"এর নাম হলো শ্রীমান রুমাল", হাড়-জ্বালানো আহ্লাদি সুরে জানালেন সুবিমল। পোষা বেড়ালটা ভদ্রলোকের কোলে জাঁকিয়ে বসে, ঘাড়ে আঙুল-বোলানি মৌজ করে উপভোগ করার পাশাপাশি আমার দিকে মারাত্মক সন্দেহের চোখে তাকিয়ে। বেড়াল নিয়ে আদেখলামো আমার মোটে সহ্য হয় না, কিন্তু বড় কষ্ট করে সুবিমল সান্যালের ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। লেখক হিসেবে ভদ্রলোকের আজকাল বেশ নামডাক। ওর সাম্প্রতিক নভেলটা বাংলার পাঠকমহলে বেশ সাড়াও ফেলেছে। কিন্তু বাজারে খবর হলো লেখার হাতটি সরেস হলেও ভদ্রলোক সামান্য ছিঁটগ্রস্ত। একা মানুষ অথচ নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে। এই খিটমিট করছেন তো পরক্ষণেই দিলদরিয়া। অমুক সম্পাদক বা তমুক সাংবাদিককে বাড়িতে ডেকে "একটু বসুন, আমি ভিতরের ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে আসি" বলে উঠে গিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে; লুঙ্গিফতুয়া গায়ে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে পাঞ্জাব মেলে বসে পড়েছেন। এ'ছাড়াও নানাবিধ অদ্ভুতুড়ে গল্পগাছা ভদ্রলোককে নিয়ে বাজারে ছড়িয়ে আছে। অতএব এহেন মানুষের আদরের বিড়ালের প্রতি বিরক্তির ছায়াটা কিছুতেই মুখের ওপর পড়তে দেওয়া চলে না। আমি এ লাইনে নতুন, সুবিমল সান্যালের একটা ইন্টারভিউ আমায় বেশ ভালো একটা পুশ দেবে।
"জানেন তো, বেশিরভাগ গপ্পের প্লটগুলো এই রুমালই আমায় ধরিয়ে দেয়", দরাজ হাসলেন সুবিমল। পরিস্থিতি ঘোরালো, মিনিট দশেক গল্প হল অথচ বেড়ালের গপ্পের বাইরে আনা যায়নি ভদ্রলোককে। "প্লট রুমালই ধরিয়ে দেয়" প্রসঙ্গে সামান্য হোঁচট খেতে হলো।
"মানে, আপনি বলতে চাইছেন যে আপনার পোষা বেড়াল শ্রীমান রুমালের সঙ্গে গল্প করার সময় আপনার মাথায় বিভিন্ন গল্পের প্লট আসে"?
" না না। রুমাল নিজেই আমায় সে সব গল্প সাজিয়ে গুছিয়ে বলে। এইটুকু মাথায় যে কী করে এ'সব জটিল মনস্তাত্ত্বিক নভেলের প্লট দাঁড় করায়। ভেরি ইম্প্রেসিভ। রুমাল না থাকলে সুবিমল সান্যালকে আপনারা চিনতেনই না"।
"আপনি বোধ হয় এই সাক্ষাৎকারটাকে সিরিয়াসলি নিতে পারছেন না"।
"সে কী। ষোলোআনা সিরিয়াস"।
"রুমাল আপনার সঙ্গে কথা বলে"?
স্মিত হাসলেন সুবিমল।
হাসিটায় গোলমেলে অথচ মোলায়েম একটা ব্যাপার ছিল। মাথায় সামান্য ঝিম লাগলো, আমি যেন আর সুবিমলের সামনের সোফায় বসে নেই।প্রবল অস্বস্তি নিয়ে টের পেলাম বেশ নরম আদরে মোড়া পরিস্থিতিতে শুয়ে আছি। কেউ ঘাড়ে বড় সুমিষ্টভাবে মালিশ করে দিচ্ছে, দু' আঙুলের ডগায় সে কী ম্যাজিক। চোখ বুজে আসছে যেন। বুকের ভিতরটা সামান্য ছ্যাঁত করে উঠলো, আমি সুবিমলের কোলে শুয়ে। আমার উল্টো দিকের সোফায় আবছায়ার মধ্যে যে মানুষটা বসে আছে সে আমার চেনা, অবিকল আমার চেহারা যে। কিন্তু সেই আমির মুখ দিয়ে কথার বদলে শুধুই ম্যাঁও ও মিউ বেরোচ্ছে।
স্পষ্ট দেখলাম সুবিমল সান্যাল মাথা নামিয়ে আমার নতুন চোখ জোড়ার দিকে চেয়ে বললেন, "সাংবাদিক মশাই, এ'বার ক'দিন আপনার বাস আমার পোষ্য হয়ে। আপনার লেখার হাত যে ভালো, আমি সে খবর নিয়েছি। এ'বার দু'তিনটে জমকালো প্লট গুছিয়ে আমায় বলতে পারলে তবেই আপনার ওই ভদ্রলোকী শরীরে ফিরে যাওয়া। কেমন? টের পাবেন বেড়ালের জিভ ঠেলে কী সুন্দর বাংলা কথা বের করে আনা সম্ভব। আগে যান, ওই দেখুন ঘুরের কোণে এক বাটি দুধ রাখা আছে, খেয়ে আসুন। তারপর প্লট নিয়ে গল্প হবে"।
এই বলে আমায় মেঝেতে নামিয়ে দিলেন সুবিমল সান্যাল।
No comments:
Post a Comment