সন্ন্যাস নিয়ে পাহাড়ে এসেছেন সন্তোষবাবু। সন্তোষবাবু নিজের আলসেমির ধাতটা নিজেই অগ্রাহ্য করতে পারেন না; সে দোষেই নিজের বছর কুড়ি পুরনো চাকরিটা খোয়াতে বসেছিলেন। আলসেমি ব্যাপারটা বিয়েথা-ঘরসংসারের ক্ষেত্রেও খুব একটা কাজে লাগেনি, গিন্নী ইহলোক ত্যাগ করে একপ্রকার প্রাণে বেঁচেছেন বলা চলে। নিঃসন্তান সন্তোষবাবু টের পাচ্ছিলেন যে চাকরী গেলে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে দিন গুজরান করতে হবে। তার চেয়ে একটা আলাভোলা মেসবাড়িতে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলে সুবিধে হয়। ভদ্রেশ্বরে শালার বাড়িতে একটা অদরকারী নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে শালার এক প্রতিবেশীর মুখে শুনেছিলেন উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ের গায়ে অজস্র ছোটখাটো মঠটঠ আছে যে'খানে গেরুয়াধারীরা নিশ্চিন্তে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছে। সে প্রতিবেশী অবশ্য সাধনার কথা বলেছিলেন, ওই শুয়ে-বসে দিন কাটানোর ব্যাপারটা নিজের মনে সাজিয়ে নিয়েছিলেন সন্তোষবাবু। অফিসের বড়বাবুর ধমক-টমকের চোটে যখন কাজকর্মে মন দেওয়ার প্রশ্ন এলো, তখনই সন্তোষবাবু ঠিক করলেন "এ মায়া প্রপঞ্চময়, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ'বার সন্ন্যাস নিলেই মুক্তি"।
পাহাড়ের বুকে এক গ্রাম সুখাবিলি। বিশ-তিরিশ-ঘর মানুষের বাস, সে গাঁয়ের এক কোণে একদল সাধক তাঁবু বেঁধে পড়ে আছেন বেশ কিছুদিন হলো। ব্যবস্থাপনার দিক থেকে ব্যাপারটাকে আদৌ মঠ বলা চলে না। কিন্তু সন্তোষবাবু দিব্যি বুঝেছেন যে গায়ে গেরুয়া ফতুয়া চাপালেই বিভিন্ন মঠে-ফঠে জাঁকিয়ে বসা সম্ভব নয়। সর্বত্রই বিশ্রী পলিটিক্স। কিন্তু এই তাঁবু খাটিয়ে পড়ে থাকা সন্ন্যাসীদের তেমন হেলদোল নেই, তাদের পাশে এসে দিব্যি মাস-দুয়েক রয়ে গেলেন সন্তোষবাবু। এরা এখানে আর কদ্দিন পড়ে থাকবে সে'টা জানা নেই, এদের কেউই বিশেষ গপ্পিয়েও নয়। একটা তাঁবুর এক কোণে তাঁর স্থান হয়েছে, সে'খানে নিজের হোল্ডঅল বিছিয়ে বেশ একটা আরামদায়ক আস্তানা বানিয়ে নিয়েছেন ভদ্রলোক। এদের সবচেয়ে বড় গুণ হলো এরা কেউই ধর্মকর্মের গপ্প নিয়ে গায়ে পড়ে না। কোথা হতে আসা হয়েছে, কী মতলব; এ'সব হাবিজাবি কথা বলেও বিশেষ বিব্রত করে না। সবচেয়ে বড় কথা চাকরী যাওয়ার ভয়টা গেছে, রোজ রোজ গাম্বাটসব ফাইলটাইলও ঘাঁটতে হচ্ছে না।। আত্মীয়স্বজনের হ্যাপাটা নেই, সে'টা একটা বাড়তি পাওনা; কেউ বাড়িতে এলেই সেই ওভেনে সসপ্যান বসানোর খাটনি, উফ।
এ'খানে সবই দিব্যি ছিমছাম। সকালে নিজের মত ঘুম থেকে ওঠো। নিজের মত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও। সন্ধে নাগাদ এরা সকলে মিলে খানিকক্ষণ হরিনাম জপে, সে আড্ডায় বসতেও দিব্যি লাগে সন্তোষবাবুর। তিনি যে আছেন, একটা জলজ্যান্ত আধবুড়ো মানুষ, সে'টা কারুর নজরেই পড়ে না যেন। এই তো চাই। এদের হোতা হলে রমাকান্ত, উত্তরপ্রদেশের বলিয়া জেলায় স্কুল মাস্টারি করতে, সন্তোষবাবুর সমবয়সী বোধ হয়। এখন পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে সাধনা করে। তাকে অবশ্য সবাই বলে গুরুজি। রমাকান্তর সঙ্গে মাঝেমধ্যে গল্পগুজব হয় বটে, ওই রাতের দিকে। ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রসঙ্গ তোলে না রমাকান্ত, সে বলে পাহাড় জঙ্গলের গল্প। কোথায় কোন ঝর্নার জল মারাত্মক মিষ্টি, কোন পয়েন্ট থেকে সানরাইজ দেখলে মন-ভালো হয়ে যাবেই, ইত্যাদি। সন্তোষবাবুর কলকাতার গল্পও মন দিয়ে শোনে সে, তবে শহুরে জীবন প্রসঙ্গে টীকাটিপ্পনী কাটেনি কোনোদিন।
সন্তোষবাবুর কিঞ্চিৎ সমস্যা এদের সমবেত ফলাহার আর একটানা সেদ্ধ-ভাত খাওয়ায়। তা'ছাড়া কাঠ জোগাড় করে রান্না করার ব্যাপারটা চাকরীর হ্যাপা সামলানোর চেয়েও কঠিন। তিরিশ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট পাহাড়ি টাউনের বাজার থেকে স্টোভ, হাড়ি, চাটু, খুন্তি, ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। কেরোসিন, তেল-মশলা, চাল-সবজি গাঁয়েই পাওয়া যায়। নিজে গিয়েও বাজারঘাট করতে হয় না, গাঁয়ের মধুরেন্দ্র নামের এক ছোকরা সামান্য কমিশনের বদলে এ'সব সাপ্লাই দেয় তাঁকে। এমন কী মাঝেমধ্যে রান্নাবান্নাও করে দেয়। রমাকান্ত আশ্বাস দিয়েছে গেরুয়া-গায়ে দিনে দু'চারটে ডিম ভেজে খাওয়া যেতেই পারে। এমন কি হপ্তায় একবার দেশি মুর্গির পাতলা ঝোলেও মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার নয়। শুধু ডিম-মুর্গি পাতে সকলের পাশে বসে খাওয়াটা এড়িয়ে চলেন সন্তোষবাবু। এ'খানের শাকসবজি টাটকা, ডিম মানেই লালচে-হলুদ কুসুমওলা দিশি, আর গাঁয়ের হাওয়া-বাতাস আর ঝর্নার জল খাওয়া মুর্গিদের গায়ের মাংসে যে কী স্বাদ। এ তৃপ্তিও তো গভীর সাধনারই অঙ্গ।
মাঝে হঠাৎ হপ্তা-দুয়েকের জন্য রমাকান্ত গায়েব হয়ে গেলো। বাকিরা কেউই তাঁর খবর দিতে পারে না। অবশ্য তা'তে যে সন্তোষবাবুর বিস্তর সমস্যা হয়েছে তা নয়, তবে রমাকান্ত ছাড়া কারুর সঙ্গে তেমন গল্প জমে না তাঁর। একটু গল্প-আড্ডা না হলে সাধনায় বেশ ব্যাঘাত ঘটে। রমাকান্ত গায়েব হওয়ার দিন সতেরো পরে একদিন দুপুরে ডিমের মামলেট আর মুসুরির ডাল দিয়ে মাখা ভাত দিয়ে জবরদস্ত লাঞ্চ সেরে হোল্ডঅলের ওপর শুয়ে পুরনো আনন্দলোক পড়ছিলেন সন্তোষবাবু। এমন সময় পাশে এসে বসলে রমাকান্ত।
- আরে এই যে ভাইটি, কোথায় ছিলেন এদ্দিন?
- আপনি কেমন আছেন সন্তোষজী, এ'দিকে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?
- না না। মধুরেন্দ্র থাকতে আর চিন্তা কী বলুন। তা'ছাড়া এ'দিকের জলে যে কী আছে মশাই। অম্বলের ওষুধ তো শেষ কবে খেয়েছি মনেই পড়ছে না। অ্যাপেটাইটও ড্রাস্টিকালি ইম্প্রুভ করেছে। সন্ন্যাসী হলে মেটাবোলিজমে এত প্রগ্রেস হবে জানলে এর আগে কবেই...।
- বহুত বঢিয়া।
- কই বললেন না তো, আপনি গেছিলেন কই? আমি তো চিন্তায় ছিলাম আপনি বুঝি নতুন কোনো মঠেফঠে...।
- আমি পওয়নপুরে গেছিলাম সন্তোষজী।
- সেই আপনার গ্রাম? বলিয়ায়?
- সে গ্রাম আমার কতটা তা বলতে পারি না। তবে হ্যাঁ, সে'খানেই গেছিলাম।
- সে কী। রিটার্ন অফ সন্ন্যাসী?
- রিটার্ন কিনা তাও বলতে পারিনে।
- একটু খোলতাই করে বলুন না মশাই।
- মঞ্জু অসুস্থ ছিলে বড়। তাই...।
- মঞ্জু?
- আমার গত-জন্মের স্ত্রী।
- গ...গত?
- সে গাঁয়ের জীবনটা এখন তেমনই ঠেকে।
- তা, আপনার ছেলেপিলে...।
- সবাই আছে। তিন ছেলে, এক মেয়ে। তাদের ঘরসংসার। ভরা বাড়ি।
- তবুও...।
- পোস্টকার্ড এসেছিল ক'দিন আগেই। এ গাঁয়ের স্কুলের অ্যাড্রেসে। সেখানকার মাস্টার আমায় চেনে। খবর পেলাম মঞ্জু শেষ-শয্যায়।
- ওহ...।
- মনে হলো। এই সুযোগে যদি মঞ্জুর একটু সেবা করে উঠতে না পারি, রাধামাধব আমার সেবা গ্রহণ করবেন না। কেন এ কথা মনে হলো বলতে পারি না। তবে ওই, মনই তো। মনের ঠেলাতেই চলে গেলাম। একটানা তাঁর পাশে বসে রইলাম। তাঁকে নিজের হাতে রোজ খাওয়ালাম, পরিষ্কার করলাম। ওষুধ খাওয়ালাম নিয়মিত। ডাক্তারবদ্যির সঙ্গে আলাপআলোচনা। ছেলেমেয়েদের সম্পত্তির হিসেব বুঝিয়ে টুঝিয়ে দিলাম, মঞ্জুর পাশে বসেই হলো সে'সব। মঞ্জু রুই মাছ বড় পছন্দ করে। বাজারে গিয়ে সে মাছ নিয়ে এলাম একদিন জানেন। নিজের হাতে রান্না করলাম, বাড়তি রসুন দিয়ে - ঠিক যেমনটি মঞ্জুর পছন্দ ছিলো। সে'অবশ্য এক-দুই গ্রাসের বেশি খেতে পারলে না। খাওয়ার অবস্থাতেই সে ছিলে না।
- তা মঞ্জুদেবী এখন...।
- গত শনিবার সে চলে গেলে। রাধামাধবের ইচ্ছে, তিনিই কাছে টেনে নিলেন।
- আপনি গাঁয়ে আর দু'দিন থাকলে পারতেন ভাই রমাকান্ত...।
- গেলবার গাঁ ছেড়ে এসেছিলাম সন্তোষজী। কিন্তু এ'বারে মনে হচ্ছে সে গ্রাম, সে বাড়িকে মাদুলি করে গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়েছি। রাধামাধবের যা ইচ্ছে, তা'তেই আমার মুক্তি।
সে রাত্রে ডাল-আলুভাজা বিস্বাদ ঠেকলো সন্তোষবাবুর জিভে। দু'টো কলা আর সামান্য দুধ দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে শুয়ে পড়লেন।
তাঁর এক হপ্তা পর কলকাতা ফিরলেন। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল খেটে কাজ করতে চাইলে তাঁর চাকরীটা আপাতত বহাল থাকবে। কোথায় কী যে সামান্য পালটে গেলো। শত ব্যস্ততার মধ্যে, ফাইলে-কাগজপত্রের ভিড়ে মাঝেমধ্যেই রমাকান্ত আর মঞ্জুদেবীর ছায়া দেখতে পান সন্তোষবাবু। নাকে আসে অতিরিক্ত রসুনের ঝাঁজওলা রুই মাছের দেহাতি ঝোলের গন্ধ। আমিষটা এ'বার ছেড়েই দিলেন ভদ্রলোক, ছাড়তে পারলেন না গেরুয়া ফতুয়াগুলো। গড়িয়াহাট থেকে এক ডজন কিনে ফেলতেই হলো। এ নিয়ে বেশি গবেষণা করতে চান না ভদ্রলোক, তা'তে খাটনি বাড়ে। "সবই রাধামাধবের ইচ্ছে" বলে কাটিয়ে দেওয়াটাই সহজ বলে বোধ হয় তাঁর।
No comments:
Post a Comment