Skip to main content

কবিজন্ম

ভোর ছ'টার ঝমঝমে অ্যালার্মে সচকিত হয়ে ওঠেন শ্রী মধুসূদন মিত্র। আর পাঁচটা দিনের মতই। তারপর কলগেটে দাঁত ব্রাশ করতে করতে ছাতে যাওয়া আর ব্রাশ মুখে নিয়েই সামান্য ফ্রি হ্যান্ড। নিচে নেমে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা আর দু'টো ক্রিমক্র্যাকার বিসকুট খেয়ে তবে তার লিখতে বসা। প্রতিদিন। মধুসূদন মিত্রর লেখার মেহগনি টেবিলটির বয়স এ বাড়ির সমান; অর্থাৎ একশো বছরের চেয়েও বেশি। মধুসূদনের দাদু উকিল ছিলেন, কোর্টের যাবতীয় কাজকর্ম এ টেবিলে বসেই দেখাশোনা করতেন তিনি। মধুসূদনের বাবাও উকিল ছিলেন; তিনিও এ টেবিল সেভাবেই ব্যবহার করে গেছেন। কিন্তু মধুসূদন উকিল হননি। এ টেবিল তিনি ছেলেবেলা থেকে ব্যবহার করে আসছেন কবিতা লেখার জন্য। কবির জীবনে কবিতা ছাড়া যেটুকু; সেটুকুই তো অপ্রয়োজনীয়। সংসারে একে একে সক্কলে মধুসূদনকে রেখে সরে পড়েছেন। কিন্তু এই পেল্লায় বাড়ি, দারোয়ান রামদিন, চাকর উমাপদ আর কবিতা তাকে ছেড়ে যায়নি কোনদিন। এই বাষট্টি বছর বয়েসেও মধুসূদনের জগতটা কবিতায় কবিতাময়। দুনিয়াটা তাকে অবশ্য চিনল না। প্রকাশকেরা ছাপলেন না, লোকে পড়লে না। নিজে খরচ করে বার তিনেক বই ছাপিয়েও সে বই বিক্রি করাতে পারলেন না। ফলত প্রকাশকরা আর তার দিকে ফিরে তাকালেন না। লিটল ম্যাগাজিনের লোকজন তার যৌবনে তার লেখা নিয়ে কম হাসিঠাট্টা করেনি।কিন্তু মধুসূদন দমে যাননি। তিনি দমতে পারে না। কঠিন অনুশীলন আর প্রবল অধ্যবসায়কে ভর করে তিনি ক্রমে নিজেকে কবিতার কারখানায় পরিণত করেছেন। আর্টিস্ট আর্টের জন্য বাঁচবে আর আর্ট রইবে নিজের খেয়ালে। এ বিশ্বাসকে স্পর্শ করতে পেরেছেন মধুসূদন। সকালে চা খেয়ে মধুসূদন লিখতে বসেন বেলা সাতটায়। প্রতিদিন তার জন্য রাখা থাকে একটা নতুন কালো মলাটের ডায়েরি আর তার পাশে নতুন ফাউন্টেন পেন। এ খাতা আর কলম, দুইই সযত্নে অর্ডার দিয়ে বানানো। প্রতিদিন ভোরবেলা একটা করে নতুন খাতা আর একটা নতুন কলম টেবিলে এনে রেখে যায় উমাপদ। প্রতিদিন। উমাপদ বেলা ন'টা নাগাদ মধুসূদনকে জলখাবার বেড়ে দেন। সেই সামান্য বিরতি নিয়ে ফের লেখায় ফিরে আসেন কবি মধুসূদন। এগারোটা নাগাদ নিয়মিত একটা সিগারেট ধরিয়ে থাকেন তিনি। নিয়মিত। এই একটা সিগারেটের ধোঁয়ায় তার বুকের মধ্যে জমে থাকা কবিতারা ট্রাপিজ খেল দেখানেওয়ালাদের মত পাক খেতে খেতে মন বেয়ে ডায়েরীতে নেমে আসে। সিগারেটটা না খেয়ে উপায় থাকে না। তবে ওই, দিনে একটাই। এরপর ফের লেখায় ফিরে যাওয়া। পরের বিরতি বেলা একটায়। এক ঘণ্টার মধ্যে স্নান খাওয়া আর সামান্য বিশ্রাম সেরে ফের কবিতার ডায়েরীতে এসে বসেন মধুসূদন মিত্র। বসার আগে একবার রামদিনকে ডেকে মধুসূদন খোঁজ নেন, "সে কী এসেছে?"। রোজ। বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি। আর প্রত্যেকদিনই রামদিন ঝুঁকে নুইয়ে তাকে আশ্বস্ত করে। এরপর তার ফের কবিতায় ডুব দেওয়া। কবিতার সাগর থেকে উঠে আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে আসে। রোজ। রোজ নতুন কালো মলাটের কবিতার ডায়েরি প্রায় অর্ধেক ভরিয়ে দেন তিনি। মধুসূদন জানেন এই যে ডায়েরীতে কলম ছোঁয়ালেই কবিতার বন্যা বইয়ে দেওয়ার অভ্যাস, সে'টা আসলে একটা জিনিয়াসের লক্ষণ। তবে লেখা ছাপানোর জন্য তদ্বির করা বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি; ওই আর্ট আর্টের জন্যেই, তার কোন ডাইনে বাঁয় নেই। সন্ধ্যে বেলা কবিতা লেখা শেষ করে পেনটা ডাস্টবিনে ফেলে, ডায়েরী বগলদাবা করে সিধে উঠোনে চলে যান মধুসূদন । উঠোনের কোণে বাঁধা পাঁঠাটিকে সম্ভ্রমের সাথে "কেমন আছেন প্রকাশক মশাই?" বলে এগিয়ে যান তিনি। রোজ। প্রতিদিন। পাঁঠাটির কাছে গিয়ে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন খানিক, মাঝে মাঝেই একই প্রশ্ন ঝালিয়ে নেন "কেমন আছেন প্রকাশক মশাই?"। শেষ পর্যন্ত কবিতার ডায়রিটা সম্পূর্ণ ভাবে খাইয়ে দেন পাঁঠাটাকে। রোজ। প্রতিদিন। ডায়রি হজম করে পাঁঠাটি বড় জোর আধ ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট বেঁচে থাকে। বড় জোর। তারপর রামদিন তাকে কাটে, উমাপদ রান্না করে আর কবি মধুসূদন নলি হাড় চোষেন। রোজ রাত্রে কবির পাঁঠা ছাড়া ভাত রোচে না। রোজ। রোজ সকালে রামদিনের নতুন পাঁঠা আনতে যাওয়া, উমাপদর বিষের কালির পেন আর বিষ মাখানো পাতার ডায়েরী আনতে যাওয়া আর কবিতা মাখানো তৃপ্তির ঢেঁকুর নিয়ে মধুসূদনের আড়মোড়া ভাঙা। প্রতিদিন। কবির নিজেকে ফিনিক্স করে অবলীলায় ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। প্রতিদিন। কবির প্রতিশোধ অঙ্ক মেনে হয় না আর সেটাই স্বাভাবিক।

Comments

পাঁঠাকে সম্পাদক নামে সম্বোধিত করে তাকে কবিতা খাওয়ানো অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু বিষাক্ত কালি, রোজ একটা করে পাঁঠাকে নিজের ইগোর হাঁড়িকাঠে বলি: এগুলোই তো ব্যাপারটা ছেতরে দিল|
Kanad said…
জাস্ট অসাধারণ হয়েছে এটা

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু