Wednesday, March 30, 2016

কন্সটিটিউশনাল

- প্রাইম মিনিস্টার। 
- ইয়েস বাবু!
- ওয়েল ডান। 
- ইউ আর কাইন্ড অ্যাস ইউসুয়াল।
- উই উইল মিস্‌ ইউ। 
- জানি। আমিও মিস্‌ করব। তোমাদের। এই অফিসটা। এই টেবিল। রোজ সন্ধ্যাবেলা বিজেন্দরের  প্যান্ট্রি থেকে আসা পকোড়া। 
- এই অফিস,টেবিল,পকোড়ার বাইরেও আপনি অনেকটা জুড়ে ছিলেন প্রাইম মিনিস্টার। ইউ লেড আ কান্ট্রি। 
- আই হ্যাভ নেভার বিন আ লিডার। 
- দ্যাট্‌স হোয়াট হেল্প্‌ড ইউ টু লিড ওয়েল। 
- আহ্‌ বাবু! আই উইল মিস ইওর পিঠ চাপড়ানি।
-  নিন। পকোড়া চলে এসেছে। 
- বিজেন্দরের মত যদি পাংচুয়াল হতে পারতাম বাবু। 
- ইউ হ্যাভ নেভার বিন আবাউট সিস্টেম পিএম। হলে এ সাফল্য আসত না। 
- সাফল্য? হবে হয়তো। 
- সাফল্য নয়? দেশে মানুষ খুনের সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে অর্ধেক হয়ে গেল। সে'টা সাফল্য নয়?
- আহ্‌! আচ্ছা!
- ল্যান্ডমাইন ব্লাস্ট। মানব বোমা। ছুরি। বন্দুক। গলায় ব্লেড। টুঁটি টিপে দেওয়া। প্রতি মিনিটে কতজন যে খুন হত...। ইউ চেঞ্জড ইট অল। ধর্মের জন্য খুন, ইডিয়লজির জন্য খুন, বদলার জন্য খুন, মজার জন্য খুন, খুনের জন্য খুন। আহ। যন্ত্রণা। আপদ চুকেছে। 
- কে ভেবেছিল বল বাবু যে ক্যানিবালিজ্‌মকে কন্সটিটিউশনাল করে দেওয়ায় দেশে খুনের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম হয়ে যাবে। কে ভেবেছিল?
- দূরদর্শিতা আপনার ছিল পিএম। 
- খাওয়ার জন্যে খুন করতে পারলে অন্য গবেট খুনগুলো বন্ধ হবে। হাঞ্চ ছিল। তবে তা এমন ফলে যাবে ভাবতে পারিনি। 
- পকোড়া ঠাণ্ডা হয়ে যাবে স্যার। আজকেরটা বিজেন্দ্রর স্পেশ্যাল রেসিপি। ফেয়ারওয়েল পকোড়া।
- তা সে এলো না আজ পকোড়ার প্লেট হাতে?
- স্পেশ্যাল পকোড়া প্রাইমমিনিস্টার। মোস্ট স্পেশ্যাল। বিজেন্দ্র আর আসবে না। কাসুন্দি নেবেন?

এন্ড

ইয়ার এন্ড


জানালাটা কচরমচর করছে। ছিটকিনি বিট্রে করল বলে। এই দুপুরেও ঘরটা আবছায়ায়। টেবিল থেকে পেপার ওয়েট নিয়ে খানিক লোফালুফিতে মন শান্ত হল না।

কম্পিউটারের স্ক্রিনসেভারে একটা বেড়াল ক্রমাগত চোখ মেরে চলেছে। রিমাইন্ডার স্লিপগুলো টেবিলে ছড়িয়ে, অযত্নে। এসি আর ফ্যান মিলে ঘাম মোছাতে পারছে না।

অথচ ইয়ার এন্ড প্রেশার তাঁকে স্পর্শ করেনি আদৌ, বরং পিয়ার এন্ড প্রেশার তার রক্ত চাপ দ্বিগুণ করেছে।

"ইহার এন্ড দেখিয়া ছাড়ব", ওথেলো দত্তর ঝোড়া স্বগতোক্তিতে ফড়ফড়িয়ে উঠল টেবিল ক্যালেন্ডারের মার্চের পাতা।


উইকেন্ড

- উইকেন্ড ইজ হিয়ার।
- এ কী রে! আজ মঙ্গল।
- সে কী! আজ শুক্রু নয়?
- সে কী!
- আজ শুক্রু নয়?
- কেন হবে? টিউসডে!
- আজ রামের বোতল বগলে বাড়ি ফেরা নয়?
- এমন ভীমরতি কেন?
- আজ কাল মাটনের দোকানে লাইন নয়?
- চারাপোনা।
- অ্যালার্ম ঘড়ির ব্যাটারি খুলে মোবাইল স্যুইচ অফ করে ঘুমোতে যাওয়ার দরকার নেই আজ?
- বিলকুল নেই।
নিজের মনের বেলুনে নিজের হিসেবের ছুঁচ ফুটিয়ে রাতের ঠাণ্ডা বালিতে এলোমেলো গেলেন ক্রসোবাবু।

মনোজবাবুর তিন

“আই মিস্‌ ইউ” মার্কা মেসেজ্‌ পড়লেই গা গুলোয় মনোজ চ্যাটার্জির। “ধুর শালা” বলে রিপ্লাই করার আগে চানাচুরের বাটিটা কাছে টেনে নেওয়ায় খানিকটা সুস্থ বোধ করলেন তিনি।

**

- শাড়ি চাই। একটা। 
- তাঁত? সিল্ক? নাকি...।
- পুরো লাল না হলেও লালচে। মিনিমাম হলুদ থাকলে বাদ। দাম পনেরোশো থেকে সাড়ে পনেরোশোর মধ্যে। 
- আঠেরোশো থেকে...। 
- পনেরোশো থেকে সাড়ে পনেরোশো।
- প্রায় ওই রেঞ্জেই আর কী!
- প্রায় নয়। ওই রেঞ্জেই। 
- আসলে দোকান ভরা শাড়ি, দেখতেই পাচ্ছেন প্রচুর ভ্যারাইটি!
- আচ্ছা। লাল। সবুজ বা হলুদ চলবে না কোন ভাবেই। দাম পনেরোশো থেকে পনেরশো পঁচিশের মধ্যে। স্ট্রিক্টলি। 
- না মানে...। 
- দোকান ভরা তেমন শাড়ি?
- না। মানে অত স্ট্রিক্টলি দেখলে...।
- অতটাই স্ট্রিক্টলি দেখুন। নয়তো আমি বাদ। 
- পাঁচ মিনিট দিন।
- ছ'মিনিট নিন। কিন্তু ছয় বলে সাত মিনিট নেবেন না। প্লীজ।

*সাড়ে চার মিনিটের মাথায়*
- স্যার। আপনার স্পেসিফিকেশনে মাত্র দু'টো শাড়ি। লালচে। সবুজ, হলুদ একদম নেই। দাম আপনার রেঞ্জে। একটা হচ্ছে তাঁত...।
- স্টপ। কোয়ালিটি কে জানতে চেয়েছে? দু'টোর দাম কত?
- দেখাচ্ছি আপনাকে!
- দেখতে কে চেয়েছে?
- না মানে...। 
- কে চেয়েছে দেখতে?
- ও। না। তাই তো। বলছিলাম একটার দাম ডিসকাউন্ট করে পনেরোশো দশ। অন্যটা এগজ্যাক্টলি পনেরোশো পঁচিশ। 
- পনেরোশো পঁচিশেরটা প্যাক করিয়ে দিন। 
- একবার দেখবেন না?
- দেখতে কে চেয়েছে? 
- পেমেন্টটা কাউন্টারে হবে স্যার।

মনোজ চ্যাটার্জি বছরে একটা শাড়ি কেনেন। কিনতে বাধ্য হন। বিবাহবার্ষিকীর উপহার। প্রতি বছরের মত এবারও বারো মিনিটের কমে শাড়ির দোকান থেকে প্যাকেট হাতে বেরিয়ে এলেন মনোজবাবু। বেরিয়ে মোবাইলের স্টপওয়াচটা বন্ধ করলেন। এগারো মিনিট তেরো সেকেন্ড। গত বারের দশ মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ডের রেকর্ডটা অধরা রয়ে গেল খুচরোর গোলমালে। ধুস্‌।

**
মনোজবাবু ইকুয়ালিটিতে বিশ্বাস করেন। ব্যান্ডেল লোকালে উঠে পাওয়া গেল একটা জানলা অথচ ক্যান্ডিডেট দু'জন; মনোজবাবু আর পাপনকুমার।
অতএব, টস। পাপন বললে টেল, মনোজবাবু বললেন "ইয়েস!!!"।
টসে হেরে পাপনকুমার জানলায় বসার অধিকার হারালে। মনোজবাবু সাত বছরের পুত্র পাপনকে ইকুয়াল অপরচুনিটির শিক্ষা দিতে পেরে তৃপ্ত হয়ে জানালার ফুরফুরে হাওয়ায় মেজাজ ভাসিয়ে দিলেন।

Monday, March 28, 2016

পিচকাই আর আবডাল

পাঁচ নম্বর সিঁড়িটা জলের এক ইঞ্চি নিচে, গোড়ালি ভিজিয়ে দাঁড়ানো যায়। ছয় নম্বর দেখা যায়, সাত আবছা, আটে কালচে সবুজ অস্পষ্টতা।  নয়, দশ, এগারো অন্ধকারে।
পিচকাই বারো ছুঁয়ে ভেসে যেত। শ্যাওলা সবুজ জল চিরে মাঝপুকুরের টলটল। ছপছপ ছপ্পর। ওপারে পানা।
পিচকাই। মায়ের মুখ বসানো, গায়ে ঘাসপুকুর গন্ধের পিচকাই।
এমন একটা বিদঘুটে নাম। তবে আড়াই বছর বয়সে কী আর এমন তালেবর নাম ভাবা যায়? মৃণ্ময়ী?  অনিন্দিতা?
আড়াই বছরের ছোট বোনের নাম তাই পিচকাই।
পিচকাই অল্প বয়সে শাড়ি পরতে পারত। দু'টো বিনুনি ঝুলিয়ে টপাটপ অঙ্কের হিসেব সাবাড় করতে পারত; সে দাদার মত ক্যালকুলাস বেকুব নয়।
অবিকল মায়ের মুখ বসানো। নরম ছায়া। নরম তোষক বালিশে পড়ন্ত দুপুরের রোদ মাখানো সুবাসের পিচকাই।
"দাদা, সার্কাস দেখাতে নিয়ে যাবি?"র পিচকাই।
"দাদা, তুই একটা অখাদ্য"র পিচকাই।
"দাদা, আমি এখনই বিয়ে করব না"র পিচকাই।
এত কিছু করতে না পারার পিচকাই।
মরতে না পারার পিচকাই।
জন্মাতে না পারার পিচকাই।
মায়ের কান্নার পিচকাই।"সে জন্মালে আজ তার বিয়ে দিতে হত"র পিচকাই।
পিচকাইয়ের না থাকার পিচকাই।
মায়ের আবডালে থাকা না-মায়ের পিচকাই।
মনে মনে গেঁথে নেওয়া অবিকল মায়ের মুখ বসানো পিচকাই।

Sunday, March 27, 2016

দুই অনু

অনু ১

- ছাদের গন্ধ। নাকে আছে শ্যামলবাবু?
- কার ছাদ?
- ছোটবেলার। আপনাদের খড়দার বাড়ি। 
- শ্যাওলা। নোনা ধরা ইট। জুঁই মেশানো। অল্প গঙ্গামাটি।
- ক্যাপচা মিলে গেছে। পরলোকে আপনাকে স্বাগত জানাই শ্যামলবাবু।

অনু ২

জানালাদের নাম দেওয়াটা ছিল তার অভ্যাস।

শোয়ার ঘরে মাথার কাছের জানালার নাম আরশি, পায়ের কাছের জানালাটা কমললতা।

পড়ার ঘরের একটাই জানালা; তার নাম বিধুশেখর।

বসবার ঘরের উত্তরের জানালার নাম নিতাই আর পশ্চিমে রয়েছে অমলকান্তি।

অন্যদিকে মিতার নাম পালটে জানালাবৌ করে নেওয়াটা তার সান্ধ্য অভ্যাস।

বাথরুমহর্ষক

বিনয় দত্ত নিজের বাথরুমটাকে বড় ভালোবাসেন।

বারান্দা পেরিয়ে উঠোন, তার উত্তর কোণ।

অ্যাসবেস্টসের ছাদ, টিনের দরজা। দু'টো কল; একটা কর্পোরেশনের টাইম কল, অন্যটা ছাদের সিনটেক্সের ট্যাঙ্ক থেকে সাপ্লাই পায়। এক কোণে একটা চৌবাচ্চা, কর্পোরশনের কলের মুখে লাগানো সবুজ পাইপ বেয়ে জল এসে জমা হয় সেখানে; এতে টুলু পাম্পটায় চাপ কম পড়ে, ইলেক্ট্রিক বিলে সাশ্রয় হয়।

একটা লোহার বালতি, একটা প্লাস্টিকের। একটা অ্যালুমিনিয়ামের মগ। চৌবাচ্চার উলটো দিকের দেওয়ালে প্লাস্টিক ফ্রেমের আয়না ঝোলানো, তার নিচে প্লাস্টকের র‍্যাক। সে র‍্যাকে মার্গো সাবান রাখার সাদা সাবানদানি, ক্লিনিক অল ক্লিয়ার শ্যাম্পু, প্যারাশুট তেল, সাবান ঘষার খোসা আর দাড়ি কামানোর বাক্স।

বিনয় দত্ত মনে মনে বাথরুমটাকে আই সি ইউ বলে ডাকেন; আদর করে।

অফিস ফেরতা রোজ সপাট নিজেকে চালান করে দেন আইসিইউ'র অন্দরে। "মা মা গো, আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না মা"; অক্সিজেন চলে এক টানা। চৌবাচ্চার ঠাণ্ডা জলের স্টেরয়েড। মার্গো সাবানের মর্ফিন। ব্যথা স্তিমিত হয়ে আসে, ভয়ের দানা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।

আধ ঘণ্টা আগের ভয়ার্ত ছোটখাটো জামরুল-নরম মানুষটা বাথরুম থেকে ইস্পাত কঠিন হয়ে বেরিয়ে আসেন। গেরস্থ হয়ে বেরিয়ে আসেন।

বিনয়বাবু পিতা হয়ে বেরিয়ে আসেন।

অন্তরে

- আর ইউ ড্রাঙ্ক?
- নো।
- তাহলে মড়ার মত পড়ে আছ কেন?
- মড়া যখন, জ্যান্ত হয়ে থাকি কী করে?
- ইউ আর স্যুইট। ডেড। অ্যান্ড ড্রাঙ্ক।
- বাট অ্যাট লিস্ট আই অ্যাম ইনসাইড ইউ।
- ইয়েস ইউ আর। স্কাউন্ড্রেল।
- মুখে লাগাম দাও।
- ওঝা ডাকলে পিছনের চামড়া গুটিয়ে নেবে।
- ডাকো না। ডাকো। সুমনা। ওঝা ডাকো।
- ডাকব। বাড়াবাড়ি আর কদ্দিন সহ্য করব। ডাকব।
- তোমার কলজে নেই ডাকার।
- যদি ডাকি? আমি সত্যিই ক্লান্ত।
- ইউ আর আ মেনিয়াক সুমনা। মেনিয়াকদের লোভ থাকে। সাহস থাকে না। ওঝা ডাকার সৎ সাহস তোমার নেই।
- মিথ্যে কথা।
- তোমার সে অনেস্টি নেই।
- অনেস্ট? তুমি লেকচার দেবে শুভ্র? তুমি? পনেরো বছরের বিয়ে। একদিনও নিজের বৌকে ছুঁয়ে দেখার সৎ সাহস দেখাতে পেরেছ? এখন যত অনেস্টির গল্প!
-  ছুঁতে পারিনি।  সে ক্ষমতা আমার ছিল না।
- সে'টা বিয়ের আগে মনে ছিল না?
- রিভেঞ্জ তো যথেষ্ট হল সুমনা। লেট মি গো নাও। নিজেকে নিয়ে ছিনিমিনি এবার বন্ধ কর। ওঝাদের কাজ ভূত তাড়ানো। ডাক্তারকে দিয়ে মানুষ মারলে কি তারা ডাক্তার থাকে?
- তুমি মারা যাওয়ায় অন্তত একটা কাজের কাজ তো হল। ফাইনালি ইউ আর ইনসাইড মি।
- লেট মি গো।
- যেও না। যেও না।

আয়নার সামনে থেকে উঠে পড়লেন সুমনা। সর্বাঙ্গে আদুরে কাঁপুনি, চোখে জল। মুখ থেকে লালা ঝরে ভিজে গেছে গলা বুক।

Saturday, March 26, 2016

ইডেন গার্ডেন্সের ব্যাপার-স্যাপার


১।
আলু দেওয়া মাংসের পাতলা ঝোল দিয়ে কষে ভাত মেখে দুপুরের খাওয়াটা একটু মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছিল। গড়িয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সাড়ে সাতটার ম্যাচ, সাড়ে ছ’টায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে ইমরান-শচীনদের। বালিগঞ্জ থেকে পাঁচটায় বেরোলেই যথেষ্ট। পাশবালিশ বুকে টেনে যখন লম্বা হয়েছি তখন বাইরে চড়া রোদ, জানালার পর্দা না টেনে দু’চোখের পাতা এক করার উপায় ছিল না।
বাঙালির মানিব্যাগ; বাসের টিকিট আর ট্রেনের মান্থলিতেই সে’খানে লক্ষ্মীবাস।  সেই মানিব্যাগই আজ ভোল পাল্টে ফেলেছে। আজ সে স্রেফ এক পেটমোটা পকেট পোঁটলা নয়, সে আজ তিলিস্মি খাজানা। মানিব্যাগ খুলে ইডেনের সি-ওয়ান ব্লকের টিকিটটা ফের বার করলাম। দাঁতে টুথপিক চালানোর তালে তালে টিকিটটা খানিক উলটে পালটে দেখে মানিব্যাগে ওয়াপস রাখলাম। বালিশের তলায় টিকিটে ডাগর মানিব্যাগটা রেখে মাথা ঠেকাতেই ঝিমঝিমে ভাব নেমে এলো গা জুড়ে; সহজেই।
তন্দ্রা কেটে গেল বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ। দম বন্ধ করা গুমোট অসোয়াস্তি। চোখ সয়ে আসতেই বাজটা পড়ল; বুকে। পর্দা সরিয়ে দেখলাম আকাশ মিশকালো। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হুমকি। হুড়মুড় করে নেমে এলো বলে।
২।
নামতে কসুর করেনি। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ যখন ময়দান চিরে ট্যাক্সি এগোচ্ছে, তখন চারপাশ বৃষ্টিতে ঝাপসা। ইডেনের আউটফিল্ডের সাথে নিরুপা রায়ের কর্নিয়ার তুলনা সহজেই চলে; একবার ভিজলে আর নিস্তার নেই। পনেরো না হোক, অন্তত বারো ওভারের ম্যাচ কি হবে না?
৩।
বাবা চাইতেন অঙ্কে টপাটপ লেটার।
মা চাইতেন বৃন্দাবনি সারঙে মন বসুক।
দাদু অনেক বেশি প্র্যাক্টিকাল ছিলেন। ছিয়ানব্বুইয়ে তখন মিঁয়াদাদ একা কুম্ভ হয়ে শেষ কয়েক ওভার পাকিস্তানের হয়ে লড়ছিলেন বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে, দাদু বলেছিলেন “ভাই, আর কিছু হোক না হোক, এ জীবনে একটিবারের জন্য বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ অন্তত দেখো; নইলে জীবন বৃথা”।
সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে যখন ঢুকছি তখন শুধু পরনের টিশার্টই ভিজে সপসপে নয়। দাদু ক্রিকেট ভালোবাসতো, জবরদস্ত। আমি দাদুকে ভালবাসতাম, জবরদস্ত। হিসাব বরাবর।
ততক্ষণে ইডেনের গমগম জবরদস্ত হয়ে ঝরঝরিয়ে নেমে আসছে মুখে কানে বুকে।
আজ আমি ন্যাশনালিস্ট।
৪।
কুড়ি টাকায় চারটে জলের প্যাকেট। কিনতেই হল। জলের বোতলের অধিকার ‘কালচার্ড’ খেলা পাগল কলকাতা খুইয়েছে সেই কবেই। “জিতেগা ভাই জিতেগা” জীবনে কী পাব না’র সুরে গাইতে গাইতে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে এলাম ব্লক সি ওয়ানে। সিট নম্বর এক হাজার পাঁচশো আটষট্টি। ফ্লাড লাইটে দেখলাম বুক জল করা ঝিরঝির চলেছে একটানা।
“ওই যে সাদা ত্রিপল দেখছেন, সৌরভ লান্ড্‌ন্ থেকে আনিয়েছে, হাওয়া গলবে না তো জল। আর বাড়তি দু’টো সুপার সপার। টোটাল চারটে। ওই যে। লংঅন লংঅফে একটা করে। আর মিডউইকেটের দিকে একজোড়া। স্টিভ ওয়কে নাজেহাল করা ছেলে। ও ঠিক সামলে নেবে। খালি আকাশটা একটু ধরলেই হল। গুগ্‌ল বলছে সাতটা থেকে বৃষ্টি থামবে। থামবেই। খেলা হবেই”, পাশে বসা কাকা’র গলায় কনফিডেন্স।
মাঠ ভরতে শুরু করেছে। ছেষট্টি হাজার “ই-ন-ডি-ইয়াআআ, ই-ন-ডি-ইয়া” দানায় দানায় জমতে শুরু করেছে।
ভেজা আউটফিল্ডের ভয় বুক থেকে নেমে যেতে সময় নিল না। পিচ আউটফিল্ডের যতটুকু কমতি, মুঠো মুঠো গ্যালারি আস্ফালনে সে ঘাটতি মিটিয়ে দেওয়ার দম রাখে ইডেন গার্ডেন্স। এবার ঝিরঝিরটা থামলে হয়।
৫।
গুগ্‌ল বলেছিল সাতটায়। বৃষ্টি থামল পৌনে সাতটায়। পিচ থেকে কভার সরতেই “হোওওওওওওও” আছড়ে পড়লো স্টেডিয়াম জুড়ে। মাঠে তখন ভদ্রলোক ফিল্ড সেট করার ব্যস্ততায় দেখভালে নেমে পড়েছেন। আর এক প্রস্থ হইহই জুড়ল যখন দু’টো টিম যখন সদ্য উন্মোচিত আউটফিল্ডে নামলো গা ঘামাতে। ‘কান্ট্রি রোড্‌স’ থেকে ‘ও মধু’, ইডেনের স্পেকট্রাম যে কতটা চওড়া তা এই গানের রেঞ্জেই মালুম হয়।
সাজের শেষ অধ্যায়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করার যে মনোরম ব্যস্ততা, সে’টুকু তখন মাঠ জুড়ে। হাজারে হাজারে কণ্ঠস্বর তালে তাল দিয়ে গলা ফাটালে যে কী মোৎজার্টীয় মনঝিমঝিম তৈরি হয়, তার ডেমনস্ট্রেশন ইডেনের চেয়ে ভালো আর কে দিতে পারে?
৬।
সংবর্ধনা-টনা ভালো জিনিস।
মুখ্যমন্ত্রীর বিসিসিআই-আইসিসিআই ভূমিকা ছাপিয়ে যে’টা ইডেনোচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সে’টা হচ্ছে “সবাই ভালো আছেন তো?”।
ভালো থাকার জন্য ইডেন গার্ডেনের চেয়ে বড় দাবী বোধ হয় আর নেই। বাসের ভিড়ের ভয়, এগজ্যামের নম্বরের ভয়, প্রেম ভেঙে যাওয়ার ভয়, প্রমোশন নষ্ট হওয়ার ভয়; সমস্ত মিলেমিশে তাজমহলসম মণ্ড তৈরি হয়। সে মণ্ড সহজেই কয়েক ঘণ্টার জন্য গায়েব করে দিতে পারে ইডেন্দ্রজাল।
ইমরানের জ্বলজ্বল বোধ হয় চাঁদে বসানো টেলিস্কোপে চোখ রাখলেও টের পাওয়া যাবে। পাকিস্তান ও পাকিস্তানি দলের হয়ে ইডেনকে যখন “থ্যাঙ্ক ইউ” জানালেন, তখন আশপাশ থেকে যে কত “গুরুদেব” মার্কা সেলাম উড়ে এলো, তার হিসেব রাখা ভার।
অমিতাভজি বচ্চনের কণ্ঠে “আমি তোমাদের জমাইবাবু” শুনে শুনে হদ্দ হয়ে গেলাম। আমার দাদু টু আমি, সক্কলেই ভদ্রলোকের শালা। তবে ওই; ভদ্রলোকের ভোকাল কর্ডের নাম বোধ হয় রজনীকান্ত।
কিন্তু সমস্ত সুর ছাপিয়ে গেল যখন তিনি উদয় হলেন। সমস্ত অঙ্ক গুলিয়ে ভালবাসা ছোপালো সন্ধ্যে।
সন্ধ্যে হল, সন্ধ্যে হল
এখন ইডেন ভরছে যারা
তাদের মনে শান্তি আসুক
শান্তি আনুক সন্ধ্যেতারা
সন্ধ্যেতারার স্থির আশ্বাসে যখন তিনি মঞ্চে উঠে এসে হাত নাড়লেন; কলকাতা তখন স্মৃতি অফ জয়।
শুরুতেই গলা গেল চিরে।
“সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন
সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন
সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন”।
একটানা। অনবরত। শুনলে ভীমসেন যোশি মগ্ন হয়ে হাঁটু ঠুকে তাল দিতেন। দিতেনই। নিশ্চিত।
টস্‌ আটটা দশে। খেলা শুরু হবে সাড়ে আটটায়। আঠেরো ওভারের ম্যাচ। নাই মামার চেয়ে আঠেরো ওভার ভালো। বিলিতি ত্রিপলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো।
৭।
টসে জিতলেন ধোনি। ঝামেলা মিটল।
“ব্যাটাচ্ছেলের কপাল সোনা দিয়ে বাঁধানো। বুঝলেন?” পাশের কাকার গলায় চাপা ন্যাটওয়েস্ট অভিমান।
এরপর। জাতীয় সঙ্গীত।
জমজমাট কেস। শফকত আমানত আলি গাইবেন পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত আর অমিতজি বচ্চন গাইবেন জনগনমন। কেতার অভাব নেই।
“পাক সরজমিন”এর সুর আমার অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু শফকত ঠিক টেম্পোটায় খেললেন না বোধ হয়। অথবা ওটাই কেতা। তেমনই বাড়তি কেতায় জনগনমন মাঠ জুড়ে ভাসিয়ে দিলেন অমিতাভজি।
সেই কয়েক মিনিট ঠায় সজারু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। “তব শুভ নামে”তে রীতিমত কম্প। মিথ্যে বলব না; তখনই দাঁড়িয়ে এই হ্যাশট্যাগটা মাথায় এসেছিল #দিলদিলজনগনমন।
আসল আড়মোড়া ইডেন ভাঙলে এরপর।
৮।
জায়ান্ট স্ক্রিনে অশ্বিনের স্পিন দেখেই পাশের কাকা বলে দিলেন “না ভাইটি, এ বারেও গেল। বল যে প্রোট্র্যাক্টর বসিয়ে পঁয়তাল্লিশে পাক খাচ্ছে। পরের ইনিংসে একশো করতে দম বেড়িয়ে যাবে । ধোনি জব্বর কেস খেলে”।
তবু শরজিল জেএনইউ বিপ্লবীদের মুখে ছাই দিয়ে বেশ টুকুরটুকুর করে যাচ্ছিলেন। এক সময় ইলশেগুঁড়ি মোমেন্টামে উইকেট পড়াও আরম্ভ হল।
বুমরার রানআপের সাথে দুলকি মেপে অবিরত “ইন্ডিয়ায়ায়ায়া ইন্ডিয়া” ঢেউ হয়ে নেমে আসছিল পিচে। আমি যেখানে ছিলাম, সেই ব্লক থেকে নেহরাকে উদ্দীপ্ত করার জন্য সবিশেষ উৎসাহ নিয়ে “শচীনশচীন” চিল্লানিও হল।
৯।
দাদু বলতেন “পারস্পেক্টিভ উল্টেপাল্টে দেখতে শেখো”। প্রথম সাইকেল ব্যালান্স করতে পারার সময় একটা বুক ঠাণ্ডা করা অনুভূতি তৈরি হত; সত্যিই ব্যালান্সটা আমার আয়ত্তাধীন তো? ব্যালান্স আমায় আয়ত্ত করছে না তো? ব্যালান্স আমায় শিখে যায়নি তো? আমার এই শেখাটা আদতে মিথ্যে নয় তো?
“জিতেগা ভাই জিতেগা”র সুরে গলা মেলাতে মেলাতে,
আলগা অসতর্ক এক মুহূর্তে ছ্যাঁত করা একটা ভয় বুকে গোঁত্তা মারে!
আমরা এই বাইশজনের খেলা দেখতে এসেছি? নাকি বাইশজন এক চমৎকার কন্সপিরেসিতে বাষট্টি হাজার পারফর্মার জড়ো করে দিব্যি উপভোগ করছে? আসলি এরিনা এই গ্যালারিটাই নয়তো? বাইশ গজ বক্স সিট নয়তো?
“ভাইটি, উইকেট পড়ল! অথচ লাফালে না! শরীর খারাপ লাগছে নাকি?” কাকার আওয়াজে সম্বিতের চাকা ঘুরিয়ে দিলো।
১০।
ইডেন সমস্ত আনন্দবিন্দু শুষে উচ্ছ্বাস মেঘ বুনে চলে অবিরত। গামলা ভর্তি দানা দানা আলোর স্তূপ। শব্দের গমগমে মোহাচ্ছন্নতা কান বেয়ে বুকে নামে না; সিধে বুকের অন্তরে তৈরি হয় ও বনবন করে ঘুরে চলে। মেক্সিকান ঢেউগুলো যেন অদৃশ্য সন্তুরের তারের ভাইব্রেশনে বাঁধা।
কিচি অন্য কোথাও অপরিচিত কোন খাটে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।
দাদুর না থাকা বাড়ির প্রতিটি ইটের জন্য গা সওয়া হয়ে এসেছে।
সঞ্জীব আর বুলেট লিখবেন না।
মা আর নিয়ম করে সন্ধ্যেবেলা হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতে বসেন না।
সমস্ত বেহিসেবগুলো যেন অন্ত্যমিলের খাপেখাপে পড়ে মিলিয়ে মিশিয়ে যায়।
আর পাঁচটা স্টেডিয়াম বা ভিড় মাত্রই যা পারে না; সে’টা ইডেন পারে।
অনুভূতি শুষে নিয়ে মগজ নিউট্রালাইজ করে দিয়ে আনন্দ রোপণ করা। ইডেন পারে।
আনন্দ ফসল ঘরে তুলতে পারা; ইডেন যেমনটি পারে; তেমনটি আর কেউ পারে না।
কলকাতা শহরে নবান্ন মেজাজ একটি সহজ বিন্দুতেই রয়েছে; ক্রিকেটে রয়েছে।
ইডেন খেলা ভেস্তেছে। গ্যালারিতে আগুন জ্বেলেছে। ইনিংস ব্রেকে বাথরুমে ঢুকলে পেচ্ছাপে গোড়ালি ডুবে যায় আজও। কিন্তু ওই; ইডেন স্কেলে বসানো নিখুঁত চায়ের কাপে চুমুক ক্রিকেট নয়। তেমনটা হতে পারেনি কোনদিন; হতে পারবেও না।
ইডেন কী? “একদিন দেখা করবে? আগের মত? দাস কেবিন? এই শেষ বার। প্রমিস”য়ের আকুতিটুকু। হয়তো।
ডেফিনিশনে নিয়ম থাকে। ডেফিনিশন দিয়ে ইডেনদের হিসেব করা যায় না।
১১।
সুইসাইড নোটে ‘তোমরা ভালো থেকো আমি চললাম’ বা ‘এ দায় কারুর নয়’ গোছের কথা লেখা কী বোরিং।
তাই ভেবে সদ্য লেখা চিরকুটটা দলা পাকিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেললেন সমরবাবু।
নতুন করে লেখা শুরু করলেন;
অনু,
সমস্ত প্ল্যান মাফিক চলছিল। সমস্তই। জীবন ইডেন গার্ডেন্স। উচ্ছল। প্রাণবন্ত। হুজুগে। প্রেমের পাকিস্তানকে ব্যাট করতে পাঠিয়ে শুরুতেই শায়েস্তা করে ফেলেছিলাম। এরপর টুকটুক ব্যাটিংয়ে সে পাতি টার্গেট চেজ করে বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। ওই যেমনটা থাকে আর কী। কেক-ওয়াক। হাতের মোয়া গোছের।
গড়বড় করে দিলে টপাটপ তিনটে বাজে উইকেটথুড়ি তিনটে খুব অসভ্য গোছের ঝগড়া। আচমকা সন্দেহের জুজুতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পিলে-পিচ। অকারণ স্পিনের ভয় আর অকারণ সন্দেহর খোঁচা;একইরকম বিষাক্ত।
তখন। ঠিক তখনই আমার বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কাঁধে হাত রেখে বলার কথা ছিল ধুর বোকা,তোমার রাগ আমার লক্ষ্মী। ঝগড়াকে ডরাই ভেবেছসব ধুইয়ে মুছিয়ে দেব। সমস্ত সইয়ে নেব। যেওনা প্লীজ। তুমি গেলে সব শেষ। থাকো। থাকো
বলা হল না। হল না। ভেসে যাওয়া আটকানো হল না। আমার বিরাট কোহলি হওয়া হল না।
চলি। প্রেসেন্টেশন সেরিমনিতে যদি আসোতাহলে ওই সবুজ সিল্ক চাপিয়ে এসো। প্লীজ। কেমন?হালকা লিপস্টিক আর কাজলএর বেশি কিছু হলেই মাখিয়ে একাকার করে ফেলো।
ইতি সমর।
চিঠিটা বারতিনেক পড়ে নিশ্চিন্ত হলেন সমরবাবু।
পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে গত মাসের স্পোর্টসস্টারটা বের করে সে’টাকে হাত পাখার মত করে ধরে হাওয়া করতে শুরু করলেন; আচ্ছা লোডশেডিংয়ের খপ্পরে পড়া গেছে — ধুস।
১২।
যখন ঘোর কাটলো, তখন সদ্য আর্সালানের সামনে নেমেছি ট্যাক্সি থেকে। ভারত বনাম পাকিস্তান; বিশ্বকাপ; ইডেন — ভারতের জয়। বাকেটলিস্টে অসংখ্য টিক পড়ে গেছে এক সন্ধ্যেতেই। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় হিসেব কষেছিলাম সোয়া বারোটার মুখেও যদি আর্সালানে ঢুকতে পারি, তাহলেও সেলিব্রেশনটা ব্যাঘ্রশাবকের মত করা যাবে। কিন্তু চৌরঙ্গী টু পার্কস্ট্রিট যে খতরনাক ট্র্যাফিক জ্যামে পড়তে হবে অত রাত্রে; সে’টা কল্পনার অতীত ছিল।
আর্সালানের সামনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত পৌনে একটা। আর্সালানের  সামনে তখন সিকি মাইল লম্বা লাইন; ইডেন ফেরতা জনগণের। হুল্লোড়।
কলকাতাকে জিডিপি দিয়ে মাপতে যাওয়া আর রবীন্দ্রনাথকে দাড়ির দৈর্ঘ্য দিয়ে বিচার করা একই জাতের ভুল।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে যখন মন্দিরে বসার একটু জায়গা পেলাম তখন সপাট ভাসিয়ে দেওয়া অর্ডার “একটা মাটন স্পেশ্যাল বিরিয়ানি, সাথে চিকেন চাপ”।
” মাটন বিরিয়ানি শেষ স্যার”।
“অমন করে বলবেন না প্লীজ। বিরাটের দিনে এমন বিরাট কেস দেবেন না। পাখি বিরিয়ানি খেতে বলবেন না”।
প্রার্থনায় জোর থাকে। থাকেই। যে’ভাবে আমার জন্য ওয়েটারবাবুটি হাঁড়ি কাছিয়ে পাঁঠার বিরিয়ানি জোগাড় করে আনলেন তাতে মনে হল যেন ইডেনে হাফসেঞ্চুরিটা আমিই ছেড়ে এসেছি।
টেবিল আলো করে বিরিয়ানি ও চাপ। পাশে ঘেমো গায়ে থামস আপ। মনে মনে তখন হল্লা চলছে “জিতেগা ভাই জিতেগা আরসালান জিতেগা”।
ক্লান্তি শরীর মন জুড়ে। গোটা আরসালান তখন ইডেন ফেরতা ভিড়ে হুহু করছে। মাঠের সুবাস, বৃষ্টি বিকেলের ছোঁয়া আর বিরিয়ানির খোশবু মিলে আর্সালন তখন ঈশ্বরের বাগান। ডায়ে বাঁয়ে আগে পিছে সর্বত্র তখন কোহলি স্তুতি। বিরিয়ানির পোটেনশিয়াল এনার্জি তখন রিনিঝিনি মেজাজে কোহলি ধোনি স্তুতির কাইনেটিকে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে।
আর্সালানের  ধুকপুকে নলেনে আদরের মত মিশে গেছিল শ্রীশ্রী ইডেন গার্ডেন্স।

Friday, March 25, 2016

মন্মথ ও অমল



চায়ের কাপটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখলেন মন্মথ। এবার যাওয়ার সময়। এবার বিকেল। 
অমল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। তার কাঁধে মন্মথের ব্যাগ। বুক পকেটে টিকিট। অনতিদূরে ট্যাক্সি।

- "হাওড়া যাবিই?", অমলের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন মন্মথ।
- "আবার কবে দেখা হবে ঠিক আছে কোন?", ঢিপ করে প্রণামটা সেরে নিলে অমল।
- "সাবধানে থাকিস"।
- "আবার কবে আসবে মনুদা"?
- "দেখি। যবে। তবে"।
- "রাতে থাকলে তাও গল্প হত"।
- "উপায় নেই। জানিসই তো আমার কাজের কথা। তোর মত ব্যবসায়ী হলে বরং পায়ে পা তুলে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতাম কলকাতায়"।
- "ভারী তো মাল সাপ্লাইয়ের কাজ, তাও তুমি সময়মত না ধরালে যে কী হত"।
- "ইম্পর্ট্যান্টলি এখন সংসারটা চালিয়ে নিচ্ছিস। দিনের শেষে জি হুজুরি করে দিনক্ষয় করতে হচ্ছে না"।
- " এ কাজেও কম সেলাম ঠুকতে হয় না জানো"।
- " হ্যাঁ রে অমল। তোদের সেই আমগাছটা কেটে ফেলেছিস না?"
- "দোতলা তোলবার সময় কেটে ফেলতে হল"।
- "গাছটার আম বড় মিঠে ছিল"।
- "মনুদা, কাল তৎকালে টিকিট কাটার একটা ব্যবস্থা করতে পারি এখনও। ট্যাক্সিওলাকে না হয় দশ বিশ টাকা দিয়ে দিচ্ছি"।
- "প্রণাম ঠুকেই ফেলেছিস। বাবা বলতেন প্রণামের ইনহেরেন্ট পারপাস্‌কে ঠেলে সরিয়ে দিতে নই"।
- "ধুস্‌। আমিই তো রিট্র্যাক্ট করতে চাইছি"।
- "ব্রহ্মাস্ত্র সাবান রাখার প্লাস্টিক কৌটো না বাপ। যে হাত পিছলে বাথরুমের ফ্লোরে পড়ল আর তুমি চুক চুক করে কৌটোটা তুলে তাকে রেখে দিলে"।
- "যাবেই"?
- " যাওয়ার কি আর উপায় আছে রে অমল? তবে এ ট্রেন যেতে দেওয়ার উপায় রাখিনি। চ'। বাকি কথা ট্যাক্সিতে হবে"।

নির্বাণ

- গৌতমবাবু।
- *ফোঁৎ ফোঁৎ*
- ও গৌতমবাবু।
- *ফোঁৎ ফোঁৎ ফোঁৎ*
- সেরেছে। তপস্যার ঘুম! ভয়ানক। বলি ও গৌতমবাবু।
- কে? কউন? কে রে ব্যাটা?
- আমি। আমি। দেখবেন, লোটা ছুঁড়ে মারবেন না প্লিজ। 
- আরে! পরমেশ্বরদা। ওহ। বাঁচালেন।
- আমি ভাবলাম আপনি বোধ হয় ঘুমের বড়ি খেয়ে তপস্যায় বসেছেন।
- না তা নয়। আসলে ভারী মিঠে হাওয়া বইছিল কিনা। যাক। মাল কই?
- মাল?
- নির্বাণ।
- ওহ। এই যে। 
- এটা কী! লেফাফা?
- ওই খামেই তো রয়েছে।
- নির্বাণ?
- আজ্ঞে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। 
- চাকরী? নির্বাণ?
- এমন চাকরী যেখানে সোমবার লোকে ফুর্তিতে ড্যাং ড্যাং করতে করতে আপিস যায়।
- রিয়েলি? 
- মাইরি।
- আপিসের নামটা কী?
- শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রাইভেট লিমিটেড।

কবিতার দিন

১।
বিশ্ব কবিতা দিবস। 
এমন দিনও যে আসে সে'টা জানা ছিল না নিমাইবাবুর।

বিশ্ব কবিতা দিবস। মিনুর মাস্টার কত কিছু যে উদ্ভট খবর দেয়।
বিশ্ব কবিতা দিবস। কবি জাতটাই আধ পাগলা। তাদের লেখাজোখার জন্য আবার আলদা দিন রেখে দেওয়া।
আজ আর বারান্দায় বসে ধোঁয়ায় টান দিতে ইচ্ছে হল না নিমাইবাবুর। চট করে সিঁড়িতে এসে বিড়ি ধরালেন তিনি। বিশ্ব কবিতা দিবস বলে কথা।

২।
- কী ব্যাপার? এখনও তৈরি হওনি?
- তৈরি? কেন? কোথাও যাওয়ার আছে?
- ওহ। তুমি তো আবার এদিকে নতুন।
- ব্যাপারটা কী বলবে?
- আজ ফ্রেম ডিঙনোর দিন।
- কী?
- ফ্রেম ডিঙিয়ে ওপারে যাওয়ার দিন।
- ও'দিকে?
- ও'দিকে।
- আমরা যেতে পারব ওদিকে? আমরা? ফিরতে পারা যায়?
- শুধু আজকের রাতের জন্য। কাল ভোর হওয়ার আগেই আবার ফ্রেমে ফেরত। 
- শুধু আজ রাতের জন্য?
- আরে আজ কবিতা দিবস যে।
- তাতে কী?
- সে কী! আমরা ফ্রেম না পেরোলে চাঁদিম হিম আর ঘোড়ার ডিম আর কারা গিয়ে রেখে আসবে না-কবিতার দুনিয়ায়? চলো চলো। আর বিলম্ব নয়।


৩।
"এসো, এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে"।
সুরেলা। মিহি। আলো আলো।
কানের মেঝে বেয়ে বুক ঘষটে ঘষটে তারা এগিয়ে আসে। কানের গলিয়ে বেয়ে ঝুপ করে নেমে আসে গলার কাছটায়। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে 'জয় মা' বলে ঝাঁপ। শোঁ শোঁ শোঁ শোঁ শুধু নেমে যাওয়া বুক বেয়ে।
অদৃশ্য কনুই অল্প ঠেলে দেয়, 
- "ভাবছিস নামছে, আসলে কিন্তু উঠছে"।
- "অপটিক্যাল ইলিউশন"?
- "সুরটিক্যাল। ভালোবাসাটিক্যাল"।

মিতার রেওয়াজে রেওয়াজি হয়ে ওঠে শুভেন্দুর ছাতিটিক্যাল পায়চারী।

হাড্‌ল



১ নম্বর - মেঘলা। দু'চার ফোঁটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। 
২ নম্বর - রাইট ক্যাপ্টেন। 
৩ নম্বর - অতএব? খিচুড়ি?
১ নম্বর  - বেগুন আছে। বেগুনী হতেই পারে। 
৪ নম্বর - ডিমের স্টেটাস?
৫ নম্বর - তেরোটা আছে। 
১ নম্বর - মিটে গেলো। সবার জন্য একটা করে। ক্যাপ্টেনের জন্য ডাবল ডিম ভাজা।
৬ নম্বর - পেঁয়াজ নেই। পেঁয়াজ নেই। 
১ নম্বর - পেঁয়াজ কুঁচি ছাড়া মামলেট কী করে হবে? মামলেট না হলে কী  করে হবে? খিচুড়িকে স্রেফ বেগুনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া সেফ্‌ হবে?
২ নম্বর - হবে না। হবে না। 
৭ নম্বর - তাহলে উপায়?
১ নম্বর - ফাঁপরে পড়া গেল। মেঘ ইগনোর করব?
৮ নম্বর - এই আকাশে দু'চার ফোঁটা না নেমে যায় কোথায়! হাওয়ায় আমেজ পাচ্ছ না? এ মেঘকে পাত্তা না দেওয়া মানে শারজায় দাঁড়িয়ে মিয়াঁদাদকে পাত্তা না দেওয়া।
৯ নম্বর - উপায় আছে।
১ নম্বর - উপায় আছে?
২ নম্বর - উপায় আছে? 
৯ নম্বর - আলবাত আছে। ডিম সেদ্ধ। সর্ষের তেল, নুন আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে কষে মেখে। মামলেটের বাবা। 
১০ নম্বর -  হল না। হল না। জমল না। 
১ নম্বর - তোমার সবেতেই বাগরা। হবে না কেন? জমবে না কেন?
১০ নম্বর - বেসিক কেমিক্যাল ব্যালেন্সিংয়ের ব্যাপার। খিচুড়িতে মামলেট মেশে আর ফ্যানা ভাত-ঘিয়ে ডিম সেদ্ধ মাখা। বেসিকস। 
১ নম্বর - গেলো। আজ হরিমটর।
১১ নম্বর - আমি বলি কি! শুরুতে অল্প ঘি মাখা ফেনাভাত। সাথে ডিম মাখানো। শেষে খিচুড়ি বেগুনী। 
২ নম্বর - বেশ। 
১ নম্বর - বেশ। 
৩-১০ নম্বর - বেশ।
১ নম্বর - যাক। টিম হাড্‌লের সময় শেষ। বাবা নয় নম্বর। ফার্স্ট ওভার তোমার। ওভারপিচ ওভারে একটার বেশি দু'টো পড়লেই ডিম মাখা থেকে নাম কাটা। 
৯ নম্বর - আইডিয়া আমার, আর আমারই নাম কাটা? যাচ্চলে।
১ নম্বর - লেট্‌স গো। 
২-১১ -নম্বর - লেট্‌স গো।

গুড ফ্রাইডে

- আপনিই মিত্রা?
- ডু আই নো ইউ?
- না। তবে আলাপে দোষ নেই। আমি মিহির।
- আমার নামটা তো জানা আছে দেখছি।
- আসলে 'মদির আঁখির সুধায় সাকি' নারী কণ্ঠে আগে শুনিনি। এমন ভাবে মানিয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। 
- এ'সব পার্টিতে যে ভাবে মদক্ষয় হয়, সম্বিৎ টিকিয়ে রাখা বড় সহজ নয়। কী গাইতে যে কী গেয়ে ফেলেছি।
- বেশ তো ভাসিয়ে নিলেন।
- স্কচ যে'ভাবে ফোয়ারায় ছুটছে, কিছু কি আর ভাসিয়ে নেওয়ার জন্য বাকি ছিল?
- নজরুলগীতির ব্যাপারে আমি অবশ্য টিটোটল্যার নই। 
- যা হোক। কারুর তো কানে গেছে গানটা। 
- পিলু মিশ্র। কাহারবা। মেজাজে পাতিয়ালা। কানের দোষ কোথায় মিত্রাদেবী।
- কথায় তো বেশ নিট আপনি মিহিরবাবু। 
- এবার বরফ মেশাই। 
- মেশান। 
- আপনার আসল নাম তো হান্সা। তাই না? 
- মাই মাই মাই...আপনি কি গোয়েন্দা?
- শেঠ ভগওয়ান দাসের এক মাত্র কন্যা। এ দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। 
- নেশা ছুটিয়ে দিলেন। এ কথা গোপনে রেখে ঘুরতে চাই বটে, তবে কেউ জানলে ক্ষতি নেই। বাবা ভয় পায়, আমি পাই না। 
- ভয় পান না?
- না মিহির।
- ভয় পাওয়া উচিৎ। 
- জানি। 
- কী জানেন?
- জানি আমার প্রাণের ঝুঁকি আছে। অ্যাই, মিহিরবাবু, আপনি আমায় খুন করতে এসেছেন?
- আমি গোয়েন্দা। মার্ডারার নই। 
- ওহ। 
- তবে। মার্ডারারের টোপ আমি হান্সা। তিরিশ পেয়েছি। আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য। গত ছয় মাস ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আজ পেয়েছি। এবার আমার কাজ শুধু একটি সৌজন্য চুমু আপনার গালে বসিয়ে দেওয়া। পাঁচটা স্নাইপার এই ওপেন এয়ার পার্টি তাক করে বসে আছে এ বাগানের চারিপাশে। আমি চুমু স্থাপন করলেই খুনি বুঝে যাবে তাদের টার্গেট কে। মিনিট কয়েকের মধ্যে আপনি ঝাঁঝাঁরা। 
- স্মুদ।
- ভয় করছে?
- আমার ভয় করে না। কতবার বলব?
- ওহ, তাই তো। 
- কিন্তু কী মুশকিল। আপনি আমায় বলে দিলেন কেন প্ল্যান? আমি যদি গালে চুমু খেতে না দিই? যদি আপনাকে ধরিয়ে দিই?
- আমিও ভয় পাচ্ছি না আপাতত। 
- রিয়েলি? হোয়াই?
- হান্সা। 'মঙ্গালস ও আঁখি তব, সাকি, দিল দোলা প্রাণে'।
- এহ! এ গানের সবচেয়ে পাতি লাইন তুলে শেষ পর্যন্ত ফ্লার্ট করছেন মিহির?
- হেহ্‌। 
- যদি চুমু খেতে না দিই মিহির? অন্য সিগন্যাল দেবেন?
- যদি কোন সিগন্যালই না দিই হান্সা?
- সে কী! এতগুলো টাকার কাজ পেয়েছেন। ছেড়ে দেবেন?
- 'গোলাবী গুলের নেশা, ছিল মোর ফুলেল কাননে'।  
- আর পরের লাইনটা? পরের লাইনটা মিহির? 'শুকায়ে গিয়াছে ফুলবন,  নাই গোলাব গুলিস্তানে'। 
- হান্সা। থাক। আমি আসি। 
- চুমু বাদ দিয়ে চললেন নাকি? ও মা! যাদের কাজ হাতে নিয়েছেন, তাদের গোঁসা হবে না?
- আসি।
- যাবেন না। 
- সে কী! কেন!
- সবাই বঢিয়া বলে। বহুত খুব বলে। প্লেব্যাকের অফার পাওয়া উচিৎ বলে ঢলে পড়ে। পিলু মিশ্র, কাহারাবা, পাতিয়ালা বলে পাশে আসে না। যাবেন না মিহির। 
- যাহ! আচ্ছা মুশকিল। বললাম তো, আমি স্নাইপারদের টোপ। আপনার কাকার লাগানো গোয়েন্দা আর স্নাইপার। আমি চলি। আপনিও চটপট বেড়িয়ে পড়ুন। বেশি কাছে আসবেন না বরং। 
- মিহির, 'জানি আমি তোমার কাছে, ব্যথা ভোলার চুমু আছে- হিয়া কোন আমিয়া যাচে, জান তুমি, খোদা জানে'। রুকো। যেও না।
- ব্যথা ভোলার দারুর বদলে চুমু? বাজে হান্সা। বেশ বাজে। 
- তোমায় গালে চুমু দিতে দিই কী করে বলো? গালে নয়। গালে নয়। 
- হান্সা। আপনি নেশাগ্রস্ত। ছাড়ুন। 
- যেও না মিহির। গালে না। ঠোঁটে। তারপর স্নাইপ করুক ওরা। আর পারা যাচ্ছে না। আমি মিত্রা নই, হান্সা। এতবার হান্সা বলে কদ্দিন কেউ ডাকে না। আমি মিত্রা নই। মিত্রা হাসে বোকার মত। হান্সা গায়। সবুজ সুর। ভোর মাখানো কথা। গানে ভিজে মাটির গন্ধ। হান্সা মিহির। হান্সা। 
- পাগলামি সে'টা। 
- আমায় মুক্তি দাও জুডাস। মুক্তি দাও। চুমু দাও। আজ শুক্রবার। মেক দিস আ গুড ফ্রাইডে ফর মি মিহির। বি মাই জুডাস। মুক্তি দাও। মুক্তি দাও। মুক্তি দাও। কিস্‌ মি।  

হান্সার শেষ চুমুতে গুনগুন মিশে ছিল;  
'সকলই গিয়াছে যখন, যাক ঈমান শরাব পানে'।   



কবিতাগুচ্ছ

- স্যার।
- হুঁ।
- বলছিলাম যে...।
- যে?
- পাণ্ডুলিপিটা...।
- কীসের?
- আজ্ঞে?
- কীসের পাণ্ডুলিপি?
- আজ্ঞে...কবিতার। 
- কার?
- আজ্ঞে?
- কার লেখা?
- আমার। সেই যে। আপনি জমা দিতে বলেছিলেন। 
- আমি? জমা দিতে বলেছি? 
- আজ্ঞে। 
- আমি বলেছি?
- ওই মানে। অবনীবাবুর সংবর্ধনায় আপনাকে প্রণাম করে আমার লেখার কথা বলেছিলাম। গত অগস্টে। আপনি বলেছিলেন অফিসে এসে পাণ্ডুলিপি জমা দিতে। বলেছিলেন পছন্দ হলে ছাপা হবে।
- ছাপা?
- আজ্ঞে।
- আপনার কবিতা? 
- আজ্ঞে। যদি আপনার পছন্দ হয়। 
- পছন্দ হয়নি।
- হয়নি? 
- পড়িনি। তবে পছন্দ হবে না। সে'টা বলেই দিতে পারি।
- না মানে...দু'টো লেখা যদি...যদি পড়ে দেখতেন।
- মাসে অন্তত সত্তরটা নতুন পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে। ওই দিকে দেখুন। তাকে বোঝাই করে রাখা আছে। অন্তত সাড়ে পাঁচশো না পড়া পাণ্ডুলিপি রয়েছে। 
- আপনার ভালো লাগত মনে হয়...।
- কত কাটবে?
- আজ্ঞে?
- কত বিক্রি হবে?
- না মানে সে'টা তো ঠিক...। 
- এগজ্যাক্টলি। সে'টা যেহেতু হলফ করে বলা যাচ্ছে না, সেহেতু আপনি আসুন।
- স্যার প্লিজ...।
- আর ও আই। বোঝেন?
- আর ও আই?
- রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট। পাঁচটাকা ট্যাঁক থেকে বেরোলে মিনিমাম সাড়ে সাত টাকা ট্যাঁকে ফেরত আসা দরকার। নয়া মালকে দমাদম ছেপে দিল আমার পকেটে যে মিসাইল পড়বে ভাইটি।
- মাল? ওহ! 
- এবারে আপনি আসুন। 
- আমার পাণ্ডুলিপিটা...। 
- আবার কী? 
- না মানে...যদি ফেরত পাওয়া যেত!
- ওই তাক ঘেঁটে খুঁজে পেলে ভালো। না পেলে আমার দায়িত্ব নয়। 

***
ঈশ্বর  যখন জীর্ণ পাণ্ডুলিপি হাতে মন্দাকিনী পাবলিশার্সের আপিস থেকে বেরোলেন তখন চোখে মুখে শার্টে ধুলো। যে ময়লা ঘেঁটে পাণ্ডুলিপিটা উদ্ধার করতে হয়েছে তা আর বলার নয়।

মনটা ভার। নাকে ধুলো মেশানো সর্দির সুড়সুড়। চোখে চিড়বিড়ে জ্বালা। 
বাসস্ট্যান্ডের দিকে খানিক এগোতেই বাঁ পায়ের চটিটা গেল ছিঁড়ে। ধুস। রাগ জমাট হল। কালচে নীল রঙের বিরক্তি টিপ টিপ করে জমতে জমতে নাভির ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল। 
ধুস। ধুস। 
কবিতাগুলো পড়লোও না কোন প্রকাশক। ধুস্‌! অখাদ্য যত লোকজন। 

ময়দান কবিতাটার মধ্যে যে প্যাথোস, বাগবাজার লেখাটা যে ছন্দে বাঁধা, চৌরঙ্গীর লাইনে লাইনে যে এক্সপিরেমেন্ট লুকিয়ে, বা পার্ক স্ট্রিটের মধ্যে যে আবেদন ছড়ানো আছে; 
কেউ কোনদিন জানবে না। বুঝবে না। পড়ে "আহ্‌, বড় আদুরে" বলে চুক্‌ চুক্‌ করে উঠবে না কেউ। বইটা বুকে চেপে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল মেঝেয় বুলোবে না কেউ। 
সবচেয়ে বড় কথা, বইপাড়া কবিতাটার মধ্যে যে ভালোবাসা মেশানো ছিল, সে'টা কাউকে টেনে ধরার সুযোগটুকুও পেল না। 

অখাদ্য যত সব। আবার আহ্লাদ করে ডাগর হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতায় নাম দেওয়া ; বাবু ঈশ্বরের 'কলকাতা'। 
ধুস। ধুস। ধুস। নিজের ওপর প্রবল রাগ হল। প্রবল। 
বাঁ পায়ের চটি আর পাণ্ডুলিপি; দুইই সপাটে ছুঁড়ে ফেলে বিড়ি ধরালেন ঈশ্বর। 

***
দড়াম স্বপ্নের ধাক্কায় ঝটকা দিয়ে তন্দ্রা ভাঙল জোব সাহেবের। চোখ ডলে দেখলেন জাহাজ ডাঙ্গার আশেপাশে এসে ঠেকেছে। তবে সবই জলাজমি আর জঙ্গল। নামা উচিৎ হবে বলে মনে হয় না। 

তবে স্বপ্নটার জন্য মনের ভিতরটা কেমন হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে উঠলো, কেউ যেন তাকে বলে দিলে এখানেই জাহাজ ভেড়াতে। তবে জাহাজ ভেড়ানোর কথা বলতে গিয়ে এক দিস্তে হিজিবিজি লেখা কাগজ যে কেন সে ছুঁড়ে মারতে গেল! প্রবল অসোয়াস্তি। 
কাগজের দিস্তেটা জোব সাহেবের কপালে লেগেছিল; স্বপ্নে। সাহেবের বুক ছ্যাঁত করে উঠলো যখন তিনি টের পেলেন যে কপালের একটা কোণ সামান্য ফুলে রয়েছে। 

"হেঁইয়ো, তোরা কে কোথায় আছিস বাপ! জাহাজ এখানেই ভিড়িয়ে দে। দে ভিড়িয়ে"।