Tuesday, July 27, 2021

অ্যালিমনি



- এই যে, ট্যাক্সিটা আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? আর ট্যাক্সি দাঁড়ালেও ট্রেন কিন্তু হার ম্যাজেস্টির জন্য নতজানু হয়ে বসে থাকবে না৷ 

- আহ্৷ আসছি তো৷

- মালপত্তর সব তুলে দিয়ে এসেছি। 

- খুব ফুর্তি প্রাণে, তাই না? পারলে এখুনি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করে নাচানাচি শুরু করবি। 

- চারটে বড় সুটকেস পিছনে৷ 

- খুব ফুর্তি? 

- দু'টো সাইডব্যাগ ড্রাইভারের পাশের সীটে৷

- রাতের রান্না ফ্রিজে আছে। আজ থেকেই হুড়ুম করে বাইরে খাওয়া শুরু করিসনা৷ বাজারটাজার নিয়মিত যাস, মিতুলদি রান্নাবান্না যেমন করছিল তেমনই করবে৷ 

- ট্যাক্সিতে চারটে জলের বোতল রেখে দিয়েছি৷ একটা মাইল্ড ঠাণ্ডা ফর ইমিডিয়েট কনসাম্পশন। বাকিগুলো ম্যাক্সিমাম কনকনে, ঘণ্টাচারেক ওয়েট করতে হবে। ওভারনাইট জার্নি কেটে যাবে৷ তবে টনটনে টনসিলওলা মানুষদের ঠাণ্ডা জলের প্রতি এই সুইসাইডাল লোভ দেখলে গা জ্বলে যায়..। 

- ডিভোর্সটা হয়েই গেল বাবু৷ কেমন চটপট, সুটসাট৷ তাই না?

- নীল সাইডব্যাগের মাঝের খাপের চেনটা খুললেই..দু'টো বাক্স। একটায় ক্ষীরকদম, অন্যটায় গজা৷ এই গজা ব্যাপারটা তোর ওই অমৃতেন্দুর থেকেও খাজা। যেমন বিচ্ছিরি টেক্সচার৷ তেমনি ক্যাটক্যাটে মিষ্টি৷ যাক গে৷ হু অ্যাম আই টু ইন্টারফেয়ার... আমি কোন হরিদাস পালতোলা নৌকো৷ তোর পছন্দ যখন..।

- অমৃতেন্দুর ব্যাপারে এই ন্যাকাপনা মেশানো গবেট-মার্কা বাজে ধারণাটা এ'বারে অন্তত বাদ দে। আমাদের সেপারেশন হচ্ছে, কারণেই হচ্ছে৷ ঝগড়াযুদ্ধ কিছু ছিল বটে, কিন্তু স্ক্যান্ডেল তো কিছুই নেই৷ তুই মানুষটা ভালো৷ আমিও মন্দ নই৷ এবং আমরা দু'জনে ভালো বন্ধু বলেই খুনোখুনি করে সংসার টিকিয়ে রাখার পাগলামোটা করছি না৷ এখন তুই এই অযথা আজেবাজে কথা বলে গায়ে পড়ে তিতকুটে ঝগড়াটা শুরু করিসনা৷ 

- ওহ, আই মাস্ট মেনশন৷ কন্ট্র‍্যাব্যান্ডের মত স্টক করা ওই কাসুন্দিতে আমার ইন্টারেস্ট নেই। একটা প্যাকেটে মুড়ে চারটে শিশিই সাইডব্যাগেই দিয়ে দিয়েছি। লীক করবে না। 

- তুই কি আর কোনও কথাই বলবি না?

- ছোট সুটকেসের মধ্যে রাখা নীল পাউচটা থেকে নেলকাটারটা আমি সরিয়ে রেখেছি৷ গড়িয়াহাট থেকে আমি নিজে কিনেছিলাম৷ আশি টাকায়৷ আর এ মুহূর্তে নখ আমার বেড়েছে বেশি৷ ভুজুংভাজুং দিয়ে সে'টা নিয়ে তুই কেটে পড়বি আর আমি টের পাব না ভেবেছিলিস?

- এ'রকম কেন করছিস হঠাৎ?  তুই তো আপত্তি করিসনি কোনওদিন? উকিলের আইডিয়াটাও তোরই ছিল৷ তবে এই ভালো, জানিস। তুই দেখিস, আমরা ভালো থাকব। সুস্থ একটা বন্ধুত্ব থাকবে৷

- ওহ হো৷ একটা বিগশপার ব্যাগ রেখেছি পিছনের সীটে৷ দু'টো চিঁড়েভাজার প্যাকেট। দু'টো বর্বোন বিস্কুটের বড় প্যাকেট৷ তিনটে..।

- তুই থামবি?

- ট্যাক্সিদাদা মিটার চালু করে দিয়েছে৷

- বাবু, সরি। 

- একটা হেস্তনেস্ত বাকি আছে৷ 

- এখনও কী বাকি আছে?

- বাড়ির বইগুলো তোকে দিয়ে দেব৷ অ্যালিমনি। সময়-সুযোগ করে পাঠিয়ে দেব'খন। 

- তারপর সে বইয়ে লেগে থাকা দীর্ঘশ্বাসে আমার গায়ে লাগুক আর কী৷ আর শোন, আমি পড়ি, টপাটপ বই শেষ করি৷ বাড়ির আলমারির বেশির ভাগ বইই আমার পড়া। আমি তোর মত নই যে গাদাগুচ্ছের বই কিনে জমাব কিন্তু পড়ব না। এ'বার তো হাতে অঢেল সময়৷ জানপ্রাণ লাগিয়ে পড় দেখি৷ 

- ওহহো৷ দ্যাখো কাণ্ড৷ আসল ব্যাপারটা বলে রাখি৷ ফোনের  চার্জারগুলো সব সবুজ সাইডব্যাগটার সাইডের চেনে রেখেছি। 

- আমি মাঝমধ্যেই আসব কিন্তু, কেমন? আর প্রতিবার তোর জন্য ভালো ভালো বই নিয়ে আসব৷ অ্যালিমনি। 

- যাস না৷ 

- যাব না?

- টু সামারাইজ৷ চারটে বড় সুটকেস পিছনে৷ দু'টো সাইডব্যাগ ড্রাইভারের পাশের সীটে। বিগশপ্যারে স্ন্যাক্স৷ চারটে জলের বোতল৷ 

- আসি৷ টু সামারাইজঃ ফ্রিজে ডিনার রাখা আছে৷ ভুলে যাস না। 

Wednesday, July 21, 2021

অতএব




প্রেমিকা "উত্তমকুমার" বলে ডাকায় কোনও প্রেমিক কোনওকালে লজ্জায় মাখোমাখো হয়ে পড়েননি।

সুকুমার কোনওদিন রুমাল ব্যবহার করেননি বা বেড়াল প্রসঙ্গে ভাবনাচিন্তা করেননি৷

রবীন্দ্রনাথ কোনওদিন দাড়িতে হাত বুলিয়ে দেখেননি৷

নেতাজী বলতে মুলায়ম সিং ছাড়া কারুর কথা মনেই পড়েনা৷ 

শীর্ষেন্দুর ভূতেরা মগনলালের প্রাইভেট সার্কাসে কোরাস গেয়ে দিন গুজরান করে।

রবি শাস্ত্রী মাইক হাতে "কলকত্তা কেমোন আছি" বলে চ্যাঁচামেচি না জুড়লে ইডেনে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয়না৷ 

উচ্ছে-কোফতা ছাড়া পিকনিক টেনিদা বরদাস্ত করতে পারেনা। 

আলভারেজকে প্রথমবার দেখেই শঙ্কর তাঁর পকেট কাটার ফন্দি এঁটেছিল।

নিয়ম করে, দুলে দুলে, পাঁচালীর সুরে; আনন্দবাজারে প্রকাশিত জ্যোতিষী-তান্ত্রিকদের বিজ্ঞাপন না পড়লে- নিউটন কিছুতেই গ্র‍্যাভিটির বিটকেল হিসেবনিকেশ সামাল দিয়ে উঠতে পারতেন না।

পলাশীতে মুখ থুবড়ে পড়ে সিরাজ ককিয়ে উঠে বলেছিলেন, "এট্ টু মিরু"?

Tuesday, July 20, 2021

কর্পোরেট বাউল, রামপ্রসাদ আর দিল্লীর বৃষ্টি



- এ যে ক্যাটস অ্যান্ড ডগস ভায়া৷

- ট্র‍্যাফিকে জবাই হওয়া ছাড়া গতি দেখছি না৷

- আহ্, তোমার খালি হাফ গ্লাস এম্পটি৷ ট্র‍্যাফিকের হয়রানিটাই দেখলে? বৃষ্টির পারকুইজিটগুলো অবহেলা করলে চলবে কেন৷ সাফিশিয়েন্ট মিঠে হাওয়া, গরমের হাঁসফাঁস গন, সন্ধ্যের ফুলুরি রাতের খিচুড়ি..। ফোকাস অন দ্য কন্ট্রোলেবলস, ট্র‍্যাফিক তোমার হাতে নেই৷ কিন্তু খিচুড়ির পাশের ডিমভাজার কোয়ালিটি তোমারই হাতে রয়েছে৷ 

- চাকরীবাকরী ছেড়ে কর্পোরেট ট্রেনিংয়ে ঢুকে পড়ুন সুদীপদা৷ এ'সব সুড়সুড়ি দিয়ে বেশ টুপাইস ইনকাম হবে৷

- আমি নিজেকে কী বলি জানো? কর্পোরেট বাউল৷ প্রমোশনে নেই, ল্যাং মারামারিতে নেই৷ দিনের কাজ দিনের মধ্যে মিটিয়ে নাও আর তারপর জীবনপুরের পথিক মোডে মানুষ কালটিভেট করে বেড়াও৷

- তা এই বৃষ্টিকে কালটিভেট করতে হলে কী করতে হবে?

- জ্যামের দিকে দাঁত খিঁচিয়ে বসে না থেকে বৃষ্টির ফ্লোটা ফীল করো ব্রাদার৷ এ তো আর কলকাতা নয় যে ঘ্যানরঘ্যানর বৃষ্টি আড়াই মাস ধরে চলবে৷ দিল্লীতে এমন বৃষ্টি সহজে জোটে না৷ সো মেক দ্য মোস্ট অফ ইট৷ 

- কলকাতা৷ হুঁহ্৷

- ঝেড়ে কাশো৷ 

- কলকাতায় থাকতে কলকাতার বৃষ্টিকে কম গালাগাল দিইনি৷ অথচ এখন মনে হচ্ছে এমন দিনে গড়িয়াহাটে দাঁড়িয়ে ইলিশের দরদাম করলে মন্দ হত না৷ তারপর দাস কেবিন থেকে মোগলাই প্যাক করিয়ে নেওয়া৷ নাহ্, এ'সব ভেবে একটু খারাপই লাগছে সুদীপদা৷ আমি অবশ্য একটু হোমসিক বাই নেচার। 

- কী জানো ভায়া, বৃষ্টি ব্যাপারটা স্মৃতি আর সিনেমায় যতটায় সুন্দর, ডেলি প্যাসেঞ্জারিতে ততটা নয়। তবে আদত নির্বাণটা কোথায় জানো? টু রিয়ালাইজ দ্যাট ডেস্পাইট দ্য ইনকনিভিনিয়েন্সেস; সাম ডে, ইভেন দিস রেইন শ্যাল বি মিসড। একদিন এই দিল্লীর বৃষ্টির জন্যেও বুকের মধ্যে একটা হাহাকার অনুভব করবে৷ হাজার বারো বছর ধরে আমরা চাষবাস করে চলেছি হে, এই চাকরীর ঘানিটানা তো হালের ফ্যাশন৷ বৃষ্টিকে ভয় পাওয়া, শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা; এ আমাদের মজ্জায়৷ বহুদিন পর জবরদস্ত বৃষ্টি দেখলে বুক চলকে ওঠাটাই সিভিলাইজেশ্যন৷ 

- নাহ্৷ কর্পোরেট ট্রেনার না হয়ে বরং বাবাজী-টাবাজীই হয়ে পড়ুন৷ তা এই বৃষ্টির সন্ধ্যেকে ভালোবাসতে হলে কী করনীয়? 

- বাড়ি ফেরার তাড়া না থাকলে চলো তোমায় রামপ্রসাদ মিশ্রর মির্চি পকোড়া খাওয়াই৷ রামপ্রসাদের পকোড়া হাইক্লাস, তবে সে একটা ঝাল মিষ্টি চাটনি অফার করে; সে'টা লেজান্ডারি৷ সে আদতে বলিয়ার মানুষ, এবং দিল্লীর জামাই৷ তার চুয়ান্ন বছরের জীবনে বেয়াল্লিশ বছর দিল্লীতে থেকেছে সে, অথচ আজও নিজের গাঁয়ের কথা ভেবে সে ছটফট করে৷ আর সেই ছটফটটুকুই সে চ্যানেলাইজ করে তার পকোড়া ভাজায়৷ সে এক আর্টিস্ট ভায়া, কড়াই না ধরে ক্যানভাস ধরলে আজ সে ওয়ার্ল্ড ফেমাস হত। আর রামপ্রসাদ আমার ডিয়ারেস্ট বৃষ্টিতুতো ভাই৷ যাবে নাকি তার কাছে? তোমার দাসকেবিন আর গড়িয়াহাটের অভাব মিটিয়ে দেব, আই প্রমিস। 

- এ'সব জিনিয়াসের খবর আপনি পান কী করে?

- শুয়োরে শুয়োর চেনে আর বাউল চেনে বাউল। চলো, এ'বার রামপ্রসাদের দোকানে হানা দেওয়া যাক৷ তোমায় দিল্লীর বৃষ্টি না চেনালেই নয়৷ 

কাগুজে বাগ



- আসুন ডক্টর চ্যাটার্জি। বসুন। আপনার অপেক্ষাতেই..।

- ইয়ে, আপনার অনুচরটিকে সেই স্পেশ্যাল কফিটা আনতে বলে দিন প্লীজ৷ 

- আমার সঙ্গে দেখা করা চেয়েও দেখছি আপনার আগ্রহ কফিতে বেশি৷ 

- মাফ করবেন মিস্টার সেন, ক্যাবিনেট মিনিস্টার হিসেবে আপনাকে যে যথেষ্ট রেস্পেক্ট করিনা, সে বদনামটাটুকু অন্তত আমার প্রাপ্য নয়৷ তাছাড়া, মানুষ হিসেবেও তো আপনাকে কম ইয়ে করিনা৷ তবে আপনার অফিসের কফিটা..জাস্ট ইনক্রেডিবল। 

- কৃতিত্বটা আমার আর্দালি মনোহরেরই প্রাপ্য৷ ছোকরার হাতে জাদু আছে। তবে আজ শুধু কফি খেয়ে সরে পড়বেন না যে৷ লাঞ্চটাও এখানেই বলে রেখেছি৷ পাবদা আর পমফ্রেট যে আপনার ফেভারিট, সে খবর কিন্তু আমি রাখি৷  

- আমার পরম সৌভাগ্য বলতে হবে৷ 

- তা, প্রজক্টের ব্যাপারটা...?

- সে'টার জন্যেই তো আপনার সেক্রেটারির কাছে জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্টটা চাইতে হল মিস্টার মিনিস্টার৷  ইট ইজ রেডি।

- রেডি?

- একদম৷ বিদেশী টেকনোলজি ধার করতে গিয়ে বিস্তর খরচ হয়েছে বটে, তবে মিশন হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাকসেসফুল। বিটা টেস্টিং পেরিয়ে ফাইনাল রোল আউটের জন্য আমরা রেডি৷  এবার আপনি প্রাইম মিনিস্টারের পারমিশন আদায় করতে পারলেই...।

- উনি তো এই ব্রেক-থ্রুর জন্যে মুখিয়ে রয়েছেন ডক্টর৷ 

- তা'হলে তো মিটেই গেলো৷ এ'বারে পঞ্জিকাটঞ্জিকা কনসাল্ট করে একটা ভালো দিন দেখে

- ডক্টর চ্যটার্জি, ইফ দিস ওয়ার্ক্স আউট..আর একদিনও।অপেক্ষা নয়।

- দিস বাগ উইল সার্টেনলি ওয়র্ক৷ 

- বাগ?

- ইট ইজ আ বাগ আফটার অল৷ আড়ি পাতার সফটওয়্যার বইতো নয়৷ কিন্তু আমাদের এই বাগের শক্তি অপরিসীম। অন্যান্য স্নুপিং সফটওয়্যারের মত হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের হাঁড়ির খবর শুধু নয়, গভর্নমেন্টের মুঠোর মধ্যে থাকবে এখন দেশের প্রতিটি মানুষের হাঁড়ি খবর৷ থুড়ি,  হাঁড়ির খবর নয়, পেটের খবর।

- গোটা ব্যাপারটাই সিক্রেট থাকবে তো ডক্টর?

- অফ কোর্স৷ নয়ত আমার মাথা ন্যাড়া করে, গাধার পিঠে চাপিয়ে দেশ থেকে খেদিয়ে দেওয়া হোক। শুনুন, দেশের প্রতিটা মোবাইল সিমকার্ডই এখন এক এক একটা ডেটা ট্রান্সমিটার, তা সে ফোন স্মার্ট হোক বা আনস্মার্ট৷ আমাদের গোপন সার্ভারে সমস্তটাই রেকর্ড করা থাকবে৷ 

- বাহ্ বাহ্ ডক্টর চ্যাটার্জি৷ তোমার করব কোতল? বাইশটা নোবেল পাওয়া উচিৎ অথচ এই ছাই সিক্রেসির জন্য তোমার এই ব্রিলিয়ান্ট প্রজেক্টের কথা কেউ কোনওদিন জানবেও না৷ 

- ইট ইজ ওয়ার্থ ইট মিস্টার মিনিস্টার৷ তবে এমন অদ্ভুত আব্দার কোনও পলিটিশিয়ান যে করতে পারে...।

- অদ্ভুত?

- একসময় শুনতাম গভর্নমেন্টরা আড়ি পাতে, মানুষের প্রাইভেসির খেলাপ করে৷ তবে এই প্রথম শুনলাম কোনও সরকার মানুষের ব্যক্তিগত কথাবার্তা শুনতে চাইছে না, বরং মানুষের খিদে পেয়েছি কিনা সে খবর গোপনে আদায় করতে চাইছে৷ 

- গোপনে অন্যের কথা শোনা? সে সব পলিটিকাল ডার্কএজে হত হে ডক্টর৷ সময় পাল্টেছে। স্নুপিং বাগ এখন আমাদের দরকার শুধু মানুষের খিদের খবর পাওয়ার জন্য৷ একটা গোটা ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে ডক্টর, আন্ডার ডাইরেক্ট সুপারভিশন অফ দ্য পি এম৷ সেটাও টপ সিক্রেট৷ তোমার এই বাগ সাকসেসফুলি ছড়িয়ে দিতে পারলে সে ডিপার্টমেন্ট কাজে নামবে৷ মানুষের খিদের কষ্ট রেজিস্টার হলেই আমাদের গ্রাউন্ড লেভেল টীম সে মানুষের দোরে পৌঁছে যাবে গরম ডালভাত বা রুটি তরকারি হাতে৷ শিশুরা খিদেয় একটানা কষ্ট পেলে পৌঁছে যাবে দুধ৷ কিন্তু কাউকে ভিক্ষে করতে হবে না,  কারুর কাছে হাত পাততে হবে না৷ আর মূলত মানুষের আত্মসম্মানবোধের কথা ভেবেই গোটা ব্যাপারটাকে নিয়ে এত রাখঢাক আর গোপনীয়তা।  অন্তত মানুষের খিদেটুকু যদি পাবলিক স্পেক্টাকেল না করে; গোপনে, ঢাকঢোল না পিটিয়ে;  আমরা মিটিয়ে দিতে না পারি ডক্টর চ্যাটার্জি...তা'হলে আমরা সরকারে রয়েছি কি করতে?

- কফিটা কিন্তু এখনও এলো না মন্ত্রীমশাই৷ হেহ হেহ হেহ।

**
ছবিটার সঙ্গে এ গল্পের যোগাযোগ আছে এবং নেই।

Sunday, July 18, 2021

হোয়্যাটস্যাপিস্টস



পেল্লায় হোয়্যাটস্যাপ গ্রুপগুলো দাঁড়িয়ে আছে দু'ধরণের মানুষের কাঁধে ভর দিয়ে৷ 

প্রথম দল সর্বক্ষণ 'মডারেট' করে চলেছে৷ 'ডিসিপ্লিন' নিয়ে তারা সর্বক্ষণ শশব্যস্ত৷ তাদের ধারালো দৃষ্টি এড়িয়ে গ্রুপে হাওয়াও বইতে পারেনা। রাজ্যশাসনের ভার তাদের হাতে৷ কড়া ধমক, শ্লেষ, বিরক্তি আর নিয়মকানুন বানানোর হুজুগ; এ'সব মিলিয়েমিশিয়ে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখছে তারা৷ তারা নিয়মিত চাবুক কষাচ্ছে;

"দেখুন মিস্টার দত্ত, ফরওয়ার্ড মেসেজ পাঠাতে হলে অন্য গ্রুপে যান৷ এই গ্রুপ একটা সিরিয়াস পারপাস নিয়ে তৈরি হয়েছে, এ'সব ছেলেমানুষি যেন এ'খানে না দেখি"৷ 
মিস্টার দত্ত চোরাই সোনার বিস্কুট সমেত ধরা পড়লেও বোধ হয় এত ভেবড়ে যেতেন না। 

"এই যে, সাহাবাবু! আপনাকে কতবার বলেছি গুড মর্নিং মেসেজ পাঠাবেন না৷ গ্রুপ মেম্বারদের মোবাইলে স্পেস নষ্ট হচ্ছে৷ আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে গ্রুপ কন্সটিটিউশনটা আর একবার পড়ে দেখতে"।
সাহাবাবু আজ পর্যন্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতাখানা ছাড়া কিছু পড়ে দেখেননি৷ গ্রুপের কন্সটিটিউশন যে আছে তাই তিনি জানেন না, জানবেনও না৷ হোয়্যাটস্যাপের কড়া মেমোটিও তিনি পড়বেন না৷ পরের দিন ফের সকাল সাড়ে ছ'টায় টুং শব্দে গ্রুপ মডারেটরের ঘুম ভাঙাবেন ভদ্রলোক; গোলাপের ছবির ওপর লেখা থাকবে "শুভ সকাল বন্ধুরা"৷ 

"বঙ্কুবাবু আর অমিয়বাবু৷ আপনাদের ভাষা এ গ্রুপের পরিবেশ নষ্ট করছে৷ ঝগড়া করতে হলে পাড়ার মোড়ে দেখা করুন। অথবা নিজেদের মধ্যে ডায়রেক্ট মেসেজ চালাচালি করে খেউড় চালিয়ে যান৷ নয়ত আমর বাধ্য হব আপনাদের গ্রুপ থেকে এস্কপেল করতে"। 
ইন্টারনেট ঝগড়ার বড় হাইভোল্টেজ ব্যাপার, সে মায়া কাটানো অসম্ভব৷ মাঝেমধ্যেই শক্তির কবিতার লাইন শেয়ার করা বঙ্কুবাবু মডারেটরের কাছা খুলবেন; "গ্রুপটা তোর বাপের সম্পত্তি নাকি রে শালা"? অমিয়বাবু এক ধাপ ওপরে গিয়ে, "এমন ফোঁপরদালালের গ্রুপে আমি ইয়ে করি" বলে স্যাট করে গ্রুপত্যাগ করবেন৷ 

আর একদল মানুষ হল হোয়্যাটস্যাপ গ্রুপের আদত লক্ষ্মী।  মডারেটর আর গ্রুপ-জ্যাঠাদের ডিফেন্স হেলায় উড়িয়ে তারা শুধু ফরওয়ার্ড খেলে যায়৷ এই পাঠালো মাজার বোতলে এবোলার গল্প, পরক্ষণেই চীনের প্লাস্টিক ডিমের কারখানার ওপর ডকুমেন্টারি, তারপরেই পলিটিকাল মীম বা এমন খবর যার গাঁজাখুরিত্ব পাঁচ বছরের খোকাও ধরে ফেলবে- এ'ভাবে একটানা অক্লান্ত ভাবে তারা গ্রুপ গুলজার করে রাখে৷ মডারেটর ধমক, সৎ মেম্বারের শুধরে দেওয়ার প্রচেষ্টা, ভূমিকম্প,  ঝড়,; কোনও কিছুই এদের রুখতে পারেনা৷ মাঝেমধ্যে 'সরি'ও বলে ফেলে এরাঃ

"ওহ হো, ফরওয়ার্ডটা আমি পাঠাইনি৷ আমার ভাইপোর হাতে ফোন ছিল তো, সেই ব্যাটা...(জিভ বের করা স্মাইলি-সহ)"৷ অবশ্যই পরের দিন ফের ফরওয়ার্ড চালু করবেন। 

"তাই কি? এ খবরটা গুজব? ওহ, আমি বুঝতে পারিনি৷ ক্ল্যারিফাই করে দেওয়ার জন্য থ্যাঙ্কিউ"৷ বলেই গুজব ব্রডকাস্টার অন্যান্য গ্রুপে সে গুজবই ফরওয়ার্ড করবে৷ 

এই হলো এ যুগের সবচেয়ে ধারালো ইডিওলজিকাল যুদ্ধ৷ ডিসিপ্লিনবাজরা কমল মিত্তিরের মত পাথুরে এবং হিমশীতল। অন্যদিকে ফরোয়ার্ডিস্টরা মাতাল কবি; অনিল চ্যাটুজ্জ্যে ঘরানায়৷ কবিতা এবং যশ চোপড়ার মহব্বতের নিয়ম মেনেই ডিসিপ্লিনকে মাথা নীচু করে সরে পড়তে হবে৷ প্রতিটা সৎ  হোয়্যাটস্যাপ গ্রুপ হিজবিজ মেসেজের সমুদ্রে ভেসে যাবে আর নিয়মকাকুকাকীমারা যন্ত্রণায় ছটফট করে হদ্দ হয়েও বিপ্লবের স্বপ্ন ত্যাগ করবেনা; এই ভিসিয়াস সাইকেল থেকে বেরোনো অসম্ভব৷

Saturday, July 17, 2021

ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স



- এই যে, সামন্ত। আগামীকাল অফিসে এসো কিন্তু। 

- কাল?

- কাল।

- কিন্তু কাল তো শনিবার।

- তা'তে কী?

- না মানে স্যার...উইকেন্ডে..।

- আহ, যুদ্ধে যেতে তো বলছি না। অফিসে এসো। 

- এমার্জেন্সি কিছু কি?

- একটা ট্রেনিং আছে। ডেভেলপমেন্টাল। 

- কীসের ওপর?

- ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স। হাইক্লাস একজন লাইফ কোচ আসছেন। টেড স্পীকার। গত মাসে মুম্বই টীমকে ঘ্যাম লেভেলে ইন্সপ্যায়ার করে গেছেন। কাজেই কাল তোমায় আসতেই হবে। টীমের সবাই আসছে। আর হ্যাঁ, কাল একটু সকাল সকাল এসো। 

- শনিবার। তাড়াতাড়ি অফিস আসব ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্সের ট্রেনিং করতে?

- উইকডেজ শুড বি অল আবাউট ওয়ার্ক ওয়ার্ক অ্যান্ড ওয়ার্ক। কালকের ব্যাপারটা তো একটা ফান এক্সারসাইজ। 

- ফান?

- রীতিমতো।  আই প্রমিস। 

- বেশ। তা'হলে আজ বেরোই এখন স্যার। 

- ও মা, এখনও তো সাড়ে সাতটাও বাজেনি। এই ভেতো বাঙালিদের এই একটা সমস্যা। অফিসে আসা মাত্রই বাড়ি যাব বাড়ি যাব বায়না। হেডঅফিস একটা জুম মিটিং রেখেছে সাড়ে আটটায়। সে'খানে তোমার থাকাটা মাস্ট। 

- ওহ। 

- দ্যাখ সামন্ত। নিজের মধ্যে একটু কিলার ইন্সটিঙ্কট তৈরি করো।  সব সময় অমন ন্যাতা হয়ে থাকলে কর্পোরেটে চলে না। এনার্জি চাই। ডাইনামিজম চাই। চাই ফায়্যার ইন দ্য বেলি। 

- একটা রিকুয়েস্ট ছিল স্যার। 

- এনিথিং। শুধু ছুটি চেয়ো না ভাই। 

- না, তা নয়। আসলে সামনের রোব্বারটা একটু ফাঁকা পড়ে যাচ্ছে। খুব ভয় হচ্ছে বাড়িতে বসে একটু রিল্যাক্স না করে ফেলি। 

- হোয়াট?

- বলা তো যায় না স্যার, দিনকাল যা পড়েছে। রোব্বারের অলস মন, একটা সর্বনাশ না ঘটিয়ে ফেলি। দুম করে হয়ত আপনার সামনে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার বদলে বৌয়ের সঙ্গে কথা বলে ফেলব।

- সামন্ত! হোয়াট ইজ দিস।

- মাইরি স্যার। খুবই নার্ভাস হয়ে আছি৷ ছুটির দিন বাড়িতে থাকলে যদি কোনও ক্যালামিটি ঘটে যায়? যদি অফিস ফাইলের বদলে টিনটিন পড়ে ফেলি? যদি মিটিং ভুলে হপ্তায় একদিন আড্ডা দিতে বসে যাই? যদি এক্সেলশিট সরিয়ে রেখে খোকার সঙ্গে আধঘণ্টা ক্যারম খেলে ফেলি? না না। রিস্ক নিয়ে লাভ নেই স্যার। আমার রোব্বারে বাড়িতে ফেলে রাখবেন না প্লীজ। অফিসে ডেকে নিন। প্লীজ। প্লীজ।

- ওয়ার্থলেস! তোমাদের সঙ্গে কোনও রকমের এনরিচিং ইনসাইট শেয়ার করতে যাওয়াটাই ভুল। ব্লাডি ক্লারিকাল মাইন্ডসেট।

Tuesday, July 13, 2021

ক্রিকেটের তুকতাক




নিজের মুখে নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো প্রসঙ্গে ফলাও করে কিছু বলতে চাই না, তাই বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছে৷ তবে তার আগে একটা মিথকে ধ্বংস করা দরকার৷ অনেক প্রাচীনপন্থী কূপমণ্ডূক ক্রিকেট ভক্তদের ধারণা যে ক্রিকেটের যাবতীয় হিসেবনিকেশ তৈরি হয় বাইশ গজ বা তার আশেপাশে; ব্যাট, বল অথবা জিঙ্ক অক্সাইড সহযোগে৷ ব্যাপারটা যে আদৌ সে'রকম কিছু নয়৷ ক্রিকেটে তন্ত্রমন্ত্র এবং তুকতাকের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ না না, আমি খেলোয়াড়দের মাদুলি বিশ্বাসকে পাত্তা দিচ্ছি না, ব্যাট আর বল ছাড়া সত্যিই তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই৷ কিন্তু সমর্থকদের তুকতাক যে যে কোনও ম্যাচের ভোল পালটে দিতে পারে; এ অমোঘ সত্য যে অস্বীকার করে তার মাথায় পড়ুক বাজ, বিরিয়ানিতে পড়ুক নকুলদানা, ইত্যাদি৷ কেউ এক চেয়ারে সাড়ে চার'ঘণ্টা ঠায় বসে থেকে প্রিয় দলের ফলো-অন আটকান, কেউ একটানা পেনিসিল চিবিয়ে উইকেট ফেলে দেন, কেউ টিভির সামনে থেকে উঠে গিয়ে নিজেকে শহিদ করেন রিকোয়্যারড রান রেট সামাল দিতে, কেউ আবার নিজের প্রিয় ব্যাটার অপয়া সংখ্যক রানে পৌঁছলে "সরি লেনিনদা" বলে গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে থাকেন ফাঁড়া কাটানোর জন্য৷ আর আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ'সব তুকতাকেই আদত এস্পারওস্পার ঘটে; মাঠের খেলোয়াড়রা স্রেফ দাবার ঘুঁটি৷

এক একজনের তুকতাকের অস্ত্র এক এক রকম৷ অর্জুন গাণ্ডিব দিয়ে মাঠ কাঁপালে ভীমের পছন্দ গদা৷ আর ক্রিকেট সমর্থক হিসেবে আমি চিরকাল ব্যবহার করে এসেছি Pessimism বা নৈরাশ্যবাদ। ভারী কাজের জিনিস, যেমন ধারালো তেমনি, তেমনি কাব্যিক৷ ফিলোসোফিটা বেশ সোজাসাপটা,  ভবিতব্যের কাছে এমন নাকিকান্না জুড়তে হবে যে ভবিতব্য নিজেই ঘাবড়ে গিয়ে ভুলচুক করে ফেলবে৷ ক্রিকেটিয় নৈরাশ্যবাদ নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে আমি বহু যুদ্ধে উতরে দিয়েছি৷ তার জন্য কোনও রকম অমরত্ব বা খ্যাতির প্রত্যাশা বা দাবিদাওয়া আমার নেই৷ একজন ক্রিকেট সৈনিক হিসেবে আমার কাজ শুধু লড়ে যাওয়া, মাঠের এগারোজনকে জেতাতে পারলেই আমি তৃপ্ত৷ আপনার প্রশ্ন করতেই পারেন, পেসিমিজমের যদি অতই তেজ হবে, তা'হলে ভারতীয় ক্রিকেট সব ম্যাচে জিততে পারে না কেন? উত্তরটা একটু ঘুরিয়ে দিতে হবে, শচীন তেন্ডুলকার সব ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে পারেনি বলে তো তাঁর স্কিলসেটকে উড়িয়ে দেওয়া যায়না৷ 

নৈরাশ্যবাদ ব্যাপারটা ঠিক কেমন ভাবে ক্রিকেট তুকতাকে সাহায্য করে? বুঝিয়ে বলতে হলে ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালের অভিজ্ঞতাটা ঝালিতে নিতে হয়৷ ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই প্রবল নাকিকান্নায় দুনিয়া ভাসিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছিলাম। "ইন্ডিয়া ফাইনালে বরাবর হারে, ইংল্যান্ডের হোম-অ্যাডভান্টেজ, আমার বাঁ হাতের কনুইতে একটা সুড়সুড়ে অস্বস্তি, খেলা শুরুর আগেই আমি পান্তুয়া খেয়ে ফেলেছি আর আমি পান্তুয়া খেলেই ইন্ডিয়া হোঁচট খেয়ে পড়ে", ইত্যাদি ইত্যাদি৷ প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ড যখন কয়েক হাজার রান (ওই তেমনই কিছু একটা মনে হয়েছিল) তখন অবশ্য নাকিকান্নার নেকুপনা ঝেড়ে ফেলে বুক বাজিয়ে হাহাকার করতে পেরেছিলাম; "এরা খেলতে যায় কেন? ইংল্যান্ডে না গিয়ে কিনিয়ায় গেলেই পারত! ভাগ্যিস ওয়ানডেতে ইনিংস ডিফীটের গল্প নেই৷ আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি ভারত দু'শোর কমে বান্ডিল হবে" ইত্যাদি ইত্যাদি। 

ওই হাহাকারের জেরে যে'টা হল সে'টা হল ভারত ব্যাট করতে নেমে দিব্যি শুরু করল৷ সৌরভ দিব্যি স্টেপআউট করছে, আর কনেক্ট করছে৷ ব্যাস, আমি ধুন্ধুমার চালু করে দিলাম; "এ বাবা, ক্যাপ্টেন হিসেবে কোনও সেন্স নেই? এমন আনতাবড়ি চালাচ্ছে? আর এমন ল্যালল্যাল করে চালাচ্ছে কেন? আমি চ্যালেঞ্জ করব বলতে পারি এখুনি আউট হবে"।    শেওয়াগও ফুরফুরে মেজাজে খেলতে শুরু করেছে৷ দশটি ওভার পার, ছয়ের ওপর রানরেট৷ আমি ডোজ বাড়িয়ে দিলাম; "শেওয়াগের কোনও গেমসেন্স আছে নাকি? ধুর ধুর৷ এই ডোবালো, আমি লিখে দিচ্ছি"৷ চোদ্দ ওভার নাগাদ একশো উঠে এলো৷ ব্যাট সৌরভ-শেওয়াগের হাতে কিন্তু চালিয়ে খেলতে হচ্ছে আমাকেই৷ সাধ্যমত চেষ্টাও করছিলাম, গলা চড়িয়ে বললাম "গেমপ্ল্যানের অভাব। স্পষ্ট দেখতে পারছি"। কিন্তু এত করেও গোলমালটা রোখা গেল না৷ 

সৌরভ আউট হল দলের ১০৬ রানে। ১১৪য় শেওয়াগ। ১২৬য়ে দীনেশ মোঙ্গিয়া৷ আমি হাঁ, মাথা ফাঁকা৷ দ্রাবিড় আর শচীনকে খেলাতে হলে পেসিমিজমের বন্যা বইয়ে দিতে হবে, কিন্তু কোমর বেঁধে 'সব জলে গেল, ডকে উঠল, অক্কা পেল' বলে কাঁদুনি গাওয়ার আগেই দু'টো খতরনাক থাপ্পড়; ১৩২য়ে দ্রাবিড় গায়েব আর ১৪৬য়ে শচীন হাওয়া৷ কে এক পাড়ার পুজোর চাঁদা তোলা ছোকরা রনি ইরানি আর  জাইলস মিলে সব গুলিয়ে দিল। 

বুক ভেঙে চুরমার৷ সামনে টিভি চলছে, বাবা হতাশায় পায়চারি করছে, মা বলে চলেছে " নতুন ছেলে দুটো কী সুন্দর খেলছে, দ্যাখ"৷ আমার সব কিছুতেই বিরক্ত লাগছে৷ ঘরের পর্দার খয়েরী রঙ দেখে বিরক্তি, বাবার পায়চারীতে বিরক্তি, মায়ের একের পর এক প্রশ্নে বিরক্তি (যুবরাজ বোধ হয় আমাদের বাপতুর বয়সী হবে, তাই না? কাইফকে দেখেই মনে হয় খুব শান্তশিষ্ট,  তাই না? লর্ডসেই সৌরভ প্রথম সেঞ্চুরিটা করেছিল না)। পরে বুঝেছিলাম, আমার যেমন নৈরাশ্যবাদ, মায়ের ক্রিকেট তুকতাকের অস্ত্র হল লাখ লাখ কোটি কোটি প্রশ্ন৷ আর বাবার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট হয় পায়চারিতে। তা মায়ের প্রশ্নের স্টেনগান আর বাবার সতেরোশো মাইল হাঁটাহাঁটির ফলে ভারত ২০০ পেরিয়ে গেল৷ যুবরাজ আর কাইফ সেট। 

আমি নড়েচড়ে বসলাম৷ বুকে সামান্য আশার আগুন জেগে উঠেছিল, তড়িঘড়ি সে আগুনের ওপর গ্যালন গ্যালন পেসিমিজমের জল না ঢাললেই নয়৷ 
"আরে ধুর ধুর, শচীন দ্রাবিড় গেল তল, যুবরাজ কাইফ বলে কত জল"।
" বড়জোর আড়াইশো করবে৷ গোহারান হারটা রুখে দেবে। লজ্জাটা একটু কম হবে৷ এ'টাই যা"।
"যুবরাজের ডিফেন্সে প্রচুর ফাঁকফোকর৷ আর কাইফের হাতে বড় শট আছে বলে মনে হচ্ছে না"। 

একসময় যুবরাজের হাফসেঞ্চুরি হল, ভারতের জিততে একশো'র কম রান দরকার৷ " জলে জলে, সব জলে"; আমার ফেভারিট ডায়লগ। এক কথায় সব উড়িয়ে দেওয়া যায়৷ 

আড়াইশো পেরোল। কাইফের পঞ্চাশও হল৷ "ধুর ধুর, এই গেল বলে৷ এ'সব সিচুয়শনে নাসের হুসেন ম্যাচের রাশ আলগা হতে দেবে ভেবেছ? এই ফাইনাল হুসেনের পকেটে রাখা মানিব্যাগে- পুজোর ফুল, ট্রেনের মান্থলি আর অফিসের আইকার্ডের পাশেই রাখা আছে৷ 

যা হওয়ার তাই হল৷ মাখনে ছুরি চালাতে চালাতে আচমকা সে ছুরি বুকে উঠে এলো; যুবরাজ আউট, কলিংউডের খুচরো বোলিংয়ে৷ 

"কফিনে শেষ পেরেক", ডিক্লেয়ার করলাম। বাবা ফের সোফা ছেড়ে উঠল৷ মা প্রশ্নে ফিরে গেল, " যুবরাজ সত্যিই আউট হয়ে গেল রে? যুবরাজ কি কাঁদছে"? 

এরপর গোটা ব্যাপারটাই একটা ঝড়ের মত ঘটে গেল৷ উত্তেজনা যত বাড়ছে, আমি তত পেসিমিজমের গুঁতোগুঁতি চালিয়ে যাচ্ছি৷ 

কাইফের ওভারবাউন্ডারি৷ ঘ্যাম কভার ড্রাইভ৷ গফ ঘেঁটে ঘ৷ জিততে হলে পঞ্চাশেরও কম দরকার। আমি বলে চলেছি, "এর চেয়ে কোনও মেগা সিরিয়াল দেখলে ভালো হত"। 

কাইফ চালিয়ে খেলছে৷ লোয়ার অর্ডারে হরভজনও টুকটাক চমকে দিচ্ছে৷ আমি দূর্গ আগলে রেখেছে, "আচ্ছা ডোবালে দেখছি এরা"৷ 

স্যাটাস্যাট হরভজন আর কুম্বলে আউট৷ হাতে হারাধনের দু'উইকেট৷ তবে রানও বেশি নয়, খান বারো৷ কাইফ ততক্ষণে বলের বদলে চালকুমড়ো দেখছে৷ কিন্তু আসল দায়িত্ব তখন আমার কাঁধে; পেসিমিজমের স্লগওভার। 
"তিনশো করেছে এই অনেক"। "জাহির আবার ব্যাট ধরতে শিখলো কবে"। "আর দেখে হবেটা কী৷ চ্যানেল ঘোরাও বাবা, নিউজ দেখা যাক"। 

ওই যে বললাম। হাইক্লাস নাকিকান্নায় ভবিতব্যকে দিব্যি টলানো সম্ভব৷ ওভারথ্রোয়ে শেষ রান তুলে নেওয়ার আড়াই সেকেন্ড আগে পর্যন্ত বলে গেলাম, " ইম্পসিবল। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি হারছি৷ বন্ড পেপারে লিখে দিতে পারি দরকার হলে"৷

ভালো পার্ফর্মেন্সের মূলে রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন মনসসংযোগ ; ক্রিকেট তুকতাকও একটা পার্ফর্ম্যান্স। সৌরভ যখন জামা খুলছে তখনও আমি বিড়বিড় করে বলে চলেছি, "স্কোরবোর্ডটা ঠিকঠাক চলছে কিনা কে জানে৷ বলা তো যায় না, যদি কিছু ভুলচুক হয়ে থাকে"৷ আর মায়ের প্রশ্ন সিরজিও তখনও থামেনি, "এহ হে, খালি গায়ে ও'ভাবে হাওয়া লাগাচ্ছে?  বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে না তো"?

Monday, July 12, 2021

সাফ টেবিল



অফিসে একটা জমজমাট প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। "সাফ টেবিল প্রতিযোগিতা"। সবচেয়ে জমাটি ব্যাপার হল যে এ খেলায় আলাদা করে খেলতে নামার সুযোগ নেই, বিচারকরাই এক্ষেত্রে মাঠে নেমে দাপাদাপি করে থাকেন। বিনা নোটিশে তাঁরা ঘুরে ঘুরে সবার অফিস ডেস্ক জরীপ করে নম্বর দেবেন। কার টেবিলে জঞ্জাল কম, কে সমস্ত কাগজপত্র মনিকা-গেলার-গোছের হাড়-জ্বালানো জ্যামিতিতে সাজিয়ে রেখেছে, কে আবার বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে অনাবিল টবে বাহারে পাতার ছোট্ট গাছ সাজিয়ে রেখে। আচমকা যখন বিচারকরা হেলতেদুলতে আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন তখন আমার টেবিলে তখন আস্ত চিৎপুর বাজার উপুড় হয়ে রয়েছে। অন্তত খান পাঁচেক ফাইল ছড়িয়েছিটিয়ে, সবক’টাই খোলা। এ ছাড়া একটা পেন স্ট্যান্ড যে’টার মধ্যে সাতটা কলমের ঢাকনি আর একটাও পেন নেই। সতেরো রকমের তার টেবিলের নীচে ওপরে জড়াজড়ি করে পড়ে। গাছপালা নেই তবে দু’তিনটে প্রিন্টআউটের মরা বাঁশ শুয়ে পড়ে আছে অযত্নে। এ ছাড়া একটা ঢাউস টিফিনবাক্স, দু’টো জলের বোতল, একটা ব্যাকপ্যাক, দু’টো স্টেপলার আর দু’টো পিনের বাক্স (কিন্ত স্টেপলারে পিন ভরা নেই, প্রতিবার স্টেপল করার দরকার হলেই ভাবছি এইবারের মত কমন প্রিন্টারের কাছে বেঁধে রাখা স্টেপলার ব্যবহার করে কাজ চালিয়ে নিই, তারপর না হয় স্টেপলারে পিন ভরে নেওয়া যাবে'খন), একটা জেমস ক্লিপের ডিবে (যে’টা বোধ  হয় ১৯৯৭ সাল থেকে এই টেবিলে পড়ে রয়েছে কিন্তু কেউই তাদের ব্যবহার করে উঠতে পারেনি), দু’টো টেবিল ক্যালেন্ডার (একটা গত বছরের, সরানো হয়নি। অন্যটা এ বছরের কিন্তু মার্চের পর থেকে পাতা পালটানো হয়নি), একটা হলুদ আর একটা কমলা হাইলাইটার (কমলা হাইলাইটারের মাথায় হলুদ খাপ আর হলদের মাথায় কাঁচকলা)। একটা বদখত সাইজের ডায়েরি, সে'টাও আধখোলা। আর কিউবিকেলের একদিকে সাঁটানো রঙবেরঙের অজস্র স্টিকি-নোটস (সে স্টিকি-নোটে যেহেতু আমার হাতের লেখা, সেহেতু সেগুলোর দিকে আধ-মিনিটের বেশি একটানা তাকিয়ে থাকে ব্লাড-প্রেশার বেড়ে যেতে বাধ্য)। 

প্রথম বিচারক বিহ্বল হয়ে আমার দিকে চাইলেন, বিব্রত হলেও আমায় খানিকটা হাসতে হল। এমন গোলমেলে পরিস্থিতিতে হ্যা-হ্যা করতে পারলে দেখেছি অস্বস্তি খানিকটা কাটানো যায়। খানিকক্ষণ আমার টেবিলের দিকে তাকিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন এক’দুবার। তারপর বললেন; 
“ট্যু ক্লাটার্ড মুকর্জি”! 

অগত্যা আমি হাসির ডোজ বাড়িয়ে দিলাম। দ্বিতীয় বিচারক ভদ্রলোক আমার নার্ভাসনেস ধরতে পেরে খানিকটা নরম ভাবে বললেন,
“ঘাবড়ে যেও না ব্রাদার, আইনস্টাইন মানবজাতীর উদ্দেশ্যে একটা মোক্ষম প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়ে গেছেন। সে’টা জানা আছে তো? If a cluttered desk is a sign of cluttered mind, of what then, is an empty desk a sign”? 

Friday, July 9, 2021

ছিদ্রান্বেষী


লোকজন বড্ড বেশি ছিদ্রান্বেষী হয়ে পড়েছে। কথায় কথায় শুধু খুঁত ধরে গপ্প ফাঁদা। গা জ্বলে যায়। ইচ্ছে করে দি কষিয়ে দু’ঘা। এই সবে একটু বাজারে বেরিয়েছি টপ কোয়ালিটি পাবদা খুঁজতে। সবেমাত্র খান-সাতেক দোকান ঘোরাঘুরি করে পাবদার পাশাপাশি সামান্য চিংড়িও তুলে নিয়েছি। সবে একটু দেশী মুর্গির খোঁজ করব কিনা ভাবতে ভাবতে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা স্পেশ্যাল আদা চা অর্ডার করেছি। সবে ভাবতে শুরু করেছি ফেরার পথে সামান্য রাবড়ি আর জিলিপি নিয়ে ফিরব। এমন সময় নজরে পড়ল; কী বিশ্রী ভিড় বাজারে। 

কী বিশ্রী ভীড়। দেশে আলফা বিটা গামা ল্যাম্বডা আর কত রকমের বিশ্রী করোনা ভ্যারিয়ান্ট নেচে বেড়াচ্ছে অথচ লোকে যেন সাপের পাঁচ দেখে রাস্তায় নেচে বেড়াচ্ছে। এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে, এ ওর সঙ্গে গপ্প জুড়েছে; যেন কল্পতরু মেলা। মাছের দোকানে ভীড়, মুর্গির দোকানে ভীড়, মাংসের দোকানে ভীড়, রাস্তায় অটো আর রিক্সার ভীড় – যাচ্ছেতাই! আরে এ’দিকে দেশে যে প্যান্ডেমিক চলছে সে’বিষয়ে কারুর কোনও হেলদোল নেই। এই ইনডিসিপ্লিনের জন্যই এ দেশের কিস্যু হল না আর হবেও না। অকারণে এত লোকের বাইরে বেরোনোর দরকারটা কী? দিব্যি ভাবলাম ফাঁকায় ফাঁকায় অল্প মাছ আর যৎসামান্য মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাব – কিন্তু তার কি আর উপায় আছে?

চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি পেলাম বটে কিন্তু মনে স্বস্তি ফিরল না। আশেপাশের মানুষজনের ওপর একটা বিশ্রী রাগ তৈরি হচ্ছিল। এমন লারেলাপ্পা পপুলেশন নিয়ে দেশের প্রগ্রেস ঘটবে কী করে? লোকে মাস্কটাও ঠিক করে পরছে না! রাবিশ! এ দেশে দরকার ডিকটেটরিয়াল শাসন। এক্কেবারে কড়া হাতে শাসন না করলে এ সমাজ যে লাটে উঠবে। বিরক্তি যখন চরমে উঠল তখন দু’নম্বর চায়ের কাপের অর্ডার দিয়ে চায়ের দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। খুব খারাপ লাগছিল দেশের এবং দশের কথা ভেবে। এমন অবক্ষয় দেখলে মাস্টারদা বড় কষ্ট পেতেন, সুভাষবাবু বোধ হয় লজ্জায় প্লেন থেকে স্বেচ্ছায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন; অবশ্যই মাস্ক পরে তবে প্যারাসুট ছাড়া। গান্ধীজী সুতো বোনা ছেড়ে আনমনে চরকায় তেল দিয়ে যেতেন শুধু। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে। 

ভাবনার মধ্যে সবে একটা পোয়েটিক ফ্লো এসেছে, এমন সময় অনিরুদ্ধর সঙ্গে দেখা। ছোকরা আমার চেয়ে বয়সে ছোট, একসময় আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকত। ভারী মুখচোরা ছিল এক সময়। তবে বাবুটি এখন লায়েক হয়েছেন, কী’সব এনজিওর সঙ্গে মিলেমিশে এদিকওদিক ফোঁপরদালালি করে বেড়ায়। কথায় কথায় ডোনেশন চায় বলে আমি সচরাচর এড়িয়ে চলি। কিন্তু আজ এক্কেবারে দুম করে সামনে চলে এলো, পাশ কাটাতে পারলাম না। 

যেই না “আরে অনি যে” বলে আমি নিজের মাই-ডিয়ার স্টাইলে খেজুর করতে এগিয়ে গেছি, অমনি সে’ব্যাটা ফস করে বলে উঠলে, “এ বিচ্ছিরি সময়ে এমন রসিয়ে মাছের বাজার না করলেই নয় দাদা? আর ভীড়ের মধ্যে নিজে মাস্ক নামিয়ে চা গিলছেন গিলুন, অমন হা-হা করে আমার দিকে এগিয়ে আসার কী আছে। আমি একটা টীম নিয়ে এসেছি এ এলাকাটা ডিসইনফেক্ট করতে। চায়ের দোকানে বসে রকের আড্ডা পরে হবে’খন। আপনিও এ’ভাবে গা এলিয়ে বসে না থেকে বাড়ি ফিরে যান”। 

সাধে কি বলি লোকজন বড্ড বেশি ছিদ্রান্বেষী হয়ে পড়েছে? কথায় কথায় শুধু খুঁত ধরে  আর গপ্প ফাঁদে! আমি সাদা-মনে-কাদা-নেই সাতে-নেই-পাঁচে-নেই মানুষ, অনিরুদ্ধর এমন সব শুচিবাই ডায়লগ শুনে আমার গা জ্বলবে না? যত্তসব!

মিটিংবাজ



কারণে অকারণে মিটিং ডাকাটা একটা রোগ৷ স্যাটাস্যাট কাজকর্ম ফিনিশ হচ্ছে৷ তরতর করে সবকিছু এগোচ্ছে৷ এমন সময় কারুর কারুর মিটিং-মিটিং মনকেমন শুরু হবে। অমনি চারদিকে দৌড়ঝাঁপ৷ সক্কলে সন্ত্রস্ত৷ মিটিং হবে! হাবিজাবি প্রিন্ট আউট বেরোচ্ছে, দুদ্দাড় করে কেউ এজেন্ডা দাঁড় করাচ্ছে, কেউ কফি বিস্কুটের অর্ডার দিচ্ছে, কেউ "উই মাস্ট বি অন টাইম" বলে খামোখা চেল্লামেল্লি করছে, কেউ "আমি তাহলে ভোট অফ থ্যাঙ্কসটা দেব'খন"? বলে নব্য-কফিহাউস কবি মাফিক মিউমিউ করছে;মিটিং হবে! এককথায় রথের মেলা বসে যাবে৷ অবশ্য নিউনর্ম্যাল জমানায় আবার কনফারেন্স রুম ঝেড়েপুছে সাফ করারও দরকার পড়েনা৷ সোজা জুম লিঙ্কের চাক্কুতে এফোঁড়ওফোঁড়৷ মোদ্দা কথা হল মিটিং শুনলেই পাবলিককে বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে ইয়ারবাড হাতে যুদ্ধ শুরু করতে হবে৷ 

"ওগো শুনছো" দিব্যি পাশ কাটানো যায়৷ কিন্তু মিটিংয়ে আপত্তি মহাপাপ৷ কাজকর্ম দু'চার আনা কম-বেশি হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু মিটিং ডেকে মার্তণ্ড-মার্তণ্ড-মার্তণ্ড স্টাইলে এক্সেলেন্স-এক্সেলেন্স-এক্সেলেন্স না করলে দুনিয়াটাই জলে। 

আর আউটপুট? যে কথা দিব্যি ফোন করে আড়াই মিনিটে সেরে নেওয়া যায়, তার জন্য বসবে আড়াই ঘণ্টার মোচ্ছব৷ ব্রেন-স্টর্মিং- অর্থাৎ একে অপরকে রকমারী কর্পোরেট ক্লীশের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে শায়েস্তা করা৷  আড়াই ঘণ্টা ধ্বস্তাধস্তিতে সেই আড়াই মিনিটের সহজ-সরল ব্যাপারটা এমন গুবলেট হবে যে আগামী আড়াই হপ্তাতেও সে জট ছাড়বে না; মিটিংয়ের সার্থকতা সেখানেই৷

বর্ষা



- বৃষ্টিফৃষ্টি না নামলে যে আর পারা যাচ্ছে না..। যা গরম, উফ!

- বৃষ্টির কী দরকার? এইত্তো, দিব্যি বর্ষা এসে গেছে৷ গরম গন্।

- বৃষ্টি ছাড়াই বর্ষা এসে গেছে?

- টোটালি৷ আজ থেকে আমার বর্ষা শুরু৷ জমিয়ে বৃষ্টির গানটান শুনব৷ ডার্মিকুলের বদলে পন্ডস পাউডারে ফেরত যাব৷ মাথায় নবরত্নের বদলে কেয়োকার্পিন৷

- বৃষ্টি নামল না, এ'দিকে তুমি বর্ষা অ্যানাউন্স করে দিলে? নিজের মর্জিমত টেম্পারেচারকে কাঁচকলা দেখানো? গরমকে অগ্রাহ্য করা?

- আজ বাড়িতে সিজনের প্রথম ইলিশ এসেছে৷ কাজেই মনসুন ইজ হিয়ার৷ ও'সব টেম্পারেচার ক্যালেন্ডার বা ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখিয়ে এই ক্লাসি মেজাজকে বাগে আনার চেষ্টা কোরো না৷

লুচিবাজ



- বুঝলে ব্রাদার..।

- ফের নেশা করে এসেছেন বিধুদা? মেসের পরিবেশ এ'ভাবে..।

- আহ...নেশা নয়৷ আমায় কি তুমি মাতাল পেয়েছ? পোয়েটিক ইন্সপিরেশন।

- তা কী বলছিলেন..?

- বলছিলাম ব্রাদার..রাত দু'টো সময় লুচির কথা মনে পড়লেই ক্যালামিটি৷

- খিদে পেয়েছে? এক বাক্স খাজা আর এক ডিবে মুড়ি স্টকে আছে৷ চলবে?

- টেস্ট ম্যাচের জন্য মন আনচান হচ্ছে বলে কি লুডোর বোর্ড পেতে বসবে ব্রাদার? 

- যেহেতু খিদে পেয়েছে আপনার..।

- মাঝরাত্তিরে লুচি লুচি মনকেমনের জন্য খিদের কী দরকার। 

- তা বটে।

- ভারী ডেঞ্জারাস সেই লুচি লুচি মনকেমন ব্রাদার৷ ভারী ডেঞ্জারাস৷ প্রেমট্রেমের ব্যথা রাতবিরেতে বুকে ধাক্কা দিলে তাও ট্রীটমেন্ট আছে৷ আফটার হল হৃদয় ইজ হাইলি ধুরন্ধর। খানিকক্ষণ কিশোরকুমার শুনে বা ছাতে পায়চারি করে প্রেমের হুহুকে বাগে আনা যায়৷ বাট দ্য বাগ অফ লুচি ইজ মার্ডারাস বিকজ নোলাকুমার হৃদয়বাবাজীর মত হিসেবি নয়৷ নোলা হলো বাউল..কখন আলুথালু হয়ে ভেসে যাবে..কেউ বলতে পারে না৷

- আপাতত তা'হলে ক্র‍্যাশ করুন৷ কাল সকালে লুচি না হোক, সুরভী সুইটসের কচুরি আর ছোলার ডালের ব্যবস্থা করা যাবে। 

- তুমি ছিলে তাই এই কেঠো মেসবাড়িটাকেও সংসার মনে হয় ব্রাদার। যাক, কাল সকালের কচুরির দায়িত্ব তোমার৷ আর আজ রাত্রে কিশোরকণ্ঠী হয়ে আমিই তোমার শুশ্রূষা করি বরং। 

- এর মানে?

- বললাম তো৷ আমার লুচি হাহাকারের কেসটা মেজর৷ সে আনচান সামাল দেওয়া যাবে না৷ কিন্তু তোমার হৃদয়-ভাঙচুরটা খানিকটা মেরামত করতে পারব, গান গেয়ে৷ চলো ছাতে৷ পায়চারিও হবে, কিশোরকুমারের গানও হবে। 

- আমার হৃদয়-ভাঙচুরের সমাচারটা আপনাকে কে দিল? মন্টু?

- নিজের সংসার। খবর না রেখে উপায় আছে? তবে ভেবো না৷ হিল্লে হয় যাবে। প্রেমই তো ভেঙেছে, রাতবিরেতে লুচির জন্য তো বুক ফাটছে না৷

লোনের ফোনে



- হ্যালো।
- নমস্কার। আমি কি মিস্টার দত্তর সঙ্গে কথা বলছি?
- হ্যাঁ। বলছি। আপনি?
- আমি অমুক ব্যাঙ্ক থেকে দীপিকা বলছি। 
- বলুন।
- স্যার, আপনি আমাদের ব্যাঙ্কে একটা লোনের জন্য আবেদন করেছিলেন।
- হ্যাঁ।
- লোনের জন্য আমাদের ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করার জন্য ধন্যবাদ স্যার। আমি কি আপনার মূল্যবান সময় থেকে দু'মিনিট নিতে পারি?
- কেমন একটা অদ্ভুত বাংলায় বললেন যেন। তবে সময়ের ব্যাপারে কোনও চিন্তা নেই। বাড়ির ওয়াইফাই ভোগে, হাতে অঢেল সময়। বলুন। 
- আপনি গত মাসের বাইশ তারিখে লোনের জন্য আবেদন করেছিলেন। তাই তো?
- একদম।
- অমুক ব্যাঙ্কের তরফ থেকে মিস্টার মনোজ হালদার আপনার সঙ্গে কথা বলছিলেন৷ 
- রাইট। ভেরি ব্রাইট ফেলো, বলতেই হয়। মাত্র তিনচারটে ফর্ম কুড়ি মিনিটের মধ্যে ভরে নিয়ে সমস্ত প্রসেস করে নিল। প্রম্পটনেস একেই বলে। 
- অমুক ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপন দেখেছেন নিশ্চয়ই। নিয়ম পরে, গ্রাহকদের সুবিধে আগে।
- বিউটিফুল।  এ'টাই তো চাই। এক হপ্তার মধ্যেই লোন এলিজিবিলিটির কনফার্মেশন ইমেলও পেয়ে গেছি। আমি যাকে বলে সুপার ইম্প্রেসড।
- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। তাহলে আপনি আমাদের সার্ভিসকে এক থেকে পাঁচের মধ্যে কত নম্বর দেবেন? 
- সাড়ে পাঁচ।
- মাফ করবেন স্যার। আপনাকে এক থেকে পাঁচের মধ্যেই একটা সংখ্যা বেছে নিতে হবে।
- ইট ওয়াজ আ জোক৷ অবভিয়াসলি৷ আমার তরফ থেকে আপনাদের সার্ভিসের জন্য রইল পাঁচে পাঁচ। 
- অনেক ধন্যবাদ স্যার৷ এ'বারে ব্যাঙ্কের তরফ থেকে একটা জরুরী তথ্য আপনাকে জানাত চাই। 
- লোনের টাকাটা অ্যাকাউন্টে ঢুকছে বুঝি? তা'হলে সামনের হপ্তার মধ্যেই বাড়ির রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলা যাবে।
- ঠিক তা নয়...।
- তবে?
- আপনার লোনের আবেদনটা নাকচ হয়ে গেছে। 
- কী?
- রিজেক্টেড, স্যার।
- সে কী! তবে সেই লোন এলিজিবিলিটির ইমেল? 
- আপনার আশা পূরণ করতে বা পারার জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্তু আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব..।
- আবার সেই খটমটে বাংলা। যাক গে। ইমেলে ভুল খবর? আপনি জানেন আমি আপনাদের নামে কেস ঠুকতে পারি?
- কেসের বিষয়ে কোনও কথা বলতে হলে আপনাকে আমাদের লীগাল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
- বেশ! আপনি তা'হল সেই লীগ্যাল ব্যাটাদের জানিয়ে দেবেন যে গোলক দত্ত ব্যাঙ্কের নামে কেস ঠুকবে।
- লীগাল ডিপার্টমেন্টকে তো আমরা জানাতে পারব না স্যার।    সে নিয়ম নেই।
- আপনাদের লীগাল টীমের সঙ্গে যোগাযোগ কী'ভাবে করব?
- মাফ করবেন স্যার। গ্রাহক হিসেবে আপনি শুধু আমাদের কাস্টোমার রিলেশন টীমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। 
- ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি? উকিলের চিঠি যখন যাবে তখন বুঝবেন। 
- অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে উকিল বা আইন সম্বন্ধে কোনও কথা বলতে হলে আপনাকে..।
- আপনাদের লীগাল ডিপার্টনমেন্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে?  সেই ডিপার্টমেন্ট যাদের সঙ্গে গ্রাহকদের যোগাযোগ করার নিয়ম নেই?
- আপনাকে সমস্ত কিছু স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই এই কাস্টোমার সার্ভিস কল। 
- ধেত্তেরি মাইরি। আমার লোনের অ্যাপ্লিকেশন রিজেক্ট হল কেন?আমার গ্যারেন্টর রিলায়েবল নয়?
- না, সে'খানে কোনও সমস্যা নেই।
- আমার মাইনে যথেষ্ট নয়? সে জন্য আমি এলিজিবল নই?
- আপনাকে তো ইমেল করে জানানো হয়েছে যে আপনি লোনের জন্য এলিজিবল। ইমেল রেফারেন্স নম্বর একুশ ড্যাশ এস তিন বাই এস এক্স ফিফটি থ্রি বাই রোমান সেভেন ডেটেড সাতাশে জুন দু'হাজার একুশ। 
- তা'হলে লোনটা নাকচ হচ্ছে কেন?
- কারণ আপনার আবেদনপত্রটা সঠিকভাবে ভরা হয়নি। 
- সে কী! ফর্মে কিছু ভুল লিখেছি?
- না স্যার৷ আপনি ফর্মে কিছু ভুল লেখেননি। সে জন্যই তো ব্যাঙ্কের তরফ থেকে আপনাকে এই লোনের জন্য এলিজিবল ঘোষণা করে ইমেল করা হয়েছে।  বিশদে জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে ইমেল রেফারেন্স নম্বর একুশ ড্যাশ এস তিন বাই এস এক্স ফিফটি থ্রি...।
- আরে থামুন! তা'হলে গোলমালটা হল কোথায়? এলিজিবল হয়েও লোন পাচ্ছি না কেন?
- কারণ আপনার ফর্মে লিখতে গিয়ে সামান্য ভুল করেছেন আপনার অমুক ব্যাঙ্ক রিলেশনশিপ ম্যানেজার মিস্টার মনোজ হালদার!
- আচ্ছা হতচ্ছাড়া তো। তা সে যদি ভুল করে থাকে তো তার কান মুলে শুধরে নিলেই হয়। 
- সে'টা সম্ভব নয়। 
- কেন?
- কারণ মনোজ হালদার অমুক ব্যাঙ্কের চাকরী ছেড়েছেন গত পরশু। ব্যাঙ্কের কোনও ফর্ম তাকে দেওয়া আর সম্ভব নয়। অতএব, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আপনার হোম লোনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে। 
- কী মুশকিল। জলে পড়ব যে। বাড়ি কেনার সমস্ত কথাবার্তা পাকা। আরে মনোজ নেই তো অন্য কাউকে দিয়ে আর একটা ফর্ম ভরিয়ে নিলেই তো হয়..। কুড়ি মিনিটের তো ব্যাপার..। আমি নিজে না হয় আপনাদের ব্যাঙ্কে চলে যাব..।
- মাফ করবেন স্যার। আমাদেত অমুক কোনও ব্যাঙ্কে লোনের আবেদন নাকচ হলে আগামী ছ'মাস আপনি নতুন কোনও লোনের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। এ'টাই নিয়ম। 
- আমি আপনাদের কোর্টে নিয়ে যাব! বলে রাখলাম।
- কোর্ট, উকিল, কেস; এ সমস্ত ব্যাপারে শুধু আমাদের লীগাল টীম কথা বলতে পারে। আমি অপারগ স্যার। তবে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ আমাদের সার্ভিসকে পাঁচে পাঁচ রেটিং দেওয়ার জন্য। আপনার দিন ভালো কাটুক৷ মনে রাখবেন, অমুক ব্যাঙ্ক সবসময় আপনার পাশে রয়েছে।

নতুন বই

*নতুন বইয়ের খবর পাওয়া গেল*

দু'সেকেন্ডের মাথায়ঃ
গুডরীডস ঘেঁটে দেখা বইটা সম্বন্ধে কে কী বলছে।

আড়াই মিনিটের মাথায়ঃ
গুগলে অন্যান্য রিভিউয়ের খোঁজ৷

সতেরো মিনিটের মাথায়ঃ
বন্ধুকে ফোনঃ ওই বইটা পড়েছিস ভাই? কেমন বল দেখি? অমুক বইটার তুলনায় কেমন? তমুক বইটার তুলনায়? তুই নিশ্চিত ভালো? মা কালীর দিব্যি? দ্যাখ! কিনে ফেলছি কিন্তু।

বাইশ মিনিটের মাথায়ঃ
অন্য বন্ধুকে ফোনঃ হ্যাঁ রে ভাই, ভটকাই বলছে বইটা বেশ ভালো৷ ওর কথা বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে কি? অন্যের বোলিংয়ে ব্যাটা একদম মন দিয়ে ফিল্ডিং করত না কিনা..তুই বলছিস বইটা ভালো? সিরিয়াসলি? 

তেত্রিশ মিনিটের মাথায়ঃ
আমাজনে (বা অন্য কোথাও) অর্ডার। 

দু'দিনের মাথায়ঃ
আমাজনের প্যাকেটটা রাক্ষুসে ভাবে ছিঁড়ে ফেলে বইটা বের করে হুড়মুড় করে চার পাতা পড়ে, 
তাকে সাজিয়ে রেখে;
স্নান করতে যাওয়া/হাতের জরুরী কাজ সেরে ফেলা/খেতে বসা। 

আড়াই বছর পরঃ
তাকে রাখা সে বইটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস; সামনের মাসের মধ্যে বইটা পড়ে না ফেললেই নয়৷

রোব্বারের খেদ

এ'বার থেকে ঠিক করেছি রোববার রাত্রে সময়মত শুয়ে পড়ব৷ সোমবার সকালে এক্কেবারে "ফ্রেশ" মেজাজে অফিস-আলো করে না বসলেই নয়৷ যেমন ভাবা তেমনি কাজ৷ 

প্রথমত, চটজলদি ডিনার সেরে নেওয়া৷ রাত নটার মধ্যে৷ 

দ্বিতীয়ত,  দশটার মধ্যে বিছানা পরিপাটি করে শুতে আসা৷ হাতের কাছে জলের বোতল, মশলা জোয়ানের কৌটো।

তৃতীয়ত, রাত পৌনে দুটোয় এসে একটানা অকারণ মোবাইলে স্টিক ক্রিকেট খেলার পাগলামোটা বন্ধ করা।

(অবশ্যই এক রোববার রাতের লেখা)

চতুর্থত, স্টিক ক্রিকেট বন্ধ করে স্টিক টেনিস খেলতে শুরু করা৷

সব চুকেবুকে গেলে



সব চুকেবুকে গেলে, লঞ্চে চড়ে হাওয়া খেতে বেরোনো যাবে।  

সে টিকিটঘর দেশলাই বাক্সের চেয়ে সামান্য বড়।আর সেই টিকিট যেমন সরু, তেমনই পাতলা - সামান্য অসাবধান হলেই  বাবাজী ফুড়ুৎ।  

দাঁড়ানো লঞ্চে হ্যাংলার মত উঠে পড়ার মানেই হয় না। ছুটির বিকেল খরচ হবে রসিয়ে রসিয়ে৷ জেটিতে এসে আগে দরকার এক ঠোঙা ঘটিগরম। সুখা মুখে জেটিতে বসে থাকা মানে ইডেনের গ্যালারিতে বসে এলসিএম জিসিএম কষা- সে অন্যায় ঘটতে না দিলেই মঙ্গল।

লঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেই জেটির ব্যাস্ততা হাওয়া। তখন একটু নজরুল আর অল্প আর ডি বর্মন গুনগুন করা যেতেই পারে। গলায় সুর না থাকলেও, মন এক্কেবারে নিয়মিত রেওয়াজ করা ওস্তাদ। 

মুখে গঙ্গার মিঠে বাতাস, পকেটে পুরনো চিঠি। দু'একটা সস্তা চুটকি মনে পড়ায় হুট করে হেসে ফেলাই যাবে। রোব্বারের বিকেলের জেটির আশ্রয়ে কাউকে তো আর কৈফিয়ৎ দেওয়ার নেই৷ 

একসময়, ও'দিকের ঘাট ছুঁয়ে লঞ্চ ব্যাটা ফের এসে জুটবে। অমনি জেটিতে ব্যস্ততার হাওয়া। লঞ্চে ওঠার মুখেই মোবাইল বেজে উঠবে হয়ত। ফোনার ওপার থেকে অফিসের কোনও তাবড় কর্তা জিজ্ঞেস করবেন, "কোথায় আছ মুকর্জি"?

ঘটিগরম আর নজরুলে পুষ্ট উত্তর যাবে তৎক্ষনাৎ, "জিমে ঢুকছিলাম যে। সানডে এইসময়টা আই ইনভেস্ট ইন মাইসেল্ফ"।

মিটার

- মনটন বেজায় খারাপ ব্রাদার৷

- সে কী! কারণ?

- ঠিক ধরতে পারছি না৷ একজন গোয়েন্দা লাগাতে হবে দেখছি সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে।

- ডিটেকটিভ?

- ফেলু মিত্তিরের সঙ্গে আড্ডা জমাতে পারলে বেশ হত।

- অন্য মিত্তির সাজেস্ট করতে পারি৷ সে মিত্তির কারণটারণ খুঁজে সময় নষ্ট করার বান্দা নয়৷ সোজা মনখারাপ তাক করে ঢিঁশকাও!

- পি সি মিটার নয়? অন্য মিটার?

- এস মিটার৷ শ্যামল মিত্তির৷

ফুটবলিষ্ঠ



- হ্যাঁ রে গুপে, টিভিতে আজকাল কোনও ফুটবল ম্যাচট্যাচ কিছু হচ্ছে নাকি?

-  ফুটবল?

- ফুটবল। 

- ভটকাইদা, তোমার হঠাৎ ফুটবলের খবরে কী দরকার?

- ফুটবল কি জাহাজ? আমি কি আদার বিজনেস করছি?

- তেমনটাই তো জানি। সে'বছর পাড়ার মাঠে হঠাৎ ফুটবল খেলতে নেমে গোলকিপারের এগেন্সটে লেগ বিফোর উইকেটের অ্যাপীল করে রেফারি স্বদেশ জ্যেঠুর গাঁট্টা খেয়েছিলে মনে নেই?

- আরে ওটা রিফ্লেক্সে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল। তবে ফ্র‍্যাঙ্কলি বলি গুপে, খেলতে নেমে অমন গায়ে পড়াপড়ি আমার ধাতে সয় না৷ যাকগে, আমি ফুটবল খেলতে চাইছি না৷ দেখতে চাইছি।

- কিন্তু হঠাৎ ফুটবল দেখার শখ হলই বা কেন? ও'দিকে তোমার আদৌ কোনও ইন্টারেস্ট আছে কি? কোনও ফুটবলারকে চেনো?

- আলবাত চিনি। পেলে। মারাদোনা। কৃশানু।  মেসি। চীমা। গোষ্ঠ পাল। 

- বাহ্। তা, নিয়মিকানুন সব জানা আছে?

- গোল দেওয়া আর খাওয়া। মাঝে এন্তার ধ্বস্তাধস্তি। কুস্তির আবার নিয়মফিয়ম কী? আর তোর অত কৈফিয়তেই বা কাজ কী? এ'বার থেকে ফুটবল দেখব। ব্যাস। 

- ইউরো চলছে। কোপ আমেরিকা চলছে। লট অফ ফুটবল অন টেলিভিশন। 

- এ তো চেনা সব টুর্নামেন্টের নাম। লাভলি। বলছি, রোনাল্ডো এখনও খেলে?

- সুপারস্টার তো। 

- এই বয়সেও খেলতে পারছে? হাড়ে জোর আছে বলতে হবে। টাকটা মেন্টেন করছে না চুল বাগিয়েছে?

- টাক? তুমি কি ব্রাজিলের রোনাল্ডোর কথা বলছ?

- অফ কোর্স। ফুটবলের থাম্বরুল তো দুটোই। ব্রাজিল জিন্দাবাদ। ইস্ট বেঙ্গল হিপ হিপ হুররে। 

- পর্তুগালের রোনাল্ডো এখন মাঠ কাঁপাচ্ছে ভটকাইদা। নট দ্য ওয়ান ফ্রম ব্রাজিল। 

- দেশ পালটে ফেললে? কেপলার ওয়েসলসের মত? 

- উফ! না রে বাবা। এ আলাদা রোনাল্ডো।

- স্ট্রেঞ্জ৷ এ যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়াসিম। ফ্যাসিনেটিং। ঠিক আছে৷ কিছুটা পড়াশোনা করতে হবে দেখছি।

- অত সাতপাঁচ না ভেবে ম্যাচ দেখে ফুর্তি করলেই তো মিটে গেল৷ পড়াশোনা করার দরকারটা কী? এ তো এগজ্যামিনেশন নয়। 

- ও মা। আকাটের মত দেখে হাততালি দিলে ফেসবুকে লিখব কী করে গুপে? খেলায় গোলটোল হলে শক্তির পোয়েট্রি কোট করে এসোটেরিক একটা কিছু বলে দেওয়াই যায় অবশ্য৷ তবু..।

- তুমি হঠাৎ ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবল নিয়ে পড়লে কেন বলো তো?

- টেস্ট ফাইনালের হারটা ডাইজেস্ট করতে পারছি না রে ভাই৷ উইলিয়ামসনের ভালোমানুষ মুখটা মনে করে মনের মধ্যে "খেলায় হারজিত আছেই, স্পিরিট ইজ ইম্পর্ট্যান্ট" গোছের স্লোগান তোলার চেষ্টা করছি বটে...কিন্তু প্রাণে সইছে না। অন্য স্পোর্টসে ডাইভার্সিফাই না করলেই নয়৷

- তুমি ক্রিকেটের দুঃখে ফুটবল দেখবে?

- তেমনটাই ইচ্ছে। তবে আরও একটা ব্যাপার আছে বুঝলি৷ হোয়্যাটস্যাপ গ্রুপগুলোতে আজকাল এত ফুটবল আলোচনা আর তর্ক চালাচ্ছে শালা ফুটবল পাগলের দল, সামান্য ফুটবল এ'বার না দেখলেই নই। খেলা বুঝেটুঝে কাজ নেই, কিন্তু স্রেফ ইনফর্মেশনের অভাবে তর্কে পার্টিসিপেট করব না...এ যন্ত্রণা বরদাস্ত করা যায় রে গুপে? অসম্ভব!

পলাশী



তেইশে জুন ১৭৫৭, পলাশী। বাঙালা এবং ভারতের হাহাকার, কান্নাকাটি, হায়-হায়-এ-কী-হল, ইত্যাদি।  

ওদিকে ব্রিটেনে ফুর্তির ঝড়। 
কোম্পানির পৌষমাস। 
আর রবার্ট ক্লাইভের পৌষ ম্যাক্স আল্ট্রা। আন্ডার দ্য টেবিল বেশ টু-পাইস বাগিয়ে বিলেতে ফিরলেন। সে টাকা নির্বিচারে উড়িয়ে পার্লামেন্টের সীটও  বাগালেন। আয়ার্ল্যান্ডে নিজের এস্টেটের নাম দিলেন - পলাশী (Plassey)। 

ক্লাইভের সেই বিলিতি পলাশী রয়েছে লিমেরিক কাউন্টিতে। লিমেরিক নামটায় সামান্য দাঁড়াতে হল। বহু বিষয়ের মত কবিতা-টবিতার ব্যাপারেও আমার অজ্ঞতা সুগভীর। তবে লিমেরিক ব্যাপারটা ফেলুদার মুখে শুনে বেশ মুচমুচে লেগেছিল। 

তাই হত্যাপুরীতে জটায়ুকে নিয়ে লেখা সেই লিমেরিক এ'দিক ও'দিক করে  দিয়ে দিলামঃ

বুঝে দ্যাখো ক্লাইভের বরাতের জোর
ঘুরে গেল ইতিহাস, এলো কলি ঘোর
ট্রেটার যেদিকে যারা
পকেটে নোটের তাড়া
কোম্পানি  মসনদে, নবাবী নো-মোর।

(২৬ জুন ২০২১, ফেসবুকে পোস্ট করা)

Thursday, July 1, 2021

দ্য রেস অফ মাই লাইফ



গতকাল পড়লাম এই বইটা৷ এর বছরখানেক আগে লোপেজ লোমংয়ের একটা দুর্ধর্ষ আত্মজীবনী পড়েছিলাম, সে'টাও এক অদম্য অ্যাথলিটের গল্প। কিন্তু সে জীবনীতে রীতিমতো উপন্যাসের মশলা ছিল৷ গৃহযুদ্ধ,  রাজনীতি,  খিদের জ্বালা; সব মিলে টানটান৷ প্রবল মনকেমনের লেখা৷ মিলখার আত্মজীবনী ঠিক সেই ধরণের লেখা নয়৷ তবে সে'টা অভিযোগ নয়৷ সাহিত্যের উপাদান তাঁর জীবনেও কম ছিল না। দেশভাগের দাঙ্গায় পরিবার খোয়ানো কিশোর, প্রবল আর্থিক অনটন, ভেসে যাওয়ার অজস্র সম্ভাবনাকে প্রতি নিয়ত ডজ করে এগিয়ে চলা, ভালোবাসা-মায়া-মমতা-বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্দান্ত উত্থান আর সাহেবি কেতায় যাকে বলে "মেজর হার্টব্রেক"; সবই ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সযত্নে ছুঁয়ে ফেলাই যেত এই বইয়ে৷ যে'টা লোপেজ করেছেন৷ অথবা আগাসির মত সিনেম্যাটিক ভঙ্গিমায় ফ্রেম করা যেত বায়োগ্রাফিটা। মিলখা সে পথে হাঁটেননি৷ কিন্তু সহজ সরল স্টাইলে যে ন্যারেটিভটা তৈরি হয়েছে সে'টা দিব্যি ঝরঝরে৷ মিলখা নিজের কথা বলেছেন, ইতিহাস-টিতিহাস নিয়ে বিশেষ হোঁচট খাননি৷ একটা সুবৃহৎ সাক্ষাৎকার হিসেবে এ বই চমৎকার৷ 

গতকাল থেকে মিলখা সিংয়ের একটা 'কোটেশন' সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব চালাচালি হচ্ছে - "The track, to me, was like an open book, in which I could read the meaning and purpose of life. I revered it like I would the sanctum sanctorum in a temple, where the deity resided and before whom I would humbly prostrate myself as a devotee"।  কথাটা এই বইতেই বলেছেন মিলখা৷ আর এ কথাটা যে স্রেফ এস্যে লিখতে বসে ভারি ইংরেজি ফলানো নয়, মিলখার আন্তরিক স্টাইলেই সে'টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ মিলখা শুধু ঘাম নয়, রক্তও ঝরিয়েছেন ট্র‍্যাকে - আর মিলখার সে গল্প পড়তে পড়তে পাঠক অনায়াসে নিজের মনের মধ্যে একটা মোতি নন্দী 'Re-telling' কল্পনা করে নিতে পারবেন৷ 

কর্পোরেটে প্রায়ই একটা খেজুরে প্রসঙ্গ নিয়ে " ডোন্ট বি আ আ মিনিমাম গাই" গোছের সাহেবরা জ্ঞান ঝাড়েন - এক্সেলেন্স৷ মিলখার মজ্জায় এককণাও দেখনাই-কর্পোরেট পালিশ নেই৷ কাজেই তার জীবনীতে পাওয়ারপয়েন্ট জ্ঞান নেই, রয়েছে আদত এস্কেলেন্সের প্রসঙ্গ৷ ফুংসুক ওয়াংড়ু যে কথাটা সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স আর "হাইক্লাস এন্টারটেনমেন্টে"র মাধ্যমে বুঝিয়েছেন, মিলখার বইয়ে সে'টাই রয়েছে একটু সাদামাটা ভাষায়, কখনও প্রায় সভাসমিতির মাইক্রোফনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার ভাষায়।

দেশভাগ আর বাপ-মা হারানোর যন্ত্রণা, আর্মি ব্যারাকের নিরস ডিসিপ্লিনের ওজন বইতে বইতে নিজের প্যাশন খুঁজে পাওয়া, আকাশ ছোঁয়া সাফল্য, আর রোম অলিম্পিকের যন্ত্রণা। সবই রয়েছে৷ ব্যাক্তিগত ধ্যানধারণা আর সম্পর্কগুলোও বাদ যায়নি৷ তবে এ বইতে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে; ভারতের স্পোর্টস 'সিস্টেম' নিয়ে মিলখার খোলামেলা মতামত এবং খানিকটা হতাশা। 

চট করে পড়ে ফেলাই যায়৷