Sunday, October 26, 2014

বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস


-   বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস।
-   হুঁ?
-   বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস।
-   এই বড়িটার নাম?
-   আমার দেওয়া। লাতিন, প্রাচীন ইজীপ্সিয়, আধ-পুরনো জার্মান আর ইনকা মেশানো নাম।
-   মানে?
-   কাঁচকলা।
-   কাঁচ...?
-   কলা।
-   এ বড়ি খেলে হবে কি ?
-   কাঁচকলা।
-   অর্থাৎ?
-   কিস্যু না। তাই কাঁচকলা।
-   স্বাদ?
-   স্বাদহীন।
-   তবে লোকে এটা খাবে কেন?
-   দুনিয়ায় কত বড়ি- ঘুমের বড়ি, সায়ানাইডের বড়ি,গর্ভ নিরোধক বড়ি, হজমি বড়ি। সব বড়িতেই কিছু না কিছু হয়। এই আমার আবিষ্কৃত বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিসই প্রথম বড়ি যা খেলে কিস্যুটি হয় না। ভালো মন্দ কিস্যু না। এক্কেবারে নিরেট কাঁচকলা। উপকারও নেই, ক্ষতিও নেই। মধ্যম পথ। বুদ্ধ বেঁচে থাকলে নিজে এনডোর্স করতেন। উকিলবাবু,আপনাকে হেল্প করতেই হবে।

Thursday, October 16, 2014

পাঁচটি মৃদু গল্প

একদিন হয়েছে কি, সল্টেড বাদামের প্যাকেটটা সবে দাঁতে ছিঁড়ে; দু চার পিস বাদাম মুখে ঢেলেছি।  
আচমকা টের পেলাম আমি বাদাম দিয়ে দাঁত চেবাচ্ছি।

Saturday, October 11, 2014

নিত্যযাত্রী

" কেউ ক্রিকেট খেলেন, কেউ রাইটার্সে ফাইল-বাজি করেন, কেউ গীটার বাজিয়ে আহা-উঁহু করেন, কেউ ভোটে দাঁড়ান, কেউ টিউশনি পড়ান। আমি করি ডেলি-প্যাসেঞ্জারি। ওইটাই হল আমার প্রফেশন বুঝলেন", সন্ধ্যে ছটা দশের আপ বর্ধমান লোকালে সদ্য আলাপ হওয়া দিলীপবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আলাপের শুরু খবরের কাগজ আদান-প্রদান দিয়ে। দিলীপবাবুর কোথায় না হেসে পারলাম না।
- " হাসছেন দাদা ?", পকেটের রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন দিলীপবাবু, " আরে মশাই , " আমার তো মনে হয় মেমারি টু হাওড়াতেই জীবন বয়ে যাচ্ছে। সকালে দু বালতি জলে স্নান আর চাট্টি ডাল-ভাত, অফিসে দুটো ফাইল আর ওপরওয়ালার খিস্তি। ওদিকে বাড়ি ফিরে বাচ্চার ঘ্যান-ঘ্যান, গিন্নীর বায়না আর টেলিভিশনে গুলতানি। এ সব তো হুশ করে হাপিশ হয়ে যায়; কিন্তু প্রত্যেক দিন যেটা রয়ে যায় সেটা হচ্ছে সাড়ে দিন ঘণ্টার ট্রেন ঘষটানি। বুঝলেন ?"

Thursday, October 9, 2014

খুচরো তফাৎ

কলেজ স্ট্রীটে ঘুর-ঘুর করছি সস্তায় পুরনো বই সটকাবার তালে। জুন মাসের বিকেল কিন্তু সদ্য বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় চনমনে হাওয়া বইছে। মেজাজ শরিফ। জলের দরে খান দুই গপ্পের বই ব্যাগস্থ করে ফেলেছি। ভাবলাম বই ঘাঁটাঘাঁটি আলতো থামিয়ে রেখে একটু চা-টা খেয়ে নেওয়া যাক। মেডিক্যাল কলেজের উল্টো দিকে; ফুটপাথের একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে বললাম- 

-“ এক কাপ চা আর একটা ডিম-টোস্ট”। 
আমার পাশে এক মাঝবয়স্ক ভদ্রলোক বসেছিলেন। আমার দিকে চেয়ে ভারি অমায়িক হাসলেন। হাসি ফেরত দিলাম।

পুজোর আট - ২০১৪

-   মহালয়া কি ডাইরেক্ট ক্যাচ করবেন বলে ঠিক করেছেন মিত্রবাবু?
-   কেন ?
-   না মানে অফিস রয়েছে কি না, অত ভোরে উঠলে আবার গোটা দিন গা-ম্যাজম্যাজ...বেলা বাড়লে বরং...আজকাল তো মহালয়ার সিডি পাওয়া যাচ্ছে
-   শুনুন মশাই, বাসি মহালয়া ইজ লাইক চালানি কাতলার ট্যালট্যালে ঝোল অমৃত আমার রুচবে না ভদ্রবাবু কাক ভোরে মেরুদণ্ডে পালক বুলিয়ে দেবেন, তবেই না থ্রিল

-   পুজোয় আমার আবার একটু বেড়িয়ে না আসলে চলে না মনটা আঁকুপাঁকু করে পাহাড়, সমুদ্র বা জঙ্গল নিদেন পক্ষে বোলপুরে গিয়ে চার দিন তা না হলে আমার চলে না, বুঝলেন কী না আপনার বোধ হয় তেমন বাতিক নেই, তাই না?
-   আমি ? পুজোয় আমার সমুদ্দুর বলতে খিচুড়ির বালতি, পাহাড় বলতে দুপুরের জগদ্দল ঘুম আর জঙ্গল বলতে পাড়ার মণ্ডপের ভিড়

পুজো ডায়েরি ২০১৩


প্রথম কিস্তি ঃ




মহালয়ার ব্যাপার-স্যাপার


মহালয়া। সলিড ভাবে ডেভেলপ করতে হবে। এক্কেবারে মার কাটারি লেভেলে জেগে উঠবো। তবেই না বাঙালি, তবেই না সোনার বাংলা। ছেলেবেলায় মনে আছে দাদু মহালয়ার আগের রাতে মন দিয়ে জোগাড় করে রাখতেনএই কটা জিনিষ:
-      টর্চ ( অন্ধকার থাকতে উঠতে হবে, সুইচ বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছোবার জন্যে)
-      রেডিও
-      অ্যালার্ম ঘড়ি
-      এক প্যাকেট চানাচুর
-      চায়ের ব্যবস্থা
ভেবে দেখলাম মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম রয়েছে। রেডিও’ও রয়েছে। এমনকি তাতে টর্চও মজুত। তোফা। চেক লিস্ট সহজ হয়ে এলো। অফিস ফেরতা এক প্যাকেট চানাচুর, গরম জলের ফ্লাস্ক আর টি ব্যাগ্‌স নিয়ে এলাম। ভোর বেলা বউকে চা বানাতে বললে আমার কোপ্তা হয়ে যাওয়ার গভীর সম্ভাবনা রয়েছে।
রাত্রি বেলা চাট্টি কাতলা ঝোল ভাত খেয়ে ফুরফুরে মেজাজে নিদ্রা গেলাম।
ব্যাটাচ্ছেলে ইমবেসাইল মোবাইল; অ্যালার্ম বেবাক ধোঁকা মেরে দিলে! এ-এম পি-এম’য়ে গড়বড় ঘটে যাওয়ায় ঘুম ভাঙল বেলার সাড়ে সাতটায়; বউ’য়ের ধমকানি তে। ধড়ফড় করে উঠে দেখি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ইতিমধ্যেই বাংলা তোলপাড় করে সরে পড়েছেন। বাইরে চড়া রোদ, অফিস যাওয়ার সময় চলে এসেছে।

মেহেরের অ্যাডভেঞ্চার

১ 

মেহেরের বুকটা ঢিপঢিপ করছিল। অনধিকার প্রবেশ ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। যদিও পেল্লায় ভাঙাচোরা এই সাতপুরনো বাড়িটার ধারেকাছেও কেউ ঘেঁষে না। সিকিউরিটি বলতেও তেমন কিছুই নেই; কাজেই ঢুকতে বিশেষ ঝামেলা পোয়াতে হয়নি তাকে। রামেসি ঠিক যেমন ভাবে বলেছিল তেমন ভাবে এগিয়েই ঢুকে পড়তে পেরেছিল মেহের। চিন্তা একটাই,  ধরে পড়লে মোটা ফাইন গুনতে হবে। 

বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটায় খানিকক্ষণ   দাঁড়িয়ে রইলে মেহের। রামেসি আসবে, সদর দরজা খোলার চাবি রয়েছে তার কাছেই। রামেসি ভদ্রলোকটির এলেম আছে বটে। সে ভদ্রলোকের বয়সেরও গাছপাথর আছে বলে মনে হয়না। এসব পুরনো ডিজিট্যাল-বাড়িগুলোর সমস্ত খবর তার নখদর্পণে। বুড়োর ব্যবসাই হচ্ছে এ সব জায়গায় বেআইনি ভাবে লোকজনদের ঘুরিয়ে আনা। শুরুর দিকে মেহের ভেবেছিল যে তার মত সতেরো বছরের কচি মেয়েকে রামেসি হয়ত পাত্তাটাত্তা দেবে না। কিন্তু আগাম টাকা হাতে পেয়ে বুড়ো দিব্যি রাজী হয়ে গেল। রামেসি যা প্রণামী চেয়েছে তাতে মেহেরের এ মাসের পকেটমানির অর্ধেকটাই বেরিয়ে যাবে। কিন্তু মেহেরের উপায় ছিল না। এ বাড়িতে তাকে ঢুকতেই হত। তার বংশের সাথে সবিশেষ ভাবে জড়িয়ে এই বাড়িটা, সে'টা সে সদ্য জেনেছে। সরকারের কাছে দরখাস্ত করলে অবশ্য এ সব ডিজিট্যাল বাড়িতে ঢোকার অনুমতি আদায় করা যায়, কিন্তু সরকারের আঠারো মাসে বছর, এই ধরণের অনুমিত আদায় করতে সময় লাগে অন্তত দু-তিন মাস। অত ধৈর্য মেহেরের ছিল না। তাছাড়া বাবাও রাজি হতেন না। রামেসির এই পন্থাই ভালো। এখন ভালোয় ভালোয় সব কিছু মিটলে হয়।

 

২ 

রামেসি এলে আধ ঘণ্টা পরে। বয়সের সত্তরের ঘরে, আশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। খুব কথা বলে। তবে এ সব ডিজিটাল-বাড়ির ব্যাপারে ওর জ্ঞানগম্যি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত।
ডিজিটাল জঞ্জাল সাফ করে এগিয়ে যেতে যেতে রামসি শুধোল; 
-  হঠাৎ তোমার এ বাড়িটায় ঢোকার ইচ্ছে হল কেন মেহের ?
- সে এক ভারি বোকা বোকা গল্প রামেসি, বাদ দাও!
- আরে আমিও মানুষটা বেশ বোকা। কাজেই বোকা গল্পের প্রতি আমার আগ্রহ অসীম। তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো। 
-  আমার দাদুর দাদুর সঙ্গে আমার দাদুর দিদিমার এখানেই প্রথম আলাপ হয়েছিল।
- বটে?
- হ্যাঁ, এই বাড়িটা ত অন্তত সোয়া দুশো বছর আগে তৈরি, তাই না? তখনকার সামাজিক আড্ডা-খানা গোছের কিছু ছিল এ'টা। ওই আদ্যিকালে যেমনটা হত আর কী। সেখানেই আলাপ তাদের দুজনের”। 
- তুমি বেশ আধ-পাগল দেখছি।
- তা হতে পারি। যাক গে, ভেতরে পৌঁছেছি কি আমরা রামেসি?  



সাবধানে ভেতরে ঢুকতে হল মেহেরকে। মেঝেময় জঞ্জাল ছড়িয়ে। পুরনো চিঠি, ছবির ফ্রেম, কত কি। ডিজিটাল রোদ তখনও ঘরের মধ্যে দিব্যি উপচে পড়ছে।  মেহেরের চারিদিকে দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল না। দেওয়ালের রঙ এখন কালশিটে নীল, একসময় কি আকাশী ছিল ?

- আচ্ছা মেহের, দু'শো বছর আগে এমন আড্ডাখানা তো আরও ছিল। তুমি নিশ্চিত এই ডিজিট্যাল বাড়িই ...?

- আমি নিশ্চিত রামেসি...অনেক রিসার্চ করে তবে খুঁজে পেয়েছি। এ'খানেই তাঁদের দেখা হয়েছিল...এবারে খুঁজে বার কর দেখি...তন্ময় মুখার্জি আর শ্বেতা দত্তগুপ্ত, এদের ঘরগুলো কোন দিকে...। 

- ওহ, সে সময় তো আবার পদবী ব্যবহারের চল ছিল...একটু সময় দাও...নেভিগেট করে বের করি...কী নাম বললে যেন ?

- তন্ময় মুখার্জি আর শ্বেতা দত্তগুপ্ত...। 

- বলিহারি সব নাম...এই তন্ময় কি তোমার দাদুর দিদা ?

- দাদুর দাদু...কথা কম রামেসি...সময় নেই বেশি...নেভিগেট করো...। 


মেহেরের লাফাতে ইচ্ছে করছিল...নেহাত রামেসি গম্ভীর মুখে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে তাই। তাঁর দাদুর দাদুর আড্ডা-ঘর।কবেকার কথা! সে সময় তো আড্ডা-ঘরের আইডিয়াটাই কত কাঁচা ছিল...।

এই ঘরটা ভূতুড়ে অবস্থায় পড়ে আছে। ডিজিটাল পোড়বাড়ির দুরমুশ হয়ে থাকা ঘরগুলো যেমন হয় আর কী!। একটা দেওয়াল জুড়ে দাদুর দাদুর একটা ছবি টাঙানো। আদ্যি যুগের মেগা-পিক্সেল ক্যামেরায় তোলা...অল্প বয়সের ছবি। মেহেরের বুঝতে বাকি রইল না সে তার বেকায়দা বাঁকা নাকটা কার থেকে পেয়েছে।
 
অন্য দেওয়াল জুড়ে ফলাও করে ঝুলিয়ে রাখা সব স্নেহের সার্টিফিকেট; সম্ভবত দাদুর দাদুর বিভিন্ন বন্ধুদের পাঠানো মেসেজ। তখন এ'সবের চল ছিল বোধ হয়। তিন নম্বর দেওয়াল জুড়ে দাদুর দাদুর নানান ছবি...সবই যৌবনের। মাঝবয়সে আসার আগেই হয়ত এই আড্ডাখানা বন্ধ হয়ে গেছিল। বন্ধুদের সঙ্গেই বেশির ভাগ ছবি। কিছু ছবি সম্ভবত তার বাপ-মায়ের সাথে। দাদুর দাদুর বাবা ও মা; মেহেরের হাসি পেল। আর ওই তো, ওই ছবিতে দাদুর দাদুর সাথে ওই প্রকাণ্ড হাসির মেয়েটি নিশ্চয়ই তাঁর দাদুর দিদা। 

লাফাতে ইচ্ছে করবে না মেহেরের ? 

- "আমার দাদুর দাদুর সাথে আমার দাদুর দিদার এখানেই দেখা হয়েছিল! আর আমি এখন সেইখানে দাঁড়িয়ে...ভাবতে পারছ রামেসি ? ভাবতে পারছ"?

- ঠিক এইখানে নয় মেহের মামনি। কম্পিউটারে...ভুলে যেও না তখনও ডিজিটাল সাইটের মধ্যে সশরীরে সেঁধিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি আসেনি। আজ থেকে দুশো-সোয়াদু'শো বছর আগের কথা এটা মেহের। তখনও মানুষ ইন্টারনেটে পড়ে রয়েছে। ডিজিটাল জগত তখন শুধু কম্পিউটারের মধ্যে। মানুষের চলাফেরা তখনও তিনটে ওই মোটা দাগের ফিজিকাল ডাইমেনশনে সীমাবদ্ধ। 

- এ মা! তাই তো!। ওঁদের আলাপ তাহলে কম্পিউটারের মধ্যে দিয়ে। কী মজা বল! তাঁর রোম্যান্স তো আরও বেশি। আমাদের এই চাইলেই যে কোনও কোন ডিজিটাল-আড্ডা ঘরে ঢুকে যে কারোর সাথে আড্ডা মারতে পারা...তাঁর মধ্যে থ্রিল কোথায় বল...উফ!কী আনন্দ যে হচ্ছে! 

- ইতিহাসের চেয়ে বড় থ্রিল আর বড় রোম্যান্স আর কিই বা আছে। তুমি তো জানো আমরা এখন যাকে ডিজিটাল সাইট বা পাতি ভাবে সাইট বলি... যেখানে আমরা সহজে ডিজিটাল কোড-কনভার্সন’য়ের মাধ্যমে সশরীরে ঢুকে পড়ি... সেই ডিজিটাল সাইট কে তখন মানুষ ওয়েবসাইট বলতো! 

- ঠিক। ওয়েবসাইট বলা হত কারণ মাকড়সার জালের মত সে সব সাইট ছড়িয়ে থাকতো তখনকার ইণ্টারেনেট প্রযুক্তিতে। শুধু কম্পিউটারে মাধ্যমে সেসবের নাগাল পাওয়া যেত। উফ! কী সব সময় ছিল বল রামেসি ? বেশ ছিল! এখন সব কিছু বড় বাড়াবাড়ি রকমের সহজ... বড় সহজে ছুঁয়ে ফেলা যায়...এই চাইলাম অমুকের সঙ্গে কথা বলতে...অমনি তাঁর কাছে গিয়ে কথা বলে চলে এলাম...ধুর... রোম্যান্স বিলকুল নেই...দাদুর দাদু আর দাদুর দিদিমা কি লাকি ছিল...।

- ঠিক বলেছো মেহের। সে সময় কমিউনিকেশন অনেক পিছিয়ে ছিল সত্যি, কিন্তু তখন সেটারও একটা মায়াবী দিক ছিল। মানুষ লিখে কমিউনিকেট করতো তখন জানো ? 

- লিখে মানে ? ওই মানে কোডেড এক্সপ্রেশন্‌স দিয়ে ? যা ভিস্যুয়ালি ডিকোড করা যেত ? তখন ছিল ? 

- নিশ্চয়ই ছিল...ওই দেরাজটা খোল...মজার জিনিস দেখতে পারবে।



ঘরের এক কোণে একটা দেরাজ রাখা। চটপট খুলে ফেললে মেহের। অসংখ্য চিরকুট। তাতে সেই প্রাচীন যোগাযোগ পন্থার নিয়মে বার্তা লেখা আছে। মেহের বুঝলে যে এই আড্ডাখানার বিভিন্ন বন্ধুরা তাঁর দাদুর দাদুকে যে সব ‘মেসেজ’ পাঠিয়েছে তা এখানে সাজানো আছে। কত লোকে কত কিছু লিখে পাঠিয়েছিল দাদুর দাদুকে...মেহেরের আচমকা মনে হলে এমন মেসেজ পড়ার আনন্দই নিশ্চয়ই আলাদা! আহা! পড়া! ব্যপারটা না জানি কত সুন্দর হবে। 

- রামেসি? এই দেখ...আমার দাদুর দাদুকে আমার দাদুর দিদার পাঠানো প্রথম বার্তা! দেখেছো ? প্লিজ দেখ! এই বার্তা দিয়েই এই আড্ডাখানায় তাঁদের আলাপ। তবেই না আমি এলাম! আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রামেসি..... ইস...আমি যদি পড়তে পারতাম! 

- আমি পড়ে দি ?

- তুমি পড়তে পার রামেসি ?

- অনেক লুকোনো স্কিল রয়েছে এই বুড়ো মগজে মামনি! দাও দেখি কী পড়তে হবে। 

তার দাদুর দাদুকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেখা দাদুর দিদার প্রথম মেসেজ খানা রামেসির দিকে এগিয়ে দিলে মেহের। 


- তোমার দাদুর দিদা লিখছেন। তোমার দাদুর দাদুকে... “ রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে দিল্লি-বাসী আমার ফ্রেন্ড-লিস্টে আছে? বাঃ! ”। বোঝাই যাচ্ছে এটাই প্রথম আলাপ! 

- আরিব্বাস! রবীন্দ্রনাথ কি অদ্দিন আগেও ছিলেন নাকি ? 

- সে কী মেহের! রবীন্দ্রনাথ যে তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো। 

- ওহ! তাই তো! আমার কেন জানি রবীন্দ্রনাথকে প্রায় আমারই কাছেপিঠের মানুষ মনে হয় গো। যাক গে! সে সব বাদ দাও। প্লিজ আরও পড়। আমি জানতে চাই দাদুর-দাদুর আমার দাদুর-দিদার সাথে আলাপ কী ভাবে এগোল!

রামেসি সমস্ত চিরকুট একের পর এক পড়তে আরম্ভ করলেন। 

৭ 

সেই প্রাচীন ইন্টারনেট আড্ডা-খানা ছেড়ে বেরোতে মন চাইছিল না মেহেরের। পুরনো সময়ের গন্ধে বুঁদ হয়ে গেছিল সে। রামেসির ধমকে বেরোতেই হল। আড্ডাখানার ভাঙ্গাচোরা ডিজিটাল ঘরখানা ছেড়ে যখন মেহের বেরিয়ে আসছে তখন তার চোখে জল। সদর দরজা বন্ধ করে রামেসি তার দিকে ফিরে হাসলে। 

- এই যে মেহের মামনি...শখ মিটল ?

- কী বলে যে তোমায় ধন্যবাদ জানাব মেহের!

- একটা স্ক্র্যাপ আমি তোমার দাদুর দাদুর ঘরের ভিতর থেকে নিয়ে এসেছি। তোমার জন্যে।

- স্ক্র্যাপ ?

- ওহ, তোমায় বলা হয় নি। এই আড্ডাখানার নাম কী ছিল জানো তো? অর্কুট। আর অর্কুটে যে লিখিত বার্তাগুলোর আদানপ্রদান হত...সেগুলো কে আড্ডাবাজরা স্ক্র্যাপ বলতো।

- স্ক্র্যাপ! বাহ!। কোন স্ক্র্যাপ টা উঠিয়ে আনলে রামেসি?

- ওই যে! তোমার দাদুর-দিদার তোমার দাদুর-দাদুকে পাঠানো প্রথম স্ক্র্যাপ। যেটা পড়ে শোনালাম! তাঁদের প্রথম আলাপ ? হে হে।  

- তোমার জবাব নেই রামেসি। 


৮ 

রামেসির দেওয়া সেই অমূল্য স্ক্র্যাপটি নিজের ডিজিটাল পার্সে রেখে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে ফের ঘুরে তাকালে মেহের। 
থমথমে ভাঙ্গাচোরা বাড়িটা অসহায় ভাবে একা দাঁড়িয়ে। এবং ওভাবেই থাকবে এই ডিজিটাল স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে, চিরকাল!  ওইখানেই তাঁর দাদুর দাদুর সঙ্গে তাঁর দাদুর দিদার প্রথম আলাপ। 

“টাটা অর্কুট” অস্ফুটে বললে মেহের।