Monday, July 31, 2017

করোলারি

- এতক্ষণে আসার সময় হল হে রাখহরি?

- বৃষ্টি দেখেছেন চক্কোত্তিদা? ক্যাটস অ্যান্ড ডগস। আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টটিকে একটু বলুন দেখি এক কাপ দার্জিলিং সাপ্লাই দিতে। আমার আবার শুগারলেস। 

- কলিংবেল শুনেই সে ইন্সট্রাকশন চলে গিয়েছে শিবুর কাছে। 

- আগের দিন পেঁয়াজিগুলো বড্ড কড়া করে ফেলেছিল। আজকে একটু কেয়ারফুলি ভাজতে বলবেন প্লীজ। 

- আজ করলা স্পেশাল ফ্রাই। 

- করলা?

- অবহেলা কোরো না ভাই। করলার যে এমন ট্রান্সফর্মেশন হতে পারে সে'টা কামড় না বসিয়ে টের পাবে না। তিল, চালবাটা আর দু'চারটে সিক্রেট ইনগ্রেডিয়েন্ট মিলিয়ে...আমার স্পেশাল রেসিপি। 

- যা হোক। শিবুকে বেগুনীর কথা বলে দিতে হয়। করলা যদি বাই চান্স মুখ থুবড়ে পড়ে?  

- চান্স নেই। তবে বেগুনীতে কারুর কোনওদিন ক্ষতি হয়েছে বলে শুনিনি । সে ব্যবস্থা করা যাবে। যাক গে, 'বার আসল মালটা বের করো দেখি বাবা রাখহরি। 

- এত ইম্পেশেন্স নিয়ে আপনি যে কী করে রেসের মাঠে নার্ভ ধরে রাখেন চক্কোত্তিদা। 

- আরে ফটোফিনিশে পঞ্চাশ হাজার ফসকে গেছিল এইটিট্যুতে। তা'তেও টেন্স হইনি। পঞ্চাশ হাজারের আজকের দিনে ভ্যালু ভেবেছ? ক্যালিফোর্নিয়া ক্রোম শেষ মুহূর্তে চোক না করলে আজ আমায় লুঙ্গি ফতুয়া পরে সোদপুরের ফ্ল্যাটে বসে থাকতে হত না। যাক গে, আমায় ইমপেশেন্ট ভেবো না রাখহরি। এ'বারে জিনিসটা বের করো। 

- এই যে। 

- 'টা?

- ব্যাগটা খুলেই দেখুন না। 

- খুললাম। এই...এই...ডিবেতে আছে?

- আজ্ঞে।

- এই? 

- স্ট্রেট ফ্রম তিব্বত। 

- দেখতে তো হোমিওপাতির দানা মনে হচ্ছে। অবশ্য হলদেটে রঙ। 

- খান পঞ্চাশেক বড়ি আছে। ও'তেই আপনার চলে যাবে। 

- এই বড়িই স্বয়ং দালাই লামা হন্যে হয়ে খুঁজেছেন? কিন্তু পাননি?

- আলবাত। 

- অথচ তুমি পেলে?

- আপনি এত অবিশ্বাসী কেন বলুন তো চক্কোত্তিদা?

- টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড নিচ্ছ ভাই রাখহরি। টাকাটা কম নয়। 

- অ্যাডভান্স তো মাত্র পাঁচ হাজার দিয়েছেন। পনেরোর পোস্ট ডেটেড চেক। কাজ না হলে চেক আটকে দেবেন। মিটে গেল। 

- পাঁচটা তাহলে ভোগে? এ বড়ি কাজে না লাগলে?

-   আপনি একটা নেগেটিভিটির ডিপো। আমি কি মাদুলির সেলসম্যান? যে আজ আছি আর কাল নেই?  

- একটা কথা বলো, এ বড়ি টেস্ট করে দেখেছে তুমি?

- না। আমার হাইটের ভয় আছে, জানেন তো। আমি যখন কলেজে তখন মেজজ্যাঠা নিকোবারে একটা কন্ট্রাক্টরির কাজ করত। আন্দামান ঘুরে যাওয়ার জন্য আমায় প্লেনের টিকিট কেটে দেবে বলে ঝুলোঝুলি; আন্দামান দেখার লোভ থাকলেও প্লেনে উঠতে রিফিউজ করেছিলাম। শেষে গিয়েছিলাম জাহাজে। দার্জিলিং পর্যন্ত এড়িয়ে চলি, অলটিচিউডের বাড়াবাড়ি আমার ধাতে সয় না। কাজেই এই বড়ি খেতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। 

- তাহলে কাজ যে দেবেই সে'টা এত নিশ্চিত হলে কী করে? 

-  কারণ আমি মহান জামইয়াংকে দেখেছি। যার আবিষ্কার এই বড়ি। তিনি নিজে এ বড়ি খেয়ে ডেমনস্ট্রেশন দিয়েছিলেন। সেই জামইয়াং যার টিকির দেখা স্বয়ং দালাই লামাও পাননি। 

- তুমি কোনও দিন তিব্বত গেছ বলে তো...। 

- জামইয়াং কি শশীবাবু? শ্যামবাজারের বাইরে যার খোঁজ পাওয়া যাবে না? আরে জামইয়াংকে বেঁধে রাখবেন তিব্বতের মধ্যে? শুনে রাখুন, জামইয়াংয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা মৌলালির কাছে। সে এক লম্বা গল্প। যাক গে। এই রইল বড়ির ডিবে। শিবুকে ডাকুন দেখি। চা না পেলে চলছে না আর।


***

তিন দিন হয়ে গেল সিলিং থেকে নামা হয়নি চক্রবর্তীবাবুর। একটা মাত্র বড়িতেই এই। তাও ভালো বড়িটা বাড়ির বাইরে গিয়ে খাননি, নয়তো এতক্ষণে ভাসতে ভাসতে বঙ্গোপসাগরের ওপর গিয়ে  পড়তে হত। বে অফ বেঙ্গল পুরীতে বাদাম চিবুতে চিবুতে ভালো লাগে, ফর্ম্যাট পালটে কেমন লাগবে বলা মুশকিল।
সিলিং ফ্যানের ব্লেডগুলোকে সেন্টার টেবিলের মত ব্যবহার করতে হচ্ছে, শিবু মই বেয়ে উঠে সে'খানে চা খাবারদাবার রাখছে আর নামিয়ে আনছে। রাখহরি এর মধ্যে একদিন দেখা করে বাকি টাকার জন্য তাগাদা দিয়ে গেছে। সেই জানালে যে জামিয়াংয়ের হিসেব বলছে যে বড়ির প্রভাব কাটতে আরও দিন দুই লাগবে।

মনটা বেশ চনমনে লাগছিল চক্রবর্তীবাবুর। সিলিংয়ে বসে বসেই নেমন্তন্নের লিস্টটা ফাইনাল করে ফেললেন তিনি।
প্রমোশনের নামে প্রহসনওলা বস।
অকারণ হেনস্থা করা সহকর্মীগুলো, বিশেষ করে সমাদ্দারের ব্যাটা।
দেশের বাড়ির বিধুবাবু, অকারণে মামলা করে দু’বিঘে হাতিয়ে নিলেন ভদ্রলোক।
মধু মাছওলা এন্তার ঠকিয়েছে গত কুড়ি বছর ধরে। হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।
প্রতিবেশী কমল শিকদার, রোজ খবরের কাগজ নিয়ে আর ফেরত দেওয়ার নাম নেই।
কালনার মেজপিসি, সেই দশ বছর ধরে বলছেন পুকুরের মাছ পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু আদতে লবডঙ্কা।

এমন আরও জনা পঞ্চাশেক। পাড়ার ক্লাবের মাঠ ভাড়া করে বিশাল আয়োজন হবে। শামিয়ানা থাকবে না। সমস্ত আপদের দলকে ভুঁড়িভোজ খাওয়ানোর অছিলায় উড়িয়ে দেবেন। স্রেফ উড়িয়ে দেবেন। সাত দিন ধরে এঁরা উড়বে। কেউ পৌঁছবে ভ্ল্যাডিভস্টক তো কেউ জাফনা। কেউ হয়ত প্রশান্ত মহাসাগরে তলিয়ে যাবে।

যাক গে।

একটা বদলার মত বদলা হবে।

***

-      চক্কোত্তিদা! আপনি...আপনি পাগল হলেন নাকি? কলার ছাড়ুন আমার!

-      রাখহরি‍! আমার সঙ্গে চালাকি নয় বাছাধন। আমার সঙ্গে চালাকি নয়। বারো ক্লাস পর্যন্ত নরেনবাবুর কাছে কুস্তি শিখেছি। আমার সঙ্গে চুক্কি চলবে না।

-      আরে হয়েছেটা কী?

-      ওই ডিবের বড়িগুলো। সব ফাঁকি। অকাজের। ইউসলেস।

-      মানে? দিব্যি তো আপনি সাত দিন ভেসে রইলেন। আমি নিজে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করে এলাম। কলার ছাড়ুন!
-      শাট আপ! ওই একটা বড়িই কাজের ছিল। বাকি সব ফাঁপা! অকাজের। কেউ উড়ল না। প্রত্যেকটা করলা ফ্রাইতে একটা করে বড়ি দেওয়া ছিল। সবাই খেলে, কিন্তু কেউ ভেসে গেল না।

-      কী? কেউ ভেসে গেল না মানে? ও বড়ি আপনি অন্যদের খাওয়াতে গেছেন?

-      আমার বড়ি আমি যাকে খুশি খাওয়াব! কিন্তু বড়ি কাজ করবে না কেন?

-      আরে! বড়ি অর্ডার নেওয়ার সময় আমি আপনার থেকে আধার কার্ডের জেরক্স নিয়েছিলাম ভুলে গেলেন?

-      তা’তে কী?

-      ওই বড়িগুলো আপনার আধার নম্বরের সঙ্গে লিঙ্ক করা যে চক্কোত্তিবাবু! অন্য কেউ খেলে কাজ করবে কেন?।

-      যাহ্‌, সাপও মরল না। এ’দিকে বিস্বাদ বড়ি মিশিয়ে আমার করলা ফ্রাইয়ের স্পেশাল রেসিপিও জনতার কাছে তিরস্কৃত হল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এ আমি কী করলাম হে রাখহরি। এ আমি কী করলাম!

পুজো পুজো ইয়ে

- পুজো আসছে।
- চিরকাল তেমনটাই ঘটে ভাই।
- মানে?
- ডিসেম্বর মাসেও পুজো উলটো দিকে হেঁটে যায় না, এদিকেই এগিয়ে আসে।
- আই মীন, পুজো প্রায় এসে গেল আর কী।
- এসে যাওয়ার ডেফিনিশন কি?
- মানে ইয়ে, নেয়ার বাই।
- আমার আলিগড় পৌঁছেও মনে হয় দিল্লী বহুত দূর। ওদিকে সুভাষবাবুর বার্মায় এসে মনে হয়েছিল দিল্লীরর ছোলেকুলচের গন্ধ পাচ্ছেন।
- আমি বলতে চাইছি যে, বাতাসে একটা বেশ পুজো পুজো গন্ধ...।
- ইউ মীন, চারদিকে ঘেমো ভিড়ের গন্ধ?
- আরে উৎসবের মেজাজটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে...।
- ইলিশের দাম কমেছে?
- কই! না তো! তা'তে কী?
- ইলিশের দাম আগুন, এরপরেও আপনারা উৎসবের কারণ খুঁজে পান?

ভাজাভুজি

- এতক্ষণে আসার সময় হল হে রাখহরি?

- বৃষ্টি দেখেছেন চক্কোত্তিদা? ক্যাটস অ্যান্ড ডগস। আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট শিবু বাবাজীবনকে একটু বলুন দেখি এক কাপ দার্জিলিং সাপ্লাই দিতে। আমারটায় আবার শুগারফ্রী।

- কলিংবেল শুনেই সে ইন্সট্রাকশন চলে গিয়েছে শিবুর কাছে।

- আগের দিন পেঁয়াজিগুলো বড্ড কড়া করে ফেলেছিল। আজকে একটু কেয়ারফুলি ভাজতে বলবেন প্লীজ।

- আজ করলা স্পেশ্যাল ফ্রাই।

- করলা?

- অবহেলা কোরো না ভাই। করলার যে এমন ট্রান্সফর্মেশন হতে পারে সে'টা কামড় না বসিয়ে টের পাবে না। তিল, চালবাটা আর দু'চারটে সিক্রেট ইনগ্রেডিয়েন্ট মিলিয়ে...আমার স্পেশ্যাল রেসিপী আর শিবুর রান্নার হাতের কামাল।

- যা হোক। শিবুকে বেগুনীর কথাও বলে দিতে হয়। করলা যদি বাই চান্স মুখ থুবড়ে পড়ে? 

- চান্স নেই। তবে বেগুনীতে কারুর কোনওদিন ক্ষতি হয়েছে বলে শুনিনি । সে ব্যবস্থা করা যাবে। যাক গে, এ'বারে গুছিয়ে বসো দেখি।

- চক্কোত্তিদা, আজ দিনটা বড় ভালো।

- শাঁসালো কাউকে জোটালে নাকি?

- বড়বাজারের ভুতোড়িয়া। ফ্যামিলির চার ভাইয়ের নামে চারটে পলিসি গছানো গেলো বেশ। মোটা প্রিমিয়াম। আমার এ কোয়ার্টারে আর চাপ রইল না।

- এত বড় একটা ব্যাপার, তাও খালি হাতে এলে হে রাখহরি?

- হরিহরের দোকান থেকে ডিমের ডেভিল আনার প্ল্যান ছিল চক্কোত্তিদা। কিন্তু অ্যাইসা বৃষ্টি...।

- বৃষ্টিকে অবহেলা করছ ভায়া?

- অবহেলা নয়। তবে কলকাতায় থেকে বৃষ্টি পোয়েটিক আবেগটাও টলারেট করা যায় না। আপনি জানেন পার্ক সার্কাসের কী অবস্থা আজ? আর দিন দশেক এমন বৃষ্টি চললে সে'খানে জাল ফেললে ইলিশ উঠবে। যা হোক, শিবুকে বলুন চা দিয়ে যেতে...।

- আর বাজে সময় নষ্ট নয়। টেবিলে এসো। একার কনসেন্ট্রেশনটা ব্যাপারটা মজবুত হচ্ছে না।

- ভিসিয়াস সাইকেল চক্কোত্তিদা। চা ছাড়া কনসেন্ট্রেট করতে পারছি না...আবার ও'দিকে...।

- কনসেন্ট্রেট করতে না পারলে  চা জুটবে না...হে হে হে হে...। এসো এসো ভায়া। চেয়ারটা টেনে নাও।

- বেশ। এ'বার শুরু করুন। ইয়ে, আপনার আগের রাঁধুনি বিপ্রদাসের চেয়ে এ ব্যাটা শিবু কিন্তু অনেক ভালো।

- ভালো হবে না কেন? বিপ্রদাসের মৃত্যু পাতি তিন দিনের জ্বরে, মিডিয়াম ছাড়া সে নামবে কেন? ওকে নামিয়ে নিজেরই হ্যাপা বাড়ত।

- শিবু বোধ হয় ট্রেনে কাটা, না?

- ডাউন কাটোয়া, উত্তরপাড়ার কাছে। এক্কেবারে ছটফটে স্টেট! মিডিয়াম টিডিয়ামের ধার ধারে না, একটু আদর করে ডাকলে নিজেই লাফিয়ে চলে আসে। হে হে হে। আর ওর রান্না হাতটাও জম্পেশ ভায়া। আজ করলা ফ্রাইটা চেখেই দেখ না।

Sunday, July 30, 2017

নিশ্চিন্দি

রাত্রি এলেই রোখ চেপে যায়।

তরতরিয়ে চিঠি লেখা চলে। আত্মবিশ্বাসী ঝরঝরে ভাষা। টেবিল চাপড়ানো দাবী,  লোফার মার্কা আদর। সিগারেটের নেশাটা নেহাত ধাতে সয় না, নয়তো অ্যাশট্রে উপচে একাকার কাণ্ড হত।

মাঝেমধ্যে পায়চারীতে জিরিয়ে নেওয়া। সে'সময় আবার মনের মধ্যে শাসনের ভাষাটুকু সাজিয়ে নেওয়া  যায় যা'তে কলম ধরলেই পুরনো বাড়ির ঝুরঝুরে পলেস্তরার মত অভিমানটভিমান সমস্ত ঝরে পড়া যায়।

পুরীর রাস্তায় বিকেলের ক্যাঁচরম্যাচর ধরে এগোনো রিক্সার মত এগিয়ে চলে সেই সাড়ে সাত পাতার চিঠি। স্বর্গদ্বারের ভীড়ে এসে প্যাডেল নরম হয়ে রিক্সা থামে। দু'জনে টুপটাপ নেমে পড়ে, রিক্সায় আটকে পড়া নীল ছাপার শাড়ির আঁচলটা ছাড়িয়ে নেন সরু চেক হাফশার্ট।

খুব সাবধানে বন্ধ করা ছিটকিনির মত "ইতি তোমার..." টেনে দেওয়া চিঠির নীচে। বেশরম হয়ে দিনদুপুরে দুদ্দাড় ঘরের দরজা বন্ধ করে লোক জানান দেওয়ার বদমায়েশি বরদাস্ত করেন না নীল ছাপা। চেকশার্টের হয়েছে যত জ্বালা আর রয়েছে দু'টো খোলা বোতাম।

ভোরের দিকে বোধবুদ্ধির পোস্ট অফিস হাঁ করে দাঁড়ায়, কুচিকুচির স্টাম্প লাগিয়ে ফেলে দিলেই নিশ্চিন্দি।

Monday, July 24, 2017

দেশ মেরে

গত তিন দিন ধরে ইউনিভার্সিটিতে রয়েছি।

বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়নি।
ইয়ে, ক্লাস করারও সুযোগ হয়নি।
গত বছর ভারতকে কুচিকুচি করার প্ল্যান যে চুয়িংগাম চিবুতে চিবুতে কষেছিলাম, আজ সে'টা ফেলে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু সময় মত মনে পড়েনি। পাঁজি বলছে চুয়িংগাম ফেলার পরের লগ্ন আগামী ডিসেম্বরে আসবে।

তবু। ঠায় বসে রয়েছি ইউনিভার্সিটির মাঠে।

আমি একা নই। সঙ্গে রয়েছে আমার বাকি কমরেডরা।
থুড়ি। আমরা একে অপরকে কমরেড বলা বন্ধ করেছি গতকাল থেকে। আমরা এখন একে অপরকে 'স্বামীজি' বা 'গুরুমাতা' বলে ডাকছি। মন সাইকেল আগরবাতির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আছে সবসময়, ডাকের কী মহিমা।

আমরা তিন দিন ধরে শুধু বসে রয়েছি। চোখে বিস্ময়, বুকে আনচান, গলা বুজে আসছে কান্নায়। বিশ্বাসে দেশের জিডিপি, তর্কে বহুদূর ; এ পরম সত্য আমাদের সকলের রক্তে গাঁজার সুবাসের মত মিশে যাচ্ছে।

আহ্। বিপ্লবকে আজ শুধু চ্যাটার্জী বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে। এই তিন দিন ধরে ক্রমশ আমরা নিজেদের বদলে যেতে দেখছি।

জয় জয় জয় হে।

এই তিন দিন ধরে আমরা একটানা ওই কামানের দিকে তাকিয়ে। যে ছেলেটা এই সেদিনও গিটার নিয়ে রূপম ইসলামের গান গাইত, সে আজ দু'দিন ধরে গাইছে "কামান ইন্ডিয়া দিখা দো"।

আমরা গত তিন দিন ধরে আমরা পালটে যাওয়া স্বপ্নের ভারতবর্ষের মুখ দেখে চলেছি। তাই লজিকটজিক শুনে ভুলিতে চাই না আর।


Saturday, July 22, 2017

কলকাতার মেসিয়াহ্‌ - ৫


মেসবাড়ি থেকে কলেজ বাসে তিনটে স্টপেজ। সকাল এগারোটা থেকে ফার্স্ট ক্লাস। অরূপ অবশ্য হেঁটেই যায়।

হাঁটার জন্য কলকাতা অতি চমৎকার জায়গা। একটু আগেভাগে স্নান সেরে নিতে হয়। একটা বাথরুম, পনেরোটা মানুষ; একটু হুড়মুড় থাকেই। সব থেকে বেশি সময় লাগে অজয়দার, তবে অজয়দা কলেজটলেজ বিশেষ যায় না। সকলে বেরিয়ে গেলে তারপর স্নান সারে সে। অজয়দা বলে স্নান হল সাধনা; দুরাউন্ড সাবান, একটু টপ্পা আর দুদিনে একবার শ্যাম্পু না মিশলে স্নান জমে না। অরূপ একবার বোকার মত প্রশ্ন করে ফেলেছিল প্রতি স্নানে দুরাউন্ড সাবান? কিন্তু এই দুমাসে যে তোমায় একটাও নতুন সাবান আনতে দেখিনি। অজয়দা খুব চটে গেছিল গুরুজনকে সম্মান করতে পারিস না? ইডিয়ট! পালটা প্রশ্ন? মেসে অ্যানার্কি ঢোকাবার তাল করছিস”? রীতিমত ঘাবড়ে গেছিল অরূপ। অজয়দার টপ্পাপ্রীতি নিয়ে আর প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি। অজয়দার রাগ অবশ্য বেশিক্ষণ টেকেনি কারণ ওর নিয়মিত জলখাবার হচ্ছে মেস লাগোয়া মন্টুদার দোকান থেকে আনা এক ভাঁড় চা, অরূপের বাড়ি থেকে নিয়মিত সাপ্লাই আসা মায়ের হাতে বানানো দুপিস গজা আর একটা গোল্ডফ্লেক। কাজেই অরূপের ওপর বেশিদিন রাগ করে থাকলে অজয়দাকে গজাNone হয়ে বসে থাকতে হবে। পাশের বেডের বল্টুদা ফিসফিসিয়ে বলেছিল অজয়দা বলে স্নান আর ধ্যান গোপনে করা উচিৎ। বল্টুদার বিশ্বাস আর দুচার বছর এগজ্যাম ড্রপ দিয়ে মেসে কাটিয়ে দিতে পারলেই অজয়দা পরমহংস হয়ে যাবে। তখন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অজয়দার জন্য এক পিস রাসমণি আর একটা বিবেকানন্দ খুঁজতে হবে।

যা হোক। শহরে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে অরূপের বড় ভালো লাগে। মেসবাড়ি সরু গলি ধরে কিছুটা এগোলেই হ্যারিসন রোড। রাস্তার এক ধার দিয়ে ঠাসা নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপানোর দোকান। অন্তত সতেরোটা দোকান তো হবেই। হ্যারিসন রোডটা যেখানে গিয়ে কলেজ স্ট্রিট মোড়ে মিশছে তার ঠিক কিছুটা আগেই দেলখোশা। অরূপ যখন দেলখোশা পেরোয় তখন রেস্টুরেন্ট সবে খুলব খুলব করছে, সাফসাফাই চলছে পুরো দমে। দেলখোশা অরূপের বেশ পছন্দ হয়েছে, সমস্ত কিছু কেমন সাত-পুরনো। কাউন্টারে বসা ম্যানেজার থেকে শুরু করে, ওয়েটার থেকে আসবাব, মেঝে, দেওয়াল সমস্ত কিছু। পুরনো। অরূপের স্থির বিশ্বাস ওই পুরনো গন্ধটা সরিয়ে নিলেই দেলখোশার কাটলেটের অর্ধেক হয়ে যাবে।

দেলখোশা থেকেই গিজগিজ করছে বইয়ের দোকান। চারিদিকে বই। বেশির ভাগ অবশ্য পড়ার বই। কিন্তু এত বইয়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে দিব্যি লাগে অরূপের। অদ্ভুত ব্যাপার, মাঝেমধ্যে অরূপ হাঁক শুনতে পায় কোনও না কোনও দোকান থেকে এইযে ভাই, দিকে! সব রকমের গাইড বই আছে। অরূপ বিরক্ত হয়, তাকে দেখে কি খুব গাইড বই গিলে বমি করা ছেলে মনে হয়? মাঝেমধ্যে পরীক্ষায় যে অরূপ ধেড়িয়ে বসে না তা নয়, তবু গাইডবইয়ের সামনে নতজানু হয়নি কোনওদিন। ছোটমামা বলে নম্বরটম্বর সব বাতেলা। নম্বরের জন্য ল্যাজ গুটিয়ে নেওয়ার কোনও মানে হয় না।

অরূপের মূল আগ্রহ টিফিনের দোকানগুলো নিয়ে। ক্যালক্যাটা ইউনিভার্সিটির সামনে খান দুই। মেডিকাল কলেজের সামনে খান তিনেক। টোস্ট, বাটার টোস্ট, ডিম টোস্ট, বাপুজি কেক, মামলেট, পোচ, ঘুগনি পাউরুটি, চা, চার থেকে ছরকমের বিস্কুট; কত কী। এই সবকিছু মেলানো সুবাসের মণ্ডটা বুকে সেধোতেই মনে হয় আহ্‌, আজকের দিনটা দিব্যি যাবে। রোজ, রোজ এমনটাই মনে হয়। মেডিকাল কলেজের উল্টোদিকে সারি সারি ওষুধ আর মেডিকাল সরঞ্জামের দোকান। এখান থেকে রঙটা পালটে যেতে আরম্ভ করে। খানিক পর থেকে একের পর এক বাথরুম ফিটিংসের দোকান। এর ফাঁকেই অবশ্য অরূপ দেখে নিয়েছে একটা ভালো কনফেকশনারির দোকান। বৌবাজার মোড়ের ঠিক আগে একটা মন্দির। তার পাশ দিয়ে একটা গলি ঢুকে গেছে যেটা অজয়দার ভাষায় আমার টপ্পাবোধ আর এই গলির হালহকিকত; এই দুই নিয়ে বিশেষ খোঁজখবর করতে যেও না হে অরূপকুমার, সে সত্য ধারণ করার ক্ষমতা তোমার মত সিলেবাস ঘাঁটা বান্দার নেই

কলেজে ঢোকার মুখে একটা টেলিফোন বুথ। অরূপ রোজ সকালে একটা ফোন করে মাকে। রোজ একই কথার সিরিজ। অরূপ খাবার খেয়েছে কিনা। জামাকাপড় সময়মত কাচছে কিনা। রোজ মশারি টাঙিয়ে শুচ্ছে কিনা। অরূপ মাঝেমধ্যে ভাবে জিজ্ঞেস করবে তাঁর নামে বাড়িতে কোনও চিঠি এসেছে কিনা। কিন্তু তার কোনও মানে হয় না।

স্নান, খাওয়া, শরীর, পড়াশুনোর খবর মাকে জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখে অরূপ। তারপর সোজা ক্লাসরুম।   

এই মেঘলা

- বৃষ্টি থামার কোনও চান্স দেখছি না ভাই। আকাশের যা অবস্থা মেঘ সহজে কাটবে বলে মনে হচ্ছে  না।

- তা'তে ম্যাদা মেরে যাওয়ার কী আছে ভায়া? দুপুরে খিচুড়ি।  সন্ধেবেলা বেগুনী। ইলিশ ভাজা রাতে। এঞ্জয়। এ'টাই তো সময়!

- আসলে হয়েছে কী...।

- আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে, গুনগুন করে ওঠো। রোম্যান্স ভুললে চলবে?

- অসুবিধেটা হচ্ছে...।

- এই মেঘলা দিনে একলা...আহা! মেঘলা দিন ছাড়া এমন ক্লাসিক মেজাজ জেনারেট হবে কী করে? এত নেগেটিভ হলে চলে ভায়া? বি পসিটিভ! বর্ষাকে ভালো না বেসে থাকা যায়?

- গেঞ্জি জাঙিয়া ইমিডিয়েটলি না শুকোলে কিছুতেই পসিটিভ হওয়া যাচ্ছে না স্যার। ইন্সটাগ্রামে বৃষ্টি নিয়ে আহাউঁহু শুনলেই লাইকের পাশে কানমলার বোতাম আছে কিনা খুঁজে দেখছি।

মালিশের ছয়

সেলুনে মাথা মালিশ করানোর সময় যে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো মাথায় রাখা দরকার:

১. তেল ছাড়া মাথা মালিশ মিথ্যে।

২. নবরত্ন ছাড়া সব তেল মিথ্যে।

৩. মালিশদাদা মিউট মোডে মালিশ করবেন না। চ্যাঁচাবেন না। স্রেফ গুনগুনিয়ে কথা বলে যাবেন। মোদী, মমতা, ম্যানহোল, মার্কিন কন্সপিরেসি; সমস্তই থাকতে পারে। থাকবে না শুধু প্রশ্ন।

৪. এফএমের বিজ্ঞাপন মালিশ-নির্বাণ বিনষ্ট করে। দরকার হলো এম্পিথ্রিতে নাদিম-শ্রবণ। অথবা "কী উপহার সাজিয়ে দেব" লেভেলের সুর।

৫. মালিশ নরমে গরমের ব্যাপার। গুঁতোগাঁতা নয়, তুলতুল নয়। মালিশকরনেওলার অপ্টিমাম বোধ মালিশখানেওলার অপ্টিমাম বোধের সঙ্গে মিলেমিশ না গেলেই গোটা ব্যাপারটা থাবড়ানোতে নেমে আসবে।

৬. সেমিনারে অফিস রিভিউতে পকেটে রাখা ফোন বেজে উঠুক ক্ষতি নেই। কিন্তু সেলুন-মালিশের সময় ফোনটি স্যুইচড অফ মোডে ভাইটি। ম্যান্ডেটরি। সাইলেন্ট ফাইলেন্ট না। বন্ধ।

নিষ্পাপ মালিশ মুহূর্তগুলো, শুধু নিজের জন্যে রাখা থাক।

Thursday, July 20, 2017

দ্রোণ পর্ব

চারদিকে ধুন্ধুমার যুদ্ধ।

অবশ্য গোটাটাই এক তরফা। দ্রোণাচার্য পাণ্ডব সৈন্য দেখলেই বেগন স্প্রে ঝেড়ে আরশোলা মারার মেজাজে কুপিয়ে যাচ্ছেন।

নকুল ইতিমধ্যে মেট্রোজিলের খোঁজ শুরু করে দিয়েছিল। সহদেব "শিবিরে লাইটার ফেলে এসেছি, ক্যুইকলি নিয়ে আসছি" বলে সেই যে হাওয়া হয়েছে এখনও পাত্তা নেই। ভীম গদার ডাঁটি দিয়ে পিঠ চুলকে যাচ্ছিলেন। অর্জুন সিলেবাসের বাইরের কোশ্চেন পেপার দেখে কৃষ্ণের ওপর তম্বি শুরু করেছিলেন 'শুরুতেই সম্মানজনক এগজিটের ব্যবস্থা করেছিলাম, তা নয়। বাবু এলেন গীতাগিরি করতে। এ'বার হ্যাপা সামলাও'। যুধিষ্ঠির লুকিয়ে অ্যাডাল্ট জোকসের বই পড়ে নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছিলেন।

কেষ্ট দেখলেন কিছু একটা না করলেই নয়।

পাণ্ডবদের ডেকে বললেন "আউট অফ বক্স সলিউশন ভাবো"।

নকুল দরাজ গলায় অফার দিলে "সহদেব খুব ভালো আউট অফ দ্য বক্স ভাবতে পারে। আমি বরং শিবিরে ফিরে যাই, যদি ওকে আউট অফ শিবির ভাবানো যায়"।

যুধিষ্ঠির বললেন "দুর্যোধনকে অনলাইন রামিতে চ্যালেঞ্জ করে দেখব"?

অর্জুন বললেন "বাক্সটা দেখছি না কেন ভাই কেষ্টা'?

ভীম বললেন "মেনহিরটা কাজের সময় খুঁজে পাই না কেন বলো তো"?

অগত্যা কেষ্টকেই সলিউশন বাতলে দিতে হল। সত্যবাদী যুধিষ্ঠির মিথ্যে বললেই দ্রোণ পিলে চমকে গোল বাঁধাবেন। সেই সুযোগেই কাজ সেরে ফেলতে হবে। যুধিষ্ঠির অল্প আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তারপর মনে হল আইডিয়ালিজমের চেয়ে রাজসিংহাসনে রেভিনিউ বেশি। অতএব রাজী হয়ে গেলেন।

কেষ্ট যুধিষ্ঠিরের কানে কানে মিথ্যে বলার প্ল্যান এ আর প্ল্যান বি বুঝিয়ে দিলেন।

যথারীতি দ্রোণকে দেখেই যুধিষ্ঠির প্ল্যান এ ফায়ার করে।বললেন "অশ্বত্থামা হত, বিপ বিপ"। শুনে দ্রোণ বললেন "স্যাড, ভেরি স্যাড। তাহলে এসো তোমাদের ডাবল প্যাঁদানি দিই"।

ভয়ে আমসি হয়ে পড়েছিলেন যুধিষ্ঠির, কোনওক্রমে প্ল্যান বি মনে করে চালিয়ে দিলেন তিনি
"আই হ্যাভ রেড অল দ্য অফার ডকুমেন্টস কেয়ারফুলি বিফোর ইনভেস্টিং"।

ধর্মরাজের মুখে এমন ডাহা মিথ্যে শুনে পর্যুদস্ত বোধ করলেন দ্রোণ। নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। চুপিসারে কাজ সেরে ফেললেন ধৃষ্টদ্যুম্ন।

অমনি চার পাঁচটা স্মাইলি দিয়ে ব্যসদেবকে হোয়্যাটস্যাপ করলেন ধর্মরাজ "স্যার, প্ল্যান বি'র রেফারেন্সটা মূল স্ক্রিপ্ট থেকে বাদ দেওয়াই ভালো, কেমন"?