Skip to main content

দীপক চ্যাটার্জীর বিকেল


বিকেলটা বড় হতে হতে কমলা হলুদে আকাশ ঢেকে ফেলেছিল। হাওয়ায় অল্প ধুলো,  ভিড়ের গন্ধ, মরা শীত আর মিঠে হইহইয়ের ঘুঙুর।

দীপক চ্যাটার্জীর একটা হাফ লিটারের জলের বোতলে চুমুক দিলেন। শীতটা চলেই গেল। বিকেল দানা বাঁধার সাথে সাথে মেলায় লোক বাড়ছে। বইয়ের বড় স্টলগুলোর ধারে কাছে ঘেঁষা মুশকিল হয়ে উঠছে। ঘড়ি দেখলেন দীপক, এই নিয়ে গত তিন মিনিটে অন্তত সতেরোবার। লিটল ম্যাগাজিনের ওদিকে একবার যাওয়া দরকার; কোন ছোট প্রকাশক অমূল্যদার একটা কবিতার বই ছেপেছে। কোন এক টেবিলের কোন এক কোণে সে বই রাখা; কেনা দরকার। কবিতার জন্য নয়, অমূল্য বসুর জন্য। বেনফিশে একবার যাওয়া কর্তব্য। সাতটা নাগাদ সুমনরা আসবে। তার আগে যেটুকু সময়। দীপকের অবশ্য মেলাটেলা ভালো লাগে না, উনি কলেজ স্ট্রিটের ভক্ত। কিন্তু যার ভালো লাগে সে এখনও এলো না। কুন্তলিকা বিরক্ত হয় দীপকের বইমেলার প্রতি অবজ্ঞায়। কুন্তলিকা সেন জোর দিয়ে বলে থাকেন বইমেলার স্নেহ যে আবিষ্কার করেনি সে হয় অলস বা নয়তো সে বইয়ের চরিত্র সম্যক বোঝে না। সে বলে; গাদাগাদা বই পড়লেই বইকে বেশি ভালোবাসা যায় না; যুক্তি দিয়ে সে বলে গান্ধারীর গায়ে কি যশোদার চেয়ে বেশি মা-মা গন্ধ? 

দীপক এ'সব শুনে হাসেন। কিছু বলেন না। কুন্তলিকার জন্যই তার আলস্য ভেঙে বইমেলায় আসা। প্রতি বছর। হলুদ শাড়ির  কুন্তলিকার মধ্যে অবিকল সঞ্জীবের "দশটি কিশোর উপন্যাস সমগ্র" উঁকি মারে - গায়ে ফুল ফুল ছোপ, নরম সঞ্জীবে আবদার জুড়ে থাকা সমস্তটা। মন ভার করা ভালোবাসা নামে ওর গা দিয়ে, ওর গায়ে মিশে যেতে ইচ্ছে করে প্রচ্ছেদে কিশোর মুখের স্কেচটির মত। বইটার শুরুতে সঞ্জীব লিখেছেন "আমার মা-কে"। দীপক জানেন হলুদ শাড়ি সবুজ ব্লাউজের কুন্তলিকাকে নিয়ে মায়ের গা ঘেঁষে বসে বসে কুইকুই করা যায়। 

কুন্তলিকা সেন বড় হতে হতে দীপক চ্যাটার্জীর আকাশ ঢেকে ফেলেছিল। হাওয়ায় কুন্তলিকার হাসি, ওর ধমকের গন্ধ, মরা ছোটবেলা আর মিঠে ক্রীমের ঝিমঝিমে গন্ধ। 

দীপক চ্যাটার্জীর হাফ লিটারের জলের বোতলে আরেকটা চুমুক দিলেন। এবার ফোন করার সময়।

- এলি না?
- আসার কথা ছিল?
- ছিল না?
- তোর সামনে থাকলে কান মলতাম।
- আচ্ছা।
- তোর কান মলতাম।
- কেন?
- তুই বইমেলায় বই ছেড়ে হাভাতের মত আমার দিকে তাকাতিস বলে।
- ভারি যেন তোর দেখা পাই।
- আমার যেতে ইচ্ছে করছে।
- বাজে কথা।
- সবটাই তো বাজে কথা, না বাবু?
- একা এ মেলা আমার বাজে লাগে রে।
- ছোটবেলা থেকেই লাগত। 
- তোর তো ভালো লাগত!
- তা লাগত।
- তাহলে আয় না।
- কাল আসব।
- আসবি?
- মা কালী। বেগুনী খাওয়াবি?
- আর ফিশ ফ্রাই।
- আমি বইমেলায় ফিশ ফ্রাই খাই না। 
- বড় স্টলে ঢুকব না।
- বেশ। আর তুই হাভাতের মত তাকাবি না?
- তাকাবো না। মা কালী।
- বাবু। আমায় নিয়ে যা। এখুনি।
- সাতটায় সুমনরা আসবে। নয়তো যেতাম।
- যত বাজে কথা।
- আমার ভালো লাগে না কিচ্ছু। এ মেলা কেমন গুমোট।
- আমায় বইমেলায় চুমু খাবি বাবু?
- এবার কে হাভাতে?
- গালে। হালকা চুমু। হাওয়াও টের পাবে না এমন নরম।
- তুই আজকাল বড় অল্পে কেঁদে ফেলিস কিচি।
- তুই বড় মাতব্বর হয়েছিস দীপু। যা ভাগ।

বাজে কথা বড় হতে হতে ঝাপসা চোখ আর কাঁপা গলায় আকাশ ঢেকে ফেলে। বিকেল ছাপিয়ে সন্ধ্যা আসে। আসে কত বছরের ধুলোয় আবছা হয়ে আসা ছেলেবেলা, আসে কত হাজার কিলোমিটারের তফাৎ আর দু'টো গাম্বাট সংসারের ফারাক।

স্নেহ বড় হতে হতে আকাশ সঞ্জীবে ঢেকে ফেলে। একলা-থাকার দল আদরের সুরে আর বইমেলার ঢেউয়ে নরম হয়ে আসে। 

কুন্তলিকা সেন কোনদিন বইমেলায় আসবেন না। বইমেলা ছাড়বেন না দীপক চ্যাটার্জি। একা সঞ্জীব নিরিবিলিতে সমস্ত ব্যথার গল্প হাসির কালিতে নোটবইতে লিখে রাখবেন। সেটুকুই ভরসা।

Comments

debalina said…
Ei lekha ta na likhleo parten...chhotobelar bhalobasa hariye gele buker bhetor bhanga kanch er gunro bhore jay...keno likhlen???

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু