Saturday, December 31, 2022

মুদীখানার অ্যাপয়েন্টমেন্ট



( পুরনো গল্পের পরের কিস্তি) 

-  কী ব্যাপার? কী চাই ? তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন অথচ কী চাই কিছু বলছেন না। দোকানের ভ্যিউ ব্লক করে কাস্টোমার টার্নওভার কমিয়ে দিন, আর কী!

- ইয়ে, চৌধুরীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।

- অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?

- অ্যাপয়েন্টমেন্ট? মুদীখানার দোকানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট?

- কী বিশ্রী ক্লাসিস্ট মেন্টালিটি আপনার ভাবুন। উইলিয়ামসন, হজেস অ্যান্ড কোম্পানিতে ঢুকে একজন ক্লার্কের দর্শনের আশায় দশটা টেবিল ঘুরে ঘুরে তদ্বির করা বাঙালি, সে মুদীর দোকানে এসে বাঘের বাচ্চা।

- আহ, এ'সব কড়া কড়া কথার কী দরকার ভাইটি।

- ভাই? ভাইটি? বাহ বাহ্‌! মুদীর দোকানের কাউন্টারের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে আড়াইশো মুগডাল ওজন করছি বলে আমি আপনার ভাইটি? আর রাস্তায় আপনার মোটরবাইক দাঁড় করানো কনস্টেবলকে ইয়েস স্যার, রাইট স্যার, নো স্যার? আপনি জানেন আমার পলিটিকাল সায়েন্সে অনার্স আছে?

- বয়সে তো তুমি ছোটই, তাই ভাই বলে ফেলেছিলাম আর কী। 

- থামুন মশাই। পাড়ার h  বয়সে আপনার থেকে বছর পাঁচেক ছোট হলে তাকে ভাইটু বলে হাত নাড়তেন? করলে বুঝতেন কত ধানে কত চাল।

- সরি স্যার। ইয়ে, আপনি কি দোকানে নতুন?

- ইন্টার্নশিপ করছি। কাকার দোকানে শেখার স্কোপ প্রচুর। হাতেকলমে শিখছি। কাস্টোমার এক্সপিরিয়েন্স কী'ভাবে এনহ্যান্স করতে হয় সে'টাও তো জানা দরকার তো। আফটার অল, পলিটিকাল সাইন্সও একধরণের কাস্টোমার ম্যানেজমেন্ট। 

- তাই তো। এ'ব্যাপারটা তো একদমই ভেবে দেখিনি। 

- ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন। আর চাল, ডাল, স্নো, পাউডার কিছু কেনার না থাকলে মানে মানে সরে পড়ুন। টার্নওভারে জল ঢালবেন না।

- শুনুন না ভাই, থুড়ি স্যার। চৌধুরীবাবুর সঙ্গে দরকারটা খুব আর্জেন্ট।

- আমায় স্যার বলার দরকার নেই। আমি এ'সব ক্লাস পলিটিক্সের ঊর্ধ্বে। আমি ভাস্কর। ওই নামেই আমায় ডাকবেন। কাল থেকে একটা নেমপ্লেটের ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি। ভাস্ক্যার চাউড্রি, হেড- কাস্টোমার ইন্টারফেস, মেসার্স বিজিএস। ব্র্যাকেটে ভজহরি জেনারেল স্টোর্স।

- শুনুন না ভাই ভাস্কর। আমার দরকারটা খুবই জরুরী।

- কী'রকম জরুরী শুনি। কোনও পাইকারি অর্ডার ছিল? নাকি আপনি সাপ্লায়ার?

- আমি? ওই সাপ্লায়ার ধরে নিন। আবার ফাইফরমাশও খাটি।

- ও, শুনুন। মাসের শুরুতে আসবেন। এ'সময় ক্যাশ বাড়ন্ত থাকে মশাই। অত ঘ্যানঘ্যান করবেন না। কাকা মাইরি নরম মানুষ, সে সুযোগে সাপ্লায়াররা ক্যাশফ্লো একদম বিগড়ে দিচ্ছে।

- প্লীজ ভাস্কর। চৌধুরীবাবু ওই পিছনের ঘরটার মেঝেতে তোষক পেতে ভাতঘুম দিচ্ছেন তো? জানি। কিন্তু ওঁকে গিয়ে একবার বলো বিনোদ এসেছে। উনি বুঝবেন।

- প্রথমত, ভাতঘুম নয়। ও'টাকে কর্পোরেটের বিদগ্ধ মানুষজন বলে পাওয়ার ন্যাপ। দ্বিতীয়ত , কাকা আমায় কোনও 'বিনোদ আসলে আমায় ডেকে দিস' গোছের মেমো দেয়নি। কাজেই, সরি। এ'বার আপনি আসুন।

- তুমি যদি ডায়রেক্টলি ডেকে দাও ভাই, তা'হলে আমি তোমার ক্যাশবাক্স থেকে কুড়ি মিনিট আগে তিনশো টাকা সরানোর গল্পটা চেপে যাব।

- কী? এ'টা কী ধরণের মিথ্যে অপবাদ! 

- তিনটে একশো টাকার নোট। একটা পাঁচশোও হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করেছিলে। কিন্তু সে'টা পকেটস্থ করার সাহস হয়নি। তুমি জানো চৌধুরীবাবু হিসেবে ক্ষুদিরাম। তিনশোটাকা মেকআপ তুমি দেবে আমি নিশ্চিত। কিন্তু সে'টা গোটা দুপুর কাস্টোমার ঠকিয়ে। কোথাও দু'দশটাকা বেশি, কোথাও দু'দশগ্রাম কম। কিন্তু সন্ধ্যের আগে তিনশো মেকআপ হবে না।

- এই শুনুন...।

- এ'টা সম্ভবত রোজকার স্ট্র্যাটেজি, তাই না? তোমার কাকাকে পাওয়ার ন্যাপে পাঠিয়েই টুক করে টু পাইস কোমরে গুঁজে ফেলা। সে অবশ্য পলিটিকাল সায়েন্সে সে'টা নেহাত আউট অফ সিলেবাস নয়। 

- কাকার উঠবার সময় হয়ে গেছে অবশ্য। আপনার কী নাম বললেন যেন?

- বিনোদ। 

- সারনেম?

- দত্ত।

- ডেকে দিচ্ছি। ইয়ে, চা খাবেন স্যার? এনে দেব?  ওই যে নির্মলের দোকান দেখছে, ওই উলটো দিকে। ফ্যান্টাসটিক মালাই চা বানায়। বেশি মিষ্টি নয়, ভেরি স্মুদ।

- নাহ্‌, এ অবেলায় চায়ের দরকার নেই।

** 

- বলো বিনোদ। 

- চ্যাটার্জীবাবুর কাজটা হয়ে গেছে। কাল রাতেই।

- সে তো বুঝলাম। তবে আমার দোকানে হুটহাট উদয় হওয়াটা কম করো। অন্তত ভাস্কর যদ্দিন গেঁড়ে বসে আছে। ছেলেটা একটু বেশি কিউরিয়াস।

- ইয়ে, চৌধুরীবাবু। খুব চালাকচতুর ভাইপোটি আপনার। ইম্প্রেসিভ।

-  হুম। যাকগে। চাটুজ্জের ব্যবস্থা হল বটে। কিন্তু মূল গলদটাকে এখনও ম্যানেজ করা হয়নি।

- গলদ?

- আমাদের মালগুলো ধরা পড়েছে চ্যাটার্জীর কেয়ারলেসনেসে। কিন্তু ট্র্যাক করেছে আর পাকড়াও করেছে অন্য কেউ। বড্ড বেশি ছোঁকছোঁক শুরু করেছে সে।

- ইন্সপেক্টর ভট্ট?

- সে তো স্রেফ যন্ত্র। আদত যন্ত্রী অন্য কেউ।

- হুঁ?

- হাবিলদার হারাধন হালদার। খবর নাও। ভট্টর যত বাড়, তার সবটাই হারাধনের এক্সপিরিয়েন্স আর ফোঁপরদালালিকে ক্যাপিটাল করে।

- ইয়ে,চৌধুরীবাবু, ইন্সপেক্টর ছেড়ে হাবিলদারে ফোকাস করব?

- ভাস্কর খুব একটা ভুল বলেনি। তুমি নিতান্তই ক্লাসিস্ট।

- হুম। ঠিক আছে। হারাধনকে বাজিয়ে দেখা যাক। আর ইয়ে, ক্লাসিস্ট প্রসঙ্গে মনে পড়ল, আপনি নিয়মিত ক্যাশবাক্স মিলিয়েটিলিয়ে দেখছেন তো? কখন কী'ভাবে খান-তিনেক একশো টাকার নোট সটকে পড়ে, কে বলতে পারে বলুন।  

দলিল



- কী রে, কাল রাত থেকে কিছু খেয়েছিস?
- হুঁ?
- এই ঠোঙায় দু'স্লাইস বাটার টোস্ট আছে৷ খা।
- রাখ৷ খেয়ে নেব খানিক পরে।
- জ্যেঠু এখন কেমন আছেন অনি?
- কেমন আছে বলতে পারব না৷ তবে জেনারেল ওয়ার্ড থেকে আইসিইউ তে সরানো খুব দরকার।
- ডাক্তার কী বলছে?
- আর পাঁচটা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার যা বলে। ভ্যাকেন্সি নেই, লিখে দিচ্ছি; প্রাইভেট নার্সিংহোমে নিয়ে যান।
- চেষ্টা করবি না?
- আমার অবস্থা তো জানিস মিনু।
- যদি আমি কিছু..।
- চেষ্টা করছি৷ একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে কালকের মধ্যে আশা করি৷ তারপর না হয়..।
- দেরী হয়ে যাবে না?
- তুই দুম করে চলে এলি..স্কুল ছুটি?
- স্কুল পালিয়ে এসেছি।
- দিদিমণিরাও স্কুল কাটে তা'হলে।
- অনি। টাকাটা আমি দিই না৷ কাল-পরশু সুরাহা হলে না হয়..।
- কই, দে দেখি মাখন-রুটির ঠোঙাটা। খিদেটা চাগাড় দিয়েছে।
- অনি, আমার থেকে টাকা নিতে না চাইলে তোর কাকার কাছে যা। প্লীজ, কথা বলে দেখ অন্তত।
- গতকাল রাত্রে ফোন করলাম কাকাকে, বাবাকে ভর্তি করতে হয়েছে বলে। তারপর থেকে একবারও খোঁজ নিলনা।
- দরকারটা তোর অনি। বাবা তোর।
- আমি একটা ইউসলেস।
- বেশ। এ'বার আগে খেয়ে নে।
**
- হ্যালো।
- মিনু, ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বাবাকে প্রাইভেটে নিয়ে যাচ্ছি৷ মেডিপাওয়ার নার্সিংহোম৷ সে'টা জানাতেই ফোন করেছিলাম৷
- যাক৷ টাকার ব্যবস্থা হল কী'ভাবে?
- কাকাই দিল৷
- তবেই দ্যাখ, তুই খামোখা বদনাম করছিলিস৷
- হেহ্। তা ঠিক৷
- জ্যেঠু ভালো হয়ে যাবেন, দেখিস।
- দেখি।
- অনি, নিজের প্রতি অত অযত্ন কেন রে তোর? চেহারাটা কী হয়েছে দেখেছিস? খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে ফ্যাফ্যা করে ঘুরলেই হবে?
- তুই ভাবিস না।
- আমি ভাবার কেউ নই অবশ্য৷ তবে..আমি মাঝেমধ্যে যাব৷ তোকে দেখতে।
- স্কুল ফাঁকি দিয়েছিস, সে'টা ঠিক আছে৷ সংসার ফাঁকি দিসনা যেন৷ তোর দায়িত্ব তো কম নয়।
- থাক৷ যাব না৷ তবে দরকারে খবর দিস৷
- দেব।
- অনি, সময়মত খাওয়াদাওয়াটা করিস। কেমন?
- করব। এখন রাখি?
- আয়।
**
- কাকা, এই দলিলটা দিতে এসেছিলাম৷ আর ওই কাগজগুলোতেও সই করে দিয়েছি। দেখে নাও৷
- দ্যাখ অনি, দাদার প্রতি একটা দায়িত্ব যে আমার আছে তা অস্বীকার করছিনা৷ তবে দুম করে অতগুলো টাকা কী'ভাবে জোগাড় করি বল..তা'ছাড়া মিতুল জয়েন্ট দেবে এ'বছর..এত আনসার্টেনটি..।
- ও তুমি বেশি ভেবোনা কাকা৷ বাবা যদি নাই থাকে তা'হলে এ বাড়ির প্রতি আমার টানই বা কী৷
- না মানে, তোকে ভিটেছাড়া করার ইনটেনশন আমার নেই৷ তোর যদ্দিন ইচ্ছে; থাক না৷ লীগাল ওনারশিপ পাল্টাছে মানে তো আর তোর মর্যাল রাইট চলে যাচ্ছে না৷ আফটার অল তুই বংশের ছেলে। তবে কী জানিস, দাদার যা সিচুয়েশন; খামোখা প্রাইভেটে নিয়ে গিয়ে অতগুলো টাকা ওয়েস্ট করলি। কোনও আশা আছে বলে তো মনে হয়না।
- আমি আসি কাকা। এখনই না বেরোলে নার্সিংহোম পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে৷
****
বাবার শোওয়ার ঘরের স্টিলের আলমারিটা খুলে নীল ফোলিওব্যাগটা বের করল অনি৷ এই ব্যাগের মধ্যেই বাবা দলিলটা রাখত৷
নীল রঙটা অনেকটাই ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে৷ তবে দলিল রাখা ব্যাগটাই বাবার সবচেয়ে 'প্রাইজড পজেশন' ছিল৷ বাড়িটা গেল। আসবাবপত্রের প্রতিও আর বিশেষ মায়া নেই অনির৷ শুধু বাবার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই ফোলিওব্যাগটা সঙ্গে রাখতে ইচ্ছে হল৷
দলিল ছাড়া ব্যাগটা বড়া ফাঁপা লাগছিল৷ কাজেই দিন সাতেক পুরনো কাগজের ঠোঙটা সযত্নে পকেট থেকে বের করে, দু'ভাঁজ করে সেই ব্যাগের মধ্যে পুরে নিল অনি৷ ওই ঠোঙায় এখনও মাখন-পাউরুটি আর মিনুর সুবাস লেগে আছে; জরুরী দলিল বইকি।

দুই-চার-চার দাদা



- এ'টা কি ট্যু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন?
- হ্যাঁ। ঠিকই। কাকে চাই?
- দিন না ডেকে বেলাকে একটিবার।
- একটু হোল্ড করুন...।
- মিটার যাচ্ছে বেড়ে...।
- এই সেরেছে...ডাকছি তো...একটু ধরুন...।
- এই পাবলিক টেলিফোনে...।
- আরে হ্যাঁ, ডাকছি তো...।
- জরুরী খুব জরুরী দরকার...।
- সে তো বুঝলাম, কিন্তু গানটা না থামালে...।
- হ্যাল্যোওওও...ট্যু ফোর ফোর...?
- যাচ্চলে, আরে আগে ডাকতে দেবেন তো নাকি...।
- ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন!
- লে হালুয়া।
- বেলা বোস তুমি পারছ কি শুনতে!
- আরে বেলাকে ডাকতে পারলাম কই যে ফোন ধরে শুনবে!
- দশবারোবার রং নাম্বার পেরিয়ে তোমায় পেয়েছি...।
- কাঁচকলা পেয়েছেন মশাই। গানের আবেগে বেলা কে হাঁক দেওয়ার সুযোগটুকুও দিচ্ছেন না তো। আগের ওই দশবারোবার রং নম্বরগুলোতেও জলসা বসিয়েছিলেন নাকি? টেলিফোন বুথের তো পোয়াবারো!
- দেব না কিছুতেই আর হারাতে...।
- আরে ছাই হারাবেন! আগে পেলে তারপর তো হারাবেন! বাপ রে বাপ! গানের কী ঠেলা!
- হ্যালোওওওওওও ট্যু ফোর ফোর ওয়ান...।
- বয়ে গেছে আমার কাউকে ডাকতে...।
- ...ওয়ান থ্রি নাইন...!
- রং নাম্বার!
*খটাস*

তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই



আমি উপলবাবু মানুষটাকে আদৌ চিনিনা৷ তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় শুধুই তাঁর গানের মাধ্যমে। গানের সঙ্গে জুড়ে যায় তাঁর কিছু আঁকাআঁকি আর খুচরো লেখালিখি। কোনও কারণে আমার ধারণা হয়েছে যে ভদ্রলোক মুখচোরা৷ এ যুগে (বা হয়ত সব যুগেই) মুখচোরা মানুষদের নিয়ে মারাত্মক সমস্যা; গোলমেলে হইচইয়ের মধ্যে তাঁদের দামী মিনমিনগুলো অক্লেশে হারিয়ে যায়, এবং সে হারিয়ে যাওয়াতে তাঁদের কোনও হেলদোল থাকে না৷ সেই উপলবাবুর একটা জরুরী মিনমিন, অর্থাৎ একটা নতুন গান (আমি প্রথম শুনলাম, সে অর্থে নতুন), স্রেফ বরাতজোরে এই দু'দিন আগে হুট করে কানে এলো৷ একটা অন্যায় হল, গানটা (এবং গানের অ্যালবামটা) উপলবাবুর একার নয়; তাঁর সঙ্গে জম্পেশভাবে রয়েছেন নীলাঞ্জনবাবু৷

ইউটিউব মিউজিক যে'ভাবে এ'গান থেকে ও'গান বেয়ে আপনা থেকেই তরতরিয়ে এগিয়ে চলে, তেমনই যাচ্ছিল৷ পরপর পুরনো বাংলা ব্যান্ডের গান বাজছিল। আমি ঘাড়-মাথা দুলিয়ে আহা-বাহা করে যাচ্ছিলাম৷ এমন সময় সুট করে এই "তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই" গানটা প্লেলিস্টে ঢুকে পড়ল৷

সরলসিধে নির্ভেজাল প্রেমের গান; সে গানের সুরে মনে হয় কলজেকে কলেজে ফেরত পাঠাই৷ সে গানের কথায় মনে হয় সেই সরল বয়সে ফিরে যাই যে'সময় নাক সিঁটকে খুঁতখুঁত করে দিন গুজরান করতে হত না; সহজ জিনিস সহজেই ভালো লাগানো যেত৷ সেই বয়স, যে বয়সে "অমুকটা ন্যাকামি, তমুকটায় ডেপথ নেই" গোছের জ্যাঠামো প্রাণকে ওষ্ঠাগত করে তোলেনি৷ এই গানটা সেই সারল্য উস্কে দেওয়া গান৷ প্রেমের গান।

"তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই
সারা বছর ধরে মেঘ জমাই"

কী সুন্দর যে গানটা, কী ভীষণ ভালো! আমার মারাত্মক সুন্দর লেগেছে, অত্যন্ত ভালো লেগেছে৷ আর গান ভাললাগাটা লাগামছাড়া হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

বাহ্‌



কলকাতায় আমরা মাঝেমধ্যে গভীর রাতের দিকে ঘুরতে বেরোতাম। অকারণে বেরোনো বলে সে ঘুরতে যাওয়ায় প্ল্যানিংয়ের ধকল থাকত না৷ ধাবার চা, বা কোনও আধ-চেনা দোকানের ম্যাগি; এ'সব দু'একটা স্টপেজ ছাড়া গোটাটাই শুধু ঢিমেতালে ড্রাইভ৷

ডিসেম্বরের কোনও একটা সময়, মাঝরাতের পর হুট করে পার্ক স্ট্রিটের দিকে ঢুকে পড়ে টের পেতাম; এইত্তো, ক্রিসমাসের আলো লেগে গেছে৷

কয়েকটা অস্ফুট "বাহ্" বেরিয়ে আসত৷ প্রতিবার। আরে, অজস্র টুনির ঝলমলে যদি "বাহ্"টুকু নাই বলতে পারি, তা'হলে আর এ জীবনে রইলটা কী।
সেই মিঠে "বাহ্" টুকু সামান্য মিস করছি বটে।

শান্তনু চৌধুরী হালহকিকত



- চাউড্রি, ওয়েল ডান।
- থ্যাঙ্কিউ স্যর।
- এত ডিটেলড প্রেজেন্টেশন আমি খুবই কম দেখেছি। ডিরেক্টরস ওয়্যার ভেরি প্লীজড।
- যাক, খাটাখাটনি সার্থক।
- ইউ লুক একটু টায়ার্ড। কী ব্যাপার? রিল্যাক্স মাই বয়। আজ সন্ধেবেলা তোমায় এমন জ্যাপনিজ স্কচ খাওয়াব যে...।
- আসলে স্যর, ঠিক ভাল লাগছে না...।
- সে কী! আন্ডার দ্য ওয়েদার?
- ইয়ে মানে, শরীর ঠিকই আছে...আসলে...।
- ক্লান্তিটা অবশ্য ন্যাচরাল, স্ট্রেস তো কম গেল না। তবে এই উইকেন্ডটা একটু রিল্যাক্স করো, দেখবে এভ্রিথিং উইল বি ফাইন। ঈট ওয়েল। গো অন আ লং ড্রাইভ। আর লেটস সি...ইকিগাই বইটা পড়েছ? বড্ড সুদিং। লাইফের পার্স্পেক্টিভ এমন ভাবে পালটে দেবে...।
- হুম, দেখি।
- কিন্তু আজ সন্ধের গেট-টুগেদারটা ভুলো না। ডায়রেক্টরসরা থাকবে। ওদের সঙ্গে একটু গল্প আড্ডা না জুড়লে চলবে কেন?
- আসলে...। মনটা না কেমন যেন...।
- ইউ আর অ্যান অ্যাসেট চাউড্রি। রিল্যাক্স...। তোমার একটু ফুর্তি দরকার...।
- ফুর্তি দরকার...তাই না?
- ঠিক তাই। সন্ধেবেলার পার্টিটা ভুলো না। ওউক্কে?
- ওকে।

***

- হ্যালো! বলো।
- বলছিলাম কী সুমি...।
- তোমার প্রেজেন্টেশন কেমন গেল?
- এক্সেলেন্ট। এক্সেলেন্ট। সবাই খুব প্রশংসা করলে।
- ভেরি প্রাউড অফ ইউ। কংগ্রাচুলেশনস।
- আরে ধুস।
- প্রশংসাটা তুমি ডিজার্ভ করো মিস্টার চৌধুরী।
- ডিজার্ভ করি। তাই না?
- নিশ্চয়ই করো। এত খাটছো। ফল পেতেই হবে।
- তাই তো। ঠিক তাই।
- অত মিইয়ে কথা বলছ কেন?
- ইয়ে, মনটা না...কেমন কেমন করছে।
- সে কী! কারুর সঙ্গে ঝগড়াটগড়া হল নাকি?
- কই, না তো।
- তুমি বড্ড টায়ার্ড শান্তনু। ভালো করে দু'দিন রেস্ট নাও। ঘুমোও। চলো কোথাও ঘুরে আসি। ইউ উইল ফীল গুড।
- তোমার তাই মনে হচ্ছে?
- স্পষ্ট।
- হুম।
- আর শোনো, হাঁড়িমুখ করে বসে থেকো না প্লীজ। দিস ইজ আ বিগ মোমেন্ট, এঞ্জয় করো। অফিসে তোমার খুব প্রশংসা হচ্ছে নিশ্চয়ই...।
- তা হচ্ছে।
- মুহূর্তটা উপভোগ করো প্লীজ।
- উপভোগই করি বরং। তাই না?
- একদম!
- যাক।
***
- হ্যালো, বসন্ত?
- আর ভাই শান্তনু, কদ্দিন পর ফোন করলি! তুইই একটা পেল্লায় চাকরী করিস বটে! পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করারও টাইম নেই।
- হ্যাঁ রে, তোর অভিযোগটা ঠিক ফেলনা নয়য়। অনেকদিন কল করা হয় না...।
- তা হঠাৎ আজ কী মনে করে?
- কিছু মনে করে ঠিক নয়। এমনি । হঠাৎ কেমন ইচ্ছে হল...।
- আরে ভাই, পুরনো ইয়ারদোস্তদের ভুললে চলবে কেন?
- ভুলিনি রে। এই দ্যাখ না, আজ মনটা কেমন হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করছিল, টুক করে কল করে ফেললাম।
- কী ব্যাপার ব্রাদার, মনের মধ্যে ইয়ে তো ভালো ব্যাপার নয়।
- ভাল নয়, তাই না?
- আদৌ নয়। তা, কনজুগ্যাল ইয়েটিয়ে নয় তো? গোপন প্রেম-ট্রেম?
- ধুস। সে'সব কিছু নয়।
- ওহ, বুঝেছি। বড় চাকরির বড় হ্যাপা। তা'তেই শান্তনুবাবু ঘায়েল।
- ঘায়েল, তাই না?
- এক্কেবারে। কনক্রিট ডায়াগোনিসিস। ইমিডিয়েট ট্রিটমেন্ট দরকার।
- ট্রিটমেন্ট?
- হবে। হবে। বসন্তদার আড্ডায় শনিবার চলে আয়। খেজুরে-আলাপ হবে, গান বাজনা হবে। দু'হাত তাসও হবে। দেখবি, মন এক্কেবারে ফ্রেশ।
- ফ্রেশ হয়েই যাবে, কী বলিস?
- গ্যারেন্টি। তাছাড়া তোকে অরূপদার দোকানের ফিশফ্রাই খাওয়াব। ও জিনিস একজোড়া খেলে দেখবি মন বাবাজি টগবগিয়ে ছুটছে।
- বাহ্‌, বাহ্‌।
- তা'হলে শনিবার দেখা হচ্ছে। দেখিস, ফের ফাঁকি দিসনা। আমি বসন্তদাকে বলে রাখব। এখন আসি ভাই। ছেলেকে জিওমেট্রি পড়াতে হবে। মারাত্মক ফাঁকিবাজ হয়েছে।
- আয়।
**
- ও মশাই। ও মশাই!
- হুঁ?
- বেঞ্চিতে আর কতক্ষণ ঘুমোবেন? দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে গেল তো।
- ওহ। সরি। উঠছি।
- আরে এখনও বসতে পারেন মিনিট দশেক। ছেলেপিলেগুলো বাসন মাজা শেষ করুক। তারপর তো।
- তা, আমার কত টাকা হল?
- চার কাপ চা, ছ'টা বিস্কুট, একটা সিঙ্গল ডিমের মামলেট। নব্বুই টাকা।
- এই যে। ইয়ে, আপনার চায়ের কোয়ালিটি খুব ভালো।
- আপনি তো ওই বড় টাওয়ারের অফিসে কাজ করেন, তাই না? আপনাকে আগেও দেখেছি এক'দু'বার। আপনি তো নির্ঘাত চাইলেই দার্জিলিং চা টেবিলে আনিয়ে নিতে পারেন। আমার এই বারবার জ্বাল দেওয়া চা ভাল লেগেছে? মাইরি?
- মাইরি। এক্সেলেন্ট কোয়ালিটি। ঘন। দুধ-চিনিতে কিপটেমো নেই।
- আর এক কাপ খাবেন? সসপ্যানে আছে, ঠাণ্ডা না। টাটকা। এই সদ্য নিজের জন্য বানালাম।
- দেবেন? দিন।
- মিন্টু, এক গেলাস চা আগে এ'খানে দিয়ে যা। তারপর সসপ্যান ধুতে নিয়ে যাস।
- থ্যাঙ্ক ইউ। তা'হলে আরও দশ টাকা তো?
- এই কাপের দাম দিতে যাবেন না প্লীজ।
- ওহ, হে হে। ধন্যবাদ। তা, আপনার নামটা কী?
- আমি বিজয় সমাদ্দার।
- আমি শান্তনু চৌধুরী।
- কিছু মনে করবেন না, শান্তনুবাবু। আমি খেজুরে আলাপের লোক ঠিক নই। তবু, একটা প্রশ্ন করব?
- করবেন? করুন।
- আপনার কি মনখারাপ?
- আমার মনটা সত্যিই খারাপ, তাই না?
- ও মা, সে তো আপনি বলবেন।
- আজ দুপুর থেকেই জানেন, সত্যিই কেমন যেন...মনটা ম্যাদা মেরে আছে।
- কেন বলুন দেখি?
- কে জানে। ঠাহর করতে পারছি না। তবে মনটা ভার, জানেন।
- মন ভারের কোয়ালিটিটা কেমন বলবেন?
- মানে, কী বলি...যেন কেউ ঘাড়ের ওপর একটা বড় ওজন চাপিয়ে রেখেছে। বুকের মধ্যে থেকে হাওয়া শুষে নিয়েছে। মুখটা তিতকুটে। অত যত্ন করে মামলেটটা বানিয়ে দিলেন, সে'টাতেও স্বাদ পেলাম না।
- বড্ড মন খারাপ শান্তনুবাবু?
- বড্ড।
- কারণটা টের পাচ্ছেন?
- বাকিরা জানে বটে, আমার মনখারাপ কেন।
- আপনি জানেন?
- না। আমি কাঁচকলা কিছুই জানি না।
- আপনি আর একটু বসবেন এই বেঞ্চিতে?
- বাহ, আপনি দোকান গোটাবেন না?
- আজ না হয় ট্রেন না নিয়ে ট্যাক্সি ধরব। ভালো বিজনেস হয়েছে গোটা দিনে। কাজেই আর একটু রাত হলে ক্ষতি নেই।
- বাহ্‌, এই লাস্ট রাউন্ড চা'টা মারাত্মক ভালো হয়েছে তো!
- থ্যাঙ্কিউ। একটু এলাচ দিয়েছি ও'টায়।
- তা, এ'বার আমি বলি? মনখারাপের ব্যাপারটা?
- নিশ্চয়ই।
- হ্যাঁ, যা বলছিলাম...। মনখারাপের নেচারটা ভারি কিউরিয়াস বুঝলেন...।