Tuesday, June 26, 2018

নির্মলবাবুর পাগলামো

এ এক বিশ্রী নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্মল আমার বন্ধু, কোথায় তাঁর পাগলামি বন্ধ করতে উদ্যত হব, তা নয়; তাঁকে রীতিমত প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি। গত তিন মাস ধরে রোজই ভাবছি; আজ আর নয়। আর কিছুতেই নির্মলের বাড়ি যাওয়া চলবে না। অথচ তবু প্রতি অমাবস্যার সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরার সময় একবার ইচ্ছে করবেই- "যাই, দেখি আজ তাঁর প্ল্যানচেট কেমন দাঁড়ায়"। অকাল্ট, তন্ত্র, তুকতাক; এ'সবে একসময় একটু আগ্রহ ছিল বটে, হয়ত সেই টানেই এখনও নির্মলের পাগলামিতে সায় দিয়ে ফেলছি। তবে উপকারের বদলে এতে ওর বেশ ক্ষতিই হচ্ছে।

আর ব্যাপারটা গোটাটাই যে ডাহা বুজরুকি; সে'টাও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজলেই ঘরের সমস্ত জানালা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে; নিজের তর্জনীর ডগাটা রাখবে বাহারি সেন্টার টেবিলটা মধ্যিখানে। আর আমায় বলবে;
"আনন্দ, তোর সমস্ত ফোকাস আর এনার্জি এই বিন্দুতে থাকা চাই, কেমন? আর হ্যাঁ; দীপার মুখটা মনে করার চেষ্টা কর। তুই তো তাকে দেখেছিস বার কয়েক। আমার দীপাকে যারা একবার দেখেছে তারা সহজে ভুলবে না। কোঁকড়া চুল, ডাগর চোখ,  ডান গালে একটা তিল, গায়ে ল্যাভেন্ডারের নরম সুবাস। ফোকাস, কেমন"?

এরপর সে 'দীপা, দীপা' বলে বিড়বিড় শুরু করবে। ঘণ্টাখানেক চলবে সেই বিড়বিড়, শেষে ঘেমেনেয়ে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়বে সে। অথচ নির্মলের সদ্যমৃতা প্রেমিকার আত্মার কোনো হদিশই মিলবে না। টেবিল নড়ে ওঠার কথা; সে'টা থাকবে স্থির। মাঝখান থেকে ঘণ্টাখানেক কেটে গেলে আমি বিরক্ত হয়ে টেবিলে চাপড় মারব আর ব্যর্থ রাগের বসে টেবিলে একটা লাথি কষাবে নির্মল। আমি ওকে তখন শান্ত করার চেষ্টা করব। এ'টাই নিয়ম। নির্মল আমার ছোটবেলার বন্ধু, আর কেউ না বুঝুক; আমি অন্তত ওকে এ অবস্থায় একা ফেলে যেতে পারব না।

আজকেও তাই হল।

- দীপা আমার সঙ্গে জাস্ট ছেলেখেলা করছে।
- তোর মাথাটা জাস্ট গ্যাছে নির্মল।
- আমি ঠিকই বলছি আনন্দ। শিমলার মনোহর সিংয়ের বাংলোয় আড়াই মাস আমি এমনি এমনি কাটিয়ে আসিনি। দু'জন মানুষের নিশ্ছিদ্র মনসংযোগ আর সঠিক তিথি ও মুহূর্ত; এই দুই মিলে অসাধ্য সাধন করা যেতে পারে; আত্মা টেনে নামানো তো কোন ছাড়। কিন্তু...কিন্তু জানিস আনন্দ; আমি দীপার আত্মার উপস্থিরি রীতিমত টের পাই।
- তোর ওই প্ল্যানচেটের সময়?
- ইয়েস। স্পষ্ট। ওর শরীরের গন্ধ আমার নাকে আসে।
- তোর দরকার একজন থেরাপিস্ট।
- আনন্দ প্লীজ, তুই আমার বন্ধু। তুই আমায় একটু সাপোর্ট করবি না?
- সাপোর্ট না করলে তোর খামখেয়ালিপনা এন্টারটেন করতে প্রতি অমাবস্যায় এখানে আসতাম না।
- আর কিছুদিন আয় ভাই,আমায় বিশ্বাস দীপা একদিন আমাদের সঙ্গে কথা বলবেই। দীপা আমায় ভালোবাসত রে, মনপ্রাণ দিয়ে। ও আসবে, আসবেই। একার কনসেন্ট্রেশনে প্ল্যানচেট হবে না; প্লীজ ভাই আনন্দ। পরের অমাবস্যায় আসিস।

প্রতিবার রাগের মাথায় নির্মলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, অথচ পরের অমাবস্যাতেই নির্মলের প্রতি একটা টান অনুভব করি। দীপার অকালমৃত্যুতে বেচারা সত্যিই বড় একা হয়ে পড়েছে। আমি ছাড়া ওর আর কেই বা আছে।

***

- হ্যালো, আনন্দ?
- বলছি। এখন কেমন আছিস তুই নির্মল?
- আগের চেয়ে ভালো। তুই ছ'মাস না এসে ভালোই করেছিস। আমার পাগলামোটা কেটে গেছে ভাই। আমি আর উন্মাদের মত প্ল্যানচেট করে বেড়াই না। দীপার আত্মা নামানোর ভূত এ'বার আমার মাথা থেকে সত্যি গেছে। তুই আসা বন্ধ করার পর আমি শিমলা গেছিলাম, মনোহর সিংয়ের কাছে। আমরা দু'জনে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। আসলে গোটা ব্যাপারটাই একটা খ্যাপামি ছিল রে, আজ বেশ বুঝতে পারি।
- যাক।
- একদিন দেখা কর প্লীজ। বুঝতে পারছি তুই আমায় এড়িয়ে যাচ্ছিস। কিন্তু আমি খুবই লজ্জিত রে আনন্দ।
- অফিসের কাজে একটু আজকাল ব্যস্ত রয়েছি রে। কিছুদিন পর না হয়...।
- আচ্ছা বেশ, পরেই না হয়।

***

নির্মলকে কী ভাবে বলব যে ওর বাড়ি যাতায়াত আমি এমনি বন্ধ করিনি। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। তাছাড়া নির্মলকে বোঝাবই বা কী; এ'টা বলব যে আমাদের প্ল্যানচেট ব্যর্থ হয়নি? ওকে জানাব যে আমার টাক মাথায় দিব্যি কোঁকড়া চুল গজিয়েছে? ডান গালে হঠাৎ করে দেখা দিয়েছে বড় একটা তিল? আর হাজারবার সাবান শ্যাম্পু ঘষে স্নান করেও আমার গা থেকে এই গা কাঁপানো ল্যাভেন্ডারের সুবাস যাচ্ছে না?

Saturday, June 16, 2018

মেসি ও মামা

- মামা গো!
- এই অসময়ে ফোন করেছিস কেন?
- অসময়? রাত পৌনে ন'টা। এখন তো তুমি সবে মশলা মুড়ি খেয়ে অ্যাপেটাইট বিল্ড করছ।
- নাহ্‌। আজ আর সে'সব করছি না।
- সে কী! শনিবার রাত তো তোমার পাঁঠার কোর্মা আর হাতরুটির রাত। প্লাস ছানার পায়েস। তা, অ্যাপেটাইট বিল্ড না করলে চলবে?
- আজ রাতে ঝিঙের তরকারি আর সয়াবিন।
- সে কী!
- বাজে কথা বলার সময় আমার নেই।
- তা খেলা দেখলে?
- হ্যাঁ। ইংল্যান্ড খুব ভালো ব্যাট করেছে।
- সে কী! মেসি মাঠে নামলে আর তুমি ক্রিকেটের রেফারেন্স দিচ্ছ মামা?
- বড্ড পেকেছিস তুই। সেদিনের ছোকরা, বড়দের লেগপুল করছিস?
- যাব্বাবা! খেলা দেখছ কিনা জিজ্ঞেস করলাম, এ'তে আবার লেগপুলের কী হল।
- শোন, এককালে ডিস্ট্রিক্ট খেলেছি। লেফট উইং। বুঝলি? তোদের মত ইএ স্পোর্টসে লম্ফঝম্প করে জ্ঞান ঝাড়ি না।
- মন খারাপ মামা? মেসির পেনাল্টি মিসে?
- মনখারাপের কী? শোন, মারাদোনা আর মেসির পর আমার মোস্ট ফেভারিট আর্জেন্টাইন চে'কে টিশার্টে নয়, বুকে রাখি। বিপ্লব কখনও পেনাল্টি মিস করে সন্ন্যাস নেয় না। আইসল্যান্ডের সঙ্গে আইসব্রেকিংয়ে সমস্যা হয়েছে, দাঁড়া আর দু'দিন। ওই নন-ন্যাড়া রোনাল্ডোর কান মুলে যদি মেসি না এগিয়েছে...।
- কিন্তু যাই বলো মামা। তেকাঠিতে প্রায় বল রাখতেই পারল না। পেনাল্টিতে অবশ্য রেখেছিল, তবে ইয়ে। গোলকিপারটা বেরসিক।
- ইনজুরিতে আজিনোমোটো ছড়াচ্ছিস? সেই জন্যেই তো ফোন করেছিস, তাই না?
- মামা, খামোখা চটছ মাইরি।
- সব বুঝি। যাক গে। এ'টা আমি জানতাম।
- জানতে?
- বাপনদা বলছিল, গ্রহের পজিশন নাকি বিট্রে করতে পারে।
- বাপনমামা? তোমার সেই তান্ত্রিক কাম জ্যোতিষ বন্ধু?
- হুঁ।
- গ্রহের পজিশনের পেনাল্টি মিস?
- মেসি একটু ভেবড়ে গেছিল তাই। মেসি একটা মাদুলি ধারণ পারলে ভালো হত। কিন্তু যাকগে। অল্টারনেট উপায় একটা পাওয়া গেছে।
- কী উপায়?
- সামনের মঙ্গলবার নিরামিষ খেয়ে মেসির নামে কালীঘাটে একটা পুজো দিতে হবে। বাপনই সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবে।
- বলো কী!
- গ্রহের ইন্টারফারেন্স কাটলেই; কচাতকচাত করে সব কচুকাটা হবে।
- মামা, তুমি মঙ্গলে নিরামিষ খাচ্ছ?
- উপায় নেই রে। উপায় নেই।
- যাব্ববা। এ তো বেশ মুশকিল হল।
- কীসের মুশকিল?
- মঙ্গলে জামাই ষষ্ঠী না? এ'বার তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে ডাকেনি? জামাইআদরের শেলফ লাইফ শেষ?
- সর্বনাশ! মঙ্গলে তো জামাই ষষ্ঠী। একদম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। এ'দিকে পুজোটা মঙ্গলেই করতে হবে। পরের মঙ্গল হলে ইট উইল বি টু লেট।
- যাক, তা'হলে কী আর করা যাবে। এ যাত্রা নিরামিষ খেয়েই কাটিয়ে দাও জামাইষষ্ঠীতে। শ্বশুরবাড়িতে জানিয়ে দাও। দুপুরে ভাত, ঝিঙে আলুর ঝোল, আর মুলো দেওয়া ডাল থাকলেই চলবে।
- খামোশ। ভামোস নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। আর রিয়েল খেলা তো ক্রিকেট রে; যে'খানে লাঞ্চ টী ড্রিঙ্কস সমস্ত আছে। ফুটবল তো ধ্বস্তাধস্তি। একটা আদ্দির পাঞ্জাবি কিনতে হবে। বেরোব ভাবছি। দেখা করবি নাকি? পাঞ্জাবি কেনা আর নন্দী হোটেলের মেটে চচ্চড়ি আর ডিম তড়কা। কী?
- তুমি অন্তর্যামী মামা। মোড়ের মাথায় দেখা করি তা'হলে? আধঘণ্টার মাথায়?
- তাই আয়। আমি একটু মশলা মুড়ি মুখে দিয়েই বেরোচ্ছি।
(ছবিঃ Pulse)

বিক্রম বেতাল


- দাদা।
- বিক্রম? আয়।
- কাজ হয়ে গেছে।
- লাশ?
- অ্যাসিড। তারপরে নদী।
- আশেপাশে?
- কেউ ছিল না। ডবল শিওর।
- গুড।
- দাদা।
- আবার কী। টাকা পাসনি?
- পুরোটাই অ্যাডভান্সে।
- তবে?
- না মানে...।
- আর কী?
- এক পেগ, হবে? আসলে এ'সব কাজের পর কেমন...।
- নার্ভাস?
- ছিঃছিঃ, তা না। তবে ওই, কেমন একটা।
- সোডা?
- শুধু জল।
- নে।
- আহ্। বাঁচালে।
- তাড়াহুড়ো কেন?
- না...এমনি।
- তাই বলে বটমস আপ?
- প্যালপিটেশন হচ্ছিল যেন। ইয়ে, হবে? আর এক পেগ?
- হবে।
- থ্যাঙ্কস।
- বিক্রম। এরপর কিন্তু আর এক পেগও নয়। কাল আবার নতুন করে কাজে নামতে হবে।
- কাল? আবার?
- উপায় নেই। থামার উপায় নেই বিক্রম।
- দাদা, আমার আর ভালো লাগছে না।
- সে কথা আগে ভাবা উচিৎ ছিল।
- তোমার দমবন্ধ হয়ে আসে না? এই বিশ্রী খেলা খেলতে?
- বিশ্রী? 
- রোজ একটা করে নতুন দেহ খুঁজে বের করে ভর করো, রোজ আমি সেই মানুষ খুঁজে খুন করি আর তারপর তুমি এখানে এসে গা এলিয়ে বসে অপেক্ষা করো আগামীকালের। নতুন দেহের।
- গা এলিয়ে বসি, নাকি? আত্মার গা?
- সরি, মানে...ওই আর কী। কিন্তু রোজ তোমায় খুন করে নতুন নতুন লাশ গায়েব করা আর তারপর এই ভূতের আস্তানায় এসে অপেক্ষা করা; কখন নতুন বডি ধরবে; কাহাতক সহ্য হবে?
- টাকা নিয়েছিস। কোনো ওপরচালাকি নয়।
- বেতালদাদা, প্লীজ। আমি আর পারছি না। আমার আর টাকার দরকার নেই।
- বেশ, শেষ খুনটা করে দে।
- তারপর?
- মুক্তি?

ছটফট করে ওঠে বিক্রম, নিজের নতুন দেহের মধ্যে তখন বেতালদাদার আত্মার পাক খাওয়া দিব্যি টের পায়। 
ফের নিজের বুকে ছুরি বেঁধানো। ফের নিজের লাশ গায়েব করা। ফের একটা মড়া বয়ে এই অন্ধকারে ফিরে আসা। রোজ রোজ নতুন শেষ খুন জমা হয়।

টাকাগুলোয় অবশ্য পরিবারটা বেঁচেছে। কিন্তু এ দুর্ভেদ্য অন্ধকার বড় অসহ্য লাগে বিক্রম গোয়েন্দার। মামুলি সিরিয়াল কিলিংয়ের কেস ভেবে বেতালের পিছনে পড়াটা মোটেও উচিৎ হয়নি।

সাহেব আর বিশ্বকাপ


বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে আমার লেভেলের ফুটবল বোদ্ধার যা প্রথমেই করা উচিৎ; তা হল
ফের "সাহেব" দেখা।

সাহেব গোলকীপার; কীপিংয়ের ট্র‍্যাজেডি সিনেমার ডায়লগেই আছে। কিন্তু ইঞ্জুরি টাইমে গোল দিয়ে এ সিনেমাকে এগিয়ে দিয়েছেন উৎপলবাবু।
মনমেজাজ বেশ গোলমেলে জিনিস, মাঝেমধ্যেই মনে হয় "সবে জলে, সব নষ্ট হয়ে গেছে। তিব্বত-লেভেলের হৃদয় নিয়ে শেয়ালদার ভীড় ট্রেনে পেষাই হয়েই এ জীবন কেটে যাবে"। তখন প্রয়োজন পড়ে আত্মার সর্বিট্রেট, মেজাজের জিভের তলায় তৎক্ষণাৎ তা না রাখলেই সমূহ বিপদ। প্যাকেজড দুঃখের ব্র‍্যান্ডিতে মন চাঙ্গা করার বেশ কিছু ফর্মুলা রয়েছে; যেমন 'ইতি তোমার মা'য়ের শেষ চিঠি বা 'সাহেব' সিনেমার এই দৃশ্যের উৎপলবাবু।
এক সৎ পিতা তাঁর পুত্রকে প্রণাম করতে চেয়েছিলেন। যে সুগভীর যন্ত্রণা আর আকাশ-ছোঁয়া গর্ব মিশে সে ইচ্ছে তৈরি হয়, তা বোধ হয় শুধু এক পিতৃহৃদয়ই ধারণ করতে পারে।

এ'দিক আর ও'দিক


ক্লাসরুমের এক কোণে বসে কেউ মন দিয়ে বুকক্রিকেটে ভেঙ্কটেশ প্রসাদকে দিয়ে ডাবল সেঞ্চুরি করাচ্ছে, আর অন্যদিকে ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক স্যার এলিয়েনদের ভাষায় আঁকিবুঁকি কেটে চলেছেন।
অফিসের গোলমালে একজন বসের ইগোর জুতোয় বুক নিঙড়ানো চেরিব্লসম ডলে চলেছেন আর অন্যপ্রান্তে বসে একজন জান লড়িয়ে দিয়েছেন ফাইলের ভিড় সাফ করতে।
একদিকে কেউ খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেলের পাল্লায় পড়ে তিতকুটে মেজাজের পুকুরে ডুবসাঁতার দিচ্ছেন আর ও'দিকে পাশের ঘরেই অন্য একজন জয় গোস্বামীর হোকাসপোকাস ব্যবহার করে নিজের পাশবালিশ কে লেভিটেট করাচ্ছেন।
আর...
ভরা গড়িয়াহাটে।
রাস্তার ও'পাশে দাস কেবিন।
এ'পাশে প্রেশার আর ওজন মাপার কাউন্টার।
মাইরি।

অক্টোবর


সাতপুরনো পুজোবার্ষিকী একসময় প্রচুর কিনেছি। একটা শুকতারার (সম্ভবত যে'টায় ভাগ্যলক্ষ্মী লটারি গল্পটা ছিল) হলদেটে পাতার এক কোণে; কালো ফাউন্টেন পেন আর কমলা স্কেচপেনে কেউ একটা শিউলিফুল এঁকে রেখেছিল। বড় যত্নে আঁকা। স্পষ্ট, জীর্ণ পাতাতেও জ্বলজ্বল করত। বইটা হারিয়ে ফেলেছি, সেই শিউলিটা রয়ে গেছে। গানের কথা গুলিয়ে গেলেও; সুরের গুনগুনে যেমন কিছু গান থেকে যায়।

আর এই 'অক্টোবর'। শীতলপাটির গায়ে ইয়ারবাডের মাথা ছোঁয়ালে যে শব্দ হবে, এ সিনেমায় তার চেয়েও কম noiseয়ে তৈরি। ঠিক যতটুকুতে ভোরের হাওয়ায় শিউলির ঝরে পড়া, ততটুকু। ততটুকুই।

তার পাশে ড্যান। ঘাসে থুতনি ডুবিয়ে শিউলি চেনা ড্যান।
Dan. Dawn. যাই হোক। গোটা ক্যালেন্ডারটাই অক্টোবর নয়। সব শিউলি 'ড্যান কোথায়?' প্রশ্নে এসে মেশে না। সমস্ত ড্যান শিউলির অপেক্ষায় শরৎ হয়ে ওঠে না।

সঠিক


চিরকাল সঠিক মানুষরা পাশে থেকেছেন। যেমন কলকাতার মেসের আন্টি।
বছরের এই সময়টা মেসে রাত্তিরে খাওয়ার পাতে একটা করে আম থাকত। সবাইকে দেওয়া হত একটা গোটা আম তিনটে লম্বা ফালি করে; খোসা-সহ।
কিন্তু আন্টি আমার 'সেনসিটিভিটি' বুঝতেন, স্নেহ করতেন। আমার পাতের পাশে স্টিলের প্লেটে থাকতো খোসা ছাড়ানো কুচোনো আম (আঁটির বাহুল্য বাদ দিয়ে); সঙ্গে ফ্রুট-ফর্ক। 
"আমাদের তন্ময়ের খোসা ছাড়িয়ে খেতে অসুবিধে হয়"
বা
"পেটির মাছ ছাড়া তন্ময় ঠিক খেতে পারে না"
বা
"আজ মাছের তেল অল্প ছিল, তেলবেগুনের চচ্চড়ি তাই শুধু তন্ময়কে দিয়েছি। ও বেচারি ঝোলটোল তেমন ভালো খায় না"।

স্নেহ ব্যাপারটা সামান্য অন্ধ না হলে চলে না। আর স্নেহে নিখুঁত অবজেক্টিভিটি হচ্ছে প্যারামাউন্টের ডাব সরবতে চোনার মত।
কপাল করে মেস-মেটদের জুটিয়েছিলাম; আমার প্রতি আন্টির বাড়তি স্নেহে কারুর কোনোদিন চোখ টাটায়নি।

Thursday, June 7, 2018

খুচরো-রবিনহুড

- খুচরো চাই?
- খুচরো?
- চাই? আছে প্রচুর।
- জানা নেই শোনা নেই। আপনি আমায় খুচরো দেবেন কেন?
- বাহ্, আধ ঘণ্টা ধরে বাসে পাশাপাশি বসে আছি। বাস ঢাকুরিয়া থেকে আলিপুর চলে এলো। আপনার খোকার নাম বিট্টা, হাফ ইয়ার্লিতে অঙ্কে কম নম্বর পেয়েছে। কতটা জানি বলুন।
- আপনি কান পেতে আমার ফোনে বলা কথা শুনছিলেন?
- হ্যাঁ। বৌদির গা ম্যাজম্যাজ। আর আজ আপনার বড়ি কিনে বাড়ি ফেরার কথা, ওই কোন সাউয়ের দোকানের বড়ি।
- এই, আপনি তো ডেঞ্জারাস লোক মশাই।
- আরে! এমপ্যাথিতে আবার ডেঞ্জার কোথায়?
- রাখুন। এমপ্যাথি। গায়ে পড়ে খুচরো দেওয়া। এই আপনার মতলবটা কী বলুন তো।
- মতলব ছাড়া কিছু করতে নেই বুঝি? কন্ডাক্টরকে পয়সা দেওয়ার সময়ই দেখলাম তো। মানিব্যাগ থেকে শেষ দশ টাকার নোটটা অফার করলেন। এখন পড়ে সব ড্যাবা ড্যাবা নোট। বড়ি কিনতে গিয়ে বড় রকমের ঝামেলায় পড়বেন তো। দিন, দু'টো পাঁচশো দিন। পাঁচটা একশো, আটটা পঞ্চাশ, পাঁচটা কুড়ি আর দশটা দশ দিচ্ছি। কড়কড়ে নোট। মাইরি।
- ধেত্তেরি। কী গায়ে পড়া লোক মাইরি। বললাম তো, খুচরো চাই না।
- সন্দেহ করছেন? জাল নোট গছিয়ে দেব?
- ট্যুয়েন্টি সেভেন্টিতে বাস করছি মশায়। মার্সেও পিকপকেট হচ্ছে। এ'দিকে আমি ফট করে মিনিবাসে এক উটকো খুচরো-যুধিষ্ঠিরকে বিশ্বাস করে ডুবি আর কী।
- কী বাতিকগ্রস্ত বলুন দেখি আপনি। হাতের খুচরো পায়ে ঠেলছেন। বাজে তর্ক না করে দিন দু'টো পাঁচশো। ভাঙিয়ে দিই, সামনেই আমি নামব।
- খবরদার। খবরদার খুচরো খুচরো করে জোর করবেন না। নয়ত কন্ডাক্টরকে কম্পলেইন করতে বাধ্য হব।
- কন্ডাক্টর কি হেডমাস্টার?
- আপনি কি ডাকাত?
- না। তবে মাইল্ড বিপদে পড়েছি স্যার। আমার খুচরো গোটা করে দিন প্লীজ। আমি জেনুইন। আমার আধার কার্ডের কপি রাখতে পারেন।
- কিন্তু বিপদটা কীসের?
- অটো যাতায়াতের জন্য সাড়ে ছয় কেজি খুচরো জমিয়েছিলাম। এই দু'হাজার সত্তর সালের মধ্যেই বেহালা মেট্রো চালু হয়ে যাবে ভাবিনি। এলিয়েনরা কী সব টেকনোলোজি নিয়ে এমন  ইন্টারভিন করল যে আমার অটো-খুচরোর স্টক এখন লায়াবিলিটি। সে কারণেই আমি এখন খুচরো-রবিনহুড স্যার। তিলে তিলে স্টক ক্লীয়ার করছি।
- বেহালা মেট্রো চালু হচ্ছে। মনখারাপ হয়ে যায় ভাবলেই। অমন ঐতিহাসিক আলসে পিলারগুলোর গায়ে কত চাপ পড়বে। নাহ, এমপাথাইজ করতেই হবে। দিন দেখি যা খুচরো আছে।

মধুময়ের হিল্লে

মধুময় জানে না ব্যাপারটা কী ভাবে ঘটে।
জানার কথাও না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই হয়।
মধুময়ের গান পায়, শুধু গান পায় তাই নয়; গলা বেয়ে গান আপনা থেকেই বেরিয়েও আসে। মধুময় জানে না ব্যাপারটা কী ভাবে ঘটে।
জানার কথাও না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই হয়।

মধুময়ের গান পায়, শুধু গান পায় তাই নয়; গলা বেয়ে গান আপনা থেকেই বেরিয়েও আসে।

সুরগুলো মধুময়ের চেনা নয়। সবচেয়ে বড় কথা; গানের ভাষাটাই মধুময় জানে না। তবু অচেনা ভাষায় নতুন নতুন সুরে নতুন নতুন গান মাঝেমধ্যে মধুময়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে। আর যখন আসে তখন সেই সুরের তোড় কিছুতেই রোখা যায় না; মধুময় গেয়ে উঠবেই। অমূল্য দাসের মুদীর দোকানে কাজ করে, হঠাৎ হঠাৎ গান পেলে বড় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে। অমূল্য দাস বা খদ্দেররাও প্রথম প্রথম ভেবড়ে যেত আর অদ্ভুত ভাষার গান শুনে, কিন্তু মধুময়ের গলায় দিব্যি সুর এসে গেছিল। ক্রমশ ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে এসেছে। এখন আর তার গানে কেউ চমকে ওঠে না, এমনিতেও 'পাগলছাগল' বলে তাকে বিশেষ কেউ ঘাটায় না।

কিন্তু গান এলেই আরো একটা ব্যাপার হয়, সে'টা মধুময় ছাড়া অন্য কেউ টের পায় না। কানের মধ্যে কারুর মিঠে খিলিখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। কোনো ছোট্টমেয়ে, নিশ্চিত। মাঝেমধ্যে আসে হাততালির শব্দ, কখনো ছোট্ট মেয়েটা কথায় বলে ওঠে, গেয়েও ওঠে; কিন্তু সেই উদ্ভট অজানা ভাষায়। ব্যাপারটা আরো গোলমেলে অন্য কারণে, মধুময় কালা। কানে কিস্যুটি শুনতে পায় না। সাত বছর বয়সে একটা বিশ্রী অসুখে কান দু'টোই গেছিল। খুকির গলা কী ভাবে শুনতে পায় মধুময়? খুকিটি কে? কোথায় থাকে?

বেশি চিন্তা করে লাভ নেই। খুকির প্রতি সামান্য মায়া পড়ে গেছে। খুকি কি তার গান ভালোবাসে?

**

শিয়াঙের বন্ধুবান্ধব নেই, কথা বলতে না পারলে যা হয় আর কী। তবে শিয়াঙ সমস্ত কথা শুনতে পারে। সে আপন মনে খেলে বেড়ায়। মাঠে, ছাদে, উঠোনে, বাগানে আর মাঝেমধ্যে চিলেকোঠার ঘরে।
চিলেকোঠার ঘরটা শিয়াঙের বড় প্রিয়। কত সাতপুরনো আসবাবপত্র সে'খানে পড়ে। ছোট্ট শিয়াঙ সবচেয়ে ভালোবাসে পুরনো ভাঙাচোরা ট্রাঞ্জিস্টরটা। সবাই অবশ্য সে'টাকে অচল বলে, অথচ শিয়াঙ সে'টার নব ঘোরালেই একই কণ্ঠে খালি গলায় বিভিন্ন গান শুনতে পায়। সে কথা অবশ্য কেউ বিশ্বাস করে না। এক ভারতীয় বিজ্ঞানী কিছুদিন শিয়াঙের বাবার অতিথি হয়ে ছিলেন, শিয়াঙের সঙ্গে বড্ড ভাব জমে গেছিল তার। যাওয়ার আগে এই ভাঙা ট্রান্সিস্টর শিয়াঙকে উপহার দিয়ে গেছিলেন।

বাড়ির সক্কলে অবাক, এমন ভাঙা ট্রান্সিস্টর কেউ কাউকে দেয় নাকি? তবে বৈজ্ঞানিকরা অমন খ্যাপাটে হয় বটে, আর উপহার যখন; তা ফেলেও দেওয়া যায় না। কাজেই তার স্থান হয়েছিল চিলেকোঠায়। 

কিন্তু উপহারটা যে কতটা ভালো তা শুধু শিয়াঙ টের পায়। রেডিওর নব ঘোরালেই একটা অচেনা পুরুষ কণ্ঠ অদ্ভুত উচ্চারণে এবং অপূর্ব সুরে গাইতে শুরু করে। কী আনন্দ হয় শিয়াঙের। খিলিখিলিয়ে হেসে ওঠে সে, হাততালি দেয় আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার; সেই গান শোনার সময় রীতিমত কথা বলতে পারে ছোট্ট শিয়াং। কেউ বিশ্বাস করে না, তা'তে শিয়াঙের ভারি বয়েই গেছে! সে গান শুনে শিয়াঙ কথা বলতে পারে; এমন কী গাইতেও পারে। 

শিয়াঙ বড্ড ভালোবাসে রেডিওর কণ্ঠস্বরটাকে।

**

- প্রহ্লাদ রে, আছিস কোথায়?
- যাক, চীনদেশ থেকে ফিরলেন শেষে। আমি ভাবলাম আর ফিরবেন না। ল্যাবোরেটরির মায়া ত্যাগ করে মানস সরোবরের আশেপাশে সাধুটাধু হয়ে ঘুরে বেড়াবেন বোধ হয়।
- ল্যাবরেটরি সাফ রেখেছিস?
- ঝকঝকে তকতকে আজ্ঞে।
- তোর জন্য একটা ভালো খবর আছে।
- সন্ন্যাসটা নিচ্ছেন? আমায় এ বাড়ি উইল করে দিচ্ছেন। ল্যাবরেটরিতে কিন্তু আমি ঠাকুরঘর করব বলে রাখলাম।
- উফফ। এ ব্যাটাকে স্নাফ গানে শায়েস্তা না করলে চলছে না। যাক গে, তোর পিসতুতো ভাই মধুময়ের কথা বলেছিলিস না? তার বড় দুঃখ সে কানে শুনতে পায় না? হিয়ারিং এডেও কাজ হয়নি? 
- নবদ্বীপে বাস। ন্যালাখ্যাপা হতে পারে, কিন্তু বড় ভালো ছেলে। আহা, কী দুঃখ তার! 
- তার একটা হিল্লে করে এলাম।
- মধুময়ের?
- নয়তো আর বলছি কী। 
- চীনদেশে গেছিলেন না নবদ্বীপ?
- চীন। অপূর্ব দেশ, ছ'মাস ধরে চষে বেড়ালাম। 
- তা'তে মধুময়ের কী লাভ? সে যে নবদ্বীপে!
- এক ঢিলে দুই পাখি। তোর মাথায় ঢুকবে না। তা হ্যাঁ রে  প্রহ্লাদ,  নিউটনকে দেখছি না যে। তার কি অভিমান হয়েছে? 

Tuesday, June 5, 2018

অগ্নীশ্বর



ছোটবেলায় অগ্নীশ্বর সিনেমাটা বড় প্রিয় ছিল। দাপুটে ক্ষুরধার চরিত্রের ডাক্তার। তাঁর প্রতিটি কথার গায়ে যতটা দেমাকের ছাপ, ততটাই তা'তে মিশে রয়েছে অবিচল সত্য যা অনবরত মানুষের মুখের উপর আছড়ে পড়ছে।

কিন্তু ছোটবেলার রুচি চিরকাল স্থির থাকবে না; সে'টাই স্বাভাবিক। ক্রমে আদত লেখাটা পড়লাম, বয়স বাড়ল। সিনেমাটাকে ওভার অ্যাক্টিংয়ের ডিপো মনে হতে লাগল। অনেক সিচুয়েশনকে মনে হতে লাগল বাড়াবাড়ি।

অথচ বয়স দেখছি অতি খতরনাক বস্তু। আর রুচি মহাখালিফা; আজ সে নজরুলগীতি গাইছে তো কাল বলিউডি ঠুমকে তো পরশু ওয়াপিস অতুলপ্রসাদ তো তরশু মুকেশের গলায় ঝুলে কান্নাকাটি।

কী মনে করে আবার অগ্নীশ্বর দেখলাম কে জানে। আবার বুক ছাপানো ভালো লাগা ফিরে এলো। সমস্ত ওভার অ্যাক্টিং স্টোরবাবুর বৌয়ের স্নেহে ধুয়ে গেল। আহা, ফটিকের সন্দেশের প্রতি যে কী লোভ, সেই সৎছেলের লোভ ভুলে তিনি কোন মুখে নিজের পথ্যে দুধ খাবেন? তাঁর প্রণাম নেননি অগ্নিডাক্তার; স্টোরবাবুর বৌ বয়সে ডাক্তারের চেয়ে ছোট, তবু তাঁর মুখের দিকে চেয়ে নিজের মায়ের বিস্মৃত চেহারার মায়াটুকু খুঁজে পান তিনি। প্রণাম নেবেন কী করে?

না স্যার, টিউশনি পড়িয়েও আমায় সিনেমা শেখাতে পারবেন না। স্টোরবাবুর বৌয়ের প্রণাম নিতে না পেরে অগ্নীশ্বর গলার মধ্যে টেনিস বল গুঁজে দেবেন। দেবেনই। আর শেষ বয়সে এসে যখন অবিশ্বাসী রুখাশুখা মেজাজের ডাক্তার দেখলেন যে ফটিক তার মাকে কাঁধে চাপিয়ে তীর্থভ্রমণে বেরিয়েছে; তখন তাঁর মুখের যে আলোময় আস্তিক হাসি ভেসে উঠল- তা দেখলে মনে পূর্ণেন্দু পত্রী মার্কা হাওয়া খেলে যাবে না? তা কি হয়? কাজ নেই আমার সিনেমা বুঝে।

বৃদ্ধ ডাক্তার আফশোস করছেন বাপের ঋণ শোধ করতে প্রতিবেশির জন্য প্রাণপাত করা দেহাতী মানুষটির সঙ্গে আগে দেখা হয়নি বলে, আমরা তা দেখে বলছি 'আহা'। নিজের ছেলে পণ নিয়েছে খবর পেয়ে সে বিয়ের আসর ত্যাগ করে উঠে আসার সময় দাঁত কিড়মিড় করে অগ্নীশ্বর বলছেন "যে দুধে কেরোসিনের গন্ধ তা গিলতে হয় তোমরা গেলো, আমি পারব না", তা শুনে আমরা বলছি "চাবুক'। সুছন্দা যে'দিন মারা গেল সে'দিন ভোরে আবহে 'তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর'র ব্যথা ছিল। 'তবু মনে রেখো'য় ডাক্তারের স্ত্রীর আলপনার মত নিষ্পাপ ভালোবাসা ছিল। পুরানো সেই দিনের কথায় হেমন্ত ছিলেন।

আর সিনেমার শেষ প্রান্তে 'ধন ধান্য পুষ্প ভরা'র সুর মিশে গেছিল "দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে, ত্রিভুবন তারিণী তরল তরঙ্গে, জয় সুর তরঙ্গিণী, মকর বাহিনী, পতিত পাবনী, মা গঙ্গে জয় গঙ্গে"র অমোঘ টানে।

সব চেয়ে বড় কথা; দেশের এবং দশের অপদার্থতায় তিতিবিরক্ত ডাক্তার অগ্নীশ্বর মুখুজ্জে শেষ পর্যন্ত এ দেশেই আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন।

আবারো বলি, কাজ নেই সিনেমার ভাষা খাতায়কলমে বুঝে। বয়সের ওজন যেন কোনোদিন সদ্য 'অগ্নীশ্বর' দেখা মনকেমনের ভার লাঘব না করতে পারে।

Monday, June 4, 2018

কলকাতার মেসিয়াহ্ - ৬



- এই যে ব্রাদার অরূপ, ঘুম আসছে না?
- এই প্রশ্নের যে কোনো উত্তরই সেল্ফ-ডিফীটিং, তাই না অজয়দা?
- সর্বনাশ। মেসবাড়িতে ফিলোসফিক উত্তর। ব্যাপারটা কী?
- আসছে না। ঘুম। অবভিয়াসলি।
- কী নাম যেন মেয়েটার? কুন্তলা?
- ধুস।
- কুন্তলা নয় ওর নাম?
- আহা, ওর নাম কুন্তলাই। কিন্তু ও আবার এলো কোথা থেকে। গরমে গলদঘর্ম, তাই..।
- লেটস সী। চিঠি দিয়েছে?
- ধ্যার।
- চিঠি এক্সপেক্ট করছিলিস অথচ দেয়নি?
- উফ, অজয়দা।
- প্রেমের কচু চেনার ব্যাপারে আমি রীতিমত শুয়োর, বুঝলি? বিকেলে চাউমিনে ডিম দিতে বললি না, ছাদে গেলি রেডিও ছাড়া; এ'সমস্তই শিওর শট সিম্পটম।
- কলকাতায় এসেছে। সে।
- কুন্তলা কলকাতায়?এই সময়? তোর না সামনে ফার্স্ট ইয়ারের এগজ্যাম? গেল পাঁচ পারসেন্ট।
- যত বাজে কথা। এ কী, আলো জ্বাললে কেন?
- হবে না, তোর এখন ঘুম আসবে না। গজার ডিবেটা এ'দিকে দে। আর খুলে বল। পটাটা থাকলে ভালো হত, প্রেমট্রেমের ব্যাপারে ওর মাথা বেশ খোলতাই।
- প্রেম কেন হতে যাবে?
- ওহ হো। তোর তো আবার সেমান্টিক অ্যালার্জি আছে। যাক গে, মাসীমা কিন্তু গজাগুলো বড় ভালো বানান।
- কুন্তলা এক হপ্তা হল এসেছে।
- থাকে তো দিল্লীতে, তাই না?
- জয়পুরে।
- ওই হল। তা, তুই জানলি কী করে? এসেছে?
- চিঠি।
- দেখা?
- করবে বলেছিল। ফোন নাম্বারও দিয়েছিল। বুথ থেকে ফোন করেছিলাম। বলল সোমবার দেখা করবে। সন্ধেবেলা।
- মানে...কালকে?
- হুঁ।
- ও, আনন্দে ঘুম আসছে না, তাই বল।
- অজয়দা, ওর গলা যেন কেমন শোনালো। দেখা করতে চায় না যেন, নেহাৎ বাধ্য হয়ে...।
- পেসিমিজম।
- গাট ফীলিং। ভাবছি দেখাটেখা করব না।
- তোর মাথায় গাঁট্টা মারলে তবে তোর বদফীলিংগুলো শায়েস্তা হবে। কোথায় দেখা করছিস? সেই আগের বারের মত? কমলা ক্যাফে?
- কথা তেমনই, কিন্তু আমি ভাবছিলাম...মানে মনে হচ্ছিল...কুন্তলা ঠিক দেখা করতে চায় না।
- রাবিশ। গজা শেষ। আর কাল দেখা করে আসিস। অবশ্যই। তারপর অ্যাসেস করব।

***

কমলা ক্যাফেতে অজয়দাও এসেছিল, অরূপের পিছুপিছু।  প্রতিবার যেমন বিরক্ত করতে আসে, আচমকা উদয় হয়। কাটলেটে ভাগ বসায়, বাজে জ্ঞান দেয়। গতবার কুন্তলা বেশ বিরক্ত হয়েছিল। তবে অজয়দা ও'সব বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না।

এ'বারে অবশ্য তেমন সমস্যা হয়নি। কুন্তলা আসেনি। অরূপের কাছে ব্যক্তিগত কোনো ফোন নেই, তাই হয়ত জানাতে পারেনি।

দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা অপেক্ষা করেছিল অরূপ। অজয়দা তারপর পাশের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।

"কুন্তলা খুব ভালো মেয়ে অজয়দা। আসলে, আমি ঠিক..." বেকুবের মত বলে ফেলেছিল অরূপ। তবে এ'বার দুম করে অজয়দাকে দেখতে পেয়ে বড় ভালো লেগেছিল।

স্পেশ্যাল মোগলাই দু'টো অজয়দাই অর্ডার করেছিল। টিউশনারি টাকাগুলো ওর কাছে বড় দামী, একদম বাজে খরচ করে না অজয়দা। ওর বাড়ির অবস্থা তেমন সুবিধের নয় কিনা। মোগলাইয়ের পর যখন দু'টো থামস আপ অর্ডার করল অজয়দা, তখন অরূপেরই গা কড়কড় করছিল। কিন্তু বারণ শুনল না। কমলা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এসে কলেজ স্ট্রীটের দে বুক স্টলে নিয়ে গিয়ে অরূপকে একটা বই কিনে দিয়েছিল অজয়দা, এ'বারও বারণ শোনেনি। শিব্রামের 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা'।

মেসে ঢোকার মুখে অজয়দা অরূপের কাঁধে হাত রেখেছিল;
"অরূপ, কুন্তলা সত্যিই ভালো মেয়ে। এ বিশ্বাস কোনোদিন নষ্ট হতে দিবি না, কেমন"?

মেসের 'বেড'টাই ক্রমশ অরূপের 'বাড়ি' হয়ে উঠছিল।

(চলছে, চলবে)

রাণু ভানু আর সুনীলবাবু



মানুষকে বোঝানোর দায় কত মানুষকে নুইয়ে দিল, কত সম্পর্ক মন্দ-উপাখ্যান হয়ে পড়ে রইল। কত গান, গল্প, কবিতার গায়ে আলো এসে পড়ল না। তবে এই সমস্ত অবান্তর সরিয়ে সুন্দরের গল্প বলতে সুনীলবাবুর মত কেউ খুব একটা পারেন না বোধ হয়। ইতিহাসের সৎ-সুবাস মাখানো ভালোবাসার গল্প। এ'দিকে সুনীলবাবুর ভাষায় বাড়াবাড়ি আবেগ নেই, কিন্তু অনুভূতির সুরগুলো কী স্পষ্টভাবে বুকে বাজে।  আবার বলা দরকার; এমন সহজ,সুন্দর, ভি-তে রাখা বাংলা যে কী অপূর্ব ভাবে প্রেমের ভাষা হতে পারে, তা টের পেতে সুনীলবাবুই সম্ভবত ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার।

ভানুদাদার মনখারাপে মনখারাপ।
রাণুর মনকেমনে মনকেমন।
সমস্ত ভানুদাদা আর রাণুর কপালে যদি সুনীলবাবুর কলম জুটত; তা'হলে কত গল্প আর কত গানের হিল্লে হয় যেত। ভানুদাদার "দুখজাগানিয়া" শব্দটা বুঝে উঠতে রাণুরও বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল; আমরা কোথাকার কে।

Sunday, June 3, 2018

ক্যালামিটি

*ক্যালামিটি*

অমিত রায়ের হাবেভাবে গায়ে পড়া ঘ্যানঘ্যান না থাকা,

উত্তমের উৎপল-কণ্ঠী ওথেলোতে সুচিত্রার চোখ ছলছল না থাকা,

আজহারের ব্যাটিং স্টান্সে গলার তাবিজের দুলুনি না থাকা,

আনন্দের শায়রির ডায়েরিতে শুকনো ফুলের স্মৃতি-ফসিল না থাকা,

'বুঝলে ভায়া'র আরামে পাহাড়ি সান্যালিস্ট আশ্বাস না থাকা,

আর

রাতের ফ্রীজে ক্ষীরকদম না থাকা।

ব্রডব্যান্ড ও কুরুক্ষেত্র


- মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের জয় হোক!
- আর ভাই সঞ্জয়! জয়ফয় বলে লেগপুল কোরো না। কুরুসেনা যে হারে প্যাঁদানি খাচ্ছে..।
- সবে তো শুরু মহারাজ। অত ইম্পেশেন্ট হলে চলবে কেন? গুড নিউজ আছে। কুরুক্ষেত্রে ট্রেন্ড পাল্টাচ্ছে।
- বটে? কী'রকম?
- শেষ খবর অবশ্য দু'ঘণ্টা আগে পেয়েছি মহারাজ। আজ পিতামহ মোমেন্টাম ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পাণ্ডব সৈন্য পালাবার পথ পাচ্ছে না। অর্জুন নিজে ভি-তে না খেলে বাধ্যে হয়ে দিলস্কুপ গোছের এলোপাথাড়ি তীর ছুঁড়ছে, তা'তেও লাভ হচ্ছে না। কৃষ্ণ রাগে ফেটে পড়ছে।
- পিজে টাইম, কৃষ্ণ রাগে ফেটে পড়লে কি ওকে ফাটাকেষ্ট বলে ডাকা যাবে?
- এল ও এল। এল ইউ এল জেড।
- যাক গে, দু'ঘণ্টা আগের খবর কেন? যুদ্ধ তো এখনও চলছে। স্ট্র‍্যাটেজিক টাইম আউট নিয়েছে একটা বড় জোর। লেটেস্ট স্টেটাস কী?
- ক্ষমা করুন মহারাজ। ব্যাসদেবের ব্রডব্যান্ড কনেকশন ডাউন চলছে।
- সর্বনাশ কাণ্ড। বলো কী? ইন্টারনেট ডাউন? রাউটারে থাবড়া মেরে রিস্টার্ট করে দেখেছ?
- লাভ হয়নি। কাস্টোমার কেয়ারে কম্পলেন করেছি, কিন্তু এখনও সুরাহা হয়নি।
- ব্যাসের যত বাতেলা। এত ডাউনলোড স্পীড রে, হ্যান রে, ত্যান রে। ধ্যার।
- স্যাড স্মাইলি ইনসার্ট করতাম চ্যাট উইন্ডো হলে।
- যাক গে। ব্রেইল পাশার সেট তৈরি হয়েছে কি? জলদি করো, ওই খেলা শুরু করতেই হবে। নয়ত একদিকে গান্ধারীর পলিটিকাল করেক্টনেসের স্টেনগান আর অন্যদিকে ওই বিদুরের চিকেন স্যুপ ফর সোল মার্কা লেকচার; আর নেওয়া যাচ্ছে না।

হোমওয়ার্ক

- একটা হোমওয়ার্ক দিচ্ছি তোকে।

- এই বয়সে হোমওয়ার্ক দেবে মামা?

- হোয়াই নট?

- শুনি।

- মতপার্থক্য প্রকাশে কোনো সিলিং নেই। এমন কী অমুকের অভিনয় বা তমুকের ব্যাটিং ভালো লাগে না; এমনটাও যত খুশি যতবার খুশি বলতে পারিস। কিন্তু রাগ বা হিউমর ঝাড়তে গিয়ে একটা ব্যক্তিগত খিস্তি দিতে হলে, অন্তত তিনজনের ব্যাপারে মন খুলে সবার সামনে প্রশংসা করতে হবে। ও হ্যাঁ, এমন তিনজনের গুণ গাইবি যাদের ব্যাপারে এর আগে পাবলিকলি তুই যথেষ্ট প্রশংসা করিসনি।  থ্রি ইস টু ওয়ান রেশিও মেন্টেন করতে হবে। অ্যাট অল টাইমস।

- বেশ। তা'হলে শোনো। বিমল জ্যাঠা চমৎকার রিদমে খৈনি ডলেন, ট্রীট ফর দ্য আইজ অ্যান্ড ইয়ার্স। মেজপিসি পনীর কুচিয়ে ভেজে তাতে পাঁপড় মিশিয়ে একটা ঝাল ঝাল রান্না করে, টেরিফিক। অখাদ্যকে উপাদেয় করে তুলতে মেজপিসিই পারে। পাশের পাড়ার গণেশ মাতাল গোপনে গান লেখে, বেশ জুতসই। এই গেল তিনটে প্রশংসা। আর এই তুমি, তোমার ভীমরতি হয়েছে। বুঝেছ মামা? ভীমরতি।

মহেন্দ্রবাবু


এই ধরুন,

তেলে টইটুম্বুর কড়াইয়ে ধবধবে লুচির ফুলে ফেঁপে ওঠা দেখতে দেখতে গেয়ে ওঠা 'সেই তো আবার কাছে এলে'।
সাইমার মটন টিকিয়ার রগরগে ঝোলের গড়িয়ে এসে রুমালি রুটির গায়ে এসে পড়া মাত্র জামার হাতা গুটিয়ে নেওয়া।

কিংবা

বালিশের তলা থেকে ছেঁড়াখোঁড়া মলাটের 'আরণ্যক' বের করে ভোরের অ্যালার্ম বন্ধ করা।
খটরমটর কফিহাউসি কবিতা-আড্ডার ভাঁওতা কাটিয়ে জানতে চাওয়া কারুর কাছে 'বিলির বুট'য়ের কমিক্স আছে কিনা।

আর
এ দুনিয়ার খটখটে রোদ্দুর সামাল দেওয়ার জন্য মহেন্দ্রবাবুর ছাতা মেলে ধরা; ভদ্রলোকের ম্যাচ শেষ করা ছক্কায়।

শোনো

- শোনো!
- এই সময় ফোন করলে? অফিস থেকে ফিরতে দেরী হবে নাকি?
- কচু। আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি, কিছুক্ষণেই পৌঁছে যাব।
- তা'হলে?
- তা'হলে কী?
- ফোন করলে কেন?
- বাহ্, ফোন করতে নেই নাকি?
- কিছুক্ষণেই পৌঁছে যাবে, অকারণ ফোনের ব্যালেন্স নষ্ট।
- আজ ফোনে একটা বড়সড় রিচার্জ করেছি!
- এ মা! কেন? কী দরকার? ক'টা ফোন করতে হয় আমাদের?
- শোনো তো। সমস্ত আউটগোয়িং কল ফ্রী। যতক্ষণ খুশি।
- সমস্ত?
- সমস্ত। তিন মাসে জন্য।
- এসটিডিতেও?
- হেহ্। হ্যাঁ। মালদায়য় ফোন করলেও ফ্রী।
- তা'হলে ঠিক আছে। তুমি অফিস থেকে ফিরলে রোজ একবার মাকে ফোন করব।
- একবার, দু'বার। যতবার খুশি।
- খুব ভালো। আমার ছোটবেলার এক বন্ধু বম্বেতে থাকে। গত পুজোয় দেখা হয়েছিল। ফোন নাম্বারও দিয়েছিল। বম্বেতে কল করা যাবে? ফ্রীতে?
- আলবাত যাবে।
- দারুণ। বেশ, আমিও একটা ভালো খবর দিই।
- ভালো খবর?
- জব্বর।
- কী'রকম?
- আজ রাত্রে বাটিচচ্চড়ি রেঁধেছি। কড়া ঝাল। খেতে বসার আগে দু'টো মামলেট ভেজে নেব। বৃষ্টির অনারে।
- তোমার জবাব নেই। তবে আমি কিছু টাকা আজ নষ্ট করে ফেলেছি জানো।
- সে কী!
- এত বৃষ্টি, ঝড়ঝাপটা। তার মধ্যে অটোর লম্বা লাইন ছিল জানো। খুব লম্বা। খুউব। তারপরে আবার একটা বাস।আর  তারপর আরও একটা অটো। ভেবেই গায়ে জ্বর এলো। কী যে হল, দুম করে একটা ট্যাক্সি ধরে ফেললাম। এক গাদা টাকা নষ্ট। ট্যাক্সিতে উঠে থেকে গা চড়চড় করছে।
- যা ঝাল দিয়েছি আজ বাটিচচ্চড়িতে, তোমার গা চড়চড় জাস্ট উবে যাবে, দেখো।
- আর মিনিট পনেরোর মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাব।
- আরও একটা জব্বর খবর আছে কিন্তু।
- বোনাস জব্বর খবর?
- আরো একটা টিউশনি পেয়েছি। এ'বার থেকে মাসে দু'দিন তোমার অফিস ফেরতা ট্যাক্সি আমি স্পন্সর করব। প্লীজ।
- ট্যাক্সি স্পন্সর করার দরকার নেই, আমার অটোজোড়া আর বাস বেঁচে থাক। আমায় পয়লা বৈশাখে নীল ছাপার শাড়ি দেবে বলেছিলে, সে'টা এ'বার হোক?
- বেশ। এ মাসের মাইনে পেয়েই গড়িয়াহাট অভিযান, কেমন?
- জী জনাব।
- এ'বার ফোনটা রাখি। মামলেটের পেঁয়াজ লঙ্কা কুচিয়ে রাখতে হবে।

শশীবাবু কলি



শশীবাবু; বিহারের গ্যাস প্ল্যান্টের শ্রমিক। ট্রাকে গ্যাস সিলিন্ডার লোড আর আনলোড করতেন। ষাটোর্ধ, ছিপছিপে তামাটে দেহ, ধবধবে সাদা চুল, পাকানো গোঁফ। মুখে সবসময় নারকোল সন্দেশের গুঁড়োর মত হাসি লেপ্টে। সিলিন্ডার ওঠানো নামানোর মাঝে যে'টুকু ফাঁকা সময়, সে'টুকু মিহি গল্পগুজবে কাটাতেন। সমস্ত শ্রমিকদের মধ্যে শশীবাবুর উপস্থিতি যেন একটু বেশি উজ্জ্বল; শান্ত। ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু নন। লোডিং-আনলোডিংয়ের কাজ টাকার দরকারে করতেন তা নয়; তার দুই ছেলে কর্মরত, ঘরে এবং গ্রামে তাঁকে সকলেই বেশ সমীহ করে চলে; ভালোবাসে। ছেলেরা মাঝেমধ্যে সকাতরে অনুরোধ করে বলে 'বাবা, এ'বারে ঘরে জুত করে বসুন। দিনের বেলা পাড়া ঘুরে বেড়ান, সন্ধ্যে হলে রামায়ণের বই খুলে আসরের মধ্যমণি হয়ে উঠুন'। শশীবাবু হেসে বলেন 'আমি ছেলেদের বলে দিয়েছি, আমার রামায়ণ হল সিলিন্ডার লোডিং আর মহাভারত হল সিলিন্ডার আনলোডিং। এ বয়সে ধর্মত্যাগ করতে পারব না রে'।

সেই শশীবাবুর বলা একটা কথা চিরকাল আমার সঙ্গে রয়ে যাবে।
"কলিযুগের ব্যাপারটা জানেন তো বাবু? আমাদের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে ঘেন্না তৈরি হচ্ছে। অনবরত। যে ঘেন্নায় মনে হয় আমি সহজেই আর একজনের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলতে পারি। যে ঘেন্নায় মনে হয় অন্যের চামড়ায় পোকা পড়ুক। তেমন ঘেন্না। আর কলির খেল সেখানেই; এই ঘেন্না একটা নেশার মত হয় দাঁড়াবে। জীবনে যথেষ্ট ঘৃণা অনুভূত না হলে আমরা ছটফট করে বেড়াব, হন্যে হয়ে খুঁজব নতুন কারণ; যদি কোনোভাবে পাশে বসা মানুষটার মৃত্যুকামনা করে বুকের জ্বালা জুড়িয়ে নেওয়া যায়"।

শশীবাবুর কলিযুগ থিওরিটা মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। দিব্যি এগিয়ে চলেছি আমরা সেই দিকে।

রাজনৈতিক মতামত এ'দিক ও'দিক হলে মনে অন্য পক্ষের মানুষগুলো জ্বলেপুড়ে গেলে দেশটা শান্ত হবে।
অন্যের প্রিয় লেখকের লেখা আমার বিশ্রী লাগলে মনে হয় সে ভক্তের চোখে গরম শিক ঢুকিয়ে দিলে সামান্য শান্তি জুটবে।
অন্তত তর্কের সময়টুকু মনে হয়ই; "ব্যাটাচ্ছেলের মরণ হয় না কেন?

একদিকে ভাষার তফাতে দমবন্ধ হয়ে আসে।
ধর্মের তফাতে লাশ ছড়িয়ে দেওয়া তো জলভাত।
অন্য দিকে পর্যাপ্ত জল নেই।
যথেষ্ট ভাত নেই।
বুক ভরে দম নেবার মত বাতাস নেই।

ভাবলে হাড়হিম হয়ে আসে যে আমার খোকার প্রতিও কেউ কোনোদিন এমন রক্তচক্ষু শানাতে পারে, সামান্য যে কোনো তফাতের সূত্র ধরে।

আর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে এই ভেবে যে নিজের অজান্তেই খোকার মধ্যে এমন কোনো ঘৃণা ইঞ্জেক্ট করে দিচ্ছি না তো যে বিষের প্ররোচনায় খোকা এমন রক্তচক্ষু আয়ত্ত করে নেবে?

রায়তা

- সঙ্গে রায়তা দেবে তো রে?
- কেন?
- বাহ্, বিরিয়ানি বললাম। সঙ্গে রায়তা দেবে না?
- ওহ্, দেবে।
- যাক।
- তবে ইয়ে।
- আবার কি? রায়তাটা অতটা ভালো নয়? বিরিয়ানির সঙ্গে আবার আমার কোয়ালিটি রায়তা ছাড়া চলে না।
- রায়তা দেয় বইকি। গেলাস ভরে রায়তা দেবে। আমি বলে দিয়েছি।
- গেলাসে দেবে? রায়তা?
- এ'টা একটু অন্য রকমের রায়তা ভাই। কালো রঙের, ঝাঁঝালো।
- কালো? ঝাঁঝালো?  রায়তা?
- আমরা এ'দিকে থামস আপ বলি। রিয়েল বিরিয়ানি পাশে সেমি-ঘোলটোল থাকলে কেমন ঘোলাটে লাগে।

নাট বল্টু



- একটাও নাটবল্টু নেই।
- একটাও নেই?
- একটাও নেই।
- তাজ্জব।
- তাজ্জব তো বটেই।
- ঠিক আমার মায়ের হাতের বাটিচচ্চড়ির  মত তাজ্জব।
- কীসের মত?
- মায়ের রান্না বাটিচ্চড়ির মত। 
- মানে?
- মানে ওই, অতিরিক্ত মশলাপাতির নাট নেই, পেল্লায় রেসীপির বল্টু নেই। তবু; দিব্যি দাঁড়িয়ে যায়।

ডাকওয়ার্থ ল্যুইস


- স্যার।
- কী হল?
- একটা কথা ছিল।
- আবার কী কথা? দস্তুরের চারটে ফাইল ক্লীয়ার করতে হবে। সন্ধে ছ'টার আগে। ক্যুইক ক্যুইক।
- টার্গেট রিভাইজ হয়েছে স্যার।
- মানে?
- রিভাইজড টার্গেট। আজ বিকেল সাড়ে চারটের আগে দু'টো ফাইল শেষ করলেই হবে। দস্তুরের অফিসে জানিয়ে দিয়েছি, তারা আপত্তি করেনি। আপনি আবার রিভাইজড টার্গেট নিয়ে বাগড়া দেবেন না প্লীজ।
- সে কী! টার্গেট রিভাইজ হল কেন?
- টেবিল থেকে মুখ তুলুন মাঝেমধ্যে। আকাশের সিচুয়েশন দেখেছেন? ছ'টা পর্যন্ত চারটে ফাইলের টার্গেট ডাকওয়ার্থ ল্যুইসে রিভাইস করে সাড়ে চারটের মধ্যে দু'টো ফাইলে নেমেছে। উপায় ছিল না যে। চলুন চলুন, চালিয়ে খেলতে হবে; চটপট শেয়ালদা না পৌঁছলেই ক্যালামিটি। কুইক কুইক।