Showing posts with label তুকতাক. Show all posts
Showing posts with label তুকতাক. Show all posts

Thursday, November 21, 2024

মাদুলিস্ট



- সায়েন্টিস্ট!
- বলুন।
- এ আমি কী শুনছি!
- কী শুনেছেন সে'টা বিশদে না বললে আমার মতামত দিই কী করে ক্যাপ্টেন।
- তুমি নাকি এক্সিস্ট করো না?
- ওহ, এই কথা। তা কে বললে?
- ভোরের আলো। ঘুম ভাঙব ভাঙব করছে।
- ওহ, সেল্‌ফ রিয়ালাইজেশন।
- ব্যাপারটা কী, তুমি সত্যিই এক্সিস্ট করো না সাইন্টিস্ট?
- আপনার গলায় ঝোলানো মাদুলিটা কিন্তু এক্সিস্ট করে ক্যাপ্টেন। ঘুমের ঘোরেও ছুঁয়ে দেখতে পারেন।
- মাদুলিটা রিয়েল। অথচ তুমি ব্যাটাচ্ছেলে আমার ফিগমেন্ট অফ ইমাজিনেশন।
- ক্যাপ্টেন, গুরুদেবের দেওয়া মাদুলিটাই রিয়েল হয়ে রইল আপনার জীবনে। এ'টা একটা ট্র্যাজেডি বটে।
- অ্যাই এ'সব ফালতু কথা বলার কোনও মানে হয় না। রোজ ঘুমের মধ্যে এ'সব লজিকাল বকর-বকর আর সয় না।
- মাদুলিটা বাদ দিন ক্যাপ্টেন। ইউ আর বিগার দ্যান মাদুলি।
- এই, এই যে। সকালের রোদ্দুর মুখে এসে পড়ছে। এ'বার ঘুম ভাঙবে। তুমি কেটে পড়ো দেখি সাইন্টিস্ট। ঘুমের কোয়ালিটি ইমপ্যাক্ট করছে এইসব বকবক।
- আর মাদুলিটা?
- আরে গুরুদেব কি আর এমনি এমনি দিয়েছে ও জিনিস? বেস্পতিটার পোজিশনটা ঠিক নেই। তারপর আবার রবির মুভমেন্টটাও নাকি রিলায়েবল নয়। সঠিক সময়ে মাদুলির সঠিক ডোজ না পড়লে ঘরে অশান্তি বাড়বে, অফিসের প্রমোশন ফসকাবে, শেয়ারের টাকাগুলো জলে যাবে। স্পষ্ট দেখেছেন গুরুদেব।
- ক্যাপ্টেন, সংসারে অশান্তি বাড়ছে আপনি মন দিয়ে বাড়ির লোকজনের কথা শুনছেন না বলে। অফিসের প্রমোশন ফসকাচ্ছে কারণ আপনি কাজের প্ল্যানিংয়ে মন দিচ্ছে না। শেয়ারের টাকাগুলো জলে যাবে কারণ ও'টা সাট্টাবাজার নয়, সে'খানে রিসার্চ আর ধৈর্য দুইই দরকারি। চট করে টাকাটা তুলে পিপিএফ অ্যাকাউন্টে রেখে দিন, সে'খানেই আপনার স্বস্তি ও মুক্তি।
- ফের সেই এক ঘ্যানরঘ্যানর। আরে বাবা মাদুলির পাওয়ারকে আন্ডারএস্টিমেট করার কোনও মানে হয় না। আমার মেজশালা এই গুরুদেবের থেকেই মাদুলি নিয়ে ফুলকপির পাইকারি সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় নেমে লাল হয়ে গেলো।
- সে লাল হয়েছে উদয়াস্ত খেটে।
- তুমি ভারি অ্যান্টি-মাদুলি সায়েন্টিস্ট। জাস্ট বিরক্তিকর!
- না, আমি প্রো-আপনি ক্যাপ্টেন। আমি আপনার দলে।
- যত বাজে কথা। তুমি আমার কল্পনা! আর এই যে আমার গলায় ঝুলছে এই মাদুলি; এ'টা কিন্তু এক্কেবারে রিয়েল ভায়া সায়েন্টিস্ট।
- আমায় সাইন্টিস্ট ডাকনামটা আপনারই দেওয়া, তাই না?
- স্বপ্নে আলাপ। স্বপ্নেই দেওয়া নাম।
- আপনার স্বপ্ন ফেলনা হতে যাবে কেন ক্যাপ্টেন? কত গুণী মানুষ আপনি, আর আমি সেই গুণী মানুষের বুকের সাহস ক্যাপ্টেন। আমি আপনার সাহস! আর ওই মাদুলিটা আপনার ভয়। ভেবে দেখুন, কোনটাকে রিয়েল বলে ধরে রাখতে চান।
- নাহ্‌। ভারি ইরিটেটিং তুমি সায়েন্টিস্ট। ভাবছি গুরুদেবের থেকে একটা বাড়তি টোটকা চাইতে হবে স্বপ্ন-লেস ঘুমের।
- টোটকাটা যদ্দিন না আপনার হাতে আসছে ক্যাপ্টেন, চেষ্টা আমায় চালিয়ে যেতে হবে। সায়েন্টিস্ট নাম দিয়েছেন, হাল ছাড়লে চলবে কেন?
- অ্যালার্মটা যে কখন বাজবে ছাই! যত্তসব গাজোয়ারি ব্যাপারস্যাপার!
( ছবিঃ জেমিনাই)

Tuesday, December 13, 2022

কবিতা অভিযান



- কী রে..এই সুমন..সবাই তোর খোঁজ করছে..আর তুই স্টেজের পিছনে এমন ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছিস..। চ'।
- দেবুদা।
- আরে কথাবার্তা পরে হবে৷ শ্যামলের পরেই তোকে স্টেজে উঠতে হবে৷ এদ্দিন সাধ্যসাধনা করে তবে তোর কবিতা পড়ার জন্য পাঁচ মিনিটের স্লট আদায় করতে পেরেছি৷ সামান্য দেরী হলে আর তোকে অ্যাকোমোডেট করবে না।
- দেবুদা, কবিতা আমি পড়ব না৷
- হোয়াট? তুই খেপেছিস? তোকে পড়তেই হবে৷ অডিয়েন্সে দীপকদা, সুমিত হাজরা আর অরুন্ধতীর মত কেউকেটারা বসে আছে৷ আমি নিশ্চিত একবার তোর মুখে তোর লেখা শুনলে হাজারো বড় অপরচুনিটি আসবে৷ সুমন, ক্যুইক৷
- আহ্, দেবুদা৷ আমার কবিতা পাচ্ছে না৷
- হোয়াট! কবিতা কি ইয়ে নাকি৷
- আমার আচমকা মনে হচ্ছে..।
- তুই অফিস কামাই করে কবি সম্মেলনে এলি, এখন বলছিস পড়বি না কবিতা! ইয়ার্কি নাকি!
- এক কথা বারবার জিজ্ঞেস করছ কেন৷ আমার আচমকা মনে হচ্ছে কবিতা পড়ার কোনও দরকার নেই৷ ইন ফ্যাক্ট, অফিস কামাই করেছি বলে বেশ একটা রিগ্রেট হচ্ছে।
- তোর শরীর ঠিক আছে সুমন?
- তুমি বোধ হয় জিজ্ঞেস করতে চাইছ আমার মাথা ঠিক আছে কিনা৷ তা'হলে বলব এদ্দিন পর মাথাটা ঠিক হয়েছে৷ হঠাৎ বুঝতে পারছি যে চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল৷
- কী'সব আগডুম-বাগডুম বলছিস! আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড?
- মাথা তোমাদের বিগড়েছে৷ কী পাও এ'সব কবিতা-কবিতা করে শহর মাথায় তুলে? কে পড়ে তোমার ছাপানো লিটল ম্যাগাজিন? তোমাদের কবিতা সবটুকুই তো ফেক আর ফাঁপা। এ পড়ে ওর পিঠ চাপড়াচ্ছে, ও পড়ে এর পিঠ চুলকে দিচ্ছে।
- বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু সুমন।
- আমিও বলিহারি৷ ইঞ্জিনিয়ারিং করে এত ভালো একটা চাকরিতে ঢুকে মাথায় যে কী ভূত চাপল..দিনের পর দিন অফিস কামাই করে আমি ভস্মে ঘি ঢালছি।
- সুমন শোন..যাস না..।
- দেখো দেবুদা৷ তোমাদের এই ম্যাগাজিন রইল কি গেল তা'তে কারুর কিছু এসে যায়না৷ ওই দীপক, সুমিত, অরুন্ধতীরা তাও এর ওর পা চেটে নিজেদের একটা স্টেটাস আর সরকারি পেট্রোনেজ বাগিয়ে নিয়েছে। তোমার আছেটা কী? অপ্রিয় সত্যটাও বলে রাখা ভালো৷ তুমি একজন পাতি রেলের ক্লার্ক৷ ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়িয়ে কবিতা সম্মেলন করাটাই তোমার জন্য একটা অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু আমার সামনে একটা প্রমিসিং কেরিয়ার আছে৷
- তুই আমায় যত গাল দেওয়ার দে৷ কিন্তু তা বলে, হুট করে লেখালিখি ছেড়ে দিবি?
- পোয়েট্রি ইজ ডেড টু মি৷ এখন যা লেখার সে'টা লিঙ্কডইনেই হবে৷ আসি৷
- স্রেফ আধঘণ্টার মধ্যে এমন কী হল..।
- বোধদয়৷ যাকগে৷ আমি আসি৷ আর প্লীজ আমায় ফোন কোরো না।
****
- নন্দিনী৷ হোয়াট অ্যান অনার টু মিট ইউ৷ আমি সুমন৷ সুমন দত্ত।
- ডমিনিক অ্যান্ড গ্লস্টার্সের সি-ই-ও৷ ম্যাগাজিন কভারের বাইরে আপনাকে দেখতে পাওয়াটা তো আমারই সৌভাগ্য মিস্টার দত্ত।
- প্লীজ৷ আমায় এমব্যারাস করবেন না৷ আর, একটা রিকুয়েস্ট৷ সুমন বলেই ডাকবেন।
- এই ধরণের কর্পোরেট জমায়েতে আমাদের মত কবিদের খাপ খাইয়ে নেওয়াটা খুব একটা সহজ নয়..। ইন ফ্যাক্ট, ইনভিটেশনটা পেয়ে আমি নিজেই খুব অবাক হয়েছিলাম..। আপনাদের পার্টি মানেই তো খানাপিনার সঙ্গে গানবাজনা। আধুনিক কবিতারও যে কর্পোরেট মহলে ডিমান্ড আছে..।
- সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আপনার কবিতা শুনেছে নন্দিনী৷
- আর আপনি?
- টু বি অনেস্ট উইথ ইউ, আমার কবিতা সম্বন্ধে কোনও ইন্টারেস্টই নেই৷ অন্তত যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলি। কিন্তু আজ আপনার কবিতা শুনে অনেকদিন পর থমকে দাঁড়ালাম, জানেন৷ মনে হল..।
- মনে হল?
- মনে হল দু'দণ্ড জিরিয়ে নিই। কদ্দিন পর হঠাৎ পুরনো পাড়ার কথা মনে পড়ল, জানেন। পুকুরপাড়ে বসে আমি আর তপন ফুটবলের গল্প করতাম। সে'সব বিকেলগুলোর গন্ধ হঠাৎ নাকে ফিরে এলো৷ মায়ের চুলে বিলি কেটে দেওয়া মনে পড়ল৷ বাবার প্রিয় খদ্দরের পাঞ্জাবিটা গালে ঠেকলে যে ভালোলাগা খসখসটা টের পেতাম, সে'টা যেন আবার গালে ফিরে এলো৷ মানে, হঠাৎ এই অফিসপার্টির থেকে যে ছিটকে গেলাম৷ স্রেফ আপনার কবিতা শুনে।
- সুমনবাবু, আর যাই হোক, আপনার মধ্যে কবিতার অভাব নেই।
- হেহ্৷ এককালে হয়ত আমার মধ্যে ছিঁটেফোঁটা কবিতা ছিল৷ তবে এখন আর..। সে যাকগে৷ ইয়ে, একটা থ্যাঙ্ক ইউ বলি৷ আপনার কবিতার মতই, আপনার কথাবার্তা খুবই কম্ফর্টিং৷
- সুমনবাবু, আমি পার্টির ইনভিটেশনটা কেন এক্সেপ্ট করেছি জানেন? আমি এ'সব জায়গা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি কিন্তু৷
- কেন? ইনভিটেশন এক্সেপ্ট করলেন কেন?
- আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে৷
- এক্সকিউজ মি? আপনি আমায় চিনতেন?
- ওই, বিজনেস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ দেখে চেনা নয়৷ আমি আপনাকে সত্যিই চিনি৷
- হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে নন্দিনী৷
- সুমনবাবু, যদি বলি এর আগেও আমাদের দেখা হয়েছে? আপনার মনে নেই, থাকার কথাও নয়৷ কিন্তু..আমার স্পষ্ট মনে আছে৷
- কবে বলুন তো?
- আমি অবশ্য এই কর্পোরেট জগত কাঁপানো সুমন দত্তর সঙ্গে দেখা করিনি৷
- সে কী৷ তার বাইরে আমার কোনও পরিচয় আছে নাকি?
- আজ থেকে বছর বারো আগে, দেবুদার অর্গানাইজ করা কবিসম্মলেনের স্টজের পিছনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আপনাকে দেখি। অবাক হয়ে৷ মুগ্ধ হয়ে৷ আপনার লেখার যে আমি কী ভক্ত ছিলাম..।
- আমি..আমি যে কী বলব..। ওই দিনটা আমার জন্য একটা..।
- টার্নিং পয়েন্ট? জানি।
- কী জানেন?
- সুমনবাবু। আমি এই পার্টিতে এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করে নিজের দোষ স্বীকার করব বলে।
- আপনার কবিতার ভাষা এত প্রাঞ্জল নন্দিনী৷ কিন্তু আপনি এখন যে কী বলছেন, আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
- আপনি ভুডুইজমে বিশ্বাস করেন? তুকতাক?
- কবিতা তো তুকতাকই।
- আমি আমার স্বীকারোক্তি আপনাকে জানিয়ে গেলাম৷ বিশ্বাস, অবিশ্বাস আপনার হাতে৷ আমি আপনাকে ঈর্ষা করতাম৷ ভীষণ৷ কী'ভাবে সে তুকতাক তন্ত্রমন্ত্রের খোঁজ পেয়েছি, সে ব্যাপারে ঢুকে লাভ নেই৷ তবে আপনার থেকে কবিতা শুষে নেওয়ার বিদ্যে আমার ছিল৷ আপনি স্টেজের পিছনে যখন নার্ভাস হয়ে পায়চারি করছিলেন, তখনই আপনার পাশ ঘেঁষে চলে যাই। ওই কয়েক সেকেন্ডেই ঘটে যায় ব্যাপারটা।
- ইউ মীন, আপনি আমার থেকে কবিতা শুষে নিয়েছেন? হিপনোটিজিম প্লাস ব্রেনড্রেন?
- আপনি হেসে উড়িয়ে দিতেই পারেন৷ তবে, ওই যে বললাম। বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার হাতে। কিন্তু ওই দিনটা যে টার্নিং পয়েন্ট ছিল, সে'টা স্বীকার করছেন তো?
- অস্বীকার করি কী করে।
- আমার জন্যও৷ সে'দিন রাত থেকেই আমার একটা নতুন কবিজন্ম হল৷ ঝরঝরিয়ে লিখতে থাকলাম, অবিকল আপনার স্টাইলে৷ আপনারই মত ভাব আর ভাষার দখলসহ। আপনি কবিতা ছেড়ে চলে গেলেন, আর কবিতা আমায় টেনে নিল। একপ্রকার চুরিই বলতে পারেন। তবে নাম, স্টেটাস; সবই পেলাম আপনারই গুণে ভর দিয়ে।
- নন্দিনী৷ যে কবিতাগুলো আজ আপনি পড়লেন, সে'গুলো কি শুধুই ভাষার খেল? না৷ ওই লেখাগুলোর মধ্যে যে অপরিসীম ভালোবাসা, তা তো মিথ্যে হতে পারেনা৷ আপনার স্বীকারোক্তি আপনারই থাক৷ আমি কিন্তু এ মুহূর্তে আপনার গুণমুগ্ধ ভক্ত ছাড়া আর কেউই নই। আজ এতবছর পর, আপনি হঠাৎ কবিতার প্রতি ভালোবাসাটা ফিরিয়ে দিলেন৷ কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। সে হিসেবে আজকের দিনটাও একটা টার্নিং পয়েন্ট৷ একটা ইউরেকা-বোধ হচ্ছে, কবিতা লেখার ইচ্ছেটা ফেরত এসেছে মনে হয়৷ আচ্ছা, কয়েক মিনিটের জন্য আপনার কলমটা পেতে পারি? আপনার জন্য ক'টা লাইন না লিখলেই নয়।
নন্দিনী কাঁপা হাতে নিজের কলমটা সুমনের দিকে এগিয়ে দিলেন৷ টেবিলের ওপর রাখা একটা ন্যাপকিন নিজের দিকে টেনে নিয়ে তার ওপরই তরতরিয়ে লিখতে শুরু করলেন সুমন; কবিতা৷ নন্দিনীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, কৃতজ্ঞতায়। তার সঙ্গে একটা পাহাড়প্রমাণ দুঃখ চেপে ধরছিল। সে জানে যে সুমনের কবিতা লেখা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তার কবিজন্মের ইতি৷
নন্দিনীর আর কোনওদিনও কবিতা লেখা হবে না।

Friday, January 21, 2022

ভূত নামানোর ব্যবসা



- এ কী৷ আবার এসেছেন?

- চিন্তা নেই৷ এ'বারে আর ভূত দেখতে আসিনি৷ 

- তাই বলে ফিজ না দিয়ে যেতে পারবেন না কিন্তু৷ আমার সময়ের দাম আছে৷ 

- রাখুন আপনার সময়ের দাম৷ বাইরে তো কেউই বসে নেই৷ ভূত নামানোর বাজার ডাউন যাচ্ছে? 

- আসলে দু'দিন আগেই পূর্ণিমা গেল তো৷ এ'সময়টায় ঠিক তেনারা অদরকারে ঘুরঘুর করতে পছন্দ করেননা৷ তাই এ'কদিন বিজনেস একটু ওই...যাকে বলে..।

- অত কথায় কাজ নেই৷ আপনার ফিজ একশো বত্রিশ টাকা তো? দেব। ইয়ে, আমায় মনে আছে আশা করি।

- ভাস্কর তান্ত্রিক একবার কাউকে দেখলে সহজে ভোলে না৷ আর আপনি মাইরি ভুলবার মত লোকও নন৷ গত হপ্তায় কী কাণ্ডটাই না ঘটালেন..। আপনি তো ব্যারাকপুরের প্রবীর দত্তগুপ্ত৷ তাই তো? দিব্যি, দিব্যি মনে আছে।  

- দেখুন ভাস্করবাবু..।

- ও কী! আমি আপনার অফিস কল্যিগ নই৷ বাবা বলুন, গুরুজীও চলতে পারে৷ 

- যাকগে৷ অকারণ খেজুর করতে আমি আসিনি। গতবার আপনাকে একটু অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলাম৷ গোটা পরিস্থিতিটাই কেমন গোলমাল হয়ে গেছিল৷ তাই ভাবলাম..।

- আপনি কিন্তু আমায় সত্যিই ভেবড়ে দিয়েছিলেন প্রবীরবাবু৷ নিজের বাবার আত্মার সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চেয়ে আমার কাছে এলেন৷ ভালো কথা। অথচ আমি তেনাকে ডাক দেওয়ার আগেই এমন বিশ্রীভাবে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন..৷ আরে বাপের নামটাও বলতে পারলেন না কান্নার চোটে৷ তারপর তো প্রায় ছুটে পালালেন..। আমি তো হতবাক। 

- জানি৷ ব্যাপারটা নেহাতই ছেলেমানুষির পর্যায়ে চলে গেছিল আর কী৷ তাই পরে মনে হয়েছে ব্যাপারটা আপনার কাছে একটু খোলসা করে যাওয়া দরকার৷ যদিও আপনার এ ব্যবসাটাকে আমি ঠিক সৎ বলে মনে করিনা, তবু ভাবলাম...।

- ব্যবসা? ব্যবসা? শুনুন মশাই৷ এ'টা হলো সাধনা৷ বুঝেছেন? সাধনা৷ ফিজটা নিই শুধু এস্টাবলিশমেন্ট মেন্টেনেন্স কস্ট হিসেবে। 

- যাক গে। ভাস্করবাবু..থুড়ি..শ্রী শ্রী ভাস্করতান্ত্রিক..যে'টা বলতে ব্যারাকপুর থেকে হালিশহর ছুটে আসা৷ আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম আমার মৃত বাবার আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে৷ কারণ..কারণ আমি পাগল হয়ে গেছিলাম৷ জানেন ভাস্করবাবু, আমার বাবার নাম অবনী দত্তগুপ্ত। পেশায় স্কুল মাস্টার ছিলেন৷ অতি সৎ একজন মানুষ ছিলেন৷ বহু সহায়সম্বলহীন ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে গেছেন মারা যাওয়ার দিন পর্যন্ত৷ ছাত্রছাত্রীরাও বাবাকে বড় ভালোবাসতো৷ আর বাবা তাদেরকে একটা শিক্ষাই দিতেন, সমস্ত ঝুটো বিশ্বাস আর কুসংস্কার উড়িয়ে দিয়ে সৎপথে থাকার শিক্ষা৷ বাবার গর্ব ছিল, যে তাঁর ছাত্ররা প্রত্যেকেই বিজ্ঞান-মনস্ক। অথচ আমিও তো বাবারই ছাত্র৷ বিশ্বাস করুন, বাবার বাকি স্টুডেন্টদের মত আমার মধ্যেও কুসংস্কার নেই৷ শুধু বাবা মারা যাওয়ার পর ক্ষণিকের জন্য মনটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল৷ বুকের মধ্যে একটানা একটা বিশ্রী হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়। আর তাই ব্যারাকপুর স্টেশনের ল্যাম্পোস্টে সাঁটা আপনার ওই ভূত নামানোর বিজ্ঞাপন দেখে হঠাৎ যেন জ্ঞানগম্যি হারিয়ে ফেলেছিলাম৷ কিন্তু আপনার কাছে এসে বসার পর সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আর তারপর একটা বিশ্রি লজ্জা আমার প্রায় গলা টিপে ধরেছিল। অবনী মাস্টারের ছেলে হয়ে তাঁর শিক্ষাকে এমন হেলায় ভাসিয়ে দিয়েছি ভেবে আমার বড় কষ্ট হয়েছিল ভাস্করবাবু৷ তাই আপনার সামনে থেকে অমন দৃষ্টিকটু ভাবে ছুটে পালিয়েছিলাম। কিন্তু পরে মনে হল, ব্যাপারটা আপনাকে জানানো দরকার..।

- আপনি আজ আসুন প্রবীরবাবু।

- আমার কথাগুলো একটু কটু শোনাচ্ছে বোধ হয়৷ মাফ করবেন কিন্তু আপনাকে না জানালে...।

- আপনি আসুন। আসুন।  

**

- আরে এতবার কলিংবেল! কে? ওহ! আপ..আপনি?

- কী,  চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না তো প্রবীরবাবু? 

- গেরুয়া লুঙ্গি আর খালি গায়ের বদলে হাফশার্ট আর ট্রাউজারে আপনাকে দেখতে হবে সে'টা কোনওদিনও ভাবিনি ভাস্করবাবু৷ আর আপনার মতলবটা কী বলুন তো? আমায় ফলো করছেন নাকি? হালিশহর ছেড়ে হঠাৎ ব্যারাকপুরে?

- ভিতরে আসা যায়?

- আমি ঠিক নিশ্চিত নই৷ বললাম তো। আপনার মতলবটা জানা দরকার৷ 

- আগের দিন মনে হল, অন্ধবিশ্বাসের টানে একবার আমার ডেরায় এসে পড়ার পর থেকে আপনি খুবই মনকষ্টে আছেন৷ তাই ভাবলাম..।

- মতলবটা কী আপনার?

- মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসব, তার জন্য আবার মতলবের দরকার হবে কেন?

- মাস্টারমশাই? আপনি কি বাবাকে..।

- চিনতাম। সাতাশির উচ্চমাধ্যমিক ব্যাচ৷ তখন অবিশ্যি আপনি নিতান্তই শিশু৷ সে'জন্যই আমি প্রথমদিন ঠিক আপনাকে চিনতে পারিনি৷ পরের দিন গিয়ে যখন অবনী স্যারের নাম করলেন, বুকের ভিতরটায় কেমন ছ্যাঁকা লাগল যেন৷ তবে মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে আমি এদ্দূর আসিনি প্রবীরবাবু৷ আমি শুধু বলতে এসেছি একটা সহজ কথা জানাতে৷ শুনুন, ভূত নামানোর টানে আমার ডেরায় গিয়ে আপনি মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতির অপমান করেননি৷ আপনি কুসংস্কারের টানে আদৌ ছুটে যাননি৷ আপনি গেছিলেন ভালোবাসার টানে, প্রবল মনকেমন বুকে নিয়ে৷ বাপের চলে যাওয়া যে ছোটখাটো ব্যাপার নয় প্রবীরবাবু৷ একটু পাগলামো চলতেই পারে৷ 

- ভাস্করবাবু..আমি যে কী বলব..।

- আপনি হয়ত আমায় দেখে ভাবছেন, মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র শেষে ভূত নামানোর ব্যবসায় ঢুকলে? তবে কি মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষায় ফাঁক ছিল? অভয় দিয়ে বলি, আপনার মতই আমিও অবনীবাবুর একনিষ্ঠ ছাত্র৷ কুসংস্কার আমায় সহজে ঘায়েল করতে পারবে না৷ তবে আপনার মতই, বাপের মৃত্যুটা আমাকে বিশ্রীভাবে ঘায়েল করেছিল বটে৷ আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য৷ ইয়াব্বড় সংসার ফেলে বাবা দুম করে সরে পড়লেন৷ টের পেলাম; পেটের দায় বড় দায়৷ ভালোবাসাও মিইয়ে যায়৷ পড়াশোনা ছাড়তে হল, মাস্টারমশাইয়ের শাসন এবং স্নেহও বাদ পড়ল কারণ বাড়ির খরচ চালাতে গেলে অঙ্ক টিউশনিতে পড়ে থাকা চলবে না৷ চাকরী না থাক, বিজনেস খুঁজে নিতে হবে।  হিপনোটিজম আয়ত্ত করে তাই চলে এলাম ভূত নামানোর ব্যবসায়, নেহাতই দায়ে পড়ে। শুনুন, মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষা জলে যায়নি প্রবীরবাবু৷ যেতে পারে না৷ কেমন? মনে থাকবে? এ'টুকু বলার জন্যই ছুটে আসা৷ আজ আসি।

- ভাস্করদা৷ চা না খাইয়ে তো আপনাকে ছাড়া যাবে না৷ আর বাবার কাছে অঙ্ক পড়েছেন যখন, মায়ের হাতের ডিমের কচুরির স্বাদও নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়৷ সে'স্বাদও না হয় আর একবার ঝালিয়ে নেবেন৷ আপনাকে ভিতরে আসতেই হবে৷ 

Monday, December 27, 2021

শ্যামল ডিলান তুকতাক



- এই যে৷
- আরে, তুমি? কী আশ্চর্য!
- চলে এলাম, ইচ্ছে হল৷ অবাক হওয়ার কী আছে!
- বসো।
- বসি, কেমন?
- একশো বার৷
- থ্যাঙ্ক ইউ।
- এই বেঞ্চটা বড় মায়ার৷ তাই না?
- যা শীত৷ বাপ রে৷ হাড় কনকনের মধ্যে মায়াটায়া টের পাচ্ছি কই৷
- হেহ্৷
- অনি কেমন আছে?
- দিব্যি৷ শখের প্রাণ৷ আজকাল হঠাৎ বাগানের শখ চেপেছে৷ হপ্তায় দু'দিন অফিস কামাই করছে পেয়ারের গাছেদের দেখভাল করতে৷ চাকরী বেশিদিন টিকলে হয়৷
- লোকটা খ্যাপাটেই রয়ে গেল৷
- আর নিপা?
- গোটা দিন ক্লাসে ছাত্র পড়ানো৷ সন্ধের পর নিজের পড়াশোনা, রিসার্চ৷
- ও'ও কিন্তু কম খ্যাপাটে নয়৷
- খ্যাপাটে না হলে ওই শীতের রাত্রে এই পাহাড়-পাড়ার এই বেঞ্চিতে বসে আর এক খ্যাপার সঙ্গে কেউ গল্প জোড়ে?
- তাই তো। আচ্ছা, নিপা এখন কী করছে বলো তো?
- মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করছে৷ কানে ইয়ারফোন। চোখ বোজা৷ আর তোমার অনি? সে কোথায়?
- শাল জড়িয়ে ছাতে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ৷ ওল্ড মঙ্কের ঝিমঝিম। আর যথারীতি কানে ইয়ারফোন৷ চোখ বোজা৷
- আহ্। অফ কোর্স৷ তাই তো আমাদের দেখা হল৷
- বেঞ্চিটা সত্যিই মায়ার।
- ব্যাপারটা দিব্যি।
- আর খানিকটা ভূতুড়ে৷
- হেহ্ হেহ্।
**
- তা'হলে ছুটি শেষ!
- শেষ৷
- কাল থেকে ফের শহর৷ দৌড়ঝাঁপ৷ আমার সেই চাকরী৷ তোমার সেই কলেজ৷ ধুত্তোর।
- সত্যিই।
- নিপা, বিয়েটা কবে করছি আমরা?
- অনিবাবু যবে সিরিয়াসলি প্রপোজ করবেন, অমনি৷
- বাহ্৷ এখন বুঝি সিরিয়াস নই?
- কাঁচকলা।
- দু'দিন সময় দাও৷ সিরিয়াস প্রপোজাল দেখবে কাকে বলে।
- আচ্ছা, অনি! যদি আমারা দূরে সরে যাই?
- তুমি বড় পেসিমিস্ট নিপা।
- সে দুশ্চিন্তা কখনও তোমার হয় না?
- দাঁড়াও৷ জন্মজন্মান্তরের একটা সলিউশন তৈরি করে যাই৷ তোমার ইয়ারফোনে একটা গান পজ্ করা আছে৷ তাই না? যে'টা এ'খানে হেঁটে আসার সময় শুনছিলে? আমায় দেখে যে'টা থামালে?
- ডিলান।
- তোমায় দূর থেকে দেখে আমিও কান থেকে ইয়ারফোন সরালাম। আমি শ্যামল মিত্তিরে আটকে ছিলাম৷ এ'বার আমায় তোমার ফোন-ইয়ারফোন দাও, আমি ডিলানের গানটা শুনে শেষ করি৷ তুমি আমার শ্যামল সামাল দাও।
- তা'তে কী হবে?
- হাইক্লাস তুকতাক নিপা। তুমি আর আমি যদি ফস্কেই যাই, কোনওদিন যদি সে দুর্ঘটনা ঘটেই যায়..। এই দু'টো গান আমাদের হয়ে মাঝেমধ্যেই এই কার্শিয়াংয়ের বেঞ্চিতে এসে বসবে। নোটস এক্সচেঞ্জ করে সরে পড়বে।
- তুমি একটা অখাদ্য।
- কলকাতায় ফিরে একটা সুপারসিরিয়াস প্রপোজাল দিয়ে তোমায় জাস্ট ঘাবড়ে দেব৷ তখন আর অখাদ্য মনে হবে না!
- দাও দেখি তোমার শ্যামল মিত্র৷ আর এই নাও, ডিলান৷

Tuesday, July 13, 2021

ক্রিকেটের তুকতাক




নিজের মুখে নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো প্রসঙ্গে ফলাও করে কিছু বলতে চাই না, তাই বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছে৷ তবে তার আগে একটা মিথকে ধ্বংস করা দরকার৷ অনেক প্রাচীনপন্থী কূপমণ্ডূক ক্রিকেট ভক্তদের ধারণা যে ক্রিকেটের যাবতীয় হিসেবনিকেশ তৈরি হয় বাইশ গজ বা তার আশেপাশে; ব্যাট, বল অথবা জিঙ্ক অক্সাইড সহযোগে৷ ব্যাপারটা যে আদৌ সে'রকম কিছু নয়৷ ক্রিকেটে তন্ত্রমন্ত্র এবং তুকতাকের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ না না, আমি খেলোয়াড়দের মাদুলি বিশ্বাসকে পাত্তা দিচ্ছি না, ব্যাট আর বল ছাড়া সত্যিই তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই৷ কিন্তু সমর্থকদের তুকতাক যে যে কোনও ম্যাচের ভোল পালটে দিতে পারে; এ অমোঘ সত্য যে অস্বীকার করে তার মাথায় পড়ুক বাজ, বিরিয়ানিতে পড়ুক নকুলদানা, ইত্যাদি৷ কেউ এক চেয়ারে সাড়ে চার'ঘণ্টা ঠায় বসে থেকে প্রিয় দলের ফলো-অন আটকান, কেউ একটানা পেনিসিল চিবিয়ে উইকেট ফেলে দেন, কেউ টিভির সামনে থেকে উঠে গিয়ে নিজেকে শহিদ করেন রিকোয়্যারড রান রেট সামাল দিতে, কেউ আবার নিজের প্রিয় ব্যাটার অপয়া সংখ্যক রানে পৌঁছলে "সরি লেনিনদা" বলে গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে থাকেন ফাঁড়া কাটানোর জন্য৷ আর আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ'সব তুকতাকেই আদত এস্পারওস্পার ঘটে; মাঠের খেলোয়াড়রা স্রেফ দাবার ঘুঁটি৷

এক একজনের তুকতাকের অস্ত্র এক এক রকম৷ অর্জুন গাণ্ডিব দিয়ে মাঠ কাঁপালে ভীমের পছন্দ গদা৷ আর ক্রিকেট সমর্থক হিসেবে আমি চিরকাল ব্যবহার করে এসেছি Pessimism বা নৈরাশ্যবাদ। ভারী কাজের জিনিস, যেমন ধারালো তেমনি, তেমনি কাব্যিক৷ ফিলোসোফিটা বেশ সোজাসাপটা,  ভবিতব্যের কাছে এমন নাকিকান্না জুড়তে হবে যে ভবিতব্য নিজেই ঘাবড়ে গিয়ে ভুলচুক করে ফেলবে৷ ক্রিকেটিয় নৈরাশ্যবাদ নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে আমি বহু যুদ্ধে উতরে দিয়েছি৷ তার জন্য কোনও রকম অমরত্ব বা খ্যাতির প্রত্যাশা বা দাবিদাওয়া আমার নেই৷ একজন ক্রিকেট সৈনিক হিসেবে আমার কাজ শুধু লড়ে যাওয়া, মাঠের এগারোজনকে জেতাতে পারলেই আমি তৃপ্ত৷ আপনার প্রশ্ন করতেই পারেন, পেসিমিজমের যদি অতই তেজ হবে, তা'হলে ভারতীয় ক্রিকেট সব ম্যাচে জিততে পারে না কেন? উত্তরটা একটু ঘুরিয়ে দিতে হবে, শচীন তেন্ডুলকার সব ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে পারেনি বলে তো তাঁর স্কিলসেটকে উড়িয়ে দেওয়া যায়না৷ 

নৈরাশ্যবাদ ব্যাপারটা ঠিক কেমন ভাবে ক্রিকেট তুকতাকে সাহায্য করে? বুঝিয়ে বলতে হলে ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালের অভিজ্ঞতাটা ঝালিতে নিতে হয়৷ ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই প্রবল নাকিকান্নায় দুনিয়া ভাসিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছিলাম। "ইন্ডিয়া ফাইনালে বরাবর হারে, ইংল্যান্ডের হোম-অ্যাডভান্টেজ, আমার বাঁ হাতের কনুইতে একটা সুড়সুড়ে অস্বস্তি, খেলা শুরুর আগেই আমি পান্তুয়া খেয়ে ফেলেছি আর আমি পান্তুয়া খেলেই ইন্ডিয়া হোঁচট খেয়ে পড়ে", ইত্যাদি ইত্যাদি৷ প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ড যখন কয়েক হাজার রান (ওই তেমনই কিছু একটা মনে হয়েছিল) তখন অবশ্য নাকিকান্নার নেকুপনা ঝেড়ে ফেলে বুক বাজিয়ে হাহাকার করতে পেরেছিলাম; "এরা খেলতে যায় কেন? ইংল্যান্ডে না গিয়ে কিনিয়ায় গেলেই পারত! ভাগ্যিস ওয়ানডেতে ইনিংস ডিফীটের গল্প নেই৷ আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি ভারত দু'শোর কমে বান্ডিল হবে" ইত্যাদি ইত্যাদি। 

ওই হাহাকারের জেরে যে'টা হল সে'টা হল ভারত ব্যাট করতে নেমে দিব্যি শুরু করল৷ সৌরভ দিব্যি স্টেপআউট করছে, আর কনেক্ট করছে৷ ব্যাস, আমি ধুন্ধুমার চালু করে দিলাম; "এ বাবা, ক্যাপ্টেন হিসেবে কোনও সেন্স নেই? এমন আনতাবড়ি চালাচ্ছে? আর এমন ল্যালল্যাল করে চালাচ্ছে কেন? আমি চ্যালেঞ্জ করব বলতে পারি এখুনি আউট হবে"।    শেওয়াগও ফুরফুরে মেজাজে খেলতে শুরু করেছে৷ দশটি ওভার পার, ছয়ের ওপর রানরেট৷ আমি ডোজ বাড়িয়ে দিলাম; "শেওয়াগের কোনও গেমসেন্স আছে নাকি? ধুর ধুর৷ এই ডোবালো, আমি লিখে দিচ্ছি"৷ চোদ্দ ওভার নাগাদ একশো উঠে এলো৷ ব্যাট সৌরভ-শেওয়াগের হাতে কিন্তু চালিয়ে খেলতে হচ্ছে আমাকেই৷ সাধ্যমত চেষ্টাও করছিলাম, গলা চড়িয়ে বললাম "গেমপ্ল্যানের অভাব। স্পষ্ট দেখতে পারছি"। কিন্তু এত করেও গোলমালটা রোখা গেল না৷ 

সৌরভ আউট হল দলের ১০৬ রানে। ১১৪য় শেওয়াগ। ১২৬য়ে দীনেশ মোঙ্গিয়া৷ আমি হাঁ, মাথা ফাঁকা৷ দ্রাবিড় আর শচীনকে খেলাতে হলে পেসিমিজমের বন্যা বইয়ে দিতে হবে, কিন্তু কোমর বেঁধে 'সব জলে গেল, ডকে উঠল, অক্কা পেল' বলে কাঁদুনি গাওয়ার আগেই দু'টো খতরনাক থাপ্পড়; ১৩২য়ে দ্রাবিড় গায়েব আর ১৪৬য়ে শচীন হাওয়া৷ কে এক পাড়ার পুজোর চাঁদা তোলা ছোকরা রনি ইরানি আর  জাইলস মিলে সব গুলিয়ে দিল। 

বুক ভেঙে চুরমার৷ সামনে টিভি চলছে, বাবা হতাশায় পায়চারি করছে, মা বলে চলেছে " নতুন ছেলে দুটো কী সুন্দর খেলছে, দ্যাখ"৷ আমার সব কিছুতেই বিরক্ত লাগছে৷ ঘরের পর্দার খয়েরী রঙ দেখে বিরক্তি, বাবার পায়চারীতে বিরক্তি, মায়ের একের পর এক প্রশ্নে বিরক্তি (যুবরাজ বোধ হয় আমাদের বাপতুর বয়সী হবে, তাই না? কাইফকে দেখেই মনে হয় খুব শান্তশিষ্ট,  তাই না? লর্ডসেই সৌরভ প্রথম সেঞ্চুরিটা করেছিল না)। পরে বুঝেছিলাম, আমার যেমন নৈরাশ্যবাদ, মায়ের ক্রিকেট তুকতাকের অস্ত্র হল লাখ লাখ কোটি কোটি প্রশ্ন৷ আর বাবার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট হয় পায়চারিতে। তা মায়ের প্রশ্নের স্টেনগান আর বাবার সতেরোশো মাইল হাঁটাহাঁটির ফলে ভারত ২০০ পেরিয়ে গেল৷ যুবরাজ আর কাইফ সেট। 

আমি নড়েচড়ে বসলাম৷ বুকে সামান্য আশার আগুন জেগে উঠেছিল, তড়িঘড়ি সে আগুনের ওপর গ্যালন গ্যালন পেসিমিজমের জল না ঢাললেই নয়৷ 
"আরে ধুর ধুর, শচীন দ্রাবিড় গেল তল, যুবরাজ কাইফ বলে কত জল"।
" বড়জোর আড়াইশো করবে৷ গোহারান হারটা রুখে দেবে। লজ্জাটা একটু কম হবে৷ এ'টাই যা"।
"যুবরাজের ডিফেন্সে প্রচুর ফাঁকফোকর৷ আর কাইফের হাতে বড় শট আছে বলে মনে হচ্ছে না"। 

একসময় যুবরাজের হাফসেঞ্চুরি হল, ভারতের জিততে একশো'র কম রান দরকার৷ " জলে জলে, সব জলে"; আমার ফেভারিট ডায়লগ। এক কথায় সব উড়িয়ে দেওয়া যায়৷ 

আড়াইশো পেরোল। কাইফের পঞ্চাশও হল৷ "ধুর ধুর, এই গেল বলে৷ এ'সব সিচুয়শনে নাসের হুসেন ম্যাচের রাশ আলগা হতে দেবে ভেবেছ? এই ফাইনাল হুসেনের পকেটে রাখা মানিব্যাগে- পুজোর ফুল, ট্রেনের মান্থলি আর অফিসের আইকার্ডের পাশেই রাখা আছে৷ 

যা হওয়ার তাই হল৷ মাখনে ছুরি চালাতে চালাতে আচমকা সে ছুরি বুকে উঠে এলো; যুবরাজ আউট, কলিংউডের খুচরো বোলিংয়ে৷ 

"কফিনে শেষ পেরেক", ডিক্লেয়ার করলাম। বাবা ফের সোফা ছেড়ে উঠল৷ মা প্রশ্নে ফিরে গেল, " যুবরাজ সত্যিই আউট হয়ে গেল রে? যুবরাজ কি কাঁদছে"? 

এরপর গোটা ব্যাপারটাই একটা ঝড়ের মত ঘটে গেল৷ উত্তেজনা যত বাড়ছে, আমি তত পেসিমিজমের গুঁতোগুঁতি চালিয়ে যাচ্ছি৷ 

কাইফের ওভারবাউন্ডারি৷ ঘ্যাম কভার ড্রাইভ৷ গফ ঘেঁটে ঘ৷ জিততে হলে পঞ্চাশেরও কম দরকার। আমি বলে চলেছি, "এর চেয়ে কোনও মেগা সিরিয়াল দেখলে ভালো হত"। 

কাইফ চালিয়ে খেলছে৷ লোয়ার অর্ডারে হরভজনও টুকটাক চমকে দিচ্ছে৷ আমি দূর্গ আগলে রেখেছে, "আচ্ছা ডোবালে দেখছি এরা"৷ 

স্যাটাস্যাট হরভজন আর কুম্বলে আউট৷ হাতে হারাধনের দু'উইকেট৷ তবে রানও বেশি নয়, খান বারো৷ কাইফ ততক্ষণে বলের বদলে চালকুমড়ো দেখছে৷ কিন্তু আসল দায়িত্ব তখন আমার কাঁধে; পেসিমিজমের স্লগওভার। 
"তিনশো করেছে এই অনেক"। "জাহির আবার ব্যাট ধরতে শিখলো কবে"। "আর দেখে হবেটা কী৷ চ্যানেল ঘোরাও বাবা, নিউজ দেখা যাক"। 

ওই যে বললাম। হাইক্লাস নাকিকান্নায় ভবিতব্যকে দিব্যি টলানো সম্ভব৷ ওভারথ্রোয়ে শেষ রান তুলে নেওয়ার আড়াই সেকেন্ড আগে পর্যন্ত বলে গেলাম, " ইম্পসিবল। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি হারছি৷ বন্ড পেপারে লিখে দিতে পারি দরকার হলে"৷

ভালো পার্ফর্মেন্সের মূলে রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন মনসসংযোগ ; ক্রিকেট তুকতাকও একটা পার্ফর্ম্যান্স। সৌরভ যখন জামা খুলছে তখনও আমি বিড়বিড় করে বলে চলেছি, "স্কোরবোর্ডটা ঠিকঠাক চলছে কিনা কে জানে৷ বলা তো যায় না, যদি কিছু ভুলচুক হয়ে থাকে"৷ আর মায়ের প্রশ্ন সিরজিও তখনও থামেনি, "এহ হে, খালি গায়ে ও'ভাবে হাওয়া লাগাচ্ছে?  বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে না তো"?

Sunday, May 16, 2021

তিনটে বত্রিশের ব্যান্ডেল লোকাল

স্পষ্ট কেউ ডাকলে৷
স্পষ্ট৷ কণ্ঠস্বরটা এখনও কানে বাজছে নির্মলবাবুর৷ গলাটা কি পরিচিত?
"নিমু, ও নিমু। আয়, একবার এ'দিকে আয়"।
ধুস৷ ও নামে অফিসে আবার কে ডাকবে৷ অফিসে তাঁকে নির্মল বলেই কেউ ডাকেনা; মিস্টার দত্ত বা দত্তবাবু বা দত্তদা বা দত্তসাহেব৷ অফিসের ঘানিটানাটানির মধ্যে নিমু ডাকটা ঠিক ওই স্যালাডের মধ্যে হাইক্লাস হিমসাগরের টুকরোর মত৷
নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন৷ নিশ্চয়ই৷
অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে ফের কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে মন দিলেন নির্মলবাবু৷
একটা মস্তবড় স্প্রেডশিট৷ সে'টাকে দলাইমলাই করে মোক্ষম কিছু হিসেবনিকেশ দাঁড় করাতে হবে৷ এর জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন মনযোগ৷ আর..আর একটা ব্ল্যাককফি৷
" আহ, নিমু! এ'দিকে৷ এ'দিকে দেখ"।
এ'বারে একটু তড়াং হতে হলো৷ ফের কানে এলো, স্পষ্ট৷ কেউ ফচকেমো করছ না তো? উঁহু, তিনি নিজে বেশ ভারিক্কি মেজাজের মানুষ, অফিসে বেশ তালেবর পোজিশন বাগিয়ে বসে রয়েছেন৷ তাঁর সঙ্গে এ'সব ফাজলামো কেউ করবে না৷ ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলেন৷ চেয়ার থেকে উঠে চেম্বারের মধ্যেই খানিকটা হাঁটাচলা করে নিলেন৷ তারপর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ফিরলেন নিজের পেল্লায় অফিস-চেয়ারটায়৷
"নিমু! ফের বসে পড়লি? বেরো দেখি"৷
এ'বার নিজের চেম্বার থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলেন নির্মলবাবু৷ বুকের একটা অস্বস্তিকর ধড়ফড়৷ পিওন বিশু ছুটে এলো৷
- কিছু চাইছেন স্যার?
- উঁ...ইয়ে৷ হ্যাঁ রে বিশে, কোনও অচেনা কেউ কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে?
- কই! না তো।
- ঠিক আছে৷ আমি একটু নীচ থেকে ঘুরে আসছি৷
- ও মা৷ গোল্ডফ্লেক আনতে হবে নাকি স্যার? আমায় বলবেন তো! এখুনি এনে দিচ্ছি৷
- না না৷ দরকার নেই৷ আমিই বেরোচ্ছি৷ একটু হাওয়া খাওয়া যাবে'খন৷
অফিসের নীচেই মনোহরলালের পানের দোকান৷ সে'খান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটাহাঁটির পর নির্মলবাবুর মনে হল, "নাহ্, সত্যিই এ এক বিশ্রী ভীমরতি"! সিগারেটটা কাছের ডাস্টবিনে ছুটে ফেলে অফিসের দিকে পা বাড়ালেন নির্মলবাবু।
" নিমু, ফের অফিস? তিন বত্রিশের ব্যান্ডেল লোকালটা ধরতেই হবে"।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে৷ ভীড়ের হইচই, বাসট্রামের গোলমাল ছাপিয়েও স্পষ্ট শুনতে পেলেন সেই মিহি পুরুষকণ্ঠ৷ গা শিরশির করে উঠল নির্মলবাবুর৷ ব্যান্ডেল লোকালে শেষ পা দিয়েছেন অন্তত বাইশ বছর আগে৷ শেষ যে'বার পাড়ায় ফিরেছিলেন৷ ছোটবেলার সে পাড়ার কথা মনে পড়তেই কেমন বুকটা চিনচিন করে উঠল৷ আহ্৷ কদ্দিন বাড়ি ফেরা হয়না৷ কলকাতার ফ্ল্যাটটাকে এখনও ঠিক বাড়ি হিসেবে আপন করে নেওয়া হলো না৷ কিন্তু এদ্দিন পর পাড়ায় ফিরে হবেই বা কি? সে'খানকার পাট তো কবেই চুকেবুকে গেছে৷
"নিমু৷ ট্রেনটা মিস করিস না"৷
আবার!
এ'বার ঝোঁক চেপে গেল। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলেন ফিরতে দেরী হবে৷ আর তৎক্ষণাৎ ট্যাক্সি ধরে সোজা হাওড়া স্টেশন৷ মাঝপথে সেই কণ্ঠস্বরটা আর একবার কানে ভেসে এসেছিল - "হাওড়ার মিনিটা ধরলেই পারতিস৷ খামোখা ট্যাক্সি ধরে বাড়তি কিছু টাকার জলাঞ্জলি"।
বৈদ্যবাটির টিকিট কেটে যখন নির্মলবাবু তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন তাঁর বুকের মধ্যে একটা বিশ্রী ধড়াস ধড়াস৷ তিনটে বত্রিশের ব্যান্ডেল লোকাল তখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে৷ আর মিনিট পাঁচেকের মাথায় ছেড়ে দেবে৷।
ট্রেনে ভীড় ছিল না৷ পছন্দমত একটা জানালার সীট বেছে নিয়ে বসেছিলেন তিনি৷ যাত্রাপথে আরও দু'বার সেই কণ্ঠস্বর শুনতে হয়েছিল নির্মলবাবুকে৷
" নিমু, দু'প্যাকেট কাঠিভাজা কেন দেখি"।
"নিমু, দু'প্যাকেট বাদাম কিনে রাখ ভাই"৷
বৈদ্যবাটি স্টেশনে নেমেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল নির্মলবাবুর৷ এ'টা আর যাই হোক দেজাভু নয়৷ এত বড় ব্যাপারটা তিনি ভুলে গেছিলেন কী করে? পকেট হাতড়ে মোবাইলফোনটা বের করে দেখলেন ফোনে সিগনাল নেই৷ স্বাভাবিক, যে'খানে তিনি এসে পড়েছেন সে'খানে মোবাইল ফোনটা থাকারই কথা নয়৷
***
- আমার কেমন নার্ভাস লাগছে বেবুলমামা।
- মাধ্যমিক দিয়ে ফেলেছিস৷ এখন তুই রীতিমতো অ্যাডাল্ট! কথায় কথায় এত নার্ভাস হওয়ার কী আছে? বি স্টেডি। আর মিনিট পাঁচেক। ট্রেন এলো বলে।
- ট্রেন এলে সত্যিই সে'টা ঘটবে?
- বেবুল সান্যালের অকাল্ট পাওয়ারকে পাড়ার লোকে পাত্তা না দিক৷ কিন্তু আমি হলফ করে বলছি নিমু; আমার তিব্বত সফর বৃথা যায়নি৷ আর সে'টা এ'বার আমি হাতেনাতে প্রমাণ করব!
- এই ট্রেন থেকে আমি নামব?
- ভবিষ্যতের তুই৷ মধ্যবয়স্ক তুই৷ ভবিষ্যৎ থেকে তোকে টেনে আনছি আমার মন্ত্রবলে৷ তিব্বতি তন্ত্র ব্যবহার করে সেই ভবিষ্যতের নিমুর সঙ্গে আমি যোগাযোগও স্থাপন করেছি৷
- যত আজেবাজে কথা৷ ধুস৷ আমি আসি৷
- আরে দাঁড়া না ইডিয়ট৷ ওই যে, ট্রেন ঢুকছে৷
- বাবা ঠিকই বলে৷ তুমি একটা ঢপবাজ৷
- তোর বাবা একটা অখাদ্য মানুষ৷ ব্যবসা করে করে স্রেফ বখে গেল। ওই যে৷ ট্রেন ঢুকে গেছে৷ এ'বার তুই নামবি৷ মানে ভবিষ্যতের তুই। রীতিমত কোট-টাই পরা সাহেবসুবো মানুষ৷ আমি মেডিটেট করতে বসে সে চেহারে আগেভাগেই দেখে রেখেছি।
- বাবা কি সাধে বলে বেবুলটা মহাফেরেব্বাজ!
- তোর বাবা একটা ইডিয়ট৷ থাম৷ ওই যে তুই। তুই আমাদের জন্য কাঠিভাজা আর বাদাম নিয়ে এসেছিস৷ আমি শিওর!
- ওই ধুমসো টেকো খিটখিটে চেহারার লোকটা আমি? ওই হাতের কী একটা খেলনার দিকে তাকিয়ে হাবার মত দাঁড়িয়ে আছে, ও'টা আমি? তাও ভবিষ্যৎ থেকে তোমার মন্ত্রবলে টেনে আনা? মামা, এ খবর জানলে বাবা তোমায় ছাতাপেটা করবে৷ ভুজুংভাজুংয়ের একটা লিমিট থাকবে না? তোমার শ্রীরামপুরের থিয়েটারের দলের কোনও লোককে সেট করেছ নিশ্চয়ই!
***
নির্মলবাবুর স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে ফেরত এলো৷ তাই তো৷ তাই তো৷ যে বেঞ্চিটার কাছে দু'জনের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সোজা সে'দিকে হাঁটা লাগালেন তিনি৷ ওইত্তো দাঁড়িয়ে বেবুলমামা৷ বেবুলমামার পাশে একমুখ বিরক্তি মেখে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোর৷ সে ছেলেটা সম্ভবত সরে পড়তে চাইছে কিন্তু বেবুলমামা তার জামার আস্তিন টেনে ধরে আছে বলে ছুটে পালাতে পারছে না৷
হাওড়ামুখো একটা ট্রেন ঢুকছে৷ নির্মলবাবু বিলক্ষণ জানেন তাঁর কী করার কথা৷ একছুট্টে সেই দু'জনের কাছে পৌঁছে গেলেন তিনি৷ বেবুলমামাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে, পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির হাতে বাদাম আর কাঠিভাজার প্যাকেটগুলো গুঁজে দিয়েই ফের ছুট৷ হাওড়ামুখো ট্রেনটা কিছুতেই মিস করা চলবে না৷