Skip to main content

সুর

জানালা খুলতেই হুহু বেগে হাড়কাঁপানো দমকা হাওয়া এসে নড়িয়ে দিল সুলেমানকে।

সর্দি লাগলে কুছ পরোয়া নেই। কিন্তু এমন কনকনে হাওয়ার ঝাপটাই আজ মন কেমন করে দিচ্ছে। কাঁপাচ্ছে কাঁপাক। খালি গা, তার ওপর বাতাসে আলতো বরফ কুচি উড়ছে। ভেবে নাও সুলেমানের কেমনটি লাগছে। তবু সুলেমান জানালা বন্ধ করলে না। এ দুনিয়ার বরফ বাওয়া হাওয়া; এমন মন ভাসানো হাওয়া আর তো জুটবে না। কাল ফাঁসি।

কোমরে আর পায়ের লোহার শিকল কনকনে ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। কুছ পরোয়া নহি। হাওয়াটুকু আসুক।

হাওয়া। মায়ের গন্ধ মাখা হাওয়া। বাবার নিজের হাতে ভুট্টা ফলানো আদরে চষা রুক্ষ মাটি ছোঁয়া হাওয়া। রাবেয়ার নীল স্কার্ফে আঙুল বোলানো হাওয়া। কদ্দিন এই অন্ধকার ঘরে আটকে সুলেমান। কতদিন। কতদিন। সেই আট বছর বয়স থেকে। "রাজরানী কী বাজে সুরে গান গায় গো" বলে ফেলেছিলে সে। সে কথা শুনেছিলেন বিদূষক। বিদূষক জানান মন্ত্রীকে। মন্ত্রী জানান মহামন্ত্রীকে। মহামন্ত্রী রাজার কানে দেন সে খবর। রাজা পেয়াদা তলব করে ফাটকে পোরেন আট বছরের সুলেমানকে।

"হারামজাদা বলে কী না রানীর গলায় সুর নেই!", কান থেকে তুলোর টুকরো বার করতে করতে বলেন রাজা, "বেওকুফ! কুত্তার অউলাদ! ওকে এমন জায়গায় আটক কর যেখানে কোন মানুষের কণ্ঠস্বর যেন ওর কানে না পৌঁছয়। ও ব্যাটার কান অভিশপ্ত"।

মা কী কান্নাটাই না কাঁদলেন। বাবা পেয়াদার হাতে পায়ে ধরতে গিয়ে মারধোর খেয়ে হাড়গোড় ভাঙলেন। সে কথা ভেবে আজ কিছুটা হাসি পায় পঁচিশ বছরের সুলেমানের। আর হয় অনেকটা কষ্ট। আহা! মায়ের হাতের রুটি আর কলাই সেদ্ধর কী সোয়াদ গো! আজও মনে আছে। আজও।

***
- সুলেমান।
- আজ্ঞে।
- ফরিস্তার ফরমান এসেছে তোমার জন্য।
- ফরিস্তা?
- আমাদের রাজা। দয়ার সাগর। করুণাময় পরমেশ্বর। তিনি তোমার গুস্তাখি মাফ করতে রাজী হয়েছেন। পিতা মাতার কাছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।
- কী বলছেন কোতয়াল সাহেব? সত্যি? ফাঁসি হবে না।
- হবে না। যদি...।
- যদি?
- যদি তুমি স্বীকার কর যে রানীমার কণ্ঠে দেবতার বাস। তার গাওয়া গানই বেহেস্তের সঙ্গীত।
- সতেরো বছরের শব্দহীনতায় কান তো আরও পেকেছে কোতোয়াল সাহেব। নষ্ট হয়নি। আর মৃত্যুর মধ্যে রোজ বাস করেছি। তাহলে বাজে গান কে বাজে গান বলতে আজ আটকাবে কেন?
- তোমায় কুড়ুলের সাত কোপে খুন করে নদীতে ভাসানো হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

***

সুলেমানের সাত নম্বর আর শেষ আর্তনাদটা কানে ভেসে আসতেই নড়েচড়ে বসলেন ঈশ্বর।

"এ কী শুনলাম আমি? এ কী হল! এ কী হল! এত দিন যা জেনেছি সব মিথ্যে। ভুল।
মানুষের পো কী না আমায় সুর শিখিয়ে গেল? যন্ত্রণাছাড়া সুর বাঁধা যাবে না, এমনটা তো আগে ভেবে দেখিনি। নাহ, সঙ্গীতবোধ কে নতুন করে আয়ত্ত করে তারপর দুনিয়াদারির সঙ্গে তাকে বাঁধতে হবে দেখছি"।

ঈশ্বরের চোখে তখন বেহেস্ত ভাসানো অশ্রু আর কণ্ঠে সুলেমানের পুঁতে দেওয়া সরগম।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু