Thursday, December 4, 2025

এক টুকরো বাড়ি ও বাড়িফেরা


কবে কোন কালে, ফুলিয়ায়, হাইওয়ে ঘেঁষা একটা জরাজীর্ণ হোটেলে বসে এই চাউমিন খেয়েছিলাম। যদ্দূর মনে পড়ে লাঞ্চ করা হয়নি সময়মত, পেটে আগুন খিদে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এই এগ-চাউমিন মুখে দিয়ে যে কী অপার তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আমার নাকে সে চাউমিনের গন্ধ এখনও লেগে আছে। মাঝরাতে বম্বের এই ফ্ল্যাটে বসে, এদ্দিন পরেও দিব্যি সে বিকেলের স্বস্তি অনুভব করতে পারছি।

পুরনো ছবিগুলো দেখি আর এ'রকম কত পুরনো গন্ধ নাকে এসে ঠেকে (আমি বোধ অলফ্যাক্টরি গোত্রের মানুষ)। বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হয়। পলিটিক্স ছাড়া সত্যিই বোধ হয় কিছু হয় না। "আমি এপলিটিকাল" সে কথার মধ্যেও মারাত্মক রাজনীতি লুকিয়ে আছে। তবু কেন জানি না ভাবতে ইচ্ছে করে যে বাড়ি ফিরতে চাওয়ার মধ্যে পলিটিক্স নেই।

বাড়ি ফেরা কী? তার উত্তর জানা থাকলে বর্তে যেতাম। মাঝেমধ্যে হাজার ঝড়ঝাপটার মধ্যে অফিসে নিজের চেনা (এবং অগোছালো) কিউবিকেলটাও স্বস্তি দেয়। সে'টার মধ্যে কি সামান্য বাড়িত্বও নেই? নির্ঘাৎ আছে। ইয়ারদোস্ত বললে "দেখা কর রে রাস্কেল", তার মধ্যেও বাড়ির গন্ধ। ভালো বই। প্রিয় গান। ছবির অ্যালবাম। বেশ খানিকটা কলকাতা। কতরকমের গন্ধ, কত রকমের টান।

একজন মানুষ প্রাণপণে বাড়ি ফিরতে চাইছে, প্রতিটা মুহূর্ত সে ফন্দি এঁটে চলেছে, ছক কষে চলেছে। প্রতিদিন বেশ কয়েকবার মন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে "এইত্তো বাড়ি", আবার তারপরই হাজারবার মনে হচ্ছে "ফেরাটেরা আর হচ্ছে না ওস্তাদ"। বহুবছর আগের সে এক ফুলিয়ার ধাবার প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিলে বসে চাউমিন খেতে খেতে দেখেছিলাম সন্ধে হচ্ছে। আজ সে ছবি দেখছি আর ভাবছি "ফেরাটেরা হচ্ছে না ওস্তাদ, হচ্ছে না"। কী অদ্ভুত, কী বিশ্রী, কী সুন্দর।

জব ওয়েল ডান


বড়সাহেব ভেবেচিন্তে আড়াই ঘণ্টার কাজ দিলেন।

মেনি জানে সে কাজ আড়াই মিনিটের। তবু লিঙ্কডইন এক্সেলেন্সের কথা মাথায় রেখে সে এক মস্ত পাওয়ারপয়েন্ট বানিয়ে প্রমাণ করলে যে এ কাজ অন্তত আড়াই দিনের।

বড়সাহেব নিজের "কেমন দিলাম" স্মিত হাসিটা মুখে ভাসিয়ে তুলে ঘোষণা করলেন যে "নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে না শিখলে রিয়েল প্রগ্রেস সম্ভবপর নয়। অতএব আড়াইদিনের কাজ আধবেলায় করে ফেলতেই হবে। ডু অর ডাই"।

অতএব মেনিশ্রেষ্ঠ আড়াই মিনিটের কাজ ঠেলেঠুলে সতেরো মিনিটে শেষ করে আধবেলা অফিসঘুম দিলে। তারপর মাছের ঝোল ভাতের ঢিপিতে টেনে নেওয়ার আগে কেল্লাফতে ইমেল পাঠিয়ে মিচকি হাসলে।

ও'দিকে বড়সাহেব মিচকিতর হাসি হেসে তস্যবড়সাহেবকে ফোন করে বললেন, "দেখলেন স্যর, কী ভাবে আড়াই মাসের কাজ আমি আধবেলায় করিয়ে নিলাম"?

মুচকি হাসি


মাস ছয়েক বসে থাকার পর একটা ছোটোখাটো চাকরি পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেলে সঞ্জয়। বার্ড অ্যান্ড বার্কিন কোম্পানির আগের চাকরিটা স্টেটাস-মাইনে সব দিক থেকেই ভালো ছিলো, আচমকা সে'টা চলে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই সামান্য দমে গিয়েছিলো। নেহাৎ ব্যাচেলর মানুষ, তাই অকূলদরিয়ায় পড়ে নাকানিচোবানি অবস্থা ঠিক হয়নি। তবু খেটে খাওয়া সৎ কর্মীর বছর দশেক পুরনো চাকরিও যে এত ঠুনকো, সে'টা টের পেয়ে সঞ্জয়ের মনের ভিতরটা বড্ড তিতকুটে হয়ে গেছিল।

নটরাজন স মিলের ক্লার্ক হিসেবে শেষ পর্যন্ত চাকরি জোটাতে পেরে যে অনুভূতিটা প্রবল ভাবে হচ্ছে সে'টাকে ঠিক বাঁধভাঙ্গা আনন্দ বলা যায় না। বরং একটা প্রবল স্বস্তি বোধ টের পাচ্ছে সে। এ চাকরিও যে সহজেই চলে যেতে পারে, সে'টাও সে ধরে রেখেছে। তা'তে বেশ একটা বেপরোয়া মনোভাবও তৈরি হয়েছে।

সঞ্জয়ের একার সংসার তবে সে বেহিসেবী নয়। এসআইপি পিপিএফ মিলে তার সেভিংস ব্যাপারটা মোটের ওপর সুবিধেজনক জায়গায় আছে সে কথা বলাই যায়। ছ'মাস বসে খেয়েও সে জমানো টাকা তলানিতে এসে ঠেকেনি। নটরাজন মিলের ফোনটা পেয়ে আজ নিজেকে বেশ চ্যাম্পিয়ন মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা হাস্যকর কী? কে জানে। পিসতুতো দাদা অতুল বেশ নাক সিঁটকে বললে এ'সব পেটি জবে কোনো ফিউচার নেই। সঞ্জয় জানে যে তার বায়োডেটাতেও একটা বিশ্রী দাগ পড়ে গেছে।

পড়ুক গে। হোক পেটি জব। তবু তো একটা চাকরি। এসআইপিটা মাস ছয়েক বন্ধ ছিলো। আবার শুরু হবে। আগের চেয়ে অনেক কম টাকার হয়তো, হোক গে। ছ'মাস হন্যে হয়ে চাকরির জন্য দিবারাত্রি টইটই করে ঘুরেছে, ক্লান্তি গ্রাস করেছে, মনে হয়েছে গোটা শহরটাই যেন আস্ত একটা অন্ধকারের টুকরো। তবে সে অবস্থাতেও সঞ্জয়কে কারুর কাছে হাত পাততে হয়নি। ইলেক্ট্রিক বিল জলের বিল বাকি পড়েনি। ইলিশ বাদ গেছে কিন্তু তেলাপিয়া চারাপোনা পোল্ট্রির ডিম পাতে এসেছে নিয়মিত। অতুলদার ছেলের জন্মদিন ছিল গতমাসে; ভুতোকে চমৎকার কিছু বই কিনে দিয়েছিল সঞ্জয়। বইগুলো কিনে ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিল সে, ভুতোকে সে বেশ ভালোবাসে।

এই দুরমুশ হয় না যাওয়টা, সে'টা জিতে যাওয়া নয়?
এই ধান্দাবাজ অর্থনীতির চাকরিবাজারের অস্থিরতাকে নিজের জীবনের শেষ কথাটা বলতে না দেওয়াটা, সে'টা জিতে যাওয়া নয়?

সঞ্জয় আজ চেয়েছিলো এই ছোট্ট চাকরিটাকে সেলিব্রেট করতে। বহুদিন পর মাংসের দোকানে গেছিল। রান্নাঘরে অনেকক্ষণ সময়ও কাটালে আজ সকালে। এ'টা ঠিক বিজয়োল্লাস নয়, সঞ্জয়ের মতে আজকের খাওয়াদাওয়াটার শিরোনাম হলো "মুচকি হাসি"।

কট ইয়াপ্পিং



সহজ এক লাইনে নিজের ভালো লাগা বলে দিতেই পারি। অভিষেক মুখার্জির 'কট ইয়াপ্পিং - আ হিস্ট্রি অফ ক্রিকেট ইন ১০০ কোটস' একটা অতি জবরদস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ বই। ক্রিকেট সম্বন্ধে আগ্রহী হলে, ইতিহাস ভালোবাসলে আর জমাটি পুজোসংখ্যার অভাব বোধ করলে এ বই নিশ্চিন্তে অর্ডার করে ফেলতে পারেন। কিন্তু স্রেফ সে'কথাটা বলার জন্য লিখতে বসিনি।

ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে বইয়ের অভাব নেই। আমার নিজের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে কম নয়তো বুক ফুলিয়ে একটা ফর্দ তুলে দিতাম এখানে। তবে নিজে অল্প পড়েছি বলে কথাও অল্প বলবো; আজকালকার যুগে সে সততা হাস্যকর-ভাবে অচল। সাধারণত পাঠক ক্রিকেট ইতিহাস বিষয়ক যে বইগুলো হাতে তুলে নেবেন, সে'গুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট ফোকাস বেছে নিয়ে এগোয়। এই যেমন রামচন্দ্র গুহর 'আ কর্নার অফ আ ক্রিকেট ফিল্ড' ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে লেখা, পিটার অবর্নের 'উন্ডেড টাইগার' পাকিস্তান ক্রিকেটের ওপর লেখা 'এপিক', নিকোলাস ব্রুকসের 'অ্যান আইল্যান্ডস ইলেভেন' রয়েছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ওপর আর টীম অলবোনের 'আউট অফ দ্য অ্যাশেস' লেখা হয়েছে আফগানদের হুজুগে ক্রিকেট নিয়ে। আবার ধরুন জ্যারড কিম্বারের একটা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে আলাদা করে বই লিখেছেন, সে বইটা রাম গুহর বইয়ের চেয়ে অনেক পাতলা কিন্তু বিষয়ের দিক থেকে ব্যাপ্তি অনেক বেশি। পরিসর যত চওড়া হবে, সে গল্প সাজিয়ে-গুছিয়ে, সঠিক পরিমাপে, সত্যনিষ্ঠ ভাবে, জমজমাট স্টাইলে লেখা ততটাই কঠিন। মানে ধরুন, পার্ক স্ট্রিটের ইতিহাস লেখার চেয়ে কলকাতার পথঘাটের ইতিহাস লেখা অনেক বেশি জটিল। আর গোটা "কলিকাতার ইতিহাস" নিয়ে ভাবতে বসলে মাথার স্ক্রু-পেরেক সব টপাটপ খুলে পড়ার কথা। পাঠক হিসেবে আমরা বলতেই পারি, "কই, কত সহজে তো পূর্ণেন্দুবাবু 'কলকাতার ইতিকথা'য় দারুণ ভাবে শহরের গোটা ইতিহাসটা রসিয়ে লিখে গেছেন"। বইটা আমার অন্যতম প্রিয় বই কিন্তু নিশ্চিন্তে বলা যায় ও'টা কলকাতার সামগ্রিক ইতিহাস নয়। মোগল-ইংরেজ রাজা-রাজড়াদের টানা পোড়েনে কী'ভাবে কয়েকটা গাঁ মিলেমিশে একটা পেল্লায় শহর তৈরি হলো সে গল্প একটা চমৎকার ব্যাপার বটে। কিন্তু কলকাতার ইতিহাসে কলকাতার মানুষজনের পোশাক, খাদ্য, প্রতিবাদ, গান-বাজনা, ধর্ম- আরো কত কী থাকার কথা। এত কিছু গুঁজে দিতে হলে পূর্ণেন্দুবাবুর বইটা স্রেফ গোল্লায় যেত, পাঠক হিসেবে আমরাও সে বই দেখলে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মাতব্বরি ঢঙে বলতাম "ও'সব বই ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে থাকার কথা, আমার বইয়ের তাকে আবার কেন"। মোদ্দা কথা হলো, বিষয়ের পরিসর যত চওড়া হবে, সে বইয়ের ব্যাপ্তিকে সামাল দিয়ে সুপাঠ্য করে তোলাটা একটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। অভিষেক মুখুজ্জের 'কট ইয়াপ্পিং' সে জটিল কাজটা দুর্দান্ত ভাবে (এবং সুরসিক স্টাইলে) করেছে।

"দিস ইজ ক্রিকেট" বলতে আর পাঁচটা সাধারণ ক্রিকেট-ভালোবাসিয়ে যা যা বুঝবে, সেই সমস্ত উপাদান এ বইতে ঠাঁই পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। ব্যাট, বল, রান, বিলেত, লর্ডস, টেস্ট, সেঞ্চুরি, উইকেট, আন্ডারআর্ম, গ্রেস, ব্র্যাডম্যান, বাউন্সার, রঞ্জি, এমসিসি, আইসিসি, প্যাকার, বিশ্বকাপ, ইত্যাদি আর যা কিছু ভাবতে পারেন আর কী। পাশাপাশি যোগ হয়েছে এমন সব এলিমেন্ট, যে'গুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, "তাই তো, ক্রিকেট মানে তো এই ব্যাপারগুলোও বটে"। আমার মতে, সে'খানেই এই বই জরুরী। অভিষেক মুখার্জি তথ্য-নিষ্ঠ, ক্রিকেট-পাগল, সাহিত্য-রসিক, সুলেখক; এ'গুলো কোনও নতুন কথা নয়। আপনি যদি ওঁর লেখা আগে নাও পড়ে থাকেন, ওঁর লেখা দু'চারটে প্রবন্ধ পড়লেই আপনি নিশ্চিন্ত হবেন যে আমি অকারণ বাড়িয়ে বলছি না। তবে এই গুণগুলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জার্নালিজমে হয়তো বিরল নয়। অভিষেকের কলমের মারাত্মকভাবে ধারালো কারণ ভদ্রলোক মারাত্মকভাবে রাজনৈতিক এবং প্রবলভাবে আধুনিক। বইটা ইনফরমেশনে ঠাসা, সেই ১১৮০ থেকে গল্প শুরু হয়েছে যে'খানে এক জোসেফ সাহেব লিখছেন "youths at cricks did play"। এরপর শুধুমাত্র যাচাই করা তথ্যের ওপর ভর করে ওঁর লেখা এগিয়েছে সাড়ে চারশো পাতা; অথচ আর পাঁচটা 'বেস্ট সেলার নভেলের' মতই এ বইয়ের পাঠকরাও তরতরিয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য। এর একটা বড় কারণ এই যে ওঁর লেখায় উল্লেখিত তথ্য ও ঘটনাগুলোকে কোনোভাবেই 'পলিটিকালি স্যানিটাইজ' করে নেওয়া হয়নি। সে'দিক থেকে এ বই যতটা ক্রিকেটের, তার চেয়েও বেশি ইতিহাসের। অ্যামেচার বনাম প্রফেশনাল, অ্যাপারথেড, বেসিল ডি'অলিভেরা, ভারত-পাকিস্তানের প্রতি বিলেতের অবহেলা; এসব প্রসঙ্গ ক্রিকেট ইতিহাস লিখতে গেলে উঠে আসবেই। কিন্তু এই বই দু'কদম বাড়তি এগিয়েছে অন্যভাবে। প্রতিটা চরিত্র ও ঘটনাকে অভিষেক ঠাণ্ডা মাথায় 'লিবেরাল পার্স্পেক্টিভে' যাচাই করে তবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ধরুন রেচেল হেহো ফ্লিন্ট, মহিলা ক্রিকেটের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। একদিকে যেমন মহিলা ক্রিকেটের হয়ে তাঁর অদম্য যুদ্ধকে সেলাম ঠুকেছে এই বই, পাশাপাশি স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতির প্রতি কিঞ্চিৎ নরম ছিলেন রেচেল - "a reminder that no human is perfect"; অভিষেক মুখুজ্জের এই আক্ষেপের মধ্যেই এই বইয়ের আদত গুণ লুকিয়ে আছে।

এই বইয়ে একশোটা অধ্যায়, প্রতিটা অধ্যায় শুরু হচ্ছে একটা কোটেশন দিয়ে। প্রতিটা কোটেশনের মধ্যে প্রায় একটা উপন্যাসের সম্ভাবনা আছে বোধ হয়। আর সে'খানেই এই বইয়ের ফরম্যাটটা 'সুপারহিট' হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা পাঠক হিসেবে সে কোটেশন পড়ে বোঝার উপায় নেই যে ঠিক কী নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে এই কোটেশন বলা হয়েছে। অথচ এমন দুর্দান্ত ভাবে সে কোটেশন গোড়ায় দেওয়া রয়েছে যে একটা "টুক করে পড়ে না ফেললেই নয়" গোছের একটা অনুভূতি টের না পেয়ে উপায় নেই। আবারও বলি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ কোটেশনগুলোয় যথেষ্ট পলিটিকাল মশলা রয়েছে। একটা কথা শেষে না জুড়লেই নয়। এই ফরম্যাটের মধ্যেই একটা মারাত্মক সমস্যাও রয়েছে। অন্তত চল্লিশটা চ্যাপ্টারে মনে হতে পারে "এ বাবা, মাত্র এতটুকু? কত তলিয়ে দেখার সুযোগ ছিলো, গল্পটাকে কতটা ফলাও করে বলে একদম ছক্কা হাঁকানোর সুযোগ ছিলো; অথচ লেখক স্রেফ ছোট প্রবন্ধ লেখার মেজাজে ব্যাপারটায় ইতি টেনে দিলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরক্তই হয়েছি বললে ভুল হবে না। কিন্তু ভুলে গেল চলবে না যে এত কাটছাঁট করেও এ বই সাড়ে চারশো পাতার। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস হয়তো সাড়ে ছ'শো হলে ভালো হতো। তবে ছাপার ব্যাপারে অনেক কিছু ভাবতে হয় হয়তো। তা'ছাড়া আমি নিশ্চিত অনেক পাঠকের জন্য আবার এই মুচমুচে ব্যাপারটা বেশ উপকারী। (একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা; দুম করে বেয়াল্লিশ নম্বর চ্যাপ্টার দিয়ে এ বই শুরু করলে আপনি অকূলপাথারে পড়বেন না। সম্ভবত এই ফরম্যাটের সে'টা একটা বড় গুণ। বেয়াল্লিশের পর সাতান্নয় গিয়ে তারপর একে ফিরে গেলেও বিন্দুমাত্র অসুবিধে হবে না বোধ হয়। তবে আমি অনুরোধ করবো প্লীজ ওই কাজটি করবেন না। এক থেকে শুরু করে একশোয় পৌঁছন। সেঞ্চুরি উপভোগ করুন। তারপর যদি ইচ্ছে হয় কখনো সাত কখনো সতেরো করে বার বার এই বইয়ে ফেরত যেতেই পারেন)

এ বই পড়লে "ক্রিকেটে"র ব্যাপ্তি ব্যাপারটা খানিকটা ছুঁয়ে দেখা যায়। আর সবচেয়ে মোক্ষম যে ব্যাপার হবে, বেশির ভাগ চ্যাপ্টার শেষ করে আপনি শশব্যস্ত হয়ে ইন্টারনেট ঘাঁটা শুরু করবেন। আমাদের হুল্লোড়বাজ ক্রিকেট দেখা মগজের আড়ালে রয়ে যাওয়া মতি নন্দী লেভেলের কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র খুঁজে পেয়ে আহ্লাদিত হবেন। আর নির্ঘাত কিছু নতুন বইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবেন। শুরুতে আক্ষেপ করেছিলাম আমার বিশেষ পড়াশোনা নেই তাই বইয়ের ফর্দ দিতে অক্ষম। আপনার ক্রিকেট বইয়ের ফর্দের অভাব দূর হবে এ বই কিনলে; বইয়ের শেষে এগারো পাতা জুড়ে অভিষেক ক্রিকেট বইয়ের লিস্ট দিয়েছেন। হাতে গোনা কয়েকটা তার মধ্যে আমার পড়া। বেশিরভাগ সবই না-পড়া বাকি কিন্তু সে'গুলো আমি গুগল করে দেখলাম মাঝে কয়েক'দিন। ওই ন্যাশনাল লাইব্রেরীর আর্কাইভ ঘেঁটে নামানো দাঁত ভাঙা বইয়ের রেফারেন্স না, বেশির ভাগই রসালো টানটান সব বইয়ের খোঁজ।

ধৈর্য্য


ডিম পাউরুটি যিনি বানাচ্ছেন, তাঁকে অযথা তাড়া দিয়ে ব্যস্ত করবেন না প্লীজ। বাস-ট্রেন মিস হওয়ার ভয় থাকল হয় ডিমরুটির লোভ ত্যাগ করুন নয়তো পরের ট্রেন কখন আছে সে খোঁজ নিন। যদি কাস্টোমাইজ করাতে হয়, যত্ন করে প্রথমেই বুঝিয়ে দিন। বার বার ঘ্যানঘ্যান করলে ভালো ডিমরুটি স্পেশ্যালিস্টের পারফরম্যান্স পড়ে যায়। আর তাঁর হাত কাঁচা হয়, তা'হলে শত ইন্সট্রাকশনেও কিছু হওয়ার নয়।

মোট কথা অপেক্ষা করুন, অবজার্ভ করুন। ভুললে চলবে না; আপনার ধৈর্য্যও ডিমরুটির একটি জরুরী উপকরণ।


বদখতিয়

বদখত মানুষেরা প্রাণখোলা আড্ডা না দিয়ে সবসময় জটিল-কুটিল প্ল্যান আঁটবে, এ ভাবনা ভারি ক্লাসিস্ট। তাঁদের আড্ডাতেও নিষ্পাপ গুল থাকবে, পিলে চমকানো হাসি থাকবে, "আরে এখনই উঠছিস কেন, আর একটু বস" থাকবে। মাঝেমধ্যে সে আড্ডা রাত পেরিয়ে ভোর পর্যন্ত গিয়ে "ফের কবে যে আবার দ্যাখা হবে...কে জানে" মার্কা দীর্ঘশ্বাসে মিশে যাবে।

বদখত মানুষের মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ বিষাক্ত সব প্ল্যান কিলবিল করবে, এ ধারণাও ভারী অযৌক্তিক। মাঝেমধ্যেই তাঁদের মাথার মধ্যে "এ'দিকে এসো দ্যাখো ভাইটি, অরেঞ্জ আইসক্রিম এনেছি" মার্কা ডায়লগ অ্যালবাট্রসের মত ডানা মেলে উড়বে। দু'টো খারাপ কাজের মধ্যিখানে তাঁরা টুক করে ভেবে নেবেন "আগামীকাল ক্যাসুয়াল লীভ নিয়ে শুধু কমিক্স পড়বো"। খামখেয়াল-হীনতা তাঁর শেষ পরিচয় হতে পারে না।

কী জানো ভাইটি, বদখত ব্যানারটাই শেষ কথা নয়। সে ব্যানার ঝুলছে যে দেওয়ালের গায়ে সে দেওয়ালটার নাম মানুষ। হাজার বদখতামো দিয়েও এই বিটকেল মানুষেমি ব্যাপারটা মুছে দেওয়া সম্ভব নয়।

ট্রাম্প দর্শন

আজকাল ট্রাম্পের মত ভাবার চেষ্টা করছি। সেই ঘ্যামটা আয়ত্ত করতে পারা সহজ নয়। তবে চেষ্টা ছাড়লে চলবে না।

এই যেমন কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে সোজাসুজি বলে দেওয়ার চেষ্টা করছি যে "তুই ভুল, তোর বাবা ভুল , তোর জ্যামিতির বাক্স ভুল, তোর ভাতের পাতে ভুল"। টুকরো টুকরো অবান্তর আক্রমণগুলো কেউ কাউন্ট রজারের গুপ্তধনের সঙ্কেত গোছের কিছু ভেবে সাজিয়ে গুছিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে গেলে আরো উঁচু গলায় বলতে হবে "শুনছি লখনৌয়ের ভুলভুলাইয়া তোর কাছে টিউশনি পড়তো এক কালে"?

নিপাট এলেবেলে কেউ নিশ্চিন্তে ভাতঘুম দিচ্ছে দেখলেই তার নামে নিন্দে করছি। তার গ্যাঁটের বা গলার জোর যদি আমার চেয়ে কম হয় তা'হলে তার গায়ে পড়ে "এই তোর গায়ে এত ময়লা" বলে হল্লা করছি। ব্যাপারটায় দেখছি মারাত্মক তৃপ্তি।

সবচেয়ে বড় কথা মোটাকে ভোঁতকা, খোড়াকে ল্যাংচা বা গোবেচারাকে 'আস্ত পাঁঠা' গোছের যে কথাগুলো আগে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে চাপা গলায় বলতাম, সে'গুলো এখন বুক বাজিয়ে আঙুল নাচিয়ে বলছি। যত বলছি তত দেখছি কনফিডেন্সের পারদ হুহু বেগে উপরের দিকে ছুটছে। শুধু তাই নয়, আর পাঁচটা ইয়ারদোস্তও জুটে যাচ্ছে যারা পিঠ চাপড়ে বলছে "এইত্তো চাই, হাউ ব্রেভ"।

কেউ একটা সে'দিন বাড়ি এসে মিনিট দশেক বিস্তর গপ্প ফাঁদলে। মতলব হলো গরীব ছেলেমেয়েদের শিক্ষাফিক্ষার জন্য চাঁদা চাইতে। গাছহারামি মাল। দু'টো নকুলদানা খাইয়ে বললাম "মহাপ্রসাদ, বিশটাকা প্রণামি ছাড়ুন দেখি। ফ্রিতে প্রসাদ সাঁটাতে নেই"। কুড়িটি টাকা দিয়ে পত্রপাঠ বিদেয় হলে, শিগগিরই আর আমার ড্রয়িংরুমে তাকে দেখতে হবে বলে মনে হয়না।

মোট কথা ট্রাম্প-দর্শন আত্মবিশ্বাসে বেশ জমকালো পালিশ এনে দিয়েছে। ভাবছি এ'বার লিঙ্কডইনে মন দেবো। এইসব হাইক্লাস লীডারশিপ মার্কা আত্মোপলব্ধি সে'খানকার মার্কেট খাবে ভালো।

খাবারদাবারের গপ্পগুজব


খাবারদাবার নিয়ে আমাদের আদেখলাপনার পিছনে যেমন আহ্লাদ বা ক্ষেত্রবিশেষে দম্ভ রয়েছে; তেমনি আছে অবসাদ, মনখারাপ, স্নেহ, আকুতি কিংবা ভালোবাসার গল্প।

"এই দ্যাখো আমি গোটাদিনের যাবতীয় ভুলভ্রান্তি বকাঝকা টেনশন উড়িয়ে দিয়ে গেরস্তালির হিসেবনিকেশ হেলায় সামাল দিচ্ছি"; এমনটা বলে তো আর সিংহনাদ করা যায় না। বাধ্য হয়ে বলতে হয় "যা ফ্যান্টাস্টিক ফুলুরি ভেজেছি না...এক্কেবারে মার্ভেলাস"।

"কত কী করার ছিল হে, কিস্যুই হলো না", সে কথা বলে বারবার নাকিকান্না জুড়লে চলবে কেন? বলতে হবে "আরে কড়াপাকের সন্দেশ দুনিয়ায় থাকতে আমি কারুর তোয়াক্কা কেন করবো"! সবাই তো আর কবি নয় প্রেমভালোবাসার অঙ্ক দেখলেই পদ্যের ক্যালকুলেটর খুলে লিলি বোস লিখে সবাইকে চমকে দেবে। তাকে চাপা দু:সাহস নিয়ে বলতে হবে, "ভুজঙ্গদার সেঁকা ভুট্টায় যে কী ম্যাজিক আছে, না খেলে অ্যাপ্রিশিয়েট করা যাবে না। আর তার ওপর একটা লঙ্কাগুঁড়ো মেশানো লবন যা ছড়িয়ে দেয় মাপা হাতে। সে গুরুদেব ব্যাপার বুঝলে..."।

অথচ।
ফুলুরি বিজ্ঞান বুঝে কি কেউ দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলেছে?
কড়াপাকের সন্দেশ নিয়ে লিখে কে কবে কেল্লাফতে করেছে?
ভুজঙ্গদা কী এমন হরিদাস পাল আর কে কবে ভুট্টা দিয়ে রাজ্যজয় করেছে?

বলাই বাহুল্য যে সে সমস্ত আস্ফালনই দ্যাখনাই। কিন্তু সাবধানে ঢেকে রাখা "আহা উঁহু ওহো"গুলো, যে'গুলো স্রেফ ভাষা ও মেধার অভাবে বুকের মধ্যে দলাপাকানো অবস্থায় নষ্ট হচ্ছিল, তারাই সেজেগুজে বেরিয়ে আসে খাবারের আলোচনা হয়ে। যতবার মানুষ খাবার নিয়ে হ্যাহ্যা করে মোটাদাগের গপ্প ফাঁদে, ততবার সে প্রমেথিউসকে অগোচরেই "থ্যাঙ্কিউ স্যার" বলে। কাজেই খাবার বিষয়ক কোনো হইহইই ব্যর্থ নয়।

নোট:
১। আজ যথারীতি বম্বের একঘেয়ে বৃষ্টিতে জেরবার ও মুগ্ধ হয়েছি।
২। ছিল রাস্তাঘেঁষা দোকানের কয়লার গনগনে আঁচ এবং ঝলসানো মুর্গি।
৩। রুমালিও যে ছিল সে'টা বলার দরকার নেই।

ভজন ও রাজকন্যা


কাঠমিস্ত্রি হিসেবে ভজনের সুনাম রাজ্যের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল একসময়। বিশেষত আরামকেদারা আর পালঙ্ক বানানোর ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ভজনের বয়স বড়জোর চব্বিশ অথচ তাঁর হাতের কাজের প্রশংসা রাজার কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছিলো। ভজনের বানানো আরামকেদারা আর পালঙ্ক নাকি দেব-ভোগ্য ব্যাপার। কিন্তু রাজার কান তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, তাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকে রাজার গোলমেলে মেজাজ। অতএব সেই সুনামই ভজনের কাল হলো। একদিন রাজা ঠিক করলেন যে ভজনের বানানো পালঙ্ক রাজকন্যাকে উপহার দেবেন। কথা মত ভজনের কর্মশালায় রাজার 'অর্ডার' পৌঁছে গেলো, বড় টাকা দিয়ে বায়নাও করা হলো। রাজার অর্ডার বলে কথা, এমন এক পালঙ্ক যাতে রাজকুমারী ঘুমোবেন। কাঠ সংগ্রহের কাজে অন্যকে ভরসা না করে নিজেই কুড়ুল কাঁধে জঙ্গলে গেলো ভজন। চারটে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে কাঠ এলো। ছেনি-হাতুড়ি ইত্যাদি সরঞ্জাম প্রস্তুত। শুভদিন দেখে কাজে হাত দিলেই হয়। এমন সময়; ভয়ানক ঝড়বৃষ্টিতে ভজনের কর্মশালার চালাঘর ভেঙেচুরে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। ভিজে কাঠ দিয়ে কাজ শুরু করা চলে না। এ'দিকে মাসখানেক সে বৃষ্টি থামলো না, সূর্যের মুখও দেখা গেলো না। ও'দিকে রাজরাজড়াদের অত বুঝদার হলে চলে না, পালঙ্কের কাজ শুরু না হওয়ায় রাজামশাই রেগে ফায়্যার হয়ে রাজপুরোহিতকে বললেন, "ওই ব্যাটাচ্ছেলেকে আমি কোতল করতে পারতাম। কিন্তু তার চেয়েও বড় কোনও শাস্তি দিতে চাই। ওর গলা কেটে হাত পা ভেঙে আমি শান্তি পাবো না। রাজকন্যার জন্মদিনে ও খাট আমার উপহার দেওয়ার কথা। এখন কোনও স্বর্ণকারকে দিয়ে পাতি সোনারূপোর খাট বানিয়ে বেচারিকে আমার তুষ্ট করতে হবে। যাক গে, রাজপুরোহিত, তুমি ব্যাটাচ্ছেলে ভজনকে এমন জম্পেশ একটা অভিশাপ দাও যাতে ওর মৃত্যুর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হয়"। আর রাজপুরোহিতেরও বলিহারি। তাঁর কাজই হলো ওই, রাজার স্বপ্ন অ্যানালাইজ করে আগডুম বাগডুম বলা অথবা এলেবেলে মানুষকে অভিশাপ দিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলা।

রাজপুরোহিতের অভিশাপে ভজন কাঠের কাজ গেল এক্কেবারে ভুলে। সে বেচারি একলা কাজ-পাগলা মানুষ। কাঠের কাজই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। সেই কাঠের কাজের তপস্যা ভুলে যাওয়ায় সে কেমন খ্যাপাটে হয়ে গেলো। ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিলো। মাঝেমধ্যে নিজের ছেনি-হাতুড়ি ধরে দেখতে গেলেই হাতে জ্বালা অনুভব করতো। জমিয়ে রাখা কাঠের দিকে চোখ পড়লেই শিউরে উঠতে হত। অসহ্য যন্ত্রণায় দিন কাটছিলো। ক্রমশ মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎটুকুও বন্ধ করে দিলো। সে ভুলে গেল কাঠের কাজের স্মৃতি, পালঙ্ক তৈরির কথা। রাজার অর্ডার আর রাজপুরোহিতের অভিশাপ, সবই মনের মধ্যে থেকে হারিয়ে গেলো। দু'দলা সেদ্ধ-ভাত কোনোদিন খেত, কোনোদিন খেত না। এমন সময় একদিন দুপুরবেলা, যখন সে তাঁর খাটের পাশের জানালায় থুতনি রেখে বসেছিল, তাঁর আলাপ হলো কনিয়ার সঙ্গে। কনিয়া একটি চড়ুইপাখি। সে নিজেই সেধে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে আলাপ জমিয়েছিলো। ভজনের ধারণা ছিলো চড়ুইপাখিরা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, এবং তাঁদের কিচিরমিচিরের মানেও মানুষ ধরতে পারে না। কী অদ্ভুত, কনিয়ার সঙ্গে আলাপ জমাতে ভজনের কোনও অসুবিধেই হলো না। ভজনের মনে হলো তাঁরা মাথাটা গেছে হয়তো, নইলে কিনা সে পাখির সঙ্গে গল্প জুড়তে পারে? কিন্তু কনিয়া এমন সদালাপী, সে'সব বাজে ভাবনাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না সে। অনেকদিন পর এই কনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পেরে যে বুকের মধ্যে সামান্য বল পেলো ভজন। এইভাবে মাসদুই কত গল্প চললো, কনিয়ার প্রশ্ন শেষ হতেই চায় না। পাশাপাশি ভজনের গল্পও শেষ হতে চায় না যেন। গল্পে গল্পে কী'ভাবে যেন ভজনের ঘায়ে মলম পড়া শুরু হলো। হঠাৎ একদিন টের পেলো যে আশেপাশে পড়ে থাকা কাঠের টুকরোর দিকে তাকিয়ে সে আর শিউরে উঠছে না। এ'ভাবেই হঠাৎ একদিন সে কনিয়াকে বলে উঠলো, "জানো কনিয়া, আমি এককালে এ রাজ্যের সেরা কাঠমিস্ত্রি ছিলাম। আর...আর...আর সে কাজ বোধহয় আমি একদম ভুলে যাইনি"। সে কথা শুনে কনিয়ার সে কী ডানা-ঝাপটানো আনন্দ।

দিন কয়েকের মাথায় ফের কাজে বসলে ভজন। রাজকন্যার পালঙ্কটা এ'বারে বানিয়ে না ফেললেই নয়। সন্ধে পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকে ভজন, গোটা ঘর জুড়ে টুকুর টুকুর ঠুকঠাক দুমদাম শব্দ; সে শব্দগুলোকে গানের মত এসে ঠেকে ভজনের কানে। আর সেই গানে নিজের কিচিরমিচির দিয়ে তাল মেলায় কনিয়া। তিন হপ্তার মাথায় একদিন; অপরূপ সে পালঙ্কে শেষ পালিশ চালিয়ে জানালার দিকে তাকাতে ভজন টের পেলে কনিয়া আর নেই, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আবার সে আসবে আলো ফুটলে। কিন্তু কী আশ্চর্য, পরের দিন সকাল হলো, সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যে। কনিয়া আর এলে না। ফিরে পাওয়া আনন্দ ফের ম্লান হয়ে গেল যেন, মুষড়ে পড়লে ভজন। দিনের হপ্তা গেল, কনিয়া কই?

হপ্তাখানেক পর, দুপুর নাগাদ। কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে হতবাক ভজন। সামনে যে অপার্থিব সুন্দরি দাঁড়িয়ে, তাঁর রূপের বাহার আর পোশাক-আভরণের জেল্লা দেখলে বোঝাই যায় এ নিশ্চয়ই এ রাজ্যের রাজকন্যা।
শশব্যস্ত হয়ে নুইয়ে দাঁড়ালে ভজন।
"আমার পালঙ্ক তো তৈরি, তবু আমায় ডাকলে না কেন"?
"আপনি...আপনি কী করে জানলেন এ পালঙ্ক তৈরি"?
"আমি যে কনিয়া। তোমার কনিয়া। আমার বাবার বিশ্রী খামখেয়ালের বশে রাজপুরোহিতে তোমায় অভিশাপ দিলে। দেবতা সে অভিশাপ ঠেকাতে পারেনি কিন্তু ব্যাপারটা ভালো চোখেও দেখেনি। দেবতা বাবা ও রাজপুরোহিতকে শায়েস্তা করতে আমায় চড়ুইপাখি বানিয়ে দিলে। এও বললে যে ভজনকে কাজে ফেরাতে না পারলে আমার মুক্তি নেই"।
"ওহ..."।
"অভিশাপ মিথ্যে হওয়া বড় সহজ কথা নয়। আমি ততদিন তোমায় কাজের দিকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি যতদিন শুধু নিজের মুক্তি কথা ভেবেছি। পেরেছি...তখনই পেরেছি...যখন...।
"যখন"?
"যখন আমি তোমায় ভালোবেসেছি, ভজন। মন দিয়ে ভালোবেসেছি, তাই তোমায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। এ'বার এ পালঙ্ক আমায় দাও, আর আমার ভালোবাসাটুকু নাও"।
"রাজকুমারী, এ পালঙ্ক আপনার জন্যই। আপনার ভৃত্যদের পাঠিয়ে দেবেন, এ পালঙ্ক তাঁরা রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবে"।
"কিন্তু আমি তো পালঙ্কের জন্য আসিনি ভজন..."।
"আপনি আসুন রাজকন্যা, আর আমায় আপনি ক্ষমা করবেন"।
"কিন্তু ভজন..."।
"আপনি রাজকন্যা, মহীয়সী। ইয়ে, সমস্যাটা হলো, আপনি যে আমার কনিয়া নন"।

রাজকুমারী বিদায় নিলে সদর দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্তে একটা আরামকেদারা ঘষামাজার কাজে মন দিলেন ভজন।
***
(ছবি: জেমিনাইতে বানানো)

সুবিমল সান্যালের বেড়াল

"এর নাম হলো শ্রীমান রুমাল", হাড়-জ্বালানো আহ্লাদি সুরে জানালেন সুবিমল। পোষা বেড়ালটা ভদ্রলোকের কোলে জাঁকিয়ে বসে, ঘাড়ে আঙুল-বোলানি মৌজ করে উপভোগ করার পাশাপাশি আমার দিকে মারাত্মক সন্দেহের চোখে তাকিয়ে। বেড়াল নিয়ে আদেখলামো আমার মোটে সহ্য হয় না, কিন্তু বড় কষ্ট করে সুবিমল সান্যালের ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। লেখক হিসেবে ভদ্রলোকের আজকাল বেশ নামডাক। ওর সাম্প্রতিক নভেলটা বাংলার পাঠকমহলে বেশ সাড়াও ফেলেছে। কিন্তু বাজারে খবর হলো লেখার হাতটি সরেস হলেও ভদ্রলোক সামান্য ছিঁটগ্রস্ত। একা মানুষ অথচ নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে। এই খিটমিট করছেন তো পরক্ষণেই দিলদরিয়া। অমুক সম্পাদক বা তমুক সাংবাদিককে বাড়িতে ডেকে "একটু বসুন, আমি ভিতরের ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে আসি" বলে উঠে গিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে; লুঙ্গিফতুয়া গায়ে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে পাঞ্জাব মেলে বসে পড়েছেন। এ'ছাড়াও নানাবিধ অদ্ভুতুড়ে গল্পগাছা ভদ্রলোককে নিয়ে বাজারে ছড়িয়ে আছে। অতএব এহেন মানুষের আদরের বিড়ালের প্রতি বিরক্তির ছায়াটা কিছুতেই মুখের ওপর পড়তে দেওয়া চলে না। আমি এ লাইনে নতুন, সুবিমল সান্যালের একটা ইন্টারভিউ আমায় বেশ ভালো একটা পুশ দেবে।

"জানেন তো, বেশিরভাগ গপ্পের প্লটগুলো এই রুমালই আমায় ধরিয়ে দেয়", দরাজ হাসলেন সুবিমল। পরিস্থিতি ঘোরালো, মিনিট দশেক গল্প হল অথচ বেড়ালের গপ্পের বাইরে আনা যায়নি ভদ্রলোককে। "প্লট রুমালই ধরিয়ে দেয়" প্রসঙ্গে সামান্য হোঁচট খেতে হলো।
"মানে, আপনি বলতে চাইছেন যে আপনার পোষা বেড়াল শ্রীমান রুমালের সঙ্গে গল্প করার সময় আপনার মাথায় বিভিন্ন গল্পের প্লট আসে"?
" না না। রুমাল নিজেই আমায় সে সব গল্প সাজিয়ে গুছিয়ে বলে। এইটুকু মাথায় যে কী করে এ'সব জটিল মনস্তাত্ত্বিক নভেলের প্লট দাঁড় করায়। ভেরি ইম্প্রেসিভ। রুমাল না থাকলে সুবিমল সান্যালকে আপনারা চিনতেনই না"।
"আপনি বোধ হয় এই সাক্ষাৎকারটাকে সিরিয়াসলি নিতে পারছেন না"।
"সে কী। ষোলোআনা সিরিয়াস"।
"রুমাল আপনার সঙ্গে কথা বলে"?
স্মিত হাসলেন সুবিমল।

হাসিটায় গোলমেলে অথচ মোলায়েম একটা ব্যাপার ছিল। মাথায় সামান্য ঝিম লাগলো, আমি যেন আর সুবিমলের সামনের সোফায় বসে নেই।প্রবল অস্বস্তি নিয়ে টের পেলাম বেশ নরম আদরে মোড়া পরিস্থিতিতে শুয়ে আছি। কেউ ঘাড়ে বড় সুমিষ্টভাবে মালিশ করে দিচ্ছে, দু' আঙুলের ডগায় সে কী ম্যাজিক। চোখ বুজে আসছে যেন। বুকের ভিতরটা সামান্য ছ্যাঁত করে উঠলো, আমি সুবিমলের কোলে শুয়ে। আমার উল্টো দিকের সোফায় আবছায়ার মধ্যে যে মানুষটা বসে আছে সে আমার চেনা, অবিকল আমার চেহারা যে। কিন্তু সেই আমির মুখ দিয়ে কথার বদলে শুধুই ম্যাঁও ও মিউ বেরোচ্ছে।

স্পষ্ট দেখলাম সুবিমল সান্যাল মাথা নামিয়ে আমার নতুন চোখ জোড়ার দিকে চেয়ে বললেন, "সাংবাদিক মশাই, এ'বার ক'দিন আপনার বাস আমার পোষ্য হয়ে। আপনার লেখার হাত যে ভালো, আমি সে খবর নিয়েছি। এ'বার দু'তিনটে জমকালো প্লট গুছিয়ে আমায় বলতে পারলে তবেই আপনার ওই ভদ্রলোকী শরীরে ফিরে যাওয়া। কেমন? টের পাবেন বেড়ালের জিভ ঠেলে কী সুন্দর বাংলা কথা বের করে আনা সম্ভব। আগে যান, ওই দেখুন ঘুরের কোণে এক বাটি দুধ রাখা আছে, খেয়ে আসুন। তারপর প্লট নিয়ে গল্প হবে"।

এই বলে আমায় মেঝেতে নামিয়ে দিলেন সুবিমল সান্যাল।

রিউতিসিউ

"তখনও আলোর ও সময়ের জন্ম হয়নি। সময়ের যেহেতু জন্ম হয়নি সেহেতু 'তখনও' কথাটা বলা ঠিক হলো কিনা জানি না। মুম্ফাসাইরসের মানুষরাও এ সম্বন্ধে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারবে না, যদিও এ রূপকথা তাদেরই। তখন ছিলো বলতে শুধু হেকেথা; আদিম নিষ্প্রাণ পৃথিবী। হেকেথার বুকের মধ্যিখানে রয়েছে সিতেগস নামের নিস্তরঙ্গ সমুদ্র। মুম্ফাসাইরসি ভাষায় সিতেগস মানে অশ্রু। বিষণ্ণতার ভার বইতে না পেরে সিতেগসের বুক চিরে অবশেষে জন্ম নেয় স্রিয় আর তিরা; আলো আর সময়। হেকেথার চিরবিষন্ন অবিচলতা ছিন্ন হলো, নেমে এলো অস্থিরতা বা স্নেম।

স্রিয় আর তিরার সন্তান ওয়েব্বেজা, আকাশ; মুম্ফাসাইরসিদের প্রথম ঈশ্বর। ওয়েব্বেজা সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আর সেই গোলমাল বাঁচিয় হইহল্লা এড়িয়ে সিতেগসকে বুকের আড়ালে রেখে দিলে হেকেথা। আদিম আদরের এই অনুভূতি-সমুদ্রকে তো আর ময়লা হতে দেওয়া যায় না। সিতেগসকে মনে রাখলে শুধু হেকেথা, স্রিয়, তিরা ও ওয়েব্বেজা।

প্রতি দশ হাজার বছরে একবার স্রিয় ও তিরা সিতেগসের সৈকতে এসে বসে। এ সাগর আজও নিস্তরঙ্গ, বিষন্নতায় অবিচল। ওয়েব্বেজা তাদের সকলকে জড়িয়ে রাখে। স্রিয়-তিরার এই দশহাজারি 'ডেট'য়ের জন্য সারা বছর সুরাসংগ্রহে ব্যস্ত থাকে ওয়েব্বেজা। সে সুরার নাম ভিসিতেগসো; মানুষের কান্না। স্রেফ সেই ভিসিতেগসো সংগ্রহের জন্য যত আয়োজন, যত উৎসব। হ্রুই অর্থাত মেঘ, রিউতিসিউ অর্থাৎ বৃষ্টি, ঘ্রঙসং অর্থাৎ বজ্রপাত। আর অতি অবশ্যই রয়েছে ত্যিউ, অর্থাৎ মানুষ"।

এদ্দূর একটানা বলে ডাক্তার ঢকঢক করে অর্ধেক গেলাস জল সাবাড় করলেন। মনুবাবু ড্যাবাড্যাবা চোখে গল্প শুনছিলেন, ডাক্তার এমন হাত পা নেড়ে গালগল্প ফাঁদেন যে চোখের ভিজে ভাব উবে যেতে বাধ্য। জলের গেলাস নামিয়ে রেখে পকেট থেকে ধবধবে সাদা ইস্তিরি করা রুমাল বের করে ঠোঁট এবং গোঁফ মুছলেন ডাক্তার।

"কাজেই যা বলছিলাম মনু, বৃষ্টিতে একা থাকলেই যে কান্না-কান্না বাইটা তুমি অনুভব করো, সে'টা এলেবেলে নয়"।

"আমার চোখের জল ঈশ্বরের ওয়াইন"?

"মাইন্ড ইউ, ধান্দাবাজি চোখের জল হলে চলবে না। অন্তর থেকে উঠে আসা বেদনা চাই। পিওর কোয়ালিটি গ্রীফ ছাড়া ও জিনিস তৈরি হয় না। আরে বাবা আলো ও সময়ের ওয়াইন, তা'তে কি আর ভেজাল চলে"!

"ডাক্তার, তোমার গপ্প শুনে বড্ড স্নেম অনুভব করছি"।

"কী অনুভব করছো"?

"ওই যে। স্নেম। মুম্ফাসাইরসি ভাষায় যে'টা হলো গিয়ে অস্থিরতা"।

"রাইট রাইট। তোমার মত হাইকোয়ালিটি শ্রোতা আছে তাই এ'সব অমূল্য গপ্প মাঝেমধ্যে ঝুলি থেকে বের করি"।

"এ দু:খ ফেলনা নয়, তাই না ডাক্তার"?

"সিতেগস থেকে আমরা সবাই বেরিয়েছি যে মনু। নিখাদ দু:খ যে'টুকু যা আছে বুকের মধ্যে, সে'টুকুই আসল। বাকি সমস্তই ওয়েব্বেজার ছেলেমানুষি খেলনাবাটি আর কী"।

প্রাণখোলা একট হাসি ভেসে উঠলো মনুবাবুর মুখে। কিন্তু চোখ ফের ভিজে। বাইরে বৃষ্টি ফের শুরু হয়েছে। মনু্বাবু অস্ফুটে বলে উঠলেন, "রিউতিসিউ"।

"তোমার চা পাতার কৌটোটা খালি নেই আশা করি" বলে ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলেন হেঁসেলের দিকে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন মনুবাবু।

জানালার বাইরে সন্ধের গুমড়ে ওঠা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনু বিড়বিড় করে বললেন, "ডাক্তার শালা বড় ফেরেব্বাজ, বড় আপন"।

সমঝদার ও ফেরেব্বাজ


সাদামাটা সমস্যাগুলোকে পেল্লায় প্রমাণ করতে গিয়ে আমরা এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে জীবনের আদত জটিলতাগুলো নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করা হয়না। অদরকারী ব্যাপারস্যাপারে গা ভাসিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে আর এ'দিকে জীবনের দরকারি বিষয়গুলোকে ধামাচাপা দেওয়াটাকে আমরা প্রায় আর্টের পর্যায় নিয়ে গেছি। কিন্তু গা বাঁচিয়ে এ'ভাবে আর কদ্দিন চলবে?

অতএব আজ আমি বাদামসমস্যাটার কথা বলি। রোজ অফিস ফেরতা বি-কে-সি থেকে বেরিয়ে ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়েতে উঠি বান্দ্রার কাছে। সন্ধে মানেই বিশ্রী ট্র্যাফিক জ্যাম। তবে মাঝেরহাটের ব্রিজভাঙা বেহালায় স্টিয়ারিং ঠেলেছি বেশ কয়েক বছর, ও'সব জ্যামফ্যামকে আমি পাত্তা দিইনা। অডিওবুক, গান ইত্যাদির জমানায় রাস্তায় ভিড় তো না; লক্ষ্মী। তা, বান্দ্রা এলাকা ছাড়িয়ে অল্প এগোলে ভিড় আরও জমাট হয়। আর এক্সপ্রেসওয়ে সান্তাক্রুজের মুখে পড়তেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাদামওলা এগিয়ে আসেন (বৃষ্টি তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না, বম্বের স্পিরিট ইত্যাদি)। কাগজে মোড়ানো 'প্যাকেট', দশ টাকার ও কুড়িটাকার ইউনিটে। আমি নিয়ম করে দশের দু'প্যাকেট কিনি। ওই একটাই আ্মার নিয়মিত নন-ডিজিটাল খরচ। যা হোক, টুকটুক করে বাদাম খেতে খেতে এগোনো। প্রতিটা দানা হিসেব করে খাই, এককুচি বাদামও এ'দিন ও'দিক হওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিটা মুচুরমুচ মন দিয়ে শুনি এবং অনুভব করি। দু'নম্বর প্যাকেট শেষ হওয়া মানে এয়ারপোর্ট অঞ্চল পেরিয়ে গেছি। একদম অঙ্কের হিসেব। আর সে অঙ্ককে অবহেলা করেই বিশ্রী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো। ভারী অস্বস্তিকর।

গোলমালের সূত্রপাত বাদামদাদাদের দু'টো দশের বদলে একটা কুড়ির প্যাকেট গছাতে যাওয়ায়। কী মুস্কিল, রোজই সেই এক ঘ্যানঘ্যান। আমার দশেরদু'প্যাকেট নিতে ভালো লাগে। এক প্যাকেট শেষ করে বেশ জল-চুমুকের ইন্টারভ্যাল নিয়ে পরের প্যাকেট খোলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা আমি নিশ্চিত ছিলাম দু'টো দশের প্যাকেটে বাদামের পরিমাণ নিশ্চয়ই একটা কুড়ির প্যাকেটের চেয়ে বেশি। তেমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু ওই, মানুষের মন ভারী বিষাক্ত; সন্দেহে ভরা। অতএব পরিমাণ ব্যাপারটা ঝালিয়ে না দেখলে চলছিল না। স্রেফ জ্ঞানার্জনের জন্য দু'টো দশ আর একটা কুড়ি প্যাকেট কিনলাম। দু'টো একই রকম কাচের গেলাসে ঢাললাম। এবং, অবাক হলাম। একটা কুড়ির প্যাকেটে বাদামের পরিমাণ দু'টো দশের কোয়ান্টিটির চেয়ে অন্তত ১০% বেশি। পৃথিবীটা দুলে উঠলো; আফটার অল আমি মানুষ।

গোলমালটা বয়েলিং পয়েন্টে পৌঁছে গেলে যখন আজ পঞ্চাশ টাকার নোট আর পুরনো খদ্দের দেখে বাদামদাদা পঞ্চাশে তিনটে কুড়ির ঠোঙা অফার করলে। বাজিয়ে দেখলাম, কিন্তু পঞ্চাশে ছ'টা দশ টাকার প্যাকেট দিতে কিছুতেই রাজী হলে না। ঘায়েল হতেই হলো। নিলাম আজ পঞ্চাশে তিনটে কুড়ির প্যাকেট। তিন দিনের বাদামের হিল্লে হয়ে গেলো, প্লাস সামান্য বাড়তি বাদাম। আজকালকার ডেঁপো ছেলেমেয়েরা বলবে "টোটাল উইন"। যুক্তি বলবে "বাহ, ভাই তন্ময়, এই তো চাই"। অঙ্ক বলবে "ব্রেভো বন্ধু। সাবাশ"। কারণ অজস্র ঠোঙা বাদাম-কিনিয়ের কাছে সবটুকুই তো ছকে বাঁধা, হিসেব এ'দিক ও'দিক হওয়ার উপায় নেই।

দিব্যি স্টিফেন ফ্রাইয়ের কণ্ঠে ইলিয়াডের গল্প শুনতে শুনতে স্টিয়ারিং হাতে আল্ট্রা ঢিমেতালে এগোচ্ছিলাম। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দুটো দশের প্যাকেট শেষ হয়। আজ যখন এয়ারপোর্টের বোর্ড দেখলাম তখন বুকের ভিতরটা ছ্যাঁকা খেলো যেন। হা ঈশ্বর, আমার হাতে তখন অর্ধেক উড়ে যাওয়া তিন নম্বর কুড়ি টাকার বাদামের প্যাকেট। কোথায় যুক্তি, কোথায় অঙ্ক। ভুলে গেছিলাম যে বাদাম-কিনিয়ে মহশয় অতিশয় সমঝদার কিন্তু বাদাম-খাইয়ে বাবাজী মহাফেরেব্বাজ।

সাজানো হিসেব শুকিয়ে গেলো। কাল থেকে আবার নতুন ভাবে ব্যূহ-রচনা।