2018

বিকেলের গল্প।

- দীপকদা, বড়সাহেব ডাকছেন।

- আমায়?

- নয়তো খামোখা আপনাকে বলতে যাবো কেন বলুন?

- রেনবো ওয়েল্ডার্সের ফাইল নিয়ে কিছু কি?

- ওঁর পেটে কী আছে তার হদিস আমার মত হরিদাস পালের কাছে থাকবে কী করে দীপুদা? আর্জেন্ট। তাড়াতাড়ি যাও।

***

- দীপু! ক্যুইক!

- কী হল রে?

- মান্তুদা ডেকেছে। রেলেরমাঠে। ক্যুইক।

- এই ভরদুপুরে!

- রেলকলোনির ছেলেদের চ্যালেঞ্জ করেছে মান্তুদা। আজ পালটা ম্যাচ।

- ও। তা আমায় ডেকেছে কেন? গত ম্যাচের পর তো বলল আমার মুখদর্শন করবে না আর।

- আহ্। তুই অমন লোপ্পা ক্যাচ ফেললি বলে..।

- মান্তুদা নিজে রানআউট মিস করেনি?

- মাঠে গিয়ে ঝগড়া করিস ভাই। এখন চ'।

- আমার টিউশনি আছে। ট্রিগোনোমেট্রি। বিভূতিবাবু এমনিতেই খাপ্পা, বাবার কাছে কমপ্লেন করেছেন। আমার হবে না।

- সে কী রে। আজ বাদে কাল মহালয়া! আর এ'দিকে তুই টিউশানি দ্যাখাচ্ছিস?

- কেটে পড়। মান্তুদাকে বলে দিস আমি আসতে পারব না..।

- মান্তুদা তোকে ওয়ান ডাউন খেলাবে বলেছে।

- ওয়ান ডাউন?

- ওয়ান ডউন।

- মান্তুদা বলেছে?

- মায়ের দিব্বি।  গা ছুঁয়ে বলতে বলেছে মান্তুদা।

- কিন্তু, বিভূতিবাবু যদি চটে যান..এ'বারে মনে হচ্ছে অঙ্কতে ডোবাবো রে...কিছুতেই কিছু ঘটে ঢুকছে না।

- রেলকলোনির ক্যাপ্টেন তোকে ক্যাচড্রপ ক্যালানে বলে ডাকছে। আমি নিজের কানে শুনেছি গতকাল।

- রেলকলোনির ক্যাপ্টেন? সৌম্যদা এ কথা বলেছে?

- রীতিমত অঙ্গভঙ্গি করে।

- সাইকেল বের করতে পারব না। আর তোর মেজমামার দেওয়া ব্যাটে খেলব।

- আমি অফ স্পিনার৷ সেভেন ডাউন। ব্যাটের মায়া আমার নেই। ও ব্যাট তুইই রাখিস। এখন চ', আমি ডাবল ক্যারি করব।

***

- সার্টিফাই করে দেব?

- দেবে।

- কিন্তু...।

- লুক দীপক, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইওর ডিলেমা। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমাদের কিছু করার নেই। গুপ্তাদের হাতে সমস্ত কন্ট্রোল, কাজেই...।

- কিন্তু স্যাম্পেলে গলদ আছে। স্পষ্ট।

- ইউ উইল বি কম্পেনসেটেড দীপক...সে দায়িত্ব আমার। বেসিকালি, ইউ হ্যাভ নো চয়েস। আই হ্যাভ নো চয়েস ঈদার। সময় আছে অবশ্য, যা হওয়ার পুজোর পরেই হবে।

- আমি একটু ভেবে দেখি স্যার।

- ইউ হ্যাভ নো চয়েস দীপক।

***

লংঅনে দাঁড়িয়েছিল দীপক। সেপ্টেম্বরের শেষে এই বিদঘুটে গরম বেশ বেমানান। তবু, ফোকাস নষ্ট হলে চলবে না। একটাও বল গলালে মান্তুদা মার্ক্স, চাণক্য বা অমরিশ পুরি কোট করে একটা দক্ষযজ্ঞ বাঁধাবে; আর তখন ব্যাটিংয়ের আগেই মেজাজ যাবে চটকে। তিন নম্বর পোজিশন মান্তুদা বারবার দেবে না, রান করতেই হবে আজ। রেলের মাঠে বড্ড বেশি বালি, চটি পরেই ফিল্ডিং করতে হচ্ছে নয়ত পায়ে রীতিমত ছ্যাঁকা লাগছে।

ঠিক তখনই হাড়হিম করা ডাক।

- তুই বিভূতিবাবুর ক্লাসে না গিয়ে খেলতে এসেছিস?

- তোকে এ'খানে কে আসতে বলেছ!

- সে কথায় তোর কাজ কী! মান্তুদাকে বলে বেরিয়ে আয়।

- অসম্ভব। তুই যা। ওরা সবাই এ'দিকে তাকাচ্ছে! এ'দিকে বল এলেই...।

- তাকাক। তুই এখুনি বেরোবি।

- অসম্ভব।

- অসম্ভব?

- রীতিমত।

- বাপের টাকা জলে দিতে লজ্জা করে না? ওই টিউশনির টাকাটা শিবুকাকুকে দিতে বলিস না কেন? বেচারি ছেলের ওষুধ যোগাড় করতে গিয়ে কী হয়রান হয়। তোর লজ্জা করে না দীপু?

- কিচি! তুই যাবি?

- ফেল করছিস কর। এমন বেয়াদবী শুরু করেছিস কেন?

- বেশ করব। আমি ফেল করেছি। আমার বাবার টাকা। আমি বুঝব৷

- তুই আমার সঙ্গে যাবি টিউশনিতে? এখুনি?

- সৌম্যদা আমায় ক্যাচড্রপক্যালানে বলেছে। এ'টা বদলার ম্যাচ।

- সৌম্যদা তোর মত অসভ্য আর মান্তুদার মত মিথ্যুক  নয়।

- বেশ। সৌম্যদার সঙ্গেই বেরোস। মহালয়ার বিকেলে। এমনিতেও তোর সমান অ্যাপ্টিচিউডের মানুষ। স্ট্যান্ডফ্যান্ড করে।

- বেশ, তাই যাবো। তুই মর্।

ঠিক তখনই একটা উড়ে আসা বলা দীপুর মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল, সে বড্ড দেরীতে দেখেছিল। নীল হলুদ সালোয়ার আর রাগ থমথম মুখে কিচি দাঁড়িয়ে। ডান হাত লেডিবার্ড হ্যান্ডেলে আর বাঁ হাতে হেলায় ধরা ওভারবাউন্ডারি হওয়া বল; নিখুঁত ক্যাচ।

সৌম্যদার শট৷ যতক্ষণে মান্তুদা রাগে উদ্ভ্রান্ত হয়ে "তবে রে শালা"র সুরে চটি হাতে তেড়ে এসেছিল; ততক্ষণে লেডিবার্ড হাওয়া।

***

- দীপু না?

- আরে সৌম্যদা! কেমন আছ? ব্যাঙ্গালোর থেকে কবে ফিরলে?

- দিব্যি আছি। আজই সকালে এসেছি।

- পুজোয় আছ তো?

- হ্যাঁ। লম্বা ছুটি, অনেকদিন পর পেলাম। তুই কলকাতায় চাকরী করছিস তো? পুজোর ছুটি?

- হ্যাঁ। আমিও লম্বা ছুটিতেই এসেছি।

- তা বেপাড়ার মাঠে বিকেলে বসে?

- এই রেলের মাঠে ছোটবেলায় কত খেলেছি বলো তো।

- হ্যাঁ রে, মান্তুটা কি আগের মতই পাগলাটে আছে?

- সর্ষের তেলের ব্যবসা। ব্যস্ত বড় আজকাল। পাগলামির সময় কই?

- আর তোর ফিল্ডিং কি আগের মতই কাঁচা রয়েছে?

- হেহ্।

- বসি তোর পাশে খানিকক্ষণ। কদ্দিন এ মাঠে বিকেলবেলা চটি পেতে বসি না। মহালয়াটা পরশু, তাই না রে?

- হুঁ।

- হ্যাঁ রে। কিচির খবর কী?

- জানি না। বহুদিন যোগাযোগ নেই। তোমার মনে আছে? এক মহালয়ায় তোমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলে?

- আমি আর কিচি? ঘুরতে বেরিয়েছিলাম?

- ঘাটের দিকে তোমাদের দেখেছিলাম তো। ইয়ে, একটু দূর থেকে।

- ওহহো। তুই ওকে পাঠিয়েছিলিস ব্যাটা, তাই না?

- মানে? আমি ওকে পাঠাব কেন?

- মানে আবার কী! আমায় গোপনে সে খবর পাঠালো, মহালয়ার সকালে দেখা করবে। আমার মনে কী আনচান। ও মা! মহালয়ার সকালে দেখা করে বললে সে জানতে এসেছে যে আমি তোকে সত্যিই ক্যাচড্রপক্যালানে বলেছি কিনা। কী খতরনাক রাগ মাইরি। একবার তো মনে হচ্ছিল কানটাই না মুলে দেয়। আমি কত কাকুতিমিনতি করে বললাম যে ক্যালানে গোছের শব্দ আমি ব্যবহার করি না। তারপর আমায় ন্যাকাট্যাকা অনেক কিছু বলল। আর রীতিমত শাসিয়ে গেল যে আমি বা আমার পরিচিত কেউ কখনও যদি তোর নামে উল্টোপাল্টা কিছু বলে তা'হলে সে আমার ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে নাকি। কী ডেঞ্জারাস মেয়ে মাইরি।

***

- হ্যালো, বলো দীপক। কী ব্যাপার?

- অনেক ভেবে দেখলাম স্যার। ভুল সার্টিফাই করতে আমি পারব না। মরাল স্ট্যান্ড নয়। কনফিডেন্সের অভাব। সে'টা বলতেই ফোন করলাম।

- আমি তোমার আগেও বলেছি। ইউ হ্যাভ নো চয়েস।

- উই অলওয়েস হ্যাভ আ চয়েস স্যার।

- ক্যালানের মত কথা বলো না।

- মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ স্যর। নয়ত আপনার ঠ্যাং আস্ত নাও থাকতে পারে।

- হোয়াট ডু ইউ মীন? তোমার সাহস কম নয় তো...।

- আমি বেশ ভীতু, মাইরি বলছি। ফোন রাখছি স্যর, ভালো থাকবেন।

ইলেক্ট্রনিক্যালামিটি

যতই লজিকটজিক নিয়ে বাতেলা ঝাড়ি, ইলেকট্রনিক যন্ত্র কেনার সময় মন নরম হয় আসে। বারবার মনে হয় এ'সব জিনিস রাশিফল দেখে আর পঞ্জিকা কনসাল্ট করে কেনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দু'টো জিনিস ঘটছে; এক, আত্মবিশ্বাসটিশ্বাস কমে টাকা-টু-ডলারে এসে ঠেকেছে আসে আর দুই, ইলেক্ট্রনিকের ভাগ্য ক্রমশ ফিক্সডিপোজিটের ইন্টারেস্ট হয়ে উঠছে।

ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় বাবা ফিলিপ্সের স্টিরিও টেপ রেকর্ডার কিনেছিলেন। সে'টার ব্যবহার তদ্দিন চলেছে যদ্দিন না ক্যাসেট ব্যাপারটা বাজার থেকে গায়েব হয়েছে। আর অন্যদিকে আমি। শৌখিন ইলেকট্রনিক কিছু কেনামাত্রই মনে হয় টাকার গায়ে চুন-খয়ের-চমনবাহার লাগিয়ে জলে দিলাম। আকাশে মেঘ দেখলে পলিথিনের প্যাকেট জোগাড় করে মোবাইল মুড়ে রাখি। ইয়ারফোন কানে কম থাকে, বেশির ভাগ সময় কাটে তারের জট ছাড়িয়ে। ঢাকুরিয়ায় মেঘ ডাকলে বেহালায় বৌকে ফোন করি টিভির প্লাগ খুলে ফেলতে।

কিন্তু তবু অতর্কিতে ঘটে যায় গোলমাল। রিভিউয়াররা বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীর আনবক্সিং করে থাকেন, আর আমি খুঁজে বের করি আউট অফ দ্য বক্স যত সমস্যা। সাধারণত মোবাইল ফোনের স্ক্রিনট্রিন ভাঙে, আমার অতিসাবধানে রাখা ফোন বিতিকিচ্ছিরি ভাবে বেঁকে যায়৷ এই এখন যেমন বেঁকে যাওয়া ফোন থেকে টাইপ করছি। কেউ বাঁকা চোখে তাকালে খিচখিচ করে উঠি; শাওমি এক্সট্রা কার্ভড ফোন বের করেছে; লিমিটেড এডিশন, শুধু চীনের জন্য, আমি আমি  স্মাগল করিয়ে আনিয়েছি। ইয়ারফোন থেকে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত রকমের গা শিরশিরে শব্দ বেরিয়ে আসে; এক বন্ধুর ধারণা এলিয়েনরা যোগাযোগ করতে চায়। একটা ওজন মাপার যন্ত্র কিনেছিলাম, দু'মাসের মাথায় স্ট্রেট অক্কা। বাড়ির লোকজন এমন ভাবে তাকায় যেন কোনো অসহায় শ্রমিকের ঘাড়ে নিজের পাপী ওজন চাপিয়ে হত্যা করেছি।

আর সবচেয়ে খতরনাক ব্যাপার হল ওয়ারেন্টি। আজকাল হাসপাতালের চেয়ে ইলেক্ট্রনিক সার্ভিস সেন্টারে গেলে বেশি বুক কাঁপে। কাস্টোমার কেয়ার দাদা দিদিদের সামনে মনেমনে নতজানু হয়ে পড়ি। বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের ওয়ারেন্টি আর নেতাদের ভোটের আগের বাতেলা; এ'সব শুনে শুনে যে কত রোম ধ্বংস হয়৷ আমি বলি 'দেখুন তো, মনে হচ্ছে মোবাইলের জ্বর হয়েছে'। বরফ ঠাণ্ডা কণ্ঠে কাস্টোমারকেয়ার দাদা-দিদি বলেন 'আই অ্যাম সরি মিস্টার মুখার্জি। বড্ড দেরী করে ফেলেছেন। পেশেন্টের দু'টো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন কিডনি লাগবে'।
ব্যাস, হাতে কাচভাঙা হ্যারিকেন, মুখে পোড়া ছাই, কানে গলানো মোম আর জানে গরম কয়লা।

বছরভর যত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের রিভিউ দেখি বা পড়ি, ততটা পরিমাণে ভালো বই পড়লে এবং সিনেমা দেখলে বছরখানেকের মধ্যে টিভি চ্যানেলের প্যানেলে প্যানেলে ঘুরে বিভিন্ন বিদগ্ধজনের মনপ্রাণ দগ্ধ করে ফেলতে পারতাম। সবাই অনুরাগ কশ্যপ থেকে মুরাকামি নিয়ে আলোচনা করে, আমি মনে মনে গীকিরঞ্জিত আর এনডিটিভি গ্যাজেটস আউড়ে চলি।

Wednesday, September 26, 2018

বিখ্যাত

- নমস্কার।

- হুঁ। নমস্কার। উঁহ্।

- বিরক্ত মনে হচ্ছে আপনাকে?

- বিরক্তি। বোরডম। হাড়জ্বলুনি।

- উম...এমন ভাবে বোধহয় আপনাকে প্রায়ই ডেকে নেওয়া হয়, তাই না?

- প্রতি হপ্তায় অন্তত বারদুয়েক। গত আশ্বিনে এক হপ্তায় সাতবার ডাক পড়েছিল। এ হপ্তায় অবশ্য আপনিই প্রথম।

- এত প্ল্যানচেট করার মানুষ আছে?

- আছেই তো। আর অর্ধেকের বেশি তো গাধাগবেটের দল। ডাকতে চায় একজনকে আর টেনে নামায় অন্য কাউকে। আরে মশাই প্ল্যানচেট কি আর যেমনতেমন ব্যাপার? ধৈর্য লাগে, অধ্যাবসায় লাগে,  ফোকাস লাগে। প্যারিসের এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছর সতেরো আগে; কী জ্ঞানের পরিধি,  কী বিনয়। তার প্ল্যানচেটে নামতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম।

- খুব ভালো লাগল আপনার সঙ্গে আলাপ করে।

- উম। সেই। বোরিং, বুঝলেন। কিছু মনে করবেন না যেন।

- আচ্ছা, এখন শুধু আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি; তা, আকার ধারণ করতে পারবেন কি?

- নির্ভর করছে আপনার প্ল্যানচেট স্কিলের ওপর৷ ধুরন্ধর ভূত-ট্র‍্যাপাররা অনেকসময় রীতিমত অবয়ব সৃষ্টি করতে পারেন। আপনিও বোধ হয় পারবেন। আর একটু কনসেন্ট্রেট করুন।

- কেমন আছেন আপনি বিমলবাবু?

- যাক, আমায় তা'হলে আনতাবড়ি নামিয়ে ফেলেননি৷ ইম্প্রেসিভ। কলকাতায় ভালো প্ল্যানচেট করিয়ে তো আজকাল বড় একটা দেখিনা।

- অকাল্ট ব্যাপারটা আমাকে বরাবরই খুব টানে...।

- তা'বলে বেশি সময় আমার নেই৷ বড় দুর্বল লাগে ফিরে গিয়ে জানেন, প্রতিবারই। কাজেই, যা প্রশ্ন করার চটপট করে ফেলুন।

- আচ্ছা বিমলবাবু, আছেন কেমন?

- মানে, এই অবস্থায়?

- হুঁ।

- দিব্যি। ফুরফুরে। ভূত ডেফিনিশনে খারাপ থাকার এলিমেন্টটা ইনক্লুডেড নেই।

- বাহ্। ইয়ে, একটা বিশ্রী প্রশ্ন করতে বড্ড সংকোচ হচ্ছে...।

- আমি কী ভাবে অক্কা পেয়েছি, সে'টা জানতে চাইছেন তো?

- হ্যাঁ।

- স্বাভাবিক প্রশ্ন। এত হেসিটেট করছেন কেন। আজ থেকে ঠিক বত্রিশ বছর আগে ব্যাপারটা ঘটে। সাতাশে সেপ্টেম্বর। রাত পৌনে বারোটা নাগাদ বোধ হয়। দ্য গ্রেটেস্ট মার্ডার মিস্ট্রি অফ দিস সেঞ্চুরি। লালবাজার হন্যে হয়েও কিছু উদ্ধার করতে পারেনি৷ ইনফ্যাক্ট, অমন ভাবে মরেছি বলেই আমার ফেমাস হওয়া। যে কারণে বহু মানুষ আজও আমায় প্ল্যানচেটে নামায়, সে রহস্যভেদ করতে। কে আমায় গলার টুটি টিপে খুন করেছিল। কে? ঘরের দরজা জানালা বন্ধ, ঘরে বাড়তি কোনো পায়ের ছাপ নেই, গলায় আঙুলের দাগ নেই; অথচ খুন হওয়া লাশটা আছে।

- ইনক্রেডিবল বিমলবাবু।

- অবিশ্বাস্য তো বটেই৷ গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বছর পাঁচেক আদাজল খেয়ে তদন্ত করেছিল। কিস্যুটি জানতে পারেনি। কাজেই, ব্রড স্ট্রীটের বিমল দত্ত হত্যারহস্য চিরঅন্ধকারেই রয়ে গেছে। কিন্তু, আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার প্ল্যানচেটবাবু, এর আগে বহু মানুষ আমায় প্ল্যানচেটে নামিয়ে জানতে চেয়েছেন আমার হত্যারহস্যের ব্যাপারে। তাদের সকলকেই সোজাসুজি বলেছি যে আমি জানি খুনি কে কিন্তু খোলসা আমি করব না। বিমল দত্ত হত্যারহস্য এনিগমা হয়েই থাকুক চিরকাল। পস্থুমাস সেলেব্রিটি হয়ে আছি, মন্দ কী।

- বিমলবাবু, আপনাকে সামান্য হতাশ করতে বাধ্য হচ্ছি।

- কী'রকম?

- আপনার হত্যারহস্যের সমাধান আমার হাতের মুঠোয়।

- কে আমার শার্লক বক্সী এলেন হে! সমাধান হাতের মুঠোয়! যত বাতেলা।

- ভূত হয়ে এমন বিশ্রী মেজাজ? মানাচ্ছে না যে।

- যত বাজে কথা।

- অকারণ উত্তেজিত হচ্ছেন।

- বটে? আপনি জানেন আমার খুনি কে?

- আপনি খুন হননি বিমলবাবু। আর খুন না হলে খুনি আসবে কোথা থেকে?

- মা...মানে...ইয়ে...কী বলছেন আপনি...।

- বিখ্যাত হওয়ার নেশা যে কী ক্ষতিকারক তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ আপনি বিমলবাবু। খেলাধুলো থেকে সিনেমা; চেষ্টা কম করেননি। অথচ কোনো জায়গাতেই তেমন সুবিধে করতে পারলেন না। এ'দিকে বিখ্যাত হতেই হবে। কাজেই আপনি বাধ্য হলেন আঙুল বাঁকা করতে...।

- আসলে হয়েছে কী...।

- প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আত্মারা যে টাইম ট্র‍্যাভেল করতে পারে সে'টা জানা মাত্রই আপনি ছক কষে ফেললেন। নিখুঁত খুনের প্ল্যান। খুন, অথচ খুন নয়। আত্মহত্যা,  যে'খানে সমস্ত চিহ্ন খুনের দিকে, অথচ খুনির পরিচিতি কেউ কোনোদিন জানতেই পারবে না।

- আপনি? আপনি কে বলুন তো?

- অনেকদিনের আগের ব্যাপার তো। বত্রিশ বছর। মনে হচ্ছে এই কথোপকথনটা আপনি ভুলে গেছেন বিমলবাবু।

- আপনি কে?

- এখনও নিজের জ্যান্ত চেহারাটা চিনতে পারলেন না বিমল দত্ত মহাশয়? আমিই যে বিমল দত্ত, আমিই জ্যান্ত আপনি। আর আজই সাতাশে সেপ্টেম্বর বিমলবাবু। আপনি বত্রিশ বছর পিছিয়ে এসেছেন। আমিই ডেকে এনেছি।   বিমলবাবু শুনুন, আপনার অবয়ব এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাত এগারোটা চল্লিশ বাজে। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে কাজ সেরে ফেলতে হবে। কেমন? এ'বার আসুন এ'দিকে। ক্যুইক।

Thursday, September 20, 2018

দার্জিলিংয়ের ফ্রেম

- দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।

- না, থাক স্যার।

- বসুন। বসুন। কাঁপছেন যে।

- আমার টাকাটা দিয়ে দেবেন প্লীজ?

- রেডি রেখেছি। এই এনভেলপে। এই যে...।

- ধন্যবাদ।

- আরে। গুনে দেখুন মন্টুবাবু।

- না না, কী দরকার। ঠিকই আছে।

- আমি লোকটা যে ভালো নই; সে খবর তো আর কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাতে হবে না।

- না...তা কেন।

- যে মানুষ টাকা দিয়ে খুন করাতে পারে, সে সামান্য টাকা মেরে দিতে পারবে না? তাই বলছি অমন দুম করে বিশ্বাস করবেন না। দিনকাল বড্ড ডেঞ্জারাস। নিন বসুন। আর গুনুন। পাক্কা চল্লিশটা নোট থাকার কথা।

- আচ্ছা...তা'হলে গুনি?

- অফকোর্স।

- এক, দুই, তিন....চল্লিশ! ঠিকই আছে।

- চা খাবেন মন্টুবাবু?

- না। একটু জল বরং...গলাটা শুকিয়ে গেছে।

- এই নিন...।

- এ'টা আপনার গেলাস তো...।

- এঁটো নয়...।

- আহা, তার জন্য নয়। আচ্ছা, থ্যাঙ্ক ইউ।

- এখনও কেঁপে চলেছেন। আহা।

- আসলে...আসলে...দাসবাবু খুব ছটফট করছিলেন জানেন...খুব। কী চিৎকার! কানের মধ্যে এখনও ঝনঝন করে বাজছে। কী অসহায় ভাবে ছটফট করছিলেন। আর...।

- আর?

- আর রক্ত। ওর অফিসের মেঝে ভেসে যাচ্ছিল। একবার মনে হয়েছিল...।

- কী মনে হয়েছিল?

- যে অ্যাম্বুলেন্স ডাকি! যদি বাঁচানো যায় আর কী।

- দ্যাখো কাণ্ড! নিজে ছুরি চালিয়ে হাসপাতালে খবর দেবেন? সর্বনাশ! আপনি তো ডেঞ্জারাস লোক মশাই।

- খুনি! ডেঞ্জারাস তো বটেই।

- মন্টুবাবু, আপনি হলেন গিয়ে কীবোর্ড, আমার আঙুলগুলো টাইপ করছে। খুনি আপনি নন।

- তবু...ছুরিটা তো আমিই।

- আরে ওই দাস ভদ্রলোক অত্যন্ত ধড়িবাজ। কথায় কথায় খালি ঘুষের বায়না। ঘুষ ছাড়া কোনো কনসাইনমেন্ট দেবেই না। তা ঠিক আছে, আমি কমিশন দিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্যাটা ইদানিং আমার ব্যাপারে একটু বেশিই জেনে গেছিল। বলে কিনা শুধু কমিশনে হবে না, আধাআধি শেয়ার চাই। রীতিমত ব্ল্যাকমেল। দিলাম সাফ করে। আরে মশাই আপনার কোনো ভূমিকাই নেই এ'খানে। হ্যাঁ, ছুরি আপনি চালিয়েছেন কিন্তু খুনের পাপ কম্পলিটলি আমার ঘাড়ে।

- দাসবাবুর টেবিলে একটা ফ্যামিলি ফটো ছিল, জানেন?

- প্রথম খুন তো। বুঝি মন্টুবাবু, বুঝি। অমন ইমোশনের ছোঁয়াছুঁয়ি একটু হবে। তবে কেটে যাবে।

- পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে তোলা সে ছবি। বৌ, দুই ছেলে। একেবারে ঝলমলে ছবি। দামী কাঠের ফ্রেম। ঘর আলো করে ছিল...। উনি টেবিলে যখন মুখ থুবড়ে পড়লেন তখন কয়েক ফোঁটা রক্ত সেই ফটোফ্রেমে...।

- মন্টুবাবু। এ টাকাটা না পেলে আপনার নিজের ছেলেটি বিনা চিকিৎসায়...।

- তা ঠিক৷ সে জন্যেই তো।

- দাসবাবুর ছেলেবৌদের অভিশাপ আপনার গায়ে লাগবে না।

- চিন্তাটা অভিশাপের নয় স্যার।

- তবে?

- আসলে এ টাকায় খোকার চিকিৎসার শুরু করা যাবে বটে...কিন্তু...এর পরেও প্রচুর টাকার দরকার হবে।

- বেশ তো। আরো দেব!

- আরো?

- আরে আমার ব্যবসা তো ঠিক সোজা পথে চলে না। শত্তুরেরও অভাব নেই। মাসে খানতিনেক কাজ পেয়েই যাবেন। আর আপনার নার্ভ বেশ স্টেডি। ছেলের চিকিৎসা আটকাবে না। ডোন্ট ওরি। আপনি ওর চিকিৎসা শুরু করিয়ে ফেলুন।

- নাহ্!

- না?

- স্যর, আমি না...আমি দাসবাবুর টেবিল থেকে ওই দামী কাঠের পালিশ করা ফ্রেমটা তুলে এনেছি।

- কেন? সে কী!

- ছবিটা বোধ হয় দার্জিলিংয়ের।  মানে, আমি ঠিক জানি না। তবে মনে হল। দাসবাবু, তার স্ত্রী আর দু'ছেলে; সবার মুখে উপচে পড়ছে হাসি আর রোদ্দুর। কী ভালো। হাজারখানেক খুনেও ওই ফ্রেম নষ্ট হবে না।

- আর এক গ্লাস জল খাবেন?

- না স্যার, এই দেখুন। আমার গা কাঁপুনি কমে গেছে। আমি ঠিক করে নিয়েছি..।

- কী? ছেলের চিকিৎসা করাবেন না?

- নাহ্, আমি পারব না জানেন। অতগুলো খুন করে...নাহ্। খোকা সেইভাবে...। বরং এই নতুন আইডিয়াটাই ভালো। চিকিৎসা আপাতত বন্ধ থাক।

- আইডিয়াটা কী?

- আমি আর খোকা দার্জিলিং যাব। ওই ফ্রেমের ছবির জায়গাটা খুঁজে বের করে ছবি তুলব, আর সে ছবি এই ফ্রেমেই..।

- দার্জিলিং গেলে ছেলেটা বাঁঁচবে?

- হয়ত না। শুধু এই ফটোফ্রেমটা থাকবে। সে ফটোফ্রেমে খোকার মুখ আলো করা হাসি। যে হাসিতে ওর খুনি বাপের কালোছায়া নেই। ওর অসহায় বাপের অনটন নেই।

- মন্টুবাবু। ছবিটা দেখি।

- এই যে।

- হুঁ।

- অপূর্ব, না স্যর?

- হুঁ।

- বিউটিফুল না?

- তা বটে। আর দার্জিলিংই মনে হচ্ছে। এ জায়গা আমি চিনি সম্ভবত।

- আমি দার্জিলিংই যাই স্যর। বাকি খুনটুনগুলো বাদ থাক। কালকেই জোড়া টিকিট কাটছি।

- মন্টুবাবু, আপনি বড় ভয়ঙ্কর মানুষ।

- খুনি বলে কথা স্যার।

- আমার একটা নতুন প্ল্যান আছে। না করবেন না।

- প্ল্যান?

- তিনটে টিকিট কাটুন।

- তিনটে?

- আপনার খোকা ছাড়া কেউ নেই। আমার ব্যবসা ছাড়া কেউ নেই। এ'দিকে এই ফটোফ্রেমে থাকার লোভ হচ্ছে। দাসবাবু লোক মন্দ ছিলেন, কিন্তু স্রেফ এই ফ্রেমে সেঁধিয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন দেখছি। দার্জিলিংয়েই চলুন। ফিরে এসে খোকার চিকিৎসা শুরু। তা বলে ভাববেন না আরো খুন করতে বলব। আর খোকার হাসপাতালের বেডের পাশে এ ফটোফ্রেম রেখে দেব, কেমন? দার্জিলিংয়ের রোদ্দুর সমেত।

- চা খেতে ঠিক ইচ্ছে করছে না। কফি খাওয়াবেন স্যর?

Sunday, September 16, 2018

জমিদারবাড়ির ইজ্জত

- (অনিল চ্যাটার্জী কণ্ঠ) আমায় ডেকেছিলেন বাবা?

- (ছবি বিশ্বাস কণ্ঠ) হুঁ। নায়েবমশাইকে ডাক দাও।

- আজ্ঞে, এত রাত্রে?

- বলেছি যখন, নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে।

- বেশ, কিন্তু...।

- নায়েবমশাইকে বলো সিন্দুক খুলতে।

- সে কী, কোনো বিপদ হল নাকি বাবা?

- বিপদ নয়, প্রয়োজন। বাড়ির দলিলটা বের করে আনতে বলো।

- দলিল!

- আশা করি ভির্মি খাচ্ছ না।

- এত রাত্রে বাড়ির দলিল নিয়ে কী করবেন বাবা?

- উকিলমশাই এসে পড়লেন বলে।

- উকিলমশাই? দলিল? হচ্ছেটা কী?

- বয়স তো কম হল না। দুয়ে'দুয়ে চার করতে শিখবে কবে? এ বাড়ির অর্ধেকটা আমি বিক্রি করে দিচ্ছি। আজ রাত্রেই সে দলিল নিয়ে উকিলবাবু শহরের দিকে রওনা হচ্ছেন, খদ্দেরপক্ষ অপেক্ষায় রয়েছে।

- কিন্তু হঠাৎ বাড়ির বিক্রির প্রয়োজন হল কেন জানতে পারি বাবা?

- চোখকান খোলা রাখলেই নিজে থেকেই টের পেতে। বাড়ি বিক্রি ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এখন মুখের সামনে সঙের মত দাঁড়িয়ে না থেকে নায়েব মশাইকে ডেকে আনো।

- বাবা, আপনার বড়ছেলে হিসেবে আমার জানার অধিকার রয়েছে! এ বাড়ি আপনি বিক্রি করছেন কেন?

- বড়ছেলে?  বড়ছেলে হয়ে বাপের মান সম্মান সম্বন্ধে কতটুকু ওয়াকিবহাল তুমি? কই, চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন? বলো!

- আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা।

- আহাম্মক। তা বুঝবে কেন। গোটাদিন টোটো করে বেড়ালে দুনিয়ার খবর রাখবে কী করে। শোনো, আজ নতুন আইফোন এক্স এস লঞ্চ হয়েছে! দিন দুয়েকের মধ্যে সে ফোন কিনে ফেলতে না পারলে জমিদারবাড়ির ইজ্জত ধুলোয় মিশে যাবে না? আমার নাক কাটা যাবে না? আর বাড়ি বিক্রি না করলে সে ফোন আমি কিনব কী করে? তা বলতে পারো?

ঘৌলমন্ডির গোলমাল -১

**ঘৌলমন্ডির গোলমাল**

প্রথম পরিচ্ছেদ - এলেম নতুন দেশে

.......

কানের মধ্যের ঝমঝম আওয়াজটা কমে এসেছে। গা হাত পায়ের অসহ্য ব্যথাটাও দেখছি কম। চোখের দৃষ্টিটা সামান্য ঘোলাটে কিন্তু গোলমেলে অন্ধকারটা ক্রমশ কেটে যাচ্ছে।

বুকের মধ্যের হ্যাঁচড়প্যাঁচড়টাও বেশ কমে এসেছে।  একবার চোখ বুজে আবার খুললাম; ড্যাবড্যাব করে দেখার চেষ্টা করলাম।

সামনের দেওয়ালটা নীল।
আমি একটা সাদা চাদর পাতা বিছানায় শুয়ে। নির্ঘাৎ হাসপাতালের বেড।

দেওয়ালে একটা ঘড়ি, চোখ কুঁচকে সময়টা দেখার চেষ্টা করলাম; ও মা! ঘড়ির দু'টো কাটাই সমান সাইজের। আটটা দশ, একটো চল্লিশ যা কিছু একটা হতে পারে। কী আহাম্মকে ঘড়িরে বাবা। বিরক্ত হয়ে চোখ বুজে ফেললাম।

নিজের পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলাম।

আমি যাচ্ছিলাম উলুবেড়িয়ায় মেজপিসির বাড়ি। অবিশ্যি মেজপিসি আর নেই, এমনকী মেজপিসেও মারা গিয়েছেন বছর সাতেক হল। মেজপিসির মেজছেলে বাপনদাদার সঙ্গে আমার খুব দহরম। মহরমের ছুটি পেয়েছি আর অমনি সকাল বেলা সরভাজার বাক্স নিয়ে বাস ধরে সোজা উলুবেড়ে। গোটাদিন শুধু তাস পেটানো আর বাপনবৌদির হাতের বাটিচচ্চড়ি আর মাছের ঝোল।

আহ..এই আমার এক রোগ। কী ভাবার কথা আর কী ভেবে চলেছি। প্রশ্ন হচ্ছে আমি এই হাসপাতালে এলাম কী করে। সাঁতরাগাছি থেকে বাস ধরে উলুবেড়িয়া যাচ্ছিলাম; দিব্যি।

ওহ্ হো। মনে পড়েছে। ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা, মাঝ রাস্তায়।

যাব্বাবা!

কী কাণ্ড কী কাণ্ড। তাই এই হাসপাতালে। তবে অল্পের ওপর দিয়ে গেছে যা বুঝছি, হাতেপায়ে প্লাস্টার নেই কোনো, সামান্য ব্যান্ডেজও নেই। শুধু পেটের মধ্যে চনমনে খিদে। যাক। সেই কোন সকালে খইদুধের সঙ্গে আমসত্ত্ব মিশিয়ে খেয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপরে পেটে পড়েছে বলতে শুধু চার প্যাকেট বাদাম আর একজোড়া ডিমসেদ্ধ, সাঁতরাগাছি বাসস্ট্যান্ডে কেনা।

ফের চোখ খুললাম।

নীল দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত রকমের ফর্সা ভদ্রলোক। ফর্সার চেয়েও বেশি ফ্যাকাসে। মাঝারি হাইট, হাত পা ল্যাকপ্যাকে অথচ দিব্যি একটা টলমল ভুঁড়ি।  মাথার চুল উসকোখুসকো। সবচেয়ে বিটকেল ব্যাপার হল ভদ্রলোকের ডান গাল সাফসুতেরো অথচ বাঁ গালে অন্তত দিন তিনেকের না কামানো দাড়ি। চোখে একটা বিটকেল সবুজ ফ্রেমের চশমা।  আর মুখের হাসিটা যেমন নার্ভাস, তেমনি ছটফটে। গায়ে সাদা কোট আর গলার স্টেথোস্কোপ না থাকলে ঘোরতর সন্দেহ হত যে ভদ্রলোক মানুষ নয়, ভিনগ্রহের প্রাণী।

" কেমন বোধ করছেন মনোজবাবু"? এই ডাক্তারের গলা অবিশ্যি দিব্যি মখমলে।

"ইয়ে, তেমন ব্যথা বেদনা তো কিছু..."।

" না, তেমন আর কী। খান কুড়ি ভাঙা হাড়, লিটার চারেক রক্ত গেছে। ও তেমন কিছু নয়"।

" হাড় ভেঙেছে? কিন্তু...কই...কোনো যন্ত্রণা নেই, প্লাস্টার নেই। রক্ত ঝরল, তবু দুর্বল লাগছে না তো"।

"ও কোনো প্রবলেম নয়। এই একটু প্রেশার মেপে দিচ্ছি, ব্যাস; তা'হলে সমস্ত ব্যথা প্লাস্টার দুর্বলতা ফেরত আসবে"।

এই বলে ঝপাৎ করে আমার বুকে স্টেথোস্কোপ চেপে ধরলেন ডাক্তার।

" এ কী ডাক্তারবাবু! স্টেথোস্কোপে প্রেশার"?

"কী স্কোপ"? ডাক্তার কেমন ঘাবড়ে গেলেন যেন।

" স্টে...স্টেথোস্কোপ"।

ধপাস করে পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন সেই অদ্ভুতুড়ে ডাক্তার।

"শরীর খারাপ লাগছে নাকি ডাক্তারবাবু"?

" আরে ধুর, শরীর থাকলে তো খারাপ"। বলেই স্যাট করে ইয়া লম্বা জিভ কাটলেন ভদ্রলোক।

"শরীর নেই মানে"?

তখনই সব গড়বড় হয়ে গেল। ডাক্তার মাথা চুলকে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বোধ হয় একটু বেশি জোরে চুলকে ফেলেছিলেন। স্টেথোস্কোপ জড়ানো গলার ওপর থেকে মুণ্ডুটা খুলে আমার বেডে এসে পড়ল। সাদা কোট পরা স্কন্ধকাটা দেহটা তখনও চেয়ারে; অসাড়।

" সরি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি মনোজবাবু। আমি এ'ভাবে আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনি। আপনার গা থাকলে ছুঁয়ে বলতাম"। খাটের ফ্যাকাসে-মুখো মুণ্ডুটা একটানা বিড়বিড় করে চলেছে। আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু কিছুতেই পারছি না ভির্মি খেতে।

খেয়াল করলাম আমার খাটের পাশের চেয়ারে মাথাকাটা দেহটা ক্রমশ আবছা হতে শুরু করেছে। কিন্তু খাটের মুণ্ডুটার "সরি সরি" বিড়বিড় থামেনি।

"তবে আপনি ঠিক ইয়ে...মানুষ নন, তাই না ডাক্তারবাবু"?

"এককালে ছিলাম মনোজবাবু"।

" আর আমিও বোধ হয়..."।

"মিনিট দশেক আগেও ছিলেন। মানুষ"।

" এখন"?

"ভূত"।

" অ। এ'টা হাসপাতাল নয়"?

"না, এ'টা বাফার জোন"।

" বাফার জোন"?

"ওই, মরার পর দুম করে ঘৌলমন্ডি দেখলে কচিভূতদের কনফিগারেশন গড়বড় হয়ে যায়। তারপর তাদের রিসেট করে রিলঞ্চ করতে হয়৷ তাদের খুলি-ক্লিনিকে পাঠিয়ে হাজার রকমের কন্ডশনিং করিয়ে তারপর নর্মাল করা দরকার৷ বিস্তর হ্যাপা। অনেকে আবার একবার বিগড়ে গেলে আর কিছুতেই বাগে আসতে চায়না। এই যেমন মাধবখুড়ো,  বোমা বাঁধতে গিয়ে চার টুকরো হলেন। অথচ ভূত হয়েছেন জেনে এমন ঘাবড়ে গেলেন যে কিছুতেই ফুল বডি রিকনসাইল করল না। আজও মাধবদার ডান পা আর বাঁ পা মিলে বডি আর মাথার নামে অকথ্য সব নিন্দে রটিয়ে বেড়ায়"।

" আমার না, কেমন গা গুলোচ্ছে"।

" গা নেই মশাই, ঘৌলমন্ডিতে কারুর গা থাকলে তবে তো গা গুলোনোর প্রশ্ন। একটা সুইডিশ ভূতের টীম অবশ্য বছর দুয়েক ধরে চেষ্টা করছে গা না থাকলেও কী'ভাবে সুড়সুড়ি উপভোগ করার উপায় খুঁজে বের করতে। কিন্তু গা গুলোনোটা মনের ভুল মনোজবাবু"।

"ঘো..ঘৌ...ঘৌলমন্ডি...এ'টা কী"?

" ও'দিকটা পৃথিবী, এ'দিকটা ঘৌলমন্ডি। অবশ্য ভিনগ্রহের ভূতজগতগুলোর নামধাম আমার তেমন জানা নেই, আছে কিনা তাও জানিনা। আমাদের দৌড় এই ঘৌলমন্ডি তক"।

"আর..বাফার জোন"?

" মরার পর মড়াদের মধ্যে চমকে ভেবড়ে যাওয়ার একটা টেন্ডেন্সি দেখা দেয়। সে'টা রুখতেই গভর্নমেন্টের তরফ থেকে এই বাফার জোন অফিস তৈরি হয়েছে প্রায় বছর দশেক হল। সমস্ত মড়া এসে আগে এখানে জড়ো হয়। আর আমরা যারা এ'খানে চাকরী করি তারা পৃথিবী গোছের একটা পরিবেশ সিমুলেট করি। যা'তে আপনাদের একটু ধাতস্থ করে নেওয়া যায়। আফটার অল, আপনারা তো জানেন না যে কোয়ালিটি অফ লাইফে পৃথিবী ঘৌলমন্ডির কাছে বারো গোল আর দু'শো বারো রানে হারবে। ক্রমশ জানতে পারবেন"।

"মরেও মুক্তি নেই দেখছি ডাক্তারবাবু। এ'খানেও গভর্নমেন্ট,  এ'খানেও চাকরী। পড়াশোনাও আছে বোধ হয়"?

" রীতিমত। আমি নিজে গ্যাস পাস করেছি। নয়ত সরকারি চাকরী পেতাম না"।

"গ্যাস"?

" ঘোস্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেস"।

"ওহ, তা এই হাসপাতাল বোধ হয় সিমুলেটেড, তাই না"?

"পুরোপুরি"।

" আর তাই বোধ হয় ওই ঘড়িতে গোলমাল, দু'টো কাটাই সেম সাইজের"।

" এহ বাবা, তাই তো। ফের সিমুলেশনে গণ্ডগোল। আমার প্রমোশনটা এ'বারেও গ্যালো"। বলে গজগজ করতে করতে মুণ্ডটা ফের চেয়ারে রাখা দেহের ঘাড়ে গিয়ে বসল; অমনি আবছা দেহটা ফের স্পষ্ট হয়ে উঠল।

"আপনার নামটা ডাক্তারবাবু"?

" ওহ, আমার আবার ডাক্তার বলা কেন। নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম হাতুড়েনসিক। ডাক নাম হাসি"।

"এ'টা কোনো নাম হল"?

" হ্যাঁ। মনোজ খুবই বদখত নাম। চলুন, সবার আগে গিয়ে আপনার নতুন নাম সংগ্রহ করে আসি"।

"নতুন নাম"?

" নয়ত কি মনোজ নামে ডাকবে নাকি সবাই চিরকাল? ভূতেরা হাসবে যে"।

"ভাই হাসি, আমার মনে কয়েক হাজার প্রশ্ন গিজগিজ করছে"।

"সামনে অনন্তকাল পড়ে ভায়া। ব্যস্ত হওয়ার কিছুই নেই। ইয়ে, একটা রিকুয়েস্ট। নাম রেজিস্ট্রেশনের অফিসে গিয়ে ঘড়ির গলদ আর আমার মুণ্ডু খুলে পড়ার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো, কেমন? নয়ত এ'বারের প্রমোশনটাও ঝুলে যাবে"।

"বেশ"।

"আর ইয়ে, আরো একটা জিনিস। বাসে আপনা সঙ্গে একটা বাক্স ছিল"।

" আহা রে, তাই তো। পরাশর সুইটসের সরভাজা। বাপনদা সে সরভাজা বলতে অজ্ঞান। ভোগে লাগল না"।

"ও মা। ভোগে লাগবে না কেন"? এরপর গলা একটু নামিয়ে বললেন " ও বাক্স আমি ঘৌলমন্ডিতে উঠিয়ে এনেছি"।

"আনা যায় নাকি"?

" আইন বিরুদ্ধ। তবে সে সরভাজার সুবাসের জন্য হাজার আইনকে জবাই করা যায়। চেপে যাবেন ব্যাপারটা, আপনি ভদ্র সন্তান, বোঝেনই তো; মাঝেমধ্যে আইন না ভাঙলে কন্সটিটিউশনের গালে ব্রণ বেরোয়। ইয়ে, ভাগ পাবেন"।

"খাওয়া যায়? আই মীন ভূতেরা খেতে পারে"?

" খেতে না পারুক, শুঁকতে পারে। এ'খানে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার সব আছে। শুধু সে সব খাওয়া হয় না; শুধু শোঁকা। তবে তা'তে সুবিধে আছে; জিরো অম্বল আর নো গলাবুক জ্বালা"।

"তোফা"।

" ওয়েলকাম টু ঘৌলমন্ডি"।