Sunday, February 27, 2022

বিরিয়ানির কবিগান



বিরিয়ানি ব্যাপারটা নিয়ে এত মাতামাতি বোধ হয় আইডিয়াটার নিপাট সারল্যের জন্য৷ ভাত-মাংস, একই পাত্রে, একই সঙ্গে৷ অবশ্য সরল ব্যাপারটা খাইয়েদের জন্য৷ রাঁধিয়েদের কাজটা সহজ নয় তেমন, এ বড় জটিল শিল্প৷ ভাতের দানা কতটা শক্ত রইল, মাংস যথেষ্ট তুলতুলোলো কিনা, মশলার ব্যবহারে যথেষ্ট সংযম দেখানো গেছে কিনা; এমন হাজারো হ্যাপা৷ 

কিন্তু আউটপুট ব্যাপারটা সুকুমার সমগ্রর মত জম্পেশ; সহজসরল অথচ ম্যাজিকে টইটুম্বুর একটা ব্যাপার। বিরিয়ানি ছাড়া খানাপিনা ভাবতে হলে আপনাকে ঝোল বাছতে হবে, রুটি বা ভাতের রকমফের দেখতে হবে, তার পাশাপাশি এ'টি এবং ও'টি৷ বিরিয়ানি ব্যাপারটা তুমুল; মাংস-ভাত, ঝোলে ল্যাপ্টালেপ্টি নেই কিন্তু শুকনো দলা হয়ে গলাতেও আটকে যাবে না৷ আর সেই অনাড়াম্বরের জন্য হয়ত খানিকটা খরচেরও সাশ্রয় ঘটে; ওই তিনচারটে পদের দরকার স্রেফ বিরিয়ানিতে মিটে যাওয়ায় (এই ছবিতে বিরিয়ানির পাশাপাশি যে মুর্গির রগরগে ঝোল আছে, সে'টা নেহাতই উত্তমকুমার পাশে আমার মত গাম্বাটের হ্যা-হ্যা করে দাঁতিয়ে দাঁড়ানোর মত অদরকারী)। 

বিরিয়ানি চিনামাটির প্লেটেও চলে, রূপোলী থালাও আলো করে থাকে আবার  সস্তা সাদা কাগজের বাক্সেও একই রকম জমজমাট এবং উপভোগ্য৷ এর ফলে ব্যাপারটার মধ্যে রয়েছে দুর্দান্ত 'ইজি অ্যাকসেস'। সে'ভরসাতেই শেয়ালদা স্টেশনের কাছে জীর্ণ ঠেলার হাঁড়ির বিরিয়ানি খাওয়ার থ্রিল য কোনও কুলীন রেস্তোরাঁয় বসে দাঁত চিবিয়ে বিরিয়ানি বিষয়ে সিঙ্গলমল্টিও বিশ্লেষণ করার সমান৷ 

আর এই ভালোবাসাটা মোটামুটি রোববার ভালোলাগার মত, অথবা ট্রেনের জানালায় বসে মিঠে হাওয়া মুখে লাগানোর তৃপ্তির মত।  ব্যাপারটা এতই মোটা জাতের যে এ প্রসঙ্গ উঠলেই বিরিয়ানি-ভালোবাসা মানুষজনের ইমোশন পিলপিলিয়ে হ্যামিলিনের ইঁদুর-দলের মত বেরিয়ে আসে৷ আলোচনায় খোঁচাখুঁচিও থাকে, থাকে ব্যান্টার; অমুক জায়গা ওভাররেটেড, তমুক জায়গার বিরিয়ানি ডালডা চোবানো, ইত্যাদি৷ তবে গোটাটাই পান্নালালের "যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি"র জায়গায় থেকে৷ বিরিয়ানি যুদ্ধ বলে কিছু হয়না, পুরোটাই কবিগানের রসালো লড়াই।

যা বলতে এতটা ধানাইপানাই, সে'টা বলি৷ এত বিরিয়ানি-বিরিয়ানি আদেখলাপনার মূলে একটাই কারণ; বিরিয়ানি-কমরেডদের সেলাম জানানো৷ আর ইয়ে (ফিসফিসিয়ে, অপরাধবোধ খানিকটা চেপে রেখে) একটা মোক্ষম কথা জানিয়ে রাখা দরকার। হ্যাংওভার কাটানোর সবচেয়ে বড় অস্ত্র লেবুজল নয় কিন্তু, বিরিয়ানির কার্ব আর সুবাসই আপনার শ্রেষ্ঠ ভরসা৷ চিয়ার্স!

Saturday, February 26, 2022

দুধে-ভাতে-মেডিক্লেমে

মেডিক্লেমের মত ভালো খরচ আর হয়না৷ প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা হওয়ার চেয়েও জরুরী বোধ হয় মেডিকাল ইন্স্যুরেন্স৷ নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়ার দেশে অবশ্য সে ব্যাপারটা অনেকের জন্যই সহজলভ্য নয়৷ তবে ঈশ্বরী পাটনীর দুধে-ভাতে থাকার স্বপ্নে একটা বড় অংশ জুড়ে বোধ হয় বিপদেআপদে ফতুর না হয়ে খানিকটা লড়তে পারার ক্ষমতা৷ 

সরকারি হাসপাতালের নিখরচায় চিকিৎসার সুযোগও অবশ্যই আছে৷ কিন্তু মেডিক্লেমের ভরসায় বেসরকারি চিকিৎসার দিকে তাকানোর দুঃসাহসটুকু অন্তত পাওয়া যায়৷ প্রাইভেট মানেই ভালো? না৷ কিন্তু, কোনও দরজাই বন্ধ নেই; এ ভরসার মূল্য ওই দুধভাতের সমান৷ 

আমার এক পরিচিত মানুষ মাঝেমধ্যেই চেনা লোকজনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন মেডিকাল ইন্স্যুরেন্স আছে কিনা, থাকলে প্রিমিয়াম নিয়মিত জমা করা হচ্ছে কিনা৷ এমন গায়ে পড়া প্রশ্নে অনেক বিরক্ত হন, আমিও হয়েছি একসময়৷ কিন্তু তা'তে সেই পরিচিত মানুষটার উৎসাহে ভাটা পড়েনা৷ তিনি জোর গলায় বলেন, "ভালো আছিস কিনা জিজ্ঞেস করার চেয়ে মেডিক্লেমের খোঁজ নেওয়া ভালো"। 

তবে সেই পরিচিত মানুষটির গায়ে-পড়া যতই উড়িয়ে দিই, একটু অবাক হই যখন অনেকে একটা নিয়মিত আয় থাকা সত্ত্বেও মেডিকাল ইন্স্যুরেন্স ব্যাপারটা নিয়ে গা করেন না৷ কিছু ভাসা ভাসা কারণ শুনতে পাই। "আরে এই জোয়ান বয়সে আবার মেডিক্লেম কেন"৷ "খামোখা অতগুলো টাকা প্রিমিয়াম দেব, কিন্তু গোটা বছর শেষে কোনও ক্লেমই হবে না। গোটাটাই জলে"৷ "ও'সব আমি বুঝি না ভাই"৷ 

প্রতিটা মানুষের মেডিক্লেমের প্রিমিয়াম যেন বছরের পর বছর জলে যায়; কাউকেই যেন হাসপাতালমুখো না হতে হয়৷ তবে ওই, খেটেখুটে জমানো সঞ্চয় উজাড় হয়ে যাওয়ার দুঃখ যে কী নিদারুণ৷ হাসপাতাল চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে সবেধন নীলমণি ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙার প্ল্যান করতে করতে বুকের মধ্যে যে কী বিশ্রী মচরমচর শব্দ হয়, সে'টা কল্পনা করে নিতে অসুবিধে হয়না৷

মেডিক্লেম মানেই কি সব সমস্যার সমাধান? আদৌ নয়৷ আজকাল সত্যিই মেডিকাল ইন্স্যুরেন্সের দর আকাশ ছোঁয়া৷ দরাজ ইনস্যুরেন্স কভার বাগানো চাট্টিখানি কথা নয়৷ কিন্তু বিপদে-আপদে একটা উজ্জ্বল ভরসা, ব্যাপারটা সত্যিই বড় দামী৷ কত দামী? বছরে একবার পুরী ঘুরতে যাওয়ার চেয়েও, মাসে দু'বার রেস্তোরাঁয় খাওয়ার থেকেও, বইমেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ার থেকেও; ঢের বেশি দামী৷ 

Monday, February 21, 2022

বাংলার ক্লাস



বাংলায় আমি চিরকালই নড়বড়ে। হাতের লেখা মারাত্মক খারাপ, বানানে বৃহস্পতি। অবশ্য অন্যান্য ভাষায় আমার অবস্থা আরও করুণ। সত্যি বলতে কী; ভাষাগত ভাবে আমি চিরকালই জুবুথুবু৷ তা সত্ত্বেও  ব্লগটা শুরু করেছিলাম নেহাতই টেকনোলজির মায়া কাটিয়ে উঠতে না পেরে৷ ২০০৭ নাগাদ ব্লগ ব্যাপারটা বেশ নতুন৷ উঠলো বাই তো করে নিজের একটা কটক-যাই-ওয়েবসাইট দাঁড় করিয়ে ফেলা যায়, যা কিছু হিজিবিজি লিখেও ফেলা যায়৷ এ লোভ পাশ কাটিয়ে চলে আসা সহজ নয়৷ সেই থেকে বংপেন৷ পরে বহুবার মনে হয়েছে নামটা কেমন যেন; বং এবং পেন, দু'টোর কোনওটাতেই বাংলার ব'ও নেই। কিন্তু নামটা তদ্দিনে ডাকনামের মত হয়ে গেছে৷ বাবাই, টুকাই, পাপাই; এই ধরণের ডাকনামের মানে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও মানেই হয়না৷ তেমনই, আমার মাথার মধ্যে বংপেনও খানিকটা ওই বাবাই-পাপাইয়ের মতই একটা ডাকনাম৷ 

ব্লগে প্রথম লেখা শুরু করেছিলাম ইংরেজি ফন্টে৷ মানে লিখতাম বাংলাতেই, কিন্তু রোমান হরফ ব্যবহার করে৷ সে'খানে বাংলা হয়ে যেত Bangla। এর মূল কারণ দু'টো৷ এক, তখনও অভ্র কীবোর্ড ততটা ছড়িয়ে পড়েনি বা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি৷ ওয়ার্ড ফাইলে বাংলা টাইপ করা একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতা ছিল৷  দুই, পরীক্ষার খাতার বাইরে বাংলা আদৌ লেখার অভ্যাস ছিল না৷ সে সময় হাতে স্মার্টফোন না থাকায় বাংলা টাইপ করার ব্যাপারটা নেহাত এলেবেলে ছিল না৷ সবচেয়ে বড় কথা, একটানা বাংলায় লিখব ভাবলেই গলা শুকিয়ে আসত৷ 

কাজেই রোমান হরফে বাংলা লিখে ব্লগের শুরু৷ তখন লেখা ব্যাপারটাকে আদৌ পাত্তা দিচ্ছি না। ইন্টারনেটে লেখা ভেসে উঠছে; থ্রিল সে'টুকুই৷ কিন্তু এরপরেই টের পেলাম আদত ম্যাজিকটা। সোশ্যাল মিডিয়ার ম্যাজিক৷ আমরা (আমিও) সোশ্যাল মিডিয়াতেই অনবরত দুঃখ করে চলি যে এই মাধ্যমটা ভীষণ নির্মম। মানুষ এ'খানে একে অপরের কলার টেনে কাদায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, এ ওর বাপ তুলে গাল দিচ্ছে, ও এর গুষ্টির পিণ্ডি চটকাচ্ছে৷ গুজব আর গালিগালাজে পরিপূর্ণ চারদিক৷ অথচ ফেসবুক ট্যুইটারের নেশা ছাড়তে না পেরে আমরা ক্রমাগত হাহুতাশ করে চলেছি৷ 

যাকগে, যে ম্যাজিকের কথা বলছিলাম। এই প্রবল গোলমেলে ইন্টারনেটের জগতে ব্লগের ঝাঁপ খুলে টের পেলাম দু'চারজন মানুষ পাশে এসে বসতে শুরু করেছেন (ইয়ে, ভার্চুয়ালি), লেখার দিকে চোখ বুলোতে শুরু করেছেন৷ আর সবচেয়ে বড় কথা; কথাবার্তা শুরু হল৷ লেখা নিয়ে, বাংলাভাষা নিয়ে। একসময় টের পেলাম আমারই বয়সী এক ছোকরা মাঝেমধ্যেই ব্লগে কমেন্ট ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়, "ভায়া, রোমান হরফে নয়৷ ইউনিকোডে লেখো৷ বাংলায় লেখো"৷ যাই লিখি ছাই একই কমেন্ট৷ খানিকটা বাধ্য হয়ে খোঁজ নিলাম ইউনিকোড ব্যাপারটা কী, আবিষ্কার করলাম অভ্র৷ একটা বিচ্ছিরি দুরুদুরু নিয়ে শুরু হল অভ্রতে লেখা৷ সেই ছোকরাটি অবশ্য নিজের 'সুপারভিশন' সরিয়ে নেয়নি৷ ওর নাম রোহণ, ওর মত বাংলাপ্রাণ মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি (ইয়ে, আমি কতটুকুই বা দেখেছি)।  রোহণের (বলাই বাহুল্য ওর একার নয়) সৃষ্টিসুখই বাংলা প্রকাশনায় এখন নতুন হাওয়া (ততটাও নতুন নয় আর৷ রীতিমত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে)।

কপাল বটে আমার৷ হিজিবিজি যা কিছু লেখা, কিছু সহৃদয় মানুষ যত্ন করে পড়তেন এবং খেটেখুটে প্রুফ রীড করতেন। কারুর কারুর সঙ্গে আলাপও হল৷ ক্রিকেট লিখিয়ে অভিষেকদার সঙ্গে আলাপও ওই ব্লগেরই মাধ্যমে৷ অভিষেকদা রীতিমতো মাস্টারি করেছে বেশ কিছু বছর। লেখার ভুলত্রুটিতে বিরক্ত হয়ে বাড়ি এসে পেটানোর হুমকিও দিয়েছে৷ কিন্তু হাল ছাড়েনি৷ বানান এখনও গুলিয়ে যায়, ভাষা এখনও নড়বড়ে, তবে ভুলের ভয়াবহতা খানিকটা কমেছে মূলত অভিষেকদার বকুনির ভয়ে। (লেখায় গোলমাল আছে এখনও বিস্তর, খানিকটা কমেছে, এই যা)৷ 

পত্রভারতীর ত্রিদিববাবু প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও বংপেনের গল্প পড়েছেন আর ধৈর্য ধরে ভাষা এবং স্টাইলের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছেন৷ সে আলাপও ইন্টারনেট ধরে। আমায় সামনে বসিয়ে একদু'বার লেখা পড়েছেন৷ প্রতিবারই মনে হয়েছে পত্রপাঠ বিদেয় করবেন৷ কিন্তু ওই, লাখটাকার কপাল; ভদ্রলোক কোনওবারই তিতিবিরক্ত হননি৷ " ও এমন কিছু নয়" ভাব করে ভুলচুকগুলো দাগিয়ে দিয়েছেন৷ আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। 

সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বংপেন ব্লগে লেখা পড়ে বহু মানুষ প্রুফরীড করে আমার লজ্জা ঢেকেছেন (চেষ্টা করেছেন অন্তত)৷ কত মানুষ ভালো বাংলা বইয়ের খোঁজ দিয়েছেন৷ ব্লগতুতো সম্পর্কের কত সহৃদয় মানুষ ভালো বাংলা সিনেমা দেখিয়ে ছেড়েছেন৷ কত মানুষ লেখার ভুল ধরিয়ে দিয়ে সরে পড়েননি, ভাষাগত বদঅভ্যাস ছাড়ানোর সহজ উপদেশ দিয়ে উপকার করেছেন৷ স্বীকার করে নিই, বংপেন ফেসবুকের পেজের কমেন্ট সেকশনের মত ধারালো প্রুফরীডার না থাকলে আমি সত্যিই বড় বিপদে পড়তাম। 

মোটের ওপর, বংপেন সম্ভবত গোটাটাই 'ক্রাউড ফান্ডেড'৷ কেউ বানানের লেগো টুকরো এগিয়ে দিয়েছেন, এগিয়ে দিয়েছেন ভাষার স্টাইলের লেগো টুকরো। এ সমস্ত জুড়েটুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বংপেন; মচমচ শব্দ আছে কিন্তু ভেঙেচুরে পড়ছে না৷ এই ব্লগের সূত্রেই বাংলাভাষা প্রসঙ্গে বিস্তর ধমক, কানমলা, গাঁট্টা, আর স্নেহপ্রাপ্তি ঘটেছে। সে'সব নিয়েই আমার বাংলা-শিক্ষা। বংপেন থেকেই জুটেছে বাংলার 'মাস্টারমশাই-দিদিমণি'দের৷ 

পনেরো বছর আগের তুলনায় ভুলভ্রান্তি খানিকটা কমেছে (তবে আবারও বলি, কমেছে মানে স্রেফ ওই সমুদ্র থেকে দু'চার মগ জল সরেছে আর কী)। আরও কমবে, আরও একটু ভালো বাংলা লিখতে শিখব ধীরেসুস্থে; উচ্চাশা বলতে সে'টুকুই৷ 

ধন্যবাদ। 

আর, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা৷

Sunday, February 20, 2022

মিহিরবাবু দায়িত্ব


রাতের দিকে ঘাটটা বেশ নিরিবিলি৷ কে বলবে যে এ'খানেই দিনেরবেলা একটা ছোটোখাটো মেলা বসে যায় প্রতিদিন৷ পাশেই সুপ্রাচীন মন্দির, লোকে বলে বড় জাগ্রত এ'খানে অধিষ্ঠিত দেবী। এককালে নরবলি হত, এখন শুধু প্রতি অমাবস্যায় পাঁঠাবলি হয়৷ প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে ঘাট ভরে যায় মানুষে, ভক্তরা এ'খানে এসেই স্নানটান করে৷ দোকানপাটও রয়েছে বেশ কিছু, পুজোসামগ্রী থেকে কচুরিমিষ্টির দোকান, এমন কি ভাতের হোটেলও আছে দু'চারটে৷ কিছু নৌকাও থাকে, অল্প ভাড়ায় দিব্যি আধঘণ্টা নদীর বুকে ঘুরে আসা যায়। অন্ধকার হলেই অবশ্য সব শুনশান; শুধু হরেনের চায়ের দোকান খোলা থাকে৷

মিহিরবাবু ভক্তও নন, ট্যুরিস্টও নন৷ কাজেই দিনেরবেলা এ'অঞ্চলটা এড়িয়ে চলেন। সন্ধ্যের পরেই অবশ্য তাঁর এ'দিকে আসাটা জরুরী। হরেনের সঙ্গে দু'হাত তাস খেলে বাঁধানো ঘাটে একটা জুতসই জায়গা বেছে নিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকেন৷ খানিকক্ষণ নদীর হাওয়া খাওয়া আর গুনগুন করে মুকেশের গান গাওয়া৷ রাত আটটার পর দোকান বন্ধ করে ঘাটের দিকে এগিয়ে এসে হাঁক পাড়েন হরেন, "ওঠো মিহিরদা, রাত হল"৷ 

ঘাড় ঘুরিয়ে মিহিরবাবু বলবেন, "ঝাঁপ নামিয়েছিস'? এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে আসবেন৷ 

এরপর ঘাটে দাঁড়িয়েই খানিকক্ষণ খেজুরে গপ্প চালান দু'জনে৷ এরপর গল্পের সুতো কাটতে না দিয়ে দু'জনে হেঁটে ফেরেন।

এ নিয়ম পালটায় না৷ 

মিহিরবাবু রোজ রাতে নদীর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ বুকের ভিতরের হিমশীতল ওঠানামাগুলোকে শত চেষ্টা করেও দাবিতে রাখতে পারেন না ভদ্রলোক৷ মুকেশের গানের সুরেও বুকের ধড়ফড়ানি থামে না৷ হরেনকে ঠকাতে মন চায় না, কিন্তু আজ পর্যন্ত অন্য কোনও উপায় খুঁজে পাননি ভদ্রলোক৷

মাঝেমধ্যে মনে হয় পুলিশের কাছে গিয়ে সমস্তটাই জানিয়ে দেবেন৷ তারপর যা হয় হবে৷ কিন্তু পরক্ষণেই ব্যাপারটা অনেকেত কানেই গোলমেলে ঠেকবে৷ তাছাড়া তিনি পথ থেকে সরে গেলেই আবার খুনখারাপি শুরু হবে৷ এই রক্তবীজের দলকে থামানো সহজ নয়, একমাত্র তিনিই পারেন এদের ঘোল খাইয়ে শান্ত রাখতে৷ মিহিরবাবু এক বড় অদ্ভুত বংশের মানুষ৷ তিনি নিজে বিয়েথা করেননি, তাঁর ভেবে ভালো লাগে যে তাঁর পর আর এই বংশের পাপ কাউকে বয়ে বেড়াতে হবেনা৷ কেউ না জানুক, মিহিরবাবু জানেন যে এ মন্দিরের নরবলি এখনও বন্ধ হয়নি৷ বছরে তেরোটা নরবলি না দেওয়া হলে নাকি দেবী পুজো গ্রহণ করেন না। অন্তত যে পুরোহিত বংশের শরিকদের একছত্র অধিকার আজও বহাল আছে, তাদের মত তেমনই৷ আর মিহিরবাবুরা বংশানুক্রমেই সে পুরোহিত বংশের ঋণে বাঁধা পড়ে৷ এই বিশ্রী কাজটাও বংশানুক্রমেই মিহিরবাবুর কাঁধে এসে চেপেছে৷ নয় পুরুষ ধরে এ মন্দিরের নরবলি দেন দিয়েছে মিহিরবাবুরই বংশের পুরুষরা। গত একশোবছর ধরে অবশ্য মন্দির প্রাঙ্গণে আর বলি হয়না, কিন্তু মিহিরবাবুর বাপ-দাদুদের দায়িত্ব ছিল বছরে অন্তত তেরোবার মানুষ খুন করে তাজা রক্ত মন্দিরে নিয়ে যাওয়া৷ মিহিরবাবুর কাজটাও পালটায়নি, তাঁর স্কুলমাস্টারির কাজটা স্রেফ দেখনাই।

এ পাপের বোঝা হালকা করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন মিহিরবাবু। তাঁর শেষ শিকার হরেন৷ বয়সে সামান্য ছোট হলেও হরেন তার ছেলেবেলার বন্ধু। আজ থেকে বছর দশেক আগে একবার, সুবিধেমত শিকার না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন মিহিরবাবু। সময়মত মন্দিরে রক্ত পৌঁছে দিতে না পারলে পুরোহিতের বংশরা তাঁর ঘটিবাটি কেড়ে নেবে, গুমখুনও করতে পারে।  কাজেই একরকম বাধ্য হয়েই রাতের বেলা বাড়ি ফেরার মুখে খুন করতে হয়েছিল অসহায় হরেনকে৷ ভাগ্যিস হরেনের পরিবার-পরিজন বলতে কেউই ছিল না, কাউকে বিধবা হতে হয়নি, কোনও শিশু পিতৃহারা হয়নি৷ 

এই হরেনই ভাগ্য খুলে দিয়েছিল মিহিরবাবুর৷ আসলে খুন হয়েও কিছুতেই নিজের মৃত্যুটাকে পাত্তা দেয়নি হরেন৷ আজও সে নিয়মতি নিজের চায়ের দোকানে এসে বসে। কিছুতেই টের পায়না যে কোনও খদ্দেরই তার দোকানমুখো হয়না, কেউ তাঁকে দেখতেই পারেনা৷ শুধু সন্ধ্যের পর মিহিরবাবু তাঁর দোকানে এসে বসে; তাস পেটায় আর গল্প করে। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও হরেনের গলায় ছুরি বসালে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়৷ কী আশ্চর্য! কাজেই বছরে তেরোবার তাঁর গলায় ছুরি বসিয়েই নিজের দায়িত্ব সেরে ফেলতে পারেন মিহিরবাবু। সে রক্ত এতটাই তাজা যে পুরোহিতরাও সন্দেহ করেনি কোনওদিন৷

কিন্তু প্রতিবার খুন হওয়ার মুখে মিহিরবাবু বিশ্বাসঘাতকতায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন হরেন।  আর প্রতিবারই পরের দিন সকালে সমস্ত ভুলে গিয়ে চায়ের দোকানের পরিত্যক্ত গুমটিটায় এসে উদয় হন তিনি। আর তারপর হাসিমুখে সন্ধ্যেবেলা মিহিরবাবুর সঙ্গে তাস খেলতে বসা। 

বহু খুনের অপরাধ থেকে মিহিরবাবুকে মুক্তি দিয়েছেন হরেন৷ তাই আজও সাহস করে সত্যি কথাটা মিহিরবাবু তাঁকে বলে উঠতে পারেননি৷ অবশ্য হরেনকে তিনি সত্যিই স্নেহ করেন, তাঁর প্রতি মিহিরবাবু কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ 

আজও, হরেনের "ওঠো মিহিরদা, রাত হল" ডাক শুনে সস্নেহে ঘুরে তাকিয়েছিলেন তিনি৷ উঠে হরেনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে পকেটে হাত দিয়ে শোধন করা ছুরিটার হাতলে হাত বুলিয়েও নিয়েছিলেন তিনি৷ বছরের তেরো নম্বর খুনটা এ'বার সেরে ফেলতে হবে৷ আজ অমাবস্যা৷

Saturday, February 19, 2022

সুন্দর নার্সারি




দিল্লীর সুন্দর নার্সারি যেমন সবুজ, তেমনই ছিমছাম৷ জানুয়ারির উইকেন্ড-ভিড়েও দেখেছি যে নিজেদের জন্য নিরুপদ্রব, ঘেসো এবং পরিস্কার এলাকা দিব্যি জুটিয়ে নেওয়া যায়৷ আজ একাই দুপুর-দুপুর ঝোল-ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম৷ প্রথমে ভাবলাম নতুন কোনও জায়গায় যাই, তারপর মনে পড়ল সুন্দর নার্সারির কাছাকাছিই রয়েছে নিজামুদ্দিন মার্কেট যে'খানে দিনকয়েক আগেই এসেছিলাম চমৎকার কাবাব খেতে৷ কাজেই নার্সারি ঘুরে সুন্দর কাবাব খেয়ে বাড়ি ফেরার প্ল্যানটাই যুক্তিযুক্ত মনে হল৷ 


প্রথম দিল্লী এসে যখন সুন্দর নার্সারির কথা শুনেছিলাম তখন ভেবেছিলাম  শৌখিন মানুষের ডালিয়া পিটুনিয়া আর ভালো কোয়ালিটির সার কিনবার জায়গা বোধহয়৷ ইতিহাস আর জেনারেল নলেজে কাঁচা হলে যা হয়৷ কিন্তু ভুল ভাঙার জন্য সশরীরে আসার দরকার নেই, গুগল করলেই হল৷ ষোলো শতকে মুঘলরা বানিয়েছিল পেল্লায় আজিম বাগ, সাহেবসুবোদের হাতে এ'খানে নার্সারি তৈরি হল ১৯১৩ নাগাদ৷ বর্তমানে নাকি শ'তিনেক রকমের গাছপালা রয়েছে এ'খানে৷ আমার মত অসবুজ গাম্বাট মানুষের জন্য অবশ্য গাছপালা মূলত চার রকমের; পেল্লায়, মাঝারি,  ছোটখাটো আর ঘাস-জাতিয়৷ কাজেই 'রেয়ার প্ল্যান্টস' দেখে লাফিয়ে ওঠার জ্ঞানগম্যি আমার নেই, যাদের আছে তাদের জন্য সুন্দর নার্সারি আরও উপভোগ্য৷ 


আমার জন্য সুন্দর নার্সারির মূল টান হল ওই সুবিশাল এলাকা, তাও আবার শহরের ঠিক মধ্যিখানে৷ এ বিষয়ে অবশ্য দিল্লীর জবাব নেই৷ লোধি গার্ডেন, সুন্দর নার্সারি ছাড়াও অজস্র এমন জায়গা রয়েছে যে'খানে হাত-পা ছড়িয়ে দিব্যি একটা বেলা কাটানো যায়; ভালোমন্দ খেয়ে, গা এলিয়ে গল্পের বই পড়ে ফেরা যায়৷ ভিড়ের চোটে এক বাড়ির লুচির পাশে অন্য বাড়ির চচ্চড়ি পড়ে যায়না৷  এই সুন্দর নার্সারিতে আর একটা দারুণ ব্যাপার হল কানে দিব্যি ঘণ্টাখানেক স্রেফ হেঁটেও কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে, গোটা ব্যাপারটাই একটা হাইক্লাস 'ওয়াক ইন দ্য পার্ক' আর কী৷


মাঝামধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন মোগলাই স্থাপত্য।  কোনওটাই পেল্লায় নয় তবে সুন্দর, যেমন সুন্দর বুর্জ (সুন্দর নার্সারি এই সুন্দরেই সুন্দর), সুন্দরওলা মহল, লক্কড়ওলা বুর্জ ইত্যাদি৷ সুন্দত বুর্জের সামনে যে সেন্ট্রাল অ্যাক্সিস এবং খানিকটা এগিয়ে যে জলাশয়, সে'সবই অতি চমৎকার৷ আর্কিটেকচার নিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই, তবে অন্য একট বিষয়ে নিজের ভালো লাগা জাহির করতেইব হয়৷ সবচেয়ে সুন্দর নার্সারির মধ্যের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে একটা দুর্দান্ত মিঠে আর মনোগ্রাহী নাম রয়েছে; ছোটা বাতাসেওয়ালা৷ ওই নামে একটা রেলস্টেশন, একটা হিলস্টেশন আর একটা গ্রাম্য মেলাও থাকা উচিৎ৷ এ'ছাড়া রয়েছে প্রচুর ফুল। আর লক্কড়ওলা বুর্জের সামনের গোলাপ বাগানটা অত্যন্ত চমৎকার।


যা হোক৷ সুন্দর নার্সারিতে আমার মূল টান অবশ্য শীতের দুপুরে ঘাসের ওপর চাদর পেতে গা এলিয়ে বসায় (এবং শোওয়ায়)৷ সঙ্গে সামান্য খানাপিনা না থাকলে আসর জমজমাট হয় না৷ গতমাসে যখন সবাই মিলে এসেছিলেম তখন সঙ্গে ছিল তিনকোণা পরোটা, ডিম কষা, কাশ্মিরি আলুর দম, গাজরের হালুয়া আর সি আর পার্ক থেকে কেনা রসের মিষ্টি৷ বিকেলের জন্য কফিও আনা হয়েছিল ফ্লাস্কে, সঙ্গে নিমকিটিমকি৷ 

আজ হুট করে একাই চলে আসায় সে আড়ম্বর বাদ পড়েছে৷ চাদরের বদলে ঘাসের ওপরেই গা এলিয়ে বসতে হয়েছে। তবে ইয়ারফোনে গান ছিল, আর ছিল বই৷ মুখ চালানোর জন্য এক প্যাকেট বাপি চানাচুর এনেছিলাম অবশ্য। দিল্লীতে এখন সেই কড়া ঠাণ্ডা আর নেই, দিব্যি আরামদায়ক দুপুরের রোদ৷ গান, বই সরিয়ে রেখে খানিকক্ষণ ঝিমটিও দেওয়া গেল৷ তরতর করে দুপুর গড়িয়ে গেল৷ সন্ধ্যে নামার আগে হাঁটাহাঁটি করে খিদেটাকে চাগিয়ে তুলতে হবে, নয়ত নিজামুদ্দিনের কাবাব-সাফারিটাই মাটি৷

Wednesday, February 16, 2022

মাল্টিটাস্কিং

মাল্টিটাস্কিং ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত৷ কাজ এগোয় না, শুধু মাল্টিটাস্কিংই চলতে থাকবে৷

সবার কম্পিউটারেই আজকাল বিরাশি সিক্কার র‍্যাম। কেন?
ব্রাউসারে বাহাত্তরখানা ট্যাব খোলা থাকবে,
সতেরোটা এক্সেল, বারোটা ওয়ার্ড ডুকুমেন্টে কাজ চলবে,
পাশাপাশি ইমেল চালাচালি৷
আর সবার ওপরে চলবে জুম মিটিংয়ের 'জী হজৌরি'।

এ'সব দিয়ে কী হবে? হবে মাল্টিটাস্কিং৷ এক কাজ নিয়ে পড়ে থাকা মানে আধুনিক কর্পোরেট জগতের বিরিয়ানিতে কুমরোর টুকরো হয়ে পড়ে থাকা।

বড়বস চাইবেন রিপোর্ট,
মেজোবস খুঁজবেন ইমেল,
সেজবস দেখবেন পাওয়ারপয়েন্ট,
ছোটবস ডাকবেন মিটিংয়ে,
আর আপনি? আপনার ইএমআই-য়ে ম্যারিনেট করা কপালে রয়েছে 'যে আজ্ঞে' আর মাল্টিটাস্কিং৷

দিনের অর্ধেকটা কেটে যায় এক্সেল থেকে জুমের মধ্যে দৃষ্টি চালাচালি করে,  ইমেল থেকে পাওয়ারপয়েন্টে ফোকাস জাগলিং করে, আর ফোনে খেজুর চালাতে চালাতে মেমো পড়ে৷ ওইটুকু পথ চলাতেই আনন্দ। শ্বাস ফেলতে না পারার মধ্যেই উত্তরণ সুপার এফিশিয়েন্ট কর্পোরেট সৈন্যদের। তারা লাঞ্চ সারবে কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে। তারা মুখ খুললেই বুলেট পয়েন্ট ছিটকে বেরোবে। তাদের টু-ডু লিস্ট সাইজে নভেলদের টেক্কা দেবে। তাদের ডেস্কটপের পাশেই জ্বলজ্বল করে মারকাটারি মোটিভেশনাল বই আর তার পাশেই ছড়িয়ে শতসহস্র স্টিকিনোট; 'ইয়ে করেঙ্গে', 'উয়ো করেঙ্গে' ইত্যাদি৷ 

এতসব করে কী বেরোয়?

অন্তঃসারশূন্য রিপোর্ট,
কেঠো গতে বাঁধা অ্যানালিসিস,
আর বাতেলা পাওয়ারপয়েন্ট।  
ও'দিকে "এক্সেলেন্স' শব্দটা বিভিন্ন অফিস পোস্টারে দোল-দোল-দুলুনি মোডে সেঁটে থাকে৷

কিন্তু কোন ব্যাপারটা সঠিক ভাবে চলতে থাকে?
মাল্টিটাস্কিং৷ 

কারুর "কী খবর ভাইটি" বলতে পারার সময় থাকা মানেই সে 'আন্ডারইউটিলাইজড'। কেউ তলিয়ে ভাবার সময় পাচ্ছে মানেই সে পাশবালিস৷ 

যার কানে ল্যান্ডলাইন রিসিভার, এক হাত কীবোর্ডে, অন্য হাত মোবাইলে, আর চোখ কম্পিউটার স্ক্রিনে; সেই ঘ্যাম৷ বাকি সমস্তটাই ফাঁকি৷

Friday, February 11, 2022

পুলিন আর সমুদ্র



পুলিন ছিলেন মেজমামার ভক্ত৷ ছেলেবেলায় মামার সঙ্গে কতবার সমুদ্রের ধারে ছুটি কাটাতে গেছেন৷ পুরীর পড়ন্ত বিকেলে মেজমামা সৈকতে এসে দাঁড়াতেন হাঁটু পর্যন্ত পাজামা গুটিয়ে। সমুদ্রের দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়তেন৷ ঢেউয়ের আরামদায়ক আসা-যাওয়ায় গোড়ালি ভিজত বারাবার, নরম হয়ে আসত মন৷ গপ্পিয়ে মানুষটা নিশ্চুপ হয়ে আসতেন, মুখে লেগে থাকত ভালোবাসাবাসির হাসি৷ হাওয়ার ঝাপটার পাশাপাশি ঢেউ ভাঙার শব্দ, ভেজা বালির গন্ধ আর সন্ধ্যের আকাশের রঙ সমস্তটুকুই মেজমামা নিজের মধ্যে শুষে নিতেন৷ সে নাকি এক তপস্যার মত ব্যাপার৷ চল্লিশ বছর আগে পরীক্ষায় বসে কষতে না পারা অঙ্কের সলিউশন মনের মধ্যে উঁকি দেয় সে সময়৷ সতেরো বছর আগে হারিয়ে ফেলা ফাউন্টেন পেনটা আদতে কোথায় ফেলে এসেছিলেন তা ঠিক মনে পড়ে যায়। রীতিমত ম্যাজিক! 

পুলিন নিজে অবশ্য সে ম্যাজিকের তল পেতেন না৷ মেজমামা চলে যাওয়ার পরেও তাঁর স্মৃতির টানে বারবার সমুদ্রের দিকে ঘুরতে গেছেন পুলিন৷  ট্রাউজার গুটিয়ে দাঁড়িয়েছেন সমুদ্রে, পা ভিজিয়েছেন ঢেউয়ে৷ কিন্তু মেজমামার সেই সমুদ্র-নির্বাণ আয়ত্ত করা যায়নি৷ বারবার নিজেকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছে, মানুষ দিনদিন ক্ষুদ্র হয়ে পড়ছে; মনের ফ্লেক্সিবিলিটি কমে আসছে, আত্মার কোয়ালিটি গাম্বাট হয়ে পড়ছে৷ তার আর মেজমামার মত তপস্বী হওয়া হল না৷ মেজমামার মামা নিশ্চয়ই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে লেভিটেট করতে পারতেন৷ তাই হবে হয়ত।  ধান্দাবাজি বাড়ছে আর মানুষের মানুষেমি কমে আসছে৷ এই থাম্বরুলটাই নিজেকে বারবার বোঝাতেন পুলিন৷

কিন্তু সেই ভুল ভাঙলো আলিসাহেবের এই আড়ম্বরহীন মাংস-রুটি-কাবাবের দোকানটির খোঁজ পেয়ে৷ প্রতি শনিবার এ দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে মাংস রুটি আর অল্প কাবাব খেয়ে রাতের খাওয়া সারেন পুলিন৷ কিন্তু এ দোকানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শনিবার রাতের মাখোমাখো রোম্যান্সের চেয়েও অনেক বেশি নিবিড়৷ চাকরীর টানে এই দূর-শহরে ঠাঁই খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই আলিসাহেব তার বন্ধু৷ আলি সাহেব কবিতা আর ইতিহাস ভালোবাসা মানুষ, কাবাব-মাংসরুটিতে তাকে বাঁধা যাবে না৷ পুলিনের পেট তেমন মজবুত নয়, হপ্তায় একদিনের বেশি মোগলাই খানা তার সয়না৷ কিন্তু হপ্তায় বার-তিনেক; সন্ধ্যের পর আলিসাহেবকে সেলাম না ঠুকলে তাঁর চলেনা৷ এক কাপ চা খেতে খেতে আলিসাহেবের শায়েরি আর গল্প শোনা। গপ্প সেরে আলিসাহেব ফিরে যান খদ্দের সামলাতে৷ 

ঠিক তারপর, কিছুটা দূরে সরে গিয়ে খানিকক্ষণের জন্য পুলিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন আলিসাহেবের মাংসের কড়াইয়ের দিকে৷ আলিসাহেবের আত্মমগ্নতা, খদ্দেরদের হইহই, মোগলাই ঝোলের সুবাস, উনুনের তাপ; এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে যে অ্যালকেমি, সে'টা পুলিনকে জাপটে ধরে৷ সে মুহূর্তে পুলিন টের পান বুকের মধ্যে যেন অজস্র জানালা খুলছে, বিভিন্ন মনকাড়া সুর তৈরি হচ্ছে৷ মনকেমন করা সব অচেনা সুর৷ অথচ বাথরুমের আবডালেও পুলিনের গলা দিয়ে গান বেরোয় না৷ আস্তে আস্তে মাথায় ঝিম লাগে পুলিনের, টের পান পায়ে ঢেউ এসে ঠেকছে, পায়ের নীচে ফুটপাথের বদলে নরম বালি৷ মনে পড়ে মেজমামার গায়ে লেগে থাকা পরিচিত গন্ধটা; খবরের কাগজ আর সিগারেট মেশানো৷ মনের পড়ে মা দুপুরবেলা উপুড় হয়ে বই পড়ছে, আর বছর পাঁচেকের একটা চঞ্চল ছেলে মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে মাথায় পাগড়ি বাঁধার চেষ্টা করছে৷ 

এমনই এক সন্ধ্যেয় ব্যাপারটা হুশ করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল পুলিনের কাছে৷ আরে, মেজমামার সমুদ্র-ম্যাজিকের তল পাওয়া গেছে যে৷ সবার সমুদ্দুর তো বে অফ বেঙ্গলে পড়ে নেই৷ নিজের সমুদ্র নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। আর সে খোঁজ একবার পেলেই কেল্লা ফতে!

থ্রিল

- ভুতো৷ চ'৷ একটু হাওয়া খেয়ে আসি৷

- এখন পারব না মামা।

- আরে চ' না৷ ডিমরুটি খাওয়াবো। 

- ধুস।

- চিকেন রোল?

- আমি ব্যস্ত।

- রাস্কেল ছেলে! সামনের বোর্ডের পরীক্ষা আর তুই বসে মোবাইলে গেম খেলছিস৷ কচু ব্যাস্ত!

- গেমিংয়ের থ্রিল তুমি বুঝবে না মামা৷ বয়স হয়েছে তো৷ তু মি হাওয়া খেয়ে এসো৷ 

- থ্রিলের তুই কী বুঝিস রে?

- আরে মামা। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ পাশ কাটিয়ে টার্গেটের দিকে এগিয়ে যাওয়া৷ পদে পদে খুনোখুনির আশাঙ্কা৷ ডায়ে গেলে গাড়িচাপা, বাঁয়ে ক্লিক করলে অতল খাদ৷ সামনে স্নাইপার, পিছনে ড্র‍্যাগন৷ এই হল আলটিমেট থ্রিল৷ 

- ওহ৷ বুঝেছি৷ 

- কী বুঝেছ মামা?

- তুই বেসিক্যালি আইআরসিটিসিতে টিকিট বুক করছিস৷

Wednesday, February 9, 2022

নিরুপম আর ব্রেকিং নিউজ



বাসের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসেছিলেন নিরুপম৷ দুপুরে জব্বর বৃষ্টি হয়েছিল, তাই সন্ধ্যের হাওয়ায় একটা দিব্যি ফুরফুরে ছিল। সে হাওয়া উপভোগ করতে করতে ভুলভাল লিরিক্স আর গোলমেলে সুরে ডাকটেলসের হিন্দী টাইটেল সং গুনগুন করছিলেন তিনি৷ 
"জিন্দেগী তুফানি হ্যায়, যঁহা হ্যায়, ডাকটেলস"৷ 

দুনিয়াটা সত্যিই রঙিন৷ 

এমন সময় কাঁধে টোকা৷

- শুনুন৷

- আমায় বলছেন?

- আপনার গায়ে টোকা মেরে অন্যকে কিছু বলতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

- টিকিট কেটেছি৷ এই যে৷

- আমার কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে? আঙুলের ফাঁকে খুচরো আছে? কথায় হাইস্পীড আছে?

- না। 

- কাজেই আমি কন্ডাক্টর নই। দরকারটা অন্য। এবং জরুরী। 

- কী ব্যাপার বলুন তো..আর আপনি কে?

- আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী।  এ'বার যা বলছি শুনুন মন দিয়ে। এই যে গান গাইছেন..।

- সরি...খুব লাউডলি গেয়ে ফেলেছি কি? কিছু মনে করবেন না ভাই..। জানি, আমার সুরতাল বোধ কিঞ্চিৎ গোলমেলে, গলা ছেড়ে গাইলে একটা সোশ্যাল আনরেস্ট তৈরি হওয়াটা আশ্চর্য নয়..। আসলে আজ হাওয়াটা এমন স্যুইট..বুঝলেন..যে একটা আমেজ..।

- না। লাউডনেস নিয়ে অসুবিধে নেই।

- ও মা। তবে?

- ও গান আপনি গাইবেন না।

- আজ্ঞে?

- গাইবেন না৷ ট্রেনেবাসে তো নয়ই৷ বাথরুমেও নয়৷ নিজের মনে মনেও নয়।

- কিন্তু কেন?

- বিদেশি কার্টুন সিরিজের গান ধরেছেন৷ তা'তে আমাদের সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

- ইয়ে, ইয়ার্কি করছেন? হা হা হা...আচ্ছা গায়ে পড়া উজবুক তো মশাই আপনি..। হে হে হে..।

- এ'টা কী দেখেছেন?

- রিভলভার! আপনি আচ্ছা উন্মাদ তো..। আর সবাই দেখুন কাণ্ড..।

- বাসের কেউই আপনার এ অসভ্যতা বরদাস্ত করবে না৷ সবাই চায় আপনাকে টাইট দিতে। 

- আরে এ'টা একটা কার্টুন সিরিজের গান..কী মুশকিল..ছেলেবেলায় শোনা..।

- দেশ তখন গোল্লায় যাচ্ছিল৷ এখন আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি৷

- আরে গানটা হিন্দীতেই..।

- কার্টুনটা ম্লেচ্ছ৷ কই, বিক্রম বেতালের টাইটেল সং তো গাইলেন না? 

- লে হালুয়া৷

**

- নিরুপম সাঁতরার বাড়ি?

- হ্যাঁ। আমি ওর বাবা৷ অমল সাঁতরা৷ কী ব্যাপার? পু..পুলিশ কেন?

- আপনার বাড়ির তল্লাশি হবে। এই যে ওয়ারেন্ট!

- সে কী! কিন্তু..খোকা বাড়ি ফেরেনি এখনও..কী ব্যাপার আগে বলুন..।

- ফিরবেনও না। উনি আপাতত আমাদের হেফাজতে৷ সরে যান।

- খোকা গ্রেপ্তার হয়েছে? সে কী! 

- দেশবিরোধী গান গেয়ে বেড়াচ্ছে আপনার খোকা। সেসেশনিস্ট কন্সপিরেসি কপচে লোক খেপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ গভর্নমেন্ট ফেলবার তাল করছে৷ 

- সে কী! 

- সরে যান৷ আমাদের কাজ করতে দিন৷

(আধঘণ্টা পর)

- অমলবাবু, আপনাকে আর আপনার স্ত্রীকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে৷ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।

- ব্যাপারটা কী আমি তো কিছুই..।

- আপনার বাড়িতে দু'টো ডোনাল্ড ডাকের পোস্টার আর একটা মিকি মাউসের ছবিওলা বেডশিট পাওয়া গেছে৷ আসুন আমাদের সঙ্গে..।

**

ব্রেকিং নিউজ। ব্রেকিং নিউজ৷ ব্রেকিং নিউজ৷ 

আজ সন্ধ্যেবেলা, 

শেয়ালদার কাছে এক মিনিবাস থেকে এক বিদেশী মদতপুষ্ট জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ জঙ্গিটির নিজের পরিচয় নিরুপম সাঁতরা জানালেও পুলিশের বড়কর্তা জানিয়েছেন যে সে পরিচয়টা নির্ঘাৎ ভুঁয়ো।

রাতের দিকে, পুলিশ সেই জঙ্গির আস্তানায় হানা দিয়ে বেশ কিছু অবৈধ এবং বিপজ্জনক নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে। পুলিশ এ বিষয়ে সমস্ত খোলসা না করলেও এক বিশেষ সূত্রের মারফৎ আমরা জানতে পেরেছি যে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আর বিস্ফোরকও নাকি উদ্ধার করে হয়েছে জঙ্গিদের ডেরা থেকে৷ গ্রেপ্তার করা হয় জঙ্গিটির আরও দুই শাগরেদকে৷ 

সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে গ্রেপ্তার হওয়া তিন ব্যক্তিই কোনও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আর শহরে কোনও বড়সড় গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছিল তারা৷ 

বিস্তারিত জানতে হলে সঙ্গে থাকুন৷ ফিরে আসছি একটা ছোট কমার্শিয়াল ব্রেকের পরেই..। 

Tuesday, February 8, 2022

বাতেলা রকেট



দড়াম করে মিথ্যে বলে দিলেই তো হল না৷

"হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা" কেত চাই৷ 
কথায় কথায় "আর একটু হলেই এস্পারওস্পার করে দিচ্ছিলাম" গোছের ঘ্যাম চাই৷ 
ভরদুপুরে 'এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো' গাইবার ধক থাকা চাই৷ 

আর চাই একদল মানুষ, যারা কথায় কথায় বলবে "ওয়াহ তাজ"! 

গুলশ্রেষ্ঠ বলবেন, "এভারেস্টের মাথায় উঠেছিলাম ভিজে গামছা মেলতে"। অমনি জি-হুজুরের দল চিল্লিয়ে উঠবে, " উফ, কী দিয়েছেন৷ আপনার কাছে কী এভারেস্ট আর কীই বা বেহালা"।

ক্যাপ্টেন বারফাট্টাই বলবেন, "খেলতে নেমে চাইলেই বারো গোলে জিততে পারতাম। কিন্তু গোল না দিয়ে তিনটে খেলাম কেন? ওই৷ তুলোর মত মন৷  আমি গোল দিলে যদি কেউ দুঃখ পায়? তাই...চেপে গেলাম। দয়ার শরীর হলে যা হয় আর কী"৷ অমনি 'এইত্তো চাই' জনতা ফ্যাঁচফ্যেঁচিয়ে উঠবে, "কী ভাবে পারেন এমন ভাবে কাঁদাতে৷ কী ভাবে পারেন বুকের মধ্যে রাখা একদলা মাখনে এমন অবলীলায় স্নেহের ছুরি চালাতে"। 

বাতেলা-রকেট বলবেন, " মানছি আজ আপনাদের পকেট কেটেছি৷ মানছি আজ আপনাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙেছি৷ মানছি আজ আপনাদের পাতে বেড়ে রাখা ভাত ছাইপোস্ত দিয়ে মেখেছি৷ তবে শুনে রাখুন, এর ফলে আজ থেকে বাইশ হাজার বছর পর আপনার যা উপকার হবে না..তা জাস্ট ভাবাই যায়না৷ সে এক ফ্যান্টাসটিক ইয়ে৷ এক্কেবারে হাইক্লাস ঘ্যাম যাকে বলে৷ আজ একটুস এ'দিক ও'দিক করে ফেলছি বটে, কিন্তু সে তো আপনাদেরই মঙ্গলের জন্য"৷ এ আশ্বাসবাণী শোনা মাত্র 'টীম বহুত খুব' গেয়ে উঠবে, "আমাদের প্রাণ, মান, ইজ্জত এবং ভোট; শুধুই আপনার৷ শুধুই আপনার"।

Monday, February 7, 2022

আহ্! মিউজিক!



কী বিদঘুটে স্বপ্ন রে বাপ! শীতের রাতের জবরদস্ত ঘুম গেল বিশ্রীভাবে চটকে৷ তবে ঘুম ভাঙলই যখন, তখন লিখেই রাখি। কী দেখলাম স্বপ্নে?

একটা সুপরিচিত পেল্লায় হলঘর৷ অবিকল যেন কফিহাউসের মত, এমন কি রবীন্দ্রনাথের ঢাউস ছবিটাও দিব্যি দেওয়াল আলো করে রয়েছে৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে'ছবিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, পায়চারি করছেন। ফ্রেম থেকে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে যাচ্ছেন আবার ফেরত আসছেন৷ যাচ্ছেন, আসছেন, যাচ্ছেন, আসছেন৷ আর মাঝেমধ্যেই ফ্রেমের বাইরে কার দিকে যেন তাকিয়ে স্মিত হাসছেন। 

চেয়ারগুলো টেবিলগুলো সবই ফাঁকা, খিটখিটে ওয়েটারদাদাদেরও দেখা নেই৷ শুধু বিদঘুটে জোব্বা গায়ে চাপিয়ে এক দাড়িয়াল সাহেবসুবো মানুষ রবীন্দ্রনাথের ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে, টেনিস ম্যাচ দেখার মত রবীন্দ্রনাথের পায়চারি দেখে চলছেন তিনি। ভদ্রলোকের মুখে একটা মিঠে আনন্দের ছাপ, আর চোখে একটা মজাদার ঝিলিক৷ রবীন্দ্রনাথও মাঝেমধ্যে পায়চারি থামিয়ে তাঁর দিকে চেয়েই হাসছেন।

বেশ খানিকক্ষণ পায়চারির পর ফ্রেমের মধ্যেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বসলেন৷ ফ্রেমের বাইরে হলঘরে দাঁড়ানো সেই সাহেব দাড়িয়ালও এ'বার একটা কফিহাউসিও চেয়ার টেনে বসে মুখে লেবুলজেন্সের মত কিছু একটা দিলেন৷ 

রবীন্দ্রনাথই কথা বলে উঠলেন।

- গরীব বাঙালির কথা বাসি করে মনে ধরালে ভাই ডাম্বলডোর?

- গুরুদেব, আপনার কথা আমি পাত্তা দেব না? আমার ঘাড়ে অতগুলো মাথা নেই, পায়ে অতগুলো মোজাও নেই৷ তবে আমাদের কিনা আঠারো মাসে বছ্র, তাই সিলেবাস পাল্টাতে কিছুটা দেরী হয়ে গেল৷ যাক গে, এখন ব্যবস্থা পাকা৷ আর তাই খবরটা আপনাকে দিতে আসা৷ 

- তুমি নিশ্চিত তো?

- হ্যাঁ। হগওয়ার্টসের ছেলেমেয়েরা এ জাদু না শিখলে সমস্তই মাটি৷ 

- যাক৷ তোমার স্কুলের সিলেবাসে এদ্দিনে তা'হলে সঙ্গীত ঠাঁই পেল৷ স্টাডি অফ মিউজিক..বাহ্ বাহ্। 

- গুরুদেব৷ নামটা একটু নিজেদের মত সাজিয়ে নিয়েছি৷ স্টাডি অফ মিউজিক নয়৷ স্টাডি অফ ব্রাইট আর্টস৷ 

- কিন্তু, সে কি আর পারবে সে তোমার স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়াতে? দেরী করে ফেললে ভাই আলবাস৷ 

- কাথবার্ট দিব্যি পেরেছে মরার পরেও ক্লাস নিতে। আর ম্যাজিকের হিসেবে লতা তো অনেক এগিয়ে৷ ও নিয়ে ভাববেন না৷ মাগলরা তাকে যতই ভালোবাসুক, তার আসল কদর কিন্তু হগওয়ার্টসেই হবে।

- বেশ৷ মঙ্গল হোক৷ তুমি নিশ্চিত হলেই হল। 

- গুরুদেব,হগওয়ার্টস আজ একধাপ এগিয়ে গেল৷ 

- এগোবেই তো৷ কতবছর আগে, হগওয়ার্টসে বসে সুরে ঘায়েল হয়ে তুমিই তো  বলেছিলে ভাই, "Ah Music, A Magic Beyond All We Do Here"।

Sunday, February 6, 2022

বিপজ্জনক



রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে শ্যামলের দোকানে দাঁড়িয়ে এককাপ চা আর দু'টো বিস্কুট খাই৷ অফিস না থাকলেও সন্ধ্যের এই সময়টা এ'দিকে ঢুঁ মেরে যাই৷ কোনও যে ইয়ারদোস্তদের আড্ডার টানে আসি তাও নয়। আমি একা মানুষ, বেশি গল্পগুজবে সবিশেষ স্বস্তিও পাই না৷
শ্যামলের চা আহামরি না হলেও সে'টার মধ্যের কড়া ব্যাপারটা আমার পছন্দ, আর ওই অস্পষ্ট একটা কয়লামাখানো সুবাসটাও বেশ৷ আমার মতই, শ্যামলও বেশি কথার মানুষ নয়৷ তবে আমি অলস, শ্যামল কর্মঠ; সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ চায়ের সসপ্যান বসাচ্ছে, মামলেট ভাজছে, হিসেব লিখছে, খদ্দেরের খেজুর সামাল দিচ্ছে - নিঃশব্দে, হাসিমুখে। এক মুহূর্তের জন্যও সে জিরোচ্ছে না৷
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি শ্যামলের দোকানের উলটো দিকের পেল্লায় আধভাঙ্গা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকি৷ প্রতিদিন, বহুবছর ধরে এ' নিয়মে আমি অভ্যস্ত৷ ব্যাপারটা অনেকটা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার মত৷ বাড়িটা গায়ে একটা মার্বেল ফলক আছে; সে'টাও খানিকটা ভাঙা৷ তা'তে লেখা "স্থাপিত ঃ ১৮৬-"। ফলকের খানিকটা খসে পড়ায় শেষ সংখ্যাটা বোঝা যায় না৷ তবে ওই, অন্তত দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো৷ ফলকের পাশেই একটা বোর্ড লাগানো, সে'টা কর্পোরেশজ থেকে টাঙিয়ে গেছেঃ "বিপজ্জনক বাড়ি! সাবধান! নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন"৷ সেই বোর্ডটার বয়সও অন্তত বছর কুড়ি তো হবেই, রঙ চটেছে, টিন গেছে তুবড়ে৷ কী একটা বিশ্রী মামলার পাকে পড়ে থাকায় ও বাড়ি ভেঙে ফেলার ব্যবস্থাও হয়নি৷
বছর চল্লিশ আগে দুই যুযুধান পরিবার এখানে বাস করত। দিনের বেলা আদালতে গিয়ে দুই পরিবারের বাবুরা বচসা চালাতেন নিজেদের উকিল লেলিয়ে দিয়ে। দুপুরে গৃহিণীরা ঝগড়া জমাতেন ছাতে৷ সন্ধ্যেবেলা বাড়ির উঠোনে দুই পরিবারের বখাটে ছেলেপিলেরা অশ্রাব্য ভাষায় সে ঝগড়া টেনে নিয়ে যেত, মাঝেমধ্যে ব্যপারটা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াত৷ আর মাঝেরাত্রে, উঠোনে মাদুর পেতে দুই পরিবারের মাথা, অশীতিপর দু'ই বৃদ্ধ একসঙ্গে বসে নেশাভাং করতেন আর দাবা খেলতেন৷
এ'সব অবশ্য সবই আমার শোনা গল্প৷ চাকরির সুবাদে আমি এ পাড়ায় এসেছি বছর দশেক হল৷ আমি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন শব্দ শোনার চেষ্টা করি৷ কতরকমের কণ্ঠস্বর, কান্না, ঝগড়া, আদর, উৎসবের কলরোল৷ ব্যাপারটা অনেকটা সমুদ্রের ঢেউ গোনার মত আরামদায়ক৷ মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই বিশাল বাড়িটা যেন পাড়ার কারুরই আর চোখে পড়েনা৷ খানিকটা আমারই মত। চায়ের দাম আদায় না করতে হলে কি শ্যামলও আমায় দেখতে পেত? রাস্তায় যাতায়াতের পথে কেউই বাড়িটার দিকে তাকিয়েও দেখেনা বোধ হয়৷ অমন পাহাড়প্রমাণ একটা উপস্থিতিকেও অগ্রাহ্য করা যায় তা'হলে৷
কিন্তু আমি কিন্তু দেখি বাড়িটাকে। রোজ৷ অবাক হয়ে৷ মনে হয়, ভাগ্যিস মামলাটা মিটমাট হয়নি৷ নয়তো কবেই ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে যেত৷ অবশ্য ফ্ল্যাটবাড়িকে গালমন্দ করার মানুষ আমি নই, আমার নিজের আস্তানাটুকুও একটি ঘুপচি ফ্ল্যাটই৷ কিন্তু এই বিপজ্জনক বাড়িটা গায়েব না হলেই ভালো৷
প্রথম দিকে, যখন আমি পাড়ায় নতুন এসেছিলাম, এই শ্যামলের দোকানেই মাঝেমধ্যে কেউ কেউ যেচে আলাপ জমাতে আসতেন৷ ওই গতানুগতিক সব প্রশ্ন, "পাড়ায় নতুন নাকি", "কোন বাড়িতে উঠেছেন", " কী করা হয়" বা "ম্যারেড তো"। আমি ঠিক সে'সব আগ্রহ সামাল দিতে পারতাম না।
ভাঙাচোরা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝেমধ্যেই মনে হয়, আমিও যদি গলায় অমনই একটা জমকালো বোর্ড টাঙিয়ে রাখতে পারতাম;
"বিপজ্জনক! সাবধান! নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন"।

দাওয়াই



অফিস ফেরত ক্লান্তি উড়িয়ে দেওয়ার ওষুধ - গলা ছেড়ে গান আর জোরদার স্নান। 

'কদ্দিন বাড়ি যাওয়া হয়না' মার্কা মনখারাপের দাওয়াই - সঞ্জীবের পাতা উলটে চোখ ছলছলে হে-হে আর দেবনাথে সেঁধিয়ে আইকস।

'কিস্যু ভালো লাগছে না' কাটানোর টোটকা - ইয়ারদোস্তকে পাঠানো 'কী রে শালা' টেক্সট আর মামলেট ভাজার তোড়জোড়।

সব গোলমাল হয়ে যাওয়ার ভয় সামাল দেওয়ার মন্ত্র - ইলিশ আসছে, তারপর পুজোর ছুটি, তারপর নলেন। 

হাতের হারিকেন ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা চেপে দেওয়ার ফর্মুলা - মায়ের কানের কাছে অদরকারী ঘ্যানঘ্যান, বাবার পিছনপিছন ভিজে বেড়াল মার্কা ঘুরঘুর।



Tuesday, February 1, 2022

দেবু দত্তর মানিব্যাগ



শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছাকাছি পরেশের রুটি-ঘুগনির স্টলে মৌজ করে পেটাই পরোটা পেটাবার তাল করে দোকানের বেঞ্চিতে এসে বসেছিলাম৷ এমন সময় সিরিয়াল কিলার দেবু দত্ত পাশে এসে বসে দু'স্লাইস পাউরুটি, চারটে ডিমসেদ্ধ আর দেড় বাটি ঘুগনির অর্ডার দিলে। আমার চোয়াল গেল ঝুলে, আরিব্বাস। আজ কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম! 

যে' দেবু দত্তকে লালবাজার ইন্টারপোল সবাই হন্যে হয়ে খুঁজছে, সে কিনা আমার পাশে বসে ঘুগনিতে পাউরুটি ডুবিয়ে খাবে? অবিশ্বাস্য যে। সোজাসুজি তাকানোর আদেখলামোটা আমার না-পসন্দ, কিন্তু উত্তেজনা সামাল দেওয়া দায়৷ দেবু দত্তকে চিনতে পারা মামুলি ব্যাপার নয়। এই যেমন আজ খয়েরি প্যান্ট আর গোলাপি চেক হাফশার্ট পরে বসে আছে, থুতনিতে কাটা দাগ, কাঁচাপাকা পেল্লায় গোঁফ, নাদুস-নুদুস চেহারা, মাথা আলো করা টাক, গালে অমায়িক হাসি; হয়ত পরিচয়  জিজ্ঞেস করলেই জানান দেবে যে সে নাকি বঙ্কুবিহারি বয়েজ হাইস্কুলের ভূগোল শিক্ষক হরেন মল্লিক। অথচ আগামীকালই হয়ত ভদ্রলোককে দেখা যাবে হাইকোর্ট চত্ত্বরে; তালপাতার সেপাইয়ের মত হাড়গিলে চেহারা। স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে ডাব বিক্রি করছেন; শশব্যস্ত উকিল আর উদ্ভ্রান্ত মক্কেলরা তার খদ্দের৷ 

কিন্তু আমি তো আর পুলিশ বা গোয়েন্দা নই, দেবু দত্তের ফাঁকিতে নিয়মিত পা দিয়ে আমার মাইনে জোটেনা৷ আমি কলকাতার সেরা পকেটমার। বিরানব্বুইয়ে বারুইপুরে দ্য গ্রেট ভোলা সান্যাল ট্রেনে কাটা যাওয়ার পর পকেটকাটার শিল্পে সেরা আমিই৷ এখন বয়স হয়েছে বটে, তা'বলে চোখের ধার কমেনি। দেবু দত্তের ডান কবজির কাছে আড়াই ইঞ্চির কাটা ঘাটা আমি বিলক্ষণ চিনি, ভেক ধরে এ'শর্মাকে টুপি পরানো সম্ভব নয়।

এসো চাঁদু দেবু, এ'বার শখ পূর্ণ করি। কোন শখ? বলি৷ জীবনে কম পকেট কাটিনি বুঝলেন৷ পলিটিকাল নেতা, ফিল্মস্টার, ক্রিকেটার...সেরা মানুষজনের পকেট চিরেছি ব্লেডের পালক বুলিয়ে।  বলাই বাহুল্য, কখনও ধরা পড়িনি। আর বহুদিন এ লাইনে হল, আখের গুছিয়ে নেওয়া গেছে দিব্যি৷ এখন আর টাকাপয়সার জন্য পকেট কাটিনা৷ স্রেফ শিল্পের জন্যই শিল্পী শুধু। তা এই গোটা শহরে আর মাত্র একজনই শিল্পী আছে যে শুধু শিল্পের জন্য নিজের জীবন উজাড় করে দিয়েছেন; ওই সিরিয়াল কিলার দেবু দত্ত। বেয়াল্লিশটা হাড়হিম করা মার্ডার অথচ সমস্ত ফেলু-ব্যোমকেশ মিলে তার তল পেলো না৷ আমি ঠিক করেছি যে দেবু দত্তের পকেট মেরেই আমি পকেটমারির ব্র‍্যাডম্যানত্ব স্পর্শ করব।  

আজ হাতের কাছেই দেবু দত্তকে পেয়ে মন চলকে উঠেছে৷ চুলোয় যাক পেটাই পরোটা, দেবু দত্তের পকেট আজ ফাঁক না করলেই নয়৷ 

***

দেবুর পকেটস্থ মানিব্যাগ ছোট্ট একটুকরো মেঘের মত তুলে নিয়ে পরেশের দোকান থেকে নিঃশব্দে সরে পড়লাম৷ হাঁফ ছেড়েছিলাম এক্কেবারে শেয়ালদার কাছে এসে। স্টেশনের কাছে একটু ছায়া খুঁজে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে বের করলাম দেবু দত্তর সেই মানিব্যাগ৷ কালো চামড়ার অতি সাদামাটা মানিব্যাগ৷ টাকাপয়সার দরকার আমার নেই, তবু ডিসিপ্লিনের খাতিরে সে মানিব্যাগ ঘেঁটে দেখা দরকার৷ 

কী আশ্চর্য৷ মানিব্যাগের ভিতরে একটাও টাকা নেই। কোনও প্রসাদী ফুল, পাসপোর্ট সাইজ ফটো, পুরনো বাসের টিকিট, বা কোনও ডেবিট কার্ডও নেই৷ আছে শুধু একটা চিরকুট৷ আর সে চিরকুট পড়া শুরু করার পর চারপাশে দুনিয়াটা কেমন বিশ্রী ঘোলাটে আর অস্পষ্ট হয়ে পড়ল।

**

ভাই রবি,

ঘাট হয়েছে তোমায় খুন করে। দু'একপিস আমার হাতে খুন হওয়া আত্মা যে আমায় আওয়াজ দিয়ে চমকায়নি তা নয়। কিন্তু তোমার মত এমন ঠ্যাঁটা পিস আর একটিও দেখিনি৷ আরে বাবা, তোমায় খুন করেছি স্রেফ শিল্পের খাতিরে৷ সেলিব্রেটি খুন করে করে হেঁদিয়ে গেছিলাম।  তাঁরা স্রেফ তারকা, টাকা আর চটকের টানে শিল্পকে ত্যাগ করেছেন বহুদিন৷ বড় নিষ্প্রাণ তাঁর৷ মড়াদের কুপিয়ে কী হবে৷ অথচ গোটা শহরে মনের মত শিল্পী পাচ্ছিলাম না আমার সিরিয়াল লিস্টে জুড়ে দেওয়ার জন্য৷ 

অবশেষে খোঁজ পেলাম তোমার৷ মুগ্ধও হলাম তোমার শিল্পীসত্তার পরিচয় পেয়ে৷ আর কী আশ্চর্য,  তুমিও চাইছিলে আমার পকেট মেরে আর্টিস্টিক কেল্লা ফতে করতে৷ ব্যাস, শুরু হল  সিরিয়াল কিলার দেবু দত্ত বনাম পকেটমার রবি মাইতির লড়াই৷ বছরের পর বছর দু'জনে দু'জনকে খুঁজে কাটিয়ে দিলাম। 

কিন্তু ভায়া, যখন দেখা পেলাম; তখন কিন্তু তোমাকেই হার মানতে হয়েছিল। এক চাক্কুতে এস্পারওস্পার; রবি পকেটমার৷ ইয়ে, তুমিও বাঘের বাচ্চা বটে, চুপচাপ খতম করা যায়নি তোমায়৷  আমার ডান হাতের কবজির ওপরে ওই যে লম্বা কাটা দাগটা, ও'টা যে তোমার ব্লেডেরই দান ভাই৷ মরার আগে তোমার শেষ কামড়।

কিন্তু তারপর ভূত হয়ে আমার পিছুপিছু ঘুরে এমন হয়রান করবে, সে'টা তো আগে ভেবে দেখিনি ভাই৷ যে'খানেই যাই তুমি ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়ে যাও৷ মহাঝ্যামেলা৷ 

শোনো, এই আমি তোমায় আমার মানিব্যাগ তোলার সুযোগ দিলাম। আর এ চিঠি পড়ছ মানে এ'বার তো তোমার শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছে৷ আর কেন ভাই৷ এ'বার এসো৷ 

ভালো থেকো।

ইতি,

দেবু দত্ত৷