Showing posts with label সিনেমা. Show all posts
Showing posts with label সিনেমা. Show all posts

Tuesday, July 16, 2024

পঞ্চায়েত তিন আর তিনি



ভালোমানুষের ভালোমানুষিতে ডেটলের গন্ধ৷ কিন্তু বখে যাওয়া মানুষের হঠাৎ খুঁজে পাওয়া ভালোমানুষির মত হিমসাগর-সুমিষ্ট ব্যাপার আর হয় না৷ সিনেমা বা নভেলের হাড়জ্বালানো চরিত্ররা আচমকা ভালো কিছু করে বসলে তাদের সে ভালোত্ব আমাদের চোখে দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়ে৷ দাদার কীর্তির ক্লাইম্যাক্সে ভোম্বলদা ভোল পালটে পাষাণপ্রাণ দর্শককেও ঘায়েল করেছিলেন৷ কুম্ভকর্ণ রাবণকে সদুপদেশ দিলে মনে গলে জল হয়ে যায়; আমরা ভাবি "আহা রে, হাবভাবে বিটকেল হলে কী হবে, কুম্ভদাদার মনটা ভারি নরম"৷ কবীর খানের দলে ভাঙন ধরানো বিন্দিয়া নায়েক যখন সমস্ত মান-অভিমান শিকেয় তুলে দলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বকাপের মোড় ঘুরিয়ে দিলে; তখন ইমোশনে একটু ফ্যাঁচফোঁচ না করলেই নয়।

তেমনই। পঞ্চায়েত সিজন ৩।

ভালো-মন্দ জমলো-জমলো না; সে'সব বিশ্লেষণ সমালোচকদের দায়। দর্শকরা নিজেদের ভালোলাগাটুকু খুঁজে নিয়ে দু'দণ্ড ফুর্তি অনুভব করবেন; তাদের ফোকাস সে'টুকুই৷ আমার কাছে পঞ্চায়েতের এই সিজনের সবচেয়ে জরুরী ব্যাপার হলো "The Grand Redemption of Asshole"। অ্যাসহোল ভাইটি যখন সচিবজীকে নিজের মারুতি গাড়ির পিছনের সীটে ঠেলে পাঠালেন, দর্শকাসনে বসে থাকা অজস্র ঘা-খাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকার দল মনে মনে "আইসাব্বাস" বলেছেন৷ (কেন, কী'ভাবে; জানতে হলে সিরিজটা দেখুন)৷ সে অর্থে অ্যাসহোলবাবুই হলেন এই সিজনের ইম্প্যাক্ট-সাব।

Monday, August 7, 2023

মুরারিলাল



- ভায়া!

- উঁ...?

- ও ভায়া..।

- কী ভাইটু?

- এ'বারে তো বাড়ি ফিরতে হয় নাকি! সন্ধ্যে হলো বলে।

- বাড়ি? ধের ধের ধের৷ বাড়িফাড়ি ফিরে লাভ নেই৷ খোঁজ নিয়ে দ্যাখো দেখি, কুতুব মিনারটা কেনা যায় কিনা। অন্তত আশেপাশের দু'কাঠা জমি যদি পেতাম ভায়া মুরারিলাল..। রোজ রাত্তিরে উঠোনে মাদুর পেতে লম্বা হয়ে মিনারের দিকে তাকিয়ে গান ধরতাম। ঠুমরি৷ বা গজল।

- নাহ্। অতগুলো বিয়ারের বোতল ফস্ করে উড়িয়ে দিয়ে মোটেও ঠিক কাজ করোনি। 

- তুমি ভাই বড়ই নেকু মালুম হচ্ছে৷ অথচ খানিকক্ষণ আগে মনে হচ্ছিল শের কা বচ্চা৷ মনে হচ্ছিল, নাহ্, একজন মজবুত লোকের সঙ্গে ইয়ারি হয়েছে বটে৷

- তুমি সত্যিই কবি মানুষ ভাই আনন্দ৷

- শায়র বলো৷ শায়র৷

- গোস্তাখি মাফ।

- ভায়া মুরারিলাল,  তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে কী ভালোই যে লাগছে৷ কয়েকঘণ্টার আলাপ, অথচ মনে হচ্ছে কত জন্ম ধরে অপেক্ষা করছি এমনই এক বন্ধুর৷

- নেশাটা ভালোই চড়েছে তোমার৷

- করেক্ট৷ কিন্তু ইমোশনটা খাঁটি। জানো মুরারিলাল৷ মাঝেমধ্যে বড্ড একলা লাগে৷

- জানি৷ তাই তো এলাম।

- তুমি জানো আমি একা? তাই তুমি যেচে এসে আজ আলাপ করলে? কুতুব মিনার চত্ত্বরে এসে বিয়ার খাইয়ে আউট করলে? তুমি কি দেবশিশু? না ভূত? হে হে হে হে হে হে..বলো না ভাই।

- আমি মুরারিলাল।  সে পরিচয়টুকু কি যথেষ্ট নয়?

- দেখো৷ ফাঁকি দিয়ে সরে পড়ো না৷ গেলে ফোন নম্বর বা ঠিকানাটা অন্তত..।

- তোমার ছেড়ে আর যাব কোথায় বলো৷ হাঁক দিলেই হবে, আমি আসব। ঠিকানা, ফোননম্বর; এ'সব জোলো ব্যাপারে কাজ কী।

- তুমি তো অন্তর্যামী দেখছি৷ বেশ৷ তাই হোক৷ দেখি শ্রীবদনটা..মনের মধ্যে ছাপিয়ে নিই।

- এই চেহারায় আটকে থেকে কী হবে। বোধিসত্ত্বকে আজ দেখছ দিল্লী পোস্টআপিসের ক্লার্কবাবুটি হিসেবে৷ তাই বলে কালকেও সেই শেপ আর ফর্মেই পাবে ভেবেছ?

- আইব্বাস৷ তুমি যে মিস্টিরিয়াস ম্যাজিক ভাই মুরারিলাল। এনিগমা!

- আনন্দ, মনে দিয়ে খুঁজলেই আমায় পাবে৷ মিলের কর্মী, খবরের কাগজ ফেরিওয়ালা, পেটমোটা ব্যবসায়ী বা রিক্সাওলা; ডাকে যদি আন্তরিকতা থাকে বন্ধু, তোমার এই মুরারিলাল কাছে এসে তোমায় জড়িয়ে ধরবেই।

- প্রমিস করছ তো ব্রাদার?

- আলবাত! তবে এ'বার আমি আসি৷ তোমার ঢুলুঢুলু অবস্থা, খানিক পর নেশা হালকা হলে বাড়ি ফিরে যেও।

- আসছ মুরারিলাল?

- তুমি বড় ভালোমানুষ ভাই আনন্দ৷ মনে রেখো, আমি আছি। আর আমি থাকতে তোমার আর একা থাকার চিন্তা নেই৷ প্রাণ খুলে হাঁক পাড়লেই হবে।

- আসবে? ডাকলে এসো কিন্তু মুরারিলাল। এসো৷ কেমন? এসো। 

- আসব৷ কে জানে৷ হয়ত কোনও দিন বাউল হয়ে ফিরে আসবো আর গাইব; " ফিরেও আসব আমি তোমার সুবাসে, থাকবো তোমার বুকে আর আশেপাশে। আমাকে পড়লে মনে খুঁজো এইখানে, এ'খানে খুঁজছি আমি জীবনের মানে"। কেমন দিব্যি হবে না?

- সে'দিন যদি আমি না থাকি মুরারিলাল?

- গানটা তবুও আনন্দেরই থাকবে৷ 

- সাবাশ৷ তুমি ব্যাঘ্রশাবক মুরারিলাল!

Wednesday, July 12, 2023

আসি



"এইবারে তোমাদের পৃথিবীর ঝড়ঝাপটায় টপাৎ করে ফেলে দেব৷ কেমন? বিটি, তুই একদিকে হন্যে হবি। আর এই যে বাবা মদনচন্দর..সে অন্যদিকে ন্যাজেগোবর হতেহতে তোর সামনে এসে দাঁড়াবে৷ ওয়েট, দাঁড়ালে চলবে না; নতজানু হবে৷ এরপর ন্যাবাকুমার দায়িত্ব নিয়ে সমস্তটা ডুবিয়ে দেবে৷ সে ডোবাবে, তুমি টেনে ভাসিয়ে রাখবে৷ এই ল্যুপেই চলবে। বানিয়ে বলছি না, এই দেখো দেখো; নোটবুকে লিখে রাখা আছে"।

***

"এইব্বারে। সিকুয়েন্স বুঝে নাও! ইম্যাজিন! চাদ্দিকে গোলাগুলি ছুটছে;সে এক ধুন্ধুমার ব্যাপার। বারুদের মোচ্ছব, দেদার রক্তারক্তি। এ ওর মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে তো ও এর পিঠে ছুরি দিয়ে ছবি আঁকছে।

এ'সবের মধ্যে তোমরা দু'টিতে গল্প জুড়বে৷ ওটাই হোমটাস্ক।
দু'জনেই নয়নতারা ভালোবাসো জেনে লাফিয়ে উঠবে।
বাদাম শেষ হলে ঠোঙা দিয়ে বুকমার্ক বানাবে।

ভালোবাসবে।

কী..ভাবছো বানিয়ে বলছি? আরে না হে৷ নোটবুকের সতেরো নম্বর পাতাটা দেখো..এই যে..দাগিয়ে দিয়েছি। ঠিক হ্যায়? ভালোবাসবে "!

***

"কবিতা? এ কী ধরণের সিলি কোশ্চেন! পোয়েট্রি ভালো না বাসলে চলবে কেন? এই এখানে ইন্সট্রাকশন লিখে রাখছি; মনে থাকে যেন; মাসকাবারির ফর্দ তোমাদের কথোপকথন।

আর হ্যাঁ৷ তর্ক না থাকলে মুক্তি কোথায়? আচমকা বৃষ্টি নামলে তর্কের ঝড় উঠবে- জানালা বন্ধ করার দায়িত্ব কার, তা নিয়ে৷ ফয়সালা হওয়ার আগেই বিছানায় জল। তারপর দোষারোপ, অভিমান, তিল থেকে তাল, মুখ ফসকে ভুলভাল, চোখ চলকে টপাটপ। 

তারপর হাওয়া ঠাণ্ডা হলে খিচুড়ি, আলুভাজা আর 'শোনো না, ময়দান যাবে'?"

***

"এরপর। 
হঠাৎ একদিন৷
কিছু মনে কোরো না।
হঠাৎই একদিন।
ডিসেম্বরের সন্ধের মত ঝুপ করে নামবে;
'আসি'৷
ব্যাস, আর কী!
ক্যাবলাচরণের মত পড়ে রইবে কলকাতা"৷

Saturday, July 1, 2023

ওট্টো



কাচের শিশিতে চিরকুট পুরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে পারাটাই বোধ হয় থেইজম। আস্তিকতা।

হয়ত যত্ন করে লেখা চিরকুটটা সত্যিই জলে যাবে৷ আর বরাতজোরে যদি কোনও এক অপরিচিতর নাগালে সে শিশি ভেসেও আসে, সে হয়ত চিরকুটটা পড়ে ভাববে, "আরে, এ তো নেহাতই বেফালতু ছেলেমানুষি"৷ চিরকুটের লেখাটা যে অত্যন্ত খাজা হয়েছে, সে চিন্তায় হয়রান হয়ে হয়ত মানুষটি শিশির সমুদ্রযাত্রা ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে যাবেন৷ কিন্তু আদত প্রাপ্তি তো চিরকুটটা নয়। ভাসিয়ে দেওয়া শিশির ছিপি খোলবার মানুষ যে কোথাও কোনও প্রান্তে রয়েছেন এবং সমুদ্রের ঢেউ সে মানুষকে খুঁজেপেতে ঠিক বের করবে; শিশির মধ্যে সেই আশাটুকু পুরে দেওয়ার সাহস একজন মানুষ করেছেন। সেই বোকামোটুকু পুষে রাখার মানুষ এখনও আছেন৷ সে'টুকুই ম্যাজিক৷
সেই সমুদ্রে শিশি ভাসিয়ে দেওয়া ম্যাজিকের ভরসাতেই এই পেল্লায় ভূমিকা লেখা৷ বিভিন্ন কারণে গোট দিনটা বড় বিরক্তিতে কেটেছে। মুখে ও মেজাজে একটা তিতকুটে ভাব৷ ভাগ্যের পান থেকে যেন চুন-খয়ের-সুপুরি-চমনবাহার-জর্দা সবই খসে পড়ছে আর দুনিয়াটা রসাতলে যাচ্ছে, এই ধরণের একটা খ্যাপাটে ভয় মাঝেমধ্যে মনের মধ্যে উঁকি মারে বটে৷ সেই বিরক্তিটা কাটাতে গিয়ে ডিনার সেরেই গেস্টহাউসের খাটে লম্বা হলাম; ঘুম ব্যাপারটা খুব কাজে দেয় এই ধরণের পরিস্থিতিতে। কিন্তু ঘুম তো আর চ্যাটজিপিটির মত আজ্ঞাবহ নয় যে "এসো ভাইটি" বলে হাঁক পাড়লেই পাশে এসে বসে দিব্যি বাহারে কোড লিখতে শুরু করবে৷
অগত্যা; অগতির গতি; নেটফ্লিক্স।
"আ ম্যান কলড ওট্টো"।
সিনেমা নিয়ে দু'টো ভালোমন্দ কথা বলব, সে গুণ আমার নেই৷ তবে একটা কাল্পনিক-শিশিতে একটা কাল্পনিক-চিরকুট কাল্পনিক কালি দিয়ে লিখে রাখলাম,
"
বন্ধু,
ওট্টোর গল্পটা রইল।
দেখো৷ কেমন? এখনই৷ অপেক্ষা-টপেক্ষা করে লাভ নেই৷ ওট্টো অ্যান্ডারসন।
যা কিছু খোকার আঁকা ছবি মত সুন্দর,
যা কিছু ছেলেবেলার শীতের বিকেলের স্মৃতির মত নরম,
যা কিছু বাড়ি ফেরার টিকিট কাটার মত মিষ্টি; সেই সমস্ত কিছু মিলিয়ে-মিশিয়ে এই ওট্টোবাবুর গল্প।
দেখো কিন্তু, হ্যাঁ?
একদম শুরু থেকে শেষ ফ্রেম পর্যন্ত৷ কেমন?
ওই যে রামকৃষ্ণ বলে গেছেন, স্টীমারে সবার আগে উঠতে আর নামতে হবে সবার শেষে। পুরোটা দেখো৷ প্রাণভরে দেখলে প্রাণ ভরবেই
ইতি,
......."।
এই চিরকুটটা লিখে,
ব্লগের শিশিতে ভরে;
আমি এই রাত প্রায় পৌনে দু'টোয় ইন্টারনেট সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলাম।
এই শিশি হয়ত কারুর কাছে পৌঁছলই না৷ হয়ত দু'চারজন এ চিরকুট পড়লে৷ কে জানে, কেউ হয়ত ওট্টোবাবুর গল্প এই রাতবিরেতেই দেখতে শুরু করলেন৷ খানিকটা দেখে কেউ হাল ছাড়লেন, আবার কেউ ভাবলেন- "চলনসই। বংপেনের আবার সব কিছুতেই আদেখলাপনা"।
কিন্তু আস্তিকতা কোথায়? বিশ্বাসের খেল কোথায়? ওই যে৷ কেউ একজন কোথাও হয়ত আছেন, যার এই রাতবিরেরে ওট্টোবাবুর গল্পটা শোনা বড্ড জরুরি ছিল।
'হয়ত', একটা প্রকাণ্ড রূপকথার মত "হয়ত"।

রিঙ্কুবাবুর প্রতি



ছয় নম্বর ১:
ছবি বিশ্বাস স্টাইলে: "প্রথমে ভাতের পাশে মুলোছেঁচকি দিয়ে খেতে দিলে। তারপর শেষ পাতে চাটনির পর মাংসের ঝোলের বাটি থেকে আলু তুলে দিয়ে মাতব্বরি! উদ্ধার করেছে আর কী! খাওয়াটা তো জলেই গেছে"।

ছয় নম্বর ২:
পাহাড়ি সান্যাল স্টাইলে: "ঠিক আছে৷ ঠিক আছে৷ আরে আধঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সিনেমার টিকিট পাওয়া গেল না বলে কি অভিমানে ফুচকাটাও খাব না? আরে জীবন থেকে রোম্যান্স বাদ দিলে চলবে কেন বলো। যা পেলাম, যে'টুকু পেলাম - চেটেপুটে নিই না"।

ছয় নম্বর ৩:
তুলসী চক্রবর্তী স্টাইলে: "বুকের ভিতর দিয়ে, বুঝলে ভায়া, কেমন যেন একটা ব্রিটিশ আমলের লিফট ঘটঘটাং করে ওঠা নামা করছে৷ মনে হচ্ছে, কেউ যেন ট্রামের ভিতরে বসিয়ে আলোর গতি নিয়ে কেঠো সব অঙ্ক কষতে দিয়েছে। বড্ড নার্ভাস বোধ করছি ভায়া"।

ছয় নম্বর ৪:
উৎপল দত্ত স্টাইলে: "ওরে তোরা যে যে'খানে বসে; খবরদার নড়বি না৷ নড়লেই তোদের আমি জেলে পুরব৷ এক মিনিট, খামোখা জেলে পুরে কী হবে, তোদের আমি গুলি করব৷ এক মিনিট, অত সহজে পার পাবি না৷ তোদের আমি আলকাতরা দিয়ে ব্ল্যাকফরেস্ট কেক বানিয়ে গেলাব। আর এই যে, তুমি৷ হ্যাঁ তোমায় বলছি! ইতিহাস তৈরি হতে চলেছে, আর এই সময় তোমার পিঠ চুলকোচ্ছে? রাস্কেল! তোমায় আমি ত্যাজ্যপুত্র করব! কী? তুমি আমার ছেলে নও? বেশ। তবে আগে দত্তক নেব, তারপর...। খবরদার যদি এক ইঞ্চিও নড়তে দেখি৷ ও কী! বাতাসে তোমার চুল উড়ছে কেন"?

ছয় নম্বর পাঁচ:
উত্তমকুমার স্টাইলে: রিঙ্কুবাবু, এই একবারটির জন্য বলেই দিলাম; তুমিই উত্তমকুমার!

(৯ এপ্রিল ২০২৩-য়ে লেখা। সে'দিনের আইপিএল স্কোরকার্ডে চোখ বুলোলেই চলবে)

বটুর দরবারে

- বটুদা আছেন?
- কী চাই!
- বটুদা। আমি...আমি এসেছি।
- এসে উদ্ধার করেছ আর কী!
- ভিতরে আসব?
- এসে যখন পড়েইছ, তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নখ না চিবিয়ে ভিতরে এসে দু'টো কাপ ডিশ ধুয়ে ফেলো দেখি। আমি চা বসিয়েছি। দু'জনের কুলিয়ে যাবে।
- থ্যাঙ্কিউ দাদা।
- তা হঠাৎ কলকাতায় কী মনে করে?
- গুরুদেবের পায়ের ধুলো না নিলে চলছিল না...।
- শোনো, তেল দিও না। তেল দিও না। আমি তোমার ওপর মারাত্মক চটে আছি।
- আহ, না হয় দু'একটা ভুলচুক হয়ে গেছে। তার জন্য...।
- দু'একটা ভুলচুক? চার পয়সার কাজ করতে গিয়ে চার লাখটাকার ঝামেলা পাকাবে। তারপর আমায় কলকাঠি নেড়ে সমস্ত ঠিক করতে হবে। আর বাইসেপ ফুলিয়ে রকেটলঞ্চার দুলিয়ে নাচনকোঁদন করলেই যদি দুষ্টু লোকেদের শায়েস্তা করা যেত, তা'হলে তো হয়েই গেছিল...। দুনিয়াটা যদি অতই সহজ হবে, তা'হলে তোমার মত বারফট্টাই ঝাড়া লোকজনেরই জয়জয়কার হত আর এই বটুগোয়েন্দা সিআইএ, ইন্টারপোলকে কনসাল্ট করার বদলে ভুবন দত্তের বাজারসরকার হয়ে জীবন কাটাত।
- সত্যি বটুদা, তুমি সময়মত গোলমালগুলো সামাল না দিলে...।
- তুমি এতদিনে অন্তত বাহাত্তরবার অক্কা পেয়ে গিয়েছিলে আর কী। নেহাত আমার মনটা নরম...।
- আসলে এ'বারের কেসটা এমন জটিল ছিল...।
- আরে ধুর। আমায় একটা এসএমএস করলেই সব মিটে যেত। তা, না। নিজে গিয়ে হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা। উফ। তোমার লোক-দেখানো স্টাইলের ঠেলায় আমার ভাতঘুমগুলো মাটি হচ্ছে।
- কাপ ধুরে ফেলেছি।
- ছ'মাস আমার এ'খানে থাকো। দিনের বেলা ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করবে, বাসনপত্র ধোবে, বাজারঘাট করবে...।
- রান্না করব না?
- খেপেছ? হেঁসেল আর ডিটেকশনের ব্যাপারে বটু আর কাউকে ভরসা করে না। তা যা বলছিলাম, দিনের বেলা ঘরের কাজ করবে, রাতের দিকে আমি ট্রেনিং দেব। ছ'মাসে দাঁড়িয়ে যাবে। আর কথায় কথায় অমন নেকুপনা কেটে যাবে। এই নাও। চা।
- আহ্‌। অমৃত। রিয়েল দার্জিলিংয়ের সামনে কোথায় লাগে সিঙ্গল মল্ট।
- হুম। এ'বার বলে ফেলো।
- বলে ফেলব? কী?
- এখন তোমার ইস্তানবুলে থাকার কথা। অথচ এই অবেলায় কলকাতায় উদয় হয়ে আমার বাড়িতে কাপ-ডিশ ধুচ্ছ। অসাবধানতায় জামার সব কটা বোতাম লাগিয়ে ফেলেছ- অর্থাৎ স্টাইল-ঠাইল সব মাথায় উঠেছে। চুলে যা বুঝছি জেলের বদলে শালিমার নারকোল তেল ঢেলেছ। তার মানে মাথাব্যথা এমন পর্যায় গেছে যে পেনকিলারে কাজ হচ্ছে না। ভদ্রেশ্বরের ঝুনোনাপিতের সেলুনে গিয়ে মাথা মালিশ করিয়ে আসতে হয়েছে। আরও আছে। এই যেমন, গতকাল থানার বড়বাবু আমায় দু'ডেকচি বিরিয়ানি পাঠিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক ভেট আর কী। বেশ খানিকটা বাসি বিরিয়ানি এখনও পড়ে আছে। গোটা ঘর বিরিয়ানির সুবাসে ভরপুর অথচ তুমি একবারও সেই সুবাসের সোর্স ঘেঁটে দেখতে চাইলে না। কাজেই বেশ ঘোরতর বিপদেই পড়েছ। তবে হ্যাঁ। বিপদটা একটু ইউনিক। ঠকাস-ঠকাস করে কেঠো স্টাইলে ইংরেজিতে কথা বলে মুরুব্বিয়ানা ফলাচ্ছ না। তার মানে প্রফেশনাল ঝ্যামেলা নয়, তাই লিঙ্কডনইন কেত মেরে সাহায্য চাইতে হচ্ছে না। তার মানে তুমি কোনও জরুরী সাহায্যের জন্য এসেছ, তবে সে'টা কাজকর্ম বিষয়ক কিছু নয়। বেশ। আমি পার্সোনাল মেন্টরও বটে। কী চাই? চটপট বলে ফেলো।
- বটুদা, মাইরি। আপনার চরণতলে ঠাঁই দিন প্লীজ। বর্তে যাই। বড় ফাঁপরে পড়ে এসেছি। এ'বারের মত উতরে দিন।
- কী ব্যাপার?
- প্রেমিকা ইয়াব্বড় বড় প্রেমের চিঠি লেখা শুরু করেছিল। মারাত্মক সব রোম্যান্টিক বুলি, ঢলোঢলো ভাষা। এ'দিকে আমার দৌড় ওই হোয়্যাটস্যাপে হার্ট সাইন পাঠানো পর্যন্ত। কাজেই ওর প্রেমের চিঠি খাটো হতে শুরু করেছে। ভাষার নরমভাব কেটে গিয়ে ধারালো খোঁচা আসতে শুরু করেছে। বড্ড নার্ভাস বোধ করছি বটুদা। বড্ড। আমি যদি ইমিডিয়েটলি একটা পেল্লায় প্রেমের চিঠি না লিখতে পারি, মুশকিল হয়ে যাবে। আমায় বাঁচান বটুদা...।
- বটু গোয়েন্দার মনটা বড্ড নরম ভাই পাঠান। রিফিউজ করি কী করে। তাছাড়া রুবাই মেয়েটি ভালো। তোমার মত নিনকমপুপকে প্রেমের আশ্রয় দিয়েছে, তোমার ভাগ্য সত্যিই সুপ্রসন্ন বলতে হবে। বেশ। আমি ডিকটেশন দেব, তুমি টুকে নিও। তুমি চা'টা শেষ করো। আমি দেড়-থালা বিরিয়ানি উড়িয়ে আসি; রোম্যান্সটা তা'হলে বেটার ফ্লো করবে। পোস্ট-বিরিয়ানি একটা অমিত রে কে টেক্কা দেওয়া সতেরো পাতার চিঠি লেখা যাবে'খন। সে চিঠির "ইতি তোমার পাঠান" পর্যন্ত আসতে আসতে রুবাই দিদিভাই চোখের জলে নাকের জলে এক হয়ে 'লগ যা গলে' গাইবে, এই গ্যারেন্টি রইল।

Thursday, June 2, 2022

ভাণু সমগ্র



ভানুবাবুর লেখালিখিগুলো(ওঁর নিজের লেখালিখি আর ওঁর সম্বন্ধে অন্যদের লেখালিখি) জড়ো করে একটা দুর্দান্ত কাজ করেছে পত্রভারতী। এই ভানু সমগ্রের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে ভদ্রলোকের একটা জমজমাট আত্মকথা, বইয়ের মূল আকর্ষণ সে'টাই।
বড় শিল্পীদের আত্মকথা অনেকক্ষেত্রেই "গোস্ট রিটেন" হয়। তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়না বোধ হয়। কিন্তু ভানুবাবুর লেখার সোজাসাপটা স্টাইল,তাঁর কপিবুক ধারালো উইট এবং রসালো
আড্ডার যে মেজাজ প্রায় প্রতিটি লাইনে রয়েছে; তা'তে মনে হয় এ জিনিস এক্কেবারে "রাইট আউট অফ হর্সেস মাউথ" না হলেই নয়। সাহিত্যের নিয়মকানুন রুচির তোয়াক্কা তেমন করেননি। গোটাটাই একটা দিলখোলা গপ্পগুজব, ওঁর সেই "একপেশে স্টাইলে"। পাঠক হিসেবে বরাবরই মনে হয়ে ভালো আত্মকথায় স্রেফ "আমি,আমি,আমি" থাকলে সমস্তটাই মাটি। আমার অমুক, আমার তমুকে আটকা পড়ে বহু সম্ভাবনাময় বায়োগ্রাফি ভেসে গেছে। ভারতীয় ক্রিকেট তারকাদের কিছু জীবনে সে ব্যাপারে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ভানুবাবুর এই ছোটখাটো লেখার ক্ষেত্রে আর যাই হোক সে অভিযোগ আনা যায় না। ভদ্রলোক নিজের জীবনের একটা ফ্লো দিব্যি সাজিয়েছেন বটে। তবে তাঁর লেখায় দুর্দান্তভাবে স্পষ্ট হয়েছে সে সময়ের বাংলা সিনেমা জগতের বেশ কিছু জরুরী ব্যক্তিত্ব। সে'সময়ের বাংলা সিনেমার (বিশেষত বিয়ন্ড-সত্যজিৎ জগতের) লেজেন্ডদের বিষয়ে লেখালিখি ঠিক সহজলভ্য নয়। ভানুবাবুর এই গল্পগাছা সে আগ্রহকে খোঁচা দেয় বইকি। মাঝেমধ্যে সিনেমার বাইরেও গিয়ে পড়েছেন ভানু। তাঁর বর্ণময় জীবন তুলে ধরতে গিয়ে উঠে এসেছে দেশভাগ, কলকাতা, রাজনীতি আর আরও কত কী।
লেখাটা পড়তে গিয়ে বারবার মনে হইয়েছে বাংলা সিনেমার সে'যুগের মানুষজন সম্বন্ধে আমরা (অন্তত আমি) কত কম জানি। সিনেমার স্ক্রিনের বাইরেও তাঁদের সরেস উপস্থিতি, ব্যক্তিত্ব, রকমারি বাতিক; এ'সব আর এ'যুগের মানুষের দৃষ্টিগোচর হল কই। এই যেমন ক্যামেরা বা স্টেজের আড়ালেও ছবি বিশ্বাসের যে কী সাংঘাতিক একটা দুনিয়া-কাঁপানো স্টাইল ছিল! ছবিবাবুকে নিয়ে একটা পেল্লায় বই লেখা উচিৎ, তরতরে ঝরঝরে ভাষায়। সে কাজটা কে করবেন আমার জানা নেই। অভিনেতা ছবি বিশ্বাস সকলের অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তবে ভানু খোলসা করেছেন ওঁর ব্যক্তিগত স্টাইল আর হিউমরের দিকটা। আমার চোখে সে'টাই এ বইয়ের অন্যতম হাইপয়েন্ট। এই যেমন ধরুন স্টেজে সহঅভিনেতাদের কী'ভাবে ভড়কে দিতেন ছবিবাবু? বিকাশবাবুকে 'বেগুনপোড়া'র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন কেন? উত্তমকুমারকেই বা ছবিবাবু ঠিক কী'ভাবে ইন্সপ্যায়ার করেছিলেন? আর নিজের জমিদার মেজাজের ঘ্যাম কী'ভাবে 'ক্যারি' করতেন ভদ্রলোক? প্রাণখুলে লিখেছেন ভানুবাবু। তবে শুধু ছবি বিশ্বাস নয়। উত্তমের ফোকাস, সাবিত্রীর দুর্দান্ত প্রতিভা, বিকাশ রায়ের ইন্টেলিজেন্স, পাহাড়ি সান্যালের সারল্য; এমন আরও কত মানুষ সম্বন্ধে কত কিছু। তবে শুধু প্রশংসায় আটকে যাওয়ার মানুষ তো ভানু নন। কড়া কথা এবং অভিযোগগুলোও চেপে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি।
সেই সময়ের কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা জগতের পরিবেশ, রাজনীতি, আর সম্পর্কগুলো সম্বন্ধে বেশ সোজাসাপটা ভাষায় লিখেছেন ভদ্রলোক। সে'দিক থেকে এ লেখা যাকে বলে বেশ জরুরী দলিল। সবচেয়ে বড় কথা, অভিনয় আর কমেডি সম্বন্ধে কিছু জরুরী অবজার্ভেশন শেয়ার করেছেন তিনি। রবি ঘোষও নিজের জীবনীতে অভিনয়ের টেকনিকালিটি নিয়ে মনোগ্রাহী স্টাইলে বেশ কিছু জরুরী কথা লিখেছেন। ভানুবাবুর লেখার মধ্যেও একই প্যাশন। রবিবাবু যেন একটু বেশি সেরেব্রাল,ভানু খানিকটা প্র্যাক্টিকাল। বাংলা সিনেমার অতিরিক্ত কান্না-প্রীতিতে দু'জনেই বিরক্ত এবং হতাশ। আর সিনেমায় রিলিফের খাতিরে কমেডির অপব্যবহারে দু'জনেই মর্মাহত।
ভানুবাবুর কেরিয়ার কার্ভটা বড্ড সিনেম্যাটিক। কমেডিতে আসর কাঁপানোর পাশাপাশি সিনেমার হিরো হয়েও বিভিন্ন সিনেমা হিট করিয়েছেন। বেশ নেতাগোছের মানুষ। সাঙ্ঘাতিক উইট এবং রসবোধ। সেই উইট ছাপিয়েই তিনি আবার দামাল, দুর্দান্ত। ঠাস ঠাস করে কড়া কথা শোনাতে পারেন। খানিকটা বেপরোয়া (নইলে অন্যদের ব্যাপারে অমন কামান দাগা সম্ভব নয়। নিজের ছেলেকেও রেয়াত করেননি অবশ্য)। সেই বেপরোয়া বিচ্ছু ভদ্রলোকই একটা সময় এসে নিজেকে ভাঁড় হিসবে সিনেমায় দাঁড় করাতে বাধ্য হয়েছেন; বারবার। ওই, প্রেম,ট্র্যাজেডি এ'সবের ফাঁকে দর্শকদের কমিক রিলীফ যোগাতে হবে। কমেডিয়ান এসে উঁচু মাত্রায় কিছু চুটকি মাঠে ফেলবেন। ওঁর মত ধারালো অভিনেতাকেও সেই টেমপ্লেটের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল। আবার একটা বয়সের পর সে'সুযোগগুলোযও হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল। রাগ, বিরক্তি, অভিমান আর সর্বোপরি টাকার অভাব; সব মিলে বাধ্য হয়ে এগোলেন যাত্রাকে এক্সপ্লোর করতে। কিন্তু জাত শিল্পীদের ব্যাপারটাই আলাদা। আমরা কর্পোরেটে একটা বুলি খুব কপচাই; যাই করো, এক্সেলেন্স থেকে ফোকাস সরলে চলবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা বলি এক্সেলেন্স আর বানাই গাম্বাট পাওয়ারপয়েন্ট। ভানুবাবু তো কর্পোরেট স্টুজ নন, শিল্পি। যাত্রাতে লোক মাতালেন। আর্টফর্মটাকে ভালোবাসলেন। সিনেমাতেও দুর্দান্ত কিছু কামব্যাক পারফর্ম্যান্স দিলেন। কিন্তু কমেডিয়ান তকমাটা আর ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। এই যে দুর্দান্ত একটা কার্ভ, যে'টা শুধুই 'রাইজিং' নয়, ভানুবাবুর প্রাণখোলা লেখার গুণে সে'টা একটা চমৎকার নভেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের বিরক্তির ওপর সাহিত্যের পালিশ চালাননি ভদ্রলোক, সে'টাই এই লেখার বড় ব্যাপার।
উত্তমের গালে চুমু খেতেন ভানু, সৌমিত্রর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা- নিজের গার্জেন বলে মনে করতেন, সত্যজিৎকে সম্মান করতেন আবার সামান্য় অভিমানও পুষে রেখেছিলেন। ও'দিকে গুপী গাইন বাঘা বাইন রিলিজের সময় উত্তম আর ভানু একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। অবাক কাণ্ড, সত্যজিতের সিনেমায় চান্স না পাওয়া ভানু কিন্তু ছিলেন সত্যজিতেরই দলে। নিশ্চিন্তে থাকুন; এ'গুলো স্পয়লার নয়, খোঁচা। এইসব ইনফর্মেশনগুলো আড়ালে যে'সব রিয়েললাইফ গল্প লুকিয়ে আছে, সে'গুলোকে টেনে বের করে আনতে হলে এ লেখা পড়া ছাড়া উপায় নেই। বাংলা-সিনেমার ভক্তদের জন্য সে'সব অ্যানেকডোটের মূল্য অপরিসীম। তবে সেই সিনেমার জগতের পরিচয়টাই ভানুবাবুর বায়োডেটার শেষ কথা নয়। ওঁর শিক্ষকদের একটা ফর্দ করলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। দীনেশ গুপ্ত থেকে সত্যেন বসু হয়ে আর কত দুর্দান্ত সব মানুষ। আর সবচেয়ে বড় কথা, দেশভাগের জ্বালাযন্ত্রণা তাঁর কমেডির সঙ্গে মিলেমিশে গেছিল।
ভানুবাবুকে নিয়ে একটা জবরদস্ত বায়পিক কে বানাবেন? স্নেহ-ভালোবাসা-ট্র্যাজেডি; মশলাপাতির তো অভাব নেই। শুভস্য শীঘ্রম!

ভোলার দাওয়াই



বড় কঠিন সময়৷ মানে, এই চল্লিশ-হল-বলে বয়সটা। মানুষজনের প্রতি নিষ্ফল রাগ বেড়েছে অথচ রাগপ্রকাশ করার সাহস কমেছে৷ মিডলাইফ ক্রাইসিসের কেমিক্যাল ইকুয়েশন বোধ হয় এ'টাই। তবে মাঝেমধ্যে মনকে শান্ত করতে বিভিন্ন দুঃসাহসী সিচুয়েশন কল্পনায় সাজিয়ে নিই৷
এই যেমন কখনও ভাবি ব্রেনের সুইটস্পট থেকে স্মার্ট সারকাজম তুলে এনে কোনও বাটপারকে চুপ করিয়ে দিচ্ছি৷ (আদতে অবশ্য স্মিত হেসে মাথা নেড়ে কথার পিঠে তাল দিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না)।
অথবা, হয়ত ভাবছি যে প্রচণ্ড ধারালো সব যুক্তি আর ইন্টলেকচুয়াল গাম্ভীর্য দিয়ে তর্কবাগীশদের জাস্ট শুইয়ে দিচ্ছি৷ তারপর রণেভঙ্গ দিয়ে সে'সব ডিবেট-ব্র্যাডম্যানরা আমায় স্যালুট ঠুকছে৷ (আদতে হয়ত বলতে হচ্ছে, "মার্ভেলাস কথা বলেছেন মশাই৷ এক্কেবারে একঘর)৷
কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় কাল্পনিক প্রত্যুত্তরে থাকে একটা ষাঁড়৷ সেই যমালয়ে জীবন্ত মানুষের ভোলা। যখন জ্ঞানগর্ভ কথার গদা দিয়ে কেউ এলোপাথাড়ি ঠোকাঠুকি করে চলে, মনে মনে ভাবি সেই ভোলা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ আর আমি আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ষাঁড়টাকে ইন্সট্রাক্ট করছি, "গুঁতো ভোলা, গুঁতো"!

Tuesday, April 19, 2022

রবি ঘোষের বই



আত্মজীবনী লেখায় বাঙালিদের যে কেন এত অনীহা কে জানে৷ রবি ঘোষের মত মানুষ যদি নিজের ভাষায় নিজের কাজকর্মের গল্প বিশদে লিখে যেতেন, বাঙালি বর্তে যেত৷ ওঁর মত গুণী মানুষদের ক্ষেত্রে যে'টা সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ওঁদের কাজের ডিসিপ্লিন আর প্যাশন সম্বন্ধে পড়ে মুগ্ধ হওয়ার জন্য সিনেমার ছাত্র হওয়ার দরকার পড়েনা৷ বরং খানিকটা পড়েই মনে হয়; ইস, রবি ঘোষ যে'ভাবে অভিনয়ের গ্ল্যামারহীন দিকগুলোকেও অনুগত ছাত্রের চোখ দিয়ে দেখছেন, তেমন ভাবে আমিও যদি অফিসের পেন্ডিং ফাইলগুলো ঘাঁটতে পারতাম; তা'হলে রোজকার কাজটা কতটা উপভোগ্য হয়ে উঠত। তুলনাটা হয়ত বাড়াবাড়ি হল৷ তবে বক্তব্য হচ্ছে রবি ঘোষ স্তরের শিল্পীদের নির্বাণলাভের জন্য  গ্যালারি থেকে ভেসে আসা উচ্ছ্বাস আর হাততালিটাই শেষ কথা নয়৷ কাজের ডিসিপ্লিনে ডুবে থাকাটাই সম্ভবত তাঁদের মূল ইনসেন্টিভ৷ আমার মত মানুষ, যার শিল্প জগতের সঙ্গে এতটুকু সুতোর যোগই  নেই, যদি শিল্পীদের প্যাশন সম্বন্ধে একটা আইডিয়া পেতে চাই; তা'হলে রবি ঘোষের মত স্টলওয়ার্টদের লেখাই কুড়িয়ে-কাছিয়ে পড়তে হবে৷ কুড়িয়ে-কাছিয়ে ভদ্রলোকের খুচরো লেখাগুলো জড়ো করার দুরূহ কাজটা করা হয়েছে  "আপনমনে" বইটাতে৷ সম্পাদক অভীক চট্টপাধ্যায় এবং সপ্তর্ষি প্রকাশনকে ধন্যবাদ৷ ভদ্রলোক জীবনী লেখার বা লেখানোর কোনও চেষ্টা যখন করেননি, তখন আমাদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ 

বইটা স্রেফ একটা প্রবন্ধ সংকলন, রবিবাবু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে'সব লেখা দিয়েছেন; সে'গুলোই জড়ো করে ছেপে দেওয়া হয়েছে৷ লেখাগুলো বেশিরভাগই টপিকাল, কাজেই কিছু ঘটনা, অনুভূতি ও অভিব্যক্তি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে৷ তা সত্ত্বেও বইটা আমার খুব ভালো লেগেছে। কেন?

প্রথম কারণটা বলেইছি৷ কর্মযোগ যে কী ফ্যান্টাস্টিক ব্যাপার, সে'টা এ বই পড়লেই মালুম হবে৷ একটা মানুষ নিজের কাজের মধ্যে ডুবে আছেন, কাজের ভালোবাসায় নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন৷ আর নিজেকে ঠুকেপিটে রোজ একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেলেন 'নেক্সট-লেভেল-এক্সেলেন্সের' দিকে৷ সে'টা যে কী দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার।  দ্বিতীয়ত, সেই সময়, সে'সময়ের কলকাতা, সে'দিনের বাংলা অভিনয় আর সে'যুগের মানুষজনদের ব্যাপারে একটা ছিমছাম প্রাইমার রয়েছে এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে৷ আর একটা জব্বর ব্যাপার হল উৎপল দত্ত আর সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে রবি ঘোষের অবজার্ভেশনগুলো; সে'গুলো আমি খোলসা করতে গেলে খেলো হয়ে যাবে৷ রবি ঘোষের ভাষাতে পড়াই ভালো৷ 

বইটার আর একটা দুর্ধর্ষ ব্যাপার হল বাংলা সিনেমায় কমেডি এবং কমিক অভিনয় সম্বন্ধে ওঁর মতামত, খেদ আর অভিমান। সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে সিনেমার হাসির যোগাযোগ নিয়ে চমৎকার কিছু মনোলগ লিখে গেছেন ভদ্রলোক; সে'গুলো যতটা ধারালো, ততটাই হতাশা মেশানো৷ আর ভদ্রলোকের ভাষার উইট মিশে লেখাগুলো বেশ রসালোও হয়েছে। সত্যজিতের স্ক্রিপ্ট থেকে উঠে আসা নটবর মিত্তিরের মতই তার কথাগুলো স্মার্ট, সাবলীল, মজারু, এবং সরলসিধে৷ আর একটা ব্যাপার, ভদ্রলোক যাই লিখেছেন সে'টা পড়লে মনে হবে টেবিলের ওপারে চায়ের কাপ নিয়ে বসে বলছেন। কাজেই তার বাংলায় চলে এসেছে প্রচুর ইংরেজি শব্দ যা আমরা সাধারণ কথাবার্তায় দিব্যি বলে থাকি৷ আমার অবশ্য সে'টা ভালোই লেগেছে। এই বই নিয়ে লিখতে বসে তাই দিব্যি ইংরেজি শব্দগুলো ফিল্টার না করে চালিয়ে গেলাম৷ 

আর একটা ব্যাপার প্রশংসার দাবী রাখে। প্রত্যেক প্রবন্ধের শেষে যত্ন করে টীকার লিস্ট সাজিয়েছেন সম্পাদক৷ আর ফুটনোটের মত কিপটেমি করে লেখা নয়, গুছিয়ে লেখা এক একটা প্যারাগ্রাফ৷  আমার মত কম-জানা মানুষজনের জন্য যা বেশ কাজের জিনিস৷ এই যেমন সেই টীকা পড়েই জেনেছু অভিনেতা সত্য বন্দোপাধ্যায় জার্মান ভাষা জানতেন আর রবি ঘোষই শর্মিলা ঠাকুরকে কমলকুমার মজুমদারের কাছে নিয়ে গেছিলেন অভিনয় শেখাতে৷ 

কাজেই, যদি না পড়ে থাকেন, তা'হলে বইটা চট্ করে সংগ্রহ করে নিতেই পারেন। 

Thursday, March 24, 2022

শুটিংয়ে ফেলুদা আর আমাদের আকাশকুসুম



ছোটবেলায় পড়া প্রিয় অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন রিক্রিয়েট করার প্রসেসটা নির্ঘাৎ দারুণ জমজমাট৷ ব্যাপারটায় ঠিক কী কী ঘটে? 

সেটে সবার হাতে ফেলুদার বইয়ের সেই ছবি আঁকা পাতাটা ঘোরাঘুরি করে? 

নির্দেশক অভিনেতা অভিনেত্রী এবং সমস্ত কলাকুশলীরা কি নিজেদের কাজ সাইডে রেখে বইয়ের ছবিতে লালমোহনের বসার অ্যাঙ্গেল আর সেটের লালমোহনের বসার ভঙ্গি মিলল কিনা তা নিয়ে মারাত্মক তর্ক জুড়ে বসেন? 

সেটের ফেলুদাকে কি পাইকারি হারে জ্ঞান শুনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়তে হয়? 

অকুস্থলে উপস্থিত প্রতিটা মানুষই কি ভেবে বসেন না যে " আহ্, আমিই যদি ফেলুদার সেই একপেশে ক্যারিস্মাটা নিজে গিয়ে ডেমোন্সট্রেট করে দিতে পারতাম"!

আর সেটের 'এক্সট্রা' বা ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা সংলাপহীন জুনিয়র অভিনেতারাও কি বইয়ে আঁকা ছবিতে নিজের খুঁজে হদ্দ হন? এই যেমন এ'খানে বইয়ের আঁকায় এক দম্পতি (তাদের দাম্পত্য নেহাতই আমার  কল্পনার ফসল) খানিকদূরে হেঁটে যাচ্ছেন। আবার সেটের ছবির আবছা ব্যাকগ্রাউন্ডে সে দম্পতি দূরের সোফায় বসে। সোফায় বসে কি তাদের মনের মধ্যে খতরনাক হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় শুরু হয়েছে "প্রিসাইস রোলে" নিজেদের ফেলতে না পেরে?

দিনের শেষে ফাইনাল আউটপুট দেখে মানুষজন কি নিজেদের হাত কামড়ে ওঠেন খুচখাচ 'তফাৎ স্পট' করে? "এ কী ভাই, নুনের ডিবেগুলো ফ্রেমে নেই কেন? কে সরিয়েছে? কোর্ট মার্শাল, রাইট নাউ"! 

আর, এর ফলে কি একসেট মানুষ নতুন করে ফেলুদা পড়তে শুরু করেন? 

কে জানে!

প্রিয় বইয়ের আঁকা ছবি শুটিং ফ্লোরে রিক্রিয়েট হওয়ার ব্যাপারটা রীতিমত টিকিট কেটে দেখা যায়৷ কিন্তু তা যখন সম্ভব নয়, তখন "আরিব্বাস" বলে বুকের ছ্যাঁত চেপে "দার্জিলিং জমজমাট" বইটা তাক থেকে নামানো ছাড়া আর বিশেষ কোনও উপায় থাকে না।

Monday, January 10, 2022

আতরঙ্গি



("আতরঙ্গি রে" সিনেমাটা প্রসঙ্গে এ'টা লেখা৷ স্পয়লার হয়ত আছে। 'হয়ত' বললাম কারণ আমি সে অর্থে ঠিক নিশ্চিত নই)


- বাবা।

- বল্।

- আবার কবে আসবে? 

- সামনের মাসে। যেমন আসি।

- ফের ওই দিন'দুয়েকের জন্য?

- সে'টা নিয়ে এখন থেকেই চিন্তা করবি না শিঙাড়াটা ঠাণ্ডা হওয়ার আগে জাস্টিফাই করবি।

- সামনের মাসের চোদ্দ তারিখ নতুন চাকরীটায় জয়েন করছি। 

- নতুন প্রফাইল।  সামলে খেলিস বুড়ি৷ কোনও ফচকেমো নয়। ইট ইজ আ হিউজ অপরচুনিটি।

- তুমি তার আগের হপ্তায় আসবে তো? প্রফাইলটা গোটাটাই টেকনিকাল। তোমার সঙ্গে একটু আলোচনা করে নিলে সুবিধে হত৷ 

- আমার জন্য আবার ওই টেকনিকাল আলোচনা কেন রে বাবা। আমি বরং তোকে কলকাতার ইতিহাসে কাঠিরোলের সিগনিফিক্যান্স বোঝাতে একটা ওয়াকে নিয়ে যাব পরের বার৷ ট্যুরটার নাম দেব রোলের উত্তর দক্ষিণ। 

-  বাবা, আমার নার্ভাসনেসকে পাত্তা না দেওয়ার বদঅভ্যাসটা এ'বার ছাড়ো দেখি। মা থাকলে এমন কথায় কথায় আমার চিন্তাগুলো উড়িয়ে দিতে পারতে?

- তোর মায়ের তো আবার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি ছিল। উফ, তুই একা রাস্তা পেরোলেও সুমির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ত। অমন নার্ভাসনেস নিয়ে কি প্যারেন্টিং হয় নাকি! যাক গে, বুড়ি! মায়ের কথা ভেবে মনকেমন হয় খুব, তাই না?

- খুব৷ খুউব।

- আমারও। মাঝেমধ্যে এতটাই মনখারাপ হয় যে মনে হয় দূরের চাকরীটা ছেড়ে তোর সঙ্গে গিয়েই থাকি। তুইই না হয় বাপকে খাওয়াবি।

- আমি তো চাই তুমি আমার সঙ্গেই থাকো৷ কিন্তু, চাকরীটা ছেড়ে দিলে কলকাতায় তোমার মন টিকবে?

- টিকবে না, তাই না রে?

- আদৌ নয়৷ যাক গে, সামনের মাসে এগরোল পরিক্রমার জন্য মুখিয়ে রইলাম।

- নামটাকে ডায়লুট করিসনা প্লীজ। রোলের উত্তর দক্ষিণ। রিমেম্বার দ্য ট্যুর নেম। 

**

- সুমি৷ কেমন দেখলে মৃণালকে?

- একইরকম। প্রতিবার যেমন দেখি।

- জানি৷ 

- ডাক্তার, মৃণাল কি কোনওদিনও আমায় চিনতে পারবে না?

- আমরা চেষ্টা তো করছি সুমি। নিজের সন্তানের মৃত্যু৷ শকটা বড্ড ইন্টেন্স।

- মিলির মৃত্যু তো আমাকেও সহ্য করতে হয়েছে ডাক্তার৷ আমিও তো মা। কই আমি তো এমন..।

- সবার ডিফেন্স মেকানিজম একই রকম হয়না যে সুমি। আর মৃণালের কেসটা বড্ড কিউরিয়াস। তোমার মধ্যে সে মিলিকে খুঁজে নিয়ে সে স্বস্তি খুঁজে পেয়েছে৷ ওই ইমোশনাল কমফর্ট জোন থেকে ওকে টেনে বের করা সহজ হবে না।

- বারবার ইচ্ছে হয় ওকে ঝাঁকিয়ে বলি আমি সুমি। আমাদের মিলি আর নেই। ওর বুড়ি আর নেই।

- ইট উইল নট হেল্প।

- কিন্তু আমার যে ওকে দরকার৷ আমি যে আর পারছি না৷ আমাকে মুছে ফেলতে ওর আদৌ কষ্ট হলনা ডাক্তার?

Sunday, January 9, 2022

লুকিং আপ



- এই যে, সাঁতরা...কোন চুলোয় ছিলে বাপ! 

- আসলে লাইটারটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই এ'দিক ও'দিক..।

- উফফ, এ'দিকে আগুন যে আমাদের গায়ে এসে পড়েছে।

- আগুন?

- এ কী...তুমি কি খবরটা পাওনি?

- কোন খবর!

- হরিহরপুরের নাম শুনেছ?

- শহর থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ। হাইক্লাস আখের গুড় পাওয়া যায়।

- খাইখাইটা থামাও। সে গাঁয়ের নীচের গোটা ওয়াটার টেবিল আচমকা বিষিয়ে গেছে৷ একশো সতেরোজন ডেড৷ তিনশোর ওপর মানুষ ক্রিটিকাল৷ 

- মাইগড!

- তবে আর বলছি কী। 

- স্যার, এখুনি টীম পাঠাতে হবে তো। সুমন্তরা রেডি আছে কিনা দেখি..। ইয়ে, একটা কথা। এতগুলো মানুষ মারা গেল, এতজন হাসপাতালে..মিডিয়ায় তবু কেউ..।

- কেউ কী?

- কেউ ফলাও করে খবর করল না কেন?

- যে কারণে তুমি এখনই খবর তৈরি করবে না। রয়সয়ে সুতো ছাড়বে।

- কী'রকম?

- মিনিস্টার পাঁকড়াশি আমায় আজ সকালেই সমস্ত জানিয়েছেন।  টপ মিডিয়াহাউজগুলো সবাই জানে৷ 

- ইন্সট্রাকশনটা কী?

- ওয়েটিং ফর দ্য রাইট মোমেন্ট৷ 

- মানে যে'টা স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল তো। অন্তত হাজারখানেক না মরলে পাত্তাটাত্তা দেওয়া চলবে না৷ 

- এ'বার কেসটা একটু আলাদা৷ সে জন্যই তোমায় খুঁজছিলাম।

- কী'রকম?

- আজ রাত্রের মধ্যে সমস্ত চ্যানেল এই খবর কভার করা শুরু করবে। কয়েক ঘণ্টা সময় আরও দরকার কারণ সরকারবাহাদুর কেস সাজাচ্ছে।

- কেস? কী কেস?

- ও মা। ওয়াটার টেবিল পয়জনড৷ ক্রিমিনালদের ধরতে হবে না?

- হিউমান ইন্টারভেনশন রয়েছে? বলেন কী! মানুষের শয়তানি? 

- তা কেউ জানে না৷ কিন্তু সরকার যদি বলে আমরা জানি না, পাবলিক তা পছন্দ করবে কেন? কতবার তোমায় বলব ভাই সাঁতরা, লোকে কী চায়?

- অ্যাকশন! 

- করেক্ট! 

- অ্যাকশন দিতে হবে লোককে৷ কাজেই সরকার কেস সাজিয়ে দু'চারজনকে গ্রেপ্তার করবে৷ সেই অ্যাকশনটাই হেডলাইন৷ মৃত্যুটৃত্যু ফুটনোটে৷ ওকে?

- ওকে। কিন্তু গ্রেপ্তার কাদের করবে?

- ও কোন রামশ্যামযদুমদুকে ধরে সুট করে ঢুকিয়ে নিলেই হল। তাতে তোমার আমার কী। 

- কিন্তু আদত কারণটা..।

- পাঁকড়াশি জানালে যে গত ছ'মাস ধরে দু'জন প্রফেসর উঠেপড়ে লেগেছিল প্রমাণ করতে যে সুপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির  বিষাক্ত কেমিক্যাল নাকি হরিহরপুরের পানীর জলকে বিষিয়ে দিচ্ছে এবং ব্যাপারটা কয়েকদিনের মধ্যেই এক্সপ্লোড করবে৷ 

- রাইট৷ প্রফেসর গুপ্ত আর তার সহকারী প্রফেসর গুহ। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। পাত্তা দিইনি৷ 

- অমন বোরিং গপ্প পাত্তা না দেওয়াটাই আমাদের কর্তব্য সাঁতরা। নয়ত প্রাইমটাইমে ভজন শোনাতে হবে। 

- তা ঠিক। কিন্তু এমন বিশ্রী ব্যাপার যে ঘটে গেল..।

- টেররিস্ট অ্যাক্ট। বললাম তো। 

- ওহ রাইট৷ কিন্তু ওই দুই প্রফেসর যদি ট্যাঁফোঁ করে..।

- প্রফেসর গুহ সচেতন ও বুদ্ধিমান। তিনি বেশ মোটা ইন্সেন্টিভ নিয়ে একটা সরকারি কমিটির মাথা হতে স্বীকার করেছেন।

- আর গুপ্ত?

- নিখোঁজ।  

- আই সী। 

- যাকগে৷ সাঁতরা। আজ প্রাইম টাইমে এ'টা থাকছে।

- বেশ।

- ইয়ে। একটা জিনিস মাথায় রেখো৷ হরিহরপুরে আমাদের যে টীম যাবে, তারা যেন এমন সব লোকেশন বেছে নেয় যাতে ক্যামেরায় হাইপিওর মিনারেল ওয়াটারের হোর্ডিংটা ব্যাকগ্রাউন্ডে স্পষ্ট দেখা যায়৷ কনেকশনটা বুঝতেই পারছ৷ বিশুদ্ধ পানীয় জলের ক্রিটিকালিটিটা হাইলাইট করার এটাই ভালো সময়। 

- হাইপিওর মিনারেল ওয়াটার৷ ও'টা ওই সুপারটেক গ্রুপেরই তো৷ আর তাছড়া এ'টা শহুরে ব্র‍্যান্ড৷ হরিহরপুরে ওদের হোর্ডিং আছে?

- আর একঘণ্টার মধ্যে হোর্ডিং দাঁড়িয়ে যাবে। ওদের সিইও নিজে ফোন করেছিল। এই সাবলিমিনাল মেসজিংয়ের অপরচুনিটি ওরা কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না৷ আমাদের প্রাইমটাইমের মূল স্পনসরও আজ ওরা৷ 

- বাহ্, বেশ বড় ডীল হাঁকিয়েছেন দেখছি।

- হ্যাঁ৷ টোটাল উইন-উইন৷ ইলেকশনের আগে টেররিস্ট কাত করে গ্রেট পিআর বুস্ট ফর সরকারবাহাদুর। সুপারটেক গ্রুপের সোনায় সোহাগা৷ আর আমাদের টিআরপি আর টু পাইস৷ কিন্তু তোমায় জোরকদমে সবকিছু এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সাঁতরা৷ 

- ওউক্কে স্যার। হয়ে যাবে৷ আচ্ছা, হরিহরপুরের মানুষদের বাইটটাইট নিতে হবে কি?

- বাইট নিও৷ তবে ওরা কী বলবে, সে স্ক্রিপ্টটা একবার নিজেই ঝালিয়ে নিও। 

- পার্ফেক্ট৷ 

- আর শোনো, তোমার লাইটারটা আমিই নিয়েছিলাম। আমারটা যে কোন শালা মেরে দিল৷ এই নাও।

Friday, December 31, 2021

চাষবাস



জটিল কিছু যদি কেউ সহজ ভাষায় ফুসমন্তরে বুঝিয়ে দেন, তা'হলে তার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না৷ সে'দিক থেকে, য়ুভাল নোয়াহ্ হারারি সাহেবের প্রতি আমি বেশ খানিকটা ঋণী। আজ হঠাৎ ভদ্রলোকের কথা ফের মনে পড়ল কারণ ওঁর স্যাপিয়েনস বইটার মধ্যে যে চ্যাপ্টারটা আমার সবচেয়ে প্রিয়, সে'টা আজ আর একবার পড়লাম৷ বলে রাখা ভালো, 'এগ্রিকালচারাল রিভোলিউশন' নিয়ে লেখা ওই কয়েক পাতায় আমি মাঝেমধ্যেই ফেরত যাই। ঠিক যেমন ভাবে মাঝেমধ্যেই ঘুরেফিরে আগন্তুক সিনেমার সেই দৃশ্যটা দেখি যে'খানে মনমোহন মিত্র আর পৃথ্বীশ সেনগুপ্তর তর্কের চোটে অনীলা আর সুধীন্দ্রর ড্রয়িংরুম সরগরম হয়ে ওঠে৷

আগন্তুক যখন প্রথম দেখি, তখন আমি নেহাতই ছেলেমানুষ। তবে সে সংলাপ এতটাই তীক্ষ্ণ  যে সেই স্কুলবয়সেও মনমোহনের ভক্ত হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। কিন্তু সে সংলাপ নিয়ে 'বলে কী রে ভাই' মার্কা বিস্ময় বোধ করেছি অনেক পরে। স্যাপিয়েনসের ওই চ্যাপ্টারটার মতই, ওই দৃশ্যটা বারবার দেখেও ক্লান্তি আসেনা। আমার মত বহু ছাপোষা মানুষ নিশ্চয়ই মনমোহনের বাগ্মিতায় বারবার মুগ্ধ হয়েছেন। ফেসবুক টাইমলাইন বা ইউটিউবে সে দৃশ্য মাঝেমধ্যেই চলেও আসে। সভ্যতা কী, টেকনোলজি কী, মানবাধিকার কী, স্বাধীনতা কী; এ'সব ভারিক্কি প্রশ্নকে প্রায় টেনিস বল লোফালুফির পর্যায় এনে আলোচনা করেছেন মনমোহন।  সারকাজম এড়াতে পারেননি, পৃথ্বীশের উস্কানিতে বারবার রেগেও উঠেছেন। কিন্তু মনমোহন নিশ্চিত ভাবেই দর্শকের ভাবনাচিন্তা এলোমেলো করে দিতে পেরেছেন৷ কিন্তু, পৃথ্বীশের জেদকে ঠিক ভাঙতে পারেননি মনমোহন। অবশ্য অমন একবগগা মানুষকে বাগে আনা সহজ নয়৷ সেই গাম্বাটপনার জন্যই তর্কটা জমে ওঠার আগেই সুতো ছিঁড়ে গেল।

আজ এই পোস্ট লিখতে বসা একটাই কারণে। আগন্তুকের সেই দৃশ্য যদি আমার মত অন্য কারুরও অসম্পূর্ণ ঠেকে, তাদের জন্য হারারির লেখা ওই কয়েকপাতা বেশ জরুরী। মানুষের চাষবাস কী ভাবে শুরু হল, সে গল্প হারারি বলেছেন যে'খানে, সেই অধ্যায়ের নাম; "হিস্ট্রিজ বিগেস্ট ফ্রড"। বনেজঙ্গলে শিকার করে, ফলমূল খেয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষ আচমকা একসময় চাষবাস শুরু করলে। সে'খান থেকে গড়ে উঠল বসতি। মানব সভ্যতা তরতরিয়ে এগোতে লাগল। পৃথ্বীশ নিশ্চয়ই যে'টাকে বলতেন; 'অভাবনীয় প্রগ্রেস'। কিন্তু সেই প্রগ্রেস যে কতটা গোলমেলে, সে'টাই বুঝিয়েছেন হারারি সাহেব; বরফ-মার্কা সব যুক্তি সাজিয়ে। গোটা মানব সভ্যতার মূলেই যে 'আশায় মরে চাষা'র ট্র‍্যাজেডি, তাই ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছেন হারারি।

চাষবাসের ফলে মানুষের খাটনি বাড়ল।
খাবারের পরিমাণ বাড়লেও পুষ্টি কমল, কারণ এর আগে মানুষ রকমারি ফল, সবজি, মাংস খেয়ে বেড়াত। অথচ কৃষিকাজ শুরু করার পর পাতে পড়তে লাগল কাঁড়িকাঁড়ি ভাত বা আটা।
শিকার করা বা গাছ থেকে ফল পাড়ার চেয়ে চাষবাসে অনেক বেশি খাটুনি। কাজেই জ্বালাযন্ত্রণা বাড়তে শুরু করল।
একদিকে।খাবার উৎপাদন যেমন বাড়ল, খেতখামারে কাজের জন্য বাড়তি লোকজনেরও দরকার পড়ল।
শিশুরা এর আগে স্রেফ মায়ের দুধের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন 'আধুনিক' খিচুড়িটিচুড়ি পাতে পড়তে শুরু করল। ফলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বাড়তে লাগল, কমল ইমিউনিটি। শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেল। সামগ্রিক রোগভোগও বাড়ল। 
দু'এক রকম ফলনের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বহুগুণ বেড়ে গেল, ফলে অতিবৃষ্টি খরা এইসব নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তায় বাড়ল বহুগুণ।  
এরপর এলো আর এক গেরো। বাড়তি উৎপাদন সামলে রাখার দায় বাড়লো যাতে ভবিষ্যতে ফলন কম হলেও পেটে দানাপানি পড়ে। এরপর এলো একের ভরাগোলা দেখে অন্যের চোখ টাটানোর পালা। শুরু হলো চুরি। এলো যুদ্ধ। বসলো ট্যাক্স। শেষে সেই চিরপরিচিত ট্রাজেডি; কৃষকদের হাড়ভাঙা খাটুনির ওপর ট্যাক্স বসিয়ে সিংহাসনে বসলেন রাজা, তৈরি হল শহর,  গড়ে উঠল সেনাবাহিনী, এলো রাজনীতি,  এলো যুদ্ধ। 

মোদ্দা কথা হল চাষবাস শুরু করার পর থেকেই হোমো স্যাপিয়েনদের রসেবশে থাকার দিন খতম। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই বোধ হয় সুখে থাকতে ভূতে কিলোনোর শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ।  

আর এ'খানেই একটা সামান্য খটকা। আগন্তুক সিনেমার সেই মারকাটারি তর্কের দৃশ্যে মনমোহন বন্যসভ্যতার পক্ষে সওয়াল করে বলছেন জংলি মানুষের 'এগ্রিকালচার, পটারি, উইভি''ও সমীহের দাবী রাখে। কিন্তু ওই এগ্রিকালচার থেকেই যে মানুষের পতনের শুরু। অবশ্যই সে পতনের মধ্যে দিয়েই রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছেন। সে'টা নিশ্চয়ই হেলাফেলার ব্যাপার নয়। 

মনমোহনের আর্তনাদ মনে আছে? যে'খানে উনি প্রায় চিৎকার করে ঘোড়েলশ্রেষ্ঠ পৃথ্বীশকে বলছেন, "আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আমি নিজে জংলি নই! এ'টা আমার পরম আক্ষেপের বিষয় যে আমি জংলি নই।...কিন্তু উপায় কী বলুন। ঘর ছাড়ার অনেক আগেই আমার মজ্জার মধ্যে ঢুকে গেছে শেকসপিয়ার, বঙ্কিম, মাইকেল, মার্ক্স, ফ্রয়েড, রবীন্দ্রনাথ.."।

" মজ্জায় রবীন্দ্রনাথ ঢুকে গেছে" - আমার মত এলেবেলে মানুষকে যদি এই আক্ষেপের মূলে পৌঁছতে হয়, তবে হারারি সাহেবের এই চমৎকার বইটা বোধ হয় অত্যন্ত জরুরী।