Sunday, February 26, 2017

মিছরি আর সৈনিক

- তুমি এসেছো মিছরি?
- উপায় রাখলে কই? বেহায়া। বেওকুফ।
- বসো। বসো।
- কয়েদী মানুষের অত কথা বলতে নেই।
- কিছু খাবে?
- কয়েদখানায় তোমার মাথাটুকু ছাড়া খাওয়ার আর কী আছে বলবে?
- কোণে একটা কুঁজো রাখা আছে। ওই দ্যাখো, ওই দিকে। ইঁদারার জলের মত ঠাণ্ডা।
- আগে তোমার মাথাটুকু চিবিয়ে নিই, তারপর জল দিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলবো, কেমন?
- হেহ্। কেমন আছো গো মিছরি?
- সুখেই ছিলাম। সংসার। আত্মীয় পরিজন।  তারপর ওই ভূতে কিলোলো। শুনলাম তোমায় কাল ফাঁসি দেবে। যতই শত্রুপক্ষের সৈনিক হও, এককালে প্রেমিক ছিলে। লোকে দুর্নাম রটালে রটাক,ঝপাৎ করে চলে এলাম। তুমি কেমন আছ?
- দিব্যি।
- শহিদ শহিদ গন্ধ পাচ্ছ নিজের গা থেকে?
- ধুস। আমি ভালো অমলেট বানাতে পারি। শাড়ির কুঁচি ধরতে পারি। চট করে বানিয়ে গল্প বলতে পারি। বাথরুমে ক্লাসিকাল গাইতে পারি। লুডোতে দুর্দান্ত চুরি করতে পারি। শহিদ টহিদ হওয়া আমার কম্ম নয়। নেহাত জোর করে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে নিলে। নেহাত জোর করে যুদ্ধে পাঠালে। মন্দ কপাল, তাই ধরাও পড়ে গেলাম।
- ভাগ্যিস দেশ ছেড়ে তোমার হাতে নিজেকে সঁপে দিইনি গো, নইলে কাল আমায় বিধবা হতে হত।
- মিছরি...তুমি আসবে আমি ভাবিনি...।
- বিয়ে না হওয়া ঠিকই ছিল, কিন্তু তুমি থাকবে না..সে'টা ভাবতে পারছি না যে।
- ও সয়ে যাবে।
- আমাদের বিয়ে না হওয়াটা যেমন তোমার সয়ে গেছিল।
- দু'টো দেশে যুদ্ধ লেগে গেল, আর বিয়ে। মিছরি...বড় আশা করেছিলাম, খবর পেয়ে তুমি একবার আসবে।
- এলাম তো..এবার বলো।
- আমার বলার তো কিছু নেই। সৈনিক মানুষ। খুনোখুনিতে আছি। বলাবলিতে নেই। তুমি কিছু বলবে?
- তুমি আমার দেশের মানুষ মেরেছ?
- হুঁ।
- অনেক?
- অগুনতি। কতগুলো মেডেল পেয়েছি জানো?
- আমার ভাইটা মারা গেছে মাস খানেক আগে। ফ্রন্টে।
- তোমার ভাই? প্রদ্যুম্ন? সে তো কবি মানুষ। যুদ্ধে গেল কেন?
- শাড়ির কুঁচি ধরা যার কাজ, সে বর্ডারে গেছিল কেন?
- ওহ্। সে কদ্দিন আগে দেখেছি তাকে। তখন প্রদ্যুম্ন স্কুলে। এখন হয়তো তাকে দেখলেও চিনতে পারতাম না। কে জানে, ওর বুকে আমিই গুলি চালিয়েছি কিনা।
- কে জানে। হতেও পারে। যুদ্ধ তো দেশের সঙ্গে দেশের। সে'খানে কেউ মিছরির ভাই নয়, কেউ প্রেমিক নয়।
- সবাই সৈনিক, আর কেউ কেউ লাশ।
- তুমি আজ সৈনিক,  কাল লাশ।
- লাশ চুমু খেতে পারে না। সৈনিক বরং...।
- শত্তুরের মুখে বড় বড় কথা! দেব জল্লাদ লেলিয়ে?
- তোমাদের দেশের কোনও গান শোনাবে মিছরি?
- কাল আমাদের দেশের হাতে কোতল হবে, আজ তার গানের খোঁজ করছ?
- তোমার দেশ। তোমার খাটের কোণায় রাখা ডায়েরি, ঢাকনা খোলা কলম, চশমা। তোমার জানালার পর্দা এলোমেলো করা হাওয়া। তোমার মায়ের হারমোনিয়াম। তোমার বালিশের ওয়াড়ে চোখের জল। তোমার রান্নাঘরের স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। তোমার বারান্দায় বিরক্তিকর পায়চারী।  তোমার তুমিটুকু দলা পাকিয়ে রয়েছে মিছরি এ দেশে। আমায় হাজার বার ফায়ারিং স্কোয়্যাডের সামনে দাঁড়ালেও মন কেমন ঘুচবে না। ঘেন্না করতে বড় সাহস দরকার মিছরি।
- ভাইটার গায়ে অন্তত কুড়িটা বুলেট ছিল জানো। একজনকে মারতে ক'টা গুলি লাগে বলো তো?
- মিছরি। কেন এলে?
- ভালোবাসি। অবিকল সেই পুরনো দুপুরগুলোর মত। তখনও খুনোখুনি জানতো না কেউ। তবে, ভালোবাসা আর কীই বা পারে। কতটুকুই বা পারে। আমি ভালোবাসার দায়ে আসিনি গো।
- তবে?
- ক্ষমা করবে গো? তোমার বুকে ওরা গুলি চালানোর আগে মন থেকে ঘেন্না মুছে ফেলে ক্ষমা করতে পারবে এ দেশকে? যে দেশ তোমায় খুন করবে?
- মিছরি...।
- কথা দাও ক্ষমা করবে। তুমি ক্ষমা করলে তার পাপ একটু লাঘব হবে।
- কে মিছরি?
- ঠিক সাতমাস পর তার আসার কথা। তোমার মিছরির সন্তান। তার দেশকে ক্ষমা করে যাবে গো?
- তাঁকেও শাড়ির কুঁচি ধরতে শিখিও মিছরি।
- লুডোয় চুরিটাও দিব্যি শিখিয়ে দিতে পারব।
- হেহ্। কাল ভোর নটায় ঘটবে। তখন গান গেও, কেমন? তোমার দেশের ভালোবাসার গান। আমি গান গাইতে পারি না, আমি চিৎকার করে অমলেটের সিক্রেট একটা রেসিপি বলে যাবো'খন। বন্দুকবাজরা মন দিয়ে না শুনলে জব্বর ঠকবে।

Saturday, February 25, 2017

শ্যামল মিত্র ও অনুপবাবু

রাত দু'টো পাঁচ নাগাদ রেডিওটা আপনা থেকেই চালু হয়ে গেল।

শ্যামল মিত্রর কণ্ঠ যে কী সুরেলা।

"ঘুম যখন আসছেই না, তখন অত কেরদানি মেরে পাশবালিশ জড়িয়ে লাভ কী"?

শ্যামল মিত্র রেডিও থেকে জিজ্ঞেস করলেন। অনুপবাবু ঠাহর করতে পারছিলেন না ভূতটা শ্যামল মিত্রের না রেডিও।

"রেডিওদের মারা যাওয়ার ব্যাপার থাকে না ভাই"।
ফের। শ্যামল মিত্র।

এ'বার ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন অনুপবাবু।

"কোন গান শুনবে? ফিল্মের একটা দিয়েই শুরু করি"?

অনুপবাবু হ্যাঁ বা না বলার আগেই শুরু হয়ে গেল
"জীবন খাতার প্রতি পাতায়..."।

ভয়টা কমে আসছিল। শ্যামল অন্তরার দিকে যেতে তিনি পা বাড়ালেন রান্নাঘরের দিকে। এক কাপ কফির দরকার।

অমনি। গান থেমে গেল।

"এ কী! চললেন কোথায়? বসুন। আর দু'টো গাই"।

" নাহ, এক কাপ কফি হলে বেশ হত"।

"কফিতে কী হবে? আমি তো ভূত"।

"না সরি, ইয়ে, আমার জন্য"।

"বোঝো, কখনও শুনেছেন ভূতের কথা ভূত না হয়ে কেউ শুনতে পেরেছে"?

"আজ্ঞে"?

"বসুন না। আরে নার্ভাস হবেন না। মরে যাননি। রাতে শোয়ার আগে রোজ নিউজচ্যানেল শুনে ঘুমোতে যান তো। তাই নিজের অজান্তেই নিজের ভিতরেই ভূত জেনারেট করে বসে আছেন। সেই ভূতের সঙ্গেই দিব্যি কমিউনিকেট করতে পারছি। আরে বসুন। বসুন। আপনার কফি নয়, সঙ্গীত দরকার। বৈঠিয়ে জনাব, বৈঠিয়ে। এবারে একটা ক্লাসিকাল ধরি, কেমন"?

Friday, February 24, 2017

থরের ডর

হাতুড়িটা না পেলেই মন খারাপ হয়ে যায় থরবাবুর। ও'দিকে বনমালী নস্কর লেনে গিয়ে নিজের জিনিস চেয়ে ফেরত নিতেও হাজার ঝ্যামেলা, সে'সব ভাবলেই থরহরিকম্প। এ'দিকে প্রতি বছর এ সময় একবার করে হাতুড়ি গায়েব হবেই।

কিন্তু দেবতাদের অত লাজুক হলে চলে না। হাতুড়িটাই যে আই-কার্ড।  দিন কয়েকের মাথায় ফেরত না এলেই সে'খানে গিয়ে হত্যে দিতে হয়। এ'বারেও হলো। এ'বার সাহস করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন থর;

"বলছিলাম দাদা, চাদ্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পেপারওয়েট, তবুও আমার হাতুড়ির দিকে ফি'বছর নজর পড়ে কেন"?

সিগারেট ধোঁয়ার খান কয়েক রিং বাতাসে ভাসিয়ে উত্তর দিলেন ভদ্রলোক;
"জরুরী দরকারেই তোমার হাতুড়িটা সরিয়ে আনি ভাই। সব পেপারওয়েটে তো আর রাষ্ট্রনেতাদের গোপন চিঠি চাপা দেওয়া ঠিক নয়। এমনিতেই মেসের ফচকে ছেলেগুলোর কিউরিওসিটি প্রয়োজনের চেতে কিঞ্চিৎ বেশি"।

দেবতা হওয়ার আবার এই এক মুশকিল। অন্তর পড়ে ফেলা যায়।

ফস্ করে বলে ফেললেন থর;
"দাদা, ডিভোর্স যখন তোমাদের দু'জনেরই হয়ে গেছে, তখন তো এটাকে আর এক্সট্রাম্যারিটাল বলা যায় না। তা ছাড়া তোমার দেওয়া বন্যা ডাকনামটা তো ভালোই ছিল, লাবণ্য দিদিভাইকে অকারণ রাষ্ট্রনেতা বলে ডাকার কী মানে? প্রতি বসন্তে তুমি একটা চিঠি লিখবে, তার একটা উত্তর আসবে। ব্যাস। তাতে অত লুকোছাপা কেন? থরের হাতুড়ির পেপারওয়েট! বোঝো! মাঝখান থেকে হাতুড়ির অভাবে আমি হয়রান। আরে শেষের পরেই তো শুরু গুরু..."।

বেজার মুখে, হাতুড়ি হাতে, মাথায় একজোড়া গাঁট্টায় পয়দা হওয়া জোড়া আলু নিয়ে সেই মেসবাড়ি ছাড়লেন থর।

Wednesday, February 22, 2017

এক্সেল

দিব্যি মরে উঠে এলাম বডি ফেলে। হাতঘড়িতে এখন রাত পৌনে ন'টা। পঞ্জিকা অনুযায়ী ক্ষতি নেই। কিন্তু আমি রেডি থাকলেও ব্যাটাচ্ছেলে যমদূতের দেখা নেই।

মহামুশকিল। মারা যাওয়ার পর দেখছি ফ্রি ফোর-জি সিমের কনেকশনটাও কাজ করছে না। সে ব্যাটা যতক্ষণ উদয় না হচ্ছে ততক্ষন আমার ভেসে বেড়ানো ছাড়া কোনও কাজ নেই। আত্মার ওজন এতই কম যে পায়চারী করতে মাটিতে নামারও কোনও উপায় নেই।

আধ ঘণ্টার মাথায় যে বস্তুটির দেখা মিললো সে'টা একটা হাওয়ায় পতপত করে ওড়া এমএস-এক্সেল স্প্রেডশিট। সে ব্যাটা আবার কথা বলে।

"এসে গেছি", বলে গায়ের উপর এসে পড়লো সে।

"কেন? এসে কী হবে?"

"ভি-লুক আপ করে আপনার খোঁজ পেলাম। টাটকা মড়া। নিয়ে যেতে এসেছি"।

"হোয়াট ননসেন্স, শিংওলা যমদূত কই"?

"ও'সব তো গত সেঞ্চুরির ব্যাপার স্যার। চলুন। আর দেরী হলে নরকের এন্ট্র‍্যান্স বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আবার আপনাকে পিভট টেবিলে লুকিয়ে রাখতে হবে"।

"নরক? স্বর্গে শর্টলিস্ট হল না ভাই এক্সেল"?

"অত প্রমোশন প্রমোশন করলে স্বর্গ জোটনা স্যার। জিভে দেখুন। এখনও চেরী ব্লসম শু-পালিশের ছোপ লেগে আছে"।

" আই সী, নরক। বেশ, গেলেই হয়। আচ্ছা, সে'খানে আছে কী? গরম তেলের কড়াই? পাপীরা কনস্ট্যান্ট ডিপফ্রাইড হচ্ছে"?

"কড়াই ফড়াই এখন মিউজিয়ামে স্যার। নরকে এখন চারদিকে শুধু ল্যাপটপ ছড়ানো। আর সব পাপী সেখানে বসে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানাচ্ছে। দিন রাত। রাত দিন"।

"হোয়াট দ্য হেল, বলেন কী"?

"নরক দিনদিন টাফ হয়ে যাচ্ছে স্যার"।

"স্বর্গে তাহলে কী কেস ভাই এক্সেল"?

"মেঘলা বিকেলের বাবুঘাট স্যার। চিরমেঘলা। চিরবিকেল। সে'খানে সল্টেড বাদাম বিক্রি"।

"ওহ্"।

"ও'সব বেশি ভাববেন না স্যার। মনখারাপ হবে। তাও তো স্বর্গে আনলিমিটেড ফ্রি লেবুজলের কথা বলিইনি। যাক গে। আপনার কপালে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। চলুন এবার"।

"আর ভাই...চলো"।

Tuesday, February 21, 2017

পিতৃভাষা বনাম মাতৃভাষা

মাতৃভাষা। পিতৃভাষা নয় কিন্তু। আমাদের ভালোবাসা আবেগ সমস্তটুকু মাতৃভাষাকে ঘিরে।

পিতৃভাষা হলে সে ভাষার জন্য এমন প্রাণপাত করা সম্ভব হত না। পিতৃভাষা দিয়ে মাটি কোপানো যেতে পারত, মাথা ফাটানো যেতে পারত। কিন্তু সে ভাষাকে তুলিকলম ধারণ করে উঠতে পারত না।  

আর এই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে কেটে গেল এতগুলো বছর। তবে এদ্দিনে স্থির বুঝেছি যে ব্যাপারটা যদি মাতৃভাষার বদলে পিতৃভাষা হত, তাহলে একুশের ফেব্রুয়ারির দিনে কালো ব্যাজ লাগিয়ে ঘুরতে হত। 

তা, পিতৃভাষা হল না কেন? 

পরিস্থিতি ১ঃ
রোগা হয়ে গেছি। 

মা - 
"তোর অমানুষিক খাটনি যাচ্ছে রে। খাওয়াদাওয়াটা অবহেলা করিস না বাবা। আর দিনে এক গ্লাস করে দুধ খেতে তোর এত আপত্তি কীসের বল তো"?

বাবা-
"দিন দিন টিকিটব্ল্যাক করা চেহারা হয়ে যাচ্ছে তো রে ব্যাটা রাস্কেল"।


পরিস্থিতি ২ঃ
মোটা হয়ে গেছি।

মা-
"ছেলের আমার রাজপুত্রের মত চেহারা"। 

বাবা-
"তোর বোধ হয় আর হাইট বলে কিছু রইল না, না রে? শুধুই ডায়ামিটার"। 

পরিস্থিতি ৩ঃ
রেজাল্ট বেরিয়েছে। 

মা-
"নম্বর যা খুশি হোক, তুই মানুষের মত মানুষ হ খোকা"। 

বাবা- 
"হাফ ন্যাড়া করে ইলেক্ট্রিক পোলে টাঙিয়ে রাখা উচিৎ ব্যাটাচ্ছেলেকে। গরু যে কিনে দেব তারও উপায় নেই, গরুদের ইনসাল্ট হবে"। 

পরিস্থিতি ৪ঃ
ডান হাতের হাড় ভেঙ্গেছে।

মা-
*হাউ হাউ করে কান্না*

বাবা-
"কে বলেছিল মোটরসাইকেলে হাত দিতে? স্কাউন্ড্রেলটার বাঁ হাতের হাড় আমি ভাঙবো"। 

পরিস্থিতি ৫ঃ
জ্বর।

মা-
"মাথা ব্যথায় খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা? বাম লাগিয়ে দিই"?

বাবা-
"সামান্য টেম্পারেচারে এমন ছটফট? আমার কপালেই এমন নেদু একটা ছেলে জুটলো? ডিসগ্রেস্‌"। 

**

অতএব। 
মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি মাতৃভাষা। 

দোলে দো দুল

দিব্যি জনসন ইয়ারবাড দিয়ে টিটেবিলে রাখা কোস্টারের ওপরের কফির দাগ নিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছিলেন অমিয়বাবু। মনের মধ্যে অরেঞ্জ স্কোয়্যাশের মত একটা বেলেল্লা প্রশান্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো।

এমন সময় স্ফিঙ্ক্সের মত বিদঘুটে চেহারার একটা নারী প্রশ্ন দুলতে দুলতে চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো। "এই কানের দুলটা ভালো লাগছে না এইটা"?

সন্ধ্যের শিউলিতে কেউ চিলি সস্ ঢেলে দিল যেন।
চাঁদে নামতেই যেন আর্মস্টংয়ের সামনে জ্যোতিষশ্রেষ্ঠ গুণময় লাহিড়ী এসে দাঁড়ালেন।
চন্দননগরের বদলে মগরায় এসে ট্রেনঘুম ভাঙলো যেন।

দুল?
দুল?
আচমকা অমিয়বাবুর মাথার স্ক্রুগুলো মচরমচর করে উঠলো।
দুল।
কানের দুল।

পাঁচ সেকেন্ড দোলে দো দুল দোলে দুলোনা গাইলেন অমিয়বাবু। অবশ্যই মনে মনে। পান সকলের পাতে দেওয়া চলে না। দুলে দোল খাওয়া বৌকে তো নয়ই।

দুল তাঁর জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?  মনে মনে চট করে সাতাত্তর হাজার পাঁচশো বিরানব্বইটা দরকারি জিনিসের কথা মনে পড়লো অমিয়বাবুর। সে লিস্টে দুল ছিল না।

ভালো দুল খারাপ দুল?
বলিভিয়ায় আমসত্ত্ব পাওয়া যায় কিনা তার চেয়ে বেশি দরকারি প্রশ্ন।
তিমি মাছের গাদা পেটির টেস্ট আলাদা কিনা তার চেয়ে জরুরী প্রশ্ন।
কলমিশাক দিয়ে বাটার নান কেমন লাগবে জেনে তাও মানুষের সামান্য উপকার হতে পারে।
কিন্তু দুল?
মন কেমন হয়ে আসে অমিয়বাবুর। কই, কেউ তো এসে শুধোলো না ডাবল এগ চিকেন রোল নাকি স্পেশ্যাল মাটন রোল?

যা হোক্। এড়িয়ে গেলে চলবে না। পাশ কাটালে চলবে না। গতকালই বাজার গিয়ে কিছু একটা আনতে ভুলে গেছিলেন ভদ্রলোক। কী ভুলেছিলেন, সে'টা আজও মনে পড়েনি অবশ্য। তবে মরমে মরে রয়েছেন। আজকের ভুলের ছুঁচ আজ থেকে বাইশ বছর পর ফলা হয়ে ঢুকতে পারে। ঢুকবেও।

এখন হাতে একটা সুযোগ এসেছে দুলের চয়েসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আনার।

সোফায় সোজা হয়ে বসলেন অমিয় সামন্ত।

"কই দেখি"! দুল দেখে কেন, চিবিয়ে খেয়েও তার ভালোমন্দ বিচার করার দম নেই অমিয়বাবুর। তবু। এ'টা হচ্ছে টিমস্পিরিট জাহির করা।

"আরেকটু কাছে এসো, ভালো করে দেখি"। খাটাখাটনি করে জলের খুব কাছে গেলে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের অ্যাটম আলাদা করে ঠাহর করা যেতে পারে হয়তো। তাই বলে দুল?

কিন্তু ডিসিশিন একটা দিতেই হবে। আবার দায়সারা হলে চলবে না।

"ডানদিকেরটায় একটা বেশ দারুণ ইয়ে আছে বুঝলে, কিন্তু তোমায় বাঁদিকেরটাই বেশি স্যুট করছে। মানে বাঁদিকেরটাতেই তোমার যে ইনহেরেন্ট ইয়ে, সে'টা বেশি এক্সপ্রসড হচ্ছে"।

ইয়ে। ইয়ের মত মজবুত শব্দ আর হয় না। ফ্লোটারের মত ব্যবহার করা যায়। রামের পিঠে, রাবণের ল্যাজে; সর্বত্র ইয়ে বসে আর উতরে যায়।

বাঁদিকের দুল। কেমন একটা গুয়েভারা গোছের ফ্লেভার আছে। বলেও তৃপ্তি পেলেন অমিয়বাবু। আর তক্ষুনি সাইকেলের আড়াল থেকে ফায়ার করা মিঠুন চোক্কোত্তির ছোঁড়া পিস্তলের গুলিতে ঘায়েল হলেন তিনি।

"আমার বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া যে কোনও জিনিসের প্রতি তোমার বরাবরই চরম অনীহা। ওরা তোমার কোন ক্ষতিটা করেছে বলতে পারো"?

বুকের ভিতর একটা প্রকাণ্ড "যাহ্চ্চলে" বয়ে গেল অমিয়বাবুর। কীসের দুল, কীসের ডান বাঁ। চারদিকে অন্ধকার, ধুলোঝড়।

"আসলে এ ঘরের টিউবলাইটই হয়েছে যাবতীয় গড়বড়ের কারণ, তোমার মুখের ডান দিক তো এক্কেবারে অন্ধকারে। আমি কালই সিএফেল লাগানোর ব্যবস্থা করছি। এ'দিকে এসো। এই এ'দিকে। এইবার। এইবার দেখতে পাচ্ছি। স্পষ্ট। ডান দিকের দুলের কারিগরির ফিনেস্ দেখেছ? এর ইয়েই আলাদা। বাঁদিকের দুলটা ইমপ্রেসিভ, নো ডাউট। কিন্তু তোমার মায়ের দেওয়া দুলটা তোমার এই কাঞ্জিভরমটাকে যা কমপ্লিমেন্ট করছে না! জাস্ট মার্ভেলাস। মাই ভোট গোজ্ টু ডানদিকের দুল"।

শাড়িটা কাঞ্জিভরম ছিল না।
অমিয়বাবুর ঘাড়ে এক্সট্রা মাথা ছিল না।

Sunday, February 19, 2017

আমার সেলুন

পুরুষ জীবন কম জটিল নয়। 
হুড়ুম করে যা-নয়-তাই ভেবে, দুড়ুম করে যা-নয়-তাই করে ফেলে আমাদের জীবন গুজরান হয়ে যায়, এমন সেক্সিস্ট আইডিয়া থেকে এবার বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। কমপ্লেক্সিটির সঙ্গে আমাদেরও অনবরত কুস্তি চলে। 

পুরুষ জীবনের জটিলতম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চুল কাটার সেলুন বেছে নেওয়া। এই একটা ডিসিশনে পালটে দিতে পারে সমাজবোধ, জীবনদর্শন। সেলুন চিন্তায় ওম দেয়, ভাবনায় রঙ দেয়, অবসরে কেত দেয়। দেয়। এই পাওয়াগুলো চিনে নিতে পারা দরকারি। জরুরী। 

কথায় আছে সৎসঙ্গে আর মনের মত  সেলুনে স্বর্গবাস, 
অসৎ সঙ্গ আর বিদঘুটে সেলুনে সর্বনাশ।  

সেলুন বেছে নেওয়ায় কোনও থিওরি নেই, অঙ্ক নেই, লিনিয়ার ইকুয়েশন নেই। পুরোপুরি ইন্সটিঙ্কটের খেলা। নচিকেতা ভালোবাসাকে পিটুইটারির খেলা বলে ঠেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু পিটুইটারি দেড় মাস রাত জেগে পড়াশোনা করেও সেলুন বেছে নিতে পারবে না। পুরুষ মাত্রই সেলুন-কবি। 

জীবনে বহুবার এই কঠিন সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যখনই বাবার চাকরী, নিজের পড়াশোনা বা নিজের চাকরীর টানে নতুন জায়গায় গিয়ে থিতিয়ে বসতে হয়েছে, সবার আগে খুঁজে নিতে হয়েছে নিজের পছন্দের হেয়ার কাটিং সেলুন। একজন কী'ভাবে নিজের পছন্দের সেলুন বেছে নেয়, সে'টা নিয়ে সামগ্রিক ভাবে থিওরাইজ করা সম্ভব নয়। তবে নিজের ভালোলাগাগুলোর একটা লিস্ট করা যেতেই পারে। 

১। সেলুনের রেট চার্ট আর মানিব্যাগের ওজনের সঙ্গে যে একদম কনেকশন নেই তা নয়। তবে সেই যোগাযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। যারা এই সরল হিসেবে সেলুন বেছে নিয়েছেন বাকি সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বাদ দিয়ে, তাঁদের জীবনে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই। 

২। সেলুনে বরাবর কাঁচির আগে গান খুঁজেছি। রেডিও নির্ভরতা নয়। একটা ছোট স্পীকার। তা'তে পছন্দের মত গান। একের পর এক। যে কোন পছন্দের গান নয়। হেমন্তবাবুর গানে সেলুন বিবর্ণ মনে হয়। মান্নাদের বাংলা গান বাজানো সেলুন ঠিক অরে জুলপি সেট করতে পারে না। বড্ড বেশি নতুন হিন্দী গানে সেলুনের আবহ বেলুনে খোঁচা পড়ে। সেলুন সেলুনিত হয় নব্বইয়া,নাদিমশ্রবণযতিনললিতাইজ্‌ড কুমার শানু-উদিত নারায়ণ-অলকা যাগ্নিকে। 
ইস তরহ আশিকি কা অসর ছোড় যায়ুঙ্গা, 
ইস তরহ আশিকি কা অসর ছোড় যায়ুঙ্গা
তেরে চেহরে পে অপনি নজর ছোড় যায়ুঙ্গা।
এ ধরণের গানে কাঁচির মিহি কুচকুচ এক ধরণের অনির্বচনীয় সিম্ফনি তৈরি করে। 
চুল কাটা অত্যন্ত কোদালে ব্যাপার, হাফ ইঞ্চি এদিক ওদিকে মহাভারতের পাতায় আলপিনের খোঁচাও লাগে না। কিন্তু সঠিক সুরে কাঁচি না চললে সে বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়। হয় ভাই, হয়। 

৩। গল্প। প্রত্যেক সেলুনে চুলকাটনেওলা আর নিয়মিত চুলকাটানেওলার গল্পের একটা স্রোত রয়েছে। সেই স্রোতে আমি কতটা গা ভাসাতে পারব, তার সঙ্গে সেলুন চয়নের গভীর সম্পর্ক। 'আসুন বসুন ছোট করে কাটব, না বড়, না মিডিয়াম'; এ'টুকুতে সেলুনের আভ্যন্তরীণ কথাবার্তা ফুরিয়ে গেলে সে সেলুনে চুল খরচ করার কোনও মানে হয় না। পাড়া পলিটিক্সের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খবরের উৎস হবে সেলুন। আড়াই কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে সমস্ত বিয়েবাড়ির মেনু থেকে এস এস সির রেজাল্ট, সমস্ত সার্কুলেট হবে সেলুনের দু'টো চেয়ার আর দেড়টা বেঞ্চকে ঘিরে। 

৪। সেলুনে টিভি বড় ক্ষতিকারক। চুলকাটিয়ের চোখ যায়। লাইন লেন্থ বিগড়ানো বোলার আর নজর হঠে যাওয়া চুলকাটিয়ে অত্যন্ত খতরনাক। তাছাড়া টিভির গোলমালে চুলকাটানেওলা আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলে জরুরী অ্যাঙ্গেল নষ্ট করে। সেলুনের ডাব সরবতে চোনা হল টিভি। 

৫। ফাউ ফুচকার মোহের চেয়ে হাজারগুণ ওজনদার মোহ হচ্ছে চুল কাটার পরের চুল ঝাড়া ফাউ মাসাজ। দু'হাতের আটটা আঙুলের ডগা আর অল্প তালু মিশিয়ে তিরিশ সেকেন্ডের যে স্নেহপ্রবাহ, যে গালিবি ভালোবাসা; সে'টুকু জরুরী। যে'খানে এই ফাউ নেই, সে সেলুন আমার নয়। 

৬। পুরনো আনন্দলোকের স্তূপ। গার্জেনরা যে বয়সে নবকল্লোলের দিকে তাকালে তিরস্কার করতেন, সে বয়সেই পাড়ার সেলুন আমায় আনন্দলোক চিনিয়েছিল। সে সময় রোববার ছাড়া সেলুনে যেতাম না। কারণ রোববারের ভিড়। লাইন দিয়ে বসে থাকা ঘণ্টা খানেক আর গপাগপ আনন্দলোক গিলে যাওয়া। আহা। সে'সব দিন। ইন্টারনেট বাজি উলটে দিলেও, স্মৃতির আঁচল পাকিয়ে আজও কান খুঁচিয়ে চলেছি। যে সেলুন আনন্দলোকের পুরনো সংখ্যা জমিয়ে রাখবে, তারা বোনাস নম্বর পাবে। 

৭। চুলকাটনেওলার তাড়াহুড়ো থাকবে না কোনও। শিল্পীর হুড়মুড় থাকলে চলে না। পিকাসো ট্রেডমিলে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতেন না। বাৎস্যায়ন ঘড়ি ধরে চুমু খেতে বলেননি। চুল কাটা হবে ধীরে সুস্থে। কাঁচির কুচ্‌কুচ্‌ শব্দে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসবে, মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে শিউলি। ভালোবাসা তৈরি হবে। চুলকাটানেওলার মনে অবিশ্বাস থাকবে না কোনও, আধোঘুমে কেটে যাবে মিনিট কুড়ি। তারপর ঝিমুনি কেটে গেলে আয়নার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে চেয়ার ছাড়া। চুলকাটনেওলা ব্যাটসম্যান, চুলকাটানেওলা ননস্ট্রাইকার। মিডঅফে বলে ঠেলে চুলকাটনেওলা ছুটবেন। ব্যাটসম্যান্‌স কল। ননস্ট্রাইকার হিসেবে আমার কাজটুকু হল গা ভাসিয়ে দেওয়ার। 

৮। চুলকাটনেওলার স্মৃতিশক্তি ব্যাপারটা ক্রিটিকাল। প্রত্যেকবার গিয়ে চুলের স্পেসিফিকেশন লিস্ট করে বলা বেশ খাটনির কাজ। চোখে চোখে কথা হবে। গোটা বছর এক ছাঁট, পুজোর মরসুম বা বিয়েবাড়ির সিজনের আগে অন্য। সে জানবে। সে বুঝবে। ডাক্তারকে রুগীর নাড়ীনক্ষত্র জানতে হয়। চুলকাটনেওলাকেও জানতে হয়। চিনতে হয়। পাল্‌স বুঝতে হয়। 

নতুন পাড়ায় এসেছি প্রায় এক বছর হতে চললো। মনের মত সেলুন খুঁজে পেতে লেগে গেল এতগুলো দিন। স্রেফ গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান বা পাড়ার ক্লাবের মেম্বারশিপ দিয়ে পুরুষ হৃদয়কে নতুন পাড়ায় স্থাপন করা যায় না। সেলুনের আশ্বাস ছাড়া পুরুষহৃদয় আশ্রয় খুঁজে পায় না, পেতে পারে না। 

Saturday, February 18, 2017

দিবাকর আর সেই মেয়েটা

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সজাগ হয়ে উঠছিল দিবাকর।  আশপাশের খুচরো শব্দগুলো কানে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এমনিতে গলিটা নিরিবিলি।  মাঝেমধ্যে শুধু রিক্সার ক্যাঁচোরকোঁচর, সাইকেল বেলের ক্রিং কিরং, পথচলতি চপ্পলের চটরফটর বা জুতোর মিয়ানো মচমচ।

হাওড়ার দিকের বিড়িতে স্বাদ আছে, দিবাকর চার প্যাকেট কিনেছিল। সেই একটা ধরিয়ে ল্যাম্পপোস্ট ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। সময় হয় এসেছে।

মনের আঁকুপাঁকু ভাবটা ক্রমশ বেড়ে চলেছিল। ভরদুপুরে সেলুন বন্ধ করে চলে আসাটা পাগলামি হয়ে গেল বোধ হয়। ব্যাপারটা এমনই বিদঘুটে যে অন্য কাউকে বলার সাহস পর্যন্ত হয়নি। অবিশ্যি এমনটা না ঘটাই স্বাভাবিক। স্বপ্নাদেশ-ফেশ লোকে পায় শুনেছে, কিন্তু স্বপ্নে পাওয়া প্রেমিকা মাটি ফুঁড়ে উঠে আসবে, এমন গড়বড়ে ব্যাপার হয়নি আগে। আজও হবে না বলেই দিবাকরের বিশ্বাস। তবু, না এসে থাকা গেল না।

অবশ্য, প্রেমিকা ঠিক না। পরিচিতা।  প্রেম প্রেম ভাবটা একান্তই দিবাকরের নিজের মনের মধ্যে। আর হবে নাই বা কেন। ও চোখ জোড়ায় দিব্যি কুয়োর বালতি নামানো যায়। ওই হাসিতে চমনবাহার খাওয়ার পর এক চুমুক জলের হুসহাস ঠাণ্ডা। গত বছর দশেক ধরে নিয়মিত স্বপ্নে দেখা হচ্ছে। নানান গল্প হচ্ছে।

ঝপাৎ করে দেখে যোগিনী টোগিনী মনে হয়। গেরুয়া পোশাক। তবে স্কিনের যা গ্লো, শেহনাজের গোল্ড ফেসিয়াল হপ্তায় একবার না করলে ও চমক আসবে না।

এই মনকেমন ব্যাপারটা অবিশ্যি ওয়ান সাইডেড। মেয়েটি এমনভাবে 'ভাইটি' বলে ডাকে যে বুকের মধ্যে বোলতা কামড়ে ওঠে যেন। যাক গে, এটুকুই বা মন্দ কী। প্রতি রাতে সে স্বপ্নে আসে। কথা হয়।

মেয়েটা বলে দিবাকরও রোজ তার স্বপ্নে আসে।
দিবাকরের মনে হয় দু'জনে দু'জনের স্বপ্নে আসে। এত দিন হয়ে গেল তবু মেয়েটার নাম জানা হলো না। অথচ কত কথা হয় রোজ রাত্রে।

মেয়েটা বড় ভালো। বড্ড ভালো। মেয়েটার মধ্যে কত কষ্ট, কত মায়া। যেটুকু আভাস পেয়েছে দিবাকর, মেয়েটা সম্ভবত ডিভোর্সি। দু'টো ছেলেও আছে। একা দু'টো ছেলেকে মানুষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। দিবাকরের একার গেরস্থালী চালাতেই নাভিশ্বাস উঠে যায় আর সে বেচারির মাথায় না জানি কতশত চিন্তা।

আর কত ভালো ভালো গল্প। ঘাসফুল, শ্যাওলার দাগ, ভোরের পুকুরপাড়,  আলপথ, আলপনা, আমের গন্ধ...।

এমনই গল্পে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল।
রাতের পর রাত।
স্বপ্নের পর স্বপ্ন।
আলোয় আলো।
বাতাসে তুলোর রোঁয়ার মত নরম ভালোলাগা।

গতকাল রাতের স্বপ্নে মেয়েটা আচমকাই বললে যে সে আসছে। সে নাকি স্বপ্ন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে দিবাকরের জগতে। বিকেলবেলা। দিবাকর যেন একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বিকেলটা অপেক্ষা করে, সে পৌঁছে যাবে। কী ভাবে সে আসবে সে'টা জানার আগেই অবিশ্যি স্বপ্ন ভেঙে যায় রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ছুঁচোর উপদ্রবে বাসন গড়িয়ে পড়ার শব্দে।

স্বপ্নের কথাকে বড্ড বেশি বিশ্বাস করা ফেলা হয়ে গেছে কি? এই ভাবনা নিয়ে খানিক জাবর কাটার সময়ই ঘটল ব্যাপারটা, এই বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ। গলিটা তখন বেশ খালি।

মেয়েটা দুম করে এসে পড়লো। দুম করে। সত্যি দুম করে। সত্যি বলতে কী, মাটি ফুঁড়ে। দিবাকরের ইচ্ছে করছিল চোখ রগড়ে নিতে।
অবিকল সে মেয়েটা। সেই চোখজোড়া। তা'তে জল। সে হাসিতে আরও কান্না।

আজ ওর পরনে কেমন যাত্রা মার্কা জবড়জং শাড়ি। গা ভরা গয়না, যাত্রাপালার মতই। যাক গে। এগিয়ে গেল দিবাকর। সে চিনতে পেরেছে, স্পষ্ট। ওর চাউনি বলে দিচ্ছে সেও চিনেছে দিবাকরকে।

কাছে যেতে ভেঙে পড়ল মেয়েটা।

"আর অপমান সহ্য হল না। আর না। চলে এলাম। ও জগৎ ছেড়ে চলে এলাম। সে'খানে আমায় বাঁচতে দিল না গো ওরা। ছিঁড়েখুঁড়ে খেলো আমায়। ছেলে দু'টো মানুষ হয়েছে, আমার আর সে'খানে থেকে কাজ নেই। চলে এলাম। আমায় কাদা না মেখে বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পার ভাই"?

কারা অপমান করেছে, কারা ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে চেয়েছে সে'সব জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না দিবাকরের। আহা রে, মেয়েটার কী কষ্ট। একটা রিক্সা ডেকে এবার বাড়ি ফেরা। বাড়িতে মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে একবার বাজারে আসতে হবে, একটা ছোট দেখে রুই যদি পাওয়া যায়।

রিক্সায় উঠেও মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না। এক জায়গা ফেলে এসেছে, আর ফিরে যেতে চায় না। নামটাও না হয় নতুন দেওয়া যাবে। সবিতা? বিপাশা? দেওয়া যাবে কিছু একটা।

কিছু কথা বলতেই হয়, তাই ঝপ করে ওর দুই ছেলের নাম জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল দিবাকর।

শহুরে জঞ্জাট উপচানো এক চোখ কান্না আর মায়া নিয়ে উত্তর দিয়েছিল মেয়েটা;

"লব আর কুশ"।

Friday, February 17, 2017

মাঝরাতের ট্রেন

- কদ্দূর?
- চুঁচুড়া। আপনি?
- ভদ্রেশ্বর।
- হুঁ।
- যাক, কামরায় একা নই। এ'টাই নিশ্চিন্দি।
- এত রাত্রে লোকাল আছে সে'টাই জানতাম না।
- আমিও। ধরেই নিয়েছিলাম ভোর চারটে নাগাদ যে ব্যান্ডেলটা আছে সে'টা ধরেই...। আচমকা অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে উঠে বসলাম।
- আমিও তো ইক্যুয়ালি সারপ্রাইজড। একটা বিয়েবাড়ি অ্যাটেন্ড করতে গিয়ে এই হ্যারাসমেন্ট। ভাবতেই পারিনি এতটা দেরী হবে। আচ্ছা, কামরায় একটা বোঁটকা মাছের গন্ধ আছে না?
- ভেন্ডরদের কামরায় না উঠে কোনও মাছওলা এখানে উঠেছিল হয়তো। ডিসিপ্লিন ওয়াইজ তো দেশটা ডকে উঠছে।
- ডিসিপ্লিন? হুঁহ্, রুলিং পার্টি যদি এমন অপদার্থ হয়, তাহলে ইনডিসিপ্লিন তো ছড়িয়ে পড়বেই। চাদ্দিকে তো এলোমেলা করে খাবলে খাই টেন্ডেন্সি।
- এই আপনাদের এক দোষ। রুলিং পার্টি চাবকে নিজেদের রেস্পন্সিবিলিটি এড়িয়ে যাওয়া।
- আপনি কি ওদের দালাল নাকি?
- আমি দালাল কি না জানি না। তবে আপনি যে অপোজিশনের পা চাটা সে'টা স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
- কী? আমি পা চাটা?
- আমি দালাল?
- নেহাত এত রাত তাই, নাহলে আপনার কলার ছিঁড়ে নিতাম।
- অপোজিশনের মতই গুণ্ডাবাজি ভাষা দেখছি আপনার। চাইলে এখুনি আপনাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতাম। নেহাত রাত গভীর, আর আপনি সিনিয়র...।
- ওরে আমার কালচারাল খুড়ো এলেন হে।
- মাছের গন্ধটা গায়েব হয়েছে, সে'টা টের পাচ্ছেন কি?
- তাই তো। স্ট্রেঞ্জ।

**

- রাত তিনটের ফাঁকা ট্রেন। মাত্র দু'জন বোকাপাঁঠা মানুষ।  তাও তুই ভয় দেখাতে পারলি না?
- বাবা, আমি গেছিলাম তো ভয় দেখাতে। এক্কেবারে ফার্স্ট কামরায়।
- উদ্ধার করেছ। গেছিলি যখন পালিয়ে এলি কেন ভয় না দেখিয়ে? রাস্কেল!
- ইয়ে, ভয় দেখানোর আগেই...।
- ভয় দেখানোর আগেই?
- ভয় দেখানোর আগেই আমি...।
- কী?
- ভয় দেখানোর আগেই আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম বাবা।
- কী?
- ভয়!
- ভয়? ভূতের বাচ্চা হয়ে তুই মানুষের ভয় পেয়েছিস? হোয়াট?
- দিব্যি ঝাঁপানোর জন্য রেডী হচ্ছিলাম মাইরি,আচমকা দু'জনে রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া আরম্ভ করল। আমি এমন ভয় পেয়ে গেলাম যে...।
- কী নিয়ে ঝগড়া?
- পলিটিক্স নিয়ে। মানুষের ঝগড়া।
- আঁ আঁ..আঁ...।
- ও কী বাবা, গোঙাচ্ছ কেন? কী হল? অমন ছটফট করছ কেন বাবা?