Saturday, January 23, 2016

স্নান খাওয়া

জমিতে কান পেতে শুয়েছিলাম। নরম জমি ম্যাজম্যাজ করছিল। শীত কি একটু কম? উষ্ণতা জমি বাওয়া জলের পূর্বাভাস।  

এদিকে  বুকে অল্প ধড়ফড়। বড় দুর্বল বোধ হয়। হবে নাই বা কেন। দেহে পুষ্টি নেই যে। কদ্দিন ভালো কিছু পেটে পড়েনি। কদ্দিন। জমি ছাপিয়ে জল না উঠলে উপায়ও নেই কিছু। জলে জমি ভাসলে খাদ্যফলন হয়, গায়ে গত্তি লাগে। 

বুকে বড় ধড়ফড়। বড় কষ্ট। বড় হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়। অর্ধেক নিকেশ হয়েছে, আমরা ক'জন ঘাড় বাঁকানো জেদ বয়ে পড়ে আছি। যদি জমি বেয়ে জল উঠে আসে। 

কদ্দিন স্নান করা হয়নি। জল নেই যে। জল নেই। গায়ে ময়লা, কুটকুট, বমিভাব, চুলে জট। বড় মলিন সমস্তটুকু। শুধু আমার না। সক্কলের। যারা বেঁচে আছে; সক্কলের এক দশা। 

জমিতে কান পেতে ঠায় শুয়ে। জল উপচে উঠে আসার মিহি শব্দ আর কম্পন অনুভূত হয়, যারা চেনে তারা রন্ধ্রে সে আগমনী অনুভব করতে পারে। পারা যায়। 

বাতাসের উষ্ণতার ওজন বেড়ে চলেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে। আজ ভাসাবেই। জমি নরম হয়ে আসবে। খাওয়ার পড়বে পেটে। আমার। ভাগ্নের। আর আমাদের সাথে যারা যারা বেঁচে আছে সক্কলের। তারপর স্নান। 

আচ্ছা, আগে স্নান করে তারপর খাওয়া উচিত, তাই না? বেশ পরিষ্কার হয়ে, ছিমছাম মেজাজে বাবু হয়ে পাত পেড়ে খেতে বসা। সেই ভালো, তাই না? অবিশ্যি এতদিনে জমানো খিদে...স্নানের অপেক্ষা সইবে? দু'মুঠো মুখে দিয়ে বরং গা মাথা ভিজিয়ে নেওয়া যাবে। অবিশ্যি যে উপচে আসা জলেরও রকম ফের আছে। জল কখনও নোনতা কম, তাতে চান ভালো হয়, কিন্তু খাওয়ারের ফলন কমে। আবার কখনও জল ভরপুর নোনতা, প্রচুর খাওয়ার কিন্তু স্নান করে দিল খুশ হয় না; গায়ে খরখর ভাব রয়ে যায়। 
একেক সময় একেক রকম জল আসে জমি বেয়ে। কিন্তু আসে। খেয়ে নাইয়ে কেটে যায়। কিন্তু এবারের মত এমন ভয়ানক সময় বহুদিন আসেনি। জমি খটখটে হয়ে পড়ে রয়েছে কদ্দিন। কদ্দিন। হাজারে হাজারে মারা গেল। বেঘোরে, না খেয়ে , না নাইয়ে। যে ক'জন বেঁচে রয়েছি, তাঁদেরও হালত নড়বড়ে। জমি বেয়ে জল না এলেই নয়। নয়। 

- "মামা, ও মামা!", ভাগ্নের ডাকে ভাবনাটা ছিঁড়ে গেল। 
- "গলা নামিয়ে, গলা নামিয়ে, শুনতে দে"। 
- " মামা গো, জল আসছে?"। 
- "মনে তো হচ্ছে, তবে বেশি আশা করিস নে"। 
- "আর যে পারা যায় না মামা"। 
- "আজ আসবে। আসবে রে আসবে"। 
- "আসবে মামা?"
- "বিলকুল আসবে, বাতাস ভারী হয়ে আসছে টের পাচ্ছিস না? জমি নরম হয়ে আসছে বুঝছিস না?"। 
- "স্নানের জল না খাওয়ার জল মামা?"
- "ভিখিরির আবার স্নান খাওয়া। যেটুকু যা আসবে তাই দিয়েই স্নান খাওয়া সব করতে হবে। অত ভেবে কাজ নেই"। 

** 
কাঁপা হাতে ফোনটা রাখল সুমনা।  শরীরের ভিতরটায় ভীষণ একটা আনচান। আনন্দের ঢেউটাকে বুকের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতে ভয় হচ্ছিল তার। ভীষণ ভয়। 
তবে খবরে ভুল নেই। অনিকেত মারা যায়নি। বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়নি। সাময়িক অ্যামেনেসিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাহাড়ি কোন একটা গ্রামে  পড়েছিল। স্মৃতি ফেরত আসেনি কিন্তু সিক্কিম পুলিস তাকে খুঁজে পেয়েছে। দশ মাস পরে হলেও পেয়েছে। 
ওরা অনিকেতকে ফেরত আনছে। সুমনা একা নয়। একা নয়। 

দশমাসে একটি বারের জন্যে কাঁদতে পারেনি সুমনা। পারেনি। বুকের ভিতর দম বন্ধকরা অস্বস্তি বয়ে বেরিয়েছে। মরে যেতে চেয়েছে কিন্তু পারে নি। মরতে পারেনি। কাঁদতে পারেনি সুমনা। 

ফোনটা রেখে আজ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল সুমনা। হাউহাউ করা কান্না জমিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। নয়। মিলু "কার ফোন ছিল মা?" জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় চোখ ঝাপসা হয়ে গেল সুমনার। 

**
- "সামহালো, সামহালো", চিৎকার করে উঠতেই হল, "জল বেয়ে উঠছে। উঠছে। উঠছে"। 
- "জল আসছে মামা? খাব? নাইব?"। 
- "সমস্ত রে। সমস্ত। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে"। 
- বাঁচলাম গো মামা"। 
- "হ্যাঁ, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। মানুষের চোখের জমি চষে খাওয়া ব্যাকটেরিয়া হয়ে বাঁচা চাট্টিখানি কথা নয় রে। নে খা"। 

No comments: