সহজ এক লাইনে নিজের ভালো লাগা বলে দিতেই পারি। অভিষেক মুখার্জির 'কট ইয়াপ্পিং - আ হিস্ট্রি অফ ক্রিকেট ইন ১০০ কোটস' একটা অতি জবরদস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ বই। ক্রিকেট সম্বন্ধে আগ্রহী হলে, ইতিহাস ভালোবাসলে আর জমাটি পুজোসংখ্যার অভাব বোধ করলে এ বই নিশ্চিন্তে অর্ডার করে ফেলতে পারেন। কিন্তু স্রেফ সে'কথাটা বলার জন্য লিখতে বসিনি।
ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে বইয়ের অভাব নেই। আমার নিজের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে কম নয়তো বুক ফুলিয়ে একটা ফর্দ তুলে দিতাম এখানে। তবে নিজে অল্প পড়েছি বলে কথাও অল্প বলবো; আজকালকার যুগে সে সততা হাস্যকর-ভাবে অচল। সাধারণত পাঠক ক্রিকেট ইতিহাস বিষয়ক যে বইগুলো হাতে তুলে নেবেন, সে'গুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট ফোকাস বেছে নিয়ে এগোয়। এই যেমন রামচন্দ্র গুহর 'আ কর্নার অফ আ ক্রিকেট ফিল্ড' ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে লেখা, পিটার অবর্নের 'উন্ডেড টাইগার' পাকিস্তান ক্রিকেটের ওপর লেখা 'এপিক', নিকোলাস ব্রুকসের 'অ্যান আইল্যান্ডস ইলেভেন' রয়েছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ওপর আর টীম অলবোনের 'আউট অফ দ্য অ্যাশেস' লেখা হয়েছে আফগানদের হুজুগে ক্রিকেট নিয়ে। আবার ধরুন জ্যারড কিম্বারের একটা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে আলাদা করে বই লিখেছেন, সে বইটা রাম গুহর বইয়ের চেয়ে অনেক পাতলা কিন্তু বিষয়ের দিক থেকে ব্যাপ্তি অনেক বেশি। পরিসর যত চওড়া হবে, সে গল্প সাজিয়ে-গুছিয়ে, সঠিক পরিমাপে, সত্যনিষ্ঠ ভাবে, জমজমাট স্টাইলে লেখা ততটাই কঠিন। মানে ধরুন, পার্ক স্ট্রিটের ইতিহাস লেখার চেয়ে কলকাতার পথঘাটের ইতিহাস লেখা অনেক বেশি জটিল। আর গোটা "কলিকাতার ইতিহাস" নিয়ে ভাবতে বসলে মাথার স্ক্রু-পেরেক সব টপাটপ খুলে পড়ার কথা। পাঠক হিসেবে আমরা বলতেই পারি, "কই, কত সহজে তো পূর্ণেন্দুবাবু 'কলকাতার ইতিকথা'য় দারুণ ভাবে শহরের গোটা ইতিহাসটা রসিয়ে লিখে গেছেন"। বইটা আমার অন্যতম প্রিয় বই কিন্তু নিশ্চিন্তে বলা যায় ও'টা কলকাতার সামগ্রিক ইতিহাস নয়। মোগল-ইংরেজ রাজা-রাজড়াদের টানা পোড়েনে কী'ভাবে কয়েকটা গাঁ মিলেমিশে একটা পেল্লায় শহর তৈরি হলো সে গল্প একটা চমৎকার ব্যাপার বটে। কিন্তু কলকাতার ইতিহাসে কলকাতার মানুষজনের পোশাক, খাদ্য, প্রতিবাদ, গান-বাজনা, ধর্ম- আরো কত কী থাকার কথা। এত কিছু গুঁজে দিতে হলে পূর্ণেন্দুবাবুর বইটা স্রেফ গোল্লায় যেত, পাঠক হিসেবে আমরাও সে বই দেখলে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মাতব্বরি ঢঙে বলতাম "ও'সব বই ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে থাকার কথা, আমার বইয়ের তাকে আবার কেন"। মোদ্দা কথা হলো, বিষয়ের পরিসর যত চওড়া হবে, সে বইয়ের ব্যাপ্তিকে সামাল দিয়ে সুপাঠ্য করে তোলাটা একটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। অভিষেক মুখুজ্জের 'কট ইয়াপ্পিং' সে জটিল কাজটা দুর্দান্ত ভাবে (এবং সুরসিক স্টাইলে) করেছে।
"দিস ইজ ক্রিকেট" বলতে আর পাঁচটা সাধারণ ক্রিকেট-ভালোবাসিয়ে যা যা বুঝবে, সেই সমস্ত উপাদান এ বইতে ঠাঁই পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। ব্যাট, বল, রান, বিলেত, লর্ডস, টেস্ট, সেঞ্চুরি, উইকেট, আন্ডারআর্ম, গ্রেস, ব্র্যাডম্যান, বাউন্সার, রঞ্জি, এমসিসি, আইসিসি, প্যাকার, বিশ্বকাপ, ইত্যাদি আর যা কিছু ভাবতে পারেন আর কী। পাশাপাশি যোগ হয়েছে এমন সব এলিমেন্ট, যে'গুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, "তাই তো, ক্রিকেট মানে তো এই ব্যাপারগুলোও বটে"। আমার মতে, সে'খানেই এই বই জরুরী। অভিষেক মুখার্জি তথ্য-নিষ্ঠ, ক্রিকেট-পাগল, সাহিত্য-রসিক, সুলেখক; এ'গুলো কোনও নতুন কথা নয়। আপনি যদি ওঁর লেখা আগে নাও পড়ে থাকেন, ওঁর লেখা দু'চারটে প্রবন্ধ পড়লেই আপনি নিশ্চিন্ত হবেন যে আমি অকারণ বাড়িয়ে বলছি না। তবে এই গুণগুলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জার্নালিজমে হয়তো বিরল নয়। অভিষেকের কলমের মারাত্মকভাবে ধারালো কারণ ভদ্রলোক মারাত্মকভাবে রাজনৈতিক এবং প্রবলভাবে আধুনিক। বইটা ইনফরমেশনে ঠাসা, সেই ১১৮০ থেকে গল্প শুরু হয়েছে যে'খানে এক জোসেফ সাহেব লিখছেন "youths at cricks did play"। এরপর শুধুমাত্র যাচাই করা তথ্যের ওপর ভর করে ওঁর লেখা এগিয়েছে সাড়ে চারশো পাতা; অথচ আর পাঁচটা 'বেস্ট সেলার নভেলের' মতই এ বইয়ের পাঠকরাও তরতরিয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য। এর একটা বড় কারণ এই যে ওঁর লেখায় উল্লেখিত তথ্য ও ঘটনাগুলোকে কোনোভাবেই 'পলিটিকালি স্যানিটাইজ' করে নেওয়া হয়নি। সে'দিক থেকে এ বই যতটা ক্রিকেটের, তার চেয়েও বেশি ইতিহাসের। অ্যামেচার বনাম প্রফেশনাল, অ্যাপারথেড, বেসিল ডি'অলিভেরা, ভারত-পাকিস্তানের প্রতি বিলেতের অবহেলা; এসব প্রসঙ্গ ক্রিকেট ইতিহাস লিখতে গেলে উঠে আসবেই। কিন্তু এই বই দু'কদম বাড়তি এগিয়েছে অন্যভাবে। প্রতিটা চরিত্র ও ঘটনাকে অভিষেক ঠাণ্ডা মাথায় 'লিবেরাল পার্স্পেক্টিভে' যাচাই করে তবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ধরুন রেচেল হেহো ফ্লিন্ট, মহিলা ক্রিকেটের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। একদিকে যেমন মহিলা ক্রিকেটের হয়ে তাঁর অদম্য যুদ্ধকে সেলাম ঠুকেছে এই বই, পাশাপাশি স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতির প্রতি কিঞ্চিৎ নরম ছিলেন রেচেল - "a reminder that no human is perfect"; অভিষেক মুখুজ্জের এই আক্ষেপের মধ্যেই এই বইয়ের আদত গুণ লুকিয়ে আছে।
এই বইয়ে একশোটা অধ্যায়, প্রতিটা অধ্যায় শুরু হচ্ছে একটা কোটেশন দিয়ে। প্রতিটা কোটেশনের মধ্যে প্রায় একটা উপন্যাসের সম্ভাবনা আছে বোধ হয়। আর সে'খানেই এই বইয়ের ফরম্যাটটা 'সুপারহিট' হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা পাঠক হিসেবে সে কোটেশন পড়ে বোঝার উপায় নেই যে ঠিক কী নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে এই কোটেশন বলা হয়েছে। অথচ এমন দুর্দান্ত ভাবে সে কোটেশন গোড়ায় দেওয়া রয়েছে যে একটা "টুক করে পড়ে না ফেললেই নয়" গোছের একটা অনুভূতি টের না পেয়ে উপায় নেই। আবারও বলি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ কোটেশনগুলোয় যথেষ্ট পলিটিকাল মশলা রয়েছে। একটা কথা শেষে না জুড়লেই নয়। এই ফরম্যাটের মধ্যেই একটা মারাত্মক সমস্যাও রয়েছে। অন্তত চল্লিশটা চ্যাপ্টারে মনে হতে পারে "এ বাবা, মাত্র এতটুকু? কত তলিয়ে দেখার সুযোগ ছিলো, গল্পটাকে কতটা ফলাও করে বলে একদম ছক্কা হাঁকানোর সুযোগ ছিলো; অথচ লেখক স্রেফ ছোট প্রবন্ধ লেখার মেজাজে ব্যাপারটায় ইতি টেনে দিলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরক্তই হয়েছি বললে ভুল হবে না। কিন্তু ভুলে গেল চলবে না যে এত কাটছাঁট করেও এ বই সাড়ে চারশো পাতার। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস হয়তো সাড়ে ছ'শো হলে ভালো হতো। তবে ছাপার ব্যাপারে অনেক কিছু ভাবতে হয় হয়তো। তা'ছাড়া আমি নিশ্চিত অনেক পাঠকের জন্য আবার এই মুচমুচে ব্যাপারটা বেশ উপকারী। (একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা; দুম করে বেয়াল্লিশ নম্বর চ্যাপ্টার দিয়ে এ বই শুরু করলে আপনি অকূলপাথারে পড়বেন না। সম্ভবত এই ফরম্যাটের সে'টা একটা বড় গুণ। বেয়াল্লিশের পর সাতান্নয় গিয়ে তারপর একে ফিরে গেলেও বিন্দুমাত্র অসুবিধে হবে না বোধ হয়। তবে আমি অনুরোধ করবো প্লীজ ওই কাজটি করবেন না। এক থেকে শুরু করে একশোয় পৌঁছন। সেঞ্চুরি উপভোগ করুন। তারপর যদি ইচ্ছে হয় কখনো সাত কখনো সতেরো করে বার বার এই বইয়ে ফেরত যেতেই পারেন)
এ বই পড়লে "ক্রিকেটে"র ব্যাপ্তি ব্যাপারটা খানিকটা ছুঁয়ে দেখা যায়। আর সবচেয়ে মোক্ষম যে ব্যাপার হবে, বেশির ভাগ চ্যাপ্টার শেষ করে আপনি শশব্যস্ত হয়ে ইন্টারনেট ঘাঁটা শুরু করবেন। আমাদের হুল্লোড়বাজ ক্রিকেট দেখা মগজের আড়ালে রয়ে যাওয়া মতি নন্দী লেভেলের কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র খুঁজে পেয়ে আহ্লাদিত হবেন। আর নির্ঘাত কিছু নতুন বইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবেন। শুরুতে আক্ষেপ করেছিলাম আমার বিশেষ পড়াশোনা নেই তাই বইয়ের ফর্দ দিতে অক্ষম। আপনার ক্রিকেট বইয়ের ফর্দের অভাব দূর হবে এ বই কিনলে; বইয়ের শেষে এগারো পাতা জুড়ে অভিষেক ক্রিকেট বইয়ের লিস্ট দিয়েছেন। হাতে গোনা কয়েকটা তার মধ্যে আমার পড়া। বেশিরভাগ সবই না-পড়া বাকি কিন্তু সে'গুলো আমি গুগল করে দেখলাম মাঝে কয়েক'দিন। ওই ন্যাশনাল লাইব্রেরীর আর্কাইভ ঘেঁটে নামানো দাঁত ভাঙা বইয়ের রেফারেন্স না, বেশির ভাগই রসালো টানটান সব বইয়ের খোঁজ।