Showing posts with label মুম্বই. Show all posts
Showing posts with label মুম্বই. Show all posts

Sunday, June 1, 2025

জুহু হন্টন



জুহু চৌপাটির বীচে নামা মানেই ভিড় আর বেশ খানিকটা জঞ্জাল। তবে আধমাইল মত হাঁটতে পারলেই (নভোটেল ছাড়িয়ে) ভিড় পাতলা হয়ে আসে, বীচটাও ও'দিকে খানিকটা চওড়া। আরও এগিয়ে গেলে বেশ নিরিবিলি। পা ছড়িয়ে বসা যায়, জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঢেউ-থেরাপিও নেওয়া যায়, অথবা স্রেফ হেঁটে এগিয়ে যাওয়া। রাতের দিকে রোদ্দুরের হ্যাপা নেই, আর নেই মিষ্টি হাওয়ার অভাব। আজ বৃষ্টি না থাকলেও ও'দিকের সমুদ্রের হাওয়ায় দিব্যি জোলো ভাব। অতএব সে' এলাকায় হাফপ্যান্ট মেজাজে মিনিট চল্লিশ হাঁটার ইম্প্যাক্ট সেলুনের চেয়ারে বসে নবরত্ন তেলমালিশ করানোর সমান।

রাত সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার সেরেই বেরিয়েছিলাম, অতএব খাবারদাবারের স্টলে সময় নষ্ট করতে হয়নি। শুধু বাড়ির পাশের পার্কের বদলে আরবসাগরের পাশে হাঁটা। পার্কে হাঁটলে কানে ইয়ারফোনের দরকার পড়ে, সমুদ্রের পাশে সে'সবের দরকার পড়ে না। ফেরার আগে চৌপাটির উল্টোদিকের পানের দোকান থেকে হাইক্লাস কলকাত্তা মিঠা মুখে না দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আর বাড়ি ফেরার পথে চারবাংলোর বাজার হয়ে আসা, সে'খান থেকে সামান্য বেলফুল না কিনলেই নয়। একা সমুদ্রদর্শন সেরে বাড়ি ফিরলে সামান্য ঘুষ দেওয়ার দরকার তো পড়বেই।

দ্য গ্রেট মুম্বই সিক্রেট



মুম্বই বড়াপাউরুটি নিয়ে উপন্যাস-কবিতা লিখবে, ট্রেনের ভিড় নিয়ে স্পিরিট বিষয়ক লেকচার দেবে, তবু নিজের তুরুপের তাসটা সচরাচর বের করবে না: একটা আস্ত সমুদ্র। রোব্বারে রাস্তায় জ্যাম নেই, মানুষ তাড়াহুড়ায় তালগোল পাকিয়ে হদ্দ হচ্ছে না, সেই সুযোগে সকালে গিয়ে যে কোনো বীচে গিয়ে দাঁড়ালেই মনে হয় দু'দণ্ড বসি, গুনগুনিয়ে গান গাই (ঢেউ ভাঙার শব্দের সে অ-সুর অন্য কারুর কানে পৌঁছবে না), ধীরে সুস্থে হাঁটাহাঁটি করি, সামান্য জিরিয়ে নিই।

অফিস-বাড়ির কাজে এ সমস্ত কিছুতে পেষাই হওয়ার ফাঁকে হপ্তায় একদিন আরবসাগর সুরসিক গপ্পিয়ে গাইয়ে মেজমামার মত মাদুর পেতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছে। সেই শেল্টার ক'টা তাবড় শহরে মেলে? অথচ এই বিশাল ব্যাপারটাকে একটা তাবড় ট্রেডসিক্রেটের মত চেপেচুপে রাখাটাই এ শহরের 'রিলিজিয়ন'।

ব্যান্ডস্ট্যান্ডের চিঠি



ব্যান্ডস্ট্যান্ডের সিঁড়িগুলো বেয়ে নেমে এসে একটা জুতসই পাথর বেছে নিয়ে ছড়িয়ে বসলেন অমিতাভ। ঢেউগুলো খানিকটা দূরেই ভেঙে যাচ্ছে, জলের ছিঁটে আসছে না বটে কিন্তু মোলায়েম শব্দ আর হাওয়া মিলেমিশে একটা ভালো ইয়ে তৈরি হচ্ছে। ইয়ে শব্দটা মাঝেমধ্যেই ব্যবহার করেন অমিতাভ; শব্দটা ভারি কাজের; "এফিশিয়েন্ট"।

ইয়ে প্রসঙ্গে অমিতাভর মনে পড়লো বুক পকেটে রাখা চিঠি। চিঠি, এই শব্দটাই আজকাল কত কম ব্যবহার হয়। বুক পকেটে হাত রাখলেন ভদ্রলোক, সুতির ও'পাশে কাগজ। নরম অথচ খসখসে, বেশ একটা ইয়ের ব্যাপার। ভালো লাগাটাকে পাত্তা দিয়ে ঠ্যাঙজোড়া সামান্য লম্বা করলেন তিনি। হাওয়া উড়তে থাকা চুলে আঙুল চালালেন। চেষ্টা করলেন তপন সিনহার নির্দেশনার ফিল্টারে নিজেকে নায়ক হিসেবে ভাবতে। ইয়েটা জমাট হলো।

অমিতাভ মনে মনে হিসেবে করার চেষ্টা করলেন, ঠিক এই মুহূর্তে ক'জন চিঠি পকেটে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে? এই মুহূর্তের পৃথিবীতে ঠিক সেই মানুষগুলো অমিতাভর আত্মীয়। নাহ, সমুদ্রের মধ্যেই একটা বিশ্রীভাবে ভালোলাগা ইয়ে আছে।

সাইকেল থেরাপি



ডেকাথেলন থেকে কেনা সাইকেলটার বয়স প্রায় এক বছর হতে চললো। দিব্যি চলছে। একটা ফ্রি সার্ভিসিং পাওনা ছিল, দিন দুই আগে করিয়ে আনলাম। তা'তে ব্যাপারটা আরও স্মুদ হয়েছে। আমাদের সাইকেলের ব্যবহার ঠিক ফিটনেস এন্থুসিয়াস্ট হিসেবে নয়। বাবা ও'টা চালিয়ে রোজ রীতিমতো বাজারঘাট ঘুরে আসে, পঁচাত্তর বছর বয়সে অবশ্য সে'টাকে জিম হিসেবে ধরে নেওয়া উচিৎ । ছুটির দিন সকালে বা অফিস থেকে ফিরে সন্ধের দিকে আমি মাঝেমাঝে সাইকেল নিয়ে বেরোই, স্রেফ হাওয়া খেতে। ঢিকিরঢিকির স্পীডে ধীরেসুস্থে প্যাডেল করি যাতে ঘামটাম ঝরে না, দু'চার কিলোমিটার দূরেই আরবসাগর, অতএব রাতের দিকে সমুদ্রের হাওয়া টেরো পাওয়া যায়। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা তুলনামূলকভাবে নিরিবিলি রাস্তা রয়েছে, নিশ্চিন্তে সাইকেল চালানোর চার কিলোমিটার। সে'টার খান দুই পাক খাওয়া মানে মেজাজ ফুরফুরে।

হাঁটতে গেলে কানে ইয়ারফোনে গোঁজা থাকে।সাইকেলে সে'সব চলে না। সমস্ত ফোকাস রাস্তায়, শোঁশোঁ বেরিয়ে যাওয়া মোটোরসাইকেল গাড়িদের স্পীডে ভড়কে গেলেও চলবে না। পান দোকানে দাঁড়ানো যেতে পারে, কেনা যেতে পারে আইস্ক্রিম; কিন্তু সাইকেল ব্যাপারটা এতই মনোরম যে দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না। সাইকেলটা এমনিতে মাখন, কিন্তু সেই মাখন সাইকেলেও প্যাডেল আর চাকার ঘষটানি মেশানো একটা আরামদায়ক মোলায়েম শব্দ আছে, যে'টা পা বেয়ে উঠে আসে।

গাড়ি হোক, মোটোরসাইকেল স্কুটার হোক কী সাইকেল; যন্ত্রটাকে আপন করে চিনে নিতে পারায় যে কী গভীর আনন্দ। সে'টাকে মনের সুখে ব্যবহার করা এবং সে'টার যত্নআত্তি করা; এক্কেবারে সুপারফাইন কোয়ালিটির তৃপ্তি।

Sunday, March 16, 2025

ল অফ সন্ধে


ল অফ সন্ধে।
যে কোনো শহর, তার যে কোনো প্রান্তে,
সন্ধে মানেই তাতে বাড়িফেরার গন্ধ মিশে থাকবে।
ট্রেনেবাসে বাদুড়ঝোলা মানুষ,
অফিসটাইমের পথেঘাটে জেরবার মানুষ;
কে কোথায় নিজের বাড়ি ফেলে রেখে এসেছে তার ঠিকঠিকানা নেই, তাদের সহায়সম্বল বলতে শুধুই একটা কেজো বাসা। তবে তাতে বাড়ি ফেরার গন্ধ উবে যায় না। ছোটবেলার পাড়ার অলিগলি, ইয়ারবন্ধুদের গল্পগুজব, মাঠের ঘাসের ওপর পাতা হাওয়াই চটি, চৌবাচ্চার পাশের পিছল মেঝেতে হাত-পা ধোয়া; এরকম আরও কয়েকশো টুকরোর জিগস পাজল অফিস সন্ধের প্ল্যানচেটে ফেরত আসে।
ভূত সত্যি নয় বলে যেমন মিথ্যে হয়ে যায় না, রোজ সে ছোটবেলার বাড়ির ছবি মনের মধ্যে ভেসে না উঠলেও বাড়িফেরার গন্ধটুকু তো মিথ্যে নয়। প্রত্যেক সন্ধেবেলা সে গন্ধের ভূত আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে। ভিড়ে, হুল্লোড়ে পাশে থাকে। সে গন্ধই ক্রমশ ছাপোষা মানুষকে তার শ্রেষ্ঠ রণহুংকার চিনিয়ে দেয়; "একদিন ঠিক বাড়ি ফিরব"।

Thursday, November 21, 2024

বম্বে ও মদনমোহন



সমুদ্রের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকাটা প্রাণায়ামের পর্যায়ে পড়ে৷ কাঁচামিঠে রোদ্দুরে জল-বালিতে পা রেখে একমনে ঢেউ গুনে যাওয়া মানে মনের মধ্যেটা ডেটল দিয়ে সাফ করে অল্প আতর ছড়িয়ে নেওয়া।

তবে ডেলিপ্যাসেঞ্জারির শহরের সমুদ্রের অবস্থা গেঁয়ো যোগীর মত।
বম্বেতে পুরীর রেল প্ল্যাটফর্ম নেই,
শালপাতায় মোড়া মদনমোহন নেই;
কাজেই তার সমুদ্র সহজে চোখে পড়ে না,
টেনে ধরে না।

কিন্তু সমুদ্রই তো, তার ম্যাজিক পুরোপুরি চেপে রাখা যাবে কী করে। হপ্তা-দু'হপ্তায় একবার, ঢেউগোনা প্রাণায়ামে কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্তত; গা থেকে অফিস-বাজারঘাট-মাসকাবারির গন্ধ কেটে যাবেই৷

টুংটাংটুংটাং



সাইকেলের জয়যাত্রা অব্যাহত৷ আজ জুহু চৌপাটি ঘুরে এলাম৷ আমাদের আস্তানা থেকে আসা-যাওয়া মিলিয়ে বড়জোর ষোলো-সতেরো কিলোমিটার পথ, খোশমেজাজেই ঘুরে এলাম৷ আর একটানা বৃষ্টিতে ধীরেসুস্থে প্যাডেল ঠেলার আনন্দই আলাদা। ডিমার্টের পাইকারি কাপড়জামার স্তুপ থেকে সম্প্রতি সস্তায় একটা রেনজ্যাকেট হাঁকিয়েছি, অতএব বৃষ্টিতে থেমে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷

তাড়াহুড়ো আমার না-পসন্দ৷ ঢিকিরঢিকির করে এগোই, সুবিধে মত দাঁড়িয়ে পড়ি৷ চায়ে চুমুক দিই, বিস্কুটে কামড় দিই; ফের এগোই৷ ঘ্যামস্য ঘ্যাম৷ যে রাস্তা দিয়ে এদ্দিন নিয়মিত গাড়িতে, মোটরসাইকেলে বা অফিস বাসে যাতায়াত করেছি, সে'গুলোকে নতুনভাবে চিনছি। কত চায়ের দোকান বা ভাজাভুজির স্টল যে এদ্দিন আড়ালে-আবডালে পড়েছিল; সে'সব এখন সুড়সুড় করে চোখের সামনে বেরিয়ে আসছে।

যা হোক৷ একটা জরুরী অবজার্ভেশন৷ হর্ন জিনিসটা বিশ্রী৷ শব্দদূষণ তো বটেই; ও জিনিস মেজাজ খিঁচড়ে দেয়, মুখ তিতকুটে করে দেয়, আর এন্তার হাড় জ্বালায়৷ হর্ন যত কম বাজাবেন, তত দেশের দশের ও আপনার নিজের মঙ্গল৷ কিন্তু সাইকেলের বেলের ব্যাপারে সে খিটখিট খাটে না৷ আর আমার সাইকেলে যে বেল বসানো আছে, সে'টা ঠুকলে আবার ক্রিংক্রিংও নয়, বেরিয়ে আসে মৃদু-নরম-কানেমধু লেভেলের টুংটাং৷ ও জিনিসকে বেল না বলে "ট্র্যাফিক নুপুর" বললে মানায় বেশি৷

সামনের অটোরিকশা বা গাড়িকে "প্লীজ দাদাভাই" গোছের আওয়াজ দিতে হবে? টুংটাংটুংটাং৷
হঠাৎ বৃষ্টি নামায় মেজাজ খুশ?
টুংটাংটুংটাং।
আচমকা স্পীড তুলে মনে হচ্ছে হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার মত ব্যাপার?
টুংটাংটুংটাং।
সামান্য ক্লান্ত হয়ে হেলেদুলে এগোতে এগোতে মনকে একটু চনমনে করে তোলার দরকার?
টুংটাংটুংটাং।
ট্র্যাফিক সিগনালে পাশে দাঁড়ানো বাসের জানালা থেকে কোনো খোকা ড্যাবাড্যাবা চোখ নিয়ে সাইকেলের দিকে তাকিয়ে?
টুংটাংটুংটাং।

মোটের ওপর ওই টুংটাংটুংটাংই হলো সাইকেল চালিয়ের ধিতাংধিতাং, সে'টার ওভারডোজ হলে ক্ষতি নেই।

বাবু ওয়াটসনের বৃষ্টিদর্শন



গত মিনিট দশেক ধরে একের পর এক রকমারি ছাতা এবং ছাতার মালিক-মালকিনদের ব্যস্ততা মুগ্ধ হয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ভদ্রলোক। থুড়ি, পর্যবেক্ষণ নয়; দেখছিলেন শুধু, তবে মনপ্রাণ দিয়ে৷ এই এক লাল ছাতা মাথায় গৃহিণীর ব্যাজার মুখ, ওই গেল কালো ছাতার নীচে হন্তদন্ত অফিস যাত্রী।

ছাতা দেখছেন, দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। ছাতার নীচে রকমারি মানুষ, তাদের হাবভাব দেখেও আর আশ মিটছে না। আর রয়েছে বম্বের একটানা ঝমঝমে বৃষ্টি; কী অসহ্য, কী বিরক্তিকর অথচ কী অদ্ভুত ভাবে মন ভালো করা।

কিন্তু সর্বোপরি; সে এক অনাবিল পরিতৃপ্তি! ছাতার অবস্থা দেখে মানুষের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের পরিস্থিতি আঁচ করতে হচ্ছে না, ছাতা হাতে মানুষের চলন দেখে তার যমজ ভাইয়ের বাঁ হাঁটুর বাতের কথা ভাবতে হচ্ছে না। বৃষ্টির রাস্তায় গাড়ির চাকার ছাপ দেখে আগামী হপ্তায় কোন দুর্ঘটনার খবর সমস্ত কাগজের প্রথম পাতায় উঠে আসবে, তা নিয়ে ভেবে হন্যে হতে হচ্ছে না।

নাহ্‌, মরিয়ার্টি ভায়া মহাবজ্জাত বটে। তবে শত দু:খের মাঝেও; মাঝেমধ্যে একটা অস্বস্তিকর স্বস্তি মনের মধ্যে টের পান বটে বাবু ওয়াটসন।

সাইকেল ও বম্বে



মুম্বই আসার পর থেকেই মনে হচ্ছিল যে আশেপাশে ঘোরাঘুরির জন্য চার-চাকা ব্যাপারটা মারাত্মক রকমের গোলমেলে। পেট্রোলের শ্রাদ্ধ, সময়ের অপচয়। সর্বোপরি মারাত্মক ঝকমারি; খোঁচা দেওয়ার ভয়, খোঁচা খাওয়ার ভয়, পার্কিং নিয়ে জেরবার৷ চারবাংলো বাজারে গিয়ে শান্তিতে মাছ উল্টেপাল্টে দেখব তার উপায় নেই৷

কাজেই বছর দেড়েক রকমারি স্কুটার নিয়ে রিসার্চ করলাম৷ একশো দশ সিসির ইঞ্জিন না একশো পঁচিশ সিসির ইঞ্জিন, পেট্রোল না ইলেক্ট্রিক, মাইলেজ না পার্ফর্ম্যান্স; এ নিয়ে বেশ দাঁত চিবিয়ে কথা বলা এক্সপার্ট হয়ে উঠলাম৷ আর এদ্দিন রিসার্চের পর আজ কিনে ফেললাম একটা সাইকেল৷ অতি রিসার্চে গাজন নষ্ট কথাটা নেহাৎ মিথ্যে নয়৷


ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ স্কুল-টিউশনি করেছি একটা হিরো ইম্প্যাক্ট সাইকেলে চেপে৷ তখন সে'টাই আমার রয়্যাল এনফিল্ড। যা হোক, এদ্দিন পর প্যাডেল করতে দিব্যি লাগছে৷ পাঁচ-সাত কিলোমিটারের রেডিয়াসে স্কুটির তুলনায় সাইকেল মন্দ হবে না৷ খরচ ঝক্কি দুইই কম৷ আর খানিক কসরতও হবে৷ তা'ছাড়া মুম্বইয়ে তেমন বিশ্রী গরম বছরে বড় জোড় বছরে দু'আড়াই মাস৷ কাজেই সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে তেমন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়৷

খটকা একটা ছিল এই চারমাসের বৃষ্টি নিয়ে৷ অবশ্য ছাত স্কুটারেও নেই৷ আজ প্রথম দিন; কাজেই হুজুগ সপ্তমে৷ অতএব বিকেলের দিকে বৃষ্টি ঠেলেই বেরিয়ে পড়লাম। লোখন্ডওলার যমুনানগর (যমুনা নেই, ধারেকাছে একটা সাত ময়লা চওড়া 'নালা' আছে) থেকে 'ব্যাকরোড' হয়ে চারবাংলা মার্কেট৷ ঝমঝমে বৃষ্টি হলে দাঁড়াতেই হয়, কিন্তু ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর নিরিবিলি রাস্তা দেখলাম মারাত্মক ভালো কম্বিনেশন- মনের মধ্যে লাকি আলি আর সেকেন্ড ইয়ার সদর্পে জেগে ওঠে৷

চারবাংলোয় মাছ-ভ্রমণে আসব ছুটির সকালে৷ আজ ফিরে এলাম বেলফুল কিনে, সে মালার অর্ধেক গেল খোকার দখলে, বাকিটা বেটারহাফের খোঁপায়৷

Tuesday, July 16, 2024

পুরনো ট্রেনের টিকিট আর মুম্বইয়ের বৃষ্টি



অফিস ব্যাগের মধ্যে ছাতা৷
ছাতার পাশে দু'খোপের টিফিনবাক্স৷
টিফিনবাক্স ঘেঁষে অফিসের আইকার্ড৷
আইকার্ডের ফিতেয় জড়ানো মানিব্যাগ।
মানিব্যাগে একটা পাঁচশো টাকার নোট দু'টো দুশো, আর তিনচারটে দশ-কুড়ির৷ কিছু খুচরো পয়সা৷ খানকয়েক কার্ড; ডেবিট, ক্রেডিট, আধার ইত্যাদি৷ কোনো এক ফোঁকরে একটা সাতপুরনো ট্রেনের টিকিট৷ বিবর্ণ, ছাপা অক্ষরগুলো এখন আর পড়া যায় না৷

বছর কুড়ি আগে ও'টিকিট এক অন্য মানিব্যাগে ঠাঁই পেয়েছিল৷ তা'তে ছিল বড়জোর চল্লিশ টাকা৷ আর কলেজের আইকার্ড৷ অদরকারি নানারকমের খুচরো কাগজে ঠাসা৷ সেই মানিব্যাগ ছিল পিঠে ঝোলানো প্যারাশুট কাপড়ের ব্যাগে৷ সে ব্যাগের মধ্যে জলের বোতল, দু'টো বই, খাতা-কলম। আর ছাতা৷

আজকের মতই, সে'দিনও বৃষ্টি ছিল, তাই টিকিটের মানিব্যাগে আর মানিব্যাগের পিঠের ব্যাগে চালান হওয়া৷ আজকের মতই, সে'দিনও ব্যাগ থেকে ছাতা বেরিয়ে আসেনি৷ কারণ দু'টো। প্রথমত, ছাতা খুলতে হওয়া পরাজয়, এ'টা কে কবে মজ্জাগত দিয়ছিল কে জানে৷ দ্বিতীয়ত, ভেজা ছাতার ছেয়ে বিশ্রী বোঝা আর কিছু হয় না৷

এই ক’বছরে কত দরকারি কাগজ, ডেবিট কার্ড, টাকা, জরুরী কত কিছু অবলীলায় হারিয়ে গেল। অথচ কোনো অদ্ভুত মন্ত্রবলে সে রেলের টিকিট টিকে রইল৷ কত মানিব্যাগ পেরিয়েও সে টিকিটের বিবর্ণতা এখনও উজ্জ্বল।

অব্যবহারের ছাতার মতই ও টিকিট এখন বুকে ভরসা জোগানো মাদুলি৷

Monday, January 15, 2024

বান্দ্রার বান্দা



বান্দ্রা স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে স্লো বোরিভলি লোকাল ধরে যোগেশ্বেরী। ও পথে আমায় মাঝেমধ্যেই ভিড়তে হয়৷ অফিস-ফেরতা সন্ধ্যে, মারাত্মক ভিড়। সে ভিড়ের চাপ মজবুত ভাবে ঠেকিয়ে রাখতে আমার অস্ত্র হলো দশটাকার এক প্যাকেট গরম চীনেবাদাম। 

বান্দ্রা-কুর্লা কম্পলেক্স থেকে আসা শেয়ারড ট্যাক্সিগুলো এসে দাঁড়ায় স্টেশন লাগোয়া চত্ত্বরে। সে ট্যাক্সি থেকে নামতেই পেটটা বাদামের খিদেতে চিঁচিঁ করে ওঠে। দু-তিনটে ঠেলা দাঁড়িয়ে থাকে, তারা বালিতে ভাজা বাদামের সুবাস উড়িয়ে প্ল্যাটফর্মমুখী জনসমুদ্রের মধ্যে চনমন ছড়িয়ে দেয়।

হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও একটা বাদামভাজা ঠেলার সামনে না দাঁড়ালেই নয়। ও'টা আমার অভ্যাস। তারপর টুপটাপ এক-একটা বাদাম মুখে ফেলে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম নম্বর একে নেম পড়া।

কানের ইয়ারফোনে বাছাই করা গান, চোয়ালে বাদাম-চিবোনো দুলকি। গোটা ব্যাপারটা মিলিমিশে তৈরি হয় 'মিউজিক'। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে একটা ব্যাপার মাঝেমধ্যেই টের পাই; জামার ঘাম আর শরীরের ক্লান্তি ছাপিয়ে যে'টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সে'টা হলো পেল্লায় শহরের পেল্লায় বোলচাল দেখে ভেবড়ে যাওয়া। 

কলেজে ভর্তি হয়ে যখন মফস্বল থেকে কলকাতা এসেছিলাম; চোখে-প্রাণে ঝিলিক লেগে গেছিল। এত এত মানুষ, ইয়াব্বড় বড় রাস্তাঘাট,  বিশাল বিশাল বাড়িঘরদোর। ঘিঞ্জি অথচ পিলে চমকে দেওয়া। সে ঝিলিক আজও ফিকে হয়ে যায়নি। তারপর এ শহর থেকে ও শহর তো নেহাৎ কম হলো না। কিন্তু এ বয়সেও শহুরে ভীড়ের বহর দেখলে পিলে চমকে ওঠে। মুগ্ধ হই, অল্পবিস্তর ভয়ও টের পাই৷

শহর ব্যাপারটাই বড্ড মায়ার। অথচ কোনো শহরেই আমার পাড়া নেই। স্রেফ মানুষজনের ভিড়ে, রাস্তাঘাটের হইহইরইরইতে আর ট্রেন-বাসের দৌড়ঝাঁপে আমার মুগ্ধতা আছে৷ আর আছে বিষণ্নতা। 

Sunday, December 31, 2023

শহরের ছ্যাঁত



- কী পেল্লায় শহর! বাপ রে বাপ!

- ভয় ভয় করে, তাই না?

- ভয় করবে না আবার! বুক ছ্যাঁত করে ওঠে।

- আমরা যদি টিকতে না পারি?

- দুই বন্ধু বাক্সপেটরা নিয়ে চলে যখন এসেছি; তখন একটা হিল্লে হয়েই যাবে।

- না হলে? হিল্লে না হলে?

- গাঁয়ে ফেরত৷

- গাঁয়ে কত বড়বড় বোলচাল ছড়িয়ে এলাম। ফিরে যাব? খালি হাতে?

- পেল্লায় শহর আর হিল্লে না হওয়ার গল্পগাছা নিয়ে ফিরব৷ সে'টাকে কি খালি হাতে ফেরা বলে নাকি রে পাগলা?

Wednesday, December 13, 2023

সমরবাবু আর ট্রেন



এখন সন্ধ্যে পাঁচটা সাত। অর্থাৎ গোরেগাঁও লোকাল আসতে আরো মিনিট দশেক। ও'টায় ভীড় কম, সীট পাওয়া না গেলেও নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে যাওয়া যায়৷ আর এই অপেক্ষার দশ মিনিট বেশ জমজমাট৷ প্ল্যাটফর্মের এক কোণে দাঁড়িয়ে সমরবাবু নিজের ব্লুটুথ ইয়ারফোনটা অফিসের ব্যাগ থেকে বের করে কানে গুঁজবেন৷ তারপর সেই ইয়ারফোন মোবাইলে কনেক্ট করে তিনটে বাছাই করা হেমন্তর গান চালাবেন; রোজকার নিয়ম। এই গানগুলো রোজ পালটে যায়৷ লিস্টে আজ আছে: "বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা", "পালকির গান" আর "এমন আমি ঘর বেঁধেছি"। হেমন্তবাবুর কণ্ঠ ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকলে শশব্যস্ত বান্দ্রা স্টেশনও ভারী সুন্দর হয়ে ওঠে৷ 

আজ বিকেলের তিন-গানের প্লেলিস্ট শুরু হয়ে সবে হেমন্তবাবু রোমান্টিক দীর্ঘশ্বাসে পৌঁছেছেন; "শুধু এই পথ চেয়ে থাকা, ভালো কী লাগে"৷ এমন সময় গানের সুতো কেটে গেলো, একটা বিশ্রী কণ্ঠের "হ্যালো"তে হেমন্ত ধরাশায়ী। কী আশ্চর্য,  কল এলো কখন, রিং তো শোনা যায়নি৷ সাড়া দেওয়ার আগে ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখলেন সমরবাবু; অদ্ভুত, কোনো কলই আসেনি। অথচ কানে স্পষ্ট শুনতে পারছেন সেই হেঁড়ে কণ্ঠস্বর;
"সমর৷ সমরবাবু৷ মিস্টার দাস! মিস্টার সমর দাস! প্লীজ রেস্পন্ড। প্লীজ সাড়া দিন"।

তিরিশ সেকেন্ড কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সাড়া দেবেন বলে মনস্থ করলেন সমরবাবু।

- হ্যালো, হু ইজ দিস?

- উফ, এতক্ষণে আপনার সাড়া দেওয়ার সময় হলো সমরবাবু? আর আমি যখন বাংলায় প্রশ্ন করছি তখন দুম করে ইংরেজি ফলানোর কী আছে?

- না মানে..ইয়ে। এক মিনিট! আপনি কে? কী'ভাবে কথা বলছেন আমার সঙ্গে? কী চাই?

- মন দিয়ে শুনুন সমরবাবু৷ ব্যাপারটার ওপর আপনার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।

- এক্সকিউজ মী?

- আবার ইংরিজি! ধুচ্ছাই! যাকগে শুনুন৷ আপনি পাঁচটা সতেরোর গোরেগাঁও লোকাল ধরবেন বলে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তার আগে অন্য কোনও ট্রেন এলেও চট করে উঠে পড়বেন না যেন।

- নিজের গ্যাঁটের পয়সা করে টিকিট কেটেছি৷ তাও ফার্স্টক্লাসের৷ আমি কোন ট্রেনে উঠব বা উঠব না, সে বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার আপনি কেন? বলুন দেখি, আপনি কে?

- সমরবাবু৷ আমিই আপনি।

- ইয়ার্কি হচ্ছে?

- আমিই সমর দাস৷ আমিই আপনি৷ শুধু সময়ের হেরফের।

মাথাটা তড়াং করে গরম হয়ে গেল সমরবাবুর, কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে পকেটে রাখলেন৷ রাস্কেল, স্টেশনে দাঁড়িয়ে কেউ প্র‍্যাক্টিকাল মস্করা কষছে! যত্তসব! দিলে মেজাজটা বিগড়ে। আর কেরামতি দ্যাখো, কণ্ঠস্বরটাও ঠিক তাঁর নিজেরই মত বিদঘুটে- নির্ঘাৎ এআই ব্যবহার করেছে। ডিজিটাল স্ক্যাম যে কী ভীষণভাবে আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে।

এমন সময় বোরিভলি লোকাল স্টেশনে ঢুকলো। সমরবাবু অবাক হয়ে দেখলেন ট্রেনটা বেশ ফাঁকা! এ'দিকে গোরেগাঁও লোকাল আসতে এখনও মিনিট পাঁচেক দেরী৷ উঠে পড়লেই হয়। কিন্তু..কিন্তু ইয়ারফোনে শোনা সেই বিটকেল কণ্ঠস্বরটার কথা তখনও কানে বাজছিল৷ তাই খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়ালেন৷

প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার জন্য ট্রেনটা নড়েচড়ে উঠতেই সমরবাবুর মনে হলো এ'সব প্র‍্যাঙ্ক কলারদের বেশি লাই দিতে নেই৷ অমনি সোজা ছুট দিলেন ট্রেনের দিকে৷ কামরায় একটা পা রেখেও ফেলেছিলেন কিন্তু ট্রেনের স্পীডের হিসেবটা একটু এ'দিক ও'দিক হয়ে গেল। একটা বিশ্রী হ্যাঁচকা টান, ট্রেন-প্ল্যাটফর্ম থেকে হইহই চিৎকার আর দেড় সেকেন্ডের মধ্যে চলন্ত ট্রেনের নীচে তলিয়ে গেলেন সমর দাস।

***

সম্বিৎ ফিরতে সমরবাবু টের পেলেন তিনি বান্দ্রা স্টেশনেই দাঁড়িয়ে৷ তবে এ যেন অন্য জগত। সন্ধ্যের যে'টুকু আলো, সে'টুকু বাদে কোনো ইলেক্ট্রিক বাতি নজরে পড়ল না৷ ট্রেনের শব্দও নেই৷ একটু মন দিয়ে চারপাশটা দেখে সমরবাবু বুঝলেন চারপাশে মানুষজন কুকুর-বেড়াল কেউই নেই৷ মনে হলো গোটা পৃথিবীতে তিনি একা। ট্রেনের তলায় পড়ার কথা মনে পড়ল৷ গা শিউরে ওঠার কথা, কিন্তু খুব একটা বিচলিত বোধ করলেন না তিনি৷ ব্যাপারটা আঁচ করতে সবিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না তবে এ'দিকটা যে এমন সিনেমার সেটের মত হবে সে'টা আশা করেননি৷

এমন সময়, সমরবাবুর নজরে পড়ল উজ্জ্বল লাল রঙের টেলিফোনটা, আদ্দিকালের রিসিভারগুলো যেমন হত -  অনতিদূরে একটা কাঠের টেবিলের ওপর রাখা। এই টেবিলটা প্ল্যাটফর্মের মধ্যে এ'ভাবে থাকার কথা নয়৷ তবে এ তো আর গড়পড়তা বান্দ্রা স্টেশন নয়৷ টেলিফোনটা দেখে সহজেই দুইয়ের সঙ্গে দুই জুড়ে চার করতে পারলেন তিনি৷ চেষ্টা করে যে বিশেষ লাভ হবে না তাও বুঝতে পারছিলেন৷ তবু, একটা শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই৷ 

মরিয়া হয়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকাতেই হেমন্তবাবুর মায়াবী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, "শুধু এই পথ চেয়ে থাকা, ভালো কী লাগে"৷ আচমকা সে গান থমকে গেল, রিসভারে ভেসে এলো একটা জলজ্যান্ত বান্দ্রা স্টেশনের হইচই। সমরবাবু জানেন রিসিভারের ওপারে কে আছে। সাহস করে তিনি বলে উঠলেন;

"সমর৷ সমরবাবু৷ মিস্টার দাস! মিস্টার সমর দাস! প্লীজ রেস্পন্ড। প্লীজ সাড়া দিন"।

বম্বেতে শীতের খোঁজে

আমার বাবা একটা অদ্ভুত প্রজেক্ট নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে: "বম্বের শীতের খোঁজ"।

ভোরবেলা জানালার বাইরে মাথা গলিয়ে হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করছে আর বলছে, " হ্যাঁ রে, বুঝলি! বাতাসে মৃদু একটা ঠাণ্ডার ইয়ে আছে কিন্তু। সত্যি বলছি; এ'দিকে এসে দাঁড়া তা'হলে বুঝবি"।

মাঝেমধ্যে উঠে গিয়ে ফ্যানের রেগুলেটর পাঁচ থেকে চারে নামিয়ে বলছে, "একটু অপেক্ষা করে দ্যাখ৷ তেমন গরম লাগবে না কিন্তু৷ বলছি শোন্! আরে আফটার অল মাসটা তো ডিসেম্বর, নাকি"।

গতকাল সন্ধেবেলা মোটরসাইকেলে বসে হাওয়া খেতে খেতে বললো, "তুই যত যাই বলিস, একটু কনসেন্ট্রেট করলেই বুঝতে পারবি একটা ঠাণ্ডা গোছের বাতাস এসে গায়ে-মুখে লাগছে৷ ফোকাস কর, কর না৷ ঠিক বুঝতে পারবি। উইন্টার ইজ হিয়ার"।

Sunday, December 10, 2023

চড়ুইভাতি



বম্বেতে শীত নেই, তবে রোদ্দুর সামান্য নরম হয়েছে বটে। অথবা হয়তো মাসটা ডিসেম্বর বলে আমার কল্পনায় রোদ্দুরের তেজ অল্পবিস্তর কমে এসেছে।

গুণীজনেরা বলেছেন ডিসেম্বরের রোদ্দুর মাংসভাতের ওপর এসে পড়লেই সে'টা চড়ুইভাতি। দল বেঁধে 'পিকনিক স্পটে' গিয়ে উনুন ধরানো, ব্যাডমিন্টন খেলা আর যাবতীয় হইহই; ও'গুলো বাড়তি সাজসজ্জা মাত্র। সে অর্থে আজ দুপুরের খাওয়াদাওয়াটা একটা জবরদস্ত পিকনিকই ছিল বটে৷ জয় শীত৷

Wednesday, December 6, 2023

মুম্বইয়ের শীত



- হ্যালো! 

- হ্যালো, বল্।

- কেমন আছিস ভাই?

- চলে যাচ্ছে। তুই?

- ভালোই আছি। তবে আচমকা টেম্পারেচারটা এমন ড্রপ করে গেল বুঝলি..বালাপোশ টেনে শুতে হচ্ছে। ধুর। আর এই এখন দ্যাখ...ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে হাত গরম করে তোকে ফোন করছি। যাক গে। আমার কথা বাদ দে। তুই বল, মুম্বইয়ের শীত কেমন উপভোগ করছিস? এঞ্জয়িং আই হোপ?

- ওই। মনজিনিসে বিরিয়ানির মত।

- হে হে হে..।

- হগওয়ার্টসের দেওয়ালে "এই চিহ্নে ভোট দিন" লেখার মত।

- হা হা হা..।

- পিকনিকে বসে কেমিস্ট্রির ইকুয়েশন ব্যালেন্স করার মত।

- বুঝেছি বুঝেছি..।

- আন্ডারটেকার আর হাল্ক হোগানকে দিয়ে ক্যারম খেলানোর মত। 

- আরে হলো হলো..।

- এক্সেলের প্রিন্ট নিয়ে কাগজে-কলমে যোগ-বিয়োগ করার মত।

- আহ্, থাক না!

- বিসর্জন প্রসেসনে তানপুরা নিয়ে যাওয়ার মত। 

- আচ্ছা৷ আমি রাখছি।

- রাখ। আর খবরদার যদি এপ্রিলের আগে কল করেছিস!

এজেন্ট বাহাত্তরের টালবাহানা



- হ্যালো। এজেন্ট বাহাত্তর বলছি।

- রিপোর্ট?

- টার্গেট স্পটেড অ্যাট নাইন ও সেভেন।

- গুড।

- টার্গেট লকড অ্যাট নাইন টুয়েন্টি সেভেন।  ওয়ান স্নাইপ অ্যাওয়ে।

- ভেরি গুড। ন'টা বত্রিশে ঢিশুম, তাই তো?

- তেমনটাই তো কথা ছিল।

- কাজ হাসিল হলে, সুটকেস পৌঁছে যাবে যথাস্থানে। 

- সুটকেস? হুম।

- তোমার হুমটা বড্ড সাসপিশাস শোনাচ্ছে এজেন্ট বাহাত্তর।

- ভাবছি আজ ন'টা বত্রিশের ব্যাপারটা তোলা থাক।

- হোয়াট ননসেন্স৷ হঠাৎ এমন দুর্মতি কেন?

- আজ শহরের ওয়েদারটা দেখেছেন? অসময়ের দু'পশলা বৃষ্টিতে এমন বিউটিফুল একটা ইয়ে তৈরি হয়েছে, আহা। প্লাস বাতাসে মারাত্মক মিঠে আমেজ..এর মধ্যে রক্তারক্তির দিকে যেতে মন সরছে না..।

- ভাড়াটে খুনির আবার অত টালবাহানা কীসের হে?

- এক্সকিউজ মি স্যার। এজেন্ট বাহাত্তর বলুন। সার্ভিস প্রোভাইড করছি বলে আপনি আমার মাথা কিনে নেননি।

- আমি তোমায় ওয়ার্নিং দিচ্ছি এজেন্ট, ন'টা বত্রিশের মধ্যে টার্গেট উড়ে না গেলে..উড়ে না গেলে...।

- দেখুন মশাই। টার্গেট বাবাজীবন এই অসময়ের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় করে এক গাল হাসি নিয়ে, সবজি বাজার করতে বেরিয়েছেন৷ এমন রোম্যান্টিক মানুষকে আজকের দিনে নিকেশ করাটা অ্যান্টি-পোয়েট্রি হবে।

- অ্যাই! আমি তোমায় ওয়ার্নিং দিচ্ছি..হ্যালো..হ্যালো..এই এজেন্ট...তবে রে ব্যাটাচ্ছেলে বাহাত্তর.. তবে রে..এই..যাহ..দিল ফোন কেটে..।

কোলবার বাগদাদি



কোলাবার বাগদাদি রেস্টুরেন্টের নিহারির ভূয়সী প্রশংসা না করলেই নয়৷ যেমন হাইকোয়ালিটি পিস পাতে পড়েছিল, তেমনই সরেস রান্না৷ অমন থালার সাইজের রুটিও অবলীলায় উড়ে গেল৷ পাশাপাশি ভাজা মুর্গিটাও বেশ উপাদেয়; পুরানি দিল্লীর স্মৃতি খানিকটা উস্কে দিয়ে গেল৷ এ'খানকার মুর্গিটা যেন আরও রসালো। কেএফসি-টেএফসিকে চার গোল দেবে, গুণে গুণে। খোকা ঠিক রুটি ভক্ত নয়, তাই বিরিয়ানি নিতে হল৷ তবে পুরানি দিল্লীর মতই, এদের বিরিয়ানি নিয়ে বেশি লাফালাফি করার উপায় নেই৷ বরং এদের শাহিটুকরাটা মারাত্মক রকমের ভালো৷ 



সবচেয়ে বড় কথা, দিব্যি 'পকেট ফ্রেন্ডলি' জায়গা৷ ব্যাঙ্গালোর থেকে এক বন্ধু জানালে এককালে নাকি ও জায়গায় জাহাজের নাবিক-খালাসিরা ভিড় জমাত সস্তায় ভালোমন্দ খেতে৷ আমরা জাহাজ চালাতে পারি না, কিন্তু ভালো খাবার চেখে দিব্যি ভেসে যেতে পারি বটে৷


শনিবার সন্ধ্যেবেলা টানটান ভিড়, সবাই মোটামুটি টেবিল শেয়র করে বসছে৷ একটা ছ'জনের টেবিলের একদিকে আমরা তিনজন; আমি, ও আর খোকা৷ উলটো দিকেও এক বাবা, মা ও তাদের খোকা৷ তফাৎ হলো ও'দিকের খোকাটি প্রায় আমাদের বয়সী, বৃদ্ধ বাপ-মাকে খাওয়াতে নিয়ে এসেছে৷ এক টেবিলে ছ'জন, রকমারি অর্ডার; কাজেই প্লেটে প্লেটে ঠাসাঠাসি অবস্থা৷ তারই মধ্যে ও'পারের খোকা মন দিয়ে বাপ-মায়ের খাওয়াদাওয়ার তদারকি করছে, এ'পারে ঝালে হুসহাস খোকাকে সামাল দিয়ে চলেছি আমরা৷ সে এক দিব্যি সিমেট্রি৷


বাগদাদি থেকে বেরিয়ে আশেপাশে সামান্য হাঁটাহাঁটি করে, সমুদ্রের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে, লিওপোল্ড থেকে তিরামিসু চেখে যখন গাড়িতে বসলাম, তখন তিনজনেই পরিতৃপ্ত।  তারপর আর কী। মাঝরাত্তিরে বম্বের রাস্তাঘাট আলো করা মানুষজনের ঢল আর মন আলো করা কিছু হিন্দি সিনেমার গানের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে বাড়িমুখো হওয়া; যে কী হাইক্লাস প্রাণায়াম..।

Saturday, November 25, 2023

বম্বের বাবু



- এই যে, ভাইটি৷ এ'দিকে এসো দেখি।

- কী ব্যাপার বলুন তো..।

- কী, আজ নাকি গাড়ি আনা হয়নি৷ আর অফিস বাসও হাতছাড়া হয়েছে?

- হেহ্। ওই আর কী।

- তা ফেরা হবে কী করে?

- ওই। উবার। বা অটো ধরে..।

- বলো কী হে!

- আগেও গেছি তো।

- আগে বহুবার ভুল করেছ বলে কি সে'টাকেই হ্যাবিটে কনভার্ট করতে হবে? এ কী ভোট দেওয়া নাকি?

- আমি বুঝলাম না।

- ট্রেন থাকতে আবার ও'সব ছাইপাঁশের দিকে যাওয়া কেন।

- ট্রেন..আসলে..হয়েছে কী..।

- কিছু হয়নি। আমি বলছি কী হবে। আজ ট্রেন।

- কিন্তু..।

- ট্রেন।

- না শুনুন..।

- কী দরকার নিজেকে অযথা চাবকানোর? ট্রেন৷

- বেশ। আজ তবে ট্রেন। রুটটা তা'হলে একটু...।

- এই হচ্ছে কথার মত কথা৷ এ'বারে শোনো.. এ'খান থেকে শেয়র অটো..।

- অটো।

- মিটারে না। শেয়র অটো। বান্দ্রা স্টেশন পর্যন্ত।

- শেয়র অটোয় বান্দ্রা।

- টার্মিনাস নয় কিন্ত।

- এই সেরেছে। বান্দ্রার ক'টা স্টেশন?

- ডোবাবে দেখছি৷ শেয়র অটো বান্দ্রা স্টেশন বলে যে'খানে নামাবে নামবে৷ কেমন?

- ওউক্কে।

- অটোয় বসেই অনলাইন টিকিট কেটে নেবে৷ ইউটিএস অ্যাপ।

- যো হুকুম।

- কোন টিকিট কাটবে?

- এই রে। ওই। বান্দ্রা টু যোগেশ্বরী।

- কোন ক্যাটেগরি?

- এই রে..সেরেছে..ভালো দেখে একটা..।

- এসি টিকিট কাটবে?

- এসি আছে?

- আলবাত। বম্বের ব্যাপারই আলাদা।

- বাহ্। তা'হলে এসির টিকিটই কাটব।

- তোমার মুণ্ডু।

- যাচ্চলে।

- এসি ট্রেনের অপেক্ষায় বসে রইলে ঝুলে যাবে। ডেলিপ্যাসেঞ্জারিরে স্পীড ইস অফ দ্য এসেন্স। এসি উইল স্লো ইউ ডাউন।

- তা'হলে এসি বাদ?

- আলবাত। সোজা এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে স্লো ট্রেন ধরবে।

- স্লো ট্রেন ধরব?

- টু রীচ ফাস্টার৷ সবই খেল অফ ফ্রিকুয়েন্সি। পরপর স্লো ঢুকবে..।

- বেশ৷ স্লোয়ের টিকিট কেটে সোজা প্ল্যাটফর্ম নম্বর এক।

- বাহ্। এইত্তো৷ ইয়ে, তোমার নরম শরীর। ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটো৷

- আচ্ছা। বেশ৷ শেয়র অটো৷ বান্দ্রা স্টেশন। এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম। স্লোয়ের ফার্স্ট ক্লাস টিকিট৷

- বাহ্। দশে দশ৷ তবে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট সঙ্গে রেখে যে'খানে চান্স পাবে উঠে যেও৷ মিনিট পনেরোর তো ব্যাপার।

- আচ্ছা।

- নার্ভাস?

- না মানে..।

- ফোকাস। তুমি প্ল্যাটফর্মে। তুমি দেখলে ভিরার লোকাল ঢুকলো। দিব্যি সে'টা যোগেশ্বরী যাবে।

- তা'হলে আর কী৷ সুট করে উঠে যাব।

- না। উঠবে না৷ তোমার সইবে না।

- সইবে না?

- সে ট্রেন তোমায় চিবিয়ে ছিবিড়ে করে জাস্ট ফেলে দেবে৷ আর ক'দিন যাক৷ বম্বের হাওয়ায় শরীর-মন তৈরি হোক। তারপর ভিরারে ঝুলে পড়বে'খন৷ আপাতত বোরিভলির লোকাল এলে তবে উঠবে। কেমন?

- (চোয়াল শক্ত) বেশ। তাই হোক৷ আজ তবে ট্রেন৷ কী বলেন?

- সাবাশ ব্রাদার! সাবাশ! ও হ্যাঁ। মাস পাঁচেক হল তুমি মুম্বইতে এসেছো। এদ্দিন মন থেকে যে কথাটা তোমায় বলা হয়নি ব্রাদার, আজ বলি৷ ওয়েলকাম টু আওয়ার সিটি। ওয়েলকাম!