Showing posts with label বই. Show all posts
Showing posts with label বই. Show all posts

Sunday, March 16, 2025

ছোট আর বইমেলা



- ভূতের গল্প পড়ছিস বড়দা?
- না। হাড়কাঁপানো প্রেমের গল্প।
- ও। তা, ঘুমোবি কখন রে?
- কী চাই?
- বলছিলাম, কাল অফিসের পর বইমেলায় যাবি?
- আমি গেলে তোর কী লাভ ছোট?
- না মানে, আমিও ঘুরতাম তোর সঙ্গে। ও'দিকেই একটা টিউশনি ছিল। সে'খান থেকে বেরিয়ে না হয়..।
- ফার্স্ট ইয়ারের লায়েক ছোকরা। ইয়ারদোস্ত থাকতে আবার এই গোবেচারা বড়দাকে কী দরকার।
- ইয়ারদোস্ত তো আর বই কেনাকাটা স্পন্সর করে না।
- বেশ তো। আমি টাকা দিয়ে দেব। বই কিনিস পছন্দমত।
- তুই আমায় সাইড করছিস কেন বল তো? প্রেম করতে যাবি নাকি বইমেলা?
- কান ছিঁড়ে নেবো ডেঁপোমি করলে।
- যাচ্ছি কি আমরা বইমেলায়? সোজাসুজি বল।
- ঠিক আছে। পাংচুয়ালি সাড়ে পাঁচটায় চার নম্বর গেটের সামনে দেখা করবি। আর ঘোরার সময় বকবক কম করবি, দেখবি বেশি।
- কিপটেমো করবি না তো?
- পিঠের চামড়া গুটিয়ে নেব ছোট।
- আচ্ছা দাদা, বইমেলা ঘুরে কোথাও রুটি মাংস খেতে যাবি?
- এই দ্যাখো। বসতে দিলে শুতে চায়।
- চ' না রে। এত ভালো চাকরি করছিস। আজ বাবাকে দামী রেজার তো কাল মাকে কানের দুল কিনে দিচ্ছিস। আমার ব্যাপারেই যত হিসেব।
- আর কোনো ফরমায়েশ আছে?
- ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরব প্লীজ। রুটি মাংসের পর বই বোঝাই ব্যাগ হাতে বাস-ট্রাম ভালো লাগবে না।
- ছোট। তোর হাবভাব ভালো বুঝছি না।
- তা'হলে সে কথাই রইলো?
- এখন ভাগ। রাত অনেক হয়েছে।
***
ছোট ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বইটা বন্ধ করে খাটের পাশের টেবিলে রাখলেন সুবিমল। এখন কিছুক্ষণের অপেক্ষা। একটু পরেই ঘুম ভাঙবে। তখন এই টালিগঞ্জের বাড়ির পুরনো ঘরটা উবে গিয়ে নিউটাউনের ফ্ল্যাটের সবুজ দেওয়াল স্পষ্ট হবে। সামনের দেওয়ালে এখন যে মা তারা হার্ডওয়্যার স্টোর্সের ক্যালেন্ডার চোখে পড়ছে, তার বদলে দেখা যাবে ফটোর-ফ্রেমে বাবা-মা। ওদের ফটোর ডানদিকে ছোটর ফটো।
স্বপ্নটা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে সুবিমলের। মাঝেমধ্যেই ঘুরে ফিরে আসে। ছোটর সেই একই আব্দার। কত বছর আগে সেই অফিসের বিশ্রী একটা মিটিংয়ে আটকে গিয়ে বইমেলায় যাওয়া হয়নি সুবিমলের। তখন মোবাইল-টোবাইল ছিল না তাই ছোটকে জানানো হয়নি। সে বেচারি একাই ঘুরেছিল হয়তো বইমেলা, কিন্তু বড়দা না থাকায় বিশেষ কেনাকাটা করতে পারেনি। আর পারেনি বাড়ি ফিরতে; রাস্তা পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনা । সেই থেকে সে বারবার সুবিমলের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে এসে ঝুলোঝুলি করে, "বইমেলা যাবি বড়দা"।
স্বপ্নটা দিব্যি চিনতে শিখেছেন সুবিমল। এই দু'ণ্ডের আব্দারটুকু এখন তাঁর অভ্যাস। স্বপ্নে ছোট অন্তত তাঁকে সেই পুরনো বাড়িতে এনে ফেলে বারবার। সে জগতে পাশের ঘরে বাবা-মা শুয়ে। অন্য ঘরে অঙ্ক করার অছিলায় ছোট রেডিওয় হিন্দী গান শুনছে। আর নির্ঘাৎ পরের দিন কী কী বই কিনবে তার ছক কষছে। প্রথমদিকে মনকেমন হত, এখন এ স্বপ্নের জগতটা উপভোগ করেন সুবিমল। মাঝেমধ্যে সন্দেহও হয়, নিউটাউনের ছোট-হীন জগতটাই আদতে স্বপ্ন নয় তো? কাল হয়তো সত্যিই বইমেলা যাওয়ার আছে?
বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে ছোটর রেডিওয় বেজে চলা সুরটা চেনার চেষ্টা করলেন সুবিমল। ছোটকে কাল বইমেলা ঘোরনোর পর পার্ক স্ট্রিটে নিয়ে গিয়ে চাইনিজ খাইয়ে চমকে দিলে কেমন হয়?

২০২৪য়ের পড়াশোনা



২০২৪য়ে পড়াশোনা ব্যাপারটা কেমন হলো? দিব্যি। তবে সবচেয়ে বড় খবর হলো আমি আবার ফিকশনে ফিরতে পেরেছি। এই ব্যাপারটা যেমন আনন্দের তেমনই স্বস্তির। ইতিহাস, রাজনীতি, ফিলসফি ইত্যাদিতে ধার থাকলেও সে'গুলোর মধ্যে রয়েছে ওই জিমে গিয়ে ঘাম ঝরানোর মেজাজ। সমুদ্রের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে হেঁটে বেড়ানোর সুখ রয়েছে ফিকশনে। জিমে গিয়ে শরীর মজবুত হয় হয়তো কিন্তু আয়ু বাড়ে ওই ফতুয়া-গায়ে সৈকত-বিহারে।

ফিকশনে ফিরতে পারার মূলে রয়েছে সেই মোক্ষম ওষুধ; শিশুসাহিত্য। ই বি হোয়াইটের শার্লটস ওয়েব দিয়ে শুরু করেছিলাম।ব্যক্তিগতভাবে সময়টা সুবিধের ছিল না, সেই সময় ও'রকম মনকেমন আর মনভালো মেশানো লেখার যে কী দরকার ছিল। ভালো লেখা পড়তে গিয়ে বয়সের হিসেব করাটা মুর্খামি। হাই-কোয়ালিটি শিশুসাহিত্য বুড়ো বয়সে পড়লেও হাই-কোয়ালিটিই মনে হবে; থাম্বরুল সে'টাই। বার্লি ডোহার্টির স্ট্রিট চাইল্ড ছোটোদের লেখা হলেও জাতে শার্লটস ওয়েবের ঠিক উল্টো। খানিকটা ডিকেন্সিয়ান, তবে তা'তে আলো অনেক বেশি। মন খারাপের গল্প, তবে মনখারাপটাই সে গল্পের শেষ কথা নয়। সে গল্প যুদ্ধজয়ের। এরপর আমাদের পুত্রের জন্মদিনে তার মা তাকে উপহার দিলে একটা রোল্ড ডালের সেট, তা'তে বাপ-ব্যাটা দু'জনেরই উপকার হলো। স্যাটাস্যাট পড়ে ফেললাম খান কয়েক বই যেমন জেমস অ্যান্ড দ্য জায়্যান্ট পীচ, চার্লি আর চকোলেট ফ্যাক্টরি, বিএফজি আর ম্যাটিলডা। আমি তিরিশ পেরিয়ে হ্যারি পটার পড়েছি। আর প্রায়-চল্লিশে ধরলাম রোল্ড ডালকে। ভদ্রলোক আমায় জাস্ট কিনে, প্যাকেটে মুড়ে, নিজের পকেটে রেখে দিয়েছেন। ডালবাবুর পকেট ছেড়ে আমি আর বেরোতেও চাইনা। জেমস, ম্যাটিলডা আর চার্লি অনবদ্য, সে নিয়ে বাড়তি কথা বলে আর হবেটা কী। শুধু বলি যে ওর বিএফজি বইটা আমি মাঝেমধ্যে খুলে পাঁচালির মত ভক্তিভরে পড়ি। সে জায়্যান্টের ভাষা আমার কানে গুলজার-প্রো-ম্যাক্স, আর ওই বই আমার চোখে আদত ইকিগাই।

হ্যারি পটারের কথা বললাম। তা সেই গোটা সিরিজটা নিয়ম করে বছর দু'আড়াই অন্তর পড়াটা একটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে। আমার ছেলের বয়স এখন ৮, ক্রমশ এই সিরিজটা হ্যারির চোখ দিয়ে নয়, বাপ-মায়ের চোখ দিয়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে শুরু করেছি। প্রতিটা ধাপে যে কথাটা সবার আগে মনে হয় সে'টা হলো "আহা রে, ওর বাপ-মা নেই"। মিরর অফ এরিসেড তাই আরও বেশি মনখারাপের। ডাম্বলডোরের "আমার ভয় কীসের, তুমি সঙ্গে আছো যে হ্যারি" আরও বেশি সুমধুর। সিরিয়াস ব্ল্যাকের ডানপিটেমোর ওপর মিসেস উইজলির বিরক্তিটা যেন অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। আর ভাই, রোলিং যে কী মহাকাব্য লিখেছেন। ওই জিনিস পড়লে কোনও সিনেমা দেখার প্রয়োজন পড়ে না। ওই সিরিজের সাতটা বইয়ের মধ্যে কোনটা আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়? আলাদা একটা বই হিসেবে দেখতে গেলে নির্ঘাৎ প্রিজনার অফ আজকাবান। গবলেট অফ ফায়্যারটা আমার প্রথমবার পড়ে তেমন মারকাটারি মনে হয়নি, কিন্তু এদ্দিনে বইটা ক্রমশ বেশ জমাটি মনে হচ্ছে। তবে আমার নতুন ফেভারিট বোধ হয় অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স। কারণ ডলোরেস আম্ব্রিজের মত হাড়বজ্জাত চরিত্র আর নেই। এই এতবারের পর এ'বারেও পড়তে বসে আম্ব্রিজের প্রতি রাগের চোটে যে কতবার সোফা খামচেছি বা টেবিল আঁচড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আর ওই বইয়ের ক্লাইম্যাক্স - সে'টা লাখটাকার। ওহো, এ'খানে বলে রাখা ভালো যে হ্যারি পটার সিরিজ আজকাল আমি মূলত শুনি (আর কখনোসখনো পড়ি)। স্টিফেন ফ্রাইয়ের কণ্ঠ আমার হ্যারি পটারের এক্সপিরিয়েন্সের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কী আশ্চর্য, ডাম্বলডোর থেকে হ্যাগ্রিড, জর্জ উইজলি থেকে নিম্ফাডোরা আর হার্মায়োনি থেকে বেলাট্রিক্স - সবার গল্প আমি জানি রোলিংয়ের ভাষায় কিন্তু তাঁদের পার্সোনালিটি আমি আত্মস্থ করেছি স্টিফেন ফ্রাইয়ের কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়ে। আর আমি এমনিতেই ভদ্রলোকের ভক্ত। ওঁর পাঠ করা আর একটা বই অডিবেলে শুনেছি এ'বছর- ম্যাট হেগের "এ বয় কল্ড ক্রিস্টমাস"। স্টিফেন ফ্রাই পড়েছেন মানেই মোটের ওপর নিশ্চিন্ত যে গল্পটা দারুণই হবে। আর ম্যাট হেগের এই রূপকথার গল্পটা এত সুন্দর। শৈলেন ঘোষ টেমপ্লেটে লেখা যেন। ক্রেয়নে আঁকা ছবির মত অপরূপ, আর সেই আঁকার মধ্যে রয়েছে বাপ-ছেলের ভালোবাসার গল্প। বারবার পড়তে (শুনতে) ইচ্ছে করবে।

পুজোয় কাশ্মীর ঘুরতে গিয়ে লিডর নদীর পাশে মাদুরে শুয়ে পড়লাম কল্কেকাশির জিনিয়াস লেভেলের গোয়েন্দাগিরি। ব্রিলিয়ান্টত্বের একটা লিমিট থাকা উচিৎ কিন্তু শিব্রামের একটা বড় সমস্যা হলো যে তাকে নিয়মকানুন লিমিট-বেলিমিটে বাঁধা যায় না। পাঠকের খ্যাঁকখ্যাঁক হাসির চোটে লিডরের বয়ে যাওয়ার দাপুটে শব্দও চাপা পড়ে গেছিল বোধ হয়। কল্কেকাশির ক্লাসিক ছাড়াও নিয়ে গেছিলাম কিছু পুরনো বই: জোড়া জোড়ায় ডবল ফেলুদা আর ফেলুদা ওয়ান ফেলুদা টু। ফেলুদা ওয়ান আর ফেলুদা টুতে আছে নেপোলিয়নের চিঠি আর এ'বার কাণ্ড কেদারনাথে। জমজমাট, টানটান। কেদারনাথ পড়ে আবার টের পেলাম এ'টা আমার অন্যতম প্রিয় ফেলুগল্প। কিন্তু ইয়ে, ডবল ফেলুদাটা বড্ড নড়বড়ে। অপ্সরা থিয়েটার মামলাটা জাস্ট দাঁড়ায় না। ছদ্মবেশী ক্রিমিনালের মশলা খাওয়া দেখে তাঁকে চিনে নেওয়া রব নে বনা দি জোড়ির চেয়েও কাঁচা ব্যাপার। আর ভূস্বর্গ ভয়ঙ্করটা নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা না করাই ভালো। কিছু ভালো না লাগলে তা নিয়ে না সাধারণত বলি-লিখি না, কারণ আমি ঠিক ক্রিটিক নই। ফেলুদা এত প্রিয় যে সে ভালোলাগার দাবী থেকেই এ'টা বলে দেওয়া গেল। এ বছরের পড়া সেরা ছোটদের বাংলা বই হলো টং লিং। সে একদম ছোটবেলার হাই-ক্লাস পুজোসং্খ্যার স্বাদ।লীলা মজুমদারের লেখা যে কী সুন্দর আর কী স্মার্ট; অনেক ভাগ্য করে জন্মালে ওই বাংলাভাষা পড়ার সুযোগ হয়। প্রায় টংলিং-য়ের মতই সুন্দর গল্প হলদে পাখির পালক। গোটা বছর আর কিছু না পড়ে যদি লীলা মজুমদারের ওই দুটো বই শুধু বই পড়তাম, তা'তেও বর্তে যাওয়া যেত।

তিনটে বাংলা গল্প-উপন্যাস, যা থেকে পরে সিনেমা হয়েছে, আমার দারুণ লেগেছে। প্রথমে শীর্ষেন্দুর গয়নার বাক্স। বইটার সারল্য, সৌন্দর্য আর হিউমর বোধহয় সিনেমায় ঠিকঠাক তুলে ধরা যায়নি। শীর্ষেন্দুর উইট ও হিউমর মারাত্মক ধারালো, সে'টায় এসে মিশেছে টানটান সোশ্যাল কমেন্ট্রি। ও জিনিস সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা সহজ নয় (এ'টা সিনেমার ক্রিটিসিজম নয়)। এ'ছাড়া পড়লাম সুনীলবাবুর অরণ্যের দিনরাত্রি। সিনেমাটা অনবদ্য, নভেলটাও তাই। তবে দু'টোই সম্পূর্ণ আলাদা ওয়ার্ক অফ আর্ট। দু'টোর অ্যাপ্রিশিয়েশনও আলাদাভাবেই করতে হবে। সিনেমাটা দেখে নভেলটাকে বোঝা যাবে না। সুনীলবাবুর লেখা পড়েও সত্যজিতের সিনেমার কোয়ালিটি আঁচ করা যাবে না। উপন্যাসটা একটু বেশি ডার্ক, খানিকটা দমবন্ধ করা। বই চরিত্রগুলোও সিনেমার চরিত্রদের থেকে পুরোপুরি আলাদা; এবং সে'টা একটা পজিটিভ ব্যাপার। ভাগ্যিস বইটা পড়েছি। আর পড়লাম গিয়ে নারায়ণ সান্যালের "পাষণ্ড পণ্ডিত"। এই সিনেমাটা আমি দেখিনি। কিন্তু এ গল্পে সান্যালবাবুর ভাষা যে কী সুন্দর। আর পণ্ডিতের চরিত্র; ঠিক এই ধরণের চরিত্রকে চেনার জন্য অনায়াসে নভেল একটানা পড়ে শেষ করা যায়।

এ বছরের পড়ার মধ্যে থেকে থ্রিলারের স্বাদ মেশানো চমৎকার দুটো গোয়েন্দা উপন্যাস রেকমেন্ড করতে পারি। প্রথমটা অ্যান্থনি হরোউইটজের ম্যাগপাই মার্ডারস। দ্বিতীয়টা শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যর শেষ মৃত পাখি। দু'টো নভেলই দুর্দান্ত আর গড়পড়তা ডিটেকটিভ গল্পের গতে বাঁধা নয়। স্পয়লার না দিয়ে বলি, দু'টো নভেলেই রয়েছে প্যারালাল প্লট, পেশাদার গোয়েন্দার পাশাপাশি রয়েছেন পরিস্থিতির ফেরে এবং সৎ অবজার্ভেশনের মিশেলে তৈরি সত্যসন্ধানী । রয়েছে অজস্র সুতোর জট এবং সুচারু লজিক-নির্ভর জট ছাড়ানো। দুটো গল্পেই পুরুষ লেখক নারী প্রটাগনিস্টের হয়ে লিখেছেন। আর দু'টো বইই একবার ধরলে শেষ না করা পর্যন্ত থামা যায় না। শেষ মৃত পাখির মত উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিরল। বোনাস: বাংলা আধুনিক কবিতা ও সেই কবিতার জগতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সে গল্পে। আমার সাজেশন হবে দু'টো বই পর পর পড়ার। একই জাতের আর একটা বই এ বছর আমার বেশ ভালো লেগেছে; বেঞ্জামিন স্টিভেনসনের "এভ্রিওয়ান ইন মাইন ফ্যামিলি হ্যাস কিল্ড সামওয়ান"। নভেলের শিরোনাম যতটা ইন্টারেস্টিং, প্লট ও লেখনীও ততটাই টানটান। শুরুতেই প্রোটাগনিস্ট বুলেট পয়েন্টে বলে দিচ্ছেন আদর্শ গোয়েন্দা গল্প কেমন হওয়া উচিৎ (যে'গুলো আমার মতে দুর্দান্ত লিটমাস টেস্ট)। তারপর গল্প যত এগিয়েছে, প্রোটাগনিস্ট নিজের গল্পের কোয়ালিটি সেই সব লিট্মাস টেস্টের নিরিখে ক্রমাগত যাচাই করে গেছেন - একদম জবরদস্ত ট্রীটমেন্ট যাকে বলে।

এ বছর একটা বিটকেল এক্সপেরিমেন্ট করেছি। আমি এমনিতে বইপত্র ধীরেসুস্থে পড়ি এবং খানদুই-তিনেক বই প্যারালালি পড়ি। ক'দিন আগে কোরবা থেকে হাইওয়ে ধরে রায়পুর ফিরছিলাম, সন্ধের ফ্লাইটে মুম্বই ফেরার কথা। সঙ্গে লীলা মজুমদারের টংলিং আর শীর্ষেন্দুর ঘুণপোকা। সাধারণত প্যারালালি দু'টো বই পড়া মানে দুপুরে একটা পড়লে রাত্রে অন্যটা। কিন্তু সে'দিন কী ইচ্ছে হলো টংলিং আর ঘুণপোকা একসঙ্গে পড়া শুরু করলাম; কয়েক পাতা টংলিং আর কয়েকপাতা ঘুণপোকা। এ'দিকে টংলিং হলো ছোটদের মনভালো করা গল্প আর ঘুণপোকা অন্ধকার পচা-গলা এক টুকরো পৃথিবীর খবর। ঘুণপোকা অস্বস্তিকর কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট, অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অথচ গতিময়। টংলিং কেমন লেগেছে সে'টা আগেই লিখেছি। এ'বারে কয়েক-পাতা টংলিং কয়েক-পাতা ঘুণপোকা; এই লেফট-রাইট লেফট-রাইটের চক্করে ব্রেনে সর্দিগর্মি লেগে যাওয়ার উপক্রম হলো। তবে কখন যে রায়পুর পৌঁছে গেলাম তা টেরও পাইনি। গোটাবছরে শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ একটাও রিপীট না করে দু'টো নতুন লেখা পড়লাম; গয়নার বাক্স আর ঘুণপোকা দু'টোই সে অর্থে 'বড়দের'। দু'টোই মেজাজে আর লেখনীতে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা। দু'টোই অনবদ্য।

এ'বাদে গ্রেম সিমিসনের লেখা দ্য রোজি প্রজেক্ট বইটা আমার খুব ভালো লেগেছে। গল্পের নায়ক শেলডন কুপার গোছের একজন নম্বর-সর্বস্ব মানুষ, অতএব তাঁর ভালোবাসার খোঁজও 'স্ট্রিক্টলি স্ট্যাটিস্টিক্স ড্রিভেন'। কিন্তু এই গল্পে শেল্ডন্ত্বই মূল থীম হয়ে দাঁড়ায়নি, রয়েছে মাপা হিউমরে লেখা স্মার্ট রোম্যান্টিক গল্প (ইয়ে, রোম্যান্স লিখলাম তবে এ গল্প ঠিক প্রেমের গল্পও নয়)। রোম্যান্স প্রসঙ্গে বলি, বুদ্ধদেব গুহর বাবলি পড়লাম - হয়ত ওই ধরণের রোম্যান্টিক নভেল অ্যাপ্রিশিয়েট করার পাঠক আমি নই। অথচ বুদ্ধদেববাবুর লেখা কোজাগর আমার ভীষণ প্রিয়। ও'দিকে তোশিকাজু কাওয়াগুচির জাপানী উপন্যাস 'বিফোর দ্য কফি গেটস কোল্ড'য়ের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে আমি মুগ্ধ। অ্যাবসার্ড টাইম ট্র্যাভেলের পটভূমিতে লেখা গল্পের কনসেপ্ট মেনে নিয়ে নভেলের মূল থীমে ফোকাস করতে পাঠক হিসেবে আমার একবারও হোঁচট খেতে হয়নি, এই ধরণের প্লটে সে'টা সবচেয়ে জরুরী। চরিত্রগুলো এত ইন্টারেস্টিং আর বিভিন্ন প্লটলাইনগুলো নিখুঁত ভাবে বোনা। এই সিরিজে আরও কয়েকটা বই আছে, পড়বো হয়তো সে'গুলো। ইয়ে, কী বলি; এদ্দিনে এসে জেফ্রি আর্চার ধরেছি। 'কেন অ্যান্ড অ্যাবেল' আর সে'টার সিকুয়েল 'দ্য প্রডিগাল ডটার' পড়লাম। ওরেব্বাবা, গতি কাকে বলে। আর একদম হলিউডি সুপারহিট মার্কা লেখা, প্রায় নেটফ্লিক্স সিরিজ দেখার স্টাইলে পড়ে যাওয়া যায়। প্রায় যেন রেডিমেড স্ক্রিপ্ট। পেল্লায় সাইজের উপন্যাস অথচ একটা প্যারাগ্রাফেও মনে হবে না "এই রে, এইবারে একটু ঝুলে গেলো"; হাইভোল্টেজ এন্টারটেনমেন্ট। তার পাশাপাশি বোনাস হলো বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার উত্থানের রাজনৈতিক পটভূমি। ওই যে বললাম, ওয়েবসিরিজের মত বিঞ্জ করা যায়, থুড়ি; গোগ্রাসে গেলা যায়।

ও হ্যাঁ, এই প্রথম বোধ হয় আমি একটা হিন্দি বই পড়েছি (বলাই বাহুল্য পড়িনি, অডিওবুকে শুনেছি);মান্টোর এক্কিস শ্রেষ্ঠ্ কহানিয়া (শ্রেষ্ঠ একুশ)। ইংরেজিতে মান্টোর গল্পের অনুবাদ আগেও পড়েছি। তবে ভাগ্যিস এই বইটা এ'বারে শুনলাম। হয়তো আমার শোনা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই এ বছর। গভীরতা আর অন্ধকার সত্ত্বেও স্মার্ট স্টাইল আর ডার্ক হিউমরের দিক থেকে মান্টোর লেখা আমার অনন্য মনে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সে অন্ধকার একটু বেশিই অস্বস্তিতে ফেলেছে, আর যাই হোক; মান্টোর সময় আর আমার রিয়ালিটির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েইছে। সবচেয়ে বড় কথা আমার মধ্যে মান্টোর গভীরতার এক আনাও নেই যে। তবে ওঁর লেখা ছোটগল্পগুলো না পড়লেই নয়। "ঠাণ্ডা গোস্ত" পড়ে কেঁপে উঠবে না; এমন কোনও পাঠক এ দুনিয়ায় আছে বলে আমার মনে হয় না। এ বই একটানা পড়ে শেষ করার নয়। ধীরেসুস্থে এক-একটা গল্প, এক-একটা চরিত্র আর এক-একটা কথোপকথনকে আবিষ্কার করে এগিয়ে যেতে হয়। মান্টোয় তাড়াহুড়ো করলেই বোধহয় সব মাটি।

দু'টো বই আমায় বেশ হোঁচট খেয়ে খেয়ে পড়তে হয়েছে। কখনও বেশ খানিকটা বোর হয়েছি, মাঝপথে ছেড়ে দেব ভেবেছি। কিন্তু দু'টো বইই শেষ করে আমার মনে হয়েছে যে ভাগ্যিস পড়েছিলাম। বিশেষত বয়সের নিরিখে চল্লিশের ঘরে এসে এই বইদুটো হয়তো আমার চোখে জরুরীই বটে। স্বীকার করতে ক্ষতি নেই যে দু'টো ঠিক 'ব্রিজি রীড' নয়। একটা ফিকশন, একটা নন-ফিকশন। ফিকশনটা হলো রেচেল জয়েসের লেখা দ্য আনলাইকলি পিলগ্রিমেজ অফ হ্যারল্ড ফ্রাই। বৃদ্ধ ফ্রাই একদিন বাড়ি থেকে বেরলেন একটা চিঠি পোস্টবাক্সে ফেলবেন বলে। কিন্তু সে চিঠি আর পোস্ট করা হলো না; তিনি চিঠিটা পকেটে হেঁটেই এগিয়ে গেলেন। এবং তাঁর হাঁটা থামলো না। না, এতে ফরেস্ট গাম্প নেই। বড় দুঃখ আছে, সম্পর্কের টানাপড়েন আছে, হতাশা আছে, সমস্ত শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট আছে। আর আছে এগিয়ে যাওয়ার সাহস। গল্পের প্লটে বিশেষ মারপ্যাঁচ নেই, অতএব স্পয়লার দিয়ে দেওয়ার ভয় নেই। তবে ওই হোঁচট খাওয়া সত্ত্বেও পড়ে যাওয়াটাই পাঠকের একমাত্র কর্তব্য। ভালো যে লাগবেই সে গ্যারেন্টি দেওয়া মুশকিল। তবুও এ বইটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। সে'রকমই গুরুত্বপূর্ণ আর একটা বই, এ'টা নন-ফিকশনঃ ইচির কিশিমি আর ফুমিতা কোগার বই 'দ্য করেজ টু বি ডিসলাইকড'। গোড়াতেই বলে দিই আমি ঠিক 'ডেভেলপমেন্টাল বই' পড়ার মানুষ নই। তবে এই বইটার শিরোনামই এই বইয়ের মূল বক্তব্য। ফ্রয়েডিয়ান সাইকোলজির প্যারালাল মত নিয়ে গড়ে ওঠা একটা কনভার্জেশন। ওই, এ'টাও আমায় হোঁচট খেয়ে এগোতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে একই জিনিস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা হচ্ছে। গোটা বইটাই একটা কাল্পনিক কথোপকথনের স্টাইলে লেখা আর আমার কখনও মনে হয়েছে যে এইবারে জাস্ট জোর করা কথা ঢোকানো হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই বইটা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে জরুরী মনে হয়েছে - ভাগ্যিস পড়লাম এই "দ্য করেজ টু বি ডিসলাইকড"।

নন-ফিকশন প্রসঙ্গে যখন ঢুকেই পড়েছি, তখন আরও কয়েকটা বইয়ের খবর দিয়ে দিই। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে বছরে অন্তত একটা বই পড়ার চেষ্টা করছি। এ বছর পড়েছি জন জুব্রিস্কির 'দ্য শর্টেস্ট হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া'। এক ট্রেনযাত্রায় সহযাত্রীর হাতে ওই বইটা দেখে গুডরীডসে সে'টার ব্যাপারে খানিকক্ষণ পড়ে তারপর এ'টাকে বেছে নিয়েছিলাম। দিব্যি লেখা, তরতরিয়ে এগোনো যায়, ভালোই লাগলো। সঞ্জয় বারুর লেখা নরসিমহা রাওয়ের ওপর বইটা (১৯৯১ঃ হাউ পি ভি নরসিমহা রাও মেড হিস্ট্রি) পড়েছিলাম গত ইলেকশনের সময়, 'এন্টারটেনমেন্টের জন্য'। আর পাঁচটা খেটেখুটে ডিটেইল ঘেঁটে লেখা রাজনৈতিক বইয়ের মতই এ'টাও মশলায় ভরপুর; অতএব নিখাদ এন্টারটেনমেন্ট। গত বছর পড়া মর্গান হাউসেলের দ্য সাইকোলজি অফ মানি আমার খুব কাজের বই মনে হয়েছিল। এ বছরের শুরুতে ওঁর লেখা 'সেম অ্যাস এভার' বইটা পড়েছিলাম। সাইকোলজি অফ মানির মত জমাট মনে হয়নি, কিন্তু কিছু খুব প্র্যাক্টিকাল কনসেপ্ট নিয়ে সহজ ভাষায় লেখা। বয়সের ধর্ম অনুযায়ী আজকা; সেভিংস ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু ফিলোসফিকাল ভাবনা-চিন্তা আজকাল মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে, সে'দিন থেকে এ বইটা পড়তে মন্দ লাগলো না। অডিবেলের ক্রেডিট ব্যাবহার করে পড়েছি ইয়ুভাল হারারির লেখা "নেক্সাস"। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগোরিদম আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোন পর্যায় পৌঁছে যেতে পারে (এবং গেছে) সে নিয়ে একের পর গা-কাঁপানো গল্প বলে গেছেন হারারি। ভদ্রলোক গুছিয়ে গল্প বলতে পারেন, সে'দিক থেকে বইটা পড়তে বেশ লাগে। তবে ইদানীং ওঁর পডকাস্ট এত শোনা যায় যে বইয়ে পড়া অনেক আইডিয়াই মনে হয় যেন এইত্তো সে'দিন পডকাস্টে শুনলাম। তবে মোটের ওপর মন্দ লাগলো না। ও'দিকে সত্যজিৎ রায়ের "স্পীকিং অফ ফিল্মস"-য়ের অডিওবুকও রয়েছে অডিবেলসে, শুনে ফেললাম। এ আনন্দ অনেকটা শেন ওয়ার্নের বায়োগ্রাফিতে লেগস্পিন নিয়ে ওঁর অভজার্ভেশন পড়ার মত; থ্রিলিং! বিশেষত বাংলা সিনেমার ওপর যে দু'টো চ্যাপ্টার, সিনেমার সংলাপ নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধ আর চারুলতার ওপর যে লম্বা লেখাটা রয়েছে, ও'গুলো এত ভালো লাগলো যে বেশ বার কয়েক শুনতে হলো। সব ছাই বুঝেছি তাও হয়ত নয়, আমি সিনেমা আর কত দেখি। কিন্তু একজন জিনিয়াস তাঁর ভালোবাসার বিষয়ে কথা বলছেন; সে জিনিস যে অমূল্য। জিনিয়াস প্রসঙ্গে বলি; মুজতাবার আলির 'দেশে বিদেশে' পড়লাম (বহু আগে একবার পড়েছিলাম বটে)। বড় কপাল করে বাঙালি হয়ে জন্মেছি তাই মুজতাবার ভাষায় মুজতাবার অবজার্ভেশন আমি পড়তে পারি। এ বছর আফগানদের সম্বন্ধে দু'টো জরুরী বই পড়েছি, তার মধ্যে একটা এইটা।

আফগানিস্তান সম্বন্ধের আর একটা যে বই পড়েছি সে'টা আগাগোড়াই একটা রূপকথার গল্প। রূপকথা বললাম একটু চমক দিতে, আদতে নন-ফিকশন। কিন্তু গল্প হলেও সত্যি যদি কোনোদিন কোনও বইয়ের শিরোনাম হতে পারে তবে সে'টা এই বইটা। টিম আলবোনের লেখা "আউট অফ দ্য অ্যাশেস"। আমার পড়া এ বছরের সেরা ক্রিকেট বই; আফগানদের ক্রিকেট শেখা, বোঝা, ভালোবাসা এবং এগিয়ে যাওয়াঃ এ'টা যে কোনও গাছে-গরু-তোলা গল্পকে ছ'গোলে হারাবে। বছর তিরিশেক আগে আফগানরা ক্রিকেট পিচ-টিচ চিনতো না, তারপর দেশটার ওপর দিয়ে একটানা ঝড় বয়ে গেল। আর এত সব কিছুর মধ্যিখানে ক্রিকেট দুদ্দাড় করে এগিয়ে এগিয়ে; এগিয়ে এলেন রাশিদ-নবীরা। এ বই নিয়ে আর একটু বিশদে লেখার ইচ্ছে ছিল। তা না করে যাকেই পাই তাঁকে টেনে বলি, "এই বইটা পড়ুন প্লীজ"। আর একটা ক্রিকেট বইয়ের উল্লেখ না করলেই নয়, সে'টা হলো আর একটা ক্রিকেট পাগল দেশের ক্রিকেটীয় বায়োগ্রাফি; অ্যান আইল্যান্ডস ইলেভেন। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সঙ্গে রাজনীতি, ধর্মের পাশাপাশি ক্রিকেট ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। নিকোলাস ব্রুকসের লেখা এই বইটা শুধু ক্রিকেটের বই নয়, এ'টা ইতিহাসের সিলেবাসে ঢুকে যেতে পারে অনায়াসে। বইয়ের তিন ভাগের দু'ভাগ জুড়ে রয়েছে শ'দেড়েক বছরের ক্রিকেট (এবং অবশ্যই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক) ইতিহাস; আশির দশকের শেষ পর্যন্ত। নব্বুই দশকের পরের ঘটনাগুলোও সবিস্তারে আছে তবে সে'টা হয়তো অনেকটা জানা বলেই সে'টা আমায় ব্যক্তিগতভাবে তেমন টেনে রাখেনি। কিন্তু দুর্দান্ত বই; ওই যাকে বলে "মাস্ট রীড"।

এ বছরে আমার পড়া সেরা বই কোনটা? দু'টো বইয়ের কথা বলা দরকার। এবং কী আশ্চর্য, এত ফিকশন পড়ে মুগ্ধ হলাম, তবে যে বই দু'টো সবচেয়ে ভালো লাগলো সে' দু'টোই নন-ফিকশন। একটা বাংলা আর একটা ইংরেজি। প্রমথনাথ বিশীর লেখা রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন গত জুলাই মাসে পড়ে ব্লগে সে বই ভালো লাগা সম্বন্ধে দু'চার কথা লিখে রেখেছিলাম। সে'খান থেকে কয়েকটা লাইনে এখানেও টুকে দিই: এ বই আত্মজীবনীমূলক৷ রসেবসে সামান্য মাত্রাযোগ ইতিউতি হয়ে থাকলে সে দায় প্রমথনাথের, কিন্তু বইটা আগাগোড়া সত্যি ঘটনাক্রমেই বাঁধা৷ ঘটনার ব্যাপারে বিস্তৃতভাবে জানতে হলে মানুষ খবরের কাগজ পড়বে। বইয়ে আশ্রয় নেওয়া সমস্ত ঘটনাদের 'ট্রীটমেন্ট' অন্যরকম হতে হবে; সে'খানে ঘটনাপ্রবাহের সত্যিটুকুকে আগলে রেখে রসালো গল্প ফেঁদে বসাটা লেখকের একটা জরুরি দায়িত্ব৷ সে'দিক থেকে, প্রমথনাথ একজন মডেল লেখক। সতেরো বছর শান্তিনিকেতনে থেকে পড়াশোনা করেছেন প্রমথনাথ। শান্তিনিকেতনের গোড়ার দিনগুলো স্বচক্ষে দেখেছেন, উপভোগ করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ আদর্শ শিক্ষা বলতে যে প্রসেসকে বুঝতেন, সেই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে প্রমথনাথের চরিত্র ঘষামাজা হয়েছে৷ সে অর্থে, তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু পেল্লায় একজন সাহিত্যিক নন, একজন মাস্টারমশাইও বটে৷ এই বইয়ে সেই মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথের গল্প রয়েছে৷ আর রয়েছে শান্তিনিকেতনের শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠার গল্প। একদিক থেকে সে'টাও রবীন্দ্রনাথেরই গল্প৷ রবীন্দ্রনাথ ভদ্রলোক যে কী 'খতরনাক', আর শান্তিনিকেতন যে কত বড় একটা বিপ্লব; সে কথা অনায়াসে লিখেছেন প্রমথনাথ৷ আর সে'সব তুলে ধরেছেন দুর্দান্ত সব গল্পের মাধ্যমে; সে'খানে মূলচরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও উঠে এসেছেন অন্যান্য শিক্ষকরা, স্কুলের ছাত্ররা, অন্যান্য কর্মীরা, আর অতি অবশ্যই; বোলপুর৷ এই বইয়ের স্থান-কাল-পাত্র সমস্ত যদি কাল্পনিকও হত; তা'হলেও এ বই দর্শনের গভীরতা আর হিউমরের ধারে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে টিকে রইত। বলাই বাহুল্য, এ বই সত্য-নির্ভর এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল৷ নেহাত নিরুপায় পাঠকরা এ বই পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যেই হে-হে করে উঠছে, তাই সমঝদার ক্রিটিকরা টুপি খুলে এই বইকে যোগ্য সেল্যুট জানাচ্ছেন না৷

এ বছরের অন্য যে বই আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে রইল সে'টা হলো অ্যানে লামোটের "বার্ড বাই বার্ড"। এই বইটা আমি অফিস থেকে উপহার পেয়েছিলাম অন্তত বছর দুয়েক আগে। এদ্দিন বইয়ের তাকে অযত্নে পড়েছিল। আমার সবসময়ই আশঙ্কা যে অফিস-টফিস থেকে পাওয়া বই মানেই তা আমায় চুক্কি দিয়ে ডেভেলপমেন্টাল জিনিস পড়িয়ে নেওয়ার চক্রান্ত। হঠাৎ কী খেয়াল হলো একদিন সে বই হাতে নিয়ে ধুলো ঝেড়ে খানিকক্ষণ উলটে পালটে দেখলাম। কয়েক পাতা পড়লাম। তারপর স্রেফ মেঘের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মেজাজে পড়ে গেলাম। লেখালিখির বিষয়ে বই, কী'ভাবে লেখা উচিৎ। লেখকরা কী প্রসেসে ভাবেন। সে ভাবনা-চিন্তা কী'ভাবে কাগজে-কলমে ফুটে উঠবে। অতি সহজেই এ বই কেজো হয়ে উঠতে পারতো। হয়ে ওঠেনি কারণ অ্যানে লামোট গল্প বুনতে পারেন। নন-ফিকশন তাঁর হাতে পড়ে রসকষহীন জ্ঞান দেওয়া গালগল্প হয়ে ওঠে না। অতি সহজেই এ বই পড়ে শৈলেন-সঞ্জীব মার্কা ভালোলাগা বের করে আনা যায়। অথচ একটা লাইনও ঘোলাটে নয়। কোথাও ভাষার ওপর-চালাকি নেই। আর যে'টা প্রতিটা পাতায় উজ্জ্বল সে'টা হচ্ছে অ্যানের ধারালো অথচ ভালোবাসায় ভরপুর সেলফ-ডেপ্রেকেটিং হিউমর। লেখালিখি সম্বন্ধে বিস্তর জরুরী কথা বলেছেন তিনি, পড়তে পড়তে ইন্সপ্যায়ার্ড না হয়ে উপায় নেই। অথচ পড়তে গিয়ে এ'টাও স্পষ্ট যে ল্যামট টিউশনি ক্লাসে বসেননি, তিনি গল্প বলার আসর আলো করে বসে আছেন। নিজের আটপৌরে জীবন হাতড়ে একের পর এক দুর্দান্ত গল্প বের করে আনছেন অ্যান আর পাঠক হিসেবে আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি, হাসছি এবং লেখালিখির আইডিয়াটাকে ভালোবাসছি। লেখালিখির ব্যাপারে আগ্রহ না থাকলেও, স্রেফ গল্প শোনার প্রতি আগ্রহ থাকলে নির্দ্বিধায় এ বই পড়ে ফেলুন।

সবশেষে, একটা জরুরী ব্যাপার না বললেই নয়। বই, বইয়ের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকা চরিত্ররা, এবং লেখক-লেখিকাতেই বইয়ের পরিচিত শেষ হয়ে যায় না। বেশিরভাগ বইই কোনও পরিচিত মানুষের মাধ্যমে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়। অমুক বই কারুর রেকমেন্ডেশন, তমুক বই কারুর উপহার। অমুক বইয়ের উল্লেখ কারুর সঙ্গে আলোচনার সময় শুনেছি, তমুক বই অন্যের হাতে দেখে আগ্রহী হয়েছে। আর কিছু ভালো লাগা বই আমরা হয়ত অন্য কাউকে গছিয়েছি আর উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করেছি এ'টা জানতে যে সে বইও তাঁদের ঠিক ততটাই ভালো লেগেছে কিনা। প্রায় প্রতিটা প্রিয় বইয়ের সঙ্গেই চেনাজানা মানুষের মুখ মিশে যায় আর সে'খানেই বইদের জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া। অতএব যারা এ বছর আমায় বিভিন্ন বইয়ের কাছে টেনে নিয়ে গেছেন, তাঁদের বিগলিত 'থ্যাঙ্কিউ' না জানালে এ বইয়ের ফর্দ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

প্রমথনাথ ও পরশুরাম



পাপী মানুষ। ভালো যা কিছু তার কদর করতে শিখিনি। ভালোমানুষজন ভালো কিছুর খোঁজ দিলে সন্দেহ হয়। দরদী মানুষ আলো জ্বেলে দিলে আঁতকে উঠে চোখে জলপটি দিয়ে আরামদায়ক অন্ধকার তৈরি করে নেওয়ায় আমার জুড়ি নেই।

পরশুরাম গল্পসমগ্রের গোড়াতেই রয়েছে ভূমিকা। ওপরচালাকিতে অভ্যস্ত পাঠক আমি; অমুক লেখকের বই কিনে তমুক সম্পাদকের কচকচি কেন পড়বো? এই নিরেট গর্দভ-যুক্তির সামনে নুয়ে পড়ে সে ভূমিকা আমি এতদিন (এত বছর) এড়িয়ে এসেছি। সংগ্রহে থাকা বইটার ঝুরোঝুরো অবস্থা, অথচ শুরুর পাতাগুলো উল্টে দেখা হয়নি।

এই আজ টের পেলাম সে ভূমিকা লিখেছেন সুপারস্টার প্রমথনাথ। ভূমিকাটা প্রায় একটা বড়গল্পের সমান আর প্রমথনাথের সিগনেচার স্টাইলে অনন্য। পরশুরাম যে কী মাপের মানুষ ছিলেন, সে'টা অ্যাপ্রিশিয়েট করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু "আরিব্বাসরেবাস" বলার ছেঁদো কাজটুকু করতেই পারি। "হাস্যরস" ফচকেমো নয়, ফাজলামো নয়, ফিচলেমো নয়; সাহিত্য। সুগভীর সাহিত্য। পরশুরামের মত কিছু মানুষ ছিলেন, তাই বাঙালির সমস্ত হাসি উৎকট খ্যাকখ্যাক স্তরে এসে শুকিয়ে যায়নি।

Thursday, November 21, 2024

বই ঠকানো মানুষ



কোনোদিন কোনো বইকে ঠকিয়েছেন?

এই ধরুন একটা বই পড়া শুরু করলেন। খান দশেক পাতা এগোতেই বইটা আপনাকে টেনে ধরলে। সেই টান অবশ্য কলার হিঁচড়ে টানা নয়৷ আপনাকে সে বই ধরে রাখছে স্নেহ-মায়া দিয়ে, বুদ্ধিদীপ্ত স্টাইল দিয়ে, ভালোবাসায় মুগ্ধ করে। হাসিয়ে৷ "ও কিছু নয়, চোখে কিছু পড়েছিল আর কী" মার্কা থমকে যাওয়া দিয়ে৷

আপনার সঙ্গে সে বই সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছে। অফিসের ব্যাকপ্যাকে, বালিশের পাশে, খাবার টেবিলের এক কোণে, সোফার কুশনের আড়ালে। সবসময় হয়ত পড়ছেন না, কিন্তু সে বইয়ের মলাটে হাত বুলোচ্ছেন মাঝেমধ্যে, বুকমার্ক হয়ে উঠছে আঙুল। ছ-সাত পাতা আগে ফেলে আসা কোনো ভালো লাগা লাইন বা প্যারাগ্রাফে মাঝেমধ্যেই ফিরে যাচ্ছেন৷ কিছু কিছু পাতা বার বার পড়েও আশ মিটছে না৷ পড়ার গতির তোয়াক্কা করছেন না মোটেও৷ আপনার দিনের প্রতিটা ফ্রেমের মধ্যে বইটার বিভিন্ন টুকরো ছড়িয়ে পড়ছে।

এমন সময়৷ কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে, বন্ধুর বইয়ের শেল্ফ থেকে বা রেলস্টেশনের হুইলার থেকে একটা বই হাতে তুলে নিলেন৷ মলাটের ও'দিকে এগোনোর কথা ছিল না৷ তবে কত কিছুই তো কথার বাইরে যায়৷ দু'পাতা চোখ বুলোনো হলো। ব্লার্বটা পড়ে মাথা নাড়া হলো। প্রচ্ছদটা যে দুরন্ত সে'টাও কাউকে ধাক্কাসহ বলে দিতে হয় না৷ আগ্রহের একটা বিন্দু জমাট বাঁধলো। বইটা সে বন্ধুর থেকে ধার নিলেন অথবা দাম মিটিয়ে ব্যাগস্থ করলেন।

কত বইই তো আসে যায়৷ এই নতুন বইটারও আপাতত ব্যাগের মধ্যেই থাকার কথা৷ ভালোবাসার যে বইটা গত কয়েকদিন ধরে আপনি ধীরেসুস্থে পড়ে চলেছেন, আপাতত ফোকাস এবং যত্ন সে'খানেই থাকার কথা। কিন্তু ওই যে বললাম, কত কিছুই তো কথার বাইরে যায়। এদ্দিন এই ভালোবাসার বইটার সিংহভাগ পড়া হয়েছে নতুন প্রেমে পড়ার কবির স্টাইলে৷ কিন্তু বাকি থাকা সত্তর আশিটা পাতা আচমকা রুদ্ধশ্বাস গতিতে পড়া শুরু হলো; ঠিক যেন দেশে যুদ্ধ এসে পড়েছে, এ'টা শশব্যস্ততার সময়৷ যে'খানে এসে প্রতিটা শব্দের ওপর স্পটলাইট পড়ার কথা, সে'খানে মনে হচ্ছে প্রতি লাফে হাফডজন সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে না গেলে চলবে না৷ মন তখন নতুন বইয়ের কবলে চলে গেছে, আর রক্ষা নেই৷

বই-ঠকানোর ইস্পাত শীতল অনুভূতি কখনও টের পেয়েছেন কি? কখনও?
(ছবি: জেমিনাই)

Tuesday, July 16, 2024

বই পড়া ক্রিকেট দেখা



অরিন্দমদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল বই পড়া আর ক্রিকেট দেখা নিয়ে৷ সুবিধের ব্যাপার হলো, আমাদের দু'জনেরই সাহিত্যজ্ঞান আর ক্রিকেটবুদ্ধিতে আদৌ তেমন গভীরতা নেই; যে'টা আছে সে'টা হলো মুগ্ধতা। এই দু'টো ব্যাপারেই মজে যেতে পারলে যে কী প্রবল আনন্দ অনুভব করা যায়; সে'টা নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল৷ ঘরে ভাজা ভালো শিঙাড়ার ওই একটা গুণ; আড্ডিয়েরা যতই খেলো হোক না কেন, আড্ডা অতি সহজেই ধারালো হয়ে ওঠে৷

আড্ডা শুরু হয়েছিল বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে, সেই আহ্লাদ গিয়ে গড়িয়ে পড়ল ক্রিকেট বিষয়ক বইয়ে। তারপর কী'ভাবে যেন মতি নন্দী হয়ে শান্তিপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়ে নেমে ছেলেবেলায় পড়া গল্পের বইয়ে এসে পড়লো। আমরা বলছিলাম যে একবার বই পড়া বা ক্রিকেট দেখায় ডুব দিতে পারাটা যোগব্যায়ামের মত৷ অরিন্দমদা আমার ভাগের একটা শিঙাড়া খানিকটা ভেঙে নিয়ে একটা জরুরী কথা বললে, "ক্রিকেট বা বই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বুঝলি তো। আদত ব্যাপারটা হলো ডুব দিতে পারায়৷ যে কোনো বিষয়ে এক মিনিটের জন্যও ডুব যেতে বলে যে'টা দরকার সে'টা হলো সেল্ফ-ডিসিপ্লিন৷ কোনো কিছুকে দরদ দিয়ে কদর করতে হলে এই সেল্ফ-ডিসিপ্লিন অত্যন্ত জরুরী। অন্যের চাপিয়ে দেওয়া ডিসিপ্লিনে হাড় জ্বলে যায়, কিন্তু নিজের ভালো লাগাকে ডিসিপ্লিনে বেঁধে ফেলায় যে তৃপ্তি, তা তুলনাহীন"। এরপর বেহিসেবের শিঙাড়াটা পুরোটাই সাফ করে অরিন্দমদা যোগ করলে, "আরো একটা ব্যাপার আছে জানিস। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্টের পরোয়া করলে সেই প্রোভার্বিয়াল ডুব দেওয়া যায় না৷ ইন ফ্যাক্ট, এ বই পড়ে কী হবে, ও ম্যাচ দেখে কী হবে; অত অঙ্ক করে বসলে সারাক্ষণ মনের মধ্যে খচখচ চলে। কিন্তু হাভাতের মত গা ভাসিয়ে দিতে পারাটাই হচ্ছে আদত থেরাপি"।

ম্যাটিলডার বাস রোল্ড ডাহলের কল্পনায়, কিন্তু ভদ্রলোকের লেখার গুণেই ম্যাটিলডা মেয়েটি জীবন্ত; প্রাণোচ্ছল। ছোট্ট ম্যাটিলডার জীবন না-পাওয়ায় ভরপুর অথচ সে'সব না-পাওয়া ছাপিয়ে ম্যাটিলডা আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে ডিকেন্সে৷ ম্যাটিলিডা জিনিয়াস বা সুপারগার্ল; বইয়ের মূল কথা সে'টা নয়। দু:খে জেরবার না হয়ে পুঁচকে একটা মেয়ে ডিকেন্সে ডুব দিয়ে আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে; আসল রূপকথা রয়েছে সেইখানে। অরিন্দমদার কথা শুনে মনে হলো অতটুকু মেয়ে ইয়াব্বড় সব বই পড়তে পারছে; সে'টা অবাক কাণ্ড বটে কিন্তু ম্যাজিক নয়৷ ম্যাজিক হলো ম্যাটিলডা এই যে মিসেস হ্যাভিশ্যাম, এস্টেলা আর পিপের জগতে হারিয়ে গিয়ে আনন্দ পাচ্ছে, সেই ব্যাপারটায়। আবার আহমেদনগর কেল্লায় বন্দী থেকে নেহেরু যতটুকু লেখালিখি করেছেন, সে'গুলো পড়েও স্পষ্ট যে ম্যাটিলডার মতই ভদ্রলোক পড়াশোনার ডিসিপ্লিনে ডুব দিয়ে নিজেকে মজবুত করছেন। সেই পড়া এবং লেখা কতটা ভালো এবং কতটা মন্দ হলো, সে হিসেবে না গিয়ে প্রসেসে গা ভাসাচ্ছেন।

আমি বা অরিন্দমদা ম্যাটিলডা বা জহরলালের নখের যোগ্য নই, তবে সামান্য গা-ভাসানোর সুযোগ আমাদেরও আছে, সে আনন্দ কম কীসে। সে আনন্দেই সে'দিন সেকেন্ড রাউন্ড শিঙাড়া ভাজতে গেছিলাম হয়ত।

প্রমথনাথের রবীন্দ্রনাথ



সম্প্রতি একটা দুর্দান্ত গল্পের বই পড়ে শেষ করেছি৷ যেহেতু আমার লেখার হাত ছিয়ানব্বুইয়ের ইডেন সেমিফাইনালের পিচের মতই কাঁচা, সেহেতু আমায় গিমিকের আশ্রয় নিতে হয়৷ প্রথম লাইনে 'গল্পের বই'য়ের ব্যবহারটা তেমনই একটা গিমিক। পড়লাম প্রমথনাথ বিশীর "রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন"; এ বই আত্মজীবনীমূলক৷ রসেবসে সামান্য যাত্রাযোগ ইতিউতি হয়ে থাকলে সে দায় প্রমথনাথের, কিন্তু বইটা আগাগোড়া সত্যি ঘটনাক্রমেই বাঁধা৷ ঘটনার ব্যাপারে বিস্তৃতভাবে জানতে হলে মানুষ খবরের কাগজ পড়বে। বইয়ে আশ্রয় নেওয়া সমস্ত ঘটনাদের 'ট্রীটমেন্ট' অন্যরকম হতে হবে; সে'খানে ঘটনাপ্রবাহের সত্যিটুকুকে আগলে রেখে রসালো গল্প ফেঁদে বসাটা লেখকের একটা জরুরি দায়িত্ব৷ সে'দিক থেকে, প্রমথনাথ একজন মডেল লেখক।

এর আগে ওঁর লেখা মাইকেলের জীবনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছি৷ এই বইখানা সে মুগ্ধতাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে৷ প্রমথনাথের ভাষা ও হিউমর সম্বন্ধে জ্ঞানগর্ভ কিছু বলতে গেলে আমি খামোখা লোক হাসাবো৷ শুধু এ'টুকুই স্বীকার করে নেওয়া; রবীন্দ্রনাথের মানবিক ও অতিমানবিক দিকগুলো খানিকটা অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হলে এ'রকম উপাদেয় বই বোধ হয় খুব বেশি নেই।

সতেরো বছর শান্তিনিকেতনে থেকে পড়াশোনা করেছেন প্রমথনাথ। শান্তিনিকেতনের গোড়ার দিনগুলো স্বচক্ষে দেখেছেন, উপভোগ করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ আদর্শ শিক্ষা বলতে যে প্রসেসকে বুঝতেন, সেই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে প্রমথনাথের চরিত্র ঘষামাজা হয়েছে৷ সে অর্থে, তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু পেল্লায় একজন সাহিত্যিক নন, একজন মাস্টারমশাইও বটে৷ এই বইয়ে সেই মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথের গল্প রয়েছে৷

আর রয়েছে শান্তিনিকেতনের শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠার গল্প। একদিক থেকে সে'টাও রবীন্দ্রনাথেরই গল্প৷ রবীন্দ্রনাথ ভদ্রলোক যে কী 'খতরনাক', আর শান্তিনিকেতন যে কত বড় একটা বিপ্লব; সে কথা অনায়াসে লিখেছেন প্রমথনাথ৷ আর সে'সব তুলে ধরেছেন দুর্দান্ত সব গল্পের মাধ্যমে; সে'খানে মূলচরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও উঠে এসেছেন অন্যান্য শিক্ষকরা, স্কুলের ছাত্ররা, অন্যান্য কর্মীরা, আর অতি অবশ্যই; বোলপুর৷

এই বইয়ের স্থান-কাল-পাত্র সমস্ত যদি কাল্পনিকও হত; তা'হলেও এ বই দর্শনের গভীরতা আর হিউমরের ধারে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে টিকে রইত। বলাই বাহুল্য, এ বই সত্য-নির্ভর এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল৷ নেহাত নিরুপায় পাঠকরা এ বই পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যেই হে-হে করে উঠছে, তাই সমঝদার ক্রিটিকরা টুপি খুলে এই বইকে যোগ্য সেল্যুট জানাচ্ছেন না৷

বইয়ে কী আছে না আছে তা বলে দিলে মোটেও স্পয়লার দেওয়া হবে না৷ কিন্তু সে সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু বলছি না কারণ যে বিষয়ে প্রমথনাথ কথা বলেছেন, আমার মত মোটাদাগের ব্লগার সে'গুলো কোট করতে গেলে প্রমথনাথের সাহিত্যবোধকে ছোট করা হবে৷

শুধু তিনটে কথা।

এক, এই বইতে দু'টো অধ্যায়ের উল্লেখ করছি৷ একটায় প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঋতু বৈচিত্রের কথা বলেছেন৷ প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা জিনিসটা যে কী 'সিরিয়াস' একটা ব্যাপার আর সে'টা যথাযথ ভাবে করতে হলে সৌন্দর্যবোধ, ভাষার ওপর দখল আর আর ভাবনার গভীরতাকে যে কী পর্যায় টেনে নিয়ে যাওয়া দরকার; তার শ্রেষ্ঠ নমুনা বইয়ের এই অংশটা৷

দুই, প্রমথনাথ ছাত্রদের বাঘ শিকার নিয়ে একটা ফিচেল অধ্যায় লিখেছেন৷ অমন গুণী মানুষ যে কী নিশ্চিন্তে ফচকেমির জগতে বিচরণ করতে পারেন, সে'টা না পড়লে বিশ্বাস হয় না৷ ফচকেমি কথাটা বললাম ওই গিমিক অর্থে। আদতে হিউমরের ব্যাপারে প্রমথনাথের কলম ক্ষুরধার; আর সেই ক্ষুরে নিজেকে রক্তাক্ত করতেও তিনি পিছপা নন; সে'খানেই তাঁর ফচকেমি হয়ে ওঠে রবীন্দ্র-লেভেলের (এ'টাও গিমিক হলো। বোধ হয়)।

তিন, এক গুরুজনের সঙ্গে আমি মাঝেমধ্যেই এঁড়ে তর্ক জুড়ি 'রিগর' (Rigour) নিয়ে৷ তিনি বলেন "যাই করবি, তা'তে রিগর থাকবে৷ অলসভাবে কোনো কিছু করবি না, এমনকি আলসেমিও না"৷ আমি তার দাবী খণ্ডন করে বলি, "রিগর মন্দ না, কিন্তু কিছু ক্ষেত্র ও'সব রিগর-ডিসিপ্লিনের বালাই না রেখে স্রেফ গা এলিয়ে উপভোগ করাই ভালো"৷ সে গুরুজন মৃদুস্বরে বলেন, "না না; রিগর থাকলে ফুর্তির কোয়ালিটিও ইম্প্রুভ করবে"৷ আমি পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাই৷ এ'দিকে প্রমথনাথের লেখা শান্তিনিকেতনের ছাত্রজীবনের গল্প পড়ে মনে হলো; রিগর ব্যাপারটা সত্যিই বড় দামী৷ রবীন্দ্রনাথের সেই 'ইস্কুলে'র মূল উদ্দেশ্যই বোধ হয় ছিল ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে 'রিগর'য়ের প্রতি আনুগত্য ঢুকিয়ে দেওয়া। সিলেবাসের বাইরে যা কিছু, যা কিছু অদরকারী; সে'গুলোও যদি মনপ্রাণ দিয়ে আয়ত্ত করা যায়- তা'হলে সেই অ-সিলেবাসিও আর অদরকারী জিনিসপত্রেও অমরত্বের জেল্লা লাগে। বইটা পড়ে সামান্য মনখারাপই হল বটে; কোনো কিছুই মন দিয়ে করা হলো না।

স্ট্রিট চাইল্ড



জিম জার্ভিসের গল্প "না পড়লেই নয়", সেই মোটা দাগের কথাটা বলতে ঠিক ইচ্ছে করছে না৷ "স্ট্রিট চাইল্ড" বইটা শিশু সাহিত্যের আওতায় পড়ে, কিন্তু বড়রাও এ বই পড়লে এক অদ্ভুত মায়ায় আটকা পড়বেন, বড় কষ্টও হবে। বিশেষত বাপ-মায়ের চোখ দিয়ে এ বই পড়াটা ঠিক সহজ নয়৷

ছোট্ট জিম বাপ-মাকে হারিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর শশব্যস্ত লণ্ডন শহরের মারপ্যাঁচে তলিয়ে যেতে থাকে৷ শৈশবে বাপ-মায়ের স্নেহ হারানো যে কী ভয়াবহ, সেই শিশুরা যে কী বিশ্রী ভাবে একা..! একরত্তি ছেলের মাথায় প্রতিনিয়ত আকাশ ভেঙে পড়ে, প্রতিদিন নিত্য নতুন যুদ্ধ৷

এ বিষয়ে সাহিত্য কম হয়নি, তবে বার্লি ডোহার্টির লেখায় একটা মারাত্মক ভালো ব্যাপার ঘটেছে। প্রবল অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্তের 'রিয়েলিস্ট' বর্ণনা করতে গিয়েও ছোট্ট জিমের 'পয়েন্ট অফ ভ্যিউ'র যে সারল্য, সে'টা ক্ষুণ্ণ হয়নি। একটা অনাথ শিশু, সে এ দোর থেকে ও দোর গলাধাক্কা খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সামান্য ভালোবাসার জন্য তার প্রবল আকুতি- সেই নিদারুণ ট্র্যাজেডির মধ্যে এক অপরিসীম মায়া আর বাঁচার অদম্য ইচ্ছে এসে মিশেছে। এবং সে ব্যাপারটা ঘটেছে শিশুপাঠ্য ভাষায়৷ এ'দিক থেকে ডোহার্টির লেখা আমার অনবদ্য মনে হয়েছে।

ওইটুকু একটা শিশু, সে বারবার ধাক্কা খাচ্ছে, ধূর্ত মানুষজন তাকে পিষে ফেলতে চাইছে; কিন্তু কোনও কিছুই তাকে পরাস্ত করতে পারছে না৷ এ গল্পে আর যাই হোক রূপকথা নেই৷ এমন কী অপু-সুলভ রোমান্টিকতাও নেই৷ আছে গ্রাসাচ্ছদনের জন্য একটি শিশুর যুদ্ধ, যে যুদ্ধের গল্প বলতে গিয়ে ডোহার্টির লেখায় মায়া হ্রাস পায়নি এতটুকু। দু:সাহস নিয়ে বলি; সে'দিক থেকে এ লেখা ডিকেন্স আর শৈলেন ঘোষের এক অদ্ভুত মিশেল।

শিশুদের আকাশকুসুম ভাবনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা জীবন আর উনবিংশ শতাব্দীর লন্ডনের একটা টুকরোকে সরেস ভাবে চিনতে চাইলে এ বই "না পড়লেই নয়"।

Wednesday, December 6, 2023

শীর্ষেন্দু



যদি মুখচোরা হতেই হয়, তবে যেন শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে গল্পের মুখচোরা শান্ত নেদু মানুষটি হয়ে নিজের অজান্তেই অসাধ্য সাধন করতে পারি।

যদি সিঁদ কাটতেই হয়, তবে যেন শীর্ষেন্দুর গল্পের ধুরন্ধর চোরটির মত আদর্শ শিল্পী হয়ে উঠতে পারি।

যদি ডাকাতিই করতে হয়, তবে যেন শীর্ষেন্দুর গল্পের গা-কাঁপানো ডাকাত সর্দার সেজে নাচনকোঁদন করেও মনেমনে আলাভোলা ভালোমানুষটিই থেকে যেতে পারি।

যদি পরনিন্দা-পরচর্চাই করতে হয়, তবে যেন শীর্ষেন্দুর গল্পের পাড়ার জ্যেঠু বা প্রতিবেশী পিসিমার মত 'মাই ডিয়ার' হতে পারি।

যদি ঝগড়ুটে হতেই হয়, তবে যেন  শীর্ষেন্দুর গল্পের সেই কথায়-কথায় পাড়া মাথায় করার লোকটার মতই চট করে বরফ-গলা-জলও হতে পারি। 

যদি বৈজ্ঞানিক হতে ইচ্ছে হয়, তবে যেন শীর্ষেন্দুর গল্প আলো করা বিজ্ঞান-সাধক হয়ে টস্তলের (টর্চ + পিস্তল) আলোয় দুনিয়ার অন্ধকার দূর করে বদখত মানুষদের শায়েস্তা করতে পারি।

আর এ জীবনে যদি কিছুই করে উঠতে না পারি, তবে যেন মরার পর অন্তত শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে গল্পের ভূত হয়ে বেঁচে উঠতে পারি।

Tuesday, December 5, 2023

ছোটদের লেখা



কিশোরভারতীর আত্মপ্রকাশের বছর তিনেকের মাথায় প্রথম পুজোসংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে, দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়।

সম্প্রতি  পত্রভারতীর তরফ থেকে সে'সংখ্যাটি বইয়ের আকারে নতুন ভাবে ছেপে বের করা হয়েছে। এই ধরণের জরুরী কাজ দেব সাহিত্য কুটীরও করে চলেছে পুরনো শুকতারাগুলো নতুন করে ছেপে৷ 

যা হোক, যে'কথাটা বলতে এই পোস্ট৷ ছোটরা যথেষ্ট বাংলা গল্পের বই ও পত্রিকা পড়ছে কিনা, এ নিয়ে আমরা প্রচুর আলাপ-আলোচনা শুনতে পাই৷ সে আলোচনাগুলো জরুরীও বটে৷ সব ভাষাতেই চিরকাল তেমন বিশ্লেষণ হয়েছে, আরও হবে৷ এর পাশাপাশি ছোটদের আমরা কী পড়তে দিচ্ছি, সে'সম্বন্ধেও জোরদার আলোচনা হবে এমনটাই  কাম্য।

সদ্য কেনা সেই নতুন করে প্রকাশিত প্রথম কিশোরভারতী পুজোসংখ্যার সম্পাদকীয়টি পড়লাম৷ ছোটদের জন্যই লেখা; সুমিষ্ট ও সরল। কিন্তু সে'লেখায় বাবা-বাছা করে সেরেল্যাক গুলে খাইয়ে দেওয়া নেই। বরং ঝরঝরে স্মার্ট ভাষায় সম্পাদক দাগিয়ে দিয়েছেন কিশোরভারতী কী এবং কেন৷ এবং তার চেয়েও বড় কথা; ধারালো সব বক্তব্য রাখঢাক ছাড়াই পেশ করা হয়েছে৷ ছোটছেলেমেয়েদের কাতুকুতু আর আশীর্বাদ ছাড়াও অনেক কিছু দেওয়ার আছে, সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি সম্পাদক৷ সে'খানেই আমাদের কতকিছু শেখার। 

সে সম্পাদকীয়র কিছুটা অংশ তুলে দিলাম; বড়দের জন্য৷ এ'টা মনে করিয়ে দিতে যে এই লেখা অনায়াসে ছোটদের পাতে দেওয়া হত এককালে (এখন হয় না তা বলছি না, আমি কতটাই বা পড়ি - তবে এমনটাই আরও হওয়া উচিৎ)। এ'ভাবেই ছোটদের মন জয় করা সম্ভব; কারণ ওরা আমাদের চেয়ে ঢের বেশি স্মার্ট- জগতসংসারের নিয়মই তেমন।

তিপ্পান্ন বছর আগেকার ছোটদের পুজোসংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে তুলে দেওয়া, পড়ুন:

"..মনে আজ শান্তি নেই, সে আনন্দও নেই।

কিছুদিন আগে অতি বর্ষণের ফলে পশ্চিমবাংলায় যে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল, ব্যাপ্তি ও গভীরতায় তার বুঝি তুলনা নেই-অন্ততঃ স্মরণকালের ইতিহাসে তার নজির মিলবে কিনা সন্দেহ। এই বন্যার ফলে জেলার পর জেলায় সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর ভেঙেছে, সংসার ভেসে গেছে, প্রাণহানি হয়েছে, স্থাবর-অস্থাবর সব সম্বল প্রায় ধ্বংস হয়েছে, গবাদি গৃহপালিত পশু ডুবে মরেছে আর মাঠের ও বাগানের ফসলের অর্থাৎ ধান ও শাক-সব্জির যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। এই লক্ষ লক্ষ সর্বস্বান্ত আর্ত ছাপোষা মানুষ আমাদেরই আপনজন। বিনা অপরাধে আজ তারা সর্বহারা। আমাদের আজ সবচেয়ে বড় কর্তব্য, অবিলম্বে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করা।

কিন্তু যে গুরুতর প্রশ্নটি আমাদের সবচেয়ে বেশী বিচলিত ও অস্থির করে তুলেছে, তা হলো- এর থেকে নিষ্কৃতি কোথায়? প্রতি বছর দেশের কোন-না-কোন অঞ্চলে একটু বেশী বৃষ্টি হলেই এই যে ভয়াবহ বন্যা নামছে, ধনপ্রাণ নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণে, এটাকে কি আমরা বিধাতার রুদ্ররোষ ও অখণ্ডনীয় বিধিলিপি হিসাবে গ্রহণ করবো, না গ্রহণ করবো একদল মানুষের চরম অপদার্থতা, দুর্নীতি ও হৃদয়হীনতার ভয়ঙ্কর নিদর্শন হিসাবে?

এর উত্তর দেবার কথা দেশের সরকারের। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, তা দেবার মতো মনোবল তাদের বোধহয় নেই।

অত্যধিক বৃষ্টি হলে দেশের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে এভাবে বিধ্বংসী বন্যা হবে কেন? দেশের অসংখ্য নদী-নালা-খাল যদি হেজে মজে ভরাট হয়ে না গিয়ে থাকে, তাদের খাত যদি গভীর থাকে এবং সুষ্ঠু স্রোত-চলাচলে যদি কোন বাধা না ঘটে, তাহলে যত বৃষ্টিই হোক, জল তো ঐ নদী-নালা-খাল দিয়ে বেরিয়ে যাবে। দেশের জল-নিষ্কাশনের এটাই তো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা।

নদী-নালা-খাল ঠিকমতো চালু ও বহতা থাকলে, খরা-অনাবৃষ্টিতে যেমন জলের অভাবে ফসল না হবার ভয় থাকে না, তেমনি অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ফসল ও ধনপ্রাণ নষ্ট হবারও আশঙ্কা থাকে না।

আমাদের দেহের রক্তবহা শিরা-উপশিরার মতো এগুলিই দেশের জলবহা শিরা-উপশিরা। দেহের শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটলে, যেমন গুরুতর রোগ ও শেষ পর্যন্ত মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হবে দাঁড়ায়, তেমনি নদী-নালা-খাল যদি ঠিকমতো চালু না থাকে, তাহলে দেশের ক্রমাগত ক্ষয় ও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আমাদের দেশও আজ সেই ধ্বংসের দিকে অনিবার্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। গুরুতর ক্ষয়রোগ ধরেছে তাকে অনেক দিন। কিন্তু কেন এই অবস্থা হলো, তার জবাব যাদের দেবার কথা, তারা কিন্তু নীরব।

দুনিয়ার প্রতিটি সভ্য অগ্রসর দেশের সরকার নিজের দেশের এই সব প্রকৃতিক শিরা-উপশিরা যাতে পুরোপুরি চালু ও বহতা থাকে, তার দিকে খরদৃষ্টি রাখেন। তাদের খাত যাতে ভরাট হয়ে না যায়, তার জন্য 'ড্রেজার' নামক অতিকায় যন্ত্র দিয়ে খাত থেকে মাটি কেটে তোলার নিয়মিত ব্যবস্থা করেন। উপরন্তু নতুন নতুন গভীর খাল কেটে তাঁরা দেশের শিরা-উপশিরার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন।

যে কোন প্রকৃত দায়িত্বশীল সরকারের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক কাজ করার ফলে, অনাবৃষ্টি হোক আর অতিবৃষ্টি হোক, জলসেচ বা জলনিকাশের কোন দুর্ভাবনা থাকে না। পারমাণবিক যুগে মানুষ আজ যেখানে মহাবিশ্বের রহস্য উদ্‌ঘাটনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নদী-নালা-খালের এই গভীরতা ও স্রোত-চলাচল ঠিক রাখা তাদের কাছে কোন সমস্যাই নয়।

কিন্তু তা, মনে হয়, বিষম সমস্যা আমাদের দেশের সরকারের কাছে। কেন? তেইশ বছর পরে দেশের এই ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ও বিপর্যয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটাই আমাদের মনকে বিদ্রোহী করে তুলেছে।

বন্ধু, আগামী দিনে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হবে তোমাদের, বাঁচাতে হবে আমাদের এই সোনার জন্মভূমিকে। তার জন্যেই আজ তৈরী হও তোমরা। তাহলেই সার্থক হবে কিশোর ভারতীর আত্মপ্রকাশ, তার এই দুর্গম পথ-পরিক্রমা আর ঐকান্তিক চেষ্টা, যত্ন ও পরিশ্রম।

***

( বলাই বাহুল্য, এমন মূল্যবান বইটা নির্দ্বিধায় সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ'টা আমি অবশ্য উপহার পেয়েছি)।

Sunday, March 12, 2023

পাঠক গুলজার

আমরা যারা 'ভোর্যেশাস রীডার' নই, অথচ বই ভালোবাসি; তারা যেন ঘাবড়ে না যাই। বই দেখলেই হয়ত আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি না, কিন্তু আলতো মলাট-স্পর্শকে ধুরছাই-কুছভিনহি বলে যারা নস্যাৎ করে থাকেন, তাদের মতামতকে তোল্লাই দিয়ে নিজেদের ক্রমাগত ইমোশনাল-ঝ্যাঁটাপেটা করার কোনও মানেই হয়না। আড়াই বছর আগে কেনা বই এখনও পড়া হয়নি, সে'টাকে শুধুই ব্যর্থতা বলে যারা দেখলেন, তাঁরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল আউটপুটটুকুতেই নিজেদের আটকে রাখলেন। রোম্যান্স কোশেন্টকে বুঝে উঠতে পারলেন না। সব প্রেমই যদি টপাটপ ছাদনাতলায় গিয়ে পড়ত, তা'হলে কি গজলের দুনিয়াটা এমন রঙিন হত?
আড়াই বছর আগে কেনা একটা বই, যে'টা আজও পড়ে ওঠা হয়নি; সে'টাকে একটা প্রবল সম্ভাবনার উৎস হিসেবে দেখতে হবে। বইয়ের তাকে বোকাসোকা হয়ে পড়ে আছে; ফুলদানির বা আমাজনের ফাঁকা বাক্সের আড়ালে ঢাকা পড়ছে, ঠিক আছে। কিন্তু দেখবেন; স্যাট করে যে'কোনও একদিন নামিয়েই ফ্যাট করে পড়া শুরু করে দেব। এই যে একটা দুর্দান্ত "পুজো আসছে পুজো আসছে" ব্যাপার, সে'টাকে উড়িয়ে দিলেই হবে নাকি। হঠাৎ একদিন বইয়ের তাক থেকে পুরনো না-পড়া বই নামিয়ে আনা হবে। ধুলো ঝেড়ে মলাটে হাত বুলনো হবে, ওজনটা অনুভব করা হবে, পাতাগুলো ফরফরিয়ে দেখা হবে খানিকক্ষণ। তবেই না আসল খেল্‌। আর তারপর সে বই হাতে খাটে বা সোফায় গা এলিয়ে বসা। বইটা কেনার মুহূর্তটা মনে করে একটা তৃপ্তির হাসি জেনারেট করার চেষ্টা করা। বছর-খানেক আগে কেনা বই হলে সে বইয়ের ছাপা দাম দেখে অবশ্যই একবার মনে হবে, "উফ, ইনফ্লেশন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে রে ভাই"। এরপর, সেই বইয়ের প্রথম প্যারাগ্রাফের (বা প্রথম লাইনের) প্রতিটা শব্দ, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। সাদা কাগজে কালো ছাপা অক্ষর, এক এক পিস মুক্তো। দেখুন, বইয়ের ভালো-মন্দ, তা পরে আসে। সে শুচিবাইয়ের আগে আসে অন্য আনন্দ; একটা ছাপা শব্দ থেকে অন্য ছাপা শব্দে গড়িয়ে যাওয়ার। সে এক হাইক্লাস থেরাপি। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি; সিলেবাসে নেই এমন যে কোনও বই পড়ার মধ্যেই একটা গোবেচারা বিপ্লব রয়েছে। বইটা কেমন ভাবে পড়লাম, কতটা মন দিয়ে পড়লাম, কতটা যত্ন করে আত্মস্থ করলাম; সে'টা বাছবিচার করতে চেয়ে কেউ কোশ্চেনপেপার ধরিয়ে দেবে না। এ'টাই আমার কাছে বরাবর একটা ম্যাজিকের মত মনে হত। মার্কশিটের বাইরেও একটা পড়াশোনার জগত তা'হলে আছে যে'খানে আমার মত এলেবেলে মানুষও মাস্তানি করতে পারে। সেই জাদু-জগতের বইগুলোকে আমি গোগ্রাসে গিলব না চেটেচেটে ধীরেসুস্থে খাবো; সে'টা আমিই ঠিক করে নেব। তেমনটাই হওয়া দরকার।
তা, হয়ত সেই নতুন বইয়ের প্রথম কয়েক লাইন পড়ার পরই মনের মধ্যে একটা তৃপ্তির ঝিম লেগে গেল। তারপর বাড়ির মধ্যে যে'খানেই ঘুরঘুর করছি, হাতে বইটা ঝুলছে। পড়ছি না, কিন্তু হাতছাড়া করছি না। সোফার পাশের টেবিলে, বিছানায় বালিশের পাশে, কাজের টেবিলে ল্যাপটপের গায়ে; বই-বাবাজীটি আছেন। কিলো কিলো পড়লেই হল নাকি, রসিয়ে বইটাকে ভোগ করতে হবে তো। এ'ভাবে হয়ত এক হপ্তায় বইটা বড়জোর বিশ-তিরিশ পাতা এগোল। তদ্দিনে বইটার সঙ্গে একটা মাইডিয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। সম্পর্কটা বেশ, ইয়ে, শারীরিক। লেখকের গুণ, সাহিত্য-মান; সে'সব নিয়ে পরে ভাবলেও হবে। কিন্তু প্রথম ক'দিনে বইটার গন্ধ, স্পর্শ, জ্যাকেটের ঘষটানি; সমস্ত চেনা হয়ে গেছে; সেই চেনার দাম লাখ-টাকা। যা হোক, হপ্তা-খানেক পর হয়ত সে বই চালান হবে অফিসের ব্যাগে। লাঞ্চের সময় টিফিন কৌটোর পাশাপাশি টেবিল আলো করে বেরিয়ে আসবে সেই বই। ফের এগোবে দু'পাতা-তিন পাতা করে। সে দু'পাতার অক্সিজেনেই অফিস গুলজার হয়ে উঠবে। ডেলিপ্যাসেঞ্জারির ক্ষেত্রে হয়ত সে বই বেরিয়ে আসবে বাসে-ট্রেনে-ট্রামে, মোবাইল ফোন আর ইয়ার-ফোনের সঙ্গে কম্পিটিশনে নামবে। পড়া হয়ত কয়েক লাইনের বেশি এগোবে না। কিন্তু সেই প্রতিটি লাইন পড়ার দামই ভরিতে মাপতে হবে।
এই'ভাবে। চিকনের মিহি সেলাই যে'ভাবে শম্বুক-গতিতে এগোয়, সে'ভাবে আমাদের মত অলস পাঠকের এ পাতা থেকে ও'পাতায় এগিয়ে যাওয়া। পৌষের শীতে শুরু হওয়া বই যখন জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরমে শেষ পরিচ্ছেদে এসে দাঁড়াবে, পাঠক ততক্ষণে শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন। তিনদিন বুক চিতিয়ে মিনিমাম স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করে দলকে টেস্ট জেতানোর আনন্দ তখন তাঁর হাতের মুঠোয়।
কাজেই আমরা যারা ঢিমেতালে বই পড়ি, তাঁদের পাঠককুলের কলঙ্ক বলে পাশ কাটিয়ে দেবেন না। কেমন?

Saturday, February 25, 2023

কবিতা কাহারে বলে, গান কাহারে বলে



মগজ ব্যাপারটা যে কী ধুরন্ধর চিজ। আর আমার মত গাম্বাট মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের মাথাই যথেষ্ট।

আমার বুকশেলফে, কোনও অজানা কারণে কয়েকটা কবিতার বই আছে। কলকাতার কম্বলদের মতই, সে'সব বইদের সচরাচর ঘাঁটানো হয়না। আবার কলকাতার মানুষের মতই, আজ হঠাৎ উথলে ওঠা হুজুগের বশে সে'সব কম্বল...থুড়ি বইদের তাক থেকে নামালাম। উল্টেপাল্টে দেখেটেখে, ধুলোটুলো ঝেড়ে তাকের বই তাকে ফেরত যাবে, তেমনটাই হওয়ার কথা। কী মনে করে দু'একটা কবিতা পড়ার চেষ্টা করলাম। খানিকটা শক্তি, খানিকটা সুনীল, খানিকটা শঙ্খ। নিজের ওপর গর্ব হচ্ছিল, কবিতা পড়ছি ভেবে। আরে, কবিতা মানে গানই তো, সুরটাকে নিজের মত মনে মনে বসিয়ে নিলেই অ্যাপ্রিশিয়েশন ব্যাপারটা তরতরিয়ে বইবে। 

যা হোক, সে'সব কবিতার বইয়ের ফাঁকে একটা বই ছিল রবিস্যারের শ্রেষ্ঠ কবিতার। সে'গুলো বেছে নিয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলি স্বয়ং। বইয়ের শুরুতে একটা চমৎকার মুখবন্ধ লিখেছেন সুনীল; শিরোনাম - "রবীন্দ্রনাথ এবং আধুনিক কবিতা"। কবিতা বুঝিনা, তায় আবার আধুনিক। রবীন্দ্রনাথ বুঝি, সে'কথা বলার দুঃসাহসও নেই। তবে বাংলা ভাষাটা যেহেতু খানিকটা বুঝি, তাই মুগ্ধ হয়ে পড়াটা ঠেকায় কে।

তা সেই বইয়ের দ্বিতীয় কবিতা একটা গান; সখী, ভাবনা কাহারে বলে। অনেকের মতই, এ গানটা আমার মুখস্থ; কমা, ফুলস্টপ, হাঁচি, বিষম সহ। আমার গলায় সুর নেই, প্রাণে কবিতা নেই; অথচ এ গান গাইতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কাজেই, কবিতা হিসেবে এই গানটা বইয়ের পাতায় ছাপা আছে দেখে প্রথমেই মনে হল; এ পড়ে হবেটা কী, পুরোটাই কণ্ঠস্থ তো। চোখ বুজলেই এ গান কানে-বুকে বেজে উঠবে; মায়ের গলায়, শ্রাবণী সেনের গলায়। সে গান আবার বইতে পড়তে যাব কেন?

তবু। মানুষ হয়ে জন্মেছি যখন, হিসেবের বাইরে পা না রাখলে চলবে কেন? শুরু করলাম পড়া। এ'খানেই সেই মগজের চমক। আমি যা লিখছি তা হয়ত গোটাটাই অযৌক্তিক; তবে যুক্তিবাজ হলে কী আর ব্লগ লিখে লিঙ্ক শেয়ার করে মানুষজনকে জ্বালিয়ে মারি। কাজেই লিখেই রাখি। কী অদ্ভুত, মুখস্থ একটা গান; সে'টাকে যখন সাদা কাগজের ওপর কালো ছাপা অক্ষরে পড়ছি; কানের বদলে চোখ অ্যাক্টিভেট হচ্ছে, চেনা সুর আবছা হয়ে একটা অন্য রিদম আবিষ্কার করছি এ লাইন থেকে ও লাইনে যাওয়ার সময়। এ গানের সুরের ম্যাজিক বর্ণনা করার দুঃসাহস আমার নেই। কিন্তু কবিতাটা পড়তে গিয়ে, সে সুর সরে গিয়ে যে'টা পড়ে রইল; সে'টাকেও একটা অন্য জাতের জাদু হিসেবে মগজ চিনে নিল। প্রতিটা শব্দই পূর্বপরিচিত, অথচ পড়তে গিয়ে দেখলাম তারা সক্কলে অন্য মেজাজে উঠে দাঁড়ালে। গানের মানে পালটে গেল না, তবু সে কবিতাটা গানের থেকে আলাদা হয়ে ধরে দিল যেন। সে লেখা সুরের সঙ্গে মিলে একটা জলতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে বটে, কিন্তু কথাগুলো সুরের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। সুর বাদেও তাদের অস্তিত্ব জোরালো; জমজমাট।

একটা নতুন কবিতা পড়ে ফেলল মগজ। বহুবার শোনা গানটার সঙ্গে যাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না কিছুতেই। ভাগ্যিস সুনীলবাবু এ গানকে "রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা"র বইয়ের প্রথম দিকেই চালান করেছেন। নয়ত টের পেতাম কী করে সুরের পরিচয়টাই কবিতার জন্য শেষ কথা নয়? আর আমাদের মত গদ্য-গাম্বাটদেরও কবিতার জগতে স্থান আছে, সে'টাকেও ক্লেম করতে হবে তো।