Showing posts with label অফিস. Show all posts
Showing posts with label অফিস. Show all posts

Sunday, June 1, 2025

স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট

আজ যে একটা স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের ওপর ওয়েবিনার জয়েন করার কথা, সে'টা সমীর প্রায় ভুলেই গেছিলো। এইচআরের শর্মিলা ফোন করে মনে করালে। ওয়েবিনার শুরু বেলা এগারোটা থেকে, ও'দিকে আবার দুপুরের মধ্যে জরুরি চারটে রিপোর্ট হেডঅফিসে পাঠানোর কথা। ওয়েবিনার পাশ কাটিয়ে গেলে ঝামেলা হবে নিশ্চিত, কর্মীরা ডেভেলপমেন্টাল ব্যাপারে আগ্রহ না দেখালে তাঁদের কদর থাকে না। এ'দিকে রিপোর্ট সময়মত না পাঠালে মুণ্ডু আস্ত থাকবে না। প্রবল অস্বস্তি বোধ করলে সে। সে অস্বস্তি কাটাতে সেন্ট্রাল এসির কনকনে হাওয়া সত্ত্বেও ডেস্কের পাশে রাখা পেডেস্টাল ফ্যানটা পাঁচের দাগে বনবন করে ঘুরিয়ে দিলে। এরপর টানা তিন কাপ কফি খেলে, বাড়তি চিনি দিয়ে। চাপের মধ্যে বিস্বাদ ব্ল্যাককফিতে চুমুক দেওয়ার মানে হয় না, মুখ এমনিতেই তিতকুটে হয়ে থাকে। রিপোর্টে কমপ্লেক্সিটির বহর দেখে খানকয়েক ক্রিমবিস্কুটও খেতে হলো। শুগার বিষ হতে পারে কিন্তু বিষেই যে বিষক্ষয় হয় সে'টা সমীরের জিভ আর আত্মা বিলক্ষণ জানে।

যা হোক। সময়মত সে ওয়েবিনারে জয়েন করলে। ক্যামেরার অন্যপ্রান্তে যে কেউ দেখলে ভাববে সমীর মগ্ন হয়ে শুনছে অথচ তাঁরা দেখবে না যে সমীরের আঙুলগুলো কীবোর্ডে শশব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কম্পিউটারের অর্ধেক স্ক্রিন জুড়ে রকমারি এক্সেল আর পাওয়ারপয়েন্ট খলবল করছে। বুদ্ধি করে দু'একটা প্রশ্ন আগ বাড়িয়ে করে ফেললে সমীর। সে জানে যে প্রশ্ন করার জন্য সমস্ত কথা মন দিয়ে শোনা মানে প্রডাক্টিভিটি লস। দু'একটা ইতিউতি শব্দ যাই ভেসে এসেছে সে'গুলোকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে "এক্সকিউজ মী, আই অ্যাম কিউরিয়াস আবাউট..." বলে দু'টো প্রশ্ন নামিয়ে দিলে সে। ব্যাস, নিশ্চিন্দি। সবাই জানলে সে জানপ্রাণ লড়িয়ে স্ট্রেসম্যানেজমেন্টের ওয়েবিনার শুনছে। এ'দিকে ওয়েবিনারের মাঝপথেই রিপোর্টগুলো রেডী। চারটের মধ্যে দু'টো রিপোর্ট যত্ন করে বানিয়েছে সে, অন্য দু'টোয় মারাত্মক কাগেরঠ্যাঙবগেরঠ্যাঙ গোঁজামিল। তবে সমীরের বিশ্বাস কোয়ালিটি হলো শুক্তো আর ডেডলাইন হলো তেলকই।

ওয়েবিনার শেষ হতে বেলা গড়িয়ে গেলো। অফিস ক্যাফেটেরিয়া থেকে একটা বার্গার অর্ডার করে ইউটিউবে একটা হেলদি ইটিং পডকাস্ট চালিয়ে দিলো সে। শতব্যস্ততার মধ্যেও লাঞ্চের সময় মিনিট কুড়ি রিল্যাক্স না করলে তাঁর চলে না।

পিঠ চাপড়ানি

অনির্বাণ কম্পিউটারটা শাটডাউন করে অফিসের চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলেন। এখন রাত সোয়া দু'টো। অবশেষে প্রজেক্ট রিপোর্ট সাবমিশন হলো। গোট অফিসে এ সময়ে মাত্র দু'জন, অনির্বাণ আর পিওন সুমিত। সুমিত নিশ্চয়ই এতক্ষণে প্যান্ট্রিতে এক রাউন্ড ঘুম সেরে নিয়েছে। গোটা দিন যা ধকল গেছে, সে বেচারাকে দোষ দেওয়া যায় না। এ'সময়ে এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না কিন্তু সুমিতকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলো না। নিজে প্যান্ট্রিতে ঢুকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নেওয়াই যায় কিন্তু তা'তেও নির্ঘাৎ সুমিত ব্যাটার তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটবে।

পাশে রাখা জলের বোতল, সে'খান থেকেই দু'ঢোক গলায় দিয়ে কফির তেষ্টাকে বাগে আনার চেষ্টা করলেন অনির্বাণ। রিপোর্টটা বেশ ভালোই তৈরি হয়েছে। তা'ছাড়া পর পর তিন রাত জেগে কাজ করার ব্যাপারট টীমে কারুর নজর এড়াবে না। দু'একটা পিঠ চাপড়ানি, "এবার একটু রেস্ট নাও" গোছের স্নেহ-মিশ্রিত কঙ্গ্রাচুলেটরি কথাবার্তা; এ'সব জুটবে। সুকুমারদা তো রিপোর্ট পড়ে অন্তত একবার ওঁর সেই উদার কণ্ঠে "ব্রাভো" বলবেনই। এ'সব ভেবে একটা বেশ তৃপ্তি অনুভব করছিলন অনির্বাণ।

সবাই ভাবে অনির্বাণ কেরিয়ার বলতে পাগল। সবাই ভাবে অনির্বাণ অফিসের একজন "গুড বয়"। ভবিষ্যতের বোর্ডরুমের একটা চেয়ার তাঁর মত ব্রাইট চ্যাপের জন্য নির্ঘাৎ রিজার্ভ করা আছে। কিন্তু অনির্বাণ নিজে মনে মনে জানেন যে কেরিয়ারের প্রতি তাঁর সবিশেষ আগ্রহ নেই। চেয়ারম্যান ডিরেক্টর হওয়ার কথা ভাবলেও তাঁর গায়ে জ্বর আসে। কিন্তু সহকর্মী অভীকের "কী করে এতো খাটতে পারো তুমি অনিদা" অথবা ওই সুকুমারদার "ব্রাভো"- এ'রকম হাজারখানা অদরকারী মৃদু-প্রশংসা আদায় করে নেওয়া ব্যাপারটা ভালো লাগে অনির্বাণের। বারবার মনে হয়, "এইত্তো, ওরা আমায় দেখছে। আমার চেষ্টাগুলো জলে যাচ্ছে না। একজন মানুষের খাটনি ওদের চোখে পড়ছে"। এই "চোখে পড়ছি" আশ্বাসটা একটা বিরাট মায়ার মত টেনে রাখে তাঁকে। সেই টানেই রোজ এই অফিস ছুটে আসার প্রতি তাঁর এত আগ্রহ।

সাতপাঁচ ভাবনার সুতো আচমকা ছিঁড়ে গেলো খটাস শব্দে। সুমিত কফির কাপ রেখেছে সামনে। "বাঁচালে ভাই সুমিত", অস্ফুটে অনির্বাণের আন্তরিক কৃতজ্ঞতাটা প্রকাশ পেলো।

"এমন খাটছেন স্যার, কফি-টফির দায়িত্বটা তো অন্তত আমায় নিতে হবে নাকি"।
"কাজ কিন্তু শেষ সুমিত, তুমি এবারে এসো। এত রাত্রে ফিরতে অসুবিধে হবে না তো"?
"স্কুটার আছে তো। ফাঁকা রাস্তায় বড়জোড় মিনিট কুড়ি। আপনিও বেরোবেন তো"?
"এই। এখুনি। তুমি এগোও"।

সুমিত চল গেলো। এ'বারে বাড়ি ফেরাই যায়। কিন্তু রোজকার মত আজও ছুটে ফেরার আগ্রহটা টের পেলেন না অনির্বাণ। সুকুমারদা, অভীক, সুমিত; এর অনির্বাণের কেউ নন। তবু, অসময়ের কফি আর ছেঁদো ব্রাভোর প্রতি অনির্বাণের বড় লোভ; ওটুকুতেই তাঁর নিজেকে দেখতে পারা।

অস্বস্তিটা সরিয়ে রেখে কম্পিউটারটা স্যুইচ অন করলেন অনির্বাণ।

বসন্ত বাহার

- এই যে, বসন্ত!
- স্যার, রিপোর্টটা রেডি...।
- আরে সবসময় রিপোর্ট রিপোর্ট কোরো না তো। লাইফে একটু ফুর্তি করতে শেখো।
- ফু...কী?
- ফুর্তি। ফান অ্যান্ড ফ্রলিক। একটু হাত-পা ছড়িয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বসো দেখি। কফির কাপে চুমুক দাও। মহম্মদ রফির গান শোনো। আর জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখো নীল আকাশের মায়া...।
- স্যার, পলিউশনের চোটে তো সবই কালচে...। আর জানালার কাচ প্লীজ খুলবেন না। আমার অ্যাজমাটা আবার বাড়বে...।
- অত লিটেরালি সব কিছু ধরো বলেই আজ কবিতা না লিখে স্প্রেডশিট কপচাতে হচ্ছে। শেম্ অন ইউ বসন্ত।
- স্যার, আপনার শরীর-টরীর ভালো তো?
- চনমনে। আজকাল পোয়েট্রি পড়ছি কিনা। জিনিসটা ভালো কিন্তু।
- এই রিপোর্টটা একবার দেখবেন? আজই হেডঅফিস না পাঠালেই নয়।
- উফ! দিলে মেজাজটা মাটি করে।
- আপনি নির্ঘাত আমার লেগপুল করছেন। ফার্স্ট এপ্রিল ফুল-টুল কিছু বানানোর তাল করছেন না তো?
- না না, স্যান্ডউইচ মেথড ট্রাই করছি।
- স্যান্ডউইচ। ওহ। দু'দিকে ভালো ফীডব্যাকের পাউরুটি আর মধ্যিখানে ক্রিটিসিজমের মাখন।
- পোয়েটিক না? তবে প্রশংসা-নিন্দে-প্রশংসা বলাটা ঠিক অ্যাকিউরেট হলো না। এই ধরো গুড নিউজ-ব্যাড নিউজ-গুড নিউজ।
- এই সেরেছে। প্রথম গুড নিউজটা কী ছিলো? যে আমি কবিতা না লিখে এক্সেল ঠেলছি?
- আহ, সেই আবার হাফগ্লাস এম্পটি দ্যাখে। বসন্ত, প্রতিটা চ্যালেঞ্জকেই একটা অপরচুনিটি হিসেবে দেখতে হবে। এই যে তুমি কবিতা লেখো না, সে'টা আদতে কবিতা লিখতে পারার ফিউচার অপরচুনিটি। সে'টা একটা গুডনিউজ।
- তা'হলে যারা অলরেডি কবিতা লেখে তাঁরা...।
- তাঁরা হরিবল। কবিদের জাস্ট সহ্য করা যায় না। এই যে তুমি লেখো না কিন্তু লেখার সম্ভাবনা আছে, সে'টা একটা মারাত্মক ভালো কোয়ালিটি। বুঝলে? তা'বলে আবার কবিতা লিখতে শুরু করে দিও না।
- বস হয়ে আপনি যখন বলছেন, তখন তাই হবে। তা'হলে এ'বারে রিপোর্টটা দেখাই...।
- ব্যাড নিউজটা শুনবে না ভাই বসন্ত?
- বলবেন?
- না বলে উপায় নেই ভাই।
- বলুন। তবে ভালো ঠেকছে না।
- নার্ভাস হয়ো না। মনে রেখো ব্যাডনিউজের ও'পারে আর একটা গুডনিউজ বসে রয়েছে।
- ব্যাড নিউজটা কী স্যার?
- তোমার চাকরিটা আজ গেল। তিরিশ দিনের নোটিস পিরিয়ড শুরু আগামীকাল থেকে।
- স্যার! কী আশ্চর্য! আমার পার্ফর্ম্যান্সে তো কোনও প্রব্লেম নেই...।
- নেই তো। আরে বাবা ভিস্তীদের চাকরী আর নেই মানে কি মানুষের জলের প্রয়োজন নেই না কি তাঁদের পার্ফরমেন্স স্যাটিসফ্যাক্টরি ছিলো না!
- স্যার, দেখুন। এ'সব হেঁয়ালি আমার আর ভাল্লাগছে না। চাকরি যাওয়ার ব্যাপারটা কি জেনুইন?
- হান্ড্রেড পার্সেন্ট! এই খামে চিঠি। আর ইমেল তোমার ইনবক্সে।
- এর পরের গুডনিউজটা কী? আমার গ্র্যাচুইটির টাকাটা মেরে দেবেন?
- রামো রামো। আমি কি পাষাণ ভাই বসন্ত? গুডনিউজ ওয়ান, তোমার মধ্যে কবি হওয়ার পোটেনশিয়াল আছে। কিন্তু মাইন্ড ইউ, তাই বলে কবি হতে যেও না। এরপর এলো সামান্য একটা ব্যাডনিউজ, চাকরিটা গেছে। গন গনা গন গন, গন্‌! এইবারে স্যান্ডউইচের নীচের আসল গুডনিউজটা। আমরা ফ্রিল্যান্স কন্ট্রিবিউটর হায়্যার করছি। প্রচুর টাকা। টাকায় জাস্ট ভেসে যাওয়া। দিনে চারঘণ্টা দিলেই যে কেউ লাল হয়ে যাবে।
- ওহ, তাই নাকি স্যার? থ্যাঙ্কিউ...আমারও মনে হচ্ছিল ফ্রিলান্সিংয়ে গেলে আমার হাতে একটু সময় বাড়বে...অন্যান্য কিছু কাজও নিতে পারবো। তা'ছাড়া আমার ঘোরাঘুরির এত শখ...।
- তা আছে নাকি তোমার নজরে ভালো কোনও ফ্রিলান্স অ্যানালিস্ট? তোমার রেকমেন্ড করা কেউ হায়্যার হলে তুমি দু'টো হাজার টাকার আমাজন ভাউচার আর একটা গুডি ব্যাগ পাবে। ফ্যান্টাস্টিক না? আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে না ভাই?
- আপনি আমায় ফ্রিল্যান্স পোস্টে নিচ্ছেন না?
- আমাদের কোম্পানির পলিসি যে, ছাঁটাই করা কাউকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ঢোকানো যাবে না। তবে ভাবো স্যান্ডউইচ মেথডের এফেক্টিভনেস, এত একটা খারাপ খবর পেয়েও নিশ্চয়ই তোমার মনের মধ্যে এন্তার ফুর্তি! দু'হাজার টাকার আমাজন ভাউচার আর একটা ঢাউস গুডিব্যাগ...ওহ ওয়াও...এই...এ কী বসন্ত...তুমি প্রিন্টারটা অমন রাক্ষুসে মেজাজে তুলছ কেন...এই...এই...এই ও'টা ছুঁড়ে মারলে আমার লাগবে কিন্তু...এই...এই...!

Sunday, March 16, 2025

বস-বিলাপ



রোব্বার দুপুর। অফিসের আরামদায়ক চেয়ারে আলতো গা এলিয়ে জুম কলে একটা রিভিউ নিচ্ছি। হায়দ্রাবাদে বসে থাকা সেলস-হেড রেড্ডি আর আমাদের গোরখপুরের ফ্যাক্টরি ইনচার্জ দত্তকে বেদম ডিজিটাল ধোলাই দেওয়ার মধ্যে একটা জমাট তৃপ্তি আছে, সে'টা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। আর্দালি পরিমল দরজার বাইরে টানটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে; মাঝেমধ্যে বেল বাজিয়ে তার স্পীড চেক করতেও বেশ লাগে। "পানি লাও", "কফি লাও", "ইডলি লাও", "এসি তেজ করো"; এমন রকমারি ফরমায়েশ ডাইভ দিয়ে লুফে নেওয়ার জন্য ও সদা-প্রস্তুত।

আমার টেবিলের উল্টো দিকে গোবেচারা মুখে বসে অপারেশনশের প্যাটেল আর ফিনান্সের সচদেব; ওরা জানে যে জুম মিটিং শেষ হলে ওদের কপালে আড়ং ধোলাই আছে। ওদের এই তটস্থ হয়ে থাকাটা জরুরী; এদের দমিয়ে না রাখলে মাথায় উঠে ড্যাংড্যাং করে নাচবে, কোম্পানির প্রফিটেবিলিটি কমবে। বিশেষত ছুটির দিনে কড়কাতে পারলে আউটপুট বেশ এনহ্যান্সড হয়। আগামী উইকেন্ডে যেমন অফিস ছেড়ে ফিল্ডে বেরোব। বিলাসপুর অফিসে গিয়ে সে'খানকার টীমের ওপর একটু তম্বি করে আসা যাবে, পাশাপাশি কিছু নতুন মানুষদের জী-হজৌরিও আদায় করা হবে।

জুম শেষ হলে পরিমলকে ক্যাপেচিনো দিতে বলে সচদেবের নিয়ে আসা ফাইল খুললাম। আড়চোখে দেখলাম সচদেব রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলে। এসি ফেল পড়ছে ব্যাটার এমন নার্ভাসনেস। নাহ্, শক্ত হাতে এদের বেঁধে যে রাখতে পেরেছি, সে'টাই নিশ্চিন্দি। রিপোর্টে তেমন ভুল না পেয়ে ফন্ট সাইজ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলাম। সচদেব মারাত্মক ভেবড়ে গিয়ে সরিটরি বলা আরম্ভ করলো, আর সেই সুযোগে আমি অ্যাটেনশন টু ডিটেল আর এক্সেলেন্সের যোগাযোগ নিয়ে একটা ছোটখাটো লেকচার দিয়ে ফেললাম। সচদেব আর প্যাটেল এমন "বাহ্ বাহ্" শুরু করলে যেন আমি গজল গাইছি আর ওর তিন পেগ গিলে দুলে দুলে গান শুনছে।
দামী ক্যাপেচিনোতে চুমুক দিতে দিতে জ্ঞান ঝাড়তে ঝাড়তে মেজাজে একটা জেল্লা চলে এসেছে; এমন সময় ঝুমার ফোন এসে সব মাটি করলে। কানে রিসিভার ঠেকানো মাত্র ইলেক্ট্রিক শকের মত চিৎকার:

"রোব্বারের বিকেল হতে চললো অথচ বাড়ি ফেরার নাম নেই! বলি বাড়ির কাজকম্ম কিছু আছে না নেই"?
"আর বলো কেন, অফিসে এত প্রেশার! দিনে চল্লিশ ঘণ্টা কাজ করলে তবে..."। ঝুমা ছাত্র ঠ্যাঙানো দিদিমণি, যুক্তিনিষ্ঠ বিরক্তিকর মানুষ। বিয়ের এত বছর পরেও ওর দাবড়ানি শুনলে এখনও আমার বুক কেঁপে ওঠে।
"থামো! যত বাতেলা! তোমার শালা আসছে, কোথায় বাড়িতে বসে ঘর গোছাবে, ফ্যানের ঝুল সাফাই করবে, মাছ ধোবে, ময়দা মাখবে...তা নয়.."।
"আহা তুমি বুঝছো না ঝুমা.."।
"তুমি আধঘণ্টার মধ্যে ঘরে ফিরবে কিনা বলো..."
"ইয়ে আমার আরো ঘণ্টাখানেক লাগবে। আসলে একটা ক্রিটিকাল মিটিং শিডিউল করা আছে। সে'টা অ্যাটেন্ড না করলেই নয়"।

খট্। ঝুমা ফোন কেটে দিয়েছে। বাপর বাপ, কী তেজ। গলা শুকিয়ে এসেছে। পরিমলকে একটা বড় গ্লাস গোলাপজল মেশানো লস্যি দিতে বলে আর সচদেবকে বেধড়ক চাবকানি দিয়ে তবে পিলে সামান্য ঠাণ্ডা হলো। এরপর প্যাটেলকে বললাম ঝটপট একটা অল ইন্ডিয়া লেভেলের জুম মিটিং ডাকতে। প্যাটেল অবাক হলে না, সে জানে যে সন্ধে পেরিয়ে রাত না হলে আমার অফিস থেকে বেরোতে ইচ্ছে করে না; সে কী সোম আর কী রবি। বাড়ি গেলে তো সেই ঝুমার খটরমটর আর হাবিজাবি কাজ। তার চেয়ে ভালো আমার এই অফিসের জমিদারিই ভালো।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না বোকাপাঁঠা মানুষজন ছুটি চেয়ে হন্যে হয় কেন? এরা কি কেউ কোনোদিন এক্সেলেন্সকে চিনতে শিখবে না?
**
(ছবিটা এঁকেছে জেমিনাই)

Thursday, November 21, 2024

পড্‌

অনিন্দ্য দিব্যি রোব্বারের মেজাজে সোফায় বসেছিলেন। সামনের দেওয়ালের মিউট রাখা টিভিতে এক আধুনিক গাইয়ে অত্যাধুনিক ভাবভঙ্গি করে গাইবার চেষ্টা করছিলন। সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা প্লেটটা সাফ হয়ে গেছে, তবে লুচি-বেগুনভাজার এঁটো চিনতে অসুবিধে হয় না।

এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো।
-হ্যালো!
- অনিন্দ্যবাবু! কেমন আছেন?
- আপনি কে? আমি...আমি কোথায়..।
- হে হে। আমি অফিস অ্যালার্ম। আপনার ড্রিমপডের দশ মিনিট কোটা শেষ। এ'বারে যে কাজে ফিরতে হয়।
- ওহ। তাই তো। যাচ্চলে। লুচির গন্ধটা এখনও আঙুলের ডগায় যে।
- এই না হলে সুপার পাওয়ার ন্যাপ। এ'বারে চটপট টেবিল গিয়ে বর্গিন অ্যান্ড বার্ক্সের ফাইলটা প্রসেস করে ফেলুন। বস অপেক্ষা করছেন।

কাশ্মীর সলিউশন


১। 

পুজোটা জলে গেল না জ্বলে উঠলো সে'টা বুঝতে পারছি না৷ কাজের অকথ্য চাপে বছর দুই সমস্ত ক্যাসুয়াল লীভই প্রায় নষ্ট হয়েছে৷ এ'বারে রোখ চেপেছিল, পুজোর দিনচারেক আগে থেকে ছুটি নিয়ে বসে থাকব এবং বিজয়ার কোলাকুলির পর্ব শেষ না হলে অফিসমুখো হব না৷ অথচ একটা বিশ্রী অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে যেতে হচ্ছে দিন-কয়েকের জন্য৷ চতুর্থীর মুখে পাড়া ছেড়ে বেরোতে হচ্ছে ভেবেই মনটা তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছে৷ স্বাভাবিকভাবেই সুমির মেজাজ খিঁচড়ে রয়েছে, রকমারি রঙচঙে পুজোর প্ল্যান আচমিকা বাতিল। বল্টু, ওরফে খোকার এ'সবে বিশেষ আসে-যায় না৷ ক্লাস এইটের পুজোর জগতে বাপ-মায়ের চেয়ে ইয়ারদোস্ত বেশি জরুরী।

গতকাল অফিসে বসে এক্সেল শিট জরীপ করতে করতে হাটারি-ভাতঘুম-লংড্রাইভ ল্যুপ প্ল্যান করছি। এমন সময় সুমন্তদা ফোন করে মেজাজের ফিশফ্রাইতে একগাদা ডেটল ছড়িয়ে দিলো।

- সঞ্জয়, আর্জেন্ট একটা ইয়ের জন্য কল করেছি।

- অ্যানালিসিস প্রায় রেডি৷ এই আর মিনিট দশেক।

- না না৷ তা নয়৷ অন্য ব্যাপার৷

- সুমন্তদা৷ সপ্তমীর দিন কোনো ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে আমি নেই৷

- না। ইটস নট আবাউট দ্যাট৷ মাচ মোর সিরিয়াস।

- কী হয়েছে?

- অনিরুদ্ধর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতেই হচ্ছে৷ ডিসিপ্লিনারি কমিটি ডিসমিসাল রেকমেন্ড করেছে৷

- সে কী! মাস ছয়েক সাস্পেন্ড করে রাখলে হত না? মাইনে-টাইনে কেটে নিলে? সুমন্তদা, অনিরুদ্ধদা যে মানসিক অবস্থায় আছে..।

- আমি জানি। তাই তোমায় ফোন করলাম৷ বোর্ড আমায় বলেছিল পত্রপাঠ ইমেল পাঠিয়ে অনিরুদ্ধকে বের করে দিতে৷ কিন্তু আমি হাতেপায়ে ধরে দিন-কয়েকের সময় নিয়েছি৷ এ কাজ ইমেলে করা অসম্ভব।

- এই ব্রাঞ্চ অফিসটা তো অনিরুদ্ধদারই হাতে গড়া। তুমি, আমি, টীমের অর্ধেক মানুষ ওর রিক্রুট। এতটা রূঢ়ভাবে...এ'টা ঠিক হচ্ছে না সুমন্তদা৷

- সঞ্জয়৷ আমি জানি অনিরুদ্ধর জন্য মনখারাপটা তোমারই সবচেয়ে বেশি হবে৷ আফটার হল, হি ওয়াজ ইওর ডাইরেক্ট মেন্টর।

- শুধু মেন্টর কেন৷ বয়সের তফাৎ খানিকটা থাকলেও, অনিদা আমার বন্ধু৷ যদিও শেষ বছর দেড়েকে যোগাযোগ কতটুকুই বা আছে...।

- এ কাজটা তোমাকেই করতে হবে সঞ্জয়।

- কাজ৷ কোন কাজ?

- বরখাস্ত হওয়ার খবরটা তুমি ওকে সামনাসামনি জানাবে৷ আর চিঠিটা হাতে দেবে৷ এম্প্যাথিটিকালি, যে'টা তোমার চেয়ে ভালো কেউ পারবে না৷

- হুম৷ বেশ৷ আজ অফিস থেকে ফেরার সময় ওর বাড়ি হয়ে..।

- অনিরুদ্ধ কলকাতায় নেই৷

- ওহ্‌। তা'হলে?

- কাশ্মীরে। আমার কাছে খবর আছে। পহেলগাঁওতে কোনো এক ঘুপচিতে বসে রয়েছে গত মাস দুই-তিন৷

- এ সময় আমায় কাশ্মীর যেতে হবে?

- প্লীজ সঞ্জয়৷ না বোলো না৷

- কিন্তু..।

- হাতে সময় নেই৷ দিন দুই-তিনের মধ্যে ওকে বের করে দেওয়ার নিদান এসেছে। আমি হেল্পলেস। এ কাজটা আমি ইমেলে সারতে চাইছি না। ইউ আর মাই অনলি হোপ।

- এ তো আর দুম করে সকালে গিয়ে বিকেলে চলে আসা নয়..।

- অনিরুদ্ধ মানসিকভাবে ঠিক কতটা বেঠিক জায়গায় আছে তা জানি না৷ তাড়াহুড়ো কোরো না। কেমন? হাতে দিন দুই নিয়ে যাও৷ কিছুটা সময় কাটাও ওর সঙ্গে৷ চাকরীর মায়া সে একদিন কাটিয়ে উঠবেই। কিন্তু এ'সময় কয়েকদিনের জন্য একজন বন্ধুকে পেলে তার উপকার হবে৷

- সুমন্তদা..।

- প্লীজ সঞ্জয়। টেক ইট অ্যাস অ্যান অফিশিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট৷

দ্য গ্রেট অনিরুদ্ধ মজুমদার। এক সময় সবাই বলাবলি করত যে এ হলো কর্পোরেটের উত্তমকুমার৷ তাঁর আজ কী দশা৷ ওঁর এই পতনটা আমার কাছে একটু বাড়তি মন খারাপের। কী'ভাবে যেন আমরা বেশ বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। যদিও অনিরুদ্ধদা আমার সিনিয়র আর মেন্টর, আমার ইন্টারভিউও সেই নিয়েছিল। আর পাঁচটা সম্পর্কের মত আমাদের ঘনিষ্ঠতাও অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে অবশ্য৷ অনিরুদ্ধদা কী'ভবে যেন নষ্ট হয়ে গেল।

তবে ওঁর চাকরী যাওয়ার খবরটা আমি নিজেই ঠিক মেনে নিতে পারছি না, ওকে ছাড়া এ কোম্পানির কথা ভাবা যায় না। যা হোক, দিন দুয়েকের ব্যাপার। আশা করি সপ্তমীর দিন রাতে ফিরে যেতে পারবো৷ পুজোয় কাশ্মীর ভেবে মনটা চাঙ্গা করার চেষ্টা করছি বটে, তবে ব্যাপারটা এমন বিশ্রী...।

ফ্লাইটের বোর্ডিং শুরু হবে৷ সুমির ফোন এলো।

- বোর্ড করলে?

- এই শুরু হবে।

- বেশ।

- সুমি, রিয়েলি সরি৷ জানি প্ল্যানগুলো ভেস্তে গেলো..। আসলে..।

- আমি একটা অন্য কথা বলতে ফোন করেছি৷ অনিরুদ্ধদার ব্যাপারটা সিরিয়াস৷ ভদ্রলোক তোমায় সবিশেষ স্নেহ করতেন৷ কাজেই তাড়াহুড়ো কোরো না৷

- বলছো?

- ইনসিস্ট করছি। নীলারা থাকছে, পুজো একা কাটবে না আমার৷ বল্টুও বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড়ে ব্যস্ত থাকবে৷ আর তুমিও বন্ধুর কাছেই যাচ্ছ৷ হি নিডস ইউ৷ আচমকা মনে হলো, পুজোর সময়ে অন্তত একটা দিন অনিরুদ্ধদা একা থাকবে না৷ দিস ইজ আ গুড থিং৷

- থ্যাঙ্ক ইউ।

- তাড়াহুড়ো করবে না৷ মনে থাকবে?

- তাড়াহুড়ো করব না৷ আসি, কেমন? শ্রীনগর পৌঁছে ফোন করব৷

- মারাত্মক ক্লিশে মার্কা একটা গল্পের বই তোমার ব্যাকপ্যাকে পুরে দিয়েছি৷ ধরে নিও খুচরো পুজোসংখ্যা৷ ফ্লাইটে খানিকক্ষণ সময় কেটে যাবে৷

- ঠিক হ্যায়।

**

২। 


শ্রীনগর এয়ারপোর্টে আমার অপক্ষায় ছিলেন সাজিদ, তাঁর ইনোভা-সমেত৷ অফিস থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা ছিল যাতে ট্যাক্সির হাঙ্গামায় না পড়তে হয়৷ একা মানুষ, দিন-দুয়েকের জন্য এসেছি, কাজেই লাগেজ বলতে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাকপ্যাক। প্লেন ল্যান্ড করার মিনিট পনেরোর মাথায় আমি সাজিদজির গাড়িতে বসলাম, "চলিয়ে সিধা পহেলগাঁও"। আড়াই ঘণ্টার পথ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছনো দরকার৷ অনিরুদ্ধদার ঠিকানা আমার কাছে আছে, কিন্তু ওর মোবাইল নম্বরটা গত মাস তিনেক ধরে অচল৷ কাজেই তাঁর দেখা পাওয়া জলবৎ নাও হতে পারে।

অক্টোবর মাসের রোদ্দুর দেখলাম বেশ চড়া, গায়ের পাতলা জ্যাকেটটাও খুলে রাখতে হলো৷ তবে হাওয়ার মিঠেভাবটা বেশ আরামদায়ক৷ চোখ বুজে আসছিল৷ সাজিদজি বেশ সদালাপী, কিন্তু আমি ঠিক গল্পগাছায় মন দিতে পারছিলাম না। আমি ভাবছিলাম হাতের কাজের ব্যাপারটা। গত মাস ছয়েক অনিরুদ্ধদা যে'ভাবে ডুব দিয়েছে, তা'তে কিছু একটা হওয়ারই ছিল। কিন্তু সোজাসুজি চাকরি নট হওয়া ব্যাপারটা আমি অন্তত খানিকটা হকচকিয়ে গেছি৷ এ কোম্পানি দাঁড় করানোর পিছনে ওঁর অবদান প্রবল, তাঁকে এমনভাবে ঘাড়ধাক্কা দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না বোধ হয়৷ বিশেষ করে গত বছরখানেক ওঁর ওপর দিয়ে যা ব্যক্তিগত ঝড়ঝাপটা গেছে। সেই বরখাস্ত হওয়ার খবর আমি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আমি কর্পোরেট জল্লাদই বটে।

শ্রীনগর-কন্যাকুমারী হাইওয়ে ধরে খানিকটা এগোলেই পাম্পোরের কেশর চাষের জমি৷ এখন সম্ভবত সবে ফসল বোনা হয়েছে। সে সম্বন্ধে মনোগ্রাহী নানা রকমের খবর দিচ্ছিলেন সাজিদ৷ টুরিস্ট হলে মন দিয়ে শুনতাম৷ কিন্তু এখন মনের মধ্যে সে স্পেস নেই৷ প্লেনের স্যান্ডউইচ আমার রোচে না, কাজেই পথে কোথাও ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া দরকার৷ সাজিদ গাড়ি দাঁড় করালেন অবনন্তীপুরার একটা ছোট ধাবায়৷ আলুর পরোটা আর কফি দিয়ে চটপট দু'জনে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে বসতে যাব তখন সাজিদ বললেন সামনেই রয়েছে অবন্তীস্বামী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। বারোশো বছর পুরনো মন্দির, চোদ্দ শতকে সুলতান সিকন্দর এ মন্দির নির্মম ভাবে গুড়িয়ে দেন৷ এ'সব গল্প বলে সাজিদ চাইলেন আমার আগ্রহ খানিকটা উস্কে দিতে৷ ভ্রমণপিপাসু মানুষ দেখতে অভ্যস্ত সাজিদ আমার মত গাম্বাটের কাশ্মীরের প্রতি অনাগ্রহের কারণটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিলেন না৷


ভাঙা মন্দির দেখার উৎসাহ আমার আদৌ ছিল না। কিন্তু নার্ভাসনেসটা বাড়ছিল। অনিরুদ্ধদা কী ভাবে রিয়্যাক্ট করবে? কোনো পাগলামি করে বসলে? সে অস্বস্তিকে খানিকটা সামাল দিতেই সাজিদকে বললাম, চলুন এ'খানে এলাম যখন দশ মিনিট ঘুরে যাই৷ ধ্বংসাবশেষটা সবিশেষ নিরিবিলি৷ নতুন করে সে'খানে গোলাপবাগান করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য আমি স্থাপত্যের চেয়ে ফুল অনেক বেশি অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারি। কয়েক ফালি মেঘের জন্য রোদ্দুর নরম হয়ে এসেছিল, কাজেই সে বাঁচিয়ে-রাখা-ভাঙনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে মন্দ লাগছিল না৷ দু'দল স্থানীয় মানুষ ইতিউতি ছড়িয়ে বসেছিলেন। এ'দিকে সাজিদ অনর্গল বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন কোথায় কোন ভাঙাচোরা পাথরের গায়ে ক্রমশ আবছা হয়ে আসা ইতিহাসের পাশাপাশি আর্কিটেকচারাল মণি-মুক্তো জড়িয়ে আছে।

আর্টকে ধ্বংস করা বেশি সহজ না মানুষকে? আমার মন আটকে ছিল অনিরুদ্ধদায়৷ অফিস ফাঁকা হয়ে এলে অনিরুদ্ধদা মাঝেমধ্যে হেমন্তবাবুর গান চালিয়ে দিতেন মোবাইল স্পীকারে। বলতেন তা'তে নাকি ফোকাস ইম্প্রুভ করে। সাজিদের মনোগ্রাহী লেকচার শেষ হলে কানে ইয়ারফোন গুঁজে "আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা" চালিয়ে দিলাম। এক বিবাহবার্ষিকীতে আমাদের নেমন্তন্ন করেছিলেন অনিরুদ্ধদা। ডিনার শেষের আড্ডায় এ গানটা গেয়েছিলেন ভদ্রলোক, ভারী ভালো লেগেছিল। যদিও আমি তেমন সুরের সমঝদার নই, তবে সম্ভবত সেই সন্ধ্যেটা এত সুন্দর ছিল বলেই ওঁর গাওয়া গানটা আমার এত টেনেছিল। আমি আর সুমি বাড়ি ফেরার পথে মুগ্ধ হয়ে আলোচনা করেছিলাম, "হোয়াট আ পার্ফেক্ট কাপল"। সে কথা ভাবলে এখনও অবাক লাগে৷ আমার নির্বোধ চোখজোড়া দিয়েও অবন্তীপুরার এই ধ্বংসাবশেষ বড় সুন্দর ঠেকল। ভাঙাচোরা স্থাপত্য কিন্তু ভাঙনটাই তার ফাইনাল ডেফিনিশন নয়। আর হয়ত কোনো এক যুগে তার সৌন্দর্যে পার্ফেকশনও ছিল। পার্ফেকশন চিরস্থায়ী হতে হবে এমন দিব্যি তো কেউ দেয়নি।

সে'খান থেকে বেরিয়ে রাস্তার উলটো দিকেই ঝিলম বয়ে চলেছে। পাড়াগাঁ চিরে বয়ে চলা যে কোনো ছোটো নদীর মতই আড়ম্বরহীন অথচ অপরূপ। সে'নদী ধরে শ'খানেক কিলোমিটার পেরোলেই নাকি পাকিস্তান৷ কাছের স্টল থেকে এক কাগজের কাপে কফি নিয়ে ঝিলমের দিকে মুখ করে আর এক প্রস্থ দাঁড়ালাম৷ সাজিদ বুঝতে পারছেন না যে খানিকক্ষণ আগে এর তাড়াহুড়ো করা একজন মানুষ হঠাৎ এমন মিইয়ে গেল কেন। অনিরুদ্ধদাকে আমি সমীহ করি, খানিকটা বায়াসডও ওর প্রতি। কিন্তু ওঁকে কি আমি ভালোবাসি? বাসলে সে ভালোবাসাটা ঠিক কী'রকম? জানি না৷ তবে ওকে ঘুষ দিয়ে শান্ত রাখার একটা শেষ চেষ্টা আমি করব। আমার ব্যাকপ্যাকের মধ্যে একটা গোবিন্দভোগ চালের আড়াই কিলোর প্যাকেট আছে। পহেলগাঁওয়ে ও জিনিস সহজলভ্য নয় বলেই আমার বিশ্বাস। আর গোটা অফিসে শুধু একা আমি জানি যে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে তৈরি ল্যাটপ্যাটে খিচুড়ির গন্ধে অনিরুদ্ধদা কবিতা খুঁজে পান। সমস্ত অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে গাড়িতে উঠে বললাম, "সাজিদজি, অব সিধা পহেলগাঁও"।

***

৩। 

- সঞ্জয়, জায়গাটা কেমন লাগছে?

- আরে! আপনি এসে গেছেন! অপূর্ব৷ কখন ফিরলেন?

- এই জাস্ট৷ ইশফাক জানালে তুমি নদীর ধারে বসে আছো। তাই সোজা চলে এলাম এখানে।

- অনিরুদ্ধদা! কদ্দিন পর আপনাকে দেখছি৷

- ছ'মাস বারো দিন আগে গর্ডন অ্যান্ড স্মিথের রিভিউ মিটিংয়ে দু'জনেই ছিলাম৷ সেই শেষ৷

- আপনার মেমোরিটা চিরকালই বড্ড চাঁচাছোলা।

- ইট ইজ আ কার্স৷

- ইয়ে৷ আপনার ইশফাক আতিথেয়তা জানে বলতে হবে৷ জামাই আদরে ভাত-সবজি দিয়ে লাঞ্চ করালে। স্নান ঘরে গরম জলের ব্যবস্থা করলে৷ ঘরখানাও দিব্যি ছিমছাম দিয়েছে৷ আর পাহাড়ি নদীর ধারে এমন শতরঞ্চি বালিশ পেতে এর আগে কখনো বসেছি বলে মনে পড়ে না৷ খানিকক্ষণ আগেই আবার চমৎকার কফি দিয়ে গেল৷

- আই অ্যাম গ্ল্যাড ইউ আর কমফর্টেবল সঞ্জয়।

- আপনার এই ইশফাক জানলো কী করে আমি আসব? আমার নাম শুনেও চমকে উঠলো বলে মনে হলো না৷

- ছ'মাস অফিসমুখো হইনি৷ কারুর ফোন রিসিভ করিনি৷ একদিন না একদিন কেউ যে আমায় ট্র্যাক করতে এ'খানে আসবে, সে'টা তো জানাই ছিলো৷ আর তুমি ছাড়া ওরা কাউকে পাঠাবে না, সে'টাও স্বাভাবিক৷ কাজেই ইশফাককে অনেকদিন ধরেই আমি কোচ করে রেখেছি৷ আফটার অল তুমি দি অনিরুদ্ধ মজুমদারের প্রটেজে বলে কথা।

- তা দি অনিরুদ্ধ মজুমদার কি দাঁড়িয়ে থাকবেন? নাকি বসবেন। অবশ্য আপনি চাইলে ইশফাকের বসার ঘরেও ফেরত যেতে পারি।

- এ'খানেই বসি। ছ'মাস হতে চললো, জানো। অথচ লিদরের প্রতি মুগ্ধতা এখনও রাইজিং কার্ভে।

- নদীটা সত্যিই সুন্দর।

- সামনের মে মাসে এসো। তখন এ নদী আরও জম্পেশ ফর্মে থাকে। আর প্রচুর ফুল দেখতে পাবে।

- কেমন আছেন অনিরুদ্ধদা?

- দারুণ৷ প্রিজনার অফ আজকাবানের মাঝপথে৷ সর্বকালের সেরা ক্যুইডিচ ফাইনাল শুরু হবে৷ আর তারপরেই সর্বকালের সেরা ক্লাইম্যাক্স৷ এই দ্যাখো, এ'টা বলেই গায়ে কাঁটা দিলো।

- কতবার হলো এ নিয়ে?

- ভালো নভেলের ক্ষেত্রে কাউন্ট ইমম্যাটেরিয়াল৷ প্রতিটি বার প্রথমবার!

- কথাটা এড়িয়ে গেলেন৷ আছেন কেমন?

- ডিভোর্স আর প্রফেশনাল হারাকিরিটা তো মিথ্যে নয়৷ তবে তার বাইরেও একটা মানুষের ভালোমন্দ থাকে৷ আমি ভালোয় আছি। প্রিজনার অফ আজকাবানের উত্তরটা এড়িয়ে যাওয়া নয়, আমি এড়িয়ে যাওয়ার লোক নই। যারা বইয়ের রেফারেন্স নিয়ে ছেঁদো কথা বলে, তাদের আমি সহ্য করতে পারি না।

- এ জায়গাটা সত্যিই বড় সুন্দর৷ সবুজ পাহাড়ে মোড়া। এলোমেলো পাথর ভেঙে ছুটে চলা সবজে-নীল পাহাড়ি নদী৷ থেবড়ে বসলে আর উঠতে ইচ্ছে করে না৷ আর এই কিন্ডলটা এনে কাজের কাজ করেছি। সবচেয়ে বড় কথা টুরিস্টদের উৎপাত তেমনটা চোখে পড়ছে না৷

- ভিড় মূলত লিদরের অন্যদিকে, বাজারের আশেপাশে৷ এ'দিকটায় গাড়িটাড়ি আসে না৷ অন্তত আড়াই কিলোমিটার ট্রেক করে আসতে হয়৷ কাজেই উড়ে আসা মানুষের হুজুগবোধ বাধ্য হয়েই খানিকটা সমঝে চলে৷ তবে ক্যাম্পাররা আসে৷ আধমাইল নেমে গেলে দেখবে একটা চমৎকার ক্যাম্পিং সাইট৷ আরও খানিকটা এগোলে খান তিনেক কটেজ৷ সায়েবসুবোরা এসে মাঝেমধ্যে জিরিয়ে যান।

- আসার পথে গাড়িটা বাজার হয়েই এলো৷ দিব্যি জমজমাট৷ খানিকটা মানালির মত৷

- গত চারমাসে একবারও সে'মুখো হইনি।

- সে কী! দরকার পড়েনি?

- এই স্পটটাকে সেন্টার করে দু'কিলোমিটার রেডিয়াসের বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ে না সাধারণত৷ আর পড়লে, ব্রাদার ইশফাক জিন্দাবাদ।

- আপনার হাত কাঁপাটা বেড়েছে৷

- হ্যাঁ৷ নার্ভের দোষ তো..ও জিনিস আর কমবে না৷ সুমি আর বল্টু কেমন আছে?

- দিব্যি৷

- ওদের নিয়ে আসলে পারতে তো৷ ইশফাকের আস্তানা তাদের রুচতো না হয়তো৷ কিন্তু ওই কাছের কটেজে একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত৷ বিউটিফুল ভ্যিউওলা ব্যালকনি, গিজার, রুমহিটার, টুয়েন্টি ফোর সেভেন খানসামা; সমস্ত ব্যবস্থাই সে'খানে আছে।

- তা'তে আপনার সঙ্গে গল্প জমত কী?

- পুজোর মুখে ছেলেবউ ফেলে এলে আমার সঙ্গে গল্প জুড়তে?

- জরুরী কাজ আছে বটে৷ তবে আমাদের গল্প আড্ডাও অনেকদিন হয় না অনিরুদ্ধদা৷

- নর্থস্টারের অ্যাকাউন্টটা আছে না গেছে?

- গেছে।

- পাওয়ারম্যাক্স?

- গন।

- ডোন্ট টেল মি৷ আর মিলার ফক্স?

- গোল্লায়।

- কোম্পানিটা আছে তো?

- হেহ্‌৷ উত্তমকুমার ছাড়া টালিগঞ্জ যে'ভাবে টিকে আছে; টিমটিম করে।

- পাওয়ারম্যাক্স আর নর্থস্টারকে ফিরিয়ে আনার দাওয়াই আমি তোমায় বাতলে দেবো। মিলার ফক্সটা একটু গোলমেলে। ভেবে দেখছি৷

- বৌদির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?

- আই ট্রাই নট টু বার্ডেন হার।

- অভিমান? অনিরুদ্ধদা?

- অপরাধীর অভিমান ভীষণ ডেস্ট্রাক্টিভ সঞ্জয়৷ চেষ্টা করি সে ব্যাপারটা এড়িয়ে চলতে।

- এ'ভাবে ডুব দিয়ে থাকার মানেটা কী?

- আমার ঠিকানা সবাই জানে৷ গাঢাকা দিয়ে তো নেই। আফটার অল, আই অ্যাম নট আ ফিউজিটিভ। ডুব আমি দিইনি৷ যাকগে৷ কাল তোমায় নিয়ে হাঁটতে বেরোব৷ পহেলগাম বলতে বাঙালি যে কমার্শিয়াল প্যাকেজ বিক্রি করে, তার বাইরেও যে কী চমৎকার একটুকরো কাশ্মীর এ'খানে রয়েছে৷ তোমার বয়স দু'দিন কমিয়ে তবে তোমায় ফেরত পাঠাবো। এ'খানকার জিপসিদের সঙ্গে আমার খানিকটা দহরম হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ ঠিক জুটে যাবে৷ ইউ উইল লাইক ইট৷

- ও বাবা, এ যে দেখছি আপনি ধরেই নিয়েছেন যে আমি কালও আপনার এই সেফ হ্যাভেনে পড়ে থাকবো৷

- গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছ তাই আন্দাজ করলাম তোমার হাতে কিছুটা সময় আছে৷ আর তোমায় হাতের নাগালে পেলেই আমার কলার টেনে জ্ঞান দিতে ইচ্ছে করে।

- বেশ৷ কাল আপনার জ্ঞান অ্যাবজর্ব করা যাবে'খন। কিন্তু আপনার পহেলগাঁও চ্যালা আশফাক আপনার ক্যালকেশিয়ান চ্যালার জন্য সামান্য তেলেভাজার ব্যবস্থা করতে পারবে কি? লিদরের শোঁশোঁ শব্দ তেলেভাজার খিদেটাকে উস্কে দিচ্ছে কিন্তু৷

- আশফাক অলরেডি আলু ভাজছে, বুঝলে। খানিক পরেই দ্বিতীয় প্রস্থ কফির সঙ্গে নিয়ে আসবে৷ আর সে'টা শেষ করেই আমরা উঠব। এমনিতেই আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অন্ধকার হয়ে আসবে, টেম্পারেচার ঝুপ করে পড়ে যাবে।

- তোফা৷ অনিরুদ্ধদা, আপনার জন্য একটা স্পেশাল উপহার এনেছি কলকাতা থেকে। আজ রাত্রে ঘটা করে সে'টা পেশ করব।

- ওহ, ব্লু লেবেল। সঞ্জয়, মদ্যপান আমি ছেড়ে দিয়েছি৷ নদী, পাহাড়, আকাশ আর দু'চারটে মানুষের নেশাতেই কেটে যাচ্ছে দিব্যি৷ তবে তুমি দু'পাত্তর চড়াতে চাইলে..।

- ডাহা ফেল করলেন। মদের মত পাতি জিনিস নিয়ে আসব? আপনার চ্যালা অত সস্তা নয়৷ আড়াই কিলো হাইক্লাস গোবিন্দভোগ চাল নিয়ে এসেছি৷ ইশফাকের হেঁসেল আজ দখল নিচ্ছি৷ ডিনারে থাকছে আসরমাত করা গোবিন্দভোগ খিচুড়ি। আর ডিম আনানোর ব্যবস্থা করুন প্লীজ৷ না ভাজলেই নয়।

- নাহ্‌৷ স্প্রেডশিট আর টার্গেটস তোমায় এখনও কম্পলিটলি কোরাপ্ট করতে পারেনি দেখছি৷ এনিওয়স। ওই যে, ইশফাক আসছে কফি-আলুভাজা নিয়ে। সূর্যাস্তও হলো বলে। এ'বারে কফি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো কথা নয়৷ গা এলিয়ে বসো দেখি৷ আকাশ আর লিদরে ফোকাস করো৷ ডিটক্স সঞ্জয়, ডিটক্স।

...

৪।

আজ চতুর্থীর সকাল৷ প্ল্যান ছিল সৌমেনদের বাড়িতে আসর বসানোর। খাবারদাবার, সামান্য সুরাপান, হৈ-হুল্লোড়, গান-বাজনা৷ প্ল্যান ছিলো সে'খানে আমি আমার স্পেশ্যাল মাটন কষাটা বানাবো। তার বদলে এখন আমি ইশফাকের বাড়ি ছেড়ে অন্তত দু'মাইল চড়াই ভেঙে এক সবুজে-সবুজ উপত্যকায় এসে থেবড়ে বসে আছি।

গতকাল রাত্রে আমি ইশফাকের রান্নাঘরে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি রাঁধলাম৷ ডিমের ব্যবস্থাও হয়েছিল, অমলেট ভেজে নিয়েছিলাম। সমস্যা হলো ইশফাকের বাসা পাহাড়ের গায়ে এমন জায়গায় যে'খানে গাড়ি পৌঁছয় না৷ গাড়ি যে'খানে নামিয়ে দেয় সে'খান থেকে অন্তত চার কিলোমিটার হাঁটা, শেষের দেড় কিলোমিটার চড়াই৷ কাজেই ডিম, পেঁয়াজ, পাউরুটি; স্টকে কিছু একটা কম পড়লেই তা জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যায়৷ অতএব ইচ্ছে থাকলেও পাঁপড়ভাজার ব্যবস্থাটা করা যায়নি। কিন্তু সে খিচুড়িতে অনিরুদ্ধদা এমন মুগ্ধ হলে যে আমিই লজ্জায় অধোবদন। ইশফাক জানালে এমন মিঠে খিচুড়ি সে আগে কোনোদিন খায়নি, তাঁর হাসিমুখ দেখে ধরে নিলাম সে'টা প্রশংসা৷ খিচুড়ি-ডিমভাজা শেষ করে অনিরুদ্ধদার স্টকের মশলা জোয়ানভাজা মুখে দিয়ে এসে বসেছিলাম বাইরে, অনতিদূরেই লিদর। এত রাত্রে শতরঞ্চিটা বাড়াবাড়ি, বসেছিলাম প্লাস্টিকের চেয়ারে। অন্ধকার নিকষ ছিল না দু'টো কারণে। এক, ইশফাকের বারান্দার টিমটিমে বাল্‌ব আর দুই, আকাশের অজস্র তারা। এ আকাশ দেখে শহরের মানুষ "উরিব্বাস" বলবেই৷ সে অন্ধকারে নদী বিশেষ দেখা যায় না, কিন্তু শোঁশোঁ শব্দে বেশ একটা ঝিম লাগে৷ ফোনের সিগনাল নেই, ওয়াইফাই নেই৷ কাজেই গল্প জমাট হতেই হত। স্বাভাবিক ভাবেই আমার আর অনিরুদ্ধদার গল্পের অনেকটা জুড়েই ছিল আমাদের অফিসের পুরনো দিনগুলো। অফিস পলিটিক্স, খোশগল্প, খুনসুটি৷ কিন্তু কিছুতেই আমি আসল প্রসঙ্গটা ভাঙতে পারলাম না৷ ইচ্ছেও করল না৷ আমারও হয়ত ওই মুহূর্তটা বিষিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল না৷ এমন তারা ভর্তি আকাশ, এমন কনকনে পাহাড়ি হাওয়া, নদীর এমন একটানা ঘুমপাড়ানি শব্দ; এর মধ্যে বললেই হলো নাকি, "অনিরুদ্ধদা, তোমার চাকরীটা নেই"। আর একটা দিন তো আছি, এই ভেবেই রাতের খোশগল্পের ফ্লো-তে ব্যাঘাত ঘটালাম না৷

ভেবেছিলাম বিশ্রী প্রসঙ্গটা আজ সকালেই টেনে আনব৷ ঘুম ভেঙেছিল দেরী করেই৷ ফ্রেশ হয়ে দেখি অনিরুদ্ধদা পহেলগাম মার্কেট থেকে ডিম, পাউরুটি, জ্যাম ইত্যাদি আনিয়ে রেখেছেন৷ বিস্তর ফল-সবজিও এসেছে দেখলাম৷ মাখন-টোস্ট, আর অমলেট দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারার সময়ই অনিরুদ্ধদা ডিক্লেয়ার করলেন, "তোমার কাজের কথা পরে শুনব৷ আগে তোমায় আমার নতুন পাড়া একটু ঘুরিয়ে দেখানো দরকার। বেশ খানিকটা চড়াই আছে, তোমার ঘোড়া দরকার হলে ব্যবস্থা হয়ে যাবে"। আমি বললাম ঘোড়া আমার অনেক বেশি নার্ভাস করবে, হন্টনই বেস্ট।

এখন সকাল সোয়া এগারোটা৷ আমি সৌমেনদের ড্রয়িংরুম থেকে বহু অলোকবর্ষ দূরে৷ ঘাসে মোড়া ঢেউ খেলানো উপত্যকা, আমাদের পিছনে পাইন-দেওদার মেশানো ঘন জঙ্গল। সামনের সবুজ জমি ঢালু হয়ে নেমে মিশে গেছে লিদরে৷ পাইনবন, শরতের ঝকঝকে আকাশ আর পাহাড় যে'খানে মিশছে, সে'খান থেকেই ছুটে আসছে নদী৷ আমি এতটা সবুজ আগে কখনও দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না৷

ইশফাকের বাড়িতে নদীর শব্দ ডলবি ডিজিটালে শোনা যায়, এখানে লিদরের গর্জন স্তিমিত, মোলায়েম। আর আছে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে ঘুরপাক খাওয়া বাতাসের শনশন। এ'ছাড়া ইতিউতি কিছু ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে, তাদের মিহি ম্যাঁ-ম্যাঁ শব্দ মাঝেসাঝে কানে আসছে। মেষপালক একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে; তার বয়স নির্ঘাৎ বারোর নীচে৷ ওরা জিপসি, আপাতত এই উচ্চতায় মাটি আর কাঠ দিয়ে বানানো কিছু ঝুপড়িতে ওদের বাস৷ ওঠার সময় সে'সব কিছু ঝুপড়ি দেখেছি বটে। শীত বাড়লে ওরা নীচের দিকে নেমে যাবে৷ মেষপালকটির নাম আসিফ, তার সঙ্গে অনিরুদ্ধদা ক্রিকেট নিয়ে গল্প করছেন৷ বুঝলাম তাদের আলাপ নতুন নয়৷

একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি৷ ভ্যাকেশন কনসেপ্টটার সঙ্গে আমি সুপরিচিত৷ কিন্তু প্ল্যান-হীন বসে থাকা আর গা-ছেড়ে দেওয়াতে আমি অভ্যস্ত নই৷ সুমিকে একবার ফোন করা দরকার৷ সবচেয়ে বড় কথা সুমন্তদা ছটফট করছেন অনিরুদ্ধদার খবরের জন্য৷ এ'দিকে গতকাল দুপুর থেকে আমার ফোন আউট অফ রীচ৷ অতএব একবার পহেলগাম মার্কেটে না গেলেই নয়৷ কিন্তু এই অলস সাম্রাজ্যে বসে মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে, দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো সে গুলিয়ে যাওয়াটা মন্দ লাগছে না৷

- ভীষণ পীসফুল, তাই না সঞ্জয়?

- হুম।

- ডোন্ট ওরি৷ আমি একটু ঘেঁটে আছি বটে, কিন্তু আমি জানি তুমি এদ্দূর ঠেঙিয়ে কাশ্মীরের হাওয়া খেতে আসোনি৷ তোমার গোবিন্দভোগের ভেটটাই আমায় একটু ইমোশনাল করে দিলো৷ ভাবলাম কাজের কথা তো হবেই৷ এদ্দিন পর সঞ্জয়কে দেখলাম, একজন কাছের মানুষকে দেখলাম৷ তাও আবার পুজোর মুখে৷ হঠাৎ পুজোর কথা মনে পড়ে গেল৷ তাই আর কী...।

- আজ চতুর্থী অনিরুদ্ধদা।

- ওহ, ইস ইট? বাহ্‌৷ আসলে আমি ভেবেছিলাম যে এতটাই ভেঙেচুরে গেছে সমস্তকিছু যে আমার জীবনে পুজোর চিন্তাভাবনাটা একটা বিশ্রী আদেখলাপনা আর বিলাসিতা। তুমি আসার পর মনে পড়ল পুজো ব্যাপারটা মারাত্মক ইনক্লুসিভ৷ অ্যান্ড প্লেজ্যান্টলি আনঅ্যাভয়েডবল।

- পুজোসংখ্যা চাইলে পাবেন না৷ তবে আমার ব্যাকপ্যাকে দু'টো পুরনো ফেলুদার বই আছে৷

- ইউ উইল স্পয়েল মী সঞ্জয়।

- হেহ্‌।

- একটা জিপসি বাড়িতে দুপুরের দানাপানির ব্যবস্থা করেছি। এ'খান থেকে বেশি দূর নয়। তবে এক্সট্রিম সাদামাটা ব্যাপার৷ থ্যাবড়া মোটা রুটি আর নুন-চা৷ ইয়েট সারপ্রাইজিংলি ডেলিশাস। খাওয়ার পর খানিকক্ষণ গড়িয়েও নিতে পারো সে'খানে। রাতে অবশ্য আশফাক তোমার জন্য মুর্গির ব্যবস্থা করছে৷ লিদরের পাশে বসে ঝলসানো হবে৷

- এ'তো মোচ্ছব।

- পুজো বলে কথা৷ আপাতত ফ্লাস্কের কফি চলবে?

- ইউ উইল স্পয়েল মী অনিরুদ্ধদা।

- হেহ্‌।

...

৫। 


এই হয়েছে জ্বালা৷ "চলো একটু হেঁটে আসি, ফিরে এসে কাজের কথা নিয়ে বসা যাবে" বলে অনিরুদ্ধদা আমায় টেনে বের করছেন৷ তারপর সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আজ বললেন "পঞ্চমীর দিন। থিম প্যান্ডেল তো জুটবে না৷ চলো তোমায় মামালেশ্বরের মন্দির থেকে ঘুরিয়ে আনি। দেড় হাজার বছর পুরনো মন্দির। কিন্তু ম্যাদামারা রাস্তা দিয়ে নয়, আমরা যাবো দু'চার মাইল ট্রেক করে৷ চলো জওয়ান"। ভদ্রলোক রিলিজিয়াস যে হচ্ছেন না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত৷ তবে কারণে অকারণে হাঁটার বাতিক মারাত্মক বেড়েছে৷

আজও যথারীতি ট্রেকের পথে এমন একটা উপত্যকায় এসে পড়লাম যে বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া গতি ছিল না৷ এখানে পাহাড় ধরে ওপরের দিকে উঠলেই এমন হাজারো জায়গা আছে যে'গুলো টুরিস্টদের হুজুগে বিকিয়ে যায়নি৷ যে'খানে গিয়ে দু'দণ্ড দাঁড়ালে মনে হয় যাবতীয় জ্বালাযন্ত্রণা সত্ত্বেও বেঁচে থাকার মত সুন্দর ব্যাপার আর কিছুই হয় না৷ এই যেমন এখন৷ ঘন পাইন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা একটু সবুজ ঢেউ খেলানো মাঠ। আকাশ যেন আগের দিনেও চেয়েও নীল৷ রোদ আজ একটু নরম, অতএব শীত একটু বেশি। দূরের পাহাড়গুলো যেন আরও স্পষ্ট আর সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। অল্প রোদ-অল্প ছায়া বেছে নিয়ে স্যাট করে ব্যাগ থেকে কফির ফ্লাস্ক বের করে থেবড়ে বসে পড়লেন অনিরুদ্ধদা। আমি আধশোয়া হয় ভ্যাবলার মত তাকিয়ে দেখছি চারপাশ৷

- ভাই সঞ্জয়৷ গত মিনিট কুড়ি কোনো কথা বলোনি যে।
- আপনি খতরনাক লোক অনিরুদ্ধদা৷ ইউ হ্যাভ ড্রাগড মি।
- আমি জানি তুমি কী বলছো৷ আরে, আমি কি ছাই কোনো আচমকা ইন্সপিরেশনের ঠেলায় পাহাড়ের স্কুলমাস্টার হবো বলে এ'খানে বসে আছি নাকি। আমি মনেপ্রাণে ক্যালকেশিয়ান। সিটি বর্ন। সিটি ব্রেড৷ ক্যালকাটা ইজ মাই হোম অ্যান্ড এটেরনাল ডেস্টিনেশন।
- তা'হলে এ'খানে পড়ে আছেন কেন?
- আমি লোটাকম্বল সমেত এ'খানে এসে বসে রইলাম ওর একটু অ্যাটেনশন গ্র্যাব করার জন্য৷ যদি একটু মন গলে।
- ডিভোর্সের পরেও?
- লজিকালি আমার কোনো দাবী নেই৷ তাই ইলজিকাল হওয়া ছাড়া কোনো গতি ছিল না। শি লাভড কাশ্মীর৷ বিশেষত পহেলগাম। তাই একটু সিম্প্যাথি জেনারেট করার জন্য আমার এ'খানে এসে বসে থাকা৷ আমার মাথাটা ভারি জটিল আর ধান্দাবাজ৷
- আপনি সত্যিই অদ্ভুত।
- প্রথম কিছুদিন ভেবেছিলাম ও অন্তত একবার খোঁজ নিতে আসবে৷ কর্পোরেট অ্যানিমাল অনিরুদ্ধ মজুমদার বিবাগী হয়ে পড়লো, হারিয়ে গেলো৷ আমি নিশ্চিত ছিলাম ও একবার অন্তত ধমক দেবেই৷ তাই এমন জায়গা বেছে নিলাম যে'খানে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়৷ অর্থাৎ ধমক দিতে হলেও ওকে ছুটে আসতে হবে।
- আপনাদের ডিভোর্স হয়েছে অনিরুদ্ধদা৷ আর দোষটা আপনার৷ এর পরেও এ'সব এক্সপেক্ট করা...।
- অন্যায়৷ জানি। বললাম তো৷ লজিকাল দাবী নেই৷ তাই এই পাগলামি৷ তবে সে পাগলামি আমার মাসখানেকেই কেটে গেছিল৷ তারপরেও এদ্দিন টিকে রইলাম ওই যে কারণটা তুমি বললে; নেশাগ্রস্ত৷ এত ময়লা জমেছে ইঞ্জিনে, প্রপার ফিল্ট্রেশন না হলে কামব্যাক সম্ভব নয়৷।

মামালেশ্বরের মন্দির দেখে অনিরুদ্ধদা আর আমি হাঁটা লাগালাম পহেলগাম মার্কেটের দিকে৷ মাত্র দেড়'দুই কিলোমিটার পথ৷ অনিরুদ্ধদার কিছু ওষুধ নেওয়ার দরকার৷ আর আমি সে'খান থেকে নিজের জরুরী প্রাইভেট ফোনগুলো সেরে নেব। এ'টা ঠিক সিজন নয়, তাই মার্কেটে তেমন ভিড় নেই৷ তবে সাজানো গোছানো ছিমছাম টুরিস্ট-টানা জায়গা৷ মানালির মত গ্যাঞ্জাম নেই, অথচ আয়োজন বিস্তর। প্রচুর রেস্টুরেন্ট, শালের দোকান৷ একটা বড়সড় বাঙলা সাইনবোর্ডও চোখে পড়লো। অনিরুদ্ধদাকে বললাম আমি এলাকাটা খানিকক্ষণ একা ঘুরে দেখব। কথা হলো ঘণ্টা খানেক পর আমরা দেখা করব ক্যাফে উইলোতে৷ লিডারের পাশে বেশ সাহেবি মেজাজের ক্যাফে। সে'খানকার পিজ্জার বড় সুখ্যাতি শুনেছি। অবশ্য গতকাল ইশফাক যে চিকেন কাবাব মেহফিল বসিয়েছিল তাঁর পাহাড়ি বাসার ধারে লিডর ঘেঁষে, তাকে কোনো ক্যাফে টেক্কা দিতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
অফিসের সুমন্তদাকে কলটা করেছিলাম মার্কেটের একটা নিরিবিলি বেঞ্চে বসে।
- সঞ্জয়! দিস হ্যাস টু বি ডান ইমিডিয়েটলি। অ্যান্ড ইউ নীড টু বি ব্যাক নাউ।
- সুমন্তদা। আপনি এতটা করেছেন৷ আর দু'দিন তো মাত্র৷ আপনি অনিরুদ্ধদাকে দেখলে বুঝতেন..। আজই ওকে বলব ভাবছি৷ কিন্তু বলেই ছুটে পালিয়ে যাওয়াটা সমীচীন হবে না।
- অনিরুদ্ধকে আমরা অনেক সময় দিয়েছি৷ আমি হেল্পলেস সঞ্জয়৷ তবে ঠিক আছে৷ দু'দিন আমি ম্যানেজ করব। বোর্ড যদিও মারাত্মক ইমপেশেন্ট৷ দে ওয়ান্ট হিম আউট, উইদাউট ডিলে। আর ওদের বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।
- থ্যাঙ্কিউ৷ দু'দিন হলেই হবে৷
- সপ্তমীর দিন ক্লায়েন্ট মিটিং শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলে। আজ বলছ রিটার্ন টিকিট একদিন পিছিয়ে সপ্তমীর সন্ধেয় ফিরবে৷ ফ্যামিলি অ্যালাউ করবে এ'বার?
- অনেক ভেবে দেখলাম সুমন্তদা৷ অনিরুদ্ধদা ইজ ফ্যামিলি।
- ভেরি ওয়েল। আর তোমার ফোন কি ফের আউট অফ রীচ হবে?
- অনিরুদ্ধদা এমন পাড়ায় ঠাঁই নিয়েছেন, আমি অসহায়৷ এই আজ তিন দিনের মাথায় পহেলগাম মার্কেটে নেমে তবে আপনার সঙ্গে কথা বলছি৷
- মনে রেখো৷ দু'দিন৷ আর শোনো, রিপ ইট অফ লাইক আ ব্যান্ড এইড৷
সন্ধ্যে হয়েছে৷ ক্যাফে উইলোর দিকে মন শক্ত করে এগিয়ে গেলাম৷ অনিরুদ্ধদা অত সরলসিধে নন যে কিছুই আঁচ করতে পারেননি৷ হিসেবনিকেশটা এইবেলা হয়ে যাওয়া দরকার। এই পাগলামো দিয়ে ওই চাকরী ধরে রাখা সম্ভব নহ৷ যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে।

...

৬।



পঞ্চমীর সন্ধেবেলা পহেলগামের উইলো ক্যাফেতে বসে অনিরুদ্ধদাকে জানিয়েছিলাম যে ওর চাকরীটা নেই৷ তারপর থেকে ঘটনাগুলো বেশ ফাস্ট ফরওয়ার্ড মোডে ঘটলো। প্রথমেই আমায় "ট্রেটার" বলে দুদ্দাড় করে ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ আমি অবশ্য ব্যাপারটা খোলসা করতে পেরে বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছিলাম৷ অতএব অমন দুর্দান্ত পেরিপেরি ফ্রায়েড চিকেন পিজ্জাকে অবহেলা করে উঠতে পারলাম না৷ সে'দিন ইশফাকের আস্তানায় ডিনারের সময় অনিরুদ্ধদা আবার উদয় হলেন। তখন তাঁর হাবভাব এমন যেন কাজের কোনো কথাই হয়নি৷ আধঘণ্টা ক্রিকেট নিয়ে বাজে গল্পের পর আমি বলতে বাধ্য হলাম যে সপ্তমীর দুপুরে আমার ফ্লাইট শ্রীনগর থেকে৷ অনিরুদ্ধদা দিব্যি প্ল্যান করে ফেললেন যে ষষ্ঠীর দিন আমার সঙ্গে শ্রীনগরে এসে থাকবেন। সপ্তমীর দিন আমায় সী-অফ করে তারপর পহেলগাম ফিরবেন৷ আমি ভাবলাম "তোফা"। ধরে নিলাম ভদ্রলোক চাকরী যাওয়ার ব্যাপারটায় বিশেষ বিচলিত হননি৷

সে'দিন মাঝরাতেই আবার গোলমাল হলো৷ রাত দু'টো নাগাদ আমার দরজায় বিস্তর ধাক্কাধাক্কি৷ দরজা খুলে দেখি অনিরুদ্ধদা তেলেবেগুনে জ্বলছেন আর বেচারি ইশফাক তাকে সামাল দিয়ে হিমশিম খাচ্ছে৷ এই প্রথম ইশফাকের বাসার দাঁড়িয়েও লিদরের শোঁশোঁতে কান পাতার সুযোগ পেলাম না৷ অনিরুদ্ধদা মিনিট কুড়ি চিৎকার চালালেন, কোম্পানির নামে কেস ঠুকবেন, সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে নাচাবেন, সব শালার দম তাঁর জানা আছে, সবকট বোর্ড মেম্বারকে জেলের লপসি না খাওয়ালে তার নাম পালটে ফেলবেন, ইত্যাদি। খানিকক্ষণ পর ইশফাক তাঁকে শান্ত করে পাশের ঘরে নিয়ে গেলো৷

মারাত্মক নার্ভাস হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে দেখি মাই ডিয়ার মেজাজে অনিরুদ্ধদা পুরি আর আলুভাজা সার্ভ করছেন৷ আজ তিনি নাকি নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট বানিয়েছেন৷ আমায় এক রাউন্ড ধমক দিলেন, "আজ বেরিয়ে যাচ্ছ পহেলগাম ছেড়ে, সানরাইজটা মিস করলে সঞ্জয়? তোমায় নিয়ে আর পারা গেল না"। দুপুরের দিকে আমার সঙ্গে সত্যিই ঝুলে পড়লেন শ্রীনগরমুখো ট্যাক্সিতে। বেরোনোর আগে আমি অবশ্যই ইশফাকের হাত জড়িয়ে নিজের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসতে ভুলিনি।

ট্যাক্সিতে বসে আধঘণ্টা মত নিশ্চুপ ভাবে কেটে গেলো৷ একসময় আমি বলতে বাধ্য হলাম..

- আপনার রিয়্যাকশনটা কিন্তু মারাত্মক আনস্টেবল জায়গায় আছে অনিরুদ্ধদা।

- সঞ্জয়৷ অ্যাম সরি। আমি জানি ব্যাপারটা খুব আনরিজনেবল অন ইউ..। আই শুড বি গ্রেটফুল তুমি এ খবরটা পার্সোনালি কনভে করতে এসেছ এবং যথেষ্ট যত্ন করে শেয়র করেছ৷

- ব্যাপারটা আপনার জন্য খুব সহজ হবে না৷ সে'টা খানিকটা বুঝি তো।

- আমি জানি আমি অনেকটা পাগলামি করে ফেলেছি৷ কিন্তু সঞ্জয়, ওই চাকরিটার বাইর আমার আর কোনো পরিচয় নেই৷ কোনো সহায়-সম্বল নেই৷ কোথাও ফিরে যাওয়ার নেই৷ ইশফাকের বাড়িতে দু'দণ্ড স্বস্তি পেয়েছি বটে, তবে ফেরার পথ না থাকাটা প্রসেস করতে পারছি না।

- আমার কিছু করার নেই অনিরুদ্ধদা৷ সুমন্তদাও অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু..।

- জানি৷ তবু, আমার এই খবরটাকে আপাতত প্রসেস না করতে পারাটা একটু মানিয়ে নেবে ভাই?

- আছি তো৷ কোম্পানি থেকে বেরোচ্ছেন, আপনার শাগরেদরা আপনাকে ছাড়বে কেন।

- সে'সব কথার কথা ভাই৷

- তাই যদি হবে, তা'হলে ষষ্ঠীর দিনে কলকাতা আর নিজের বাড়িঘরদোর ছেড়ে আপনার লেজুড় হয়ে করছিটা কী?

- তাই তো। আসলে মদটা ছেড়ে দিয়ে ভারী বিপদে পড়েছি ভাই সঞ্জয়৷ ক্রাইসিস ফাঁকি দেওয়ার একটা দিব্যি এস্কেপ রুট হাতের বাইরে চলে গেছে। আচ্ছা শোনো, আজ তোমার শ্রীনগরে কোনো কাজ আছে?

- নো স্যার৷ টোটালি ফাঁকা।

- তবে একটা ছোট্ট ডিট্যোর নেবো৷ ড্রাইভারজী, মাটন চলিয়ে।

- মাটন? রোগনজোসের মাটন?

- ধুর৷ মাটন ছোট্ট একটা শহর, অনন্তনাগ ডিস্ট্রিক্টে পড়ে৷ সে'খানে একটা অ্যাবানডান্ড সূর্য মন্দির আছে৷ মার্তণ্ড মন্দির। রাজতরঙ্গীনীতে রাজা ললিতাদিত্যের রেফারেন্স আছে, জানতে? এ'টা তাঁর বানানো সূর্য মন্দির, ওই নাইন্থ সেঞ্চুরির কন্সট্রাকশন৷ পনেরো শতকে সিকন্দর শাহয়ের বাহিনী এসে ডেস্ট্রয় করে দেয়। তোমার অবন্তীপুরার মন্দির ভালো লেগেছিল তো? ইউ উইল লাইক দিস মোর৷ এ'তে কোনার্কের মত ব্যাপ্তি নেই, কিন্তু মায়ার দিক থেকে এগিয়ে৷ আর হ্যাঁ, আঁধির ওই গানটা..তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোই..ও'টার শুটিং হয়েছিল সেই রুইনসের মধ্যে৷ কাব্যিক আয়রনি ভাবো, ভাঙা সূর্য মন্দিরে দাঁড়িয়ে গাওয়া গানের লাইন; তুম যো কেহ দো তো আজ কি রাত চাঁদ ডুবেগা নহি, রাত কো রোক লো।

- হোক তবে৷ মার্তণ্ড মার্তণ্ড মার্তণ্ড।

অজস্র আপেল বাগান চিরে একটা পিচ বাঁধানো পাহাড়ি রাস্তা গিয়ে মিশেছে মার্তণ্ড মন্দিরে৷ আমরা যখন সে'খানে ঢুকছি তখন প্রায় বিকেল চারটে৷ রোদ নরম, কনকনে বাতাস৷ মন্দির চত্ত্বর নিরিবিলি, নিশ্চুপ৷ আমি আর্কিটেকচার বুঝি না, অথচ সে ভাঙাচোরা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়েও মুখ দিয়ে "বাহ্‌" বেরিয়ে এলো। অনিরুদ্ধদার বিহ্বলতা গায়েব, ওঁর ভিতরের ইতিহাসের প্রফেসর ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে৷ গান্ধার, গ্রীক, আর গুপ্ত আর্কিটেকচারাল স্টাইল মিলেমিশে যে কী ধরণের ম্যাজিক সম্ভব, তা নিয়ে ছোটোখাটো একটা ক্লাস নিয়ে ফেললেন তিনি৷ মন্দিরের গায়ে খোদাই করা বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি চিনিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। বুঝিয়ে দিলেন সানডায়্যালের মেকানিজম৷ মন্দিরের সামনের পরিখায় নাকি এককালে লিদরের জল এসে পড়ত৷ লিদরের প্রতি একটা স্নেহ জন্মে গেছে টের পেলাম।

আমি ইতিহাসে কাঁচা, স্থাপত্যশিল্পে গোল্লা৷ অথচ মুগ্ধ হয়ে পড়ার ব্যাপারে আমি অনন্য৷ মন্দিরের সিঁড়িতে বসে গায়ে কাঁটা দেয়, অপরূপ পাহাড়ের গায়ে কী দুর্দান্ত এক টুকরো ইতিহাস৷ আমি আরও মুগ্ধ হই অনিরুদ্ধদায়। ও যখন ইতিহাস নিয়ে বলছিল, আমার মনে হচ্ছিল আমি চোখ বুজে এ মন্দিরের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারি৷ অনিরুদ্ধদা একজন কর্মনিষ্ঠ প্যাশনেট মানুষ, একটা চাকরীর থাকা না থাকায় তাঁর ঔজ্জ্বল্য কমতে পারে না৷ হয়ত ফোকাসে একটু ধাক্কা লেগেছে৷ কিন্তু সেই ধাক্কাটাই শেষ কথা হতে পারে না৷

ষষ্ঠীর সন্ধেটা প্রায় যেন একটা পুজোমণ্ডপেই কাটলো৷

...

৭। 


কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ভাট সাহেব অনিরুদ্ধদার বন্ধু। নিশাদবাগে তার বাড়িতেই আমরা উঠেছিলাম৷ এ'খানে লিদরের টান নেই, কিন্তু বাগান-ঘেরা বাংলোখানি চমৎকার। ভাট সাহেবের পরিচিত অটোরিক্সাওলা আর পরিচিত শিকারাওলার সঙ্গে প্ল্যান ছকে সপ্তমীর ভোর পৌনে চারটে নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম৷ টুরিস্টদের ভিড় যতটা সম্ভব এড়িয়ে শিকারা উপভোগ করবো, সে'রকমই প্ল্যান ছিল। দিনেরবেলা শ্রীনগরের রোদের তাপ বেশ গায়ে লাগে এ'সময়। বিকেলের পর থেকে অবশ্য হাওয়া কনকনে, সোয়েটার মাফলার ছাড়া ঘোরাঘুরি চলে না। কিন্তু ভোররাত্রে বেরিয়ে দেখলাম হাড় কেঁপে উঠলো; সোয়েটারের ওপর একটা বাড়তি জ্যাকেটের প্রয়োজন৷ হজরতবালের কাছে ডাল লেকের ওপর ওয়াজিরের শিকারায় আমি আর অনিরুদ্ধদা যখন বসলাম তখন সোয়া চারটে, দু'জনের মুখ দিয়েই গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে৷ ওয়াজিরের ঠোঁটে অবশ্য একটানা গোল্ডফ্লেক ঝুলছিল, আমরা আপত্তি করিনি৷ আমাদের গন্তব্য ডাল লেকের ফ্লোটিং মার্কেট, যে'খানে কাকভোরে অজস্র শিকারা জড়ো হয় আনাজপাতি কেনাকাটার জন্য৷ এ'খান থেকে ঘণ্টা-দেড়েক লাগবে শিকারায়৷ অনিরুদ্ধদা বলেছিলেন যে বেশ কয়েকবার শ্রীনগর ঘুরে যাওয়া সত্ত্বেও টুরিস্টের চোখ দিয়ে এখনও শহরটাকে দেখে উঠতে পারেননি তিনি। তাই এই আয়োজন৷ আমার ফ্লাইট আজ বেলা এগারোটায়, আমাদের শিকারা বিহার অনেক আগেই শেষ হয়ে যাবে।

দূরের হাউসবোটের আলোগুলো বাদে চারপাশ তখন অন্ধকার। ওয়াজিরের দাঁড় বাওয়ার ছন্দবদ্ধ ছপরছপর আর শিকারার মৃদু দুলুনিতে বড় মিঠে ঘুম চোখে এসে লেগেছিল। ডাল লেকের ইকোসিস্টেমের ওপর অনিরুদ্ধদার মনোগ্রাহী লেকচারও সে ভালোলাগা-তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। সোয়া পাঁচটা নাগাদ আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। পর্যটকদের প্রিয় ভাসমান মীনাবাজারের সমস্ত দোকানের ঝাঁপ নামানো। ইতিউতি দু'একটা শিকারায় কেউ চা-কফি-কাহওয়া বিক্রি করছে বড়জোর। সে'খান থেকে খানিকটা এগিয়ে ডাল লেকের ওপর স্থানীয় পাড়া-বাড়িঘরদোর; ঘুমন্ত কিন্তু সজীব। ওলকপি, গাজর, মুলো, নাদ্রু; কতরকমের সবজি চাষ হয় এর আশেপাশে। আনাজপত্রের সেই শিকারা-বাজারে যখন পৌঁছলাম তখন বেচাকেনা সবে শুরু হচ্ছে।

বেচাকেনা দরদস্তুরের গুঞ্জন আর দাঁড় বাওয়ার ছপছপে যেন এক যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। এ'সবের ফাঁকে দু'চারটে শিকারায় আমাদেরই মত আগ্রহী পর্যটক; তারা অবজার্ভ করছে কিন্তু বেচাকেনায় সিম্ফনিতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না৷ পদ্ম ডাঁটা আর ওলকপির বিক্রিবাটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল। আমি আর অনিরুদ্ধদা মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখে যাচ্ছি।

- আহ্‌, দ্য সাইট, সাউন্ড অ্যান্ড স্মেল অফ হিউম্যান্স কন্ডাক্টিং বিজনেস৷ বিউটিফুল৷ তাই না সঞ্জয়?
- তাই তো।
- আমরা মিউট স্পেক্টেটর। ছবি তুলছি৷ প্রকৃতি দেখে আহা উঁহু করছি৷ কিন্তু বাজারের আসল খেলোয়াড়েরা ব্যস্ত অঙ্কের হিসেব নিয়ে। ওদের কাছে বিউটি হলো মিউচুয়াল প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ করায়৷
- আপনি অফিস মিস করছেন অনিরুদ্ধদা।
- চাকরিটা যাওয়ার পর তো ডেফিনিটলি মিস করছি। দ্যাখো সঞ্জয়, এ'খানে যারা বেচা কেনায় ব্যস্ত, তাদের কাছে এই অপরূপ সূর্যোদয়ের পোয়েট্রি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। এরা ব্যাস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদের ব্যবসাকে মজবুত করতে৷ এই গাম্বাট ডিটারমিনেশনটা কিন্তু ফ্যালনা নয় সঞ্জয়৷ খেটে খাওয়া মানুষেদ খাটুনি কোনোদিনও ফেলনা নয়৷
- হয়ত নয়৷
- ইন ফ্যাক্ট, ইন সো মেনি স্ট্রেঞ্জ ওয়েজ, মানুষের রক্ত জল করা পরিশ্রমের চেয়ে সুন্দর আর কিছুই নয়, ডাল লেকের সূর্যোদয়ও সে সৌন্দর্যের সামনে ম্লান হয়ে যায়৷ ভাবো, এ'খান থেকে দু'পয়সা কামিয়ে কত চাষাভুষো মানুষ বাড়ি ফিরে আটা-ময়দা কিনবে, সেভিংসে দু'পয়সা সরিয়ে রাখবে৷ আবার এ'খান থেকে সস্তায় কেনা মালে বাড়তি মার্জিন কামিয়ে কিছু মানুষ নিজের ছেলেপুলেকে স্কুলে পাঠাবে৷ ইট ইজ বিউটিফুল। আওয়ার ওয়ার্কপ্লেসেস আর বিউটিফুল।
- অফিসে থেকে এ কথা কখনও মনে হয়েছে আপনার?
- হওয়া উচিৎ ছিলো৷ তবে কী জানো, কর্মস্থলে শোষণ ব্যাপারটাও জড়িয়ে থাকে। যার যত নীচের তলায় বাস,তার ভালনারিবিলিটি তত বেশি। আমাদের চোখের সামনের কেনাবেচাতেও কি মহাজনের ধূর্ততা আর সিস্টেমের ধান্দাবাজি নেই? তবে সে তর্ক অন্য। আর মানুষের গ্রাসাচ্ছদনের লড়াইয়ের সৌন্দর্য অন্য প্রসঙ্গ। উই মাস্ট প্রটেস্ট আনফেয়ারনেস, বাট রিমেন গ্রেটফুল ফর এভ্রি ব্রেড ইউ আর্ন। কী'ভাবে যেন এই গ্রেটফুলনেসটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম৷ আয়রনি দ্যাখো, চাকরিটা খোয়াতে হলো সেই কৃতজ্ঞতাবোধটা ফেরত পেতে।
- আপনার মনভার অনিরুদ্ধদা।
- অবভিয়াসলি। অবভিয়াসলি৷ হয়ত বাজে বকছি।
- না৷ আপনার কথার লজিকে কোনো গ্যাপ নেই৷ আফটার অল, কর্পোরেট উত্তমকুমার আপনি।
- আমি কর্পোরেটের ভাণু বন্দ্যোপাধ্যায় হতে চাই যে। ভোলাদের গুঁতোনোর হুকুমও দেব, পাশাপাশি মাসীমাদের প্রতি মালপোর দাবীও রাখব৷ কিন্তু আপাতত স্পটবয় হতে চাই।
- ফিউচার কিছু ভেবেছেন?
- আজ মহাসপ্তমী। আজ সন্ধেটাই আপাতত আমার ভবিষ্যৎ চিন্তার ম্যাক্সিমাম লিমিট। তোমার ফ্লাইট তো খানিক পরেই?
- হুঁ।
- সঞ্জয়, আজ তোমার না গেলেই নয়? দু'দিন থাকবে প্লীজ? কথা দিচ্ছি, চাকরি যাওয়া নিয়ে আর হল্লা করব না৷ থাকবে? প্লীজ?
- সম্ভব না আর অনিরুদ্ধদা। প্লীজ, এ'বার এ'টা আপনাকে বুঝতে হবে...।
- প্লীজ সঞ্জয়৷ এই শেষ একটা আনরিজনেবল দাবী তোমায় মানতে হবে৷ ফর ওল্ডটাইমস সেক...।
- সুমি অপেক্ষায় আছে৷ অফিসেও রিপোর্ট করাটা এ'বার জরুরী। অনিরুদ্ধদা...।
- সঞ্জয়..আই নীড টু ডেজ৷ প্লীজ৷ আচ্ছা শোনো..আমি খবর নিয়েছি৷ এই প্রথম শ্রীনগরে দুর্গাপুজা হচ্ছে৷ রীতিমতো বাঙালি পুজো, প্যান্ডেল বেঁধে৷ জম্মু থেকে প্রতিমা এসেছে, মেদিনীপুর থেকে ঢাকি আর পুরুত। এ'খানকার বাঙালি স্বর্ণকার সমতির লোকজন আয়োজন করেছে; একদম পাড়ার আন্তরিক পুজোর মেজাজ সে'খানে৷ এই শ্রীনগরে৷ সে জন্যই পহেলগাম থেকে তোমার সঙ্গে ঝুলে পড়েছি, এ'বার স্বীকার করেই ফেললাম।
- কিন্তু অনিরুদ্ধদা...।
- আমার কী যে হয়েছে, কিছুতেই পুজো মণ্ডপে একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না৷ আমি বিলিভার নই, তবু আচমকা কী যে অদম্য ইচ্ছে পুজো দেখার৷ কলকাতায় ফিরব ক'দিন পর, এখনই সম্ভব নয়৷ কিন্তু পুজো এ'বারে দেখবই, দেখব টু ফীল দ্যাট অনিরুদ্ধ মজুমদার ইজ আলাইভ! কপাল দ্যাখো, এ'বারেই শ্রীনগরে পুজো শুরু৷ শুধু সে'খানে একা যাওয়া সম্ভব নয়.. প্লীজ ভাইটি..থাকবে?
- আই অ্যাম সরি অনিরুদ্ধদা। আমি বুঝতে পারছি আপনি বেশ ভেঙে পড়েছেন৷ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আপনাকে সাহায্য করতে৷ কিন্তু আজ আমায় কলকাতায় ফিরতে হবেই৷ আই হোপ ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড।
- অফ কোর্স৷ সরি সঞ্জয়, থেকে থেকেই মাথার মধ্যে কেমন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। সরি। কিছু মনে কোরো না৷ আই নো ইউ মাস্ট বি ইন কলকাতা টুডে৷ সপ্তমী আফটার অল।
- আই অ্যাম রিয়েলি সরি অনিরুদ্ধদা৷ বিশ্বাস করুন।
- এই, এ'বার আমায় তুমি লজ্জায় ফেলছো। পরের পুজোয় তোমার কলকাতার বাড়িতে গিয়ে আড্ডা জমাবো৷ কেমন?
- এই হলো প্ল্যানের মতো প্ল্যান।
- বেশ৷ এ'বারে লেটস ফোকাস অন ডাল লেক৷ এ'খানে কত রকমের পাখি দেখা যায় জানো?

আহদুস রেস্টুরেন্ট থেকে মাটন শামি কাবাব, তন্দুরি মুর্গ, মাটন রোগনজোশ, ভাত আর ফির্নি দিয়ে মারাত্মক লেট-লাঞ্চ সেরে আমি আর অনিরুদ্ধদা আহদুসেরই বেকারিতে বসে দুর্দান্ত চকোলেট পেস্ট্রি সাঁটালাম৷ তারপর মিনিট কুড়ি হেঁটে পৌঁছলাম মহারাজা বাজারের কাছে শিবমন্দিরে। তখন সন্ধ্যে হব হব করছে৷ শিবমন্দির চত্ত্বরেই শ্রীনগর বাঙালি স্বর্ণকার সমিতির দুর্গাপুজোর জন্য প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে। অনিরুদ্ধদার রিপোর্ট খাপেখাপ; শ্রীনগরে এই প্রথমবারের জন্য দুর্গোৎসব। প্রতিমা এসেছে জম্মু থেকে, বাংলা থেকে এসেছে ঢাকি, পুরুত আর মফস্বলি তাসা। মণ্ডপ চত্ত্বরে পা রাখতেই অনিরুদ্ধদার হাঁটাচলায় জেল্লা চলে এলো৷ পুজো কমিটির লোকজনের সঙ্গে নিমেষে আলাপ জমিয়ে ফেললেন৷ আধঘণ্টার মাথায় মনে হলো তিনিই বোধ হয় কমিটির সেক্রেটারি গোছের কেউ৷ সরল-সিধে মনভালো করা পাড়ার পুজো; প্রতিটা মানুষ একে অপরের সঙ্গে যেচে আলাপ জমাচ্ছে, অল্প সময়ের মধ্যেই সে আলাপ গড়িয়ে গিয়ে পড়ছে প্রাণখোলা আড্ডায়৷ চায়ের কাপ না চাইতেই হাতের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে৷ আর তাসা পার্টির দল আসরমাত করছে নির্মলা মিশ্রর "তোমার আকাশ দু'টি চোখে"র সুরে। খোদ কলকাতার বুকে পুজোর আয়োজনে এ আন্তরিকতা জুটতো কিনা কে জানে৷



তাসা থামলো যখন সন্ধে সাতটা নাগাদ পুরুতমশাই হাল ধরলেন৷ তখন পাশাপাশি আসরে নামলেন ঢাকিরা৷ সন্ধ্যারতিতে মজে গেলাম। শান্তির জল, ভোগ সবেতেই অনিরুদ্ধদার ক্যারিশ্মায় আমিও খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে রইলাম৷ এ যেন নিজেদের পাড়ার পুজো৷

আমার বড় গর্ব হলো অনিরুদ্ধদাকে নিয়ে৷ মানুষকে তিনি সহজে কাছে টেনে ধরতে পারেন, মানুষও সহজেই তাঁকে জড়িয়ে ধরতে পারে৷ সে কারণেই কর্পোরেট জগতে এমন দাপুটে লীডার ছিলেন তিনি৷ আবার শ্রীনগরের পুজো মণ্ডপের ভিড়েও উজ্জ্বলতম বিন্দুটি এখন অনিরুদ্ধদা৷ এই পুজোর ব্যাপারে ঠাকুরমশাইকে হেল্প করছেন, এই মণ্ডপের কোণে জমে ওঠা চায়ের আড্ডা গুলজার করছেন হাসিঠাট্টায়, এই আবার ভোগ বিতরণের কাজে লেগে পড়ছেন কোমর বেঁধে। কে বলবে ঘণ্টা তিনেক আগে ভদ্রলোককে এ'খানে কেউই চিনত না৷ হঠাৎ মনে হলো, উত্তমবাবু বোধ হয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনিরুদ্ধদা ছিলেন।