Skip to main content

জগন্নাথবাবুর ফিরে আসা

দড়ির ডগার আগুনে সিগারেটটা ধরিয়ে আগে বুক ভরে শ্বাস নিলেন জগন্নাথবাবু। পানওলার ফেরত দেওয়া খুচরো বুক পকেটে রাখতে গিয়ে টের পেলেন ট্রেনে কেনা আদা লজেন্স এক পিস তখনও রয়ে গিয়েছে। মিনুর বড় প্রিয়। মারা যাওয়ার পর থেকে এই অসুবিধে হয়েছে। মিনুর প্রিয় কোন কিছু দেখলেই চোখ বেয়ে হুড়মুড় করে জল নেমে আসে।

আজ পাঁচ নম্বর বছর পূর্ণ হল। ফাইভ ইয়ার্স। কদ্দিন। মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে এ ক’দিনে। গ্র্যাজুয়েট হতে চলল নিশ্চই। ভাগ্যিস বছরে একটা দিন অন্তত দেখা হয় মিনুর সাথে। মেয়েটাকে কম ঝক্কি পোয়াতে হয় না এখানে একা আসতে। বাড়িতে নিশ্চিয়ই কম মিথ্যে বলতে হয় না বেচারিকে, এমন দুম করে বেরোতে। অথচ ঠিক এ জায়গা ছাড়া দেখা হওয়ার উপায়ও থাকে না। ঠিক এই জায়গায়। নিখিলের পানের দোকানের পাশে। ঠিক বিকেল পাঁচটা বেজে বত্রিশ মিনিটে। যখন বাসটার নিচে যেতে হয়েছিল আর কী। ঠিক এমনভাবেই সিগারেট ধরিয়ে পকেটে আদা লজেন্সের অনুভব নিয়ে রাস্তা পেরোবার জন্য এগিয়েছিলেন। শীতকাল অন্যমনস্ক হওয়ার আদর্শ সময় বোধ হয়।তা বলে বাসটা অমন হুড়মুড় করে গায়ের ওপর এসে পড়বে সেটা ভাবতে পারেননি জগন্নাথবাবু। এক্কেবারে বিশ্রী কাণ্ড।
পরের বছর থেকে মিনুর সাথে ঠিক এই সময়, এইখানে একটি বার করে দেখা হয়। কী ভাবে যেন ঠিক এই সময়টা মিনুর চামড়ার চোখে ধরা দিতে পারেন জগন্নাথ আর তার জন্যে যে তাঁর কী ভীষণ আনন্দ। অল্প কথাও হয়। লজেন্সটা এত বছর ধরে পকেটে রয়ে গেছে, মিনুকে দেওয়া হয়ে ওঠে না।

-   বাবা?
-   এসেছিস মা?আমি ভাবলাম...।
-   আসব না?
-   না মানে...।
-   বছরে একটা বার...দেখা করতে আসব না?
-   মিনু। পড়াশোনা কেমন চলছে?
-   পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরোলো। ফার্স্ট ক্লাস।
-   ফার্স্ট ক্লাস? দারুণ! দারুণ!
-   মা কেমন আছে রে?
-   ভালো না। কাঁদে। প্রায়ই। তাই বলে তুমি এখন কেঁদো না।
-   ভূতের আবার কান্না। মা রে, মিনুমা রে! কাঁদিস না মা। এটুকুর দেখা। কাঁদিস না।
-   ভূতের মেয়ে আবার কান্না।
-   হে হে হে।
-   হে হে।
-   লজেন্স খাবি?

ক্রমশ আবছা হয়ে মিলিয়ে গেলেন জগন্নাথবাবু।

***

-   গিন্নীমা। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। গিন্নীমা। গিন্নীমা!
-   হুঁ?
-   ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে।
-   ওহ। এসে গেছে?
-   আজ্ঞে।
-   এ বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হবে, না রে কানাই?
-   চলেন গিন্নীমা। অন্ধকার হয়ে এল।
-   পঁচিশ বছর আগে বিয়ে করে এসেছিলাম রে।
-   মনে আছে। চলেন।
-   এ বাড়ি জুড়ে কত স্মৃতি রে কানাই। বাড়ি ছাড়লে স্মৃতি ছাড়া যায়?
-   চলেন।
-   যেতে হবেই। এখানে থাকব কী করে রে? বাপ বাসের তলায় মরলে তো মরলে, সেদিনই পোড়ামুখীর গলায় দড়ি দিতে হল। মায়ের কথা একবারটির জন্যেও ভাবলে না মিনু হতচ্ছাড়ি। গোটাদিন বাড়ি জুড়ে তার দুরন্তপনা, কথায় কথায় মিথ্যে বলা আর দুষ্টুমি। আর ওদিকে বাপমেয়ের মিলেমিশে কত আদিখ্যেতা। ওঁদের এ সমস্ত স্মৃতি ভাসিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে যাব কোথায় রে কানাই?
-   ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে মা। চলেন। চলেন।  

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু