Saturday, May 30, 2020

"দ্য লোল্যান্ড" প্রসঙ্গে


যিনি "দ্য লোল্যান্ড" রেকমেন্ড করেছিলেন তিনি এককথায় এ উপন্যাস সম্বন্ধে বলেছিলেন; "বিষাদসিন্ধু"।

বিষাদসিন্ধুতে যে মিঠে রোদ্দুর এসে মিশেছে, সে'টা টের পেতে হল বইটা পুরো পড়ে। ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখা আমি সদ্য পড়েছি। কিছুদিন আগে পড়েছিলাম 'নেমসেক' আর দু'তিনদিন আগে শেষ করলাম নেমসেক। সে বই সম্বন্ধে চারটে মনের কথা।

১।

কলকাতা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে ক্লিশেয় মাখামাখি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মনে রাখতে হবে যে লাহিড়ীর পাঠক আন্তর্জাতিক; তাঁদের কাছে যে ধরণের কলকাতা বিষয়ক ডিটেলিং চমৎকার  ঠেকবে, বাংলার (এবং কলকাতার) বাঙালির কাছে সেই ডিটেলিংই ক্লিশে ভারে ক্লিষ্ট মনে হতে পারে৷ কিন্তু লাহিড়ীর গুণ সে'খানেই। তাঁর বর্ণনা প্রায় নিখুঁত, বাহুল্যবর্জিত আর তাঁর ভাষা প্রাণবন্ত।  কলকাতার যে'টুকু তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে, সে'টুকু পড়লে আজীবন কলকাতায় বন্দী কোনও মানুষেরও দিব্যি ভালো লাগবে বলে আমার মনে হয়। অফিস যাওয়ার পথে রোজ টালিগঞ্জ পেরিয়ে যাই, এ বইতে টালিগঞ্জ একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ক'দিন ধরে যখনই টালিগঞ্জ পেরোতে হয়, 'দ্য লোল্যান্ড'য়ের সুভাষ, উদয়ন আর গৌরীর কথা মনে পড়ে। বেলা নামের এক কিশোরীর কথা মনে পড়ে যার টালিগঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ মাত্র কয়েকদিনের। আর হ্যাঁ, নেমসেকের কলকাতার তুলনায় লোল্যান্ডের কলকাতার ব্যপ্তি অনেকটা বেশি। 

 ২। 

বিষাদে মিঠে রোদ্দুরের ব্যাপারটা সামান্য খোলসা না করলেই নয়। লোল্যান্ডে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র গৌরী। সে আদর্শ বলে নয়। বরং তাঁর ভুলভ্রান্তিগুলোই এ উপন্যাসের মূল রসদ। সত্যি কথা বলতে কী উপন্যাসের মূলে রয়েছে একটা অস্থির সময় আর ক্যাটালিস্ট হয়ে উঠেছে গৌরীর অন্ধকারটুকু। কত মানুষের ঘেন্না, রাগ আর বিরক্তি সামাল দিয়ে গৌরী পথ হেঁটেছেন। একদিকে যেমন ভালোবেসেছেন, অন্যদিকে প্রকাণ্ড সব ভুলও করেছেন৷  হলফ করে বলতে পারি যে একসময় পাঠকের সমস্ত রাগ এসে পড়বে গৌরীর ওপর। কিন্তু সেই উপন্যাসের এই কাল্পনিক চরিত্রটি যেন ভালো থাকে, যেন সামান্য স্বস্তি খুঁজে পায়; এ আশাটুকুও পাঠকের বুকের মধ্যে আনচান তৈরি করবেই। লাহিড়ীর লেখায় যে অসাধারণ 'এমপ্যাথি' রয়েছে, তার মাধ্যমেই গৌরীকে ভালোওবাসবেন কিছু (বা বেশিরভাগ) পাঠক। 

৩। 

বাপ-ছেলের সম্পর্ক নিয়ে কত লেখা পড়ি। বাপ মেয়ের ভালোবাসাটুকুর ওম অনুভব করার জন্য এ বই হয়ত আবার পড়ব। সুভাষের বেলাকে আঁকড়ে রাখা আর বেলার ভেসে যেতে চেয়েও ভেসে না যাওয়া, এ'সবটুকুর মধ্যেই সুভাষের ভালোবাসা। হেঁয়ালি বা স্পয়লার নয়; তবু বলি যে সুভাষ সে অর্থে বেলার বাবা নন৷ আবার সুভাষ যে ভাবে বেলার পিতা হয়ে উঠতে পেরেছেন, বাপ-মা দু'জনের ভালোবাসা জুড়লেও বোধ হয় সুভাষের স্নেহের গভীরতার সঙ্গে তুলনা চলেনা।  হয়ত এমন একটা সময় আসে যখন বৃদ্ধ বাপ-মা সন্তানের স্নেহের মধ্যে আশ্রয় খোঁজেন৷ সুভাষকে সে আশ্রয় দিয়ে নিজের বুকে টেনে নিয়েছিল বেলা, মায়ের মতই। বুকে টেনে নিয়ে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সে বাপ কা বেটি আর কী। 

৪। 

গল্পের পরিসর চল্লিশের দশকের কলকাতা থেকে ইন্টারনেট সমৃদ্ধ আধুনিক দুনিয়া। এসেছে নক্সাল আন্দোলন প্রসঙ্গ৷ এসেছেন উদয়ন নামের এক উজ্জ্বল তরুণ, হারিয়েও গেছেন৷ খুন হন উদয়ন, নিজের বাবা মা ও স্ত্রীর চোখের সামনে। সে মৃত্যুর মেঘ আবছায়ায় ভরে দিয়েছে গোটা উপন্যাস। সে মৃত্যুর যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছেন উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র। উদয়নকে ভালোবাসা প্রতিটি মানুষ সে যন্ত্রণায় একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রইলেন অথচ একে অপরের হাত ধরতে পারলেন না। সেই পাহাড়প্রমাণ মনখারাপের মধ্যেই এই ভালোবাসার উপন্যাস। বার বার ফিরে এসেছে উদয়নের মৃত্যু, উপন্যাস শেষও হয়েছে সেই মৃত্যু আর একটা ব্যর্থ আন্দোলনের যন্ত্রণায়৷ কিন্তু মৃত্যু আর যাবতীয় ব্যর্থতা পেরিয়ে এ উপন্যাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ভালোবাসা আর কলকাতার গল্প৷

Sunday, May 24, 2020

দাদার লাইব্রেরি

- দাদা।


- কী ব্যাপার পিলু? এত রাত্রে?


- মনে হল তুই হয়ত এখনও ঘুমোসনি। তাই ভাবলাম যাই একবার...।


- আয়। বস।


- কী পড়ছিস?


-  ইংরেজি নভেল পড়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ভাবলাম একটু শরদিন্দু ঝালিয়ে নিই। তোর ডিনার হয়েছে রে পিলু?


- দাদা। রাত ক'টা বাজে সে খেয়াল আছে? পৌনে একটা৷ আর নীলাকে তো জানোই, রাত ন'টার মধ্যে খাওয়াদাওয়া না করলেই এক্কেবারে হুলুস্থুল শুরু করবে।


- নীলার শাসনে আছিস তাই কোলেস্টেরলে পিষে মারা যাসনি এখনও। 


- ছেলেবেলায় মায়ের শাসন। আর এখন বৌয়ের। তোর তো আর সে বালাই নেই, বেশ আছিস।


- বৌ না থাক। বই তো আছে। আর বইও শাসন করে, সোহাগও করে। এই লাইব্রেরি কত সাধ করে বানানো বল দেখি।


- তা বটে। টিকলিকে তো আমি বারবার বলি, জ্যেঠুর লাইব্রেরিতে যা৷ দু'টো বই উল্টেপাল্টে দেখ৷ তোর মত ভোরেশাস রীডার না হোক, মাঝেমধ্যে দু'একটা বই তো পড়তেই পারে বলো। কিন্তু না। সে দিনরাত শুধু ওই মোবাইলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। 


- দিনকাল পাল্টেছে। বইটাই তো আজকাল একমাত্র রিসোর্স নয়। তুই বরং ওকে জোর করিস না। 


- জোর করলেও সে মেয়ে পাত্তা দেবে নাকি৷ ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ। তার ওপরে সদ্য কলেজে যাওয়া শুরু করেছে, তা'তে বাড়তি আর এক জোড়া ডানা গজিয়েছে। 


- পিলু। বুড়োদের মত খিটখিট করিসনা। নতুনদের সব খারাপ আর আমাদের সব ভালো, এ'সব ন্যাকাপনা আমার অসহ্য লাগে। বাড়িতে এত বড় লাইব্রেরি, তুইই বা ক'টা বই পড়েছিস গত দু'বছরে?


- ব্যবসাপত্তর সামলে আর পড়ার সময় কোথায় বল৷ আমার ওই ইকনমিক টাইমসই ভালো। তা দাদা, আর কতক্ষণ পড়বি? এত রাত হল...।


- পড়ার জন্য এই রাতটাই ভালো সময় বুঝলি। দিনের গোলমালে বরং ফোকাস নষ্ট হয়। তা হ্যাঁ রে পিলু, তোর চেহারাটা এত শুকনো লাগছে কেন?


- ও তেমন কিছু না।


- তুই আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট পিলু। কাস্টোমারদের ফাঁকি দিয়ে বাড়তি দু'পয়সা কামিয়ে নিচ্ছিস নে, আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবি না। 


- বাজারের যা অবস্থা। ডিপ্রেশন,  মিসগভার্নেন্স, শেয়ারমার্কেট রক্তারক্তি। তার ওপর কোরাপশন; গত বছরখানেক ধরে ব্যবসাটা যে কী'ভাবে চালাচ্ছি তা আমিই জানি। 


- পিলু, আমি দেখি তো তোর ব্যস্ততা।  আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি তুই উদয়াস্ত কী পরিশ্রম করিস। শোন, আমি তোর দাদা। এক বাড়িতে আমরা থাকি। আমি একতলায় তুই দোতলায়, অথচ দিনের পর দিন আমাদের দেখা হয়না৷ এই যে তুই আজ মাঝরাত্রে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলি, কী ভালোই যে লাগল। রোজ আসিস না কেন? নীলা বারণ করে? 


- সে'সব কথা থাক দাদা।


- যাকগে, ব্যবসার সমস্যা কথা কিছু বলছিলিস। 


- দাদা, বাড়তি কিছু টাকা ঢালতে না পারলে ব্যবসাটা ভেসে যাবে। টিকলি আর নীলাকে নিয়ে যে কী বিপদে পড়তে হবে আমায়..। আর দুম করে টাকাটা আমি কী করে জোগাড় করব বল।


- পিলু। তুই কি ফের বাড়ি বিক্রির কথা বলতে এসেছিস?


- গোটা বাড়িটা আমরা বিক্রি কেন করব দাদা? তুই কী ভাবিস, এ বাড়ির প্রতি আমার টান নেই? তোকে তো আগেও বলেছি কতবার; শুধু একতলার এই উত্তরের দিকটা বেচে দেব। লীগাল দিকটা অলরেডি দেখে নিয়েছি৷ আর দ্যাখ, এত বড় বাড়ি মেন্টেন করা এমনিতেও আমার পক্ষে..। তাছাড়া লাহাদের অফারটা লুক্রেটিভ। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলতে চায়। পোজিশন ভালো, মার্কেট রেটের আড়াইগুণ অফার করেছে। 


- পিলু..।


- প্লীজ দাদা..আমার কথাটা ভাব একবার...।  শুধু তো এই একতলার উত্তর দিকটা..।


- কিন্তু এই সে'খানেই তো আমার এই লাইব্রেরি পিলু...এই লাইব্রেরি ভাঙলে আমি কোথায় যাব...। এই বইগুলো ছাড়া তো আমার আর কিছুই নেই। 


- প্লীজ। আমার জন্য একটু ভেবে দেখবি?


- কথাটা তুই তো আগেও বলেছিস। বহুবার। আমার উত্তরও তো তুই জানিস। এ লাইব্রেরি আমি ছাড়তে পারব না। আর আমার জোর করিস না, ফল ভালো হবে না।


- তুই আমার কথাটা একবারও ভাববি না দাদা?


- আমি তোর চোখের দিকে তাকিয়ে তোর মনের কথা টের পাই পিলু। আজও আমি সে'টা পারি। এ লাইব্রেরি নষ্ট করতে তুইও চাস না, তা আমি বেশ বুঝি। আর শোন, নীলাকে বলে দিস। এ লাইব্রেরি আমি কিছুতেই ছাড়ব না।


- আমি আসি দাদা। অনেক রাত হল।


- পিলু।


- কিছু বলবি?


- তোকে সত্যিই বড় শুকনো দেখাচ্ছে রে। শরীরের অযত্ন এ'বার একটু কম কর। আর...আর মাঝেমধ্যে আসিস  আমার ঘরে, কেমন? না হয় রাত্রের দিকেই আসিস, নীলারা ঘুমোলে। কোনও বাড়ি বেচার মতলব ছাড়া আসিস কখনও। দুই ভাই মিলে না হয় একটু খোশগল্প করা যাবে। আসবি পিলু?


- গুডনাইট দাদা। 


***


- নাহ্। দাদার সেই একই গোঁ। লাইব্রেরি সে ছাড়বে না। 


- যত বাজে কথা। এ সব তোমারই বদমায়েশ।


- কী যাতা বলছ নীলা?


- আমি ঠিকই বলেছি। তুমিই ওই লাইব্রেরির মায়া ত্যাগ করতে না পেরে লাহাদের অফার রিফিউজ করছ। আর সে'টা চালাচ্ছ দাদার নামে।


- কতবার বলব, আমি দাদার লাইব্রেরি সহ বাড়ির ওই অংশটা বেচে দিতে চাই। কিন্তু দাদা অ্যালাউ না করলে..।এইতো, আজও দাদা বললে, লাইব্রেরি হাতছাড়া হলে তার ফল ভালো হবে না। 


-  যত্তসব বাজে কথা। 


- বাজে কথা?


- বাজে কথা নয়? দু'বছর আগে যে মানুষটা মারা গেছে তাকে নাকি তুমি শুধু দেখতে পাও। আর চাইলেই তাঁর সঙ্গে গল্পগুজব করে আসো। আর সে নাকি বাড়ি বিক্রি আটকাচ্ছে...। আমার মেজদা বললে হালিশহর থেকে ওঝা নিয়ে এসে হিল্লে করে দেবে। তা'তেও তোমার আপত্তি...তোমারই কোনও মতলব আছে..।


- শোনো নীলা। দাদা আজীবনের কমিউনিস্ট।  ধান্দাবাজ পলিটিকাল ফায়দা লোটা লোক নয়, মনেপ্রাণে কমিউনিস্ট।  মরার আগে উকিল ডেকে এমন লিখিত ব্যবস্থা করে গেছিল যাতে কেউ ধর্মমতে ওঁর শ্রাদ্ধ না করে। সেই কম্যুইনস্ট দাদার আত্মাকে আমি ওঝা লাগিয়ে বাড়িছাড়া করব গো নীলা? ধর্মে সইবে?

Tuesday, May 19, 2020

বংঈটসের বিরিয়ানি রান্না প্রসঙ্গে

এই অসময়ে মনখারাপ হলেই সর্বকালের অন্যতম সেরা (এবং জরুরী) ভিডিও অর্থাৎ  বংঈটসের কলকাতা বিরিয়ানির রেসিপিটা লূপে চালিয়ে দিয়ে একটানা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকছি আর "মার্তণ্ড মার্তণ্ড মার্তণ্ড" রিদমে "বিরিয়ানি বিরিয়ানি বিরিয়ানি" বিড়বিড় করছি।

এই রেসিপি ভিডিও সম্বন্ধে কয়েকটা মনের কথা না বললেই নয়। 

১। ভিডিওর গোড়াতে বিরিয়ানির হলদে আলু নরম সুরে ভাজা হচ্ছে, তারপর পেঁয়াজের 'বিরিস্তা'। মনে তখন শ্যামল মিত্তিরে ফুরফুর। 

২। তারপর বিরিয়ানি মশলা তৈরি। সে কী থ্রিল!  আর্কিমিডিস চৌবাচ্চা-স্নান যেন নিজের চোখের সামনে দেখতে পারছি। সামান্য তুকতাকে যে কী ঘ্যামগোত্রের বিগব্যাং ঘটতে পারে..আহা।

৩। এরপর পাঁয়তারা পক্ষের শেষ, অ্যাকশন পক্ষের শুরু। মাংসের ম্যারিনেশন। দই,মশলাপাতি দিয়ে মাংসমাখা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল এইবেলা গভর্নমেন্টের উচিৎ আইন করা; যাতে নজরুলগীতি বা বাউল না গেয়ে কেউ যেন ম্যারিনেশনের মাংস না মাখে। 

৪। সরু লম্বা চালের ভাত দেখলে এমনিতেই মনে হয় পৃথিবীতে আজও কতটা গভীর রোম্যান্স জমে আছে। আর যে চাল বিরিয়ানিতে গিয়ে ঠেকবে, তা সেদ্ধ হতে দেখা তো মেডিটেশনের ঠাকুরদা। ভিডিওর এ জায়গায় আমি বুকে পাশবালিশ টেনে নিই।

৫। যথাযথ ম্যারিনেশন শেষে কষা হয় মাংস, বুকে নামেন কবীর সুমন আর উথাল-পাতাল প্লাস ভাবনা নেশায় চিন্তামাতাল। 

৬। বিরিয়ানি দমে বসানোর আগে মশলাপাতি, আতর, কেওড়ার জল, গোলাপজল, কেশর, ঘি মাখন, খোয়া ইত্যাদি নিয়ে যে জটিল অ্যালকেমিটা ঘটে, তা দেখে ভরসা পাই। নাহ্, রক্তচোষা শয়তানি বা নিরেট ধান্দাবাজিটুকুই মানুষের শেষ পরিচয় হয়ে থাকবে না। যারা বিরিয়ানি বানাতে পারে, তারা নেহাৎ ফেলনা নয়; ভালোবাসা তাদের মজ্জায়। 

৭। জাদুকর দর্শকের চোখের সামনে পর্দা টানবেনই৷ অথবা হয়ত কাউকে পুরে ফেলবেন একটা ঢাউস আলমারিতে। সেই আড়ালটাই ম্যাজিকের আত্মা৷ ঢাকা পাত্রের আড়ালে ভাত মাংসের অঙ্কমাপা মিলনে জেগে উঠবেন মহানায়ক। সবার অগোচরে বিরিয়ানি-অরিন্দম বলে উঠবেন "আই উইল গো টু দ্য টপ, টু দ্য টপ, টু দ্য টপ"! 

ভিডিওটা দেখে মনের মধ্যে থেকে স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে। মাংস ভাত মিলিয়েমিশিয়ে যা নয় তাই পোলাও গোছের কিছু করে আর বলার চেষ্টা করব না " আজ বাড়িতে বিরিয়ানি বানিয়েছি"। 
সাধনায় শর্টকাট আর কবিতায় গাইডবই; চলে না৷ 

মনখারাপ যতই জমাট হোক, এ ভিডিও একটানা বার দশেক দেখলেই মনে হয় কোনও পাহাড়ি গ্রামের ঝকঝকে রাত্রির আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছি। 

সাবাশ বংঈটস। 

আরসালানে সিরাজে বা আমিনিয়ায় যারা মেগাস্কেলে নিয়মিত এ ম্যাজিক হাঁকাচ্ছেন; তাঁদের সেলাম।

***

ভিডিওটা নতুন নয়। প্রায় বেশিরভাগ মানুষই আশা করি বহুবার দেখেছেন।  তবু লিঙ্কটা দিয়ে রাখলামঃ

https://youtu.be/SbWGXcZTYzg

Sunday, May 17, 2020

বসের প্ল্যান

- বস!

- বলে ফেলো দত্ত।

- বলছি, সেলসটীম খুব রেস্টলেস হয়ে উঠছে, মেমোটা এবার ইস্যু না করলেই নয়। 

- কীসের মেমো?

- ওই যে। সামনের কোয়ার্টারের সেলস টীমের টার্গেট। ছেলেরা হপ্তাখানেক ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে কিনা...। 

- সেলসের ছেলেপিলে; প্রয়োজনে লোহাকুচির চচ্চড়ি দিয়ে ভাত মেখে খাবে, মনুমেন্টের মাথায় মশারি টাঙ্গাবে, জিরাফের গলায় নেকটাই পরাবে। মেমোটেমোর মত নেকু জিনিসে তাদের কাজ কী। 

-  বস, যাই বলুন। এত হাই টার্গেট সেট করা হচ্ছে আজকাল। আগাম টার্গেট মেমোটা পেলে ছেলেমেয়েগুলো একটু আগেভাগে প্ল্যান করে নিতে পারত। একটু প্রস্তুত হতে পারত। তাছাড়া এই মেমোতে শুধু যে টার্গেট আছে তা তো নয়। ইনসেন্টিভ পাল্টে যাচ্ছে। অনেকের চাকরীবাকরী নিয়েও টানাটানি হতে পারে, অন্তত মেমোর ড্রাফট পড়ে আমি তেমনই বুঝছি। 

- দত্ত, তোমার চাকরী নিয়ে তো টানাটানি পড়বে না। তুমি খামোখা অত মাথা ঘামাতে যাচ্ছ কেন?

- কিন্তু এই লুকোছাপাতে সেলসটীমের মনবল একটু...একটু...।

- সেলসটীমের মনোবল দিয়ে কোন কাঁচকলাটা হবে দত্ত? ইয়ার এন্ড রিভিউতে বাহাত্তর খানা স্লাইড জুড়ে দলের মনোবলের বাহার দেখাব? 

- বস। আপনি গুরু, আমিই গরু। তবে পারমিশন দিলে সামান্য হাম্বা করি। 

- বলে ফেলো। 

- সেলস টীমের মনোবল ইস ডাইরেক্টলি প্রপোরশনাল টু সেলস নাম্বার, তাই না?

- উইথ ডিউ রেস্পেক্ট টু ইয়োর হাম্বা, মাই ডিয়ার দত্ত। মনোবল মানেই পার্ফরমেন্স; ওই টেম্পারামেন্ট নিয়ে এইচআরে গিয়ে বাতেলা ঝাড়ো গিয়ে। সেলসটীম সামলানো তোমার কর্ম নয়। 

- মনোবলের সঙ্গে পার্ফরমেন্সের যোগাযোগ নেই বস ? 

- মনোবল দিয়ে টেডটক হয়, লাল নীল হাবিজাবি পোস্টার হয়। পার্ফরমেন্সের জন্য দরকারি হল ভয়। 

- ভয়?

- ইয়েস দত্ত। ফিয়ার জেনারেটস ফায়্যার। আর ওই আগুনটুকু না থাকলে সেলসটীম মাধুকরী করে বেড়াবে, বেচতে পারবে না। 

-  কথামৃত লেভেল বস। কিন্তু তবু... একটিবার ভেবে দেখুন...আগামীকাল থেকে নতুন কোয়ার্টার শুরু...এখনও যদি মেমোটা রিলিজ না করা হয়...।

- আগামীকাল। আগামীকাল শুরু হবে রাত বারোটার পর। আর আজ এখন সবে বেলা আড়াইটে। এখনও সাড়ে নয় ঘণ্টা হাতে। 

- হ্যাঁ...মানে ইয়ে...বস...মেমোটা তো তৈরি...। 

- তাতে কী হয়েছে? তৈরি হলেই বিলি করতে হবে? দাঁড়াও। আগে ব্যাটাচ্ছেলেদের তড়পাও সামান্য। পারফর্মেন্সের জন্য দরকার ভয়, ভয়ের জন্য কী দরকার?

- কী বস?

- মিস্ট্রি। অন্ধকার। ওরা যত অন্ধকারে থাকবে, তত ভয়ে ছটফট করবে। আর তত সহজে ওদের নাচানো যাবে। এবং ছটফটের অনুপাতে বাড়বে পারফর্মেন্স। শোনো দত্ত...ওই মেমো যেন রাত আটটার আগে সেলসটীমের কাছে না পৌঁছয়।

- কিন্তু মেমো এক্কেবারে তৈরি, আপনিও অ্যাপ্রুভ করেছেন। টীমের ছেলেমেয়েদের যে কী বলি...। 

- ওদের বলে দাও মেমো নিয়ে এখনও ম্যানেজমেন্ট ধন্দে আছে।  বিকেলবেলা ডিরেক্টররা মিটিং-য়ে বসবে। রাত আটটা নাগাদ ওই মেমো রিলিজ করে দিলেই হল। অকারণ  প্ল্যানিংয়ে অনেক সমস্যা হে। তাছাড়া আজকালকার ছেলেছোকরাদের প্রশ্নের আর শেষ নেই । সব কথাতেই এটা কে'ন, ও'টা কেন; অসহ্য। শেষ মুহূর্তে মেমো পাবে, আজেবাজে প্রশ্নের সময় সুযোগ কোনোটাই থাকবে না। এ মেমো দিব্যি বেরিয়ে যাবে। হেহ হেহ। 

- তা আপনি বলছেন যখন...কিন্তু বস...মেমো পড়ে যা বুঝেছি, অনেকের চাকরী নিয়ে টানাটানি পড়তে পারে। 

- সে জন্যেই তো সাস্পেন্সটা খুব কাজের জিনিস ভাই দত্ত। বাবাবাছা বলে কি কাউকে ডারউইন শেখানো যায়? ও মহামন্ত্র ঠেকে না শিখে উপায় নেই। 

- বেশ। তা'হলে রাত আটটা নাগাদই না হয় মেমোটা সেলস টীমের কাছে পাঠাব। 

- গুডবয়। আর দত্ত, আমার হয়ে একটা মনোবলে সুড়সুড়ি দেওয়া মেসেজ তৈরি করো দেখি। এমন একটা কিছু যা পড়েই মনে হবে যাই এখুনি আড়াই কিলোমিটার দৌড়ে আসি। তোমার মেমোর সঙ্গে না হয় সেই মোটিভেশনাল মেসেজটাও বিলি করে দিও? উইথ লাভ ফ্রম ডিয়ার বস বলে? কেমন?

- ইয়েস বস।

Wednesday, May 13, 2020

ট্যুইটস অফ আইসোলেশন ১৩


ফের একদিন। 

ভীড়। ধরুন, ওই চৈত্র সেলে গড়িয়াহাট মার্কা ভীড়।

আর ভীড়ে হাঁসফাঁস অবস্থায় কেউ আমার পা মাড়িয়ে ফেলবেন। এবং তারপরেই চেনা স্ক্রিপ্ট ভেস্তে দিয়ে মারকাটারি মিরাকেল।  

"অন্ধ নাকি শালা" বলে আমি চিৎকার করে উঠব না।
"ভীড় ফুটপাথে অমন ট্যালার মত ল্যাম্পপোস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে অথচ সামান্য টোকা লাগলে ন্যাকাপনা। আচ্ছা গবেট মাল" মার্কা পাল্টা উত্তর ভেসে আসবে না। 

বরং পা মাড়িয়ে যাওয়া মানুষটি ঘুরে হন্তদন্ত হয়ে কাছে আসবেন। জিভ কেটে বলবেন; "ছিঃ ছিঃ,অমন ইস্টুপিডের মত কেউ হেঁটে যায়? আমি একটা অখাদ্য। বলি, পায়ে কি খুব লেগেছে দাদা"?

আমি তৎক্ষণাৎ লাজুক সুরে জানাব " আরে না না, ভীড়ের মধ্যে অমন অল্পস্বল্প হয়েই থাকে। আরে পা মাড়িয়েছেন, বুলডোজার তো আর চালাননি। আমিই বরং অকারণে থমকে দাঁড়িয়ে গেছিলাম। কোনও মানে হয়? হাতে অতগুলো ভারী ব্যাগ নিয়ে ছুটছেন আপনি, পায়ে পা লাগতেই পারে। ধুস, ও নিয়ে ভাববেন না"।

দু'টো দিলখোলা হাসির আদানপ্রদান হবে। পা মাড়িয়ে দেওয়ার ব্যথা বা পা মাড়িয়ে দেওয়ার লজ্জা;তিরিশ সেকেন্ডে গায়েব কিন্তু সে হাসির ওম তিরিশ দিন মন চনমনে রাখবে। 

হাল ছাড়িনি। এই করনো-ধ্যাষ্টামোর শেষে ভীড় ফিরে আসবে। সেই ফিরে আসা ভীড়ে আমাদের হাঁসফাঁসটুকুও দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকবে। কিন্তু সেই নতুন ভীড়ের পুরনো মানুষগুলো আগের চেয়ে সামান্য নরম হবে। হবেই। হতেই হবে।

Tuesday, May 12, 2020

ব্যালেন্স

- সুমিতদা! 

- হাঁপাচ্ছিস কেন?

- মিস্টার লাহিড়ীর ব্যাপারটা শুনেছেন?

- বস আগে। এক গেলাস জল খা। তারপর না হয়...।

- সুমিতদা...বসার সময় কোথায়? লাহিড়ীর কেসটা তো অনন্তপুর থানার আন্ডারে।  এখন বেরোলেও পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। আপনার ড্রাইভার আজ এসেছে নাকি ট্যাক্সি ডাকব?

- অরিন্দম। বড্ড উত্তেজিত হয়ে আছিস। নিমাইদাকে বলেছি দু'টো চা দিতে৷ লাঞ্চ করেছিস তো?

- লাঞ্চের আর সময় পেলাম কই৷ অনলাইনে খবরটা ফ্ল্যাশ হতেই ছুট দিলাম..।

- আমারও লাঞ্চ করা হয়নি। চা'টা খেয়ে নে। তারপর নিমাইদাকে বলছি ছুটে গিয়ে দু'টো রোল নিয়ে আসবে।

- সুমিতদা..আমাদের হাতে অত সময় নেই...আপনি খবরটা শুনেছেন তো?

- পুলিশ লাহিড়ীর এগেন্সটে কেস নিয়েছে৷ বিভিন্ন পলিটিকাল কাঠি নেড়েও মাফিয়া লাহিড়ী পুলিশকে ঠুঁটোজগন্নাথ করে রাখতে পারেনি। আর হ্যাঁ, এই বয়সেও অবিনাশ মিত্তিরের পার্সিভারেন্সের জবাব নেই। ওই একটা সাতপুরনো আধভাঙা বাড়ি আঁকড়ে থেকে বুড়ো যা ফাইট দিল..ব্রাভো। থ্রেট, ইন্টিমিডেশনে থেমে না থেকে, নিজের গুণ্ডাও লেলিয়েছিল লাহিড়ী৷ কিন্তু তবুও বুড়োকে টলিয়ে বাড়িটা খালি করাতে পারল না।  ওই গুণ্ডাবাহিনীর জোরে লাহিড়ী তো কম পুকুর বোজালো না, অথচ এই অবিনাশ মিত্তির ব্যাটাকে ঘোল খাইয়ে ছাড়ল।

- খবরটা তা'হলে ঠিকঠাকই পৌঁছেছে আপনার কাছে৷ সুমিতদা... অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে গত বছর চারেক তো আপনি নিরন্তর ওই লাহিড়ীর মত জমিখেকো মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছেন৷ সুরজমল, মনোহর সিং, অজয় সান্যালদের মুখোশ খুলে ফেলার পিছনে আপনার ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে'টা গোটা শহর জানে। মিডিয়া বলুন, পুলিশ বলুন; আপনাকে সবাই যা ভক্তিশ্রদ্ধা করে...। লাহিড়ীর আগের কুকীর্তিগুলো সম্বন্ধে আপনার কাছে যা তথ্যপ্রমাণ, তা যদি এই সময় পুলিশের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তা'হলে...।

- তা'হলে কী হবে অরিন্দম?

- বৃদ্ধ অবিনাশবাবুর অন্তত একটু উপকার হয়৷ তাছাড়া লাহিড়ী পুলিশের জাল থেকে বেরোনোর আপ্রাণ চেষ্টাটুকু তো করবেই। কিন্তু আপনার মত একজন অ্যাকটিভিস্ট যদি..। সুমিতদা, আমাদের কিন্তু আর দেরী না করে..।

- কিছুক্ষণ আগেই লাহিড়ী আমায় ফোন করেছিল।

- লাহিড়ী? আপনাকে?

- নিজের সব দোষ মোটামুটি স্বীকার করেছে। 

- আরিব্বাস। স্বীকার করেছে?

- সব। এও আশ্বাস দিয়েছে যে অবিনাশ মিত্রের বাড়ির ওপর ওর আর কোনও লোভ নেই। আমিও সে সুযোগে দু'টো কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছি। ওর এই গুণ্ডাদলের দৌরাত্ম্য যে সুস্থসমাজে অচল, সে'টা ওর মুখের ওপর বলাটা জরুরী ছিল। 

- স্বীকার যখন করেইছে তখন তো আর চিন্তার কিছুই নেই। এ'বার সোজা পুলিশের কাছে গিয়ে...।

- অরিন্দম। আমি লাহিড়ীকে কথা দিয়েছি, এ ব্যাপারে আমি আর পুলিশের কাছে যাব না। আর ব্যাপারটা তো মিটেই গেছে।

- কথা দিয়েছেন সুমিতদা? লাহিড়ীকে?

- এই অবিনাশ মিত্তির ভদ্রলোকও খুব একটা সুবিধের নয় রে অরিন্দম। টাকাপয়সার ব্যাপারে ভদ্রলোক তেমন বিশ্বাসযোগ্য বোধ হয় নন। নেহাত বৃদ্ধ, একলা মানুষ...তাই সিমপ্যাথি ব্যাপারটা চলে আসছে..।

- সুমিতদা! অবিনাশ মিত্তিরের যতই দোষ থাক। লাহিড়ীর অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।  গুণ্ডা লেলিয়ে যে মানুষ প্রমোটারি চালায়..।

- সে অপরাধের শাস্তি পাওয়া অবশ্যই উচিৎ।  কিন্তু অরিন্দম, আমি পুলিশও নই, গভর্নমেন্টও নই। শহরের সমস্ত বজ্জাত প্রমোটারকে শাস্তি দেওয়ার দায় শুধু আমি একা বয়ে বেড়াব, এর কোনও মানে নেই।

- সমস্ত জেনে হাত গুটিয়ে বসে থাকা মানে তো ওর গুণ্ডার দলেই নাম লেখানো সুমিতদা। আপনার থেকে তো এই শিক্ষা পাইনি।

- অবিনাশ মিত্তির দিব্যি প্রপার্টি বগলে ড্যাংড্যাং করে বেরিয়ে যাবে। আর আমি খামোখা লাহিড়ীর গুণ্ডাদের হাতে হ্যারাসড হব কেন বলতে পারিস? সমস্ত লড়াই ব্যক্তিগত হয়ে পড়লে মুশকিল। সততার ইগোই শেষ কথা নয়, মাঝেমধ্যে ব্যালেন্স খুঁজে নিতে হয় অরিন্দম। 

- ইগো? আইডিয়াল বলুন। 

- আমি আর তর্ক করতে চাইনা। তুই চাইলে যেতে পারিস।

- প্রয়োজনে তাই যাব সুমিতদা৷ কিন্তু আমার যাওয়া আর আপনার যাওয়ার মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। 

- আমাদের মধ্যে এই যে আকাশপাতাল ফারক, সে'টা শুধু বয়সের তফাৎ নয় অরিন্দম। ওই যে বললাম, আমার মধ্যে সততার ইগো নেই তাই আমি এদ্দূর আসতে পেরেছি। তাই লাহিড়ীর মত একটা রাস্কেলও আমায় ফোন করে কান্নাকাটি করে; কারণ ও জানে যে সুমিত দত্তর মতামতের একটা ওজন আছে। সুমিত দত্ত কিছু বললে সে'টা পুলিশ বা মিডিয়া সমীহ করবে। আইডিয়াল এক জিনিস, কিন্তু তা নিয়ে গোয়ার্তুমি আমি বরদাস্ত করতে পারিনা। নিজের এই ইগো ঝেড়ে ফেলতে যদি না পারিস, তা'হলে আমার মত কারুর সেক্রেটারি হয়েই জীবন কাটাতে হবে। যাকগে। আবারও বলছি, নিজেথানায় যেতে চাইলে যেতে পারিস।  তবে সে'খানে গেলে আর আমার অফিসে ফিরে আসবার কোনও প্রয়োজন নেই। কথাটা মনে রাখিস। 

****

- গুম মেরে আর কতক্ষণ বসে থাকবি অরিন্দম? চা'টা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আর থানায় যেতে হলে বেরো এখন, দেরী করে লাভ কী। 

- নিমাইদাকে বরং রোলের বদলে চাউমিন আর চিলি চিকেন আনতে বলো সুমিতদা। সেই কোন সকালে দু'টো রুটি খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি দলা পাকিয়ে যেতে বসেছে। 

Sunday, May 10, 2020

মা, এক নির্ভীক সৈনিক


"ভালোবাসার ছোট্ট হরিণ" আমার পড়া প্রথম শৈলেন ঘোষের লেখা, আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে৷ সে গল্প খুব ভালো লেগেছিল শুনে পাশের বাড়ির এক সহৃদয় কাকু আমায় পড়িয়েছিলেন "মা এক নির্ভীক সৈনিক"। ধার করা পূজাবার্ষিকীতে পড়েছিলাম, তাই পড়ার পর বুকে পাথর রেখে সে বই ফেরত দিতে হয়েছিল। অত ছোটবেলায় যে'টা সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল সে'টা হল 'স্তেপস'য়ের হিংস্র যাযাবর উপজাতিদের দৈনন্দিন জীবন। 'সাইথিয়ান' শব্দটা উল্লেখ উপন্যাসের শুরুর দিকেই ছিল আর আমার মনে মধ্যে শব্দটা গেঁথে গিয়েছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক একটা কারণে। সাঁইথিয়া নামে একটা রেলস্টেশন এ বাংলায় আছে, এই অকারণ মিল খুঁজে পেয়ে থ্রিলড হয়েছিলাম। বহুবছর পর ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়েছিলাম সাইথিয়ানদের সম্বন্ধে;  আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইউরেশীয় অঞ্চলের স্তেপস দাপিয়ে বেড়াত এই যাযাবর উপজাতিরা। শৈলেনবাবু লিখেছিলেন সাইথিয়ান (Scythian)-দের মধ্যে বিভিন্ন জাত; তার একটি হলো আসগুজাই। উইকিপিডিয়া বলছে সাইথিয়ানদের বিভিন্ন নামে ডাকা হত যেমন সাকা, ইসকুজাই, ইত্যাদি। 

গল্পের মূলে রয়েছে আসগুজাই দলের সেনাপতি স্তানের পুত্র কোহেন এবং কোহেনের মা আনাতুরি। তবে যে নামটা মনের মধ্যে আজও সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে আছে সে'টা হল আসগুজাই দলের নির্মম রাজা বুমবুজাং৷ বুমবুজাং নামটা বিড়বিড় করে খানতিরিশবার বললেই মনে হয় " এখুনি যুদ্ধে যাব"। শৈলেনবাবু এত সুন্দর সব নাম বাছতেন তাঁর রূপকথার গল্পের চরিত্রদের জন্য; আহা, তাতেই কেল্লা ফতেহ হয়ে যেত। আলা-ইজা, শিজুমন; এক একটা লাখটাকার নাম। 

আসগুজাইদের রক্তলোলুপতায় হাড়হিম করা বর্ণনা রয়েছে এই গল্পে। নির্মম হিমশীতল স্তেপসে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ানো মানুষ তাঁরা, গেরস্তবাড়ির নরম তাঁদের স্পর্শ করেনি কোনওদিন। এই দলের সঙ্গে ওই দলের খুনোখুনি সে'খানে নিত্যদিনের ব্যাপার। শত্রুর গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে গায়ের চাদর বানানো বা শত্রুর খুলি দিয়ে পানপাত্র তৈরি করাটাই তাঁদের একমাত্র ফ্যাশন। রক্তপাত ব্যাপারটা তাঁদের কাছে ছিনিমিনি৷ তা সেই খুনে শয়তান রাজা বুমবুজাংয়ের নেকনজর থেকে পড়ে যেতেই সেনাপতি স্তানকে নিকেশ হতে হয় খোদ রাজার হাতে৷ বুমবুজাং পারলে সে'দিনই খতম করে দিত শিশু কোহেন ও তাঁর মাকে। কিন্তু আনাতুরি কোনওক্রমে সেই কোলের শিশুকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন, আশ্রয় পান শত্রু শিবিরে। 

আনাতুরি কোহেনকে বড় করেন একটাই স্বপ্ন নিয়ে, কোহেন আর পাঁচটা খুনে যাযাবরদের মত রক্তলোলুপ হবেনা৷ কোহেন ভালোবাসতে শিখবে৷ মা কোহনেকে সর্বক্ষণ আগলে রাখেন; কোহেনকে বুঝতেই হবে এ রক্তারক্তি কতটা অর্থহীন। কিন্তু আনাতুরির স্নেহ কাটিয়ে একসময় কোহেন বেরিয়ে পড়ে রক্তের নেশায়, খুনখারাপির টানে৷ মায়ের কান্না,আদর ও শাসন; সমস্ত হেলায় ভাসিয়ে দেয় সে, কোহেনকে পেয়ে বসে যুদ্ধের নেশায়।

তরুণ কোহেনের হিংস্র হুঙ্কার আনাতুরিকে ভেঙেচুরে ফেলে কিন্তু নিজের দায়িত্বটা দিব্যি টের পায় সে। লতায় পাতায় এগোতে এগোতে এই অপূর্ব রূপকথায় একসময় হিংস্র সন্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মা নিজে; মায়ের হাতে তখন অস্ত্র৷ মা তখন এক সৈনিক। মায়ের যুদ্ধ ভালোবাসার জন্য, খোকার যুদ্ধে খুনির দাপট। খোকা নির্মম, মা নির্ভীক। 

ছেলেবেলায় ধার করা পূজাবার্ষিকীতে পড়া এই উপন্যাস। তারপর ঘটনাচক্রে সেই পূজাবার্ষিকীটা বহুদিন কিছুতেই জোটাতে পারিনি।  কলেজের সম্ভবত সেকেন্ড ইয়ারে, ক্যালক্যাটা ইউনিভার্সিটির লাগোয়া ফুটপাথের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম সেই পুরনো পূজাবার্ষিকীটা। হাতে পেয়েই ফের পড়ে শেষ করেছিলাম "মা এক নির্ভীক সৈনিক"। ছেলেবেলায় ভালো লাগা অনেক উপন্যাস এখন পড়লে মনে হয়;  আগে যেমন ভালো লেগেছিল বটে, এখন যেন তেমনটা মনে হল না। কিন্তু শৈলেনবাবুর বেশির ভাগ উপন্যাসের ক্ষেত্রেই এ দুশ্চিন্তা খাটেনা৷ আর "মা এক নির্ভীক সৈনিক" আমার পরে পড়ে যেন আরও বেশি ভালো লেগেছিল। এই ধেড়ে বয়সেও গল্পটা যখনই পড়ি, মনে হয় যেন আরও একটু বেশি ভালো লাগল। "জল নয়, আগুন"; এ কথা যেন এ উপন্যাসের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে খাটে। 

শৈলেনবাবুকে আমরা যথেষ্ট সমাদর করতে পেরেছি কি? সে হিসেব করার যোগ্যটা আমার নেই। তবে যে রূপকথাগুলো উনি রেখে গেছেন, বয়স নির্বিশেষে বাঙালি পাঠকের জন্য সে'গুলো অত্যন্ত জরুরী।

আর হ্যাঁ, যদি এই গল্পটা আপনাদের বইয়ের তাকের কোনও কোণায় পড়ে থাকে; তবে আজকে পড়ে ফেলতে পারেন৷ আমি সোফায় মায়ের পাশে বসে একবার পড়ে ফেললাম; কোহেন ও তার মায়ের গল্প। 

হ্যাপি মাদার্স ডে।

Saturday, May 9, 2020

পঁচিশে বৈশাখ আর নৈবেদ্য


আজ সারাদিন ফেসবুক ও ট্যুইটার রবিপ্রণামে ভরপুর। আঁকা, পাঠ, গান, নাচ থেকে কার্টুন পর্যন্ত; যোগ দিয়েছেন সব বয়সের মানুষ৷ আর এ'সব কিছু আমার যে কী ভালো লাগল। কত চেনা মানুষ হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বসেছেন বা খালি গলায় গান ধরছেন, কত খোকাখুকু কী অপূর্ব ভাবে কবিতা আবৃত্তি করছে, ঘরের মধ্যে বা ছাতের ওপর হয়ত কেউ নেচেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে। 

এক সময় মনে হত; আমাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে গেলানোর একটা প্রবণতা আছে। হয়তো আছেও বা৷ কিন্তু এখন মনে হয় এই যে এত মানুষ সাহস করে গান গেয়ে উঠছেন, কবিতা পড়ছেন, ছবি আঁকছেন; সে সাহসের মূল্য অসীম। এবং সেই গাওয়া গান বা পাঠ করা কবিতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া; সে সাহস খানিকটা যুগিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে কেউ দড়াম করে গাইতে বললে অনেকেরই অস্বস্তি হয়; দুম করে ওই ভাবে গাওয়া যায় না নাচা যায়? কিন্তু এই স্মার্টফোন আর ফেসবুক/ট্যুইটার গোছের প্ল্যাটফর্ম মিলেমিশে; ব্যাক্তিগত স্পেস আর এক্সপোজার ব্যালেন্স করে একটা চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছে।  

ফেসবুক জমানার আগে জানতাম পাড়ার স্টেজে বসে হারমোনিয়াম বাজাতে যে পারবে না তাঁর গান পাতে দেওয়া চলে না; রবিস্যারের গান হলে তো নয়ই। এখন সে ব্যাপারটা আমি একটু অন্যরকম ভাবে বুঝি। আমি ছাই গানবাজনার কিছুই তো বুঝি না। কিন্তু এ'টুকু বেশ টের পাই যে একজন মানুষ ভালোবেসে গান গাইছেন; এই গোটা ব্যাপারটা চাক্ষুষ করার মধ্যেও রয়েছে একটা দুর্দান্ত থ্রিল। নাচের ন'টুকুও  বুঝি না, কিন্তু এক ছোট্টখুকি তাঁর দিদিমার সঙ্গে ফুলে ফুলে ঢলে চলেছে; তার সৌন্দর্য বর্ণনা করার ক্ষমতা থাকলে আমি নভেলিস্ট হতাম।   এ দিনটা ফেসবুকে এমনভাবে ডালপালা বিস্তার না করলে জানতেই পারতাম না পাড়ার খিটখিটে জ্যেঠু হারমোনিয়ামের সামনে বসলে পান্তুয়া মেজাজের সলজ্জ মিঠে হাসি আবিষ্কার করে ফেলেন। 

মোদ্দা কথা হল, আজ গোটদিন ফেসবুক দারুণভাবে সরগরম ছিল। পরনিন্দায় নয়, গায়ে ফোস্কা ফেলা সারকাজমে নয়, 'তুমি রাস্কেল তোমার গুষ্ঠি রাস্কেল' গোছের ভার্চুয়াল কলারটানা ঝগড়ায় নয়; সে সরগরম নাচে, গানে আর কবিতায়। শিল্পীদের অনেকেই তুরীয়, তাঁদের তাক করে আমার মত নন-সমঝদারের ছুঁড়ে দেওয়া 'কেয়াবাত'টুকু প্রায় ধৃষ্টতা। কিন্তু এমন অনেকে আছেন যাদের হয়ত পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় স্টেজে ওঠা হয়নি কিন্তু গান, কবিতা বা নাচের প্রতি তাঁদের অপত্য ভালোবাসাটুকু আছে। আর আছেন রবীন্দ্রনাথ৷ রবিস্যারের লেখা কতটা গুলে খেলে তাঁকে চেনা যায়? আমি রবীন্দ্রনাথ এতটাই কম পড়েছি যে সে ফর্মুলা নিয়ে দু'কথা বলার সাহস আমার নেই। তবে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যে মানুষটা রবিস্যারের গান আনমনে গুনগুন করতে গিয়ে বুকে আরামবোধ করেন; রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর অধিকার কোনও কালচারজ্যেঠুর চেয়ে কম হওয়া উচিৎ নয়।

যে'টা আগেও বলেছি। সোশ্যাল মিডিয়ে মানুষকে প্রাইভেট স্পেস আর এক্সপোজার মিলিয়ে একটা চমৎকার 'আউটলেট' তৈরি করে দিয়েছে তা অনস্বীকার্য ( নয়ত আমার মত দড়কচা মারা মানুষ এতগুলো লাইন লেখার সাহস পেত কী করে)। আবার সেই সাহসে ভর দিয়েই কত পরিচিত আর অপরিচিত মানুষের গান, নাচ ও আবৃত্তি আজ আমার টাইমলাইনে ভেসে আসছে। এবং আমি বারবার মুগ্ধ হচ্ছি, স্যালুট করছি রবীন্দ্রনাথকে। আমার টাইমলাইনে যারা রবীন্দ্র-প্রণাম ভাসিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে আন্তরিক ধন্যবাদ;  চারদিকে এত মনখারাপ আর অন্ধকার সত্ত্বেও আপনারা আজ আমায় ভালো রেখেছেন।

Friday, May 8, 2020

মগজে নতুন চুটকি

কোনও জোক বা চুটকি যখন প্রথম মাথার মধ্যে এসে দাঁড়ায় তখন তাকে মনে হয় উত্তমকুমার। স্যুটবুট পরে, শর্মিলা ঝলসানো হাসি হেসে; সে কলম ঝাঁকিয়ে অটোগ্রাফ দেবে। অথবা মোটরবাইকে-সুচিত্রা-বইতে-পারা কনিফেডেন্স নিয়ে বিশ্বজয় করবে। মনে হয়; 
বাহ্, এই চুটকিটার জন্যই তো এদ্দিন বসেছিলাম। এই তো সেই জোক যা ইন্টেলেক্টে অঞ্জনবাবুর দাড়ি চুলকে দেবে,
অথচ শিব্রাম মার্কা ইম্প্যাক্টে চুটকি শুননে-ওয়ালারা হেসে গড়াগড়ি যাবে। এই তো সেই জোক যা শুনে একদিকে পাড়ার ফক্কর বন্ধু নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে প্রেমিকাকে পারফিউম কিনে না দিয়ে আমায় ওল্ডমঙ্কের বোতল উপহার দেবে আর অন্যদিকে বাবা বাহবা জানিয়ে  বলবে "বারো ঘণ্টা পর যখন আমার হাসি থামবে, তখন বেরোব তোর জন্য মাটন আনতে"। সে চুটকি অ্যাইসা ভাইরাল হবে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকোকে বিবেকামুণ্ডম গোছের কিছু ধমক দেওয়ার আগে সে চুটকি 'ক্র‍্যাক' করবেন। আবার সে ঠাট্টা এতটাই লিটলম্যাগিও গভীর হবে যে তা নিয়ে ঝাড়া আড়াইমাস কফিহাউস সরগরম থাকবে। 

মোদ্দা কথা হল কোনও নতুন চুটকিটা যতক্ষণ নিজের মাথার ভিতর থাকে, মনে হয় " কেয়াবাত, গালিবদা! কেয়াবাত"।

কিন্তু মগজের মধ্য থেকে সে চুটকি যেই গুটিগুটি পায় বেরিয়ে আসে অমনি ফুলকো লুচির পেটে জলকামান। 

বুক হিম হয়ে আসে যখন বুঝতে পারি মাথার ভিতরে যে চুটকি উত্তমকুমারিও ঘ্যাম নিয়ে ঘুরছিল, আসরে নামার পর সে আদতে ঢ্যাঁড়সশ্রী। ইন্টেলেকচুয়ালরা সে চুটকি শুনলে মোগলাই পরোটায় ব্রকোলি মার্কা ওয়াক তুলবেন। আর সে চুটকি শুনে অনেকেই ফলিডল ফ্লেভারের লস্যি খুঁজে হন্যে হবেন; শিব্রামাইজড হাসি তো দূরের কথা। 

চুটকিটা বলার পর টের পাওয়া যায় মাখাসন্দেশ নামাতে গিয়ে ঝুলি থেকে এক ঠোঙা আরডিএক্স বের করে ফেলেছি; চারদিকে হাহাকার। বন্ধুরা সে জোক শুনলে যে ত্যাজ্যবন্ধু করতে পারে, সেই সম্ভাবনা জোকটা মুখ ফসকে বলে ফেলার পরেই মাথায় আসে, আগে নয়। আর সে চুটকি বাপের কানে উঠলে নিজের পিঠের চামড়া দিয়ে তৈরি ফোলিওব্যাগে নিজের প্রায়-ফেল-করা মার্কশিটগুলো ফাইল করে রাখতে হবে। 

মাথার ভিতরে উদয় হওয়া নতুন চুটকির হম্বিতম্বিতে সহজে বিশ্বাস করবেন না। জনসমক্ষে সে চুটকি আপনার নাকের কিমা-চচ্চড়ি তৈরি করবে না; এমন গ্যারেন্টি স্বয়ং ঈশ্বর কেন, গভর্নমেন্টও দিতে পারবেন না।

Monday, May 4, 2020

ভাড়া

- আরে শিবু নাকি?

- আজ্ঞে।

- আরে থাক থাক থাক, রাস্তাঘাটে আবার প্রণাম করা কেন।

- না করবেন নায়েবমশাই। না করবেন না। পায়ের ধুলোটুকু অন্তত নিতে দিন। আপনাকে যে আমি কী বলে...।

- আহা, আমায় কিছু বলতে যাবেই বা কেন। চলো, বেলা বাড়ছে। স্টীমারে উঠি চলো গিয়ে।

- নায়েবমশাই, আপনি আমাদের উদ্ধার না করলে আমরা ভেসে যেতাম। এই অসময়ে আপনি দেবদূতের মত আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ালে...।

- দ্যাখো শিবু। আমি তো মাইনে করা চাকর মাত্র। তবে হ্যাঁ, পেন্নাম যদি ঠুকতেই হয়; তবে ঠোকো জমিদার মশাইয়ের নামে।

- জমিদারমশাইয়ের জন্য জান কবুল নায়েবমশাই। এদ্দিন আমরা ভাবতাম মানুষটা বড় কঠিন..কিন্তু তাঁর মধ্যে যে এত মায়া..।

- নারকেল দেখেছ তো শিবু? নারকেল? তার বাইরেটা কেমন।বিশ্রী  ছিবড়ে?  আমাদের জমিদারমশাইও ঠিক তেমনি। বাইরেটা যতই শুকনো হোক, তাকে একটু বাজিয়ে দেখলেই জলের নড়াচড়া টের পাবে। 

-  তা তো বটেই। নইলে গরীবমানুষের জন্য এতটা কেউ করে?

- যবে থেকে জমিদারবাবুর কানে উঠেছে যে নদীর ও'পারে হরিহরপুর গাঁয়ে মড়ক লেগেছে; অমনি তাঁর ঘুম হাওয়া। বারবার শুধু পায়চারি করছেন আর শুধোচ্ছেন "নায়েব, আমার ফুলপুর গাঁয়ের অনেক মানুষ ওই হরিহরপুরের ইটভাটায় কাজ করে না? সে গায়ে মড়ক লেগেছে, এই অসময়ে আমি উদ্ধার না করলে তাঁদের দেখবে কে বলো"।

- দেবতা, সাক্ষাৎ দেবতা।

- আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম; "জমিদারমশাই, আপনার দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। কিন্তু এ গাঁয়ের অন্তত শ'খানেক লোক সে ইটভাটায় খাটে৷ এই ভরা বর্ষায়, ছোটখাটো ডিঙিনৌকার ভরসায় এতগুলো মানুষকে নদী পারাপার করাবেন কী করে"? তা শুনে জমিদার মশাই আমায় চোপা কী করে বললেন জান?

- কী বললেন তিনি আজ্ঞে?

- বললেন, "শোনো নায়েব, এ গাঁয়ের প্রতিটি মানুষ আমার সন্তান। আমার অতগুলো জোয়ান ছেলেপিলে ভীনগাঁয়ের মড়কে উজার হয়ে যাবে আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব? রাধামাধব আমায় ক্ষমা করবেন তা'হলে? তুমি শোনো, তুমি এখুনি স্টীমারের ব্যবস্থা করো। আমি তাদের স্টীমারে করে গাঁয়ে ফেরত আনব"।

- মাটির মানুষ আমাদের জমিদারবাবু। 

- কিন্তু আমি যে সেরেস্তার হিসেবকিতেব নিয়ে থাকা কেঠো মানুষ, ফের বুঝিয়ে বললাম; "আপনারএস্টেটের খান দুয়েক স্টিমার আছে বটে। কিন্তু তা দিয়ে রোজ জুটমিলে সাপ্লাই যায়। সে স্টিমার দিয়ে একটা গোটা দিন মানুষ বওয়ালে যে প্রচুর টাকা নষ্ট"৷ কিন্তু ওই, কে শোনে কার কথা। আমায় কী হুকুম করলেন জানো শিবু?

- কী বললেন তিনি কত্তা। 

- বললেন " নায়েব, আমার সন্তানরা কষ্টে আছে। এ সময় আমি জুটমিলের সাপ্লাই নিয়ে ভাবব? রাধামাধব রাধামাধব! শোনো, তুমি কাল ভোরে নিজে স্টিমার নিয়ে গিয়ে হরিহরপুরের ঘাটে গিয়ে দাঁড়াবে। আর হরিহরপুরের ইটভাটায় এ গাঁয়ের যত লোক কাজ করে, তাদের সব্বাইকে স্টিমারে তুলে, তবে ফিরবে"। 

- আর ক'দিন থাকলেই মড়ক আমাদেরও ছুঁয়ে ফেলত নায়েবমশাই। জমিদারমশাইয়ের অসীম কৃপা যে এ অসময়ে স্টিমার পাঠিয়ে আমাদের প্রাণ বাঁচালেন। নয়ত আমাদের পরিবারগুলো নয়ত সবই ভেসে যেত৷ আমরা তো গাঁয়ে ফেরার জন্য কম চেষ্টা করিনি, কিন্তু  মড়কের গাঁয়ে আমাদের বাস বলে কোনও ফেরিনৌকাই আমাদের নিতে চায়না। আপনার মধুকে মনে পড়ে নায়েবমশাই?

- মধু...যার বাপ ঘরামী ছিল?

- আজ্ঞে। তা সে বেচারা দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে ভরা নদী সাঁতরে পেরোনোর তাল করলে। এই গেল হপ্তায়। যা হওয়ার হল,বেলা ফুরোনোর আগেই তাঁর দেহ ভেসে উঠল এই ঘাটের কাছেই।

- ইশ। দ্যাখো দেখি, গণ্ডমূর্খ আর কাকে বলে। জমিদারমশাই শুনলে ভারী ব্যথা পাবেন যে। যা হোক। যার যেমন কপাল। 

- তা ঠিকই বলেছেন নায়েব মশাই। আচ্ছা, স্টিমার বিকেলের মধ্যে ফুলপুর ঘাট পৌঁছে যাবে। তাই না?

- তা যাবে। কেন বল দেখি?

- আজ হাটবার, না? সন্ধ্যের আগে পৌঁছলে ঘাটের হাট থেকে খোকার জন্য দু'টো জামা কিনতাম। আর বৌটার জন্য হাঁড়ি খুন্তিও যদি..। 

- রস আর রসদ, তোমার দুইই আছে দেখছি শিবু

- হেহহে, ওই আর কী। আধপেটা খেয়ে টাকা জমাই, যাতে গাঁয়ে ফিরে চালডাল ছাড়াও সামান্য কিছু..। ছেলেবৌকে তো কিছুই তেমন দিতে পারিনা নায়েবমশাই। তবে হাতে ওই এ'বারে সতেরো টাকা মত জমেছে। হাট থেকে তাই..। আর তাছাড়া, একটা জরুরী ওষুধও এ'বারে নিয়ে নেব ভাবছি। ওই ঘাটের কাছের রস সাহেব ডিসপেনসারি থেকে এ'বার কিনে নেব'খন।

- ওষুধ?

- ওই, বেশ কিছুদিন হল আমার মাঝেমধ্যে শ্বাস আটকে আসে, চোখে অন্ধকার দেখি। আর বুকে সারাক্ষণ একটা বিচ্ছিরি জ্বালা জ্বালা ভাব। জ্বালাটা অম্বলের নয় তাও বুঝি, আরও গোলমেলে কিছু যেন। তা ছ'মাস আগে গঞ্জের এক ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন, যে ওষুধ মাস তিনেক খেলেই নাকি ও'সব অসুবিধে কেটে যাবে। 

- তা এদ্দিন সে ওষুধ খাওনি কেন?

- আজ্ঞে, এ ইটভাটা সর্বস্ব পাড়াগাঁয়ে রস সাহেবের ডিসপেনসারি কোথায় পাই বলুন। আর সে'সব যে দামী ওষুধ।  যখন দেখলাম টাকা কিছুটা জমেছে তখন থেকে আর ফুলপুরে ফেরাও হয়নি। তাই ভাবছি সুযোগ যখন পেয়েছি তখন হাটের থেকে কেনাকাটা করে চলে যাব রস সাহেবের ডিসপেনসারিতে।  সে'খান থেকে ওষুধ নিয়ে তারপর বাড়ি।

- বাহ্, মড়কে বাস করেও বাবুর শখে জং পড়েনি।

- হেহহেহহে।

- আর দেরী নয়, স্টীমারে উঠে একটু আয়েশ করে বসো তো দেখি শিবু।

- যেয়াজ্ঞে।

- আর শিবু, শোনো। ভাড়াটা আমায় দিয়ে তারপর স্টীমারে উঠো, কেমন?

- আজ্ঞে?

- ফ্যালফ্যাল করে দেখছ কী৷ ভাড়া! ভাড়া! ভাড়াটা আমায় দিয়ে তারপর স্টীমারে উঠো।

- কিন্তু নায়েবমশাই..ভাড়া? ভাড়া লাগবে?

- দ্যাখো কাণ্ড,ভাড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য তুমিও ওই মধু পাগলার মত সাঁতরে ফেরার তাল করছ না তো? হা হা হা হা হা।

- কত?

- ভাড়া? ও সামান্যই। পাঁচ টাকা মাত্র।

- পাঁচ টাকা? কী বলছেন কী নায়েবমশাই৷ ফেরিনৌকা নেয় চার আনা।

- তা'হলে তুমি।ফেরিনৌকাই খুঁজে নিও শিবু৷ খামোখা স্টীমারে ওঠার শখ হয়েছে কেন? 

- পাঁচ টাকা ভাড়া দেব আমরা? অত টাকা দেওয়ার মুরোদ কি আমাদের আছে নায়েবমশাই?

- হাটে ঘুরে কেনাকাটি করার শখ আছে৷ জমিদারের স্টীমারে গা এলিয়ে নদীর হাওয়া খাওয়ার ধক আছে। কিন্তু সামান্য পাঁচ টাকা ভাড়ার কথা শুনলেই বাবুদের গলা শুকিয়ে কাঠ। বলি, জমিদারমশাই কি স্টীমারখামা মাগনা খাটাবেন? একদিন জুটমিলের সাপ্লাই বন্ধ মানে কতটাকার লোকসান জানো? তিনশো টাকা। চোখে দেখেছ অত টাকা কোনওদিন? দেখোনি। কিন্তু জমিদারমশাই সে'সব লোকসান গায়ে না মেখে স্টীমার পাঠিয়েছেন তোমাদের দুঃসময়ে উপকার করতে৷ আর এই তার প্রতিদান? ভাড়া দেওয়ার বেলায় গায়ে ফোস্কা?

- কিন্তু অতগুলো টাকা...।

- খোকার জন্য জোড়া জামা, বৌয়ের জন্য নতুন হাঁড়ি-কড়াই; বাহা। বাহ্ বাহ্ বাহ্। এ'দিকে জমিদারের বাড়িতে সিঁদ কাটার ইচ্ছে। তোমার লজ্জা করে না শিবু? কই, তোমার আগে এতজন যে স্টীমারে এসে বসলে; তাঁরা তো অকারণ চেল্লামেল্লি করেনি। বাজে কথায় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই৷ স্টীমার ছাড়ার সময় হল৷ ভাড়া দিতে না চাইলে ওই মড়কের গাঁয়ে ফেরত যাওগে, আমার মাথা খেওনা।

***

- হ্যাঁ গো..।

- ঘুমোওনি বৌ?

- তুমিও তো ঘুমোওনি।

- কিছু বলবে?

- খোকার জন্য দু'টো জামা আনলে। আমার জন্য নতুন হাঁড়ি, হাতা,খুন্তি৷ আর এতগুলো চুড়ি। কত খরচ হল বলো..।

- ধুস, ইটভাটায় পয়সা উড়ছে গো বৌ৷ পয়সা উড়ছে। হাতে বেশ ক'পয়সা জমেছিল। তাই ভাবলাম...তা, খোকার বেশ মনে ধরেছে জামা দু'টো, তাই না?

- খুব। সেই যে দু'টো জামা একসঙ্গে গায়ে চাপালো, ঘুমের মধ্যেও খুলতে দিচ্ছে না। পাগল।

- চুড়িগুলো তোমার পছন্দ হয়েছে বৌ?

- খুউব। হ্যাঁগো, এত খরচ করলে...তোমার সেই ওষুধ আনলে না?

- ওষুধ?

- ওই যে গো..তুমি বলতে না। হঠাৎ করে শ্বাস আটকে আসে, বুক জ্বালা, চোখে অন্ধকার...। গঞ্জের হাসপাতালের ডাক্তার তোমার বুকে যন্তর দিয়ে দেখেশুনে কী'সব দামী ওষুধ লিখে দিলে। তুমি বললে টাকা জমলেই সে'সব ওষুধ কিনে আনবে...।

- ওহ হো, বাবাজীর ব্যাপারটা তোমায় বলাই হয়নি, তাই না?

- বাবাজী? কী ব্যাপার?

- হপ্তাখানেক আগের ঘটনা বুঝলে। আমাদের হরিহরপুরের ইটভাটার আস্তানায় এক বাবাজী এসে হাজির হলেন; এক্কেবারে সোজা হিমালয় থেকে পায়ে হেঁটে হরিহরপুর।

- সোজা হিমালয় থেকে?

- তবে আর বলছি কী বৌ। চেহারায় যেমন তেজ, চোখে তেমনি মায়া। তা সে বাবাজী তো একরাত আমার ঝুপড়িতেই কাটালেন। আমার বানানো রুটি আর ডাল খেয়ে খুব খুশি হলেন। রাতে গল্পের ছলে তাঁকে আমার অসুখের কথাটা বললাম৷ বাবাজী শুনেই নিজের ঝুলি থেকে কী একটা শিকড় বের করে বললেন সে'টাকে তুলসীপাতা সঙ্গে বেটে খেয়ে নিতে। 

- তারপর?

- আমি বাবাজীর কথা মত খেয়ে নিলাম। সত্যিই ধন্বন্তরি৷ ওই এক দাগেই আমার বুক জ্বালা, শ্বাসের কষ্ট এক্কেবারে গায়েব।

- এক্কেবারে? আমার গা ছুঁয়ে বলো।

- গা ছুঁয়েই তো আছি। তোমায় কি আমি কোনওদিন মিছে কথা বলেছি গো বৌ?

আ গোল্ডেন এজঃ রেহানার মুক্তি ও যুদ্ধ

থার্ড রাইখের ওপর শিরার সাহেবের পাহাড়প্রমাণ (এবং গুরুত্বপূর্ণ) বইটা পড়ার বেশ কিছুদিন পর পড়েছিলাম 'দ্য বুক থীফ'। প্রথম বইটা জরুরী ঐতিহাসিক দলিল। পরেরটা সে ইতিহাসের পটভূমিতে লেখা কাল্পনিক উপন্যাস; এক বইচোর খুকির গল্প। ইতিহাস নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু ইতিহাসের চাকা ঘোরে মূলত তারিখে,  সংখ্যায়, স্মৃতিফলকে এবং রাজনৈতিক মতবাদের হাওয়ায়। এ'টা ইতিহাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয় মোটেও; তথ্য ও যুক্তিনির্ভর না হয়ে ইতিহাসের উপায় নেই৷ কিন্তু মানুষের গল্প শুধু তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বাঁধা অসম্ভব। মানুষের খিদের গল্প শুধু মন্বন্তরে মৃতের সংখ্যা বা শাসকের শয়তানি বা প্রতিবাদি জনতার প্রতিঘাতের খবর জানিয়ে শেষ হয়ে যায়না। তবে সেই পুরো গল্পটা বলার দায় ইতিহাসের নয়, সম্ভবও নয়। নিজের পাতের খাবার পাশের বাড়ির অভুক্ত শিশুর জন্য সরিয়ে রাখা গৃহিণীর গল্প জমিয়ে রাখার পরিসর ইতিহাসের বইতে নেই৷ পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘোরা কোনও অকুতোভয় তরুণ বিপ্লবী যখন  পুরনো চিঠির গন্ধ শুঁকে বারুদের গন্ধ ভুলতে চেষ্টা করে, সে ব্যাপারটা কোনও দস্তাবেজে লিখে রাখা চলেনা। গৃহযুদ্ধে বাপ হারানো ছোট্ট খোকার ফ্যালফ্যালে চোখে শরতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার গল্প নিয়ে পড়ে থাকলে ইতিহাসের এগোতে পারে না। 

আর সে'খানেই প্রয়োজন সেই ইতিহাসের পটভূমিতে লেখা গল্প-উপন্যাসের। এমন গল্প যা ঐতিহাসিক সত্যের গণ্ডির মধ্যে দাঁড়িয়ে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর 'হেডকাউন্ট' ছাপিয়ে; গেরস্তের হেঁশেল থেকে ভেসে আসা ভাতেভাতের গন্ধ খুঁজে নেবে। লেখকের হিসেব-কষা কল্পনায় সেই গেরস্থালীর হিসেবকিতেব বোঝাটাও বোধ সামগ্রিকভাবে ইতিহাসকে চেনার জন্য জরুরী। 

আর সে'খানেই তাহমিমা আনমের লেখা "দ্য গোল্ডেন এজ" বইটা আমার মনে ধরেছে। লেখিকার একটা সাক্ষাৎকারে শুনলাম যে'খানে তিনি বলছেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজের রিসার্চের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা প্রামাণ্য বই লেখার; অথচ লিখতে লিখতে সে বইয়ের মূল বিষয় হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের আবহে লালিত হওয়া কিছু মানুষ ও তাঁদের স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্কগুলো। অথচ ইতিহাসের নিরিখে এ বইয়ের মোটেও গুরুত্বহীন নয়। 

উপন্যাসের শুরু সদ্য স্বাধীন হওয়া পূর্ব পাকিস্তানে, শেষ ১৯৭১য়ের ডিসেম্বরে; বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ দিয়ে। আর গোটা উপন্যাস দাঁড়িয়ে রেহানা হকের  পয়েন্ট অফ ভ্যিউতে৷ বাংলা ভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তান; এ দু'টোই রেহানা পেয়েছেন (এবং ক্রমশ জড়িয়ে ধরেছেন) বিয়ের সূত্রে। জন্মসূত্রে রেহানা উর্দুভাষী এবং কলকাতার মানুষ; কাজেই তাঁর বাংলাদেশকে জড়িয়ে ধরা এবং মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়ার গল্পটা শুধু জন্মগতভাবে পাওয়া ইডিওলজি আউড়ে নয়। এবং সে'কারণেই; রেহানার পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়ার গল্প শোনাটা পাঠকের কাছে একটা অনন্য অভিজ্ঞতা। 

স্বামীহারা রেহানার যাবতীয় মুক্তি ও যুদ্ধ তাঁর দুই সন্তানকে ঘিরে। তাঁদের আঁকড়ে ধরেই নিজেকে চিনেছেন রেহানা। প্রয়োজনে নিজেকে ভেঙেছেন, তারপরে আবার নতুন ভাবে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি; সবটুকুই তাঁর ছেলে সোহেল ও মেয়ে মায়াকে ঘিরে। নিজের দেশ কী ও কোথায়, এ প্রশ্নের উত্তরটুকুও রেহানা খুঁজে নিয়েছেন সোহেল ও মায়ার মধ্যে দিয়ে। "দেশ বা ভাষা মানেই মা আর সে মায়ের জন্য প্রাণপাত করা যায়"; এই চিরকালীন ফর্মুলাকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ার করে এক অন্য ভালোবাসার গল্প বুনেছেন রেহানা। সন্তানের জন্য প্রাণপাত করা মা হিসেবে বাংলাদেশকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন তিনি; সে'টাই তাঁর মুক্তিযুদ্ধ৷ এবং রেহানার মত মানুষের ভালোবাসা যে দেশের জন্য কত জরুরী, সে'টাও এ উপন্যাসে বেশ টের পাওয়া যায়।  রেহানাদের আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার গল্প ইতিহাসের বইতে আঁটবে কেন? ঐতিহাসিক উপন্যাস ছাড়া গতি নেই।

আর একটা জায়গায় লেখিকার রিসার্চ এ বইকে সমৃদ্ধ করেছে; সে সময়ের ঢাকা ও সে শহরের বর্ণগন্ধকে সুন্দরভাবে নিজের লেখায় ধরেছেন তিনি। আমি ঢাকায় যাইনি কোনওদিন। তবে ধানমণ্ডি বা গুলশন গোছের নামগুলো মাঝেসাঝে পড়েছি বা শুনেছি। কিন্তু এই উপন্যাস পড়ে যেন মনে হচ্ছে যে জায়গাগুলো একবার ঘুরে না এলেই না। না না, ভৌগোলিক ডিটেলিং তেমন নেই এ লেখায়; তবে ওই জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে বহু ছোটছোট ঘটনার এমন সুন্দর করে গোটা বইতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে বইটা শেষ করার পর মনে হচ্ছে যেন জায়গাগুলো যেন আর পাঁচটা চেনা শহুরে পাড়ার মতই। তাছাড়া জবাকুসুম তেলের সুবাস থেকে  বিরিয়ানি হয়ে ইলিশ বা ডাল-বেগুনভাজার চনমন ও পাড়ার আড্ডার অত্যন্ত সুরসিক বর্ণনা এ বইতে রয়েছে। ডিটেলিংয়ে কিছু খুচরো খুঁত যে নেই তা হলফ করে বলতে পারি না৷ তবে পড়তে গিয়ে সুর কাটবে, তেমন কিছু গলদ আমার অন্তত নজরে পড়েনি।  

দু'টো কথা বলে শেষ করি। 

এক।
আমি এ বই অডিওবুক হিসেবে শুনলাম। মধুর জাফরির কণ্ঠে রেহানার গল্প শুনতে চমৎকার লাগল। বিশেষত এ উপন্যাসে এ'দিক ও'দিক ছড়িয়ে থাকা বাংলা শব্দগুলো দিব্যি উচ্চারণ করেছেন তিনি।

দুই।
কোনও গল্পের বই পড়ে ভালো লাগলে তা নিয়ে দু'চার কথা চট করে লিখে ফেলবার পিছমে একটা গুরুতর কারণ আছে। সে লেখা পড়ে দু'একজন যেমন সে বই উল্টেপাল্টে দেখতে চাইতে পারেন, তেমনই সহৃদয় কেউ সে লেখার সূত্র ধরেই হয়ত আমায় অন্য ভালো বইয়ের খবর দেবেন। ওই হল গিয়ে আমার আখেরে লাভ৷ 'নেমসেক' নিয়ে দু'দিন আগে সাহস করে দু'চার কথা লিখেছিলাম। সে'টা পড়ে এক দাদা বললেন "তাহমিমা আনমের দ্য গোল্ডেন এজ বইটা পড়েছ ভায়া"? 
পড়া ছিল না, পড়ে নিলাম; একেই বলে মুনাফা। 

পুনশ্চ: এই বইটি একটা ট্রিলোজির প্রথম অংশ।

Friday, May 1, 2020

অশোক ও অসীমা

১।

উপন্যাস থেকে তৈরি হওয়া সিনেমা।
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত থাম্বরুল হল আগে উপন্যাসটা পড়ে তারপর সিনেমায় পৌঁছনো। উপন্যাসের 'ডিটেলিং' স্বাভাবিক ভাবেই সিনেমার স্ক্রিনে ঘণ্টা দুই-আড়াইয়ের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়৷ তাছাড়া উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে কিছুটা কাটছাঁট না করে সিনেমার ফ্রেমে বসানো মুশকিল।  তার মানে এই নয় যে গুরুত্বের দিক দিয়ে সাহিত্য সবসময়ই সাহিত্য-নির্ভর সিনেমার ওপরে থাকবে। এডিটিং আর নির্দেশনার গুণে সিনেমা যে স্বতন্ত্র হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তেমন উদাহরণ যে অজস্র আছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।  সিনেফাইলরা সে বিষয়ে আরও বিশদে বলতে পারবেন৷ কিন্তু ওই, আমার বরাবরই মনে হয় যে ভালো লাগা বই থেকে তৈরি হওয়া সিনেমা যতটা সাগ্রহে দেখা যায়, সে সিনেমা আগে দেখে প্লটের নির্যাস বুঝে নিয়ে বইটা পড়তে শুরু করা অনেক বেশি কঠিন।

ঝুম্পা লাহিড়ীর 'নেমসেক' বইটা আমি সংগ্রহ করি নেমসেক সিনেমার বিভিন্ন ছবি দেখে। দু'টো ছবি আমায় বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে;
 
এক। যে'খানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে একগাল হাসি নিয়ে ইরফান দাঁড়িয়ে, পাশে টাবু। টাবুর মাথা ঝুঁকে পড়েছে ইরফানের কাঁধে।

দুই। টাবু আর ইরফান কোনও এক মার্কিন শহরের পটভূমিতে। টাবুর কোলে শিশু, ইরফানের হাতে ফুলের বোকে। আমেরিকা বাদ দিলে; এ ধরণের ছবি বোধ হয় একসময় প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত বাঙালির অ্যালবামে থাকত। 

বইটা পড়া বা সিনেমাটা দেখার আগেই বিভিন্ন রিভ্যিউয়ের মাধ্যমে জেনেছিলাম যে সিনেমায় টাবু রয়েছেন অসীমার চরিত্রে আর ইরফান হয়েছেন অশোক। কাজেই নেমসেক পড়তে শুরু করার আগেই আমার মনের মধ্যে স্পষ্ট ছিল যে এই বইয়ের মূল দু'টো চরিত্র ঠিক কেমন দেখতে বা তাঁদের কণ্ঠস্বর ঠিক কেমন। আমি সিনেমাটা দেখার আগেই, উপন্যাসের প্রতিটি পাতাকে অনুভব করেছি ইরফান খানের অশোক  আর টাবুর অসীমার মধ্যে দিয়ে। 
এবং আমি হলফ করে বলতে পারি; অশোক ইরফান গাঙ্গুলি আর অসীমা টাবু গাঙ্গুলির উষ্ণতায় ভর দিয়ে আমার উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতাটা আরও গভীর উঠেছে। 

বইটা পড়ার পর; সিনেমায় আমি যখন অশোক আর অসীমাকে স্ক্রিনে দেখেছি, চরিত্রেগুলোর পিছনে থাকা অভিনেতাদের নাম কিন্তু একবারও মাথায় আসেনি।

২।
'নেমসেক' উপন্যাসটি মন্থর কিন্তু ক্লান্তিকর নয়; বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে আলপনার মত সুন্দর।  প্রবাসী বাঙালি জীবনের খুঁটিনাটির আড়ালে অশোক আর অসীমা স্পষ্ট হয়ে উঠেছেন, ক্রমশ বেরিয়ে এসেছেন খোলসের মধ্যে থেকে। ষাট-সত্তরের দশক থেকে তুলে আনা মধ্যবিত্ত বাঙালির 'সিগনেচার ক্লিশে'গুলো ঝরঝরে ভাষার গুণে বড় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে; অশোক আর অসীমার নতুন সংসারের ছবি যেন আমাদের পুরোনো ছবির অ্যালবামের কোনও এক কোণে সহজেই সাঁটা থাকতে পারে। প্রবাসে থাকলে যে কোনও মানুষই নিজের দেশে থেকে বয়ে আনা ছোটোখাটো বর্ণগন্ধগুলোকেও যে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাইবেন; সে'টাই স্বাভাবিক।  তাছাড়া ইন্টারনেটের যুগে আমরা অনেকেই দু'শো মাইল আর আড়াই হাজার মাইলের মধ্যে বিশেষ তফাৎ দেখতে পাইনি; ষাট-সত্তরের দশকে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম।

অসীমা আর অশোকের কোনও 'রীতিমতো নভেল' গোছের আঙুলে আঙুল ছোঁয়ানো ভালোবাসা আবিষ্কারের মুহূর্ত নেই৷ দৈনন্দিন জীবনের জট ছাড়াতে ছাড়াতে তাঁরা নিজেদের অজান্তেই একে অপরে জাপটে ধরেছেন। তাঁদের কাছে আসার প্রসেসটা হয়ত ঠিক সেই অর্থে সিনেম্যাটিক নয়। আমাদের স্মৃতিতে কিছু মুহূর্ত উজ্জ্বল হয়ে থাকে বটে কিন্তু যে অসংখ্য আটপৌরে সাদামাটা মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে গিয়ে দু'জন মানুষ একে অপরকে চিনতে শুরু করে, ভালোবেসে আপন করে নয়; সেই সাদামাটা দিনপঞ্জির মাধ্যমেই অশোক আর অসীমার কথা লিখেছেন ঝুম্পা। আর কী অপূর্ব সারল্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন এই দু'জন মানুষ ও তাঁদের স্নেহের সম্পর্ককে। 

আগেই বলেছি, সিনেমার পোস্টারে ইরফান আর টাবু আমায় এতটাই মুগ্ধ করেছিলেন যে অশোক আর অসীমার চরিত্র দু'টো আমার মনের মধ্যে একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। 

আমার কাছে এই উপন্যাসের দু'টো ভাগ। এক, শুরু থেকে অশোক গাঙ্গুলির মৃত্যু পর্যন্ত। দুই, তারপরের অংশটুকু৷ আমার টান বেশি ওই প্রথম অংশটার প্রতি৷  

উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই রয়েছে অশোক অসীমার ছেলে গোগোল। কালপুরুষ সিনেমার শেষে দৃশ্যে বাবা আর ছেলের পাশাপাশি হাঁটার স্বপ্নালু দৃশ্যটা ভোলার নয়। 'নেমসেক' উপন্যাসের শেষে এসে গোগল নাগাল পেয়েছিল নিজের বাবা অশোক গাঙ্গুলি এবং অশোকের প্রিয় লেখক (এবং গোগলের 'নেমসেক') নিকোলাই গোগোলের।  কালপুরুষ সিনেমার সেই দৃশ্যটা বারবার মনে পড়ছিল এ উপন্যাসের শেষে। 

৩।
নেমসেক সিনেমাটা দেখায় আগেই উপন্যাসের অশোক ও অসীমা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ইরফান আর টাবু হয়ে। কাজেই সিনেমা দেখা শুরু করার পর ; উপন্যাসের চরিত্র আর সিনেমার অভিনেতাদের রিকনসাইল করতে আদৌ কোনও অসুবিধে হয়নি। সিনেমার একদম গোড়ার দিকে ইরফানের বাংলা উচ্চারণ কানে সামান্য খোঁচা দিয়েছিল বটে। কিন্তু সিনেমাটা শেষ করার পর ব্যক্তিগত ভাবে বলতে দ্বিধা নেই যে ইরফান ছাড়া অশোক গাঙ্গুলির কোনও অস্তিত্ব আমার মনে নেই৷ তাছাড়া সিনেমা চলাকালীন এক সময় মনে হয়েছিল উপন্যাসের যে অশোক, তাঁর তুলনায় সিনেমার অশোক যেন সামান্য বেশি প্রাণোচ্ছল, সে যেন একটু বেশি হাসতে পারে। সিনেমার শেষে দিব্যি টের পেয়েছিলাম যে অভিনেতা ইরফান আমার মত একজন মোটাদাগের পাঠককে বোঝতে পেরেছেন যে অশোক গাঙ্গুলির চাপা প্রাণোচ্ছলতাটুকুই তাঁর চরিত্রের মূলদিক৷ তারপর বইটার বিভিন্ন পাতায় ফেরত গিয়ে দেখেছি; প্রথমবার বইটা পড়ার সময় অশোককে যতটা চাপা মনে হয়েছিল, আদৌ সে ততটা নয়। সত্যিই, সিনেমাও পারে মূল উপন্যাসের পাঠককে সমৃদ্ধ করতে; ইরফানরা পারেন৷ 

অশোক গাঙ্গুলির অসময়ে চলে যাওয়াটুকু ওই ইরফানের মতই। প্রায় ইরফানেরই বয়সে। ভাগ্যিস ইরফান ছিলেন, নয়ত অশোক গাঙ্গুলিকে ভালো করে চেনাই হত না।

এবং শেষে যার কথা না বললেই নয়। টাবু। সিনেমায় পরিসর কম, উপন্যাসের মনকেমন করা অলস গতি সে'খানে চলে না। কোনও উপন্যাস ভালো লাগলে অনেক সময়ই মনে হয় যে সে উপন্যাস ভর দিয়ে বানানো সিনেমাটা যেন একটু হুটোপুটিতে কেটে গেল; কিছু জায়গায় 'নেমসেক'য়ের ক্ষেত্রেও সে'টাই মনে হয়েছে। সে'টাই স্বাভাবিক। 

কিন্তু টাবুর হাত ধরে অসীমা যে কী গভীর হয়ে উঠেছেন। অচেনা পাত্রের জুতোয় পা গলানো ছেলেমানুষি থেকে সদ্য পিতৃহারা ছেলেকে জাপটে বুকে টেনে নেওয়া সাহস; উপন্যাসের অসীমাকে ভালো করে চেনাও সেই টাবুর মাধ্যমে, ঠিক যেমনভাবে অশোককে পূর্ণতা দিয়েছেন ইরফান।