Sunday, July 24, 2022

জনসেবা



প্রিয় সুমি,

হাসপাতাল থেকে লিখছি। মন ভার৷ জিভ বিস্বাদ৷ গা-হাত-পা ব্যথা৷ যা হোক, নিজের দুঃখকে কোনওদিনই তেমন বড় করে দেখিনি, আজও দেখব না৷ মানুষের ভালো করতে চেয়ে এ বন্ধুর পথ আমি নিজেই বেছে নিয়েছি, সামান্য দু'একটা চোরকাঁটা বা সেফটিপিনের খোঁচায় দমে গেলে চলবে কেন?

যাক গে। যা বলতে কলম ধরলাম।আজকাল আর অসহায় মানুষদের কথা কেউ মন দিয়ে ভাবে না৷ কত সহায়সম্বলহীন মানুষ যে সহমর্মিতার অভাবে দুর্ভাগ্যের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই৷

এই আমার কথাই ধরো৷ সাধারণ মানুষের জন্য তো কম করলাম না এ'কবছরে৷ এ'পাড়ায় টিউবওয়েল চাই, ও'পাড়ায় ডিসপেনসারিতে ভালো ডাক্তার চাই, অমুক অঞ্চলে রাস্তার মেরামতি দরকার, তমুক অঞ্চলে তেলেভাজার দোকান বসানো দরকার৷ নেতা মানুষের কাজ কি কম সুমি? অথচ দেখ, এত কিছু করিয়ে দেওয়াটা কেউ দেখল না৷

এরা দেখে শুধু কে আমায় জোর করে সামান্য কমিশন গছিয়েছে, কে ভালোবেসে ক্ষীরকদমের বাক্সে পুরে তোমার জন্য চোদ্দ ভরির হার দিয়েছে৷ চারদিকে নেগেটিভ মাইন্ডসেট৷ ওরে বাবা টিউবওয়েল সাপ্লায়ার আমার বাড়ির চারতলার ঘরের মেঝে মোজায়েক করে দিয়েছে কি দেয়নি; তা জেনে পাবলিকের কী লাভ? আরে টিউবওয়েল তো জায়গা মত বসেছে, নাকি! ঠিক আছে, সাত মাসের মধ্যে বার পাঁচেক সে টিউবওয়েল খারাপ হয়েছে বটে, কিন্তু তার ফলে টিউবওয়েল রিপেয়ার করনেওলা কন্ট্র‍্যাক্টর যে বাড়তি ব্যবসা পেল, তা'তে তো আখেরে ইকনমিরই উপকার; তাই নয় কি? লোকে সে'সব অ্যাপ্রিশয়েট করবে না, গণ্ডমূর্খের দল যত৷ শুধু খুঁত ধরবে। টিউবওয়েল সাপ্লাইয়ের কন্ট্র‍্যাক্টর আর টিউবওয়েল রিপেয়ার করার কন্ট্র‍্যাক্টর, তারা ভালোবেসে আমায় ছোটখাটো সামান্য কী'সব বাড়ি, গাড়ি দিয়েছে; তা'তে লোকের গাত্রদাহের শেষ নেই৷ কী জেলাসি ভাবতে পারো? এ জন্যেই বাঙালির আজ এই দুর্দশা। 

একটু মনপ্রাণ দিয়ে জনতা-জনার্দনের সেবা করব, সে'উপায় আর রইল না৷ অকারণ অদরকারী ব্যাপারস্যাপার নিয়ে টানাটানা করে, আমার পিছনে খামোখা টিকটিকি লাগিয়ে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার করল৷ আরে ঠিক আছে, জেরা করবি কর। সে ব্যাপারটায় একটা আলগা রোম্যান্স আছে বইকি। তা'বলে  স্যাট গ্রেপ্তার করার কী আছে? বাধ্য হয়ে বুকের ব্যথার রেফারেন্সটা দিতে হল৷

যাকগে, পার্টি ব্যাপারটা সামলে দেবে। আমায় নিয়ে তুমি ভেবোনা, ডাক্তার বলে গেছে আমার বুক চিনচিনটা সারাতে একমাত্র পথ্য হলো মাটনকষা আর বাসন্তী পোলাও৷ হাসপাতালে ক'দিন সে'সবই চলবে। সঙ্গে নেটফ্লিক্স।  জামিনের ব্যবস্থাটা হয়ে গেলেই  আবার ওই স্ট্যু আর ম্যানিফেস্টোতে ফিরে যাব'খন৷ আফটার অল ওয়েলথ ইজ হেলথ। 

তুমি সাবধানে থেকো। জনতার স্বার্থে, দেশের স্বার্থে; আমি শিগগিরই ফিরে আসছি৷ 

জয় হে। জয় হে। জয় হে।

ইতি,

সুমির আমি।

আড়াইশো গ্রাম দুঃখ



দু-আড়াই'শো গ্রাম দুঃখ পকেটে নিয়ে দিব্যি ঘুরছিলাম৷ আশেপাশে শোরগোল শুনলেই পকেট খামচে ধরছি৷ নিরিবিলি পেলেই পকেট থেকে সেই ড্যালাটা বের করে পোষা খরগোশের মত হাত বুলোচ্ছি৷ টো-টো করে দিব্যি কাটছিল।

হঠাৎ কী খেয়াল হলো, গিয়ে পৌঁছলাম রেলস্টেশনে।
তারপর ফের কী হল, দেখলাম একটা ট্রেন হেলতেদুলতে এসে দাঁড়ালে। ফাঁকা কামরা দেখে টুপ করে উঠে বসলাম ট্রেনের জানালার পাশে৷ ফুরফুরে হাওয়ায় চোখ লেগে এলো।

ওই হল গিয়ে কাল!

ভদ্দরলোকের তুলতুলে ব্যথা-ব্যথা আমেজের ঘুম; ভগবানের সহ্য হবে কেন?

ওই। তারপর যা হয় আর কী৷

কোন এক ব্যাটা বেআক্কালে বেয়াদপ রাস্কেল,
আমার পকেট মেরে 
অমন বাইশ ক্যারাটের দুঃখ সাফ করে,
"এতেও-ভেসে-যাব-না-ভাইটি" ব্র‍্যান্ডের সল্টেড বাদাম রেখে সরে পড়েছে৷

এক্কেবারে রাহাজানি, আর কী৷ ধেত্তেরি৷

ফান্ড



সকালের ঝকঝকে নীল আকাশ, ফুরফুরে শরতের হাওয়া। একটা জরাজীর্ণ চারতলা স্কুলবাড়ি। ছেলেপিলের দল নেই, বোঝাই যায় ছুটির দিন। তা বলে হইচইয়ের অভাব নেই। অন্তত জনা চল্লিশ লোক মিলে স্কুলবাড়ি আর তার সামনের মাঠটাকে সরগরম করে রেখেছে। চার-পাঁচজন মিলে মাঠের পশ্চিম কোণে স্টেজ বাঁধছে।  আর সাত-আটজন বাবু-গোছের লোকজন তাদের "হ্যান করো, ত্যান করো, জলদি জলদি করো" বলে তাড়া লাগিয়ে চলেছে। বাবুরা অবশ্য ভুলেও কাজে হাত লাগাচ্ছে না, পাছে কাজ সময়মত শেষ হয়ে যায়। একটা ঢাউস ফ্লেক্স ব্যানার টানাটানি করে দু'জন লোক হন্যে হচ্ছে, আর একজন মাতব্বর কন্ট্রাক্টর গোছের লোক তাদের ওপর তম্বি করে চলেছে। জনা-দশেক লোক স্টেজের সামনে ভাড়া করা প্লাস্টিকের চেয়ার সাজাতে ব্যস্ত। আর যথারীতি অন্য আর এক বাবুদের দল বিভিন্ন জরুরী ইন্সট্রাকশন দিয়ে ক্রমাগত তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলেছে।

কিন্তু এই সমস্ত গোলমালকে বিন্দু মাত্র পাত্তা না দিয়ে এক বছর তিরিশের যুবক স্কুলের স্যাঁতস্যাঁতে বারান্দায় একটা ক্লাসরুম থেকে বের করে আনা নিচু বেঞ্চের ওপর বসে একটা মচমচে টেবিলের ওপর ঝুঁকে কিছু কাগজপত্তর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ওঁর নাম অনুপ চ্যাটার্জী, পরনে চেক ফুলশার্ট, কালো প্যান্ট, ঝাঁচকচকে পালিশ মারা কালো জুতো। অনুপের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক; উসকোখুসকো চুল, ময়লা হাফশার্টের পকেটে আধ-ঝোলা সস্তা সানগ্লাস, ঢলা প্যান্ট - যে'টাকে পাজামা বলে চালালেও আপত্তি করা উচিৎ নয়। হিসেব কষতে কষতে হঠাৎ সামান্য বিষম খেলেন সেই ধোপদুরস্ত যুবকটি। কাগজ থেকে মুখ তুলে সেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন;

- সামন্তবাবু,তিনশো চেয়ার দিয়েছেন কেন? আড়াইশোটা বলা ছিল!

- আসলে এত বড় ইভেন্ট। পঞ্চাশটা চেয়ার এক্সট্রা লাগতেই পারে।

- কাজের কন্ট্রাক্ট নিয়েছেন। কথামত জিনিস সাপ্লাই করবেন, সরে পড়বেন। মাথা খাটিয়ে পঞ্চাশটা বেশি চেয়ার দিতে কে বলেছে?

- আসলে আমি ভাবলাম...।

- সাপ্লাই করাটা আপনার কাজ। ভাবার কাজটা আমার। বিল থেকে পঞ্চাশটা চেয়ারের টাকা বাদ যাবে।

- না মানে, ব্যাপারটা ভেবে দেখুন....।

- খাবারের প্যাকেটগুলো কতক্ষণে আসবে?

- এই, আধঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে। আমার ম্যানেজার কমল নিজে হালদারপাড়ার দোকান থেকে ম্যাটাডোরে করে তুলে আনছে। এই খানিকক্ষণ আগেই ফোনে কথা হয়েছে।

- দেখবেন, বাড়তি শ'খানেক প্যাকেট আনিয়ে বসবেন না নিজের মাথা খাটিয়ে।

- আজ্ঞে না। ওই, এগজ্যাক্ট নাম্বারই আসছে।

- স্টেজ বাঁধা, ব্যানার, ফেস্টুন, ভিআইপি আপ্যায়ন, মাইক, জেনারেটর, পাবলিকের জন্য খাবারের প্যাকেট, ভলেন্টিয়ার, মানপত্র, উত্তরীয়...উঁ...প্লাস এইগুলো...উম...।

- হিসেবে কোনও ভুল নেই স্যার।

- যাকগে, শুনুন। বড়সাহেব আর একঘণ্টার মধ্যে এসে পৌঁছচ্ছেন। ওঁর সঙ্গে আর জনাচারেক সিনিয়র অফিসার আসবেন। কাজেই মিনিমাম খানচারেক গাড়ি থাকবে। সে'গুলোর পার্কিং আর ড্রাইভারদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে যেন আমায় ভাবতে না হয়...। আর তাছাড়া কলকাতা থেকে কুড়িজন মত রিপোর্টার আসবেন। তাদের যত্নআত্তির ব্যাপারটা আমিই দেখব। কিন্তু আপনি নিজে থাকবেন আমাকে অ্যাসিস্ট করতে।

- আরে সে'সবের জন্য তো আমরা আছি...।

- ভালোই তো কামাচ্ছেন এই ইভেন্টটা থেকে।

- শুধু তো ইনকামের জন্য নয় স্যার। আপনাদের কোম্পানি আমাদের গাঁয়ের স্কুলে এতগুলো টাকা দেবেন। সে টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন বেঞ্চি টেবিল ব্ল্যাকবোর্ড কেনা হবে। কত বড় উপকার বলুন।

- সে গাঁয়ের মানুষ হয়ে নিজের কন্ট্র্যাক্টরির টাকা থেকে বাড়তি কিছু ডিসকাউন্ট দিতে পারতেন তো।

- হে হে হে স্যার। আমরা সাধারণ ব্যবসায়ী। আপনাদের মত বড় কোম্পানি কর্পোরেট সোশ্যাল কাজকর্ম সারতে গ্রামে-গঞ্জে আসছেন। এতে তো আমাদের রুরাল ইকনমিরও ফায়দা, বলুন।

- বাব্বাহ্, গপ্প তো ভালোই জানেন। কিন্তু বলে রাখলাম, পঞ্চাশটা এক্সেস চেয়ারের টাকা আপনার বিল থেকে কেটে নেব।

- বেশ তো। বেশ তো।

- হ্যাঁ, আড়াই লাখটাকার বিল হাঁকছেন। সে'খান থেকে হাজারখানেক এলো কী গেলো তা নিয়ে আপনার ভাবার কথা নয়। শুনুন, আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসছি। আপনি ততক্ষণে আমাদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থাটা সেরে ফেলুন দেখি। লোকজন এসে পড়ার আগে সে ব্যাপারটা মিটে যাক।

**

স্কুলের পাশেই কেষ্টবাড়ি ঝিল। জায়গাটা নিরিবিলি, মনোরম। সে ঝিলের এককোণে বাঁধানো কয়েকটা সিঁড়ি। সে সিঁড়িতে বসে সিগারেটটা ধরালে অনুপ চ্যাটার্জী। ভারী মিঠে হাওয়া বইছে, চোখেমুখে সে হাওয়া লাগায় চোখ লেগে আসে। কাল রাত্রে যে লজে রাত কাটাতে হয়েছে সে'খানে মশার কামড়ের চোটে অর্ধেক রাত পায়চারী করে কাটাতে হয়েছে। ঝিমুনিটা ভাঙল একটা মিহি কণ্ঠস্বরে; "আপনিই কলকাতার হিউউইট কোম্পানির সিনিয়র অফিসার"?

অনুপ ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন এক বছর পঞ্চাশের লোক, পরনে হাফ পাঞ্জাবী আর পাজামা। সৌম্য চেহারা, মুখে স্মিত হাসি। উঠে দাঁড়ালেন অনুপ।

- আমিই হিউউইট কোম্পানির সিনিয়র অফিসার, অনুপ চ্যাটার্জী। আপনাকে তো ঠিক...।

- নমস্কার। আমি সমর মণ্ডল। দীননাথ ঠাকুর জুনিয়র হাই, যে'খানে আপনারা কিছু অনুদান দিতে সম্মত হয়েছেন, ও'খানে আমি অঙ্ক শেখাই।

- নমস্কার। বলুন।

- আমি জানি এমন দুম করে কিছু বলে বসাটা সমীচীন নয়। তবে আপনি ইয়ং কর্পোরেট লীডার। হয়ত ফর্ম্যালিটির তেমন প্রয়োজন নেই।

- বলুন না।

- আপনারা স্কুলে একলাখ টাকা দিচ্ছেন বেঞ্চি-ডেস্ক এই'সব কেনার জন্য। তা'তে আমাদের অনেক উপকার হবে। শুধু...।

- শুধু?

- আমাদের একটা লাইব্রেরী আছে, জানেন। রিসোর্সফুল নয়। সামান্য কয়েকটা বই। বেশিরভাগই ডোনেটেড। বেশিরভাগই পুরনো এডিশনের টেক্সটবুক। লাইব্রেরী নামেই আর কী। ছেলেপিলেরা বড় একটা ঘেঁষে না ও'দিকে। অবশ্য, যাবেই বা কেন। ওদের অ্যাট্রাক্ট করার মত ভালো কোনও গল্পের বইটই তো নেই। রঙিন এনসাইক্লোপিডিয়া গোছের কিছু বই হলেও না হয়...।

- ওহ আই সী।

- মিস্টার চ্যাটার্জী, আমরা কয়েকজন মিলে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি বটে এ বই সে বই জোগাড় করে আনার। কিন্তু তাতে আর কতটা হয় বলুন। আপনাদের তরফ থেকে যদি লাইব্রেরির জন্য একটা কর্পোরেট ডোনেশন পাওয়া যেত...।

- বেশ তো। একটা অ্যাপ্লিকেশন যদি স্কুলের থেকে দেওয়া হয়, তা'হলে আমাদের পরের বছরের বাজেট থেকে কিছু করা যায় কিনা, সে'টা না হয় আমরা কনসিডার করে দেখব...।

- না না, লাইব্রেরীর জন্য লাখটাকার দরকার নেই। হাজার কুড়ি হলেই অনেক জরুরী বই  আমরা কিনে ফেলতে পারি...।

- টাকার পরিমাণ যাই হোক, রিলিজ করার প্রসেসটা তো একই। তাছাড়া এই ধরণের কাজে গোটা টাকাটাই আসে আমাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির ফান্ড থেকে। সে'টা তো লিমিটেড।

- চ্যাটার্জীবাবু, একটু দেখুন না। এই যে এক গাঁ মানুষকে শিঙাড়া, মিষ্টি, কেক খাওয়াচ্ছেন; তার বদলে যদি...। বা এই যে অনুষ্ঠান করছেন, তার এত খাইখরচ...স্পেশ্যাল গেস্ট, মিডিয়া...। সে'সব থেকেই যদি সামান্য কিছু সরিয়ে...।

- সেই খরচ পি-আর ফান্ড থেকে আসে। সে ব্যাপারটা আলাদা।

- আজ্ঞে?

- সে খরচ আলাদা। কোম্পানি একটা স্কুলকে অনুদান দিচ্ছে, সে'টার পাবলিসিটি করতে হবে না?

- ওহ, তাই তো।

- মণ্ডলবাবু। আমি আসি। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। আর, পারলে একটা অ্যাপ্লিকেশন দিন না কলকাতায় এসে। আপনাদের লাইব্রেরী ফান্ডের জন্য। আমি রেকমেন্ড করে দেব'খন।

ডাক

খোকাখুকুদের ডাকঃ "এই যে দাদা"।

দাদা-দিদিদের ডাকঃ " এই যে ভাই"।

লেজেন্ডদের ডাকঃ "এই যে ব্রাদার"।

আল্ট্রা-লেজেন্ডদের ডাকঃ "এই যে বেরাদার"।

আল্ট্রা-লেজেন্ড প্রো-ম্যাক্সদের ডাকঃ "এই যে ভাইটি"।

আল্ট্রা-লেজেন্ড প্রো-ম্যাক্স-প্লাসদের ডাকঃ "এই যে ভাইটু"।

পার্লামেন্টারি



- দোলগোবিন্দবাবু!

- *ফুড়ুৎফুড় নাক ডাকার শব্দ*

- ও দোলগোবিন্দবাবু! এই যে! মিস্টার দোলগোবিন্দ গোলদার! 

- এই! কে! ডাকাত নাকি? এই পুলিশ ডাক! এই কেউ আমার ফলস দাতটা নিয়ে আয়। এই কেউ আমার বন্দুকটা নিয়ে আয়। আর ট্যাপা, সবার সমানে ফ্যাট করে বলে দিসনা এ'টা তোর খেলনা  রাইফেল!

- আপনার লজ্জা করেনা দোলগোবিন্দবাবু?

- অ্যা! ও, ওহ। সরি সরি! সরি ইওর অনার! আমি ভাবলাম ড...ডাকাত পড়েছে। তবে খামোখাই ভয় পেয়ে গেছিলাম মশাই। আমি তো আর চোরছ্যাঁচোর নই যে আমার মেজানাইন ফ্লোরে রাখা ডিভানের গদির পেটে কোটিকোটি কালোটাকা পোরা রয়েছে। আমার আবার ভয় কীসের।

- ইওর অনার আবার কী! আপনি মাঝেমধ্যেই নিজেকে কাঠগড়ায় দেখতে অভ্যস্ত তাই না? 

- ওহ, তাই তো। এ'টা তো পার্লামেন্ট। সরি। সরি। একটু চোখ লেগে এসেছিল তো। তাই গুলিয়ে গেছিল। যাকগে, বলুন স্পীকারবাবু।

- বলবেন আপনি। সে'জন্যই আপনাকে ডাকাডাকি।

- ওহ হো। আগের ভদ্দরলোকের ওই ভ্যান্তেরা শেষ হয়েছে এতক্ষণে? উফ, বাপ রে বাপ। কী বাজে কথা রে বাবা...।

- এ'খানে একটা ডেকোরাম আছে। এ'টা পরনিন্দাপরচর্চার জায়গা নয়। জরুরী ডিসকাশন চলছে। বিরোধী হিসেবে আপনার কী বক্তব্য আছে সে'টাই বলুন। প্লীজ স্টিক টু দ্য টপিক। 

- জো হুকুম ধর্মাবতার...।

- এই সেরেছে...।

- সরি। সরি। ধন্যবাদ স্পীকার মহাশয়। এ'বারে যা বলছিলাম...এই যে বিল নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে এত...। 

- দোলগোবিন্দবাবু...পার্লামেন্টে বসে ঘোঁতঘোঁত করে ঘুমোলে এই হবে। কিছুই তো জানেন না! জলঘোলা শব্দটা এ'খানে ব্যবহার করা নিষেধ।

- আজ্ঞে?

- নিষেধ।

- অ। তা ঠিক। তাই এ বিল নিয়ে এত কচকচি চলছে মশাই...।

- কচকচি? হাউ রিডিকুলাস। নাকচ।

- যাচ্চলে। যাকগে। এই বিল নিয়ে এই যে এত কেলোর কীর্তি...।

- আপনাকে আজ লাল কার্ড দেখতে হবে মশাই...।

- ধুত্তোর। যাক গে। আব্বুলিস। নতুন করে শুরু করছি। সরকারপক্ষ এই যে একটা বিটকেল বিল এনেছেন...। 

- এ'সব কী ভাষা? বিটকেল?

- আচ্ছা বেশ। রক্ষে করুন স্পীকারদাদা। এই যে  চমৎকার বিল পার্লামেন্টে আনা হয়েছে, তা'তে যে দশের এবং দেশের আখেরে ক্ষতি, সে'টা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? আমি একটা রিপোর্ট কোট করছি...।

- এই দাঁড়ান দাঁড়ান দাঁড়ান। ক্ষতি? ক্ষতি তো নেগেটিভ শব্দ। আনপার্লামেন্টারি। ও'সব চলবে না। 

- লে হালুয়া।

- ও'টাও চলবে না। লে হালুয়াও বাদ। আপনি কি পার্লামেন্টারি এটিকেটের বইটা বেচে দিয়েছেন দোলগোবিন্দবাবু?

- বেচে দেওয়া ব্যাপারটা বোধ হয় পার্লামেন্টারি, তাই না?

- সারকাজম ? ফের নাকচ।

- ধেরছাই ছাতার মাথা।

- ছাতা শব্দটা ঠিক ছিল। ছাতার মাথাটা অফেন্সিভ। ছাতার বাট দিয়ে আক্রমণ করা আয়। আপনার মতলব ভালো বুঝছি না দোলগোবিন্দবাবু।

- এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। 

- ঝামেলা। ফের আনপার্লামেন্টারি।

- বেশ। বুঝলাম। আমি একটা কথাই বলতে চাই। বিলটা দারুণ হয়েছে। এক্কেবারে অপূর্ব! এ'বার যথেষ্ট পার্লামেন্টারি হয়েছে কি?

- এইবারে একশোয় একশো পেয়েছেন।

বিনোদবাবু আর আদা-চা



মার্ক অ্যান্ড ডগলাস কোম্পানির ফাইলটা ছুঁড়ে ফেললেন বিনোদবাবু। ফাইলের ভিতরের কাগজগুলো এলোমেলো হয় ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল৷ টানা আড়াইমাস বড় খেটেখুটে প্রপোজালটা তৈরি করেছিলেন৷ নিখুঁত ভাবে সাজানো প্ল্যান৷ মার্ক অ্যান্ড ডগলাসের পারচেজ ম্যানেজার মিস্টার পোদ্দার সে প্রপোজালে একবার নজর বুলিয়েই বলেছিলান, "বিউটিফুলি ডান"। সিনহা সাহেব বিনোদবাবুর পিঠ চাপড়ে পোদ্দারকে বলেছিলেন, "বিনোদ আমাদের অ্যাসেট৷ ও' যখন উঠেপড়ে লেগেছে, আপনার কোনও চিন্তাই নেই"৷ বিনোদবাবুর সেই প্রপোজালটা আজ পাস হয়ে গেল, কিন্তু প্রজেক্ট সামলানোর দায়িত্ব পেল সৌম্য দত্ত৷  প্রতিবাদ করেছিলেন বিনোদবাবু, কিন্তু লাভ হয়নি৷ বরং সিনহা সাহেব দাঁত চেপে বললেন যে বিনোদবাবু যেন 'নুইসেন্স ক্রিয়েট' না করেন৷ 

অভয়চরণ আদা দেওয়া চা নিয়ে এসেছিল, মুখঝামটা দিয়ে তাকে কফি আনতে বললেন বিনোদবাবু৷ হতবাক অভয়চরণ কথা বাড়ায়নি৷ ছেলেটা এমনিতেই বেশ নম্র। এরপর  কম্পিউটারে বসেই বিনোদবাবু দেখলেন সিনহা সাহেব ইমেলে নতুন প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরির হুকুম দিয়েছেন।  মেজাজটা আরও ঘেঁটে গেল৷ ইনবক্স বন্ধ করে পায়চারি শুরু করলেন তিনি৷ বয়ে গেছে এমন বিচ্ছিরি পরিবেশে দিনরাত খাটতে৷ বিনোদবাবু মনস্থ করলেন এ'বার থেকে তিনক মনপ্রাণ দিয়ে কাজে ফাঁকি দেবেন। 

হ্যাঁ! ফাঁকি দেবেন৷ সিনহাদের দল বুঝুক ঠ্যালা৷ কিন্তু কী'ভাবে ফাঁকি দেবেন কাজে? চট করে মোবাইলে মিনিট চারেক লুডো খেললেন৷ কিন্তু সে'ফাঁকিটা তেমন মজবুত মনে না হওয়ায় কম্পিউটারের দিকে খামোখা তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর মনে পড়ল হরপ্রসাদের কথা৷ অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। কিন্তু নিজের সীটে তাকে  দেখাই যায়না, দিনরাত শুধু অফিসের বাইরের চায়ের দোকানে গিয়ে চা-মামলেট খাচ্ছ আর বিভিন্ন আড্ডিয়ে দলের সঙ্গে আড্ডা জমাচ্ছে৷ সমস্ত ফিচেল আড্ডার মধ্যমণি হরপ্রসাদ কারণ সে  হল অফিস গসিপের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া৷ 

যথারীতি সেই চায়ের দোকানের বেঞ্চিতেই পাওয়া গেল হরপ্রসাদ ধরকে৷ গলায় আই-কার্ড, ঠোঁটে সিগারেট, চোখে ঝিলিক৷ দু'জন নতুন ছোকরাকে গ্লোবাল ইকনমি নিয়ে দেদার জ্ঞান দিচ্ছিল৷ বিনোদবাবুকে চা-মামলেটের অর্ডার দিতে দেখে এক গাল হাসি নিয়ে এগিয়ে এলো হরপ্রসাদ; "এ কী! বিনোদদা এ'সময় এ'দিকে? স্প্রেডশিট থেকে চোখ সরাবার সময় পেলেন এদ্দিনে"?

আড়াই সেকেন্ড হে-হে করে হরপ্রসাদের পাশে এসে বসলেন বিনোদবাবু৷ হরপ্রসাদ তার ইকনমিক লেকচারে ফেরত গেল৷ বিনোদবাবু বুঝলেন যে এ আড্ডায় সবচেয়ে বড় সুবিধে হচ্ছে বেশি কথা না বললেও চলে কারণ হরপ্রসাদের কথা শেষ হয়না৷ এই ভালো; আড্ডাও হল, অসময়ে মামলেটও হল, আবার কাজে ফাঁকিও দেওয়া যাচ্ছে৷

ভিয়েতনামের ইকনমি থেকে হরপ্রসাদের মনোলগ যখন কানাডার ফিসকাল পলিসিতে পৌঁছেছে,  তখনই বিনোদবাবুর মোবাইলে বেজে উঠল, কনিষ্ঠ পুত্রটি ফোন করেছে, গত মাসে তার পাঁচ  বছর পূর্ণ হয়েছে৷ অতএব সে এখন লায়েক হয়েছে।

"বাবা! তুমি কী করছ"? 

বিনোদবাবুর মুখের মামলেটটা সুট করে বিস্বাদ ঠেকল৷ প্লেটটা নামিয়ে রেখে তড়াং করে উঠে দাঁড়ালেন৷ হরপ্রসাদের লেকচারে ছন্দপতন ঘটল৷ নতুন শ্রোতা হারানোর ভয় বড় সাংঘাতিক৷ 

- ও কী বিনোদদা, চললেন কই? অমলেটটা শেষ করুন৷ আর চা তো আসেইনি৷ আমাদের নির্মল লেবুচা-টা যা বানায় না, এ-ক্লাস৷ আরে বসুন না, এই তো এলেন।

- আসলে হঠাৎ মনে পড়ল, বুঝলে, একটা আর্জেন্ট রিপোর্ট শুরু করতে হবে। দেরী হলেই আবার..।

- কেন এত চাপ নিচ্ছেন৷ রিপোর্ট বানাবেন আপনি। আর প্রজেক্ট পাবে মৃণাল সিনহার পেয়ারের ওই সৌম্য দত্ত। ছাড়ুন না৷ তারচেয়ে বরং জ্যাপানের ইকনোমিক মডেলের ব্যাপারে একটা অদ্ভুত গল্প বলি শুনুন..।

- সৌম্য ইয়ং এনার্জেটিক চ্যাপ৷ কাজ পাক না, ক্ষতি কী৷ আমি বরং আসি৷ মামলেট আর জ্যাপান পরে হবে'খন৷ 

নিজের অফিসঘরে এসেই মেঝেয় ছড়িয়ে থাকা মার্ক অ্যান্ড ডগলাসের কাগজগুলো যত্ন করে ফের ফাইলে গুছিয়ে রাখলেন তিনি৷ অভয়চরণ কফি রেখে গেছিল, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে৷ "অভয়" বলে একটা পেল্লায় হাঁক পাড়লেন বিনোদবাবু৷ অভয় এলে তিনটে কাজ সারতে হবে।

এক নম্বর, অকারণ খারাপ ব্যবহার করার জন্য অভয়কে একটা জবরদস্ত 'সরি' বলতে হবে।
দু'নম্বর, আদা দেওয়া চা এক কাপ চাইতে হবে।
তিন নম্বর, মার্ক অ্যান্ড ডগলাস কোম্পানির ফাইলটা অভয়চরণের হাত দিয়ে সৌম্যর কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে৷ ওর বেশ কাজে লাগবে৷ 
অভয় আসার আগেই সে ফাইলে একটা হলুদ স্লিপ এঁটে একটা "অল দ্য বেস্ট" লিখলেন বিনোদবাবু৷

কালী

গুপ্তিপাড়ায় মায়ের পিসির বাড়ি। ছোটবেলায় সে'খানে কয়েকবার গেছি রটন্তী কালীপুজো দেখতে। সে পুজো হত মাঝরাতে, শীতের অমাবস্যার কনকন ছাপিয়ে জমজমাট আয়োজন। গুপ্তিপাড়ার দাদু, অর্থাৎ মায়ের পিশেমশাই নিজেই পুজো করতেন। ঋষিসুলভ মানুষ; শান্ত, গম্ভীর অথচ হাসিহাসি মুখ। প্রচুর আত্মীয়স্বজন জড়ো হত। নিপাট ভক্তির সঙ্গে হইহইরইহই মিলেমিশে সে অন্ধকার রাত্রি আলোআলো হয়ে উঠত। সন্ধ্যে থেকে বড়রা পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত, ছোটরা খামোখা ছুটোছুটি করে হন্যে হত এবং এন্তার কানমলা খেত। পুজো শুরু হতে হতে মাঝরাত। নেহাতই ছোট ছিলাম, রাত জেগে পুরো পুজোটা ঠিক দেখা হয়ে উঠত না। 

পরের দিন দুপুরে একটা জবরদস্ত ব্যাপার ঘটত। দুপুরবেলা খাওয়ার পাতে জুটত ভোগের নিরামিষ পাঁঠার মাংস। পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া রান্না, অতএব নিরামিষ। এই অকাট্য যুক্তির কাছে মাথা না নুইয়ে উপায় নেই। আর সেই ভোগের মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মাখার সময়ই প্রথম টের পেয়েছিলাম যে বাঙালির কালীপুজোয় নিরামিষের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

Wednesday, July 6, 2022

ভবেন সমাদ্দার আর লজেন্সওলা



১। 

- লজেন্স দেব বড়দা?

- দেবেন?

- দিয়েই দি', নাকি?

- অমন করে বলছেন যখন, দিন। আর তো তিনটে স্টেশন। লজেন্স চুষতে চুষতেই ব্যান্ডেল চলে আসবে'খন।

- মিনিমাম দু'টো লজেন্স লাগবে কিন্তু। তিনটে স্টেশন কভার করতে। 

- একটা আদা দিন। আর একটা লেবু।

- ভেরি গুড। আসুন।

- থ্যাঙ্কিউ। তা, বিক্রিবাটা কেমন চলছে?

- রোববারের সন্ধ্যেটা এলেবেলেই থাকে। দেখছেন না, ফাঁকা কামরা।

- আগে কোনটা মুখে দেওয়া যায় বলুন দেখি। আদা না লেবু?

- লেবু আগে। লেবু আগে। লেবু জিভকে শানাবে কিন্তু একটা টক ভাব ফেলে রেখে যাবে। আদা সে টক-ভাব উড়িয়ে দিয়ে পালিশ দিয়ে যাবে।

- ঠিক, ঠিক। আচ্ছা লজেন্সভাই, প্যাকেটে ক'টা করে লজেন্স থাকে?

- পাঁচটা করে। দেব নাকি? একটা আদা আর একটা লেবুর প্যাকেট?

- নিশ্চয়ই। 

২।

- এই যে, লজেন্সদাদা, ঘুম ভাঙল?

- আমি...আমি কোথায়...। 

- ভবেন সমাদ্দারের বাড়িতে। 

- আপনি ভবেন সমাদ্দার?

- আমিই।

- ব্যান্ডেল লোকালে আপনিই আমার থেকে লজেন্স কিনলেন তো...। 

- দু'টো লুজ। আর দু'টো প্যাকেট।

- কিন্তু তারপর আর কিছুই মনে পড়ছে না কেন...। আচ্ছা, আপনি কি আমায় কিডন্যাপ করেছেন?

- লজেন্সদাদা, একটা জরুরী কাজের জন্য আপনাকে আমার আস্তানায় নিয়ে এসেছি।

- দেখুন, আমি গরীব হকার। আমায় এ'ভাবে ধরে-বেঁধে রেখে কিন্তু কিছুই পাবেন না। আমার সংসারে আছে বলতে এক ভাই। সে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাপ-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। এখন আমার কিছু হলে সে ভেসে যাবে।

- লজেন্সদাদা। একজন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। 

- কে? এ'সব কী হচ্ছে!

- আপনাকে ধরে-বেঁধে রাখব বলে নিয়ে আসিনি লজেন্সদাদা। তার সঙ্গে কথা হয়ে গেলেই আপনাকে ছেড়ে দেব।

- কিন্তু কে কথা বলবে? আর তো কাউকে দেখছি না।

- আপনি তাকে দেখতে পাবেন না। তবে তার কণ্ঠস্বর শুনতে পারবেন। 

৩।

- দাদা!

- কে? কে?

- আমি অনি। 

- অনি, অনির গলা তো এ'রকম নয়। সে তো বাচ্চাছেলে। বারো বছর বয়স, পাতলা গলা...। 

- বারো বছর আগে আমায় বয়স বারো ছিল দাদা। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে।

- এ'সব কী যাতা কথাবার্তা হচ্ছে অ্যাঁ! কে বলুন দেখি আপনি! এই ভবেন সমাদ্দার ট্রেনে লজেন্স কেনার নাম করে আমায় খামোখা উঠিয়ে এনে এখন হয়রান করছে। 

- দাদা, আমি অনিই। তোমার ভাই, তোমার অনু।

- সে এমন দামড়া হল কবে। আর তাকে আমি দেখতে পারছি না কেন। আপনারা আমায় ছেড়ে দিন। আমায় এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে। অনু সে'খানে একা আছে। আমি গিয়ে ভাতেভাত বসালে তবে তার কপালে খাওয়া জুটবে।

- দাদা, এ'বার শান্ত হতে হবে তোমায়। 

- কী পাগলামো!

- আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এক রাত্রে তুমি আচমকা আর ফিরলে না। আর কোনোদিনও ফেরোনি। ট্রেন-চাপা। ওই, আপ বর্ধমান লোকালের নীচেই।

- যতসব বাজে কথা...। 

- দাদা। আমি ভেসে যাইনি। গ্রাজুয়েশন করেছি। আর গত হপ্তায় একটা কারখানায় ছোটখাটো চাকরীও জুটে গেছে। স্টোরস ডিপার্টমেন্টে। আমি ভেসে যাইনি দাদা। তোমার অনু ভেসে যায়নি।

- এ'সব কী...কেন...তুই সত্যিই অনু?

- দাদা। বাবাকে আমার মনে নেই। তুমি আমার বাপের চেয়ে কম নও। কিন্তু দাদা, এমন ট্রেনে-ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়ে কী পাও। রাতের দিকে ফাঁকা কামরায় মানুষজন মাঝেমধ্যে তোমায় দেখতে পারে। ভয় পায়। গত বছর খানেক ধরে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে দাদা। লক্ষ্মীটি। 

- আমার মাথাটা কেমন...আমি কি মিথ্যে অনু?

- মিথ্যে কেন হবে? তোমার আত্মাটা ঝুটো হতে যাবে কেন। তবে আর কেন দাদা। আমিও তো দাঁড়িয়েই গেলাম। আর লজেন্স হেঁকে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরবে কেন। ব্যান্ডেল লাইনের ট্রেনে উঠতে লোকে ভয় পাচ্ছে। এ'বার শান্ত হয়ে বসো। ভবেন সমাদ্দার নাম করা ওঝা। রেলের অফিস থেকে তাকে বহাল করে হয়েছে তোমায় পাকড়াও করতে। আর, আর আমায় ওরা সাহায্য করতে বলেছিল। 

- তুই ভালো আছিস তো অনু?

- তোমার জন্য মন কেমন হয় দাদা খুব। কিন্তু তোমার মত এমন মাটির মানুষের আত্মাকে সবাই ভয় পাবে, এ ব্যাপারটা আমার বড় খারাপ লাগে।

- তাই তো। তোর মান-সম্মান নষ্ট হচ্ছে হয়ত। অনু, নিজে মরে ভূত হয়ে গেছি বলে যে দুঃখ, তুই চাকরী পেয়ে জীবনে দাঁড়িয়ে গেছিস জানতে পারে তার বহুগুণ বেশি আনন্দ পেয়েছি রে। আমার আর কোনও আকাঙ্ক্ষা রইল না। আর আমার লজেন্স বিক্রি করার নেই। এ'বারে মুক্তি। 

- এই ভবেন সমাদ্দারের আস্তানা ছেড়ে আর বেরিও না। কেমন?

- এই তোকে আমি কথা দিলাম অনু। সমাদ্দার ওঝার পারমিশন ছাড়া আমি আর এক পাও নড়ব না। তুই ভালো থাকিস অনু, কেমন? এ'বার আয়। আমি সামলে নেব'খন। 

৪। 

- থ্যাঙ্কিউ ডক্টর সমাদ্দার। এ যে এমন শান্ত হয়ে আপনার ছত্রছায়ায় পড়ে থাকতে রাজি হবে, সে'টা আমরা ভাবিনি। রেলওয়েজের পক্ষ থেকে উই মাস্ট থ্যাঙ্ক ইউ এগেন।

- আ ভেরি কিউরিয়াস কেস, আপনাদের এই লজেন্স-বাউল।

- ওই রুটের লোকজন কিন্তু ওকে লজেন্স-খ্যাপা বলে।

- মানুষ ইনসেনসিটিভ, এ আর নতুন কী। তবে আমার কাছে ও বাউলই। লজেন্স বিক্রির প্রতি ওঁর যে ডিভোশন, সেলাম না করে উপায় নেই। মানছি, খালি বয়াম নিয়ে লজেন্স লজেন্স করে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়ে যাত্রীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। কিন্তু কোনোদিন কারুর অনিষ্ট তো করেনি। তাছাড়া, মানুষটা আগাগোড়া ভালোবাসার। আনফরচুনেটলি, সেই ভালোবাসা দিয়েই ওঁকে বেঁধে রাখতে হল। খুব অপরাধ বোধ হয় মাঝেমধ্যে। 

- এ'ছাড়া তো কিছুতেই ওকে কাবু করা যাচ্ছিল না। অ্যান্ড আই এগ্রি উইথ ইউ। লোকটা পাগল...সরি...একটু অসংলগ্ন হলেও...নিপাট ভালোমানুষ। আপনার অ্যাসাইলামে স্বেচ্ছায় থাকতে না চাইলে ওকে হয়ত হাজতে পুরতে হত। কারণ ধরতে গেলেই ও বড্ড ভায়োলেন্ট হয়ে উঠত। আর রেলের অফিসার হয়ে আমাদের তো প্যাসেঞ্জার সেফটিটা ইগনোর করলে চলে না ডক্টর সমাদ্দার।

- আপনাদের সিচুয়েশনটা আমি বুঝি। চিন্তা করবেন না স্যার, ওঁর যথাযথ চিকিৎসা হবে এ'খানে। তবে ট্রমাটা বড্ড সিরিয়াস। ভাবুন, নিজের সন্তানসম ছোটভাইটিকে লাইনে কাটা পড়ে থাকতে দেখেছে। সেই মারাত্মক রিয়ালিটিকে রিফিউজ করা ছাড়া আর ওঁর সামনে কোনও পথ ছিল না। আমার খুব খারাপ লাগছে, সেই মরা ভাইকে জ্যান্ত সাজিয়ে, সেই অভিনয় করে ওকে এখানে আটকে রাখতে হল। তবে ভালোবাসা কী অদ্ভুত জিনিস দেখুন, নিজের মৃত্যুটা বিশ্বাস করে নেওয়া ওঁর কাছে অনেক সহজ, নিজের ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নেওয়ার থেকে। এ'ব্যাপারটা বাদ দিয়ে ওকে এ'খানে আনতে পারলে ভালো হত। কিন্তু আই ওয়াজ হেল্পলেস।

- ব্যাপারটা ট্র্যাজিক। ইয়েস। তবে আই মাস্ট কঙ্গ্রাচুলেট ইউ এমন একটা মিরাকুলাস ব্যাপার ঘটাতে পারার জন্য। ওয়েল ডান ডক্টর সমাদ্দার। নাকি আপনাকে সমাদ্দার ওঝা বলে ডাকব এ'বার থেকে?