Sunday, December 31, 2023

হ্যাপি নিউ ইয়ার

যারা বংপেন ব্লগের পেজটায় মাঝেমধ্যেই ঘুরে যান, তাঁদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল। আর বিশেষত যারা বানান-লেখার ভুল শুধরে দিয়ে থাকেন নিয়মিত, তাঁদের কয়েক হাজার থ্যাঙ্কিউ বললেও যথেষ্ট হবে না। একটা ঢাউস ডবল-চিকেন-রোল তাঁদের অবশ্যই প্রাপ্য। লেখালিখি কতটা দাঁড়াচ্ছে জানি না, তবে বাংলাভাষাটা শিখছি, ভুলত্রুটির ব্যাপারে সচেতন হচ্ছি; সে'টা কম কথা নয়।

নববর্ষের শুভেচ্ছা জানবেন।

আগামী বছর:

দেদার হাঁটাহাঁটি হোক। 
ইএমআই-য়ের ভার কমে আসুক।
সবার কপালে মেডিকাল ইনস্যুরেন্স থাকুক।
ভালো মন্দ খাওয়াদাওয়া থাকুক, তবে মাপা পরিমাণে।
প্রতি মাসে কিছুটা টাকা অন্তত 'সেভিংস'-য়ের দিকে যাক।
বই পড়া বাড়ুক। রোজ এক পাতা পড়াটাও ফেলনা নয়। 
ভালো ভালো সিনেমা-সিরিজ থাকুক।
ঘোরাঘুরি থাকুক। থাকুক হঠাৎ উঠল-বাই-কটক-যাই।

আবারও বলি, ধন্যবাদ।

গৌতমবাবুর বুকপকেট

১।।

 

অফিস যাওয়া  মানেই গৌতমবাবুর বুকপকেটে তিনটে জিনিস থাকবেই৷  একটা দশ-কুড়িটাকা দামের ডটপেন৷ একটা পকেট নোটবই যে'টায় অফিসের বড়সাহেবের ফরমায়েশ থেকে শুরু করে গেরস্থালীর মাসকাবারি ফর্দ আর ধোপার লেনদেন; সবরকমের হিসেবকিতেব লিখে রাখা হয়  আর একটা নীল প্লাস্টিক মোড়কে ঢাকা রেলের  মান্থলি টিকিট৷ মাঝেমধ্যে অবশ্য 'দেড়েক টাকাও থাকে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা একটু হিসেবের বাইরে চলে গেল৷

 

রোজকার মত আজও অফিস-ফেরতা ট্রেনের ভিড়ে দাঁড়িয়ে মৌজ করে ঝিমচ্ছিলেন গৌতমবাবু৷ সে একটা আধো-ঘুম অবস্থা, গৌতমবাবুর ভাষায় ডেলিপ্যাসেঞ্জারি-ট্রান্স৷ ঝিমুনি কাটল পাশে দাঁড়ানো ভাস্কর সমাজপতির আলতো টোকায়;

 

"গৌতমদা, আপনার কলমটা দিন না প্লীজ৷ আমারটার আচমকা কালি শেষ"

 

ভাস্কর পাশে দাঁড়িয়েই ইংরেজি কাগজের ক্রসওয়ার্ড পাজল সলভ করছিলেন। ভিড়ের সুবিধে হল ট্রেনের ঝাঁকুনিতেও গড়িয়ে পড়ার বিশেষ চান্স নেই, কাজেই নিশ্চিন্তে ভাস্কর সময়টা রোজ ব্যবহার করেন ক্রসওয়ার্ড সাধনায়৷ নিজের কলমটা বিট্রে করায় গৌতমবাবুর কাছে চাইতে হল। গৌতমবাবুও বিনা-বাক্যব্যয়ে বুকপকেটে হাত দিলেন কলম বের করতে।

 

কিন্তু কোথায় কলম, কোথায় নোটবই, কোথায় রেলের মান্থলি টিকিট৷

 

স্তম্ভিত গৌতমবাবু নিজের বুকপকেট থেকে একটা গ্রেনেড বের করে এগিয়ে দিলেন।

 

২।।


- "মাইরি গুরু, তুমি কিছু চিজ বটে৷ গ্রেনেড শালা কেউ পকেটে নিয়ে ঘোরে"

- "গ্রেনেডকে আমি বিড়ির প্যাকেটের চেয়ে বেশি ইজ্জত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনা"


নিজের মুখ থেকে বেরোনো শব্দগুলোয় নিজেই মেরে গেলেন গৌতমবাবু। কথায় কী অদ্ভুত ধার, কী রোয়াব! এমন মেজাজ তো তাঁর নিজেরই অচেনা। আর কোথায় ট্রেনের দুলুনি? কোথায় ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের হুল্লোড় আর ভিড়ভাস্কর আর তাঁর ক্রসওয়ার্ড পাজলই বা গেল কোথায়? একটা ঘুপচি গলির এক প্রান্তে; প্রচুর লোহার ড্রামের আড়ালে আধশোয়া হয়ে রয়েছেন তিনি। তাঁর সেই অফিস যাওয়ার চেক-চেক হাফ শার্ট আর নিখিল-দর্জির সেলাই করা নস্যি রঙের প্যান্ট পালটে গেছে। পরনে আগাগোড়া একটা মিশকালো পোশাক। মুখে কালিঝুলি। কিন্তু এই পোশাকটা গৌতমবাবুকে আদৌ চমকে দিল না, ভদ্রলোক জানেন যে তিনি এখানে কেন আছেন। দুই মাস্তানদের দলের চুলোচুলি; টাই তাঁর রোজকার জীবন। চারদিকে বোমা, গুলি চলছে; বারুদের গন্ধ আর চিৎকার-চ্যাঁচামেচি মিলেমিশে সে এক বিশ্রী অবস্থা। দৃশ্য তাঁর অতি-পরিচিত। গৌতমবাবু জানেন যে গৌতম নামটার কোনও অস্তিত্বই তাঁর জীবনে নেই; তাঁর আদত নাম গুপে মাস্তান। কিন্তু ওই ট্রেনের দৃশ্য, পাশে দাঁড়ানো সেই ভাস্কর, সেই অফিসটাইমের ভিড় ট্রেনের শব্দ-গন্ধ-দৃশ্যগুলো যেন মনের মধ্যে বড্ড বেশি টাটকা। কী অদ্ভুত। কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই জগতটায় পৌঁছে গেলেন কী করে?

সম্বিৎ ফিরল যখন একটা গুলি প্রায় কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।

পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল গুপের স্যাঙাৎ হাবলাঃ

 “আরে গুরু! এইসব কেলোর কীর্তির মধ্যিখানে তুমি অমন লেতকে শুয়ে কী ভাবছ বলো দেখি? ওপরের বাঁদিকের জানলাটার পাশে দুজন টেঁটিয়া বড় জ্বালাচ্ছে। গ্রেনেড আমি চার্জ করছি। তুমি বরং আমার রিভলভারটা নিয়ে পিঁপড়েগুলোর একটা হেস্তনেস্ত করে দাও


এই বলে নিজের পিস্তলটা গুপের দিকে ছুঁড়ে দিল হাবলা।

 

উড়ে আসা পিস্তলটা খপ করে লুফে নিলো গুপে মাস্তান। কিন্তু গুপে অবাক হয়ে দেখল যে সে যেটা লুফেছে সেটা পিস্তল নয়, একটা দলা-পাকানো নীল রঙের কাগজ।

 

৩।।

 

দলা-পাকানো কাগজ। আবছা নীল। তার ওপর কালো কালিতে লেখা চিঠি।

 

বিনয়দা,

 অপেক্ষা করব, বিকেল ৪টে। কোথায়? সে'টা তুমি জানো।

আর দেরী কোরো না। প্লীজ। বাড়ি ফিরতে দেরী হলেই বাবা খুব বকাবকি করবে।

এসো! কেমন?

 

লিপি

দলা পাকানো কাগজটাকে হাঁটুর ওপর টানটান করে মেলে, তারপর যত্নে  ভাঁজ করে বুক পকেটে রাখল বিনয়।

 

লিপি ডেকেছে,

লিপি ডেকেছে,

লিপি ডেকেছে।

বুকের ভিতরটা কেমন একটা দোলা দিয়ে উঠল। লাস্ট ক্লাসটা মিস হবে। হোক গে, লিপি ডেকেছে বলে কথা। কিন্তু কী অদ্ভুত, কিছুক্ষণ আগেও যেন এই কলেজের এই বারান্দাটা তার জীবনে ছিলনা। শুধু কলেজ কেন, লিপিও ছিল না, বিনয় নিজেও ছিলনা। কয়েক মুহূর্তের জন্য একটা অন্য জীবনে ছিল যেন সে। চারদিকে গোলাগুলি, সে বারুদের গন্ধ যেন এখনও নাকে লেগে আছে। কী অদ্ভুত।

গুপে মাস্তান কি তা'হলে কেউই নয়? হাবলা এখন কোথায় আছে? তারা কি স্রেফ উবে গেছে?

 

মাথাটা গুলিয়ে আসে বিনয়ের।

 

ধুরছাই, লিপির ভাবনায় মন দিল সে। লিপি ডেকেছে বলে কথা। একটা কিশোরকুমারের গান গুনগুন করতে করতে কলেজ ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে গেল বিনয়।

 

এমন সময় একটা পিছুডাক শুনে ঘুরে তাকালো সে। ডাকটা সুপরিচিত। অথচ যে ডেকেছে; সে কিন্তু বিনয়ের নাম ধরে ডাকেনি। অথচ কী অদ্ভুত, বিনয় জানে যে ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই।

ডাকটা বিনয়ের কানে বাজতে লাগল;

গৌতমদা, গৌতমদা! ঝিমচ্ছেন নাকি? এগিয়ে চলুন, আজ তিন নম্বরে ঢুকছে ট্রেন। আর এই যে আপনার কলমটা


৪।।

বিনয় ঘুরেই টের পেলে বুকের চিনচিনটা।

 

লিপি আসবে না।

লিপি হয়ত নেই কোথাও, অন্তত তাঁর আশেপাশে তো কোথাও নেই।

বিনয় নিজেও নেই।

 কোথায় বাহারে বাটিক প্রিন্টের হাফ-পাঞ্জাবি, কোথায় পিঠে ঝোলানো কলেজের বইয়ের ব্যাগ, কোথায় ক্লাস পালিয়ে ঘাটের দিকে ছুটে যাওয়ার হাতছানি। পরনে এখন একটা সাতবুড়ো হাফশার্ট, ট্রেনের ঘেমো ভিড়, ঠেলাঠেলি। তিনি টের পেলেন যে বিনয় তিনি নন, তিনি গৌতম। অফিস-ফেরতা এই ঝুলোঝুলিই তাঁর জীবন।

 

সমস্তটাই স্পষ্ট! তবুও লিপির না থাকার দুঃখটা বড় বিশ্রীভাবে বুকে বাজল গৌতমবাবুর। বেজার মুখে ভাস্করের হাত থেকে কলমটা নিয়ে নিজের বুকপকেটে চালান করলেন তিনি। আর তখনই তাঁকে আবারও ভেবড়ে যেতে হল।

 

বুক পকেটে ছোট নোটবই, মান্থলি টিকিটের পাশাপাশি রয়েছে একটা যত্নে ভাঁজ করা নীল কাগজ যেটা খানিকক্ষণ আগেই নির্ঘাত কেউ দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে ছুঁড়েছিল। নিজের চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে ঢোক গিললেন গৌতমবাবু।

 

সাহস করে নিজের বুকপকেটে উঁকি দিয়ে নীল কাগজটার ভাঁজ একটু খুলেই নজরে পড়ল কালো কালিতে নিখুঁত হাতের লেখায়;

দেরী কোরো না, লিপি"!

 

গৌতমবাবু বেশ টের পাচ্ছিলেন যে ওই নীল কাগজের চিঠির গায়ে সামান্য বারুদের গন্ধ লেগে আছে।