Skip to main content

স্নান খাওয়া

জমিতে কান পেতে শুয়েছিলাম। নরম জমি ম্যাজম্যাজ করছিল। শীত কি একটু কম? উষ্ণতা জমি বাওয়া জলের পূর্বাভাস।  

এদিকে  বুকে অল্প ধড়ফড়। বড় দুর্বল বোধ হয়। হবে নাই বা কেন। দেহে পুষ্টি নেই যে। কদ্দিন ভালো কিছু পেটে পড়েনি। কদ্দিন। জমি ছাপিয়ে জল না উঠলে উপায়ও নেই কিছু। জলে জমি ভাসলে খাদ্যফলন হয়, গায়ে গত্তি লাগে। 

বুকে বড় ধড়ফড়। বড় কষ্ট। বড় হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়। অর্ধেক নিকেশ হয়েছে, আমরা ক'জন ঘাড় বাঁকানো জেদ বয়ে পড়ে আছি। যদি জমি বেয়ে জল উঠে আসে। 

কদ্দিন স্নান করা হয়নি। জল নেই যে। জল নেই। গায়ে ময়লা, কুটকুট, বমিভাব, চুলে জট। বড় মলিন সমস্তটুকু। শুধু আমার না। সক্কলের। যারা বেঁচে আছে; সক্কলের এক দশা। 

জমিতে কান পেতে ঠায় শুয়ে। জল উপচে উঠে আসার মিহি শব্দ আর কম্পন অনুভূত হয়, যারা চেনে তারা রন্ধ্রে সে আগমনী অনুভব করতে পারে। পারা যায়। 

বাতাসের উষ্ণতার ওজন বেড়ে চলেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে। আজ ভাসাবেই। জমি নরম হয়ে আসবে। খাওয়ার পড়বে পেটে। আমার। ভাগ্নের। আর আমাদের সাথে যারা যারা বেঁচে আছে সক্কলের। তারপর স্নান। 

আচ্ছা, আগে স্নান করে তারপর খাওয়া উচিত, তাই না? বেশ পরিষ্কার হয়ে, ছিমছাম মেজাজে বাবু হয়ে পাত পেড়ে খেতে বসা। সেই ভালো, তাই না? অবিশ্যি এতদিনে জমানো খিদে...স্নানের অপেক্ষা সইবে? দু'মুঠো মুখে দিয়ে বরং গা মাথা ভিজিয়ে নেওয়া যাবে। অবিশ্যি যে উপচে আসা জলেরও রকম ফের আছে। জল কখনও নোনতা কম, তাতে চান ভালো হয়, কিন্তু খাওয়ারের ফলন কমে। আবার কখনও জল ভরপুর নোনতা, প্রচুর খাওয়ার কিন্তু স্নান করে দিল খুশ হয় না; গায়ে খরখর ভাব রয়ে যায়। 
একেক সময় একেক রকম জল আসে জমি বেয়ে। কিন্তু আসে। খেয়ে নাইয়ে কেটে যায়। কিন্তু এবারের মত এমন ভয়ানক সময় বহুদিন আসেনি। জমি খটখটে হয়ে পড়ে রয়েছে কদ্দিন। কদ্দিন। হাজারে হাজারে মারা গেল। বেঘোরে, না খেয়ে , না নাইয়ে। যে ক'জন বেঁচে রয়েছি, তাঁদেরও হালত নড়বড়ে। জমি বেয়ে জল না এলেই নয়। নয়। 

- "মামা, ও মামা!", ভাগ্নের ডাকে ভাবনাটা ছিঁড়ে গেল। 
- "গলা নামিয়ে, গলা নামিয়ে, শুনতে দে"। 
- " মামা গো, জল আসছে?"। 
- "মনে তো হচ্ছে, তবে বেশি আশা করিস নে"। 
- "আর যে পারা যায় না মামা"। 
- "আজ আসবে। আসবে রে আসবে"। 
- "আসবে মামা?"
- "বিলকুল আসবে, বাতাস ভারী হয়ে আসছে টের পাচ্ছিস না? জমি নরম হয়ে আসছে বুঝছিস না?"। 
- "স্নানের জল না খাওয়ার জল মামা?"
- "ভিখিরির আবার স্নান খাওয়া। যেটুকু যা আসবে তাই দিয়েই স্নান খাওয়া সব করতে হবে। অত ভেবে কাজ নেই"। 

** 
কাঁপা হাতে ফোনটা রাখল সুমনা।  শরীরের ভিতরটায় ভীষণ একটা আনচান। আনন্দের ঢেউটাকে বুকের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতে ভয় হচ্ছিল তার। ভীষণ ভয়। 
তবে খবরে ভুল নেই। অনিকেত মারা যায়নি। বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়নি। সাময়িক অ্যামেনেসিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাহাড়ি কোন একটা গ্রামে  পড়েছিল। স্মৃতি ফেরত আসেনি কিন্তু সিক্কিম পুলিস তাকে খুঁজে পেয়েছে। দশ মাস পরে হলেও পেয়েছে। 
ওরা অনিকেতকে ফেরত আনছে। সুমনা একা নয়। একা নয়। 

দশমাসে একটি বারের জন্যে কাঁদতে পারেনি সুমনা। পারেনি। বুকের ভিতর দম বন্ধকরা অস্বস্তি বয়ে বেরিয়েছে। মরে যেতে চেয়েছে কিন্তু পারে নি। মরতে পারেনি। কাঁদতে পারেনি সুমনা। 

ফোনটা রেখে আজ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল সুমনা। হাউহাউ করা কান্না জমিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। নয়। মিলু "কার ফোন ছিল মা?" জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় চোখ ঝাপসা হয়ে গেল সুমনার। 

**
- "সামহালো, সামহালো", চিৎকার করে উঠতেই হল, "জল বেয়ে উঠছে। উঠছে। উঠছে"। 
- "জল আসছে মামা? খাব? নাইব?"। 
- "সমস্ত রে। সমস্ত। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে"। 
- বাঁচলাম গো মামা"। 
- "হ্যাঁ, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। মানুষের চোখের জমি চষে খাওয়া ব্যাকটেরিয়া হয়ে বাঁচা চাট্টিখানি কথা নয় রে। নে খা"। 

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু