Wednesday, May 15, 2019

খচখচ


- কী বুঝছ ভাইটি?

- ছেলেপিলেরা দেখছি বড়ই উত্তেজিত।

- কিন্তু তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ ফুর্তিতেই আছ।

- ব্যাজার মুখে থাকব কেন বলতে পারেন খুড়ো?

- তোমার মূর্তিফূর্তি এমন টেরিফিক লেভেলে ভাঙচুর করছে। সে'সব দেখে একটু নার্ভাস হবে না?

-  আদিঅনন্তকাল ধরে এই ভগবানবাজি করে করে আপনার সেন্স অফ হিউমরে মরচে পড়ে গেছে দেখছি।

- যাহ্, আমি আবার কী করলাম?

- ভ্যাপসা গরমে ছেলেপুলেগুলো ঘেমেনেয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। এ'দিকে আপনি বৃষ্টি চার্জ করার ব্যবস্থা না করে পিএনপিসি চালিয়ে যাচ্ছেন।

- বটে? মানুষ এমন গাম্বাটস্য গাম্বাট কাজ করে যাবে আর তুমি দোলনায় দুলে দুলে মাথার টিকি নাচিয়ে মজা দেখবে?

- এই যে বামিয়ানে সে'বার আপনার মূর্তিগুলো সাফ করে দিলে, আপনি এখানে বসে কোন ঘ্যাম কাজটা করেছেন শুনি?

- ঘ্যাম? আহ, ভাষাটাষা সামলে ভায়া। আর তাছাড়া আমি কবেকার পিস্, মূর্তিটূর্তির মায়া কবেই ত্যাগ করেছি। কিন্তু তোমরা হলে ইয়ং ঘোস্ট, বাঁদরদের বাঁদরামি তোমাদের স্পর্শ না করলে চলবে কেন?

- কী জানেন খুড়ো, বেঁচে থাকতে দেখেছি প্রতিটি সৎকাজে খোঁচা মারার লোকের অভাব হয়না। মোটাবুদ্ধি, মোটাচামড়া আর গবেটসুলভ আত্মবিশ্বাস;  এ'গুলোর রমরমা চিরদিনই একই রকম। আর মূর্তির মধ্যে যেহেতু আমার নার্ভাস সিস্টেম নেই; তাই তার গায়ে বিছুটি ঘষলে বা বোম মারলেও আর পরোয়া করিনা। তবে মনে ফুর্তি ঠিক নেই গো দাদা, মনের মধ্যে খচখচ তো সামান্য আছেই।

- আছে? খচখচ?

-  সত্যিই আছে। নয়ত রীতিমতো হরিতকী ফ্লেভারের পপকর্ণ আনিয়ে খেতাম৷

- তা খচখচানিটা ঠিক কী রকম নেচারের?

- বাঁদরেরা মূর্তি ভেঙে ভাববে রাজ্যজয় করলাম, তা'তে আর আশ্চর্য কী। কিন্তু ভদ্রসমাজের পেল্লায় থেকে পেল্লায়তর মূর্তি বানিয়ে 'কী দিলাম' গোছের বাতেলা দেওয়া যে কী হাড়-জ্বালানি ব্যাপার দাদা, কী বলব। ভয়ে সিঁটিয়ে আছি গো দাদা, এই বুঝি ভাঙা মূর্তির বদলে একটা ডাইনোসর সাইজের কিছু বানিয়ে ফেলবে। অথচ সে'টাকা দিয়ে...।

- যদির টাকা নদীতেই পড়বে হে। রিল্যাক্স।

Saturday, May 4, 2019

সাইক্লোন

সে এক দুর্দান্ত ঝড় আসবে। সেমি-প্রলয় গোছের কিছু। উড়ে বেড়াবে ডিশটিভির চাকতি, রাস্তায় উপড়ে পড়া গাছের ধাক্কায় তুবড়ে যাবে মারুতিভ্যানের ছাত। সে সাইক্লোন অবশ্য এখনও এসে পড়েনি। তবে সন্ধে থেকে একটানা লোডশেডিং, আর বাইরে বৃষ্টির তোড়ে ফ্যাকাসে হয়ে আসা রাতের অন্ধকার ।  খবরাখবর যে'টুকু তা জোড়া পেন্সিল ব্যাটারির ছোট রেডিওর মাধ্যমে। এ'দিকে মোবাইলের ব্যাটারি সাত পারসেন্টে নেমেছে; ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নির্ঘাৎ স্যুইচ অফ।

অনুপ সামন্ত একটানা সাতখানা হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।  কাহাতক ঠায় বসে থাকা যায়, মোমবাতির ঘোলাটে আলোয় একটানা বই পড়াও কষ্টকর। একা থাকার এই এক সমস্যা; 'জলের বোতলটা এগিয়ে দাও' গোছের কথা বলার কেউ নেই, 'দরজা জানালাগুলো চেপেচুপে বন্ধ করেছিস তো' বলে খোঁজখবর নেওয়া কেউ নেই।

মোমবাতিটা নেভানোর ঠিক আগে হাতঘড়িতে সময় দেখেছিলেন অনুপবাবু, রাত পৌনে একটা। আর আধ ঘণ্টার মাথায় সেই তুমুল সাইক্লোন শহরের বুকে আছড়ে পড়ার কথা; ইন্টারনেট স্যাটেলাইট ইত্যাদির যুগে আজকাল এ'সব খবর খুব একটা এ'দিক ও'দিক হয়না।

ঝড়ের রাতের অন্ধকারে একাকিত্ব ব্যাপারটা বেশ সহজেই গাঢ় হয়ে পড়ে বোধ হয়, আর তখন বড় মায়ের কথা মনে পড়ে। সামান্য তিন দিনের জ্বরে চলে গেল মা; এই গত বছর। ছেলের বিয়ে দেখে যাওয়ার বড় সাধ ছিল, হল না। কত কীই তো হয়না আর সেই না হওয়াগুলোই পোষা বেড়ালের মত চিরকাল পায়ে-পায়ে ঘুরবে।

মায়ের নরম শাড়ির ওম বড় মনে পড়ে, রাতে পাশ ঘেঁষে শুলে মা প্রায়ই গাইতেন "ভব-সাগর-তারণ-কারণ হে, রবি-নন্দন-বন্ধন-খণ্ডন হে"। মায়ের সে সুরে বুকে বাতাস বইত; ঝড়টড় নয়, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শেষে ছাতের টাবে রাখা নয়নতারার মাথা নুইয়ে দেওয়া মখমলি হাওয়া। সে সুরের জন্য বড় মন আনচান করে আজকাল। আর সে আনচান বাড়লেই ঘরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ফ্রেম করা ছবিটার দিকে নিবিষ্টচিত্তে তাকিয়ে থাকেন ভদ্রলোক। আজও সে দেওয়াল তাক করে টর্চের আলো ফেললেন অনুপবাবু, সে আলোয় মায়ের মুখ যেন আরো উজ্জ্বল মনে হল। নাকের নীচের অংশটুকু ধরে বিচার করলে মায়ের সঙ্গে অনুপবাবুর মুখের হুবহু মিল।

বেঁচে থাকতে মা অবিশ্যি জ্বালাতনও কম করতেন না, বেশ বাতিকগ্রস্ত ছিলেন তিনি। অফিস থেকে বেরোনোর সময়  থাকত হাজার রকমের প্রশ্ন; মানিব্যাগ নিয়েছিস তো? টিফিনবক্সের সঙ্গে আলাদা একটা ছোট কৌটে অল্প খেজুর দিয়েছি, খেতে ভুলবি না তো? ফিরতে দেরী হলে আগাম ফোনে জানিয়ে রাখবি তো? দৌড়ে বাসে উঠবি না তো? এমন আরো খানকুড়ি প্রশ্ন, রোজ। আর এমন ঝড়ের রাতে না জানি মায়ের কাছে কত কৈফিয়ত দিতে হত; বারান্দার টবগুলো ভিতরে এনে রাখা হয়েছে কিনা, ছাতে কোনো কাপড় মেলা আছে কিনা, টিভি ফ্রিজের প্লাগ খোলা আছে কিনা; এমন হাজারো প্রশ্ন বারে বারে তেড়ে আসত অনুপবাবুর দিকে। আর সেই সব প্রশ্ন আর আকুতির অভাবটা অনুপবাবুর বুকে বড় বাজছিল, বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ গলায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যেন। অবিশ্যি ঝড় শুরু হয়নি এখনও, তবে 'এনিটাইম নাউ' পরিস্থিতি।

চমকে উঠতে হল খট করে বিশ্রী শব্দটা হওয়ায়, মায়ের ছবিটা দেওয়ালের পেরেক উপড়ে মেঝেয় পড়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে কাচ। আড়মোড়া ভেঙে খাট ছেড়ে উঠলেন অনুপবাবু। মায়ের ছবিটা যত্ন করে তুলে পাশের টেবিলে রাখলেন। বড় কান্না পাচ্ছিল; এমনটা হয়, যাদের মা না থাকে; তাঁদের তো হয়ই।

তখনই খেয়াল পড়ল পাশের দেওয়ালের জানালাটা আধ-খোলা, বাতাসের শব্দে মালুম হচ্ছিল গতিবেগ বাড়ছে। ছুটে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করলেন অনুপবাবু, আর সামান্য দেরী হলেই বিশ্রী কাণ্ড ঘটত।

**

গীতাদেবী স্বস্তি পেলেন।

খোকাটা আগের মতই বেখেয়ালি রয়ে গেল, হাজারবার এক কথা কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর না করলে বাবুর কিছুতেই জরুরী কাজগুলো মনে থাকবে না। আগে তাও চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে কাজ সেরে ফেলা যেত, এখন তার বদলে বিশ্রী সব কাণ্ড ঘটাতে হয়। এই যেমন আজ এই ঝড়ের রাতে জানালার খোলা পাল্লার দিকে খোকার নজর টানতে গিয়ে নিজের ছবির ফ্রেমটাকেই ভেঙে ফেলতে হল।

Wednesday, May 1, 2019

লুডো


- বাদাম দেব নাকি?

- নেব। নিলে একদান লুডো খেলবে?

- বিক্রি বন্ধ করে তোমার সঙ্গে লুডো খেলব বিল্টুবাবু?

- চার প্যাকেট বাদাম আর দু'প্যাকেট কাঠিভাজা কিনব। প্লাস এক প্যাকেট মিষ্টিবাদাম।

- টিউশনির টাকা মেরেছ?

- মেজমাসী যাওয়ার আগে গোপনে বখশিশ দিয়ে গেল, কড়কড়ে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট।

- বেশ। তবে একদান। আমি লাল হলুদ নেব।

- বসে পড়ো।

- টিউশনির ব্যাগে লুডোর বোর্ড আর ঘুটি নিয়ে ঘুরছ। বিকেলে একলা ঘাটের বেঞ্চিতে বসে। ব্যাপার কী বিল্টুবাবু?

- চাল দাও।

- সোজা ছক্কা। বাহ্। আচ্ছা, টিউশনি কামাই করেছ?

- তা'তে তোমার কী?

- মাধ্যমিকে ফেল করবে?

- ফার্স্ট ডিভিশন কেউ আটকাতে পারবে না।

- বিকেলে ঘাটে বসে লুডো না খেললে আরো দু'নম্বর বাড়ত।

- দু'প্যাকেট বাদাম না হয় বেশি নেব। ঘ্যানঘ্যান বন্ধ করবে?

- একশো টাকার খবরটা ভাঁওতা নয় তো?

- বুকপকেটে খসখস করছে। তাজা নোট। এই দ্যাখো।

-  বুকে না হয় একশো টাকার নোটের খসখস। গলায়?

- খেলতে হবে না তোমার লুডো। তোমার বিক্রির সময় নষ্ট করে এ'খানে বসতেও হবে না। এই সময় নদীর ধারে কত মানুষজন আসে। কত লোকে বাদাম কেনে। তুমি এসো'খন।

- টিউশনি?

- একটু দেরী হয়ে গেছে। তবে যাব।

***

- বাবা, এই অসময়ে অফিসে চলে এলে?

- এমনি আসিনি। সঙ্গে লুডোর বোর্ডও আছে। এই যে।

- কিন্তু বাবা, এখন আমি ব্যস্ত..। একটু জরুরী মিটিং আছে সন্ধেবেলা।

- টুক করে এক দান খেলে নেব। আমার লাল হলুদ।

- কিন্তু বাবা...।

- না হয় এখন ভালো চাকরী করো। তাই বলে বাৎসরিক ট্র‍্যাডিশনকে ল্যাং মারবে বিল্টুবাবু? 

- পাক্কা এক দান কিন্তু। কনফারেন্স রুমে চলো।

- ভাগ্যিস সে'দিন ঘাটের ধারের বেঞ্চিতে স্পট করেছিলাম।  নয়ত খামোখা মনখারাপে টিউশনে ফাঁকি পড়ত।

- সে এক ইতিহাস। কিন্তু বাবা, নিজের বাদাম বিক্রি বন্ধ করে লুডো খেলাটা ফাঁকিবাজি নয়?

- আমার মনখারাপটা মনখারাপ নয়?

- আজ আমার শুরুতেই ছক্কা।

- মেজমাসীর বখশিশটা সেই কবে থেকে আমার পাওনা।

- হেহে। বুক পকেটে কড়েকড়ে টাকার খসখস? শুনবে?

- আর গলায়?

- বাবা, এই দিনটা খুব খারাপ। তাই না?

- খুউব। ধুস, আমার আবারও পুট...তোমার মা এমন ধুপ করে চলে গেলো তার আগের বছর, বিল্টুবাবু। তবে আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম।

- জানি বাবা। বারবার এ কথা বলো কেন?

- এ দিনেই সে চলে গেছিল। প্রতিবছর এ দিনটাতেই তাই..তাই বার বার বলতে ইচ্ছে করে..। আর তাই বছরের এ দিনটায় বাদাম-বিক্রি বন্ধ রাখলেও তা'তে ফাঁকি নেই..।

- বাবা, এই কনফারেন্স রুমে লুডো কী বেমানান। মেজাজটাই মাটি।  চলো ঘাটের বেঞ্চিতেই যাই, সে'খানে লুডো পেতে বসি।

- ও মা, তোর সন্ধেবেলার মিটিং?

- বছরের এ দিনটায় মিটিংয়ে ডুব দিলেও তা'তে ফাঁকি নেই..।

- তা'হলে চটপট!

- ঝটপট!

- আচ্ছা বিল্টুবাবু, ছোট্টবেলায় ঘাটের সেই বেঞ্চিতে তুমি মায়ের সঙ্গে প্রায়ই রাত্রে এসে বসতে। মা তোমায় জড়িয়ে কীর্তন গাইত। বিক্রিবাটা শেষে আমি পাশে এসে বসতাম..তুমি ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত মায়ের গান থামত না। আমি সেই সুরে দুলে দুলে পয়সাকড়ি গুনতাম। তারপর ঘুমন্ত বিল্টুবাবুকে কোলে নিয়ে বাবা-মা ঘরে ফিরত...তোমার মনে পড়ে? বিল্টুবাবু?