Tuesday, August 23, 2022

অর্ক আর সুমন



স্কুল থেকে ফিরেই দুদ্দাড় করে স্নান, হুশহাশ করে ঝোল-ভাত সাফ করা। এর পর অর্ক গিয়ে বসে ছাতের ঘরে। এ'টাই তার দুপুর-সাম্রাজ্য। আর তার সাম্রাজ্যে সবচেয়ে দামী জিনিস হল একটা ফিলিপ্সের পুরনো টেপরেকর্ডার।  মেজদা এক জন্মদিনে উপহার পেয়েছিল, কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়ার আগে অর্ককে উইল করে দিয়ে গেছে। 

তা'তে প্রচুর হিন্দি গান শোনে অর্ক। প্রচুর। কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, অলকা ইয়াগ্নিক আর সাধনা সরগম; তার খুব পছন্দ। ফুলকাকার ধারণা অত লারেলাপ্পা হিন্দি গান শুনে অর্ক বখে যাবে। বাবার ধারণা ফুলকাকা বড্ড বেশ চালবাজ, সে'টাই বাঁচোয়া। 

বাবা বলে "যে গান পছন্দ সে গানই শুনবি। গানও যদি অন্যের মতে শুনতে হয়, তা'হলে আর বেঁচে থেকে হবেটা কী"।



**



- এক্সকিউজ মী। এই যে আপনি..আপনাকে কি আমি চিনি?



- আরে, মিস্টার চ্যাটার্জী৷ হোয়াট আ প্লেজ্যান্ট সারপ্রাইজ। আমি আপনারই অপেক্ষায় বসেছিলাম তো৷ 

আমিই দুলাল।

- এই অঞ্চলে আমি এর আগে আসিনি৷ একটা জরুরী কাজে আচমকাই এ'দিকে..। এই চায়ের দোকানও আগে দেখিনি৷ আচমকাই চলে এলাম। আমি জানতাম না এই বেঞ্চিতে আপনি বসে থাকবেন৷ নেহাত আপনার মুখটা একটু চেনা ঠেকল..

তাই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আর আপনি বলছেন আপনি আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন?দুলাল নামে কাউকে কখনই আমি...।

- বহু বছর ধরে মাই লর্ড। বহু বছর ধরে আমি আপনার অপেক্ষায় বসে।

- কী'সব আজেবাজে কথা!

- বাজে কথাই যদি হবে, তা'হলে আপনার আমায় চেনা-চেনা ঠেকল কেন মিস্টার চ্যাটার্জী?যাক গে, খামোখা সময় নষ্ট কেন। যে কারণে এসেছেন, সে ব্যবস্থা করা যাক।

- এক মিনিট। আমি কী কারণে এসেছি? এ'সব হেঁয়ালির কী মানে দুলালবাবু?

- আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারছেন না?

মিস্টার চ্যাটার্জী একটা পেল্লায় ঢোক গিললেন। বুকের ঢিপঢিপটা বেশ অস্বস্তিকর পর্যায় পৌঁছে গেছে। 



**



বাবার কাছ থেকে মাসে দু'টো ক্যাসেট কেনার টাকা পাওয়া যায়৷ তা দিয়ে বিভিন্ন হিন্দি সিনেমার ক্যাসেট খুঁজেপেতে নিয়ে আসে অর্ক৷ কিন্তু এই অদ্ভুত লোকটার অদ্ভুতুড়ে বাংলা গানগুলো কী'ভাবে যেন ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। এক ক্লাসমেটের বাড়িতে গিয়ে ওঁর গান প্রথম শুনেছিল, তারপর থেকে খানিকটা নেশার মত হয়ে গেছে। কাজেই গত মাসের 'ক্যাসেট-বখশিশ' দিয়ে ওই দাড়িওলারই দু'দুটো ক্যাসেট কিনেছে সে। "তোমাকে চাই" আর "ইচ্ছে হল"। আপাতত অবশ্য "ইচ্ছে হল" অ্যালবামটাই অর্কর বেশি প্রিয়। 

আর এই ক্যাসেটে একটা গান অর্ক বার বার রিওয়াইন্ড করে শোনে; "বয়স আমার মুখের রেখায়..."।
গানটা যতবার শোনে, অর্কর মনের মধ্যে আশেপাশের বয়স্ক মানুষগুলো সম্বন্ধে একটা আলাদা রকমের মনকেমন তৈরি হয়। একটা কেমন ব্যথা মেশানো স্নেহ; সে ঠিক বোঝাতে পারে না। ওই ব্যথা, স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা মিলে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা। গানটার সুর যেমন, কথাগুলোও তেমনি সুন্দর। বাবার দূরসম্পর্কের মামা, কথায় কথায় ছড়া কাটা বিনোদদাদুর কথা মনে পড়ে, আসানসোলের দাদু-দিদার কথা মনে পড়ে, জামশেদপুরের অঙ্ক-পাগল বিমলজ্যেঠু,  এমন কি বাড়ির পাশের  মুদিখানায় বসে থাকা খিটখিটে জয়ন্ত জ্যেঠুর কথা ভেবেও মনটা সামান্য খারাপ হয়ে আসে। ওই বয়সে গিয়ে সবাই কি অল্প-বিস্তর একা হয়ে পড়ে? কে জানে। গত সাতদিন ধরে দুপুরবেলা নিয়মিত এই গানটা অন্তত বার তিনেক করে শুনছে অর্ক। 

**


চায়ের দোকানে বেঞ্চির ওপরই একটা ক্যানভাসের ব্যাগ রাখা ছিল। সেই ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেশ একটা মাতব্বরে হাসি ছুঁড়ে দিলেন দুলালবাবু। মিস্টার চ্যাটার্জীর অস্বস্তি বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই সরে পড়তে ইচ্ছে করছিল না। আর কী আশ্চর্য, দোকানের অন্যান্য মানুষজন তাঁদের পাত্তাও দিচ্ছে না।

অন্তত আড়াই মিনিট সে ব্যাগ হাতড়ে দুলালবাবু ঘোষণা করলেন, "পেয়েছি মিস্টার চ্যাটার্জী, পেয়েছি"। 

**

সুমনের এই গানটা শুনতে শুনতে প্রতিবার বুকের মধ্যে একটা মোচড় টের পায় অর্ক। আজকেও পাচ্ছিল। আচমকা সামনের দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাটার দিকে বুক ছ্যাঁত করে উঠল। 

**

ব্যাগ হাতড়ে একটা সস্তা দাড়ি কামানোর আয়না টেনে বের করলেন দুলালবাবু। 

- কই মিস্টার চ্যাটার্জী, এ'টার জন্যই তো এসেছিলেন। নাকি!

- এ'সব কী পাগলামো হচ্ছে দুলালবাবু?

- পাগলামো দেখেও তো পালিয়ে যাচ্ছেন না মিস্টার চ্যাটার্জী। দেখুন না, এ'টার জন্যই তো আপনি ছুটে এসেছেন। তাই না?

- এই আয়না? 

- দেখুন না।

- দেখার কী আছে! বিচ্ছিরি একটা আয়না। আর তা'তে আমি আর আপনি।

- সত্যিই তো। দেখার কী আছে। শুনুন। শুনুন। আয়নায় শুনুন।

- শুনব? আয়নায় শুনব?

- শুনুন না। মন দিয়ে।

মিস্টার চ্যাটার্জীর বুকের ভিতরে যেন কেউ ইটপাটকেল ছোঁড়াছুড়ি করছে।  গলা শুকিয়ে আসছে। স্পষ্ট হয়ে আসছে সব কিছু। খানিকটা কান্নাও পাচ্ছে তার। আর নিজেকে বড় ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। বৃদ্ধ চ্যাটার্জী দিব্যি টের পাচ্ছিলেন যে আয়না থেকে ভেসে আসছে গান, "বয়স আমার, মুখের রেখায়..."। 

**
অর্ক হতবাক হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে। সে নিজেকে দেখতে পারছে না। আয়না থেকে তার ঘরটাও হাওয়া। আয়নায় তখন দু'জন মানুষ দাঁড়িয়ে। দু'টোই অচেনা মুখ। একজনের উসকোখুসকো চেহারা, গালভরা হাসি। সে যেন অর্কর দিকে তাকিয়েই হাত নাড়ছে। আর তার পাশে একজন বয়স্ক মানুষ, নির্ঘাত বছর ষাটেক বয়স। এর মুখটা আবার অচেনা হয়েও চেনা। ভীষণ চেনা। সেই বুড়োটে আধ-চেনা মানুষটার চোখ ছলছল, যেন এই মাত্র কেঁদে ভাসাবেন। 

ও'দিকে ফিলিপ্স টেপ রেকর্ডারে সুমন অক্লান্ত ভাবে গেয়ে চলেছেন;
"গলার কাছে পাল তুলেছে আজগুবি এক স্মৃতির খেয়া
বয়স হওয়া মানেই বোধহয়; স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়া,
কে বলে হে আড্ডা নাকি কম বয়সের কথকতা
বয়স হলেই বরং জমে আড্ডা এবং নীরবতা"!

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আয়না থেকে সেই দু'জন বিটকেল মানুষ হারিয়ে গেল। কাঁপা হাতে অর্ক টেপ রেকর্ডারের 'স্টপ' বোতামটা টিপল।

**

কয়েক মুহূর্তেই আয়না থেকে সুমনের সেই গান হারিয়ে গেল। ততক্ষণে সমস্তই জলের মত সহজ। ডুকরে কেঁদে উঠে দুলালবাবুকে জড়িয়ে ধরলেন অর্ক চ্যাটার্জী।

দুলালবাবু আয়না সরিয়ে রেখে শুধলেন, "এই বয়সে গিয়ে সবাই কি অল্প-বিস্তর একা হয়ে পড়ে মিস্টার চ্যাটার্জী"?

Sunday, August 21, 2022

আলভারেজের ধনরত্ন



ঘুম ভাঙার পর আলভারেজ থ৷ এ কী৷ দিব্যি তাঁবুর মধ্যে ক্যাম্বিসের খাটে লম্বা হয়েছিল৷ অথচ ঘুম ভেঙে দেখছে সে একটা বিশাল বাওবাব গাছের তলায় শুয়ে৷ হাত-পা বাঁধা।

আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আলাভোলা মুখের জনা পাঁচেক জংলি লোক৷ আলভারেজ বুঝলে এরা বুস্ত্ববা উপজাতির লোক, এ অঞ্চলে এদের সাংঘাতিক দৌরাত্ম্য। এদের বড় একটা কেউ দেখেনি কারণ তানজানিয়ার জঙ্গলের এই দুর্গম অঞ্চলে বড় কেউ তেমন সুবিধে করতে পারেনা৷ গতকাল রাত্রেই আলভারেজ ভাবছিল যে এ পোড়া জায়গায় হীরে খুঁজে হন্য হয়ে লাভ নেই; এ অঞ্চলের একেকটা মশাও এক্কেবারে পান্তুয়ার সাইজের। এ'খান থেকে সময়মত কেটে পড়াই মঙ্গলজনক। আলভারেজ ভেবেছিল আজই বেলার দিকে হীরের লোভ ত্যাগ করে কলকাতায় এসে বিরিয়ানির দোকান দেবে৷ বেশ কয়েকজন ইন্ডিয়ান তাঁকে বলেছে কলকাতায় বিরিয়ানির দোকান দেওয়া মানেই নাকি 'গোল্ডডাস্ট'৷

কিন্তু তার মধ্যে এই ঝামেলা৷ বুস্ত্ববাদের মধ্যে নেতাগোছের একজন এগিয়ে এসে ভাঙা হিন্দিতে কিছু বললে৷ আলভারেজ অবাক হলে না, এই গভীর জঙ্গলে আর কিছু না থাক; বলিউডি এফএম চ্যানেলের রমরমা খুব৷ আলভারেজ নিজেও কাজ চালানোর মত হিন্দি শিখে নিয়েছে৷

- তোমার সাহস তো কম নয় সাহেব৷ আমাদের অঞ্চলে এসে তাঁবু ফেলেছ?

- সরি সর্দার৷ আমি ঠিক ঠাহর করতে পারিনি৷

- এ অঞ্চলে বাইরের মানুষের উৎপাত আমরা সহ্য করব না৷ নো বহিরাগত৷

- সরি।

- তোমায় ভাবছি কচুকাটা করে সিংহকে খাইয়ে দেব৷

- এ'বারের মত ছেড়ে দিন স্যার৷ পরের বার না হয়..।

- ছাড়ব কেন? কীসের জন্য?

- ক্যাশ দেব? পেটিএম নিলে আরও কিছু না হয়..।

- ও'সব মায়ায় আমরা আটকে নেই সাহেব৷

- আমার একটা ব্যাকপ্যাক ছিল টেন্টে৷ সে'টা কেউ এনেছে কি? ও'টার মধ্যে একটা দারুণ ব্যাপার আছে৷

সে ব্যাকপ্যাক এক জংলি ছোকরার পিঠেই ছিল৷ তার মধ্যে থেকে বাঁটুল দ্য গ্রেট সমগ্র বেরিয়ে আসায় মানুষগুলোর হাবভাব পালটে গেল৷ সর্দার মানুষটা বেশ খানিকক্ষণ সে বই উলটে পালটে দেখলে, তাঁর কাঁধের ওপর বাকিরা হুমড়ি খেয়ে পড়লে। পড়া তাদের সাধ্যের বাইরে, কিন্তু ছবিতে বাঁটলোর কাণ্ডকারখানা দেখে তারা এক্কেবারে মুগ্ধ৷ সর্দার নিজে এগিয়ে এসে আমার বাঁধন খুলে দিলে।

- সাহেব, তোমাদের এই দেবতার নাম কী?

- বাঁটুল দ্যি গ্রেট।

- বাহ্, বেশ জাঁক তো৷ যাক, তোমার জান মকুব৷ তবে তোমার দেবতা আমাদের সঙ্গে থাকবে৷

- জো হুকুম সর্দার।

- আর এই দেবতা বইয়ের জন্য তোমায় আমরা একটা উপহারও দেব।

- দেবে কিছু? দাও। এমনিতে হাতটান চলছে খানিকটা। জঙ্গলে থাকো তোমরা সর্দার, ইনফ্লেশনের হ্যাপা তো আর পোহাতে হয় না।

- তুমি তো এ অঞ্চলে হীরে খুঁজতে এসেছিলে, তাই না?

- সবই তো জানো সর্দার।

- তোমার খালি হাতে ফেরাব না৷ তবে ওই ব্যাগভর্তি পাতি পাথর নিয়ে ফিরে কী করবে? তোমায় এমন জিনিস দেব যে তোমার চোখ টেরিয়ে যাবে৷

- কী জিনিস সাহেব?

***

সর্দার তাঁর দলবল নিয়ে চলে যাওয়ার পর স্তব্ধ হয়ে সেই বাওবাব গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে আধঘণ্টা বসে রইলে আলভারেজ৷ সত্যিই তার চোখ গেছে টেরিয়ে৷ মাথা গেছে ঘুরে৷ গলা গেছে শুকিয়ে। বুকের মধ্যে দুমদুম-দমাস। অনেক দামী পাথর সে দেখেছে এ জীবনে৷ কিন্তু আজ এই বুস্ত্ববা সর্দার যে এ জিনিস দিয়ে যাবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি৷

আর হীরের খোঁজে হন্যে হওয়া নয়৷

আফ্রিকার সেই নির্দয় জঙ্গলের এক কোণে বসে আলভারেজ নিজের রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং শুরু করলে। তার কাঁপা দু'হাত তখন আগলে রেখেছে সেই সাতরাজার ধন; সিনেমা থিয়েটারে বিক্রি হওয়া পেল্লায় একটাব পপকর্ন। 

চপ ও মেসোমশাই



বছর আষ্টেক আগে৷ কোথায় একটা যাওয়ার পথে হুগলীর কাছে হাইওয়ে ঘেঁষা একটা জায়গায় গাড়ি থামানো হয়েছিল৷ রুখাশুখা খটখটে দুপুর৷ সে'জায়গায় দোকানপাট বড় একটা যে ছিল তাও নয়৷ কিন্তু খিদে এতটাই প্রবল ছিল যে ভাতের হোটেল খুঁজে বের করার ধৈর্য ছিলনা৷ পাশাপাশি দু'চারটে গুমটি গোছের দোকান দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম৷

গুমটিগুলোর মধ্যে যে'টাকে সবচেয়ে 'রিসোর্সফুল' মনে হয়েছিল, সে'টার দিকেই এগিয়ে গেলাম৷ কাছে গিয়ে দেখলাম সাংঘাতিক অলরাউন্ডার দোকান৷ চা-বিস্কুট, সিগারেট-বিড়ি, চপ-ঘুগনি, মুড়ি-পাউরুটি; সব মিলে এই অসময়ে এই বেজায়গায় বেশ সুব্যবস্থাই বলতে হবে৷ দোকানি মেসোমশাই একটা ঘটংঘটং শব্দ করে চলতে থাকা টেবিলফ্যানের দিকে পিঠে করে ঝিমুচ্ছিলেন৷ "ফ্রেশ চপ" ভাজা হবে কিনা জানতে চাওয়ায় তার মেডিটেশনে ব্যাঘাত ঘটল৷ তবে ঘুমের চেয়ে খদ্দের জরুরী। অতএব এক ঝটকায় চোখ থেকে ঘুমঘুম ভাব উড়িয়ে জানান দিলেন যে বেসনটেসন গুলে ফের চপ ভাজার ব্যবস্থা করতে সেই বিকেল৷ তবে আশ্বাস দিলেন যে স্টকের আলুরচপ মিয়ানো হলেও স্বাদে যে টপক্লাস।

খিদে পেটে অত বাছবিচার করলে চলে না৷ আর আমার এবং আমার বন্ধুর পেটের মধ্যে চলতে থাকা ছুঁচোর কীর্তনগান বোধহয় মেসোমশাইয়ের কানে পৌঁছেছিল। আমরা শুধু চপের আব্দারই করেছিলাম, উনি আমাদের একটা দরাজ সলিউশন অফার করলেন৷

"ঠাণ্ডা আলুর চপ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি"। আমরা বাক্যব্যয় না করে দোকানের বেঞ্চিতে বসলাম৷ ঝিমিয়ে থাকা মানুষটা আচমকা সাংঘাতিক তৎপর হয়ে উঠলেন৷ একটা টিনের ড্রাম থেকে শালিমারের পুরনো ছোট কৌটোয় খানিকটা মুড়ি তুলে; তা'তে পেঁয়াজ, ছোলা, লঙ্কাকুচি দিয়ে; কয়েকটা ঠাণ্ডা আলুরচপ টুকরো করে তা'তে মিশিয়ে- কড়াইতে অল্প সর্ষের তেলে ফেলে সুট করে ভেজে নিলেন৷ তারপর স্টিলের প্লেটে ঢিপি সাজিয়ে আমাদের হাতে দিলেন৷ চুঁইচুঁই খিদের সঙ্গে ম্যাজিক-মেসোমশাইয়ের আন্তরিকতা মিশে যে কী দারুণ স্বাদের সৃষ্টি হয়েছিল৷ নিমেষে প্রথম প্লেট সাফ করে আমরা দ্বিতীয় প্লেট নিয়েছিলাম৷ দ্বিতীয় প্লেট উড়িয়ে দেওয়ার আগেই মেসোমশাই প্লাস্টিকের কাপে লেবুচা এগিয়ে দিলেন৷ না চাইতেই। মুড়ি-ভরা পেটে সে চায়ের কাপে এক চুমুক দিতেই মেজাজে জেল্লা ফিরে এলো। ভদ্রলোকের সঙ্গে আরও মিনিট দশেক গল্পগুজব করে আমরা এগিয়েছিলাম৷ আমার ধারণা সে'দিন ঝোল-ভাতের থালা পেলেও সেই স্পেশ্যাল মুড়িভাজা লেভেলের তৃপ্তি জোটাতে পারতাম না৷

সে মহাভোজের বছর পাঁচেক পর ফের সে রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় সে দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন শেষ-বিকেলে; শাস্ত্রে সে'টাকে বলে চপলগ্ন। কড়াইভর্তি তেলে আলুর চপ আর ফুলুরি ভেসে বেড়াচ্ছে আর এক বছর কুড়ি-বাইশের চটপটে ছোকরা ঝাঁঝরি দিয়ে তাদের খেলিয়ে খেলিয়ে তোলবার তাল করছে। দোকানের আসবাবে তেমন কোনও রদবদল হয়নি৷ শুধু ঘটঘটানো টেবিল ফ্যানটা হাওয়া, বদলে একটা ছোট মিনিমিনে সিলিং ফ্যান ঝুলেছে৷ আর একদিকের দেওয়ালে একটা তেলচিটে মালা ঝোলানো ছবিতে ম্যাজিক-মেসোমশাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।

কড়াই থেকে তুলে আনা আগুন আলুর চপে কামড় বসিয়েও সেই পুরনো অমৃতস্বাদ পাওয়া গেলনা৷ সে দোষ অবশ্য চপের নয়৷ অন্য যে কোনও জায়গায় ও চপ পেলে দশে সাড় নয় দেওয়া যেত নিশ্চিন্তে৷

স্যামপ্লিং



এই সাইজের স্টিলের প্লেট সাধারণত আড়ালে-আবডালে পড়ে থাকে৷ শৌখিন খাবারদাবার পরিবেশনের সময় এদের কদর বড় কম। তেমন কিন্তু এ'গুলো অবহেলার বস্তু নয় মোটেও৷ এ'দের মূলত দু'টো কাজ৷

এক, ব্যাকএন্ড৷ এ'গেলাস ও'পাত্রের টেম্পোরারি ঢাকনি হিসেবে৷

দুই, ফ্রন্ট এন্ড, আইকনিক ভূমিকা; স্যাম্পলিং প্লেট৷ রোব্বারের মাংসের ঝোলের কড়াই থেকে তুলে নেওয়া একটা সরেস পিস আর সামান্য ঝোল; সঙ্গে হাফ-হাতা পোলাও৷ স্যাম্পলিং চলে স্নানের আগে৷ স্নানের সময় গড়িয়ে যায়৷ নুন বেশি, ঝাল কম; এ'সব অভাব-অভিযোগের করেকশন চলে৷ অতএব প্লেট রিফিল হয়৷ রান্না নিখুঁত হলে রিফিলের গতি বেড়ে যায়৷ ফুচকা খাওয়ার স্ট্রাকচার আর ডিসিপ্লিন দিয়েই মাংস-পোলাও 'স্যাম্পলিং'। গুরুজনরা বলেছেন "সে'টাই হল Soul of Robbar"।

এরপর সে প্লেট চেটেপুটে সাফ করে, তেলতেলে আঙুল চাটতে চাটতে নিজের প্রিয় গামছার খোঁজে বারান্দায় ছুটে যাওয়া৷ লাঞ্চে দেরী করলে চলবে কেন?

আমার জানলা দিয়ে যায় না দেখা



- কী বুঝছ ভায়া৷

- অ..অদ্ভুত৷

- ভূতের মুখে অদ্ভুত শব্দটা কেমন লাগে যেন।

- বেঁচে থাকতেও আমি ভূতে বিশ্বাস করতাম বটে৷ কাজেই ফস্ করে মরে গিয়েও যখন দেখলাম পুরোপুরি হাপিস হয়ে যাইনি, তখন চমকে যাইনি৷ কিন্তু এই সারপ্রাইজটা তখনও এক্সপেক্ট করিনি অমলদা।

- আরে আমারও তো মরার পর সে' অবস্থাই হয়েছিল ভাই বিনোদ৷ ভূত হয়ে দেদার ঘুরব, টেনশন-ফেনশন থাকবে না ভেবে দিব্যি ছিলাম৷ ইচ্ছে ছিল মাঝেমধ্যে এর ওর পিলে চমকে দেওয়ার৷ অথচ দেখ কত হ্যাপা৷ এর চেয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা কম৷

- অনেক কম। এমন জানলে নিজের শরীরটার অনেক যত্ন নিতাম৷ হাবিজাবি খেতাম কম৷ নিয়মিত যোগব্যায়াম করতাম৷

- কিন্তু এ পাপ থেকে তো মুক্তি পেতে না৷ কয়েক বছর এ'দিক ও'দিক হত৷

- ব্যাপারটা এখনও কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে অমলদা৷ সত্যিই কি তাই?

- নতুন ভূতদের পুরনো ভূতরা গাইড করে দেয়৷ তোমাকেও ভালো মনে আমি বুঝিয়েপড়িয়ে নিচ্ছি৷ ঠকাব কেন বলো৷

- ছিঃ ছিঃ, আমি তা বলতে চাইনি৷ কিন্তু মানুষ মারা যাওয়ার পর তাদের ভূত টাইম ট্র্যাভেল করে জন্মের সময়ে ফিরে যায়, এমনটা কেমন যেন...কেমন যেন..।

- বিদঘুটে৷ তাই না?

- তাই তো।

- জন্ম থেকে মৃত্যু লূপে দেখে যেতে হবে৷ হাজার হাজার বছর ধরে৷ যদ্দিন না ডিভাইন সাইকেল ভেঙে গিয়ে মুক্তি পাচ্ছ৷ আমি সতেরো বার নিজের লাইফ রিওয়াইন্ড করে দেখে ফেললাম ভাই৷ এমন ভূতদেরও চিনি যারা বাহান্ন হাজারবার দেখেছে৷ আবার কেউ নাকি দু'তিনবার দেখেই মায়া কাটিয়ে হাওয়া হয়ে যায়৷ তারা অবিশ্যি মহাপ্রাণ৷

- মায়া?

- মায়া নয়? নিজের জীবনের প্রতি মুহূর্ত বারবার দেখতে পাওয়া৷ নিজের জন্ম, বেড়ে ওঠা, চোট-আঘাত-প্রেম-ভালোবাসা, দুঃখ, হতাশা, যন্ত্রণা, স্নেহ৷

- অমলদা, আমার জীবন বেশ বোরিং ছিল কিন্তু৷ প্রাইভেট ফার্মের ক্লার্ক৷ গতে বাঁধা সব কিছু৷ শেষবয়সে রোগেভোগে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার..।

- সেই ফেলে আসা রুটিনের মায়া এ'বারে টের পাবে৷ এ সিনেমা বার বার দেখেও সাধ মিটবে না৷ সবচেয়ে বড় কথা, এ সিনেমার নায়ক তুমি নিজেই৷ যা কিছু বোরিং মনে হয়েছে বেঁচে থাকতে, এখন দেখবে সে'গুলো কী দুরন্ত৷ যত দুঃখ বয়ে বেরিয়েছ, সে'গুলোকে এখন বারবার পোষা বেড়ালের মত আদর করতে ইচ্ছে করবে৷ দূর থেকে নিজের হতাশার মুহূর্তগুলোকে দেখে মনে হবে, "উফ, বাঁচার মত বেঁচে নিয়েছি বটে"৷ এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক ভাই বিনোদ।

- মিস্টিরিয়াস৷ কিছুই তো ছাই বুঝছি না৷ আচ্ছা, এই মাঝরাত্তিরে আমরা এই জানালাটার সামনে এসে দোল খাচ্ছি কেন? আমি কই?

- এ'টা হাসপাতালের জানালা বিনোদ৷ জানালার ও'পাশে তোমার মা শুয়ে৷ পাশে তোমার বাবা৷ ডাক্তাররাও আছেন৷ নার্সের কোলে তুমি৷

- ও'টাই...আমার মা? বাবা? ওরা আছে? ওদের দেখতে পাব? উফ অমলদা..।

- মায়া৷ মায়া৷ মনে রেখো, দেখা ছাড়া তোমার আর কোনও ভূমিকা নেই৷ আর যে'দিন দেখার ইচ্ছেটুকু যাবে, সে'দিন মুক্তি৷

***

ডাক্তার যখন খোকাকে সুতপার কোলে দিল, এক মুহূর্তের জন্য সুতপার মনে হলে রাতের জানালার বাইরে যেন কেউ আছে৷ তবে অন্যমনস্ক ভাবটা এক ধাক্কায় কেটে গেল, খোকা চিলচিৎকার জুড়েছে৷